Home » , , , » একই গগনের দুই জ্যোতিষ্ক by নিয়ামত হোসেন

একই গগনের দুই জ্যোতিষ্ক by নিয়ামত হোসেন

Written By Unknown on Monday, June 13, 2011 | 6:59 AM

ঠাৎই যেন চলে গেলেন মোহাম্মদ কিবরিয়া। শিল্পী কিবরিয়া। দেশের শিল্প ও সংস্কৃতি ভুবনের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। চারুকলা ৰেত্রের একজন দিকপাল। অগণিত ভক্ত, ছাত্র ও অনুরাগীরই শুধু নয়, আমাদের দেশের একজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। বয়স যাই হোক, এভাবে তিনি চলে যাবেন সেটা কেউ আশা করেনি। সেজন্যই তাঁর চলে যাওয়ার খবর যিনিই শুনেছেন, তিনি চমকে ওঠেছেন।
যেন হঠাৎ করেই চলে গেলেন বিশিষ্ট এই চিত্রশিল্পী। এ দেশে আধুনিক বিমূর্ত চিত্ররীতির অন্যতম প্রবর্তক তিনি। এই ৰেত্রে তাঁর অবদান বিরাট। দেশে শিল্পীমহলে তিনি এর স্বীকৃতি পেয়েছেন। একই সঙ্গে আর যেসব শিল্পী এই ধারা প্রবর্তনে ভূমিকা রেখেছেন তাঁরাও আজ দেশে খ্যাতিমান। আজ দেশের শিল্পকলার ৰেত্রে যে অগ্রগতি এসেছে তার পেছনে অবদান রয়েছে অনেকেরই। শিল্পী কিবরিয়া তাঁদেরই অন্যতম। আমাদের চিত্রকলা আজ অনেক দূর এগিয়েছে। একটা সময় ছিল যখন চিত্রকলা ছিল না বলা যাবে না, ছিল, কিন্তু আধুনিক চিত্রকলা ছিল না। বেশ কয়েকজন নিবেদিতপ্রাণ শিল্পীর হাত ধরে আমাদের চিত্রকলা এগিয়ে এসেছে। এর মধ্যে এসেছে আধুনিক রীতি। এদেশে সে রীতির অন্যতম প্রবর্তক মোহাম্মদ কিবরিয়া। এদেশে চিত্রশিল্পের এগিয়ে যাওয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে যাঁরা অক্লানত্ম পরিশ্রম করেছেন তাঁদের মধ্যে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, পটুয়া কামরুল হাসান, শফিউদ্দিন আহমদ প্রমুখের পরবর্তী ধাপেই আছেন মোহাম্মদ কিবরিয়া। এদেশে আধুনিক শিল্পকলার অন্যতম প্রবর্তক হিসেবে তাঁর অবদান বিরাট। এই ধারারই শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, আমিনুল ইসলাম, আবদুর রাজ্জাক প্রমুখ। এঁরা সকলেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে খ্যাতিমান। এদেশে আধুনিক চিত্রকলার প্রবর্তন ও প্রসারের ৰেত্রে এঁদের প্রত্যেকের অবদান অনস্বীকার্য।
বিমূর্ত চিত্রকলা বোঝেন না এ কথা অনেকে বলেন। কথাটি পুরোপুরি ঠিক নয়। শিল্পী কিবরিয়ার মৃতু্যর পর এক স্মরণসভায় বিশিষ্ট শিল্পী হাসেম খান তাঁর স্মৃতিচারণে ঠিক এই বিষয়টি নিয়ে স্মৃতিচারণ করে নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন।
মোহাম্মদ কিবরিয়ার চিত্র প্রদর্শনী চলছে। বহু লোক দেখতে আসছে। একদিন এল বোরকাপরা এক বধূ ও তাঁর স্বামী এক রিকশাচালক। ওই মহিলা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে একটি ছবি খুব আগ্রহ নিয়ে দেখছেন। একবার সামনে একবার পাশে এভাবে কয়েকবার দেখার পর স্বামীকে ডেকে ছবিটা দেখে বললেন, দেখো দেখো এটা সরষে খেত না? ছবিটি বুঝতে পেরে আনন্দিত এই মহিলা। শিল্পীর স্বার্থকতা এখানেই। দর্শকদের মনোযোগ আকৃষ্ট করছেন এবং বিশেষ ধরন বা ভঙ্গিতে উপস্থাপন করছেন তাঁর বিষয়বস্তু।
অমায়িক মানুষ ছিলেন শিল্পী কিবরিয়া। রুচিবান মানুষ। অনেকটা নিভৃতচারী। তাঁর একটা বিশেষ গুণ ছিল বাংলা সাহিত্যের প্রচ- ভক্ত ছিলেন তিনি। এদেশের এবং পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতিমান লেখকদের গল্প উপন্যাস তিনি নিয়মিত পড়তেন। সাহিত্যের সঙ্গে ছিল তাঁর আজীবন সখ্য। চিত্রকলা এবং সাহিত্যের অবস্থান দূরে নয়, নিকটে। সাহিত্য যেমন একটা মাধ্যম তেমনি চিত্রকলাও একটি গুরম্নত্বপূর্ণ মাধ্যম যার মাধ্যমে প্রকাশ করা যায় মনের ভাব বা অনুভূতি। দুটির রূপ ভিন্ন হলেও তাদের অবস্থান পরস্পরের কাছাকাছি। সঙ্গীতও তাই। তাই বলা যায়, এগুলোর মধ্যকার সম্পর্ক দূরের নয়, নৈকট্যের। কবি গুরুকে তাই দেখা যায়, কবিতা, গল্প, উপন্যাস এবং তার সঙ্গে সঙ্গীতচর্চার এক পর্যায়ে কবি চলে আসেন চিত্রকলায়।
আমাদের দেশে অনেক শিল্পীই সাহিত্যের অনুরাগী, কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে তাঁদের হৃদতাপূর্ণ সম্পর্ক। লেখকদের বইয়ের ছবি বা প্রচ্ছদ অাঁকার ৰেত্রেই নয়, সামগ্রিকভাবে শিল্পীরা সাহিত্য অঙ্গনের সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত। কোন কোন শিল্পী সাহিত্য রচনার সঙ্গেও সংশিস্নষ্ট। শিল্পী কিবরিয়া ছিলেন সাহিত্য অনত্মপ্রাণ মানুষ। বাংলা সাহিত্যের প্রচ- অনুরাগী ছিলেন। তাঁর শিল্পপ্রেম এবং সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ মিশে গিয়েছিল একাকার হয়ে। বিদগ্ধ এই মানুষটি তাঁর ছাত্রদের মধ্যে একাধারে শিল্পের প্রতি অনুরাগ এবং সাহিত্যের প্রতি ভালবাসা যেমন জাগিয়ে তুলেছিলেন, তেমনি তাদের মধ্যে জাগিয়ে তুলেছেন দেশপ্রেমও। আমাদের আধুনিক চিত্রশিল্পী তাঁকে মনে রাখবে। তিনি আমাদের শিল্পকলার ইতিহাসে বেঁচে থাকবেন, বেঁচে থাকবেন তাঁর অগণিত সহকর্মী, ছাত্র ও অনুরাগীর মধ্যে।
শিল্পী কিবরিয়ার চলে যাওয়ার অর্থ বাংলাদেশের শিল্প গগন থেকে এক উজ্জ্বল নৰত্রের বিদায়।
প্রতিবেশী ভারতের শিল্প গগনের এক নৰত্রের চলে যাওয়ার সংবাদ পাওয়া গেল এ সময়েই। তিনি শিল্পী হুসেন। পুরো নাম মকবুল ফিদা হুসেন। তবে হুসেন নামেই পরিচিত তাঁর দেশব্যাপী এবং একই সঙ্গে বিশ্বব্যাপীও। আপাদমসত্মক শিল্পী তিনি। তাঁর চালচলন জীবনযাপন সবই একজন প্রকৃত শিল্পীর মতো। কোন ভনিতা নেই, সহজ-সরল সুন্দর জীবন। বিলাসিতার ধার ধারেন না। শিল্পী হুসেন বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে পক্বকেশ ও শ্মশ্রম্নম-িত এক সরল মানুষের চেহারা। বিলাসিতা দূরের কথা অনেক সময় তিনি পায়ে জুতা স্যান্ডেলও ব্যবহার করতেন না।
দেশ-বিদেশে তাঁর নাম। অগণিত ভক্ত। ছবির দামও অনেক। এক নিলাম ঘরে তাঁর একটা ছবির দাম উঠেছিল ২০ লাখ ডলার পর্যনত্ম। সহজ-সরল এই মানুষটি থাকতেন সাদাসিদ্ধাভাবে। পশ্চিমা দেশের এক ম্যাগাজিনে তাঁকে বলা হয় 'ভারতের পিকাসো।' আসলে বড় মাপের মহৎ সব শিল্পী নিজ নিজ ৰেত্রে অনন্য। কারও সঙ্গে কারও তুলনা হয় না। সবাই নিজ নিজ ৰেত্রে অনন্য। পিকাসো পিকাসোই। তাঁর সঙ্গে কারও তুলনা চলে না। হুসেন হুসেনই। তাঁর সঙ্গেও তুলনা চলে না কারও।
হুসেনের বিষয়ে সর্বপ্রথম যে কথাটি বলা যায়, সেটি হচ্ছে হুসেন স্বশিৰিত শিল্পী। কোনদিন কোন একাডেমী বা স্কুল থেকে চিত্রকলায় শিৰা নেননি। নিজের ভেতরেই ছিল শিল্প। নিজেই সেটাকে বিকশিত করে জগদ্বিখ্যাত হন।
নিজ দেশে ছিলেন খুবই জনপ্রিয় একজন মানুষ। পথে ঘাটে শহরে নগরে ঘুরে বেড়িয়েছেন। শিল্পীর চোখে দেখেছেন মানুষ ও পরিপাশর্্ব। ছবি অাঁকতেন যেখানে সেখানে। কাগজ পেন্সিল কলম তুলি একটা হলেই হলো। সাবলীল দৰতায় একের পর এক হয়ে যেত স্কেচ। সকল পর্যায়ে মানুষ তাঁর ছবি ভালবাসত। তাঁর ছবি বুঝত সাধারণ মানুষও। ভারতের অনেক সম্মান তিনি পেয়েছেন। পেয়েছেন পদ্মশ্রী ১৯৫৫ সালে। তারপর পেয়েছেন পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণও পেয়েছেন।
জন্ম তাঁর ভারতের মহারাষ্ট্রে। সেই মহারাষ্ট্রের মুম্বাইতে সিনেমার বিশাল বিশাল ছবি অাঁকার মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরম্ন। সিনেমার ব্যানার বা পোস্টার ইত্যাদি অাঁকার মাধ্যমে বাসত্মব শিল্পী জীবনের সূচনা তাঁর। পাশাপাশি চলে নিজের ছবি অাঁকা। ১৯৫২ সালে তাঁর প্রথম একক চিত্র প্রদর্শনী হয় সুইজারল্যান্ডে। সেই থেকে তিনি পান আনত্মর্জাতিক খ্যাতি।
চলচ্চিত্রের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন শিল্পী হুসেন। মাধুরী দীৰিতকে নায়িকা করে তিনি তৈরি করেন একটি চলচ্চিত্র। তার নাম 'গজগামিনী।' এরপর আরেকটি চিত্র নির্মাণ করেন টাবুকে নিয়ে। প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণে হাত দেন ১৯৬৭ সালে। তাঁর প্রথম ছবি 'থ্রম্ন দ্য আইজ অব এ পেইন্টার।' ছবিটি বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয় এবং সেখানে 'গোল্ডেন বিয়ার'-এ সম্মানিত হয়।
ভারতজুড়ে খ্যাতিমান শিল্পী হুসেন হিন্দুদের দেবী সরস্বতীর একটা ছবি অাঁকায় হিন্দু উগ্রবাদী কট্টরপন্থীদের রোষানলে পড়েন। তাঁর বাড়িতে উগ্রপন্থী একদল লোক হামলা চালিয়ে তাঁর অনেক ছবি নষ্ট করে দেয়। তাঁরা তাঁকে হত্যার হুমকিও দেয়। উগ্রপন্থীরা এই মহান শিল্পীর অাঁকা ঐ ছবির ব্যাপারে নগ্নতার অভিযোগ তোলে।
শিল্পী হুসেন ২০১০ সালে স্বেচ্ছানির্বাসনে চলে যান কাতারের নাগরিকত্ব নিয়ে। তিনি বাস করতে থাকেন লন্ডনে। সেখানেই তাঁর জীবনাবসান ঘটে। ভারতের এই বিখ্যাত শিল্পী ছিলেন সে দেশের কোটি কোটি মানুষের প্রিয় শিল্পী, ভারত সরকারও তাঁকে দিয়েছে উচ্চতর সব সম্মান ও মর্যাদা। অথচ ধর্মান্ধ মৌলবাদী উগ্র সাম্প্রদায়িক হিন্দুদের একটি গ্রম্নপ তাঁর বিরম্নদ্ধাচরণ করে অসম্মান করে তাঁকে। শিল্পী হুসেন বেঁচে থাকবেন তাঁর দেশ ভারতের শিল্পকলার ইতিহাসে। বেঁচে থাকবেন বিশ্বের আধুনিক চিত্রকলার ইতিহাসেও।
লেখক শিল্পীদের জন্ম হয় কোন না কোন দেশে। কিন্তু তাঁরা কোন একটি দেশের সম্পদ নন। তাঁদের কাজ বিশ্বের সকল দেশের সকল মানুষের। সাহিত্যই হোক চিত্রকলাই হোক এবং যে কোন দেশেই সেগুলো রচিত বা অঙ্কিত হোক, সেগুলো বিশ্ব শিল্প ভুবনের অংশ। শিল্পীদের তাই নিজস্ব দেশ থাকলেও তাঁরা সব ধরনের গ-ির উর্ধে, সকল দেশের তাঁরা। শিল্পী কিবরিয়া যেমন আমাদের তেমনি সবার, শিল্পী হুসেন যেমন ভারতের, তেমনি তিনি আমাদেরও। এই দুই শিল্পীর মৃতু্য তাই শুধু বাংলাদেশ ও ভারতেরই ৰতি নয়, ক্ষতি বিশ্ব শিল্প ভুবনেরও।
এই দুই মহান শিল্পীর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা।

0 comments:

Post a Comment

 
Support : Dhumketo ধূমকেতু | NewsCtg.Com | KUTUBDIA @ কুতুবদিয়া | eBlog
Copyright © 2013. Edu2News - All Rights Reserved
Template Created by Nejam Kutubi Published by Darianagar Publications
Proudly powered by Dhumketo ধূমকেতু