কালের পুরাণ- বড় ধাক্কা খেল আওয়ামী লীগ by সোহরাব হাসান

Saturday, February 22, 2014

সব রাজনৈতিক দলেই কিছু নেতা থাকেন, কথা বলতে ভালোবাসেন। তাঁরা কাজ করেন কম। কথা দিয়েই কাজের ঘাটতিটা পূরণ করতে চান।
তবে সম্ভবত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে এই নেতা-নেত্রীর সংখ্যাই বেশি। বিরোধী দলে এ রকম কথার রাজাদের কদর বেশি। কেননা, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিরোধী দলের একমাত্র কাজ হলো সরকারের সমালোচনা করা এবং সেই কাজটি যিনি যত জ্বালাময়ী ভাষায় দিতে পারেন, তিনি বড় নেতা হন। বাংলাদেশে জ্বালাময়ী ভাষায় বক্তৃতা দেওয়া নেতার অভাব নেই। অভাব আছে দক্ষ প্রশাসকের। মন্ত্রীও যে একজন প্রশাসকও, সে কথাটি তাঁরা ক্ষমতায় থাকতে ভুলে যান এবং নিজের মন্ত্রণালয় ছাড়া সব বিষয়ে পাণ্ডিত্য দেখান।

শেখ হাসিনার তৃতীয় মন্ত্রিসভার বয়স দেড় মাসেরও কম। গত মাসের ১২ তারিখে তাঁর নেতৃত্বে নতুন মন্ত্রিসভা শপথ নিয়েছে। আজ ফেব্রুয়ারির ২২ তারিখ। এই এক মাস ১০ দিনের মধ্যে সরকার রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণী ক্ষেত্রে যেই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটি নিয়েছে তা হলো উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। সব উপজেলার মেয়াদ এখনো শেষ হয়নি। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, মেঘ না চাইতেই জল। সরকার হয়তো ভেবেছিল, প্রায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে আসা জাতীয় নির্বাচনের এক-দেড় মাসের মধ্যে উপজেলা নির্বাচন হলে বিরোধীরা বেকায়দায় পড়বে। কিন্তু প্রথম দফার ৯৭টি উপজেলা নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায়, বিরোধী দল নয়, সরকারি দলই বেকায়দায় পড়েছে। বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে। দ্বিতীয় যে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছে তা হলো, দ্রুত বিচার আইনের মেয়াদ আরও চার বছর বাড়ানো। আগামী এপ্রিলে এই মেয়াদ শেষ হবে। আগে দুই বছর করে বাড়ানো হতো। এবার চার বছর বাড়ল।
তবে উপজেলা নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে সরকারি দলের একটি সন্তুষ্টির জায়গা আছে সেটি হলো, শেখ হাসিনার আমলে সব নির্বাচন যে অবাধ ও সুষ্ঠু হয়, এটাই তার প্রমাণ। এ কারণে বাকি উপজেলা নির্বাচনগুলো ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেসব নির্বাচন যদি মোটামুটি সুষ্ঠু হয় এবং বিরোধীদের জয়ের ধারা অব্যাহত থাকে, তাহলে আওয়ামী লীগ নেতারা জোর দিয়ে বলতে পারবেন, ‘আমরা ভোট কারচুপি করি না।’ তাতে তাঁদের রাজনৈতিক অবস্থান দুর্বল হলেও নৈতিক অবস্থান পোক্ত হবে। আর যদি নির্বাচন সুষ্ঠু না হয় এবং ক্ষমতাসীনেরা যেকোনো উপায়ে জয়ী হতে চায়, তাহলে আরও বড় চ্যালেঞ্জ সরকারের জন্য অপেক্ষা করছে। বিরোধী দল তখন সরকারকে সময় দিতে চাইবে কি না, সে ব্যাপারে যথেষ্ট সংশয় আছে।
গত দেড় মাসে মন্ত্রীরা কে কী কাজ করেছেন, হিসাব নিলে অনেকের জমা খাতার হিসাব মেলানো কঠিন। বেশির ভাগ মন্ত্রীর কথাবার্তা শুনে মনে হয়, মন্ত্রিত্ব করা তাঁদের কাছে ডাল-ভাত। তাঁদের একমাত্র কাজ হলো পরাস্ত বিএনপি-জামায়াতকে কোণঠাসা করা। বিএনপি-জামায়াত তো এখন সংসদে নেই, রাজপথেও নেই। কোনো কোনো মন্ত্রী জাতীয় নির্বাচন বর্জন করে উপজেলা নির্বাচন করার জন্য বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়াকে নাকে খত দিতে বলেছিলেন। সেই মন্ত্রীদের কাছে জিজ্ঞাসা, এখন কে নাকে খত দেবেন।
তবে আমরা নিশ্চয়ই সব মন্ত্রীকে এই বাকপটু দলে ফেলছি না। অনেক মন্ত্রীকে দায়িত্ব নিয়েই কঠিন পরিস্থিতি সামাল দিতে হচ্ছে। তাঁরা নিজেদের গুরুত্ব দেশের মানুষ ও বিদেশি বন্ধুদের কাছে ভালোভাবেই তুলে ধরতে পেরেছেন। যেসব মন্ত্রী আগের মন্ত্রণালয়ে নিজেদের ঠাঁই করে নিতে পেরেছেন, স্বভাবতই তাঁরা কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থায় আছেন। কিন্তু যাঁরা মন্ত্রিসভায় নতুন এসেছেন অথবা পুরোনো হলেও নতুন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন, তাঁদের কাজটি বুঝতে তো কিছুটা সময় লাগার কথা। যদিও এসব মন্ত্রীর হাবভাব দেখে মনে হয়, মন্ত্রণালয় পরিচালনা কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো বিএনপি-জামায়াতকে ঘায়েল করা। তাই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই তাঁদের কণ্ঠে সেই জিগিরই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে—রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি কত খারাপ, কত গণবিচ্ছিন্ন।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপির না যাওয়া তাদের রাজনৈতিক ভুল ছিল বলে আমরাও মনে করি। এর অর্থ এই নয় যে তারা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বরং উপজেলা নির্বাচনে মৌলবাদী জামায়াতে ইসলামীর আশাতীত ভালো ফল কেবল সরকারের জন্য নয়, বাংলাদেশের জন্যও অশনিসংকেত। অতীতে কোনো নির্বাচনে তারা এই ফল দেখাতে পারেনি।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে গত দেড় মাসে সরকার এমন কিছু করে দেখাতে পারেনি যে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা বাড়বে। এমনকি মার্কিন গবেষণা সংস্থা আরডিআই ও ডিআইএর জরিপে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা কমারই ইঙ্গিত দিয়েছে। অনেকে এ কথাও বলাবলি করছে যে সরকার ছাত্রলীগকেই সামাল দিতে পারছে না, সেই সরকার কীভাবে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিজের আয়ত্তে নিয়ে আসবে। চট্টগ্রামে স্বর্ণ ব্যবসায়ী মৃদুল চৌধুরীর অপহরণ ও উদ্ধারের ঘটনাটি নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করতে চাই, কেন মৃদুল অপহরণ হলেন, কারা তাঁকে অপহরণ করলেন, কেন অপহরণ করলেন, কীভাবে তিনি ছাড়া পেলেন?
আয়মান আল-জাওয়াহিরির ভিডিও বার্তার জন্য বিরোধী দলকে দায়ী করা যায়। কিন্তু মৃদুল চৌধুরীর অপহরণকারীদের খুঁজে বের করা সত্যি কঠিন!
এত দিন সরকারি দলের নেতারা এবং সরকারের মন্ত্রীরা সব অপকর্মের দায় বিরোধী দলের ধ্বংসাত্মক রাজনীতির ওপর চাপিয়ে বাহবা নিতে চাইতেন। দেশের যা কিছু অমঙ্গল, সবকিছুর জন্য বিরোধী দল দায়ী। কিন্তু এখন তাঁরা কী বলবেন? এখন তো বিরোধী দল ধ্বংসাত্মক কোনো কর্মসূচি দিচ্ছে না।
একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে বাংলাদেশে আল-কায়েদার এজেন্ট হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সেটি যদি সত্যি হতো, তাহলে মন্ত্রীর তথ্য উদ্ঘাটনের আগেই যুক্তরাষ্ট্র প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিত। তাঁর পরামর্শের অপেক্ষা করতেন না। তারেক রহমানের রাজনীতির বিরোধিতা করা এবং তাঁকে আল-কায়েদা বানানো এক কথা নয়। উপজেলা নির্বাচনে তারেক রহমানের দল আওয়ামী লীগের চেয়ে বেশি পদ পেয়েছে, জামায়াতকে ধরলে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ। এখন কি মন্ত্রী মহোদয় বলবেন, বাংলাদেশের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ আল-কায়েদার সমর্থক? মন্ত্রী মহোদয় হয়তো বলবেন, বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া যেহেতু আল-কায়েদা নেতা জাওয়াহিরির ভিডিও বার্তাকে প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের বানানোর বলে দাবি করেছেন, সেহেতু তার পাল্টা একটি বক্তব্য দেওয়া দরকার। কিন্তু তাঁকে মনে রাখতে হবে, দেশ চালাচ্ছে আওয়ামী লীগ, বিএনপি-জামায়াত নয়। তাই দেশে যত অঘটন ঘটবে, তার দায়ও আওয়ামী লীগকেই নিতে হবে অথবা তথ্য-প্রমাণ দিয়ে বলতে হবে, ওরা অপরাধী। হাওয়ায় ছড়ি ঘোরালে হবে না।
বিরোধী দলে থাকলে নেতা-নেত্রীরা অনেক কিছু বলেন, বলতে পারেন। কিন্তু ক্ষমতায় থাকা নেতাদের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব জনগণের কাছে দেওয়া ওয়াদা পূরণ করা। অবশ্যই ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২০২১ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত করার বাইরে কার্যত কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি। দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। বরং বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধে ২০০৮ সালে যেই প্রতিশ্রুতি ছিল, সেটি সজ্ঞানে প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এর অর্থ কি এই দাঁড়ায় না যে ২০০৮ সালে বাংলাদেশে আইনের শাসনের জন্য বিচারবহির্ভূত হত্যার প্রয়োজন ছিল না! এখন আছে। বিশ্ব দ্রুত সামনে এগোচ্ছে। আর আমরা ক্রমেই পেছনে চলে যাচ্ছি।
১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালের নির্বাচনেও আমরা শক্তিশালী বিরোধী দল পেয়েছিলাম বলে সেই সরকার ও সংসদে ভারসাম্য ছিল। অন্তত প্রথম দুই-আড়াই বছর। ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে সেই ভারসাম্য রক্ষিত হয়নি বলে দেশের রাজনীতি ও গণতন্ত্রচর্চা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়ে পড়ে। আর ২০১৪ সালে নির্বাচনে বিরোধী দলের অস্তিত্ব নেই বলেই জনমনে ধারণা। ফলে এই ভারসাম্যহীন সংসদ ভারসাম্যপূর্ণ রাজনীতি উপহার দিতে পারবে কি না, সেটাই এখন ক্ষমতাসীনদের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জাতীয় ঐকমত্যের সরকার মুখে বললেই হয় না, কাজে দেখাতে হয়। নির্বাচনী বৈতরণি পার হয়ে আওয়ামী লীগের নেতারা এতটাই আস্থাশীল হয়ে পড়লেন যে উপজেলায় ১৪-দলীয় শরিকদের সঙ্গেও পদ ভাগাভাগি করতে রাজি হলেন না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে পথ ও পথের বিবেচনায় আওয়ামী লীগের যেমন কিছু সুবিধা আছে, তেমনি অসুবিধার দিকটি হলো, আওয়ামী লীগ বিপদে না পড়লে কখনো কারও সঙ্গে জোট বাঁধে না। বিপদে পড়লে খেলাফত মজলিসের সঙ্গেও জোট বাঁধতে পারে। অন্য সময়ে একলা চল নীতিতে চলে দলটি। ১৪ দল ও জাতীয় পার্টির সঙ্গে সমঝোতা করে প্রার্থী দিলে নিশ্চয়ই ক্ষমতার দেড় মাসেরও কম সময়ের মধ্যে আওয়ামী লীগকে উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের কাছে এভাবে নাকানিচুবানি খেতে হতো না।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

নগর দর্পণ: চট্টগ্রাম- আওয়ামী লীগের মেজবান ও র‌্যাবের নতুন গল্প by বিশ্বজিৎ চৌধুরী

Tuesday, February 18, 2014

লালদীঘির ময়দানে দাঁড়িয়ে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মহিউদ্দিন চৌধুরী ঘোষণা দিয়েছিলেন, সন্ত্রাস-সহিংসতা-সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিরুদ্ধে সাতকানিয়া অভিমুখে লংমার্চ করবে আওয়ামী লীগ।
শুনে মনে হয়েছিল, এটা নেহাত পলিটিক্যাল স্টান্ট। কিন্তু সত্যি যেদিন (৮ ফেব্রুয়ারি) তাঁর নেতৃত্বে ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সমন্বয় পরিষদ’-এর ব্যানারে সাতকানিয়া অভিমুখে যাত্রা শুরু করল কয়েক শ গাড়ির বহর, সেদিন একধরনের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে কাটিয়েছে চট্টগ্রামের মানুষ। যদিও দক্ষিণ জেলা জামায়াতের নেতারা পত্রিকান্তরে বলেছেন, ‘লংমার্চে যাঁরা আসবেন, তাঁরা আমাদের মেহমান। আমরা তাঁদের স্বাগত জানাব। এ ছাড়া আমাদের কোনো কর্মসূচি নেই।’

কিন্তু সাধারণ মানুষ এতে আশ্বস্ত হতে পারেনি। কারণ, মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতের নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডাদেশ ঘোষিত হওয়ার দিন থেকে শুরু হয়ে গত ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে-পরে সাতকানিয়ায় যে ধরনের সন্ত্রাস-সহিংসতা ঘটেছে, তা নজিরবিহীন। গত বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায় তাণ্ডব শুরু হয়। ওই সময় থেকে এযাবৎ এই অঞ্চলে খুনই হয়েছে নয়জন। এ ছাড়া সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলা-লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, শত শত গাছ কেটে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়ক অবরোধ, বিদেশি পর্যটকের ওপর হামলা, পুলিশ-বিজিবির ক্যাম্প ঘেরাও করে বোমা নিক্ষেপসহ হেন কোনো দুষ্কর্ম নেই, যা এখানে সংঘটিত হয়নি। এমনকি ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর যৌথ বাহিনীর অভিযানে সাতক্ষীরা, সীতাকুণ্ডের মতো গোলযোগপ্রবণ এলাকাগুলো অনেকটা শান্ত হয়ে এলেও সাতকানিয়ার জামায়াত কর্মীরা ছিলেন সক্রিয় ও আক্রমণাত্মক। সুতরাং দক্ষিণ জেলা জামায়াতের নেতারা যতই আশ্বাসবাণী প্রচার করুন যে লংমার্চের যাত্রীরা তাঁদের মেহমান, তাঁদের স্বাগত জানাতে প্রস্তুত তাঁরা, তাতে আশ্বস্ত হতে পারেনি এ অঞ্চলের মানুষ। বরং ‘স্বাগত’ জানানোর ধরনটি কী রকম হতে পারে, এ নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার অবসান হয়নি তখনো।
যা-ই হোক, মহিউদ্দিন চৌধুরীর লংমার্চের ঘোষণা যে জনমনে শঙ্কার সৃষ্টি করেছিল, তার বাস্তব ভিত্তি নিয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই। অবশেষে যাবতীয় শঙ্কার অবসান ঘটেছে ৮ ফেব্রুয়ারি। ওই দিন নগর থেকে যাত্রা শুরু করে লংমার্চ পটিয়া ও দোহাজারীতে দুটি পথসভা করে সাতকানিয়ার কেরানীহাটে নির্ধারিত জনসভাস্থলে গিয়ে পৌঁছে বিকেলে। সেখানে নির্বিঘ্নে জনসভা সম্পন্ন করে লংমার্চ নগরে ফিরে আসে রাতে।
‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সমন্বয় পরিষদ’-এর ব্যানারে আয়োজিত এই লংমার্চ মূলত আওয়ামী লীগেরই একটি কর্মসূচি। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, এই লংমার্চ থেকে কী পেল আওয়ামী লীগ?
সুদূরপ্রসারী লাভ-ক্ষতির হিসাবে না গিয়েও এ কথা বলা যায়, এই লংমার্চ দলীয় নেতা-কর্মীদের চাঙা করেছে। সর্বোপরি সাতকানিয়াকে জামায়াতের দুর্ভেদ্য দুর্গ বলে যে মিথ প্রচারিত ছিল, সেই মিথকেও ভেঙে দেওয়া সম্ভব হয়েছে।
কেরানীহাটের জনসভায় মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেছেন, ‘আমরা শান্তির বাণী নিয়ে এসেছি।’ তিনি জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছেন, ‘সাতকানিয়াবাসী বেশির ভাগই ব্যবসায়ী। আপনারাও ব্যবসা করেন, লেখাপড়া করেন। কিন্তু সহিংসতা, নারী নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগ থেকে বিরত থাকুন।’ মহিউদ্দিন চৌধুরীকে যাঁরা চেনেন, তাঁরা জানেন, এই সহজ বক্তব্যের মধ্যে একধরনের প্রচ্ছন্ন হুমকি আছে। সাতকানিয়া জামায়াত-শিবির কর্মীরা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা নন, তাঁদেরও ব্যবসা-বাণিজ্য, লেখাপড়ার জন্য অন্যত্র যেতে হয়, এ কথাটি মনে করিয়ে দিয়ে তিনি প্রকারান্তরে সহিংসতার দায়ে অন্যত্র তাঁদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে, এমন বার্তাও দিয়ে রেখেছেন বলে মনে করেন মহিউদ্দিনের ঘনিষ্ঠজনেরা।
আপাতত শান্তিপূর্ণভাবে লংমার্চ শেষ করতে পেরে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা উদ্দীপ্ত। সেই উদ্দীপনাকে দীর্ঘস্থায়ী করার জন্যই কি না জানি না, সাতকানিয়া-লোহাগাড়াবাসীর জন্য এবার মেজবানের আয়োজন করেছেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। ২৬ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম নগরের জিমনেসিয়াম প্রাঙ্গণে এই মেজবান অনুষ্ঠিত হবে। সাংসদ ও শিল্পী মমতাজ এ অনুষ্ঠানে গান গাইতে আসবেন বলেও জানা গেছে।
এক সংবাদ সম্মেলনে মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘সাতকানিয়া-লোহাগাড়ার মানুষের সঙ্গে একটা দিন আমরা অন্যভাবে কাটাতে চাই। আমরা সাতকানিয়ার মানুষকে আস্থায় নিতে চাই, উদ্বুদ্ধ করতে চাই। যেন সহিংসতাকে সবাই রুখে দাঁড়ায়।’
চট্টগ্রামের একটি ঐতিহ্যবাহী আপ্যায়নের প্রথা ‘মেজবান’। সহিংসতার বিরুদ্ধে এই ঐতিহ্যের ধারা কতটা কার্যকর হয়ে ওঠে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
র‌্যাবের নতুন গল্প
সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও মানবাধিকারকর্মীরা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে যতই সোচ্চার হোন না কেন, সাধারণ মানুষের মনে এ নিয়ে একটি মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে। একসময় ‘ক্রসফায়ার’ ও সাম্প্রতিককালে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ শিরোনামে যে গল্পগুলো র‌্যাব-পুলিশের বরাত দিয়ে প্রকাশিত হয় সংবাদমাধ্যমে, তার অধিকাংশই যে বানানো, এ সম্পর্কে কোনো সন্দেহ নেই দেশবাসীর। তবে ‘সন্ত্রাসী দমনে’র এই পদ্ধতিতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির হয়তো উন্নতি হচ্ছে, এমন একটি আপাতস্বস্তিকর ধারণা থেকে ক্রিকেটের পরিভাষায় যাকে বলে ‘বেনিফিট অব ডাউট’ তা-ই পেয়ে আসছে র‌্যাব-পুলিশ। কিন্তু পুরো বিষয়টা যে ক্রমেই বিপজ্জনক মোড় নিচ্ছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
র‌্যাব বন্দুকযুদ্ধের একই গল্প পুনরাবৃত্তি করে যাচ্ছে, এমন অভিযোগ উঠেছে সংবাদমাধ্যমগুলোয়। সেই বিষয়টা বিবেচনায় নিয়ে কি না জানি না, চট্টগ্রামে সম্প্রতি নতুন একটি গল্পের অবতারণা করেছে তারা।
১১ ফেব্রুয়ারি সকালে অফিসে যাওয়ার পথে মৃদুল চৌধুরী নামের একজন স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে র‌্যাবের সদস্যরা তুলে নিয়ে গেছেন বলে অভিযোগ করেছে তাঁর পরিবারের লোকজন। পরিবারের অভিযোগ, র‌্যাবের বিরুদ্ধে একটি মামলা করার কারণেই এই পরিণতি হয়েছে তাঁর।
অপহূত মৃদুলের ভাই জানান, গত বছরের ৩ অক্টোবর র‌্যাব-২-এর মেজর রকিবুল আমিন এই স্বর্ণ ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ৮০ ভরি স্বর্ণ কেড়ে নেন। এ ঘটনায় মৃদুল চৌধুরী ঢাকার মহানগর মুখ্য হাকিমের আদালতে মামলা করেন রকিবুল আমিন, র‌্যাবের সোর্স ফাহাদ চৌধুরী ও গাড়িচালক বাবুল পালের বিরুদ্ধে।
মেজর রকিবুল আমিন যথারীতি অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এবং মৃদুল চৌধুরীকে তিনি চেনেন না বলেও জানিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে র‌্যাবের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, কিছুদিন আগে চট্টগ্রাম থেকে বিপুল চোরাই তেল উদ্ধার করেছে র‌্যাব। সেই অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মেজর রকিবুল আমিন। এর পর থেকেই একটি চক্র তাঁর পেছনে লেগে আছে। সোনা কেড়ে নেওয়া ও ব্যবসায়ী অপহরণের ঘটনাটি সাজানো বলে তিনি জানান।
গল্পটি নতুন। এখন অপহরণের ঘটনাটি ‘সাজানো’ নাকি র‌্যাবের গল্পটি ‘বানানো’—এটি প্রমাণের দায় র‌্যাব বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর বর্তায় না?
অপহূত হওয়ার ছয় দিন পর গতকাল সোমবার ভোরে কুমিল্লার কংসনগর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ব্যবসায়ী মৃদুল চৌধুরীকে। জীবন ফিরে পেয়েছেন তিনি; তবে স্বর্ণ ফিরে পাবেন কি না, জানি না। এ ব্যাপারটি এখানেই শেষ হলে প্রকৃত রহস্যের জট কিন্তু খুলবে না।


বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwabd@yahoo.com

আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া হতে যাচ্ছে : ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ

Tuesday, February 11, 2014

বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ বলেছেন, আওয়ামী লীগের বর্ষিয়ান রাজনীতিকরা ভোটারবিহীন নির্বাচনের পরও পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার স্বপ্ন দেখছেন। এটাই প্রমাণ করে তারা রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া হতে যাচ্ছে।
মানবজমিনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, একের পর এক বিরোধী নেতাকর্মীদের হত্যা করা হচ্ছে বিচারবহির্ভূতভাবে। আর বলা হচ্ছে এরা সবাই সন্ত্রাসী। আসাদুজ্জামান নূর তো এখন সত্যি সত্যিই বাকের ভাই হয়ে গেলেন। আমাদের নামেও তো বোমা মারার অভিযোগে বিস্ফোরকদ্রব্য আইনে মামলা আছে। আমাদেরও তাহলে সন্ত্রাসী বলে হত্যা করে ফেলুক। তাদের চিন্তাচেতনায় গণতন্ত্র নেই এটা তারই প্রমাণ। ১৯ দলের তরুণ এ নেতা বলেন, সংবিধান বলছে প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতার উৎস হলো জনগণ। আর এখন প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতার উৎস হয়ে গেছে আওয়ামী লীগ। বিরোধী জোটের আন্দোলন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আন্দোলন তো শেষই হয়নি। মার্চ ফর ডেমোক্রেসি কর্মসূচিতে বিরোধীদলীয় নেতাকে তার বাড়িতে অবরোধ করে রাখার পর এটা স্পষ্ট হয়েছিল, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের চেয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকাই আওয়ামী লীগের বড় বিষয়। ওই দিন কর্মীরা রাস্তায় নামলে অনেকগুলো প্রাণ হারাতো। বিরোধী দল রাস্তায় না নেমে অনেকগুলো জীবন বাঁচানো গেছে। এমন একটা সরকার গঠন করেই খেলা শেষ মনে করছে আওয়ামী লীগ। আসলে খেলা তো শেষ নয়। সামনে আন্দোলনের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশে অহিংস আন্দোলন করে কোন সরকার পতনের আন্দোলন সফল হয়নি। আমরা কোন সহিংসতা সমর্থন করি না, কিন্তু সহিংসতা হচ্ছে তা দেখতে হবে। তিন বছর ধরে দেশে আর লাঠিচার্জ বলে কিছু নেই। এখন সিনিয়র নেতাদেরও রাস্তায় নামলেই গুলি করে দেয়া হচ্ছে। কঠোর আন্দোলন শুরু হলে আর কিছু বলার থাকবে না কারও। তিনি বলেন, যারা জনগণের ইচ্ছার কথা চিন্তা করে না তাদের সঙ্গে তো লড়াই করা মুশকিল। তারা তো ভোটের কথা চিন্তাই করে না। জনগণের কাছে তো তাদের জবাবদিহির ভাবনা নেই। তারা যা খুশি করতে পারে। আমরা তো পারি না। আমাদের জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, সুখ-শান্তির বিষয় ভাবতে হয়। বারবার পাঁচ বছর থাকার কথা বলে আওয়ামী লীগ নেতারা স্পষ্ট করছেন তাদের পাঁচ বছর থাকার বৈধতা নেই। বিদেশী কোন বাধা নেই- এ কথা বলেই তারা প্রমাণ করছেন বিদেশীদের চাপে সরকার বিব্রত। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে পুতুল প্রার্থীদের দিয়ে নির্বাচন করা হয়েছে উল্লেখ করে সাবেক এ সংসদ সদস্য বলেন, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সম্ভব নয় এটা প্রমাণ হয়েছে। আমাদের আন্দোলন এখনও শেষ হয়নি। সরকার এখন নানাভাবে মিডিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। একটা মিডিয়া বন্ধ করে ১০০টা মিডিয়াকে নার্ভাস করার চেষ্টা করছে। কিন্তু আসলে সরকার নিজেই চাপে আছে। গণমাধ্যমের ভূমিকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন যে ব্যর্থ এটা মিডিয়ার মাধ্যমেই স্পষ্ট হয়েছে। আমরা বুঝি যে, মিডিয়া অনেক চাপের মধ্য দিয়ে কৌশল করে চলছে। কিছু কিছু ডিজিটাল বিটিভি আছে যারা সম্পূর্ণ সরকারের তোষামোদী করছে। তা ছাড়া সবাই সাহসী ভূমিকা রাখছে।

প্রসঙ্গ জামায়াত- আওয়ামী লীগের উস্কানি বিপদে বিএনপি

Sunday, January 26, 2014

বিএনপির কারাবন্দি জ্যেষ্ঠ নেতা মওদুদ আহমদ ইঙ্গিত করেছেন যে, ১৯৯১ সালে জামায়াতের সমর্থনে বিএনপি সরকার গঠন করে ‘আওয়ামী লীগের উস্কানিতেই’ জামায়াতকে বিপদে ফেলেছিল।
আবার তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার দাবির মুখেই জেনারেল এরশাদকে গুলশানের সাব-জেল থেকে কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়েছিল। অথচ আওয়ামী লীগ পরে এই দু’টি দলকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপির নির্বাচিত সরকার উৎখাতের আন্দোলনে শরিক হয়েছিল।

২০১২ সালে মওদুদ আহমদের বইটি প্রকাশ করেছে ইউপিএল। ‘বাংলাদেশ এ স্টাডি অব দ্য ডেমোক্রেটিক রেজিমস’ শীর্ষক বইয়ে মওদুদ আহমদ জামায়াত-বিএনপি সমঝোতা এবং তা ভঙ্গ হওয়ার নেপথ্য ইতিহাস বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। মওদুদের বর্ণনা মতে, জেনারেল মোহাম্মদ নুর উদ্দীন খান খালেদা জিয়া ও গোলাম আযমের মধ্যে দূতিয়ালি করেন। স্থান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জি ডব্লিউ চৌধুরীর বাসভবন। এখানে বেগম খালেদা জিয়া, গোলাম আযম ও মতিউর রহমান নিজামীর মধ্যে বৈঠকটি হয়। সে সময় ১৮ আসনধারী জামায়াত ওই বৈঠকের পর প্রেসিডেন্টকে লিখিতভাবে বিএনপিকে সমর্থনের কথা জানিয়ে দেয়।
মওদুদ লিখেছেন, ‘কি করে সমঝোতা রদ হলো সে প্রশ্নটি কোন আদালতের মামলার বিষয় ছিল না। কিংবা তার নাগরিকত্বের কারিগরি দিক নিয়েও ছিল না। এমনকি অধ্যাপক গোলাম আযম একজন কোলাবরেটর ছিলেন কি ছিলেন না কিংবা এই প্রশ্নও ছিল না যে বাংলাদেশ থেকে তাকে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল কি ছিল না।’
এরপর মওদুদ বলেন, ‘কিন্তু এই প্রশ্নটি এক বিশাল বিস্ময়ের সঙ্গে তোলা যেতে পারে যে কি করে জামায়াতের সমর্থন নিয়ে গঠিত সরকার তাদের আমীরকেই কারাগারে পাঠিয়েছিল? সেটা কেবল দুই নেতার মধ্যকার সমঝোতার লঙ্ঘন নয় সেটা রাজনৈতিক আস্থা ও বিশ্বাসের ক্ষেত্রে একটি ঘোরতর প্রতারণাও বটে। যদি জামায়াত ও অধ্যাপক  গোলাম আযম পাাকিস্তানি দখলদার সরকারের সহযোগীই হয়ে থাকবেন, তাহলে বেগম জিয়া কেন সরকার গঠনে ১১ বামপন্থি সংসদ সদস্যের সমর্থন নিলেন না?’ তিনি ইঙ্গিত দেন যে, ওই বামেরা যাদের কেউ কেউ এখন মহাজোটে সক্রিয় তারা খালেদা জিয়াকে সমর্থন দিতে চেয়েছিলেন।
মওদুদ আরও লিখেছেন, গোলাম আযম দেশের ভেতরে ও বাইরে সক্রিয়ভাবে বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণায় অংশ নেন বলে বিএনপি সরকারের পক্ষে আদালতে দেয়া বিবৃতিতে বলা হয়। ১৯৭১ সালের পর গোলাম আযম পাকিস্তানের নাগরিক হন। বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্যের শপথ তিনি নেননি। জামায়াতে ইসলামীর সশস্ত্র ক্যাডাররা রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেয় কেবল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহায়তা করতেই। গোলাম আযম বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে রাজাকার, আলবদর এবং আল-শামসের মতো বাহিনী গঠনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সাহায্য করেন। ১৯৭১ সালের এপ্রিলে বর্বর জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে তাকে দেখা যায়। অধ্যাপক আযমকে লিবিয়ায় একটি সম্মেলনে যোগ দিতেও দেখা যায়। সেখানে তিনি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিতে ইসলামী পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের প্রতি আবেদন জানান। মুজিব সরকার গোলাম আযমসহ ৩৮ জনকে তাই বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে অযোগ্য ঘোষণা করে।
মওদুদ আহমদ তথ্য প্রকাশ করেন যে, ‘জামায়াতে ইসলামীর আমীর হিসেবে গোলাম আযমের নিয়োগ এবং তার নাগরিকত্ব ফেরত দান ছিল সমঝোতার শর্ত। মওদুদ আহমদ পরোক্ষ মন্তব্য করেন যে, সেদিন প্রকারান্তরে জামায়াতের সঙ্গে বিশ্বাস ভঙ্গ করা হয়েছিল। নাগরিকত্ব ও আমীরত্ব না দিয়ে বরং তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। গোলাম আযম কারাগারে ছিলেন পুরো রমজান মাস।
এরশাদ ও জাপা: মওদুদ মনে করেন, ১৯৯০ সালের ৬ই ডিসেম্বরের পর জেনারেল এরশাদের জাতীয় পার্টি ও তার নেতাকর্মীদের প্রতি বিএনপি প্রতিহিংসার রাজনীতি অনুসরণ করে। তার ভাষায়, ‘অভিযোগ রয়েছে যে জামায়াতে ইসলামীর মতোই জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধেও বিএনপি প্রতিহিংসামূলক নীতির আশ্রয় নিয়েছিল। আর তাতে আওয়ামী লীগ অনেকটাই উস্কানি দিয়েছিল। এর ফলে ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকারের সঙ্গে দেশের প্রধান ধারার দল এবং শক্তিশালী মিত্রদের সঙ্গে তার দূরত্ব সৃষ্টি করে।’
মওদুদ আহমদ স্মৃতিচারণ করেন যে, ‘সংসদে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনা বলেছিলেন যে, এরশাদ কেন কূটনৈতিক এলাকার বিলাসবহুল বাড়িতে থাকবেন? এরপরই খালেদা জিয়া তাকে কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠান। আবার গোলাম আযমের ক্ষেত্রেও দলটি একই সুর তোলে। বলে যে, বাংলাদেশের নাগরিক না হওয়া সত্ত্বেও গোলাম আযম কেন আইন লঙ্ঘন করে বাংলাদেশে থাকবেন? দেশের একটি রাজনৈতিক দলের আমীর হবেন? তখন বিএনপি সরকার অমনি তাকে দ্রুত দেশের বাইরে পাঠাতে তোড়জোড় শুরু করে। অথচ সময় গড়ালে দেখা গেল জামায়াত ও জাতীয় পার্টি সেই আওয়ামী লীগের সঙ্গেই হাত মিলিয়ে ১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকারের অসম্মানজনক গদিচ্যুতি নিশ্চিত করেছিল।’

আওয়ামী লীগের টার্গেট ইমেজ উদ্ধার by লুৎফর রহমান

ইমেজ উদ্ধারের টার্গেট নিয়ে সামনে যেতে চায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন নতুন সরকার। আপাতত সরকারের মেয়াদ নিয়েও ভাবছে না ক্ষমতাসীন দল।
বরং পরিস্থিতি বিবেচনায় মধ্যবর্তী নির্বাচন দেয়াকে সুবিধাজনক মনে হলে নির্বাচন আয়োজনেও আপত্তি থাকবে না তাদের। তবে এই মুহূর্তে স্থানীয় সরকার নির্বাচন এবং সংলাপ ইস্যুতে বিরোধী জোটকে ব্যস্ত রেখে দল এবং সরকারের ইমেজ উদ্ধারের চেষ্টা করবে আওয়ামী লীগ। এ লক্ষ্যে দলীয় এবং সরকারের আলাদা পরিকল্পনাও নেয়া হয়েছে। দলীয় পরিকল্পনার মধ্যে আছে বিতর্কিত ও জনবিচ্ছিন্ন নেতাদের বাদ দিয়ে সাংগঠনিক পুনর্গঠন। এছাড়া বিগত সরকারের নেয়া অসমাপ্ত মেগা প্রকল্পগুলো দ্রুত সময়ে সম্পন্ন করে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে দৃশ্যমান করা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক রেখে সামনে এগোবার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। একই সঙ্গে বিগত সরকারের যেসব মন্ত্রী-এমপিদের প্রতি দলের নেতাকর্মী ও ভোটারদের ক্ষোভ ছিল কৌশলে তাদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের বাইরে রাখা হয়েছে। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদ, সংসদের গুরুত্বপূর্ণ পদে সমালোচিত নেতাদের রাখা হয়নি। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের নেতারা মনে করছেন, সরকার কত দিন চলবে এটি নির্ভর করবে পরিবেশ পরিস্থিতির ওপর। যত দিন নিরাপদে দায়িত্ব চালিয়ে যেতে পারে নতুন সরকার, ততদিন দায়িত্ব পালন করে যাবে। এক্ষেত্রে অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে মানুষের ভাল ইমেজ গড়ার চেষ্টা করা হবে। এটি করা সম্ভব হলে যখনই নির্বাচন হোক না কেন এতে ফল আওয়ামী লীগের ঘরেই আসবে। দলের একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সরকারের মন্ত্রী বলেন, সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে। সাংবিধানিকভাবে পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার অধিকার আছে। তবে সবার অংশগ্রহণে নির্বাচনে যে কথা বলা হচ্ছে তা নির্ভর করবে পরিবেশ পরিস্থিতির ওপর। বিরোধী জোট যদি সহিংস কর্মসূচি বাদ দিয়ে সংলাপের পরিবেশ তৈরি করে তাহলে সংলাপ হতে পারে। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের কোন আপত্তি নেই। সরকার ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে চলার চেষ্টা করবে বলে জানান তিনি। সরকারের এ মন্ত্রী জানান, দলের মন্ত্রী-এমপিদের অনেকের প্রতি মানুষের বিরূপ ধারণা ছিল। নতুন সরকারে তাদের সেভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র জানিয়েছে, বিগত পাঁচ বছরে সাংগঠনিক যে স্থবিরতা তৈরি হয়েছিল তা দ্রুতই কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করা হবে। বিতর্কিত ও জনবিচ্ছিন্ন নেতাদের সরিয়ে নতুন নেতৃত্বকে সামনে আনা হবে। এক্ষেত্রে চলতি বছরে বিশেষ কাউন্সিলও আহ্বান করা হতে পারে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনসহ বিভিন্ন নির্বাচিত পদে তরুণ ও ত্যাগী নেতাদের নির্বাচিত করারও চেষ্টা করা হবে দলীয়ভাবে। এজন্য উপজেলা নির্বাচনে দলের একক প্রার্থী রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে কেন্দ্র থেকে। দলের নির্দেশনার বাইরে কেউ প্রার্থী হলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য স্থানীয় পর্যায়ে বার্তা পাঠানো হয়েছে। সূত্র বলছে, উপজেলা নির্বাচন শেষ হলে জেলা পরিষদের নির্বাচনের উদ্যোগ নেয়া হবে। দীর্ঘ দিন থেকে প্রশাসক দিয়ে চলা জেলা পরিষদের দলের নেতাদের নির্বাচিত করে আনার পরিকল্পনা রয়েছে আওয়ামী লীগের। এদিকে সরকারের কর্মপরিকল্পনার রয়েছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের নির্বাচন দাবিকে অন্যান্য ইস্যু দিয়ে চাপা দিয়ে রাখা, নির্বাচন ও নির্বাচন পূর্ববর্তী সময়ে সংগঠিত সহিংস গঠনার বিচার ও দায়ীদের আইনের আওতায় আনা। পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করা, কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে সরকারের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়। সূত্রমতে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সার্বিক দিক প্রধানমন্ত্রী নিজেই তদারক করছেন। এজন্য শুরু দিকে এ মন্ত্রণালয়ে শুধু প্রতিমন্ত্রী নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এ মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রীই দেবেন। সরকারের শুরুতে কূটনৈতিক চাপ এড়ানোর অংশ হিসেবে এ মন্ত্রণালয়ে পূর্ণ মন্ত্রী নিয়োগ দেয়া হয়নি। এ মন্ত্রণালয়ের সার্বিক কার্যক্রমও প্রধানমন্ত্রী সরাসরি তদারিক করছেন। এক্ষেত্রে তার পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী সহায়তা করছেন। আপাতত প্রতিমন্ত্রীকে এ মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব দেয়া হলেও নির্বাচনকালীন সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে কিছুদিনের মধ্যেই এ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হতে পারে। বিগত সরকারের বিতর্কিত মন্ত্রীদের অনেকে বাদ পড়েছেন দলীয় পরিকল্পনার আলোকে। অপেক্ষাকৃত অনভিজ্ঞদের মন্ত্রণালয়ে আনাও একই লক্ষ্য থেকে। জাতীয় সংসদে চিফ হুইপ পরিবর্তন করা হয়েছে। হুইপদেরও সরিয়ে নতুনদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। দলীয় সূত্র জানিয়েছে, দশম সংসদের সংসদীয় কমিটিগুলোর চেয়ারম্যান নিয়োগের সময় স্বচ্ছ এবং ভাল ইমেজের এমপিদের গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কোন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত কাউকে ওই মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির সভাপতি নিয়োগ করা হবে না। সরকারি সূত্র বলছে, দু্রততম সময়ের মধ্যেই সরকার দৃশ্যমান উন্নয়নকাজ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। এর মধ্যে পদ্মা সেতুর কাজ শুরুকে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে তৎপরতা শুরু করেছে সংশ্লিষ্ট বিভাগ। রাজধানীতে নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারগুলোর কাজও দ্রুত শেষ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।  ঢাকা-ময়মনসিংহ ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চার লেন কাজ দ্রুত শেষ করার পরিকল্পনা নিয়েছে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়। এদিকে কম ভোটার উপস্থিতি ও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রেকর্ডসংখ্যক প্রার্থী এমপি হওয়ায় নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে যে বিতর্ক এবং গ্রহণযোগ্যতার সঙ্কট রয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে কূটনৈতিক তৎপরতাও জোরদার করা হয়েছে। সরকারের নীতি নির্ধারকদের মতে, ইতিমধ্যে অনেক দেশ নতুন সরকারকে অভিনন্দন জানিয়ে সহযোগিতা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত থাকলে যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অন্যান্য দেশের মনোভাবও পরিবর্তন হবে বলে মনে করছেন সরকারের নীতি নির্ধারকরা। আর এ লক্ষ্য দিয়ে কূটনৈতিক তৎপরতাও শুরু হয়েছে। এছাড়া বিগত সময়ে কিছু দাতা সংস্থার সঙ্গে সরকারের টানাপড়েন থাকলেও সামনে তাদের পরামর্শকে ইতিবাচক হিসেবে ধরে এগোতে চায় নতুন সরকার। এ জন্য দাতাদের পরামর্শ অনুযায়ী প্রকল্প প্রণয়ন ও অর্থায়নে গুরুত্ব দেয়ার কথাও ভাবা হচ্ছে। এদিকে দাতা ও বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর চাপেই বিরোধী দলের সভা-সমাবেশে বাধা দেয়া থেকে সরে আসছে সরকার। একই সঙ্গে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা থেকে নেতাদের জামিন ও মুক্তির ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে না। সূত্র বলছে, সার্বিক ক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক আবহ তৈরি হলে তা সরকারি দলের জন্য পরবর্তী নির্বাচন বৈতরণী পার হওয়া সহজ হবে। এমন একটি পরিবেশ তৈরিই এখন সরকারের চূড়ান্ত লক্ষ্য।

নগর দর্পণ: চট্টগ্রাম- আওয়ামী লীগে এলে তিন খুন মাফ? by বিশ্বজিৎ চৌধুরী

Monday, January 20, 2014

একসঙ্গে একই পরিবারের তিনজনকে হত্যার ঘটনা তখন তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল চট্টগ্রামে। সেটা ২০০৪ সাল। সে বছর ২৯ জুন রাতে ব্রাশফায়ারে নির্মমভাবে খুন হন শিবির ক্যাডার সাইফুল আলম,
তাঁর বড় ভাই মো. আলমগীর ও বোন মনোয়ারা বেগম। এই হত্যার জন্য অভিযোগের আঙুল ওঠে শিবিরেরই ক্যাডার আবুল কাশেম, মোহাম্মদ ইউসুফ, নাছির উদ্দিন (গিট্টু নাছির নামে পরিচিত) ও ফয়েজ মুন্নার দিকে। ঘটনার পরদিনই নিহত সাইফুলের স্ত্রী আয়েশা আক্তার বাদী হয়ে হত্যা মামলা দায়ের করেন এই চারজনের বিরুদ্ধে। ২০০৫ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি এজাহারভুক্ত চারজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেন বায়েজিদ বোস্তামী থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)। এর মধ্যে র‌্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা যান দুই আসামি নাছির উদ্দিন ও ফয়েজ মুন্না।

২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এলে আওয়ামী লীগে যোগ দেন আবুল কাশেম ও মোহাম্মদ ইউসুফ। এই যোগদানের ঘটনা সরকারি দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের কতটা উদ্বুদ্ধ করেছিল জানি না, কিন্তু এক বছরের মধ্যেই শিবির ক্যাডার ও হত্যা মামলার আসামি আবুল কাশেম ‘অলংকৃত’ করেছেন জালালাবাদ ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহসভাপতির পদ।
জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাস ও নাশকতার বিরুদ্ধে অবিরাম গলা ফাটাচ্ছেন যে দলের নেতা-কর্মীরা, সেই দলে যোগ দিয়েই যেন ‘পরশ পাথরের’ ছোঁয়া পেলেন শিবিরের এসব ক্যাডার। সব গরল রূপান্তরিত হলো অমৃতে। আবুল কাশেম তাঁর ও সহকর্মীর বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারের জন্য আবেদন করেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। সেই আবেদনে সুপারিশ করেন তৎকালীন নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত কাজী ইনামুল হক। এখন ‘রাজনৈতিক বিবেচনায়’ মামলাটি প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া চলছে বলে জানা গেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইন শাখা থেকে আসা এ-সংক্রান্ত একটি চিঠি আদালতে দেওয়া হয়েছে।
মামলার সরকারি কৌঁসুলি অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর (এপিপি) অশোক কুমার দাশ কয়েক দিন আগে পত্রিকান্তরে জানিয়েছেন, শিবির ক্যাডার কর্তৃক তিনজনকে খুনের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলা প্রত্যাহারের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিঠি পাওয়ার পর গত ২৫ অক্টোবর আদালতে আবেদন করা হয়। গত ৫ নভেম্বর আবেদনের ওপর শুনানি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে শুনানি হয়নি। পরবর্তী শুনানির জন্য ধার্য তারিখে আদালত মামলাটি প্রত্যাহারের আদেশ দিতে পারেন।
মামলা প্রত্যাহারসংক্রান্ত জাতীয় কমিটির ৩১তম বৈঠকে শিবিরের তিন খুনের মামলাটি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত হয়। এর আগে একই কমিটির ১৭তম বৈঠকেও একবার মামলাটি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও গণমাধ্যমে বিষয়টি সমালোচিত হলে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে জাতীয় কমিটি।
দলীয় কোন্দলে খুন হয়েছিলেন সাইফুল ও তাঁর ভাইবোনেরা। এর আগে চট্টগ্রাম বন্দরের সাবেক চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম রব্বানী হত্যা মামলায় শিবির ক্যাডার নাছির ও তাঁর ভাই মনছুরকে আসামি করা হলে শিবিরের একটি পক্ষ সন্দেহ করেছিল সাইফুলকে। ধারণা করা হয়, সাইফুল তাঁদের ফাঁসিয়েছেন—এমন সন্দেহের কারণেই ভাইবোনসহ প্রাণ দিতে হয়েছে তাঁকে।
রাজনীতির ক্ষেত্রে ভোল পাল্টানোর নজির এ দেশে কম নেই। ‘আল্লাহর আইন’ প্রতিষ্ঠার জন্য ‘শহীদ’ হওয়ার অঙ্গীকার করা নেতা-কর্মীর ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিকে’ রূপান্তরিত হওয়ার নজিরও কম নয়। কিন্তু নতুন দলীয় পরিচয়ের সুবাদে এই আসামিরা অব্যাহতি পেলে মামলার বাদী আয়েশা আক্তার ও তাঁর দুই সন্তানের জীবন কতটা সংশয়মুক্ত থাকবে, কিংবা ২০০৭ সালের আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত ২২ জন সাক্ষীর মধ্যে যে ১৫ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে, তাঁদের জীবনের নিরাপত্তাই বা নিশ্চিত করবে কে? এসব প্রশ্নের জবাব দেওয়ার কেউ নেই।
একই ধরনের ঘটনা ঘটতে চলেছে ফটিকছড়িতেও। এই উপজেলার বহুল আলোচিত ‘ভুজপুর ট্র্যাজেডি’র মূল হোতা হিসেবে চিহ্নিত জামায়াতের তিন নেতাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন। এই ঘটনায় ভুজপুর থানায় যে পাঁচটি মামলা দায়ের করা হয়েছিল, তার কোনোটিতে ২ নম্বর, কোনোটিতে ৩ নম্বর আসামি হিসেবে অভিযুক্ত এই তিন নেতা।
২০১৩ সালের ১১ এপ্রিল ফটিকছড়ির ভুজপুর এলাকায় যে ভয়াবহ রক্তাক্ত তাণ্ডবটি ঘটেছিল, যাদের স্মৃতিতে নেই, তাদের জন্য ঘটনাটি পূর্বাপর উল্লেখ করা এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে না। গত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দুদকের মামলা থাকার কারণে ফটিকছড়ি আসনে প্রার্থী হতে পারেননি আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ রফিকুল আনোয়ার। তাঁর অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগের অন্য প্রার্থীর বিরুদ্ধে জয়ী হয়েছিলেন বিএনপির নেতা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত সালাহউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী। ওই নির্বাচনের পর থেকে সাকা চৌধুরীর ক্যাডারদের সন্ত্রাসের মুখে দলীয় প্রার্থীর পরাজয়ে হতোদ্যম স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা অনেকেই পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। এর মধ্যে রফিকুল আনোয়ারের আকস্মিক মৃত্যুতে আরও অগোছালো হয়ে পড়ে দল।
নির্বাচনের প্রস্তুতি ও দলকে পুনর্গঠিত করার জন্য ২০১৩ সালের ১১ এপ্রিল বড় ধরনের শোডাউনের আয়োজন করেন এখানকার নেতা-কর্মীরা। উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের নেতা পেয়ারুল ইসলামের নেতৃত্বে সেদিন দু-তিন হাজার নেতা-কর্মী এক মিছিলে অংশ নেন। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত ও হেফাজতে ইসলামের কর্মীরা সেদিন মসজিদের মাইকে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে চারদিক থেকে ঘিরে এই মিছিলে হামলা চালালে এক নারকীয় তাণ্ডবের সাক্ষী হয় ভুজপুর এলাকাবাসী। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ফটিকছড়ির এই সংবাদ পড়ে ও দেখে শিউরে ওঠে দেশের মানুষ। যুবলীগ-ছাত্রলীগের কর্মী বিপুল, রুবেল ও ফেরকানকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। আজীবন পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন এ ঘটনায় আহত অনেক নেতা-কর্মী। পুড়িয়ে দেওয়া হয় মাইক্রোবাস, জিপ, ব্যক্তিগত মোটরযান ও দুই শতাধিক মোটরসাইকেল। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ফায়ার সার্ভিসের গাড়িসহ সরকারের কোটি টাকার সম্পদ।
সেই রক্তাক্ত স্মৃতি, কর্মী-সমর্থকদের ওপর নেমে আসা সেই বীভৎসতা আজ ভুলে যেতে চান আওয়ামী লীগের কিছু নেতা। অভিযোগপত্র থেকে তাঁরা বাদ দেওয়ার চেষ্টা করছেন জামায়াতের নেতা নূর মোহাম্মদ আল কাদেরী, ইকবাল চৌধুরী ও শহীদুল আজমকে। তাঁরা তিনজনই ফটিকছড়ির তিনটি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান। উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার, তৃণমূলের এই জনপ্রতিনিধিদের দলে টানতে পারলে ভবিষ্যতে নির্বাচন বা অন্যান্য দলীয় কর্মকাণ্ডে বাড়তি সুবিধা পাওয়া যাবে। কিন্তু দলের নেতা-কর্মীদের রক্তে যে এলাকাটি এখনো সিক্ত, এখনো মানবেতর জীবন যাপন করছেন দলের যে পঙ্গু নেতা-কর্মীরা, তাঁরা কীভাবে মেনে নেবেন আইনের নিজস্ব গতিকে রুদ্ধ করার এই উদ্যোগ!
এই মামলার অন্যতম বাদী জামাল পাশা শওকতের মুখে আমরা শুনি সেই ক্ষোভ। তিনি বলেন, অভিযোগপত্র চূড়ান্ত করার আগে যাতে কোনো নিরীহ লোকের নাম এতে অন্তর্ভুক্ত না হয়, তা যাচাই-বাছাই করার জন্য দলীয়ভাবে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। অথচ অন্যতম বাদী হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে সেই কমিটিতেও রাখা হয়নি। অভিযোগপত্র থেকে জামায়াতের নেতাদের বাদ দেওয়ার খবর শুনে তিনি বলেন, এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হলে তা স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তিকে আবারও ভুজপুরের মতো ঘটনা ঘটাতে উৎসাহিত করবে।
ভুজপুর থানার কর্মকর্তারাও এই অযৌক্তিক উদ্যোগের বিরোধিতা করে বলেছেন, পুরো তদন্ত যেখানে শেষ হয়নি, সেখানে অভিযোগপত্র থেকে কারও নাম বাদ দেওয়ার সুযোগ কোথায়, কারণই বা কী?
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা না জানলেও আমরা কিছুটা আঁচ করতে পারি। হত্যা, সন্ত্রাস ও নাশকতার সঙ্গে জড়িত জামায়াতের নেতা-কর্মীরা এখন চাইবেন ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সমঝোতা করে আইনের হাত থেকে বাঁচতে। আওয়ামী লীগের স্বার্থান্বেষী নেতারা সেই সমঝোতার পথে নিজের স্বার্থ হাসিলের স্বপ্ন দেখছেন। এতে আইনের হাত অকেজো হয়ে পড়বে আর নিহত ব্যক্তিদের পরিবার বা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারও দেখবেন, কীভাবে ‘বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে কাঁদে’!
যশোর-৫ (মনিরামপুর) আসনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীকে বিজয়ী করতে বিএনপি-জামায়াতের কর্মীরা এককাট্টা হয়েছেন—এমন সংবাদ আমরা দেখেছি পত্রপত্রিকায়। সেখানে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান উপদেষ্টা অভিযোগ করেছেন, আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী নাকি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সহিংসতার অভিযোগে জামায়াত-বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলাগুলো তিনি প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করবেন। এই অভিযোগ কতটা সত্য জানি না, তবে এটা তো এখন সহজেই অনুমেয়, সারা দেশে এ রকম অভিযুক্ত নেতা-কর্মীদের আওয়ামী লীগে যোগদানের হিড়িক পড়বে। তাতে মামলার দায় থেকে হয়তো রক্ষাও পাবেন অনেকে। কিন্তু আইনের ওপর ক্ষমতাসীনদের এই হস্তক্ষেপ খারাপ নজির হয়ে থাকবে।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwabd@yahoo.com

মুখর নেতাদের মুখে তালা by পাভেল হায়দার চৌধুরী

Sunday, September 18, 2011

রকারের সমালোচক আওয়ামী লীগ নেতাদের মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। নেতাদের দলীয় ফোরামের বাইরে কথা বলার ব্যাপারে সংযত হওয়ার একটি অলিখিত নির্দেশ জারি করা হয়েছে ইতিমধ্যে। বিভিন্ন সভা-সমাবেশ বা সেমিনারে সরকারের বিরুদ্ধে ব্যর্থতার অভিযোগ বা মন্ত্রীদের কাজের সমালোচনা করে যেসব নেতা সরব ছিলেন, তাঁদের সংযত হয়ে কথা বলার নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। জানা গেছে, সরকারের বিরুদ্ধে ব্যর্থতার অভিযোগ ও মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে সমালোচনা এমন পর্যায়ে পেঁৗছেছে যে বেশ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা ইতিমধ্যে সরকারের কয়েকজন মন্ত্রীর পদত্যাগ পর্যন্ত দাবি করেছেন।
ফলে দলের অভ্যন্তরে নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে বিশেষভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। সরকারও এই সমালোচনা ও অভিযোগের মুখে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছে। এই অবস্থায় দলের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বলা হয়েছে, নেতারা দলীয় ফোরামের বাইরে কথা বললে অবশ্যই তাঁদের সংযত হয়ে কথা বলতে হবে। জানা গেছে, গত শুক্রবার আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বিষয়টি উত্থাপন করেন। তিনি বলেন, এটা দলের ও সরকারের জন্য ক্ষতিকর। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে নেন এবং তাঁর সঙ্গে একমত প্রকাশ করে বলেন, এটা সরকার ও দলের জন্য খুবই বিব্রতকর। তবে সমালোচনাকারী নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যাঁরা মুক্ত ও স্বাধীনভাবে কথা বলে আসছেন, তাঁরা এর সঙ্গে একমত না হলেও আপাতত কিছুটা চুপ হয়ে গেছেন। তবে কেউ কেউ আবার মুক্ত ও স্বাধীনভাবে কথা বলে যাবেন বলেও মনস্থির করেছেন। জানা গেছে, কিছু নেতার স্বাধীন ও মুক্তভাবে কথা বলার কারণে সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে, পাশাপাশি বিরোধী দলের হাতে ইস্যু তুলে দেওয়া হচ্ছে বলে আওয়ামী লীগের অনেকেই মনে করছেন। আবার যাঁরা সরকারের ভুলত্রুটি নিয়ে কথা বলছেন, তাঁরা এটাকে সমালোচনা হিসেবে ধরে না নিয়ে বরং দলের এবং সরকারের মধ্যে যে গণতন্ত্র চলছে, এটাকে তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে দেখছেন। বেশ কিছুদিন ধরে সরকারের নানা ব্যর্থতা চিহ্নিত করে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, আবদুল জলিল, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, ওবায়দুল কাদের, কেন্দ্রীয় নেতা মোহাম্মদ নাসিম সংসদে ও সংসদের বাইরে কঠোর সমালোচনা করে আসছিলেন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত শেয়ারবাজারের অস্থিরতা নিয়ে অর্থমন্ত্রীর সমালোচনা করে তাঁকে পদত্যাগ করার আহ্বান জানান। আওয়ামী লীগ সভাপতির এক উপদেষ্টাকে দরবেশ উপাধি দিয়ে তাঁরও কঠোর সমালোচনা করেন। তোফায়েল আহমেদ যোগাযোগব্যবস্থা ও বিদ্যুৎ পরিস্থিতির সমালোচনা করে সংসদে বলেন, বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় কে চালায়? মোহাম্মদ নাসিম সরকারের স্বরাষ্ট্র, অর্থ ও বাণিজ্যমন্ত্রীকে বেশি কথা না বলে কাজে মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দেন। বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খানের কম খাওয়ার বক্তব্য নিয়ে বেশ কড়া বক্তব্য দেন সুরঞ্জিত, নাসিম ও ওবায়দুল কাদের। এদিকে শেয়ারবাজার নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর এক বক্তৃতার বিরুদ্ধাচরণ করে সরকারদলীয় এমপি আ হ ম মোস্তফা কামাল ওরফে লোটাস কামাল বলেছিলেন, এটা প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক বক্তৃতা। লোটাস কামালের এ বক্তব্য সেই সময়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ ঝড় তোলে।
বিশেষ করে শেয়ারবাজার, যোগাযোগব্যবস্থার বেহাল দশা, দলীয় কর্মকাণ্ডে নিষ্ক্রিয়তা, মন্ত্রী-এমপিদের দূরত্ব ইত্যাদি বিষয়ে সমালোচনা উঠে আসে বিভিন্ন সভ-সমাবেশ ও সেমিনারে। এ নিয়ে গত শুক্রবার দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে এবং বাইরে কথা না বলতে নেতাদের আহ্বান জানানো হয়েছে বলে সূত্রে জানা গেছে। সভা শেষে দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেন, দলের অনেক নেতা সরকারের সমালোচনা করে বাইরে কথা বলছেন, তাতে সরকারের ক্ষতি হচ্ছে। বাইরে কথা না বলে দলে বিভিন্ন ফোরাম রয়েছে, সেখানে কথা বললে দল ও সরকারের জন্য মঙ্গল হবে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা মোহাম্মদ নাসিম কালের কণ্ঠকে বলেন, দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় এ বিষয়ে কথা হয়েছে। দলের সাধারণ সম্পাদক এ বিষয়ে প্রস্তাব এনে সকল পর্যায়ের নেতাদের দলীয় ফোরামের বাইরে বক্তৃতা-বিবৃতিতে যাতে সমালোচনা না করা হয়, তার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করেছেন। এটা ইতিবাচক উল্লেখ করে তিনি বলেন, এতে 'শৃঙ্খলা' থাকে। দলের সমালোচনা দলের ফোরামেই করা উচিত। তিনি বলেন, কখনো কখনো এমন সব সমালোচনা হয়, তাতে বিরোধী দলের হাতে অস্ত্র চলে যায়। ওবায়দুল কাদের বলেন, দলীয় ফোরামে কথা বলার ধারা বজায় রাখতে পারলে ভালো। কিন্তু যখন ফোরামের ভেতরের আলোচনা বাইরে চলে আসে, তখন বিষয়টি অতিরঞ্জিত হয়ে যায়। এটা বন্ধ করা উচিত। গত ২৫ আগস্ট সরকারের ব্যর্থতার আওয়াজ তুলে শত্রুর হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়ার কোনো অর্থ হয় না_জাতীয় সংসদে ভাষণ দিতে গিয়ে এমন মন্তব্য করেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে নিজ দলের সমালোচনাকারীদের জবাবে এভাবেই মন্তব্য করেন তিনি।
সেই সব সমালোচনা : ১০ সেপ্টেম্বর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে 'ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফর নিয়ে আমাদের দায়িত্বশীলদের অতিকথনে অতি আশা জাগলেও প্রত্যাশার তুলনায় প্রাপ্তি আশানুরূপ হয়নি।' তবে ওবায়দুল কাদের সবাইকে আশ্বস্ত করে বলেন, হতাশার কিছু নেই। অচিরেই তিস্তা চুক্তি হবে। ২৩ আগস্ট বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের প্রতি সংসদে আবারও ক্ষোভ প্রকাশ করেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও সরকারদলীয় সিনিয়র সংসদ সদস্য তোফায়েল আহমেদ। সংসদে বাতিল নোটিশের ওপর দুই মিনিটের আলোচনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, 'বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টাকে জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হয় না। কিন্তু আমাদের জবাবদিহি করতে হয়। তাঁকে পাওয়াও যায় না। অন্যদিকে প্রতিমন্ত্রী সংসদে উপস্থিত থাকেন না।' বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় চালায় কে_এমন প্রশ্নও তোলেন তিনি। কৃষি ব্যাংক মিলনায়তনে গত ২০ আগস্ট যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের প্রতি ইঙ্গিত করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, 'আমাদের মন্ত্রীদের চেহারা উজ্জ্বল, রাস্তাঘাটের কেন বেহাল দশা?' তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, বাজেটে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেওয়ার পরও যোগাযোগব্যবস্থা কেন ভেঙে পড়বে? রাস্তাঘাটের অবস্থা কেন এমন হবে? যোগাযোগমন্ত্রী কাজের চেয়ে কথা বেশি বলেন। কিছু হলেই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে জরুরি বৈঠক কেন? সবই যদি প্রধানমন্ত্রীকে করতে হয়, তাহলে মন্ত্রীদের প্রয়োজন কী? নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, সুচিন্তিতভাবে কথা বলুন। ঈদের আগে যাতে নির্বিঘ্নে মানুষ বাড়ি ফিরতে পারে, তার ব্যবস্থা করার দিকে নজর দিন। এ সময় তিনি সড়ক ও সেতু বিভাগের মধ্যকার বিভেদ দ্রুততার সঙ্গে সমাধানের পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, সমস্যা সমাধানের জন্য এ বিভেদ দূর করতে হবে। ১৪ আগস্ট আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ওবায়দুল কাদের এমপি বলেছেন, 'আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর কিছু ধান্দাবাজ মুজিবকোট পরে অর্থ আত্মসাৎসহ নানা অপকর্ম চালায়। তাদের অপকর্ম বঙ্গবন্ধুর আত্মাকে কলুষিত করছে। এসব মেকি আওয়ামী লীগার ও স্বার্থান্বেষী মহল সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে। সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার বেহাল দশায় ক্ষোভ প্রকাশ করে ওবায়দুল কাদের আরো বলেন, ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কসহ প্রতিটি মহাসড়ক চাঁদের মতো খানা-খন্দে ভরা। সারা দেশের রাস্তাগুলো ভেঙে গেছে। উড়াল সেতু-পাতাল রেলের স্বপ্ন বাদ দিয়ে আগে অধিক প্রয়োজনের দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে বেশি নজর দিয়ে কাজ করতে হবে। মানুষের প্রয়োজন বুঝে মনের কথা ভেবে কাজ করতে হবে। ১৪ আগস্ট মিরপুর বাঙলা কলেজে ঈদকে সামনে রেখে দেশজুড়ে চাঁদাবাজির মহোৎসব চলছে বলে অভিযোগ করেছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, কাঁচাবাজার, ফুটপাত, লঞ্চঘাট থেকে শুরু করে সর্বত্রই ফ্রি-স্টাইলে চাঁদাবাজি চলছে। এ সত্যকে চাপা দিয়ে লাভ হবে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীকে এগুলো কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। নিত্যদিনের বেড়ে চলা দুর্ভোগ ও সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার পেছনে মন্ত্রী, ছাত্রলীগ ও প্রশাসনের ভূমিকাকে দায়ী করে ওবায়দুল কাদের বলেন, 'আমাদের দক্ষ টিম লিডার আছেন। কিন্তু শক্তিশালী টিম নেই। জনদুর্ভোগ কমাতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সরকারের দায়িত্বশীলদের সমন্বয় নেই।' পুঁজিবাজারে বিক্ষুব্ধ ব্যবসায়ীদের ফটকাবাজ বলা বা রমজানে কম খেতে মন্ত্রীদের পরামর্শের সমালোচনা করে ওবায়দুল কাদের বলেন, ফ্রি-স্টাইলে কথা না বলে কাজের কাজ করুন। কম কথা বলে বেশি কাজ করুন। ভুক্তভোগী জনগণ এসবের সরব প্রতিবাদ না জানালেও আগামী নির্বাচনে নীরব ভোটে ক্ষমতাসীন দল এর জবাব পাবে। তিনি সরকারের ভাবমূর্তি কতটা খারাপ হয়ে উঠছে, তা বিবেচনায় নিয়ে দায়িত্বশীলদের সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দেন।
৫ আগস্ট বাণিজ্যমন্ত্রী মো. ফারুক খানকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে না পারলে প্রধানমন্ত্রীর কাছে অপারগতা প্রকাশ করে চলে যান। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খানকে উদ্দেশ করে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, বক্তৃতা-বিবৃতি নয়, কাজের কাজটি করুন। পাবলিক সেক্টরে কার্যকর ভূমিকা রাখুন। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়ার ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের আলোচনা সভায় মোহাম্মদ নাসিম সরকারের মন্ত্রীদের সমালোচনা করে বলেন, সরকারের মন্ত্রীরা কাজ করার পর বলবেন ভুল হয়েছে। দুই বছর পর 'ভুল হয়েছে' জনগণ এ কথা শুনতে চায় না। মন্ত্রীদের ভুলের কারণে দল ও জনগণ ভোগান্তির শিকার হবে, এটাও কাম্য নয়। তাই ভুল করার আগে চিন্তা করা উচিত। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে আরো কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়ে অন্য একটি অনুষ্ঠানে এ নেতা বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে শুধু আদর-সোহাগ করলেই হবে না, শাসনও করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সড়কদ্বীপে এক অনুষ্ঠানে সুরঞ্জিত সেন বলেন, সংসদ নয়। দেশে এখন আইন প্রণয়ন করে আমলারা। অন্য একটি অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, মিলিটারি মেজাজে কথা বললে জিনিসপত্রের দাম কমবে না। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে জনতার প্রত্যাশা আয়োজিত এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে ওবায়দুল কাদের বলেন, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের টাকা যারা হাতিয়ে নিয়েছে, তারা ঠাণ্ডা মাথার খুনি। শেয়ার কেলেঙ্কারির ঘটনা প্রসঙ্গে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, 'কয়েকজন স্বার্থান্বেষী দলের বদনাম করবে আর আমরা বসে আঙুল চুষব, তা হতে পারে না। নিম্ন ও মধ্যবিত্তের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা টাকা ফেরত দিতে হবে। লুণ্ঠনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। ইব্রাহিম খালেদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মানহানি মামলার সমালোচনা করে তিনি বলেন, পুঁজিবাজার বিপর্যয়ের ঘটনায় যারা জড়িত, তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া উচিত হবে না। গুটিকয়েক নেতার জন্য আওয়ামী লীগ দোষী হতে পারে না। দরবেশ, ইমাম, মোয়াজ্জেন_এরা কারা, তাদের সামনে আনতে হবে।' এসব বিষয়ে দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব-উল-আলম হানিফ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'যেখানে-সেখানে সরকারের সমালোচনা না করার সিদ্ধান্ত ইতিবাচক। আমাদের যেহেতু উপদেষ্টা পরিষদ, সভাপতিমণ্ডলী, সম্পাদকমণ্ডলী, সংসদীয় দল, কার্যনির্বাহী সংসদ_এ ধরনের বিভিন্ন ফোরাম রয়েছে, তাই দলের ফোরামের বাইরে কথা বলা আমাদের মোটেই সমীচীন হবে না।'

তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থা নিয়ে আন্দোলনের সেকাল, একাল

Sunday, June 12, 2011

৮ বছর আগের ঘটনা। ১৯৯৩ সালের ৬ ডিসেম্বর রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে এক জনসভায় তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা বিএনপি সরকারের উদ্দেশে বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই জাতীয় নির্বাচন হতে হবে। তাই অবিলম্বে পদত্যাগ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিন। অন্যথায় সারা দেশে গণআন্দোলন গড়ে তোলা হবে।’ একই দিন জাতীয় সংসদে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি নাকচ করে দিয়ে বলেন, ‘জনগণ ভোট দিয়েছে সংসদে এসে কথা বলার জন্য। হরতাল, ভাঙচুর করে দেশের উন্নয়ন হবে না। যা বলার সংসদে এসে বলুন। আসুন, সংসদে আলোচনা করে সব সমস্যার সমাধান করি।’

১৯৯৩ সালের ৭ ডিসেম্বর ভোরের কাগজ-এর প্রথম পাতায় এ সংবাদ ছাপা হয়েছিল। ১৮ বছর আগে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার দাবিতে হরতাল-অবরোধ করেছে। বিএনপি সে সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিকে অসাংবিধানিক উল্লেখ করে আওয়ামী লীগকে সংসদে এসে সব বিষয়ে আলোচনার আহ্বান জানিয়েছে।
আর এখন বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে রাজপথে। আওয়ামী লীগ সংসদে এসে আলোচনার আহ্বান জানাচ্ছে।
১৯৯৩ সালের শেষ দিকে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি সামনে নিয়ে আসেন। সারা দেশে গণআন্দোলন গড়ে তোলেন। ১৯৯৪ সালের ১০ ও ২৬ এপ্রিল এই দাবিতে হরতাল ডাকে আওয়ামী লীগ। এরপর সচিবালয় ঘেরাও, অবরোধ, মশাল মিছিল, পদযাত্রাসহ নানা কর্মসূচি পালন করে দলটি। বিএনপি বিরোধী দলের এই দাবিকে পুরোপুরি অযৌক্তিক বলতে থাকে। এ পরিস্থিতিতে ’৯৪ সালের ৩ জুন দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী নেতারা শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে আলোচনার মাধ্যমে সব সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানান।
ওই সময়ের পত্রপত্রিকা ঘেঁটে দেখা যায়, ’৯৪ সালের ২৭ জুন সংসদ ভবনে বিরোধীদলীয় নেতার সম্মেলনকক্ষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীসহ সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী পাঁচটি বিরোধী দল এ সময় উপস্থিত ছিল।
এ রূপরেখার প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী আবদুস সালাম তালুকদার সংসদে বলেন, অসাংবিধানিক কোনো দাবি মেনে নেওয়া যায় না। নিরপেক্ষ ব্যক্তির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হওয়া সম্পর্কে খালেদা জিয়া সে সময় বলেছিলেন, ‘পাগল এবং শিশু ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ নন।’
১৯৯৪ সালের ১ অক্টোবর ঢাকার মানিক মিয়া এভিনিউতে এক সমাবেশে খালেদা জিয়া বলেন, ‘গণতান্ত্রিক সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে এবং হতে হবে। কারণ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধান পরিপন্থী। ৩ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়া হরতাল ও নৈরাজ্যের কড়া সমালোচনা করে বলেন, ‘গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের সরকার পরিচালিত আর্থসামাজিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বাধা সৃষ্টি করা কারও জন্যই শোভন নয়।’ জাতীয় সংসদকে সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু অভিহিত করে খালেদা জিয়া বলেন, ‘সংসদেই সব বিষয়ের নিষ্পত্তি সম্ভব।’ (ভোরের কাগজ, ৪ অক্টোবর ১৯৯৪)
রাজনৈতিক সমঝোতার লক্ষ্যে কমনওয়েলথের মহাসচিব এমেকা এনিয়াওকুর বিশেষ দূত স্যার নিনিয়ান স্টিফেন ’৯৪ সালের ১৩ অক্টোবর ঢাকায় আসেন। তিনি সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে বৈঠক করেন। একপর্যায়ে তিনি প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ১১ সদস্যের একটি সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা গঠনের কথা বলেন। এই সরকারে প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারি দলের পাঁচজন এবং বিরোধী দলের পাঁচজন মন্ত্রী থাকার প্রস্তাব করেন। আওয়ামী লীগ এই দাবি নাকচ করে দেয়। ’৯৪-এর ২৮ ডিসেম্বর পঞ্চম সংসদের ১৪৭ জন বিরোধীদলীয় সদস্য একযোগে পদত্যাগ করেন। এরপর শুরু হয় টানা হরতাল-আন্দোলন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি না মেনে ’৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন করে বিএনপি। আওয়ামী লীগ এই নির্বাচন বর্জন করে আন্দোলন করতে থাকে। ’৯৬-এর ৯ মার্চ থেকে সারা দেশে অনির্দিষ্টকালের হরতাল ডাকে আওয়ামী লীগ। ১০ মার্চ শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে অনড় অবস্থানের কথা জানিয়ে দেন।
আওয়ামী লীগের আন্দোলন সত্ত্বেও খালেদা জিয়া ২৭ সদস্যের নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করে নতুন সংসদ অধিবেশন শুরু করেন। ’৯৬ সালের ২১ মার্চ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন বসে। এরপর ব্যাপক আন্দোলনের মুখে ওই অধিবেশনেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল আনা হয়। সর্বসম্মতিক্রমে বিলটি পাস হয়। এরপর রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাস ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করেন এবং সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিযুক্ত হন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু হওয়ার পর ১৯৯৬ সালের ১২ জুন সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে ১৯৯৪, ১৯৯৫ ও ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি এবং জামায়াতে ইসলামী অভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে মোট ৯৬ দিন হরতাল, অবরোধ এবং অসহযোগ কর্মসূচি পালন করে। এসব কর্মসূচিতে সকাল-সন্ধ্যা হরতালের পাশাপাশি একটি লাগাতার ৯৬ ঘণ্টা, দুটি ৭২ ঘণ্টা এবং পাঁচটি ৪৮ ঘণ্টার হরতাল ডাকা হয়। তবে ’৯৬ সালে ক্ষমতায় গিয়ে আওয়ামী লীগ হরতাল না করার ঘোষণা দিয়েছিল।
১৯৯১ এবং ২০০১ সালে ক্ষমতায় গিয়ে হরতালের বিপক্ষে কথা বলতে থাকেন খালেদা জিয়া। হরতাল করে দেশকে ধ্বংস না করার জন্যও তিনি বিরোধী দলসহ সবাইকে আহ্বান জানান। সংসদে এসে আলোচনা করে সব সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানান। কিন্তু এখন সংসদে না গিয়ে হরতাল কর্মসূচি দিয়েছে বিএনপি।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সভাপতি মোজাফ্ফর আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, সবকিছুরই যেন পুনরাবৃত্তি চলছে। যখনই যারা ক্ষমতায় গেছে, তারাই প্রশাসনকে কাছে টেনে তাদের পক্ষে সবকিছু করার চেষ্টা করেছে। এটা কাম্য নয়। আর ’৯৬ সালে বিএনপি অনেক দুর্বল অবস্থায় ছিল বলে দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের সে অবস্থা নেই যে তারা দাবি মেনে নিতে বাধ্য হবে।
বর্তমান অবস্থায় করণীয় কী জানতে চাইলে মোজাফ্ফর আহমদ বলেন, তাত্ত্বিকভাবে বলতে গেলে সব সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত সংসদে। এটাই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। কিন্তু সংসদের যে পরিবেশ, সেখানে যেভাবে বিএনপি নেতাদের গিবত করা হয়, তাতে দুই দল মিলে আলোচনা করার কোনো পরিবেশ নেই। একমাত্র সুশীল সমাজই পারে এ অবস্থায় ভূমিকা রাখতে। কিন্তু সেখানেও বিভক্তি। সুশীলরা আনুগত্য দেখাতেই ব্যস্ত। তার পরও যদি শিক্ষক, আইনজীবী সাধারণ মানুষ—সবাই মিলে দুই দলের মধ্যে যোগাযোগ তৈরি করাতে পারে এবং দুই দলকে আলোচনায় বসাতে পারে, তাহলে সমস্যার সমাধান হবে।

প্রত্যয় বাড়ছে বিএনপির by মোশাররফ বাবলু

Saturday, January 22, 2011

পৌর নির্বাচনে সাফল্যের পর এবার জাতীয় সংসদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ ও হবিগঞ্জ-১ আসনে উপনির্বাচনে বিজয়ের টার্গেট নির্ধারণ করেছে বিএনপি। দুটি আসনেই জয়লাভের জন্য মরিয়া চেষ্টা করবে দলটি। বিএনপির নেতারা মনে করছেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থা ভালো হলেও হবিগঞ্জে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে এগিয়ে আছেন তাঁরা।
এ ছাড়া হবিগঞ্জে জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের প্রার্থী সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেওয়ায় বিএনপির প্রত্যয় আরো বেড়েছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে পারলে পৌর নির্বাচনের মতো হবিগঞ্জ-১ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের উপনির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিত।’
উপনির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি নেতারা নির্বাচনী এলাকায় এরই মধ্যে সাংগঠনিক সফর শুরু করেছেন। এরই মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ঘুরে এসেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। দলীয় প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার খালেদ মাহমুদ শ্যামলসহ স্থানীয় নেতা-কর্মীদের নিয়ে তিনি চষে বেড়াচ্ছেন পুরো নির্বাচনী এলাকা। হবিগঞ্জ-১ আসনেও যাওয়ার কথা রয়েছে তাঁর। ২৪ জানুয়ারি হবিগঞ্জ যাচ্ছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জহিরুল ইসলাম হবিগঞ্জ অবস্থান করছেন। বিএনপির সমমনা জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের মাওলানা আবদুল মালিক চৌধুরী হবিগঞ্জ-১ আসনে প্রার্থী হয়েছেন। জানা গেছে, মালিক চৌধুরীকে নিবৃত্ত করে তাঁর সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে জহিরুল ইসলাম হবিগঞ্জ গেছেন। বিএনপি চেয়ারপারসনের অনুরোধে আবদুল মালিক চৌধুরী নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়ে বিএনপিকে সমর্থনের ঘোষণা দিতে পারেন বলে বিএনপির ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে।
আগামী ২৭ জানুয়ারি এ দুই আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্য লুৎফুল হাই সাচ্চু ও দেওয়ান ফরিদ গাজীর মৃত্যুতে এ দুটি আসন শূন্য হয়।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পৌর নির্বাচনে বিজয়ের পর বিএনপির জনসমর্থন আরো বেড়ে গেছে। দলের নেতা-কর্মীরা আÍপ্রত্যয়ী হয়ে উঠেছেন। দলের মধ্যে ঐক্য গড়ে উঠেছে।’
বিএনপির নেতা হারুন আল রশীদ ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসন থেকে এর আগেও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তবে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ নেতা লুৎফুল হাই সাচ্চুর কাছে পরাজিত হন। বিএনপি হারুন আল রশীদকে প্রথমে মনোনয়ন দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তিনি একপর্যায়ে অনীহা প্রকাশ করেন। তাঁর পরিবর্তে ইঞ্জিনিয়ার খালেদ মাহমুদ শ্যামলকে এ আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। শ্যামলের পক্ষে কাজ করছেন হারুন আল রশীদ। এ জন্যই বিএনপি মনে করছে, এখানে তারা ভালো করবে।
হবিগঞ্জ-১ আসনের উপনির্বাচনে জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের মাওলানা আবদুল মালিক চৌধুরী প্রার্থী থাকলে বিএনপির জন্য ক্ষতি হতো। এ জন্য তাঁর সমর্থন আদায়ের জোর চেষ্টা চালান বিএনপি নেতারা। মাওলানা আবদুল মালিক চৌধুরীর প্রার্থিতা প্রত্যাহার নিয়ে জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের নেতাদের সঙ্গে গত বৃহস্পতিবার উমেদনগর মাদ্রাসায় বৈঠক করেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জহিরুল ইসলাম। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন জমিয়তের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি মাওলানা তাফাজ্জল হক, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব শেখ মুজিবুর রহমান, হবিগঞ্জ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও নবনির্বাচিত মেয়র জি কে গউস, বিএনপি প্রার্থী শেখ সুজাত মিয়া, জমিয়তে ওলামায়ের প্রার্থী আবদুল মালিক চৌধুরী প্রমুখ। অবশেষে গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় ওই মাদ্রাসায়ই এক সংবাদ সম্মেলনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন মালিক চৌধুরী। বিএনপি প্রার্থীর পক্ষে কাজ করারও ঘোষণা দেন তিনি। পরে ফোনে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে ভবিষ্যৎ ঐক্যের স্বার্থে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছি।’
হবিগঞ্জ-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ডা. মুশফিক হোসেন চৌধুরী ও বিএনপির প্রার্থী শেখ সুজাত মিয়ার মধ্যে নির্বাচনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের প্রার্থী নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালে বিএনপি প্রার্থীর অবস্থান আরো ভালো হবে বলে দাবি করছেন বিএনপি নেতারা। দীর্ঘদিন ধরে এ আসন থেকে নির্বাচন করে আসছেন শেখ সুজাত মিয়া। ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী দেওয়ান ফরিদ গাজীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তিনি। কাছাকাছি ভোট পেয়ে পরাজিত হন তিনি। কিন্তু দেওয়ান ফরিদ গাজীর অবর্তমানে সুজাত মিয়া ভালো করবেন বলে আশাবাদী বিএনপি।
এ ব্যাপারে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘গত দুবছরে আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারের একটিও বাস্তবায়ন করতে পারেনি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাÍক অবনতির কারণে দেশের মানুষ সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ। এ কারণে আওয়ামী লীগের ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে জনগণ। পৌর নির্বাচনে জনগণ বিএনপিকে সমর্থন দিয়েছে। আসন্ন দুটি উপনির্বাচনেও বিএনপি প্রার্থীকে ভোট দিয়ে বিজয়ী করবে বলে আশা করি।’

আওয়ামী লীগ উদ্বিগ্ন বিএনপি উৎফুল্ল

Wednesday, January 19, 2011

দ্য সমাপ্ত পৌর নির্বাচনে জয় পেয়ে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নেতা-কর্মীরা উৎফুল্ল। প্রত্যাশিত ফলাফল না পাওয়ায় আশাহত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বিএনপি নেতারা বলছেন, পৌর নির্বাচনে জনগণ সরকারকে হলুদ কার্ড দেখিয়েছে। সামনে লাল কার্ড দেখানোর অপেক্ষায়।

আওয়ামী লীগ নেতারা এই ফলাফলকে দলের জন্য সতর্কসংকেত হিসেবেই দেখছেন। বিএনপি নেতারা মনে করছেন, এই ফলাফলে ঘুরে দাঁড়াবে বিএনপি। ভবিষ্যতে ইউনিয়ন পরিষদ, সিটি করপোরেশন এমনকি জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও এর প্রভাব পড়বে। উদ্বিগ্ন আওয়ামী লীগ নেতাদের মতে, পরাজয় থেকে শিক্ষা নিয়ে দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করতে হবে। রাজশাহী, রংপুর, খুলনা, বরিশাল, ঢাকা, চট্টগ্রাম বিএনপিরও অন্তত দুটি পৌরসভা হাতছাড়া হয়েছে বলে নেতা-কর্মীরা মনে করছেন।
মেয়র পদে সিলেট বিভাগের ১৬টি পৌরসভার মধ্যে ৯টিতে বিএনপি এবং ছয়টিতে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন। একটিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জয়লাভ করেছেন।
বিভাগের ১৬ পৌরসভার মধ্যে সিলেটের দুটিতেই আওয়ামী লীগ, মৌলভীবাজারের পাঁচ পৌরসভার সবকটিতে বিএনপি, সুনামগঞ্জের চার পৌরসভার তিনটিতে আওয়ামী লীগ ও একটিতে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত হবিগঞ্জ জেলার পাঁচ পৌরসভার তিনটিতে বিএনপি, একটিতে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী এবং একটিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জয়লাভ করেছেন।
সিলেটে কানাইঘাট এবং জকিগঞ্জ পৌরসভায় নির্বাচন হয়। দুটিতেই আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন। শেষ মুহূর্তে কানাইঘাট আওয়ামী লীগের কোন্দল মেটাতে উদ্যোগী হন দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ ও জেলা সাধারণ সম্পাদক ইফতেখার হোসেন শামীম। এ সময় থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি জমির উদ্দিন প্রধানকে দল থেকে বহিষ্কারও করা হয়। ফলে দলীয় প্রার্থী লুৎফুর রহমানের বিজয় অনেকটা সহজ হয়ে যায়। এখানে বিএনপির প্রার্থী নির্বাচনে ভুল এবং একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী থাকার কারণে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চলে আসেন জামায়াতের প্রার্থী মো. ওলিউল্লাহ। কানাইঘাটে এবারই প্রথম নির্বাচন হলো।
জকিগঞ্জ পৌরসভায় আওয়ামী লীগের আনোয়ার হোসেন সোনা উল্লা বিজয়ী হয়েছেন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী বর্তমান মেয়র ইকবাল আহমদ। মাত্র ২১৫ ভোটের ব্যবধানে আওয়ামী লীগ প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। এখানে বিএনপির মূল প্রার্থী বদরুল হক বাদল পেয়েছেন সাকল্যে ৩৫১ ভোট।
বিএনপির তৃণমূল নেতাদের মতে, প্রার্থী নির্বাচনে ভুল না করলে এ পৌরসভায় বিএনপি মেয়র পদটি লাভ করত। থানা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান সদস্য অ্যাডভোকেট কাওসার রশীদ বাহার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যোগ্য প্রার্থী নির্বাচনে দল ব্যর্থ হওয়ায় এই ভরাডুবি হয়েছে। বর্তমান মেয়র ইকবাল আহমদ বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েও সামান্য ভোটের ব্যবধানে হেরেছেন।’ দলীয় প্রার্থীর গ্রহণযোগ্যতা না থাকা এবং ভুল সিদ্ধান্তের খেসারত হিসেবে মেয়র পদ হাতছাড়া হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
সুনামগঞ্জে পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপির অবস্থা ছিল নাজুক। জেলার চারটি পৌরসভার মধ্যে একমাত্র জগন্নাথপুর পৌরসভায় বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। কারণ এখানে সাত প্রার্থীর মধ্যে ছয়জনই ছিলেন আওয়ামী লীগের। দলীয় কোন্দলের কারণে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী পরাজিত হন। ছাতক ও সুনামগঞ্জ সদরে কোনো প্রার্থীই দিতে পারেনি বিএনপি। ছাতকে আওয়ামী লীগ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচন করেছে। অন্যদিকে দিরাই পৌরসভায় প্রার্থী দিলেও গ্র“পিংয়ের কারণে জয়লাভ সম্ভব হয়নি।
মৌলভীবাজার জেলায় যে পাঁচ পৌরসভায় নির্বাচন হয়েছে তার চারটিতে আগেই বিএনপি সমর্থিত মেয়র ছিলেন। এবার পাঁচটিতেই বিএনপির প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন। তৃণমূল নেতাদের মতামতকে মূল্যায়ন না করে কেন্দ্র থেকে প্রার্থী চাপিয়ে দেওয়ায় এই ভরাডুবি হয়েছে বলে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা মনে করেন। প্রায় প্রতিটি পৌরসভায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন। কমলগঞ্জ পৌরসভায় দলের প্রার্থী চতুর্থ স্থানে রয়েছেন। এই পরাজয়ের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে জেলার সাবেক কমিটির সহ-প্রচার সম্পাদক নজরুল ইসলাম নাজমুল বলেন, ‘তৃণমূল পর্যায় থেকে যেসব প্রার্থী নির্বাচন করা হয়েছিল, তাঁর একজনকেও কেন্দ্র মনোনয়ন দেয়নি। ভুল প্রার্থী নির্বাচনের কারণে এমন দুরবস্থা হয়েছে।’ দলের ভরাডুবির জন্য অভ্যন্তরীণ কোন্দলকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন তিনি।
হবিগঞ্জ জেলার পাঁচ পৌরসভার মধ্যে তিনটিতেই বিএনপির প্রার্থীরা জয়লাভ করেছেন। পরপর দুবার মেয়র থাকার সুবাদে একমাত্র নবীগঞ্জ পৌরসভায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী জয়লাভ করেছেন। তাও মাত্র ১১২ ভোটের ব্যবধানে। মাধবপুর পৌরসভায় আওয়ামী লীগ সমর্থিত বর্তমান মেয়রকে পরাজিত করেছেন একই দলের বিদ্রোহী প্রার্থী। শায়েস্তাগঞ্জ ও চুনারুঘাটে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী থাকায় ভোট ভাগাভাগির সুবাদে বিএনপি প্রার্থীদের জয়ের পথ সুগম হয়।
সদর পৌরসভায় আওয়ামী লীগে কোন্দল না থাকলেও নির্বাচনের শেষ মুহূর্তে এসে প্রার্থী নির্বাচন এবং বিএনপি আমলের উন্নয়নের বিষয়টি ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ায়। ফলে প্রায় দ্বিগুণ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক বর্তমান মেয়র জি কে গউছ। স্থগিত একটি কেন্দ্র ছাড়াই বর্তমান মেয়র গউছ পেয়েছেন ১৬ হাজার ৫৬০ ভোট। আওয়ামী লীগ প্রার্থী শরীফ উল্লাহ পেয়েছেন ৮ হাজার ৬৩৪ ভোট।
সিলেট বিভাগে পৌর নির্বাচনে নিজ দলের পিছিয়ে পড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ বলেন, ‘সিলেট অঞ্চলের নির্বাচনে কালো টাকার ছড়াছড়ি ছিল। টাকার কাছে অনেক প্রার্থীই দাঁড়াতে পারেননি।’ তবে নিজেদেরও ব্যর্থতা রয়েছে বলে স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমরা মূল্যায়ন করছি।’

দলীয় কোন্দলে ক্ষুব্ধ হাসিনা by পার্থ প্রতীম ভট্টাচার্য্য

Thursday, January 13, 2011

রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপর্যয়ে ক্ষুব্ধ দলের সভাপতি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে এ ধরনের ফলাফল এড়ানোর জন্য ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের পৌর নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীদের এখনই নিষ্ক্রিয় করতে এবং দল ঘোষিত প্রার্থীদের পক্ষে তাঁদের সমর্থন আদায়ে সব রকমের ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।

গত বুধবার অনুষ্ঠিত দুই বিভাগের ৭২ পৌরসভায় আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা কাঙ্ক্ষিত ফল অর্জন না করায় এবং পরবর্তী নির্বাচনে পরাজয়ের আশঙ্কা থেকেই দলের হাইকমান্ড বিদ্রোহী প্রার্থীদের দমনে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন বলে দলীয় সূত্র নিশ্চিত করেছে।
বিদ্রোহী প্রার্থীদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার এবং দল ঘোষিত প্রার্থীদের পক্ষে সমর্থন আনতে ব্যর্থ হওয়ায় বুধবার অনুষ্ঠিত দুই বিভাগের পৌরসভা নির্বাচনে প্রত্যাশিত ফল আসেনি বলে মনে করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
পাশাপাশি দল ঘোষিত প্রার্থীদের পক্ষে স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং মন্ত্রীদের সমর্থন না থাকাকেও পরাজয়ের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগ নেতারা।
জানা গেছে, গত বুধবারের দুটি বিভাগের পৌরসভা নির্বাচনের ফলাফলে অখুশি শেখ হাসিনা গতকাল বৃহস্পতিবার গণভবনে দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এবং সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্লাহর সঙ্গে আলাদা বৈঠক করেন এবং নির্বাচনের ফলাফলে তাঁর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান। তিনি সাধারণ সম্পাদককে নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হওয়া বাকি বিভাগের পৌরসভা নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীদের নির্বাচনের মাঠ থেকে সরানোর জন্য সব রকমের ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন।
সূত্র জানায়, বৈঠকে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা যেসব পৌরসভায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জয়ী হয়েছেন, তাঁদেরকে দলে ফিরিয়ে নেওয়া হবে না এবং বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার কারণে যাঁদেরকে দল থেকে ইতিমধ্যে বহিষ্কার করা হয়েছে, তাঁদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হবে না বলেও তাঁর অবস্থান জানিয়ে দিয়েছেন।
বৈঠকে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেছেন, বিদ্রোহী প্রার্থীদের সঙ্গে যেসব মন্ত্রী, সংসদ সদস্য এবং কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের নেতারা সংশ্লিষ্ট, তাঁদের বিরুদ্ধেও সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবে দল। এ ছাড়া কোনো বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে যদি সেই জেলার নেতারা জড়িত থাকেন, সে ক্ষেত্রে জেলা কমিটি বাতিলেরও নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
দলীয় সূত্র নিশ্চিত করেছে, সারা দেশের পৌরসভা নির্বাচন শেষ হলে নির্বাচনে পরাজয়ের কারণ চিহ্নিত করে বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদকদের কাছে এ ব্যাপারে রিপোর্ট চাওয়া হবে।
পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে মহাজোটের অন্যতম শরিক জাতীয় পার্টির সমঝোতা হয় এবং কেন্দ্রীয়ভাবে একক প্রার্থী ঘোষণা করে দলটি। সে সময় ঘোষণা দেওয়া হয়, দলীয় সিদ্ধান্ত না মেনে বিদ্রোহী প্রার্থী হলে দল থেকে বহিষ্কার করা হবে এবং কিছু কিছু জায়গায় বহিষ্কারের ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু এত কিছুর পরও দলটি বিদ্রোহী প্রার্থীদের নির্বাচনের মাঠ থেকে সরাতে পারেনি।
এ ছাড়া গতকাল সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকেও শেখ হাসিনা দলের পরাজয়ের জন্য বিদ্রোহী প্রার্থীদের দায়ী করেছেন বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে। তবে বরিশাল বিভাগের পৌর নির্বাচনের ফলাফলে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন তিনি।
বিদ্রোহী প্রার্থীদের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পরই দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের পক্ষ থেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের পৌর নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীদের নির্বাচনের মাঠে নিষ্ক্রিয় করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফের বাসায় কেন্দ্রীয় নেতাদের বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বিদ্রোহী প্রার্থীদের পক্ষাবলম্বন করায় এরই মধ্যে কয়েক জায়গায় বহিষ্কার এবং শোকজের ঘটনাও ঘটেছে। কক্সবাজার পৌরসভায় বিদ্রোহী প্রার্থীকে বহিষ্কার এবং নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মোহাম্মদুল্লাহ এবং সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলীকে শোকজ করা হয়েছে বলে দলীয় সূত্র নিশ্চিত করেছে।
প্রথম দিনের নির্বাচনের ফলাফলের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রায় সব পৌরসভায় আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থী ছিলেন। মূলত এ কারণে দল প্রত্যাশিত ফল পায়নি। পাশাপাশি দল ঘোষিত প্রার্থীদের ব্যাপারে স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং মন্ত্রীরা অনেক ক্ষেত্রে একমত হতে পারেননি। তাঁরা দল সমর্থিত প্রার্থীকে সহযোগিতা করলে প্রত্যাশিত ফল পাওয়া সম্ভব হতো বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
রংপুর বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে দল পৌর নির্বাচনে কাক্সিক্ষত ফল পায়নি। তিনি বলেন, ‘দলীয়ভাবে একক প্রার্থী চূড়ান্ত করা হলেও প্রায় প্রতিটি পৌরসভায়ই বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন। আমরা বিদ্রোহী প্রার্থীদের নিষ্ক্রিয় করতে এবং তাঁদের সমর্থন দল ঘোষিত প্রার্থীর পক্ষে আনতে পারিনি।’
উল্লেখ্য, রংপুর বিভাগে মোট ২২টি পৌরসভা নির্বাচনে শুধু দিনাজপুরের সেতাবগঞ্জ ছাড়া সব পৌরসভায়ই আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন।

আ.লীগের একলা চলা ও শরিকদের অবহেলা by জাহাঙ্গীর আলম

Monday, January 3, 2011

রকারে অংশীদারি থাকলেও গত দুই বছরে মহাজোটের শরিকদের মধ্যে খুব একটা সমন্বয় বা যোগাযোগ ছিল না। বলা যায়, অনেকটা নিষ্ক্রিয় ছিল মহাজোটের কর্মকাণ্ড। আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয়েছে হাতে গোনা কয়েকটি। ক্ষমতায় আসার পর সরকারের একলা চলার প্রবণতা কখনো কখনো শরিকদের ক্ষুব্ধ করেছে।

বড় দল হিসেবে শরিকদের গুরুত্ব কম দেওয়া বা অবহেলা করার অভিযোগ রয়েছে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। প্রকাশ্যে কিছু না বললেও প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি নিয়ে মহাজোটে ক্ষোভ-বেদনা আছে। তবে পৌরসভা নির্বাচন ঘিরে সম্প্রতি মহাজোটের তৎপরতা বেড়েছে।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দল ও জাতীয় পার্টির সমন্বয়ে গড়া মহাজোট ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি ১৪ দলের শরিক সাম্যবাদী দলের দিলীপ বড়ুয়া ও জাতীয় পার্টির জি এম কাদেরকে নিয়ে মহাজোটের মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়। ১৪ দলের অপর দুই শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন ও জাসদের হাসানুল হক ইনুকে মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়। জাতীয় পার্টির আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও মজিবুর রহমানকেও সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি করা হয়। ১৪ দলের দুই শরিক ন্যাপের আমেনা বেগম ও গণতন্ত্রী পার্টির রুবী রহমানকে সংরক্ষিত মহিলা আসনে সাংসদ মনোনীত করা হয়।
এসব প্রাপ্তি সম্পর্কে শরিক দলের নেতাদের মত হচ্ছে, পদ বা সরকারে অবস্থান বড় কথা নয়। দল হিসেবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে কি না, সেটাই দেখার বিষয়। তাঁদের অভিযোগ, সরকারের সার্বিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে মহাজোটকে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে না। কেন্দ্রীয় পর্যায়ে অংশীদারিত্ব থাকলেও জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সমন্বয় নেই। এ কারণে মফস্বল পর্যায়েও শরিক দলের নেতাদের মধ্যে ক্ষোভ-বিক্ষোভ আছে।
শরিক দলের নেতারা মনে করেন, মহাজোট নিষ্ক্রিয় থাকায় সরকারের সাফল্য অনুধাবন করা সম্ভব হচ্ছে না। মহাজোটে অংশীদারিত্ব অনুধাবন করা গেলে আরও অনেক দূর এগোনো সম্ভব হতো।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য ওবায়দুল কাদের এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, শরিকদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো দরকার। সমন্বয়ের উদ্যোগ নেওয়ার দায়িত্বও বড় দল হিসেবে আওয়ামী লীগের।
সরকার গঠনের পর প্রথম বর্ষপূর্তিতে প্রধানমন্ত্রীর তখনকার সরকারি বাসভবন যমুনায় মহাজোটের সব শরিকদের নিয়ে প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এ বৈঠকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদসহ শরিকদের শীর্ষ নেতারা অংশ নেন। এরপর এক বছরে ১৪ দল ও মহাজোটের কয়েকটি বৈঠক হয়। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও শরিক দলের নেতাদের কথাবার্তা হয়। এরই মধ্যে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে মহাজোটের সমন্বয়ক করা হয়। গত নভেম্বরে ১৪ দলের বৈঠক মাসে একবার হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এক মাস পর গত ৩১ ডিসেম্বর ১৪ দলের মাসিক বৈঠক হয়। পৌরসভা নির্বাচনে প্রার্থী সমর্থন নিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাসহ দলের সাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে জাতীয় পার্টির কয়েক দফা বৈঠক হয়। জাতীয় পার্টিকে ১৯টি পৌরসভায় মহাজোটগতভাবে প্রার্থী সমর্থন দেওয়া হয়।
ক্ষোভ-বেদনা থাকলেও গত দুই বছর শরিকদের কেউ মহাজোটের ঐক্য-পরিপন্থী কিছু বলেনি। সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় এমন কোনো বক্তব্যও কেউ দেয়নি। বরং মহাজোটের প্রয়োজনীয়তা এবং একে আরও সক্রিয় করার ব্যাপারে শরিকদের সবাই এক বাক্যে একমত।
শরিকদের মধ্যে জাতীয় পার্টির অভিযোগ বেশি। জাপার নেতারা বলেন, গত দুই বছরে মহাজোটের এজেন্ডাভিত্তিক কোনো বৈঠক হয়নি। সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাঁদের সম্পৃক্ত করা হচ্ছে না। এইচ এম এরশাদকে মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষ দূত করার বিষয়টিও এগোয়নি।
সরকারের অবস্থান সম্পর্কে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাতীয় পার্টির এক নেতা বলেন, ‘আমরা প্রধানমন্ত্রীকে ছেড়ে যাইনি। উনিও আমাদের বের করে দেননি, আমাদের রেখেছেন।’
জাতীয় পার্টির নেতাদের অভিযোগ, পৌরসভা নির্বাচনে জাতীয় পার্টিকে ১৯টিতে সমর্থন দেওয়া হলেও আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থীরা সেসব পৌরসভা থেকে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেননি। জাপার মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, জনগণের কল্যাণে মহাজোট নামে যে ঐক্য স্থাপিত হয়েছে, তা থাকবে। কিছুটা মান-অভিমান থাকলেও মহাজোটের ঐক্য জোরদার করার বিকল্প নেই।
১৪ দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মহাজোটে লিয়াজোঁ শিথিল। এটা বাড়ানো দরকার। তা ছাড়া ভারতসহ অনেক দেশেই শরিক দলের মধ্যে ‘কোর’ কমিটি থাকে। এটা এখানে নেই। মহাজোটে কোর কমিটি থাকলে ভালো হতো। জেলা ও উপজেলা পর্যায়েও মহাজোটকে কার্যকর রাখা দরকার। তাঁদের মতে, বিরোধী দল এ মুহূর্তে উঠে-পড়ে লেগেছে। তাই মহাজোট কার্যকর রাখা জরুরি। তাঁদের অভিযোগ, পৌরসভা নির্বাচন নিয়ে ১৪ দলে কার্যকর কোনো আলোচনা হয়নি। কিছু জায়গায় ছাড় দেওয়া হলেও বিদ্রোহী প্রার্থীর ছড়াছড়ি রয়েছে।
১৪ দলের অন্যতম শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন প্রথম আলোকে বলেন, অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক ভিত্তিতে ১৪ দলের ঐক্য আরও শক্তিশালী করা দরকার।
১৪ দলের আরেক নেতা জাসদের হাসানুল হক ইনু বলেন, মৌখিকভাবে ঐক্যের প্রতি সমর্থন দেখানো হলেও মিত্রদের মহাঐক্যকে কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ গাফিলতি দেখিয়েছে। বিগত সময়ে তাদের একলা চলার নীতিটাই প্রাধান্য পেয়েছে। ঐক্যের অংশীদারদের অবহেলা ও উপেক্ষা করা হয়েছে।
শরিকদের এসব অভিযোগ সম্পর্কে আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের সব কথা যে সঙ্গত, তা ঠিক নয়। আবার ক্ষোভ-বিক্ষোভও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে যোগাযোগ বাড়ানো দরকার। বসাবসি হলে দূরত্ব কমে, সম্পর্ক বাড়ে।
 
Support : Dhumketo ধূমকেতু | NewsCtg.Com | KUTUBDIA @ কুতুবদিয়া | eBlog
Copyright © 2013. Edu2News - All Rights Reserved
Template Created by Nejam Kutubi Published by Darianagar Publications
Proudly powered by Dhumketo ধূমকেতু