ডান হাতে গ্রেনেড, বাঁ হাতে রাইফেল। লুঙ্গি পরা, খালি গা, খালি পা আর পেশিবহুল এ ভাস্কর্যটি গাজীপুরের জয়দেবপুর চৌরাস্তার ঠিক মাঝখানে সড়কদ্বীপে অবস্থিত। মুক্তিযুদ্ধের মহান শহীদদের অসামান্য আত্মত্যাগের স্মরণে নির্মিত এ ভাস্কর্যটির নাম 'জাগ্রত চৌরঙ্গী'। মতিঝিলের শাপলা চত্বরের শাপলার ভাস্কর আবদুর রাজ্জাক জাগ্রত চৌরঙ্গী নির্মাণ করেন। এ স্মৃতিসৌধটি ১৯৭৩ সালে নির্মাণ করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নির্মিত এটি প্রথম ভাস্কর্য। ১৯৭১ সালের মার্চ মাস। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের পর পরই পাকিস্তান সরকার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে তাদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে তৎপর হয়।
এরই অংশ হিসেবে ১৯ মার্চ দুপুরে ঢাকা থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একদল সৈন্য পাঁচটি ভ্যানে জয়দেবপুরে অবস্থিত সেনাবাহিনীর ছাউনিতে পেঁৗছে। তারা ছাউনিতে পেঁৗছার পর পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের একটি দলকে নিরস্ত্র করার চেষ্টা করে। ফলে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ব্যাপক সম্মুখযুদ্ধ হয়। ওই যুদ্ধের সংবাদ আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে। মুহূর্তেই স্থানীয় জনগণ জয়দেবপুর শহরে জমায়েত হয় ও তাৎক্ষণিক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বড় বড় গাছের গুঁড়ি ফেলে মুক্তিকামী মানুষ জয়দেবপুর শহরে ঢোকার এবং বের হওয়ার একমাত্র রাস্তাটি বন্ধ করে দেয়। এতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে স্থানীয় জনগণের যুদ্ধ বেধে যায়। একদিকে ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, অন্যদিকে স্থানীয় জয়দেবপুরবাসী। বাধাপ্রাপ্ত হয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। এতে হুরমত আলীসহ কমপক্ষে ২০ মুক্তিকামী মানুষ শহীদ ও ১৬ জন আহত হন। কিন্তু পাকিস্তান সরকার তা অস্বীকার করে। সরকারি হিসাবে তিনজনকে নিহত ও পাঁচজনকে তাদের বিবৃতিতে আহত দেখানো হয়। ওই দিন বিকেল পৌনে ৪টা থেকে ৫টা পর্যন্ত এ প্রতিরোধ যুদ্ধ চলে। এরপর সন্ধ্যা ৬টা থেকে জয়দেবপুরে অনির্দিষ্টকালের জন্য সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সারা দেশে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। অসহযোগ আন্দোলন শুরু হওয়ার পর দেশের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে বাঙালিদের হতাহতের ঘটনা ঘটলেও এটিই ছিল মুক্তিযুদ্ধের সূচনাপর্বে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ। আর এই প্রতিরোধ যুদ্ধে শহীদ হুরমত আলী ও অন্যান্য শহীদের অবদান ও আত্মত্যাগকে জাতির চেতনায় সমুন্নত রাখতে জয়দেবপুর চৌরাস্তার সড়কদ্বীপে দৃষ্টিনন্দন এই স্থাপত্যকর্ম স্থাপিত হয়, যা জাগ্রত চৌরঙ্গী নামে অভিহিত। ভিত বা বেদিসহ জাগ্রত চৌরঙ্গীর উচ্চতা ৪২ ফুট ২ ইঞ্চি। ২৪ ফুট ৫ ইঞ্চি ভিত বা বেদির ওপর মূল ভাস্কর্যের ডান হাতে গ্রেনেড ও বাঁ হাতে রাইফেল। কংক্রিট, গ্রে সিমেন্ট, হোয়াইট সিমেন্ট ইত্যাদি দিয়ে ঢালাই করে নির্মিত এ ভাস্কর্যটিতে ১৬ শ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৩ নম্বর সেক্টর ও ১১ নম্বর সেক্টরের শহীদ সৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধাদের নাম লিপিবদ্ধ করা আছে। 'ডান হাতে তাজা গ্রেনেড আমার/বাম হাতে রাইফেল/বিদ্রোহী আমি মুক্তিপিয়াসী/প্রাণ সদা উদ্বেল।/ আমি তোমাদের চেনা/আমি যে মুক্তিযোদ্ধা।' স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী উপলক্ষে ১৯৯৬ সালে জাগ্রত চৌরঙ্গীর মূল বেদির সম্মুখভাগে ভাওয়াল রত্ন মো. নুরুল ইসলামের (নুরু স্যার) লেখা কবিতার এ লাইন কয়টি একটি ফলকে লিপিবদ্ধ করা আছে। এই ভাস্কর্য আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ ও সংগ্রামের প্রতিচিত্র।
Related Articles
If you enjoyed this article just Click here Read Dhumketo ধূমকেতু, or subscribe to receive more great content just like it.
0 comments:
Post a Comment