বাংলাদেশে নির্বাচনকালীন উত্তেজনা একটি প্রচলিত রীতি। কিন্তু গত বছরজুড়ে যে সহিংসতা এবং ৫ই জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেশকে আত্মপরিচয় ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বড় বড় দেশ ও সংগঠন স্বীকৃতি দেয়নি বাংলাদেশের নির্বাচনকে। বিরোধী দলের বর্জনের মধ্য দিয়ে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশের জনমত একেবারে পরিষ্কার। তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে একটি নির্বাচনের জন্য বিরোধী দলের পক্ষ নিয়েছে। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের কাছে তা কোন দাগ কাটেনি। শাসকগোষ্ঠীর ভয়াবহ দুর্নীতি, নিষ্ঠুরতা ও ক্ষমতার অপব্যবহার দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নীরব জনগোষ্ঠীর মাঝে সৃষ্টি করেছে অসন্তোষ। ভারতের একনিষ্ঠ সমর্থন নিয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ স্পর্শকাতর ধর্মনিরপেক্ষতা, ধর্ম ও সার্বভৌমত্ব ইস্যুতে দেশে মেরুকরণ করেছে। এ মেরুকরণ কার্যত উল্টো ফল দিয়েছে। এতে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সব স্থানেই হেরেছে আওয়ামী লীগ। এটা অবশ্যই বলা যায় যে, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হারানোর আতঙ্কে ছিল। তারা যে দমন ও প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড চালিয়েছে তা সংশোধন করার পরিবর্তে এ দলটি দমনপীড়ন দ্বিগুণ করে এবং অব্যাহতভাবে কূটনৈতিক অতিথি আসায় ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের নিশ্চয়তা পেয়ে তারা আরও উৎসাহী হয়ে ওঠে এবং যে কোন গণতান্ত্রিক দাবিকে উপেক্ষা করার সাহস পায়। ফল হিসেবে বিরোধীদের এবং সাধারণ জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার পুরোপুরি হরণ করা হয়। ভিন্নমতাবলম্বী বা বিরোধীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয় তীব্র শক্তি। সেটা হয় মিডিয়ার বিরুদ্ধে। হতে পারে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে। হতে পারে আইনজীবীদের বিরুদ্ধে। সুশীল সমাজের সদস্যদের বিরুদ্ধে অথবা বিরোধী রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে। পশ্চিমা কূটনীতি অনুসরণ করে বাংলাদেশের বর্তমান সময়ের রাজনৈতিক সঙ্কটে মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ। কিন্তু দুঃখজনক হলো, বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থা ও রাজনৈতিক প্রেক্ষিত বিবেচনা করে, যেখানে গণতন্ত্র নয়Ñ এ সময়ে দেশ চলছে কর্তৃত্ববাদী শাসনে, সেখানে ব্যর্থ হয় তাদের সে উদ্যোগ। নিজেদের গণতান্ত্রিক দাবির বিষয়ে বাইরের দেশগুলোর প্রতিক্রিয়া কি সেদিকে তাকিয়ে থাকে বেশির ভাগ বাংলাদেশী। বাংলাদেশী পণ্যের বড় রপ্তানি বাজার হলো ইউরোপীয় ইউনিয়ন। বাংলাদেশীদেরও গন্তব্য সেখানে। এসব বাংলাদেশীর বেশির ভাগই বসবাস করেন শহর এলাকায়। তারা শিক্ষিত। প্রয়োজনের সময় ইউরোপীয় ইউনিয়নকে তারা পাশে পেতে ছিলেন উদগ্রীব। অবশেষে ১৬ই জানুয়ারি ইউরোপীয় ইউনিয়ন একটি প্রস্তাব উত্থাপন করে, যা উত্তরের চেয়ে বেশি প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। অন্য পশ্চিমা অংশীদারদের সঙ্গে ইইউ বিরোধী দলের প্রতিবাদ বিক্ষোভকে ‘সহিংস’ আখ্যায়িত করেছে। তারা প্রধান বিরোধী দলের অংশীদারদের ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যায়িত করছে। ইইউ যে প্রস্তাবনা এনেছে তাতে সহিংসতার মূল কারণ অনুসন্ধানে ব্যর্থ হয়েছে তারা। এখানে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও অধিকার ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের ভয়াবহ দমনপীড়ন ও নৃশংসতার বিষয়টি তারা তুলে ধরেননি। ক্ষমতাসীনদের হাতে বিরোধী দলের যেসব নেতাকর্মীকে গুলি করা হয়েছে, অপহৃত হয়েছেন অথবা হত্যা খুন হয়েছেনÑ কেউ যদি এ বিষয়ে পরিসংখ্যান ও রিপোর্টের বিষয়ে খোঁজ নেন তাহলে এটা পরিষ্কার হয়ে যাবে যে সহিংসতার মূল হোতা ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী। অথচ ইউরোপীয় ইউনিয়নের দৃষ্টিভঙ্গিতে বলা হয়েছে:
১. মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে শাসকগোষ্ঠীর সমালোচনা করেছে ইইউ। অনিচ্ছাসত্ত্বেও একনায়কসুলভ শাসন মেনে নেয়া হয়।
২. সহিংসতার জন্য বিরোধীদের দায়ী করেছে ইইউ।
৩. জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলামকে ‘জঙ্গি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে ইইউ।
৪. ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে পরামর্শ দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী ও অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে।
৫. ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে বিরোধীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ইইউ।
প্রথমত, হেফাজতে ইসলামীকে সহিংসতায় জড়িত করা একটি ভুল। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর মতো একই আওতায় হেফাজতকে নিয়ে আসে ইইউ। এটা তাদের আরেকটি বড় ভুল।
হেফাজতে ইসলামী কোন রাজনৈতিক দল নয়। তারা কোন রাজনৈতিক প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশ নেয় নি। এটা একটি সামাজিক-ধর্মীয় আন্দোলন। তারা আন্দোলন করছে ইসলামী বিশ্বাসের পবিত্রতা রক্ষার দাবিতে। জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলাম থেকে বিএনপিকে দূরে সরে থাকার যে আহ্বান জানানো হয়েছে তাতে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে। যেমন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন কি বাংলাদেশের মৌলিক ইস্যুগুলো অনুধাবন করতে পেরেছে? বাংলাদেশে বর্তমানে মূল ইস্যু হলোÑ অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত একটি নির্বাচনে সরকার নির্বাচিত করতে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার। এমন বৈধ গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের দীর্ঘদিনের সমর্থন দেয়ার রীতি আছে। তাহলে কেন বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল তার কোন জোটসঙ্গী অথবা কোন গ্রুপের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবে? এক্ষেত্রেও তো একই গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রশ্ন আসে। ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে আলোচনায় বসার জন্য বিরোধী দলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এর মাধ্যমে বর্তমানের সঙ্কট সমাধানের জন্য পথ খুঁজে বের করার তাগিদ দেয়া হয়েছে। ক্ষমতাসীনরা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায় না বলেই জাতিসংঘ সহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও বিরোধীদের সমঝোতা উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন না দেয়ার ব্যাপারে ক্ষমতাসীনদের সমর্থন দেয় ভারত। এতে উৎসাহী হয় তারা। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রস্তাব সম্পর্কে বাংলাদেশীদের প্রশ্ন তোলার আরও একটি কারণ আছে। ধরা যাক ইউক্রেনের কথা। সেখানে শাসকগোষ্ঠীর দমন-পীড়নের মুখে চলমান আন্দোলন সহিংস হয়ে ওঠে। ইউক্রেনের বিরোধীর বাধ্য হয়ে যে আন্দোলন করছে তার দিনপঞ্জি ও ধরন অনেকাংশে বাংলাদেশের মতোই। সরকার বিরোধী এ দু’টি প্রতিবাদ বিক্ষোভের মধ্যে একটিই পার্থক্য। তা হলোÑ ইউক্রেনের বিরোধীদের সঙ্গে সম্পর্ক আছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের। তাদেরকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেইনি, উপরন্তু তারা তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে দেয়নি। তাহলে বাংলাদেশের বিরোধীদের বেলায় তাদের কেন এ ভিন্নতা? এরই মধ্যে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সলমন খুরশিদ বলেছেন, বাংলাদেশ ইস্যুতে ভারতকে অনুসরণ করতে যুক্তরাষ্ট্রকে পরামর্শ দিয়েছেন তারা। কারণ, প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশকে তারা ভাল জানেন। সারসংক্ষেপ হলো, ভারত চায় কোন ম্যান্ডেট ছাড়া হলেও আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখতে। যদি তা না হয় তাহলে বাংলাদেশ শাসন করবে সন্ত্রাসীরাÑ এমনটা তাদের ধারণা। ভারত ও ক্ষমতাসীনরা হিসাব কষে দেখেছেন যে, ‘সন্ত্রাসী’দের বিরুদ্ধে দমনপীড়ন চালালে তাতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও পশ্চিমা দেশগুলো থেকে মৌন সম্মতি পাওয়া যাবে। বাংলাদেশে জঙ্গিদের কখনও কোন তৎপরতা ছিল না এবং বিরোধীদের ভিতর থেকে কোন সমর্থন নেইÑ এ সত্যটিকে চাপা দিয়েছে ভারতীয় প্রচারণা। ‘জঙ্গি’দেরকে বিরোধী দলীয় শিবিরে ফেলে ভারতীয় কোরাসে যোগ দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এর মাধ্যমে কি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ও জনপ্রিয় দাবিকে দুর্বল করে দিচ্ছে না ইউরোপীয় ইউনিয়ন? রাষ্ট্রীয় নৃশংসতার শিকার কোন ব্যক্তি কিভাবে ‘জঙ্গি’ হতে পারে এবং সহিংসতার মূল হোতা হতে পারে? রাজনৈতিক দলগুলোর সমপর্যায়ে কিভাবে নেয়া যেতে পারে সামাজিক-ধর্মীয় আন্দোলন হেফাজতকে? হাজার মাইল দূরত্বে থেকে ইইউ সংসদ সদস্যরা তাদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু তাদের তথ্যের যোগান দিয়েছেন কারা? ইইউতে যাদেরকে বক্তব্য দিতে আহ্বান জানানো হয়েছে তাদের অবস্থান মারাত্মকভাবে পক্ষপাতমূলক। অভিযুক্তদের তাদের অবস্থান উপস্থাপন করতে দেয়ার সুযোগটা প্রথাগত। কিন্তু জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতকে জঙ্গি তকমা দেয়ার আগে কি তাদের অবস্থান উপস্থাপন করার কোন সুযোগ দেয়া হয়েছিল? না। বরং বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ সম্ভ্রান্তদের ইইউ রেজল্যুশনে তাদের বানোয়াট ভাষ্য ঢুকিয়ে দেয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছিল, যাদেরকে প্রায়ই ইইউ দূতদের সঙ্গে আলোচনা করতে দেখা গেছে। কে ঘটনার বলি আর কে জঙ্গি সেটা নিরূপণ করার জন্য ইইউর সম্ভবত সত্যিকার অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। বাংলাদেশে স্থিতিশীল পরিবেশ নিশ্চিত করতে ইইউর অভিপ্রায় স্পষ্ট। বাংলাদেশের তৈরী পোশাক শিল্পে ইইউ ক্রেতারাই উপকৃত হয়ে থাকে। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের শহুরে সম্ভ্রান্ত আর ধর্মনিরপেক্ষ শ্রেণীর বাইরে সাধারণ জনগণের সঙ্গে একীভূত হওয়ার ক্ষেত্রে ইইউ কতটা প্রস্তুত?
মীর রাশেদুল হাসান বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলে আইটি পেশায় যুক্ত।
(গতকাল হংকং ভিত্তিক অনলাইন এশিয়া টাইমসে প্রকাশিত ‘ইইউ লেটস ডাউন বাংলাদেশী অপোজিশন’ শীর্ষক প্রতিবেদনের অনুবাদ)
১. মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে শাসকগোষ্ঠীর সমালোচনা করেছে ইইউ। অনিচ্ছাসত্ত্বেও একনায়কসুলভ শাসন মেনে নেয়া হয়।
২. সহিংসতার জন্য বিরোধীদের দায়ী করেছে ইইউ।
৩. জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলামকে ‘জঙ্গি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে ইইউ।
৪. ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে পরামর্শ দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী ও অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে।
৫. ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে বিরোধীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ইইউ।
প্রথমত, হেফাজতে ইসলামীকে সহিংসতায় জড়িত করা একটি ভুল। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর মতো একই আওতায় হেফাজতকে নিয়ে আসে ইইউ। এটা তাদের আরেকটি বড় ভুল।
হেফাজতে ইসলামী কোন রাজনৈতিক দল নয়। তারা কোন রাজনৈতিক প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশ নেয় নি। এটা একটি সামাজিক-ধর্মীয় আন্দোলন। তারা আন্দোলন করছে ইসলামী বিশ্বাসের পবিত্রতা রক্ষার দাবিতে। জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলাম থেকে বিএনপিকে দূরে সরে থাকার যে আহ্বান জানানো হয়েছে তাতে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে। যেমন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন কি বাংলাদেশের মৌলিক ইস্যুগুলো অনুধাবন করতে পেরেছে? বাংলাদেশে বর্তমানে মূল ইস্যু হলোÑ অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত একটি নির্বাচনে সরকার নির্বাচিত করতে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার। এমন বৈধ গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের দীর্ঘদিনের সমর্থন দেয়ার রীতি আছে। তাহলে কেন বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল তার কোন জোটসঙ্গী অথবা কোন গ্রুপের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবে? এক্ষেত্রেও তো একই গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রশ্ন আসে। ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে আলোচনায় বসার জন্য বিরোধী দলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এর মাধ্যমে বর্তমানের সঙ্কট সমাধানের জন্য পথ খুঁজে বের করার তাগিদ দেয়া হয়েছে। ক্ষমতাসীনরা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায় না বলেই জাতিসংঘ সহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও বিরোধীদের সমঝোতা উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন না দেয়ার ব্যাপারে ক্ষমতাসীনদের সমর্থন দেয় ভারত। এতে উৎসাহী হয় তারা। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রস্তাব সম্পর্কে বাংলাদেশীদের প্রশ্ন তোলার আরও একটি কারণ আছে। ধরা যাক ইউক্রেনের কথা। সেখানে শাসকগোষ্ঠীর দমন-পীড়নের মুখে চলমান আন্দোলন সহিংস হয়ে ওঠে। ইউক্রেনের বিরোধীর বাধ্য হয়ে যে আন্দোলন করছে তার দিনপঞ্জি ও ধরন অনেকাংশে বাংলাদেশের মতোই। সরকার বিরোধী এ দু’টি প্রতিবাদ বিক্ষোভের মধ্যে একটিই পার্থক্য। তা হলোÑ ইউক্রেনের বিরোধীদের সঙ্গে সম্পর্ক আছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের। তাদেরকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেইনি, উপরন্তু তারা তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে দেয়নি। তাহলে বাংলাদেশের বিরোধীদের বেলায় তাদের কেন এ ভিন্নতা? এরই মধ্যে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সলমন খুরশিদ বলেছেন, বাংলাদেশ ইস্যুতে ভারতকে অনুসরণ করতে যুক্তরাষ্ট্রকে পরামর্শ দিয়েছেন তারা। কারণ, প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশকে তারা ভাল জানেন। সারসংক্ষেপ হলো, ভারত চায় কোন ম্যান্ডেট ছাড়া হলেও আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখতে। যদি তা না হয় তাহলে বাংলাদেশ শাসন করবে সন্ত্রাসীরাÑ এমনটা তাদের ধারণা। ভারত ও ক্ষমতাসীনরা হিসাব কষে দেখেছেন যে, ‘সন্ত্রাসী’দের বিরুদ্ধে দমনপীড়ন চালালে তাতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও পশ্চিমা দেশগুলো থেকে মৌন সম্মতি পাওয়া যাবে। বাংলাদেশে জঙ্গিদের কখনও কোন তৎপরতা ছিল না এবং বিরোধীদের ভিতর থেকে কোন সমর্থন নেইÑ এ সত্যটিকে চাপা দিয়েছে ভারতীয় প্রচারণা। ‘জঙ্গি’দেরকে বিরোধী দলীয় শিবিরে ফেলে ভারতীয় কোরাসে যোগ দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এর মাধ্যমে কি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ও জনপ্রিয় দাবিকে দুর্বল করে দিচ্ছে না ইউরোপীয় ইউনিয়ন? রাষ্ট্রীয় নৃশংসতার শিকার কোন ব্যক্তি কিভাবে ‘জঙ্গি’ হতে পারে এবং সহিংসতার মূল হোতা হতে পারে? রাজনৈতিক দলগুলোর সমপর্যায়ে কিভাবে নেয়া যেতে পারে সামাজিক-ধর্মীয় আন্দোলন হেফাজতকে? হাজার মাইল দূরত্বে থেকে ইইউ সংসদ সদস্যরা তাদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু তাদের তথ্যের যোগান দিয়েছেন কারা? ইইউতে যাদেরকে বক্তব্য দিতে আহ্বান জানানো হয়েছে তাদের অবস্থান মারাত্মকভাবে পক্ষপাতমূলক। অভিযুক্তদের তাদের অবস্থান উপস্থাপন করতে দেয়ার সুযোগটা প্রথাগত। কিন্তু জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতকে জঙ্গি তকমা দেয়ার আগে কি তাদের অবস্থান উপস্থাপন করার কোন সুযোগ দেয়া হয়েছিল? না। বরং বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ সম্ভ্রান্তদের ইইউ রেজল্যুশনে তাদের বানোয়াট ভাষ্য ঢুকিয়ে দেয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছিল, যাদেরকে প্রায়ই ইইউ দূতদের সঙ্গে আলোচনা করতে দেখা গেছে। কে ঘটনার বলি আর কে জঙ্গি সেটা নিরূপণ করার জন্য ইইউর সম্ভবত সত্যিকার অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। বাংলাদেশে স্থিতিশীল পরিবেশ নিশ্চিত করতে ইইউর অভিপ্রায় স্পষ্ট। বাংলাদেশের তৈরী পোশাক শিল্পে ইইউ ক্রেতারাই উপকৃত হয়ে থাকে। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের শহুরে সম্ভ্রান্ত আর ধর্মনিরপেক্ষ শ্রেণীর বাইরে সাধারণ জনগণের সঙ্গে একীভূত হওয়ার ক্ষেত্রে ইইউ কতটা প্রস্তুত?
মীর রাশেদুল হাসান বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলে আইটি পেশায় যুক্ত।
(গতকাল হংকং ভিত্তিক অনলাইন এশিয়া টাইমসে প্রকাশিত ‘ইইউ লেটস ডাউন বাংলাদেশী অপোজিশন’ শীর্ষক প্রতিবেদনের অনুবাদ)
0 comments:
Post a Comment