অস্থির রাজনীতি, স্থবির অর্থনীতি by আলী ইদ্‌রিস

Saturday, January 25, 2014

সাম্প্রতিককালের হরতাল-অবরোধ ও সহিংসতায় দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি ও শিল্পোৎপাদনের যেমন অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, তেমনি বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি ম্লান হয়েছে।
আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় সাম্প্রতিক সহিংসতার ঘটনাবলী দেশকে হানাহানি, মারামারির দেশ হিসেবে তুলে ধরেছে। তদুপরি একতরফা নির্বাচন দেশের গণতন্ত্র চর্চাকে কলঙ্কিত করেছে বিশ্বের দরবারে বিজিএমই-এর এক প্রতিবেদন মতে দেশের সর্ববৃহৎ শিল্প তৈরী পোশাক খাতে উৎপাদন ও রপ্তানি ব্যাহত হওয়ায় ৯,২৫০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে, রপ্তানি আদেশ কমেছে ৩০-৩৫%, অনেক কারখানার হাতে রপ্তানি আদেশ না থাকায় শ্রমিক ছাঁটাই চলছে অথবা বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে, কোন কোন কারখানা শ্রমিকদের বসিয়ে না রেখে আগামী জুন-জুলাই মাসের কাজ এখনই শেষ করে ফেলছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি হলেও তিন মাসের একটি শূন্যতা সৃষ্টি হবে যদি রপ্তানি আদেশ ৭০% কমে যায়। এফবিসিসিআই-এর প্রতিবেদন মতে চামড়া শিল্পে ৭০০ কোটি টাকা, পোল্ট্রিতে ৩৮২ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। হিমায়িত খাদ্যে ৩৩% রপ্তানি কমেছে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে প্রতি হরতালে ৭৫০ কোটি টাকা, পরিবহন খাতে প্রতিদিন প্রায় ৩০০ কোটি হিসাবে ২০,০০০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে, আবাসন খাতে ৫০% ছাড় দিয়েও ক্রেতা মিলছে না, প্রায় ২০,০০০ ফ্ল্যাট অবিক্রীত পড়ে আছে। এ খাতের ব্যাংক লোন ১৮,০০০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণে পরিণত হতে পারে। সব কিছু বিবেচনায় ব্যবসায়ীদের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিদিন হরতাল-অবরোধে ১৬০০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়। আমার মতে, লাগাতার হরতাল-অবরোধে প্রতিদিন প্রায় ২০০০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়। একটানা হরতাল না হলে একদিনের ক্ষতি পরের ৩ দিনে পুষিয়ে নেয়া যায়, কিন্তু লাগাতার হলে সেটা সম্ভব নয়। কারণ সময়সীমা, পচনশীলতা, উৎপাদন ক্ষমতা, পরিবহন ইত্যাদি বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সব কিছু বিবেচনা করে এফবিসিসিআই বলেছে ২০১৩ সালে ক্ষতি হয়েছে ১০০,০০০ কোটি টাকা। অঙ্কটির কলেবর দেখলে আতঙ্কিত হতে হয়। এই বিরাট ক্ষতি দায়ী রাজনৈতিক দলগুলো বা ক্ষমতাসীন সরকার পুষিয়ে দিতে পারবে কি? না। তাহলে দেশের ও জনগণের ক্ষতি করার অধিকার তাদেরকে কে দিলো? জনগণ ভোটের মাধ্যমে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করেছে দেশের ও জনগণের মঙ্গল সাধনের জন্য, ক্ষতি করার জন্য নয়। বিনিয়োগের পরিস্থিতিও হতাশাব্যঞ্জক। বিদেশী বিনিয়োগ তো নেই-ই, ব্যাংকগুলোতে প্রায় ১,০০,০০০ কোটি টাকা অলস পড়ে আছে, বিনিয়োগের উদ্যোক্তা পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে কু-ঋণ, খেলাপি ঋণ ও অর্থ কেলেঙ্কারির প্রভাবে ব্যাংকগুলো সুদের হার কমাতে পারছে না, সুদের হার কমালে ব্যাংকগুলোকে লোকসান গুনতে হবে। এর মধ্যে নতুন আরও ৮টি ব্যাংক বাজারে এসে অসম প্রতিযোগিতার আবহ সৃষ্টি করেছে। সুতরাং অর্র্থনীতির প্রাণকেন্দ্র এবং পুঁজি ও ঋণ সরবরাহকারী ব্যাংকিং সেক্টর ঝুঁকির মধ্যে আছে। অত্যন্ত দুর্ভাগ্য ও হতাশার বিষয় যে, দেশটি অর্থনৈতিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে নিচ্ছিল, প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়, দারিদ্র্য বিমোচন, জন্ম হার, মিলেনিয়াম লক্ষ্য অর্জন ইত্যাদিতে দ্রুতবেগে অগ্রসর হচ্ছিল, রাজনৈতিক অস্থিরতায় সব কিছু এখন স্থবির হয়ে আছে। এই স্থবিরতা কাটিয়ে উন্নতির পথে গতি পেতে অনেক দিন লেগে যেতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের পরেই বাংলাদেশের অর্থনীতি অগ্রসরমান ছিল, বিরাট আয়তন ও বিশাল জনসংখ্যার দেশ ভারতের প্রবৃদ্ধিও বাংলাদেশের চেয়ে কম ছিল। এবার প্রবৃদ্ধি ৬.৫ থেকে ৬-এ নেমে যেতে পারে। ক্ষমতাসীন সরকারি ও প্রধান বিরোধী দল উভয়ের এখন বিবেক জাগ্রত করা উচিত, যা ক্ষতি হওয়ার হয়েছে, অর্থনীতির ক্ষতি আর নয়। এখন উভয় দলকে সহনশীল হয়ে, ত্যাগ স্বীকার করে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে হবে।

লাইনচ্যুত গণতন্ত্রের ট্রেন by আলী ইদ্‌রিস

Sunday, January 19, 2014

বলা হয় একটি জাতি বা গোষ্ঠী তার যোগ্যতা অনুযায়ী নেতা-নেত্রী পেয়ে থাকে। জাতি নিজেই তার নেতা ও শাসক নির্বাচিত করে। এ নির্বাচনের মধ্যে যদি জনগণ ভুল সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে জাতি অযোগ্য,
অদক্ষ, দুর্নীতিগ্রস্ত  নেতা বা শাসক উপহার পায়। আধুনিককালে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অর্থাৎ প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। একটি ভোটের অনেক দাম। কারণ, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে লাখ লাখ ভোট পেয়েও এক ভোটের ব্যবধানে একজন প্রার্থী হেরে যেতে বা জয় লাভ করতে পারেন। জনগণের এই ভোটাধিকার যদি কেড়ে নেয়া হয় তাহলে গণতন্ত্র থাকে না। দশম জাতীয় নির্বাচনে ১৫৩টি আসনে ৪ কোটির বেশি ভোটার তাদের সাংবিধানিক ভোটাধিকার  প্রয়োগ করে পছন্দমতো নেতা-নেত্রী নির্বাচন করতে পারেননি। তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে মহাজোটের মনোনীত প্রতিনিধিবৃন্দ। এ মনোনয়ন টেন্ডার ভাগাভাগি করে নেয়ার মতো হয়েছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি জোট নির্বাচনে অংশ নেয়নি বলেই এমনটি হয়েছে। বিএনপি ১৮ দলীয় জোট কেন নির্বাচনে অংশ নেয়নি তা সবার জানা, এতে গণতন্ত্র লাইনচ্যুত হয়েছে সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। এখন লাইনচ্যুত গণতন্ত্রের ট্রেনকে লাইনে ওঠাতে হলে সব দলের অংশগ্রহণে আর একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান দরকার। একমাত্র ভারত ছাড়া পৃথিবীর বহু দেশ এই ভোটারবিহীন নির্বাচনকে অগ্রহণযোগ্য আখ্যা দিয়ে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুপারিশ করেছে। ভারতের ভেতরেও জাতীয় দৈনিকগুলো দিল্লির অন্ধ সমর্থনের বিরুদ্ধে সোচ্চার। ডেইলি টেলিগ্রাফ লিখেছে- লজ্জাজনক নির্বাচন হওয়া সত্ত্বেও দিল্লি সরকার আওয়ামী লীগের পাশে দাঁড়িয়েছে যে জন্য ভারতকে মূল্য দিতে হবে। ভারতের বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকা বলেছে- ভারতের উচিত শেখ হাসিনাকে সমঝোতার পরামর্শ দেয়া। আনন্দবাজার পত্রিকা লিখেছে- গণতন্ত্রের মাপকাঠিতে নতুন সরকারের বৈধতা প্রশ্নযোগ্য কিংবা সরাসরি অবৈধ। দ্য স্টেটসম্যান লিখেছে- নিজের ছকে পাওয়া বিজয়ে রাজনৈতিক নেতা হিসেবে শেখ হাসিনার এবং অবশ্যই আওয়ামী লীগের বিশ্বাসযোগ্যতা বিনষ্ট হয়েছে। দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস লিখেছে, নির্বাচনের প্রক্রিয়া ও বৈধতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে। দি হিন্দু লিখেছে- নির্বাচন এক সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা বলে শেখ হাসিনার দাবির প্রতি ভারতের সমর্থন কাজে আসবে না, বরং তারা দলীয়ভাবে পক্ষপাতী বলেই দৃশ্যমান হবে। টাইমস অব ইন্ডিয়া লিখেছে- ভারত দুই পক্ষের মধ্যে সৎ ও আন্তরিক মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করতে পারে। ভারত সরকারের উচিত উভয় দেশের জনমতের মূল্যায়ন করা এবং ঐতিহ্যবান, প্রাচীন গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে বাঁচানো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী  ইঙ্গিত দিয়েছেন যে বিএনপির সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতা হলে একাদশ সংসদের নির্বাচন সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হতে পারে। যোগাযোগমন্ত্রী অবশেষে বলেছেন, নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়েছে কিন্তু সর্বজনগ্রাহ্য হয়নি। অর্থমন্ত্রী ক’দিন আগে বলেছিলেন যে এ নির্বাচন সংবিধান বাঁচানোর নির্বাচন, প্রধান বিরোধী দলের সঙ্গে সমঝোতা হলে শিগগিরই (২৪শে জানুয়ারির পরে) আরেকটি সর্বদলীয় নির্র্বাচন হতে পারে। এদিকে সরকারের ভেতরে অন্য মন্ত্রী ও উপদেষ্টাদের কেউ কেউ বলেছেন নতুন সরকার পাঁচ বছর থাকবে। তাহলে সরকারের প্রকৃত অভিলাষ কি এখনও স্পষ্ট  কিছু বোঝা যায় না। এদিকে বিএনপি জোট হরতাল অবরোধ প্রত্যাহার করে শান্তিপূর্ণ  আন্দোলনের যে কর্মসূচি দিয়েছে তাতে সরকারের অনুমতি দেয়া উচিত এবং যে সংলাপ চলছিল তা আবার শুরু করা প্রয়োজন। গণতন্ত্রকে বাঁচাতে এবং সমঝোতায় পৌঁছতে বিএনপিকেও প্রয়োজনীয় ছাড় অবশ্যই দিতে হবে। তবেই দীর্ঘ সংগ্রামের পর ২৩ বছর আগে  পুনরুদ্ধারকৃত গণতন্ত্র আবারও বেঁচে যাবে।
 
Support : Dhumketo ধূমকেতু | NewsCtg.Com | KUTUBDIA @ কুতুবদিয়া | eBlog
Copyright © 2013. Edu2News - All Rights Reserved
Template Created by Nejam Kutubi Published by Darianagar Publications
Proudly powered by Dhumketo ধূমকেতু