ভারত- হায়দরাবাদ থেকে তেলেঙ্গানা by আলী ইমাম মজুমদার

Saturday, March 1, 2014

প্রতিবেশী ভারতে শাসনকাজ সুচারুভাবে পরিচালনার জন্য মাঝেমধ্যে বিভিন্ন রাজ্য ভাঙাগড়া হয়। এ ধরনের ভাঙাগড়ায় বিপরীতমুখী স্বার্থের সংঘাত থাকে বলে ব্যাপারটি কিন্তু সহজ নয়।
অতীতের ভাঙাগড়াগুলোও সহজে হয়নি। ক্ষেত্রবিশেষে ঘটেছে সংঘাত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জনপ্রতিনিধিদের সুবিবেচনাপ্রসূত মতামতের ভিত্তিতে নিষ্পত্তি হয়েছে। ঠিক তেমনি দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্য অন্ধ্র প্রদেশকে ভেঙে তেলেঙ্গানা নামের একটি রাজ্য গড়ার জোর দাবি ছিল দীর্ঘদিনের। এটা নিয়ে দফায় দফায় আন্দোলন হয়েছে। প্রাণহানিও ঘটেছে বেশ কিছু মানুষের। ১৯৬৯ আর ১৯৭২-এ আন্দোলনের তীব্রতা ছিল প্রকট। কিন্তু তখন আলোর মুখ দেখেনি দাবিটি। তা দেখল ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ভারতের ২৯তম রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রায় সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়েছে তেলেঙ্গানার। সম্প্রতি লোকসভা ও রাজ্যসভায়ও জনপ্রতিনিধিরা যখন এটা নিষ্পত্তি করেন, তখনো কিন্তু বিষয়টি সহজসাধ্য ছিল না। তবে প্রধান দুটো দল একমত হওয়ায় অন্যদের আপত্তি ধোপে টেকেনি।

ফেডারেল সরকারব্যবস্থায় এ ধরনের রাজ্য বিভক্তির পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি থাকে। উভয় পক্ষ প্রায় ক্ষেত্রে অনড় অবস্থান নেয়। তা সত্ত্বেও জনগণের বৃহত্তর কল্যাণ বিবেচনায় রেখে একপর্যায়ে একটা সমাধান করতে হয়। আর এটাই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য। আবার এ ধরনের দাবি একটি মেনে নিলে সমধর্মী দাবিও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আর কেন্দ্রীয় সরকার ও সংশ্লিষ্ট রাজ্যও এ ধরনের দাবির পক্ষে ঢালাওভাবে অবস্থান নিতে পারে না। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর পর্যালোচনার পরই একেকটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তবু নিজ নিজ অবস্থানে থেকে অনেকে আন্দোলন চালায়। ভারতে গত বিজেপি সরকারের সময়ে তিনটি নতুন রাজ্য গঠিত হয়েছিল। সেগুলো হচ্ছে উত্তর প্রদেশ, ওডিশা আর বিহার ভেঙে যথাক্রমে উত্তরাঞ্চল, ছত্তিশগড় আর ঝাড়খন্ড। এখনো জোর দাবি চলছে মহারাষ্ট্রের বিদর্ভ, আসামের বোড়োল্যান্ড আর পশ্চিমবঙ্গের গুর্খাল্যান্ডসহ আরও কিছু অঞ্চলে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারকে একটি রাজ্য গঠনের সময়ে তার ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক, নৃতাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিকসহ সব দিক বিবেচনা করতে হয়। পার হতে হয় জটিল সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে।
কতগুলো দিক বিবেচনায় তেলেঙ্গানাকে প্রকৃত অর্থে সম্পূর্ণ নতুন একটি রাজ্য বলা যাবে না। এ অঞ্চল মূলত ব্রিটিশ-ভারতে হায়দরাবাদ রাজ্যের অংশবিশেষ। ১৯৪৮ সালে এর ভারতভুক্তি হয়। এর আগে ইংরেজ শাসকেরা রাজ্যটির বেড়ার নামক একটি অংশ মধ্যপ্রদেশের সঙ্গে জুড়ে দেয়। ভারতভুক্তির পরও মারাঠাভাষীর কিছু অংশ মহারাষ্ট্র আর কানাড়াভাষী কিছু অংশ কর্ণাটকের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। তেলেগুভাষী অংশটিকে ১৯৫৬ সালের রাজ্য পুনর্গঠন প্রক্রিয়াকালে অন্ধ্র প্রদেশের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। সেই হায়দরাবাদ নগরই হয় অন্ধ্র প্রদেশের রাজধানী।
ভাষার সাযুজ্য থাকলেও এর একটি ঐতিহাসিক পৃথক সত্তা ছিল। ১৭২৪ সাল থেকে পৃথক দেশীয় রাজ্য হিসেবে এর শাসনভার ছিল নিজাম পরিবারের হাতে। সীমানার কিছু পরিবর্তন হলেও ব্রিটিশরা এ সত্তা বহাল রাখে। ব্রিটিশ-ভারতের ৫৫৬টি দেশীয় রাজ্যের মধ্যে এটি ছিল সর্ববৃহৎ ও সবচেয়ে সমৃদ্ধ। মূল হায়দরাবাদ রাজ্যের আয়তন ছিল দুই লাখ ১৫ হাজার বর্গকিলোমিটার। কেটে নিয়ে অন্ধ্রের সঙ্গে যেটুকু দেওয়া হয়েছে, তার আয়তন এক লাখ ১৫ হাজার বর্গকিলোমিটার। আর বর্তমান লোকসংখ্যা সাড়ে তিন কোটি। অবিভক্ত অন্ধ্র প্রদেশের আয়তন দুই লাখ ৭০ হাজার বর্গকিলোমিটার। আর লোকসংখ্যা সাড়ে আট কোটি। এর সরকারি ভাষা তেলেগু ও উর্দু। সুজলা-সুফলা এ রাজ্যকে ভারতের খাদ্যভান্ডার বলা হয়। চাল ছাড়াও চিনিসহ অন্যান্য কৃষিপণ্য ও মৎস্য উৎপাদনে অগ্রণী এ অন্ধ্র প্রদেশ।
পাশাপাশি শিল্পায়নেও অনেক অগ্রসর। মাথাপিছু গড় আয়ের দিক দিয়ে ভারতে দ্বিতীয়। অন্ধ্রের রাজধানী হায়দরাবাদের আয়তন ৬৫০ বর্গকিলোমিটার। আর জনসংখ্যা প্রায় ৮০ লাখ। ভারতের চতুর্থ জনবহুল শহর। এ নগর রাজ্যের জিডিপি আর কর প্রদানে শীর্ষে রয়েছে। রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া তথ্যানুসারে ভারতের নগরওয়ারি বিবেচনায় হায়দরাবাদ ব্যাংক আমানতে ষষ্ঠ আর ঋণ প্রদানে চতুর্থ স্থানে রয়েছে। এখানে রয়েছে প্রায় এক হাজার ৩০০টি উঁচু মানের আইটি ফার্ম। এর মধ্যে মাইক্রোসফটসহ বেশ কিছু নামজাদা বহুজাতিক কোম্পানিও আছে। অর্থাৎ ব্যাপক বিনিয়োগ হয়েছে এ নগরে। বিশ্বব্যাংকের গবেষণা অনুসারে, এটি ভারতের দ্বিতীয় ব্যবসাবান্ধব শহর। এর অর্থ ব্যাপক বিনিয়োগ, কর্মসংস্থানের পাশাপাশি এখানে সুশাসনও স্বাভাবিক মাত্রায় রয়েছে। আগামী ১০ বছর নগরটি উভয় রাজ্যের যৌথ রাজধানী থাকবে বটে। এরপর চলে যাবে তেলেঙ্গানার ভাগে।
হায়দরাবাদ তেলেঙ্গানার রাজধানী হিসেবে পাবে। তবে উল্লেখ করা যথার্থ যে তেলেঙ্গানা নামক অঞ্চলটি অন্ধ্র প্রদেশের অন্য অঞ্চল থেকে বেশ কিছুটা পিছিয়ে আছে। তাদের অভিযোগ রয়েছে সুষম উন্নয়ন না হওয়ার। যেকোনো কারণেই হোক এ অভিযোগের বাস্তবতা লক্ষণীয় হয়। যেমন গোটা অন্ধ্র প্রদেশের শাসনব্যবস্থায় তেলেঙ্গানাবাসীর সংখ্যা শতকরা ২০ জন। আর শীর্ষস্তরে এর অনুপাত শতকরা পাঁচজন। সুতরাং সূচনায় রাজ্য পরিচালনা করতে গিয়ে তারা কিছু হোঁচট খাবে। তবে রাজনৈতিক দূরদর্শিতাসম্পন্ন নেতৃত্ব থাকলে নতুনভাবে গঠনের পর্যায়ে অঞ্চলনির্বিশেষে সবার সহযোগিতা নিতে নতুন সরকার সচেষ্ট থাকবে। নিজামের শাসনকাল থেকেই এ রাজ্যের অবকাঠামো উন্নত ছিল। ব্রিটিশের সাধারণ নিয়ন্ত্রণে থাকলেও এর নিজস্ব সেনাবাহিনী, বিমান পরিবহন, টেলিযোগাযোগ, রেলওয়ে, ডাক যোগাযোগব্যবস্থা, মুদ্রা ও বেতার সম্প্রচারব্যবস্থা ছিল। অর্থনীতিও পেছনে ছিল না। এখন মাঝখানে যেটুকু পিছিয়েছে, তা থেকে বিদ্যমান অবস্থায় দ্রুত উত্তরণ সম্ভব।
নতুন রাজ্য হিসেবে তেলেঙ্গানার এ অভ্যুদয়কে ভারতের রাজনৈতিক এমনকি সিভিল সমাজ নিরঙ্কুশভাবে স্বাগত জানাচ্ছে না। এখানে একটা তীব্র দ্বিধাবিভক্তি লক্ষণীয়। একটি অংশ এ ধরনের পুনর্গঠনের পক্ষে থাকলেও অপর অংশটি সক্রিয়ভাবে বিরুদ্ধে। যারা পক্ষে তারা বলছে একটি ভূখণ্ড তার পূর্ব সত্তা ফিরে পেলে নিজদের ভাগ্য পরিবর্তনের সুযোগ পাবে। সমৃদ্ধির গতি আরও বাড়বে। পশ্চাৎপদ অঞ্চলগুলো নজরে আসবে। ক্রমান্বয়ে অবসান ঘটবে তাদের পশ্চাৎপদতার। অপর অংশটির মতে, এ সিদ্ধান্ত ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন ভাষাভাষী ও নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্ব বাড়াবে। একের পর এক নতুন রাজ্য গঠনের দাবি আসতে থাকবে। তাঁরা আরও বলছেন, এ প্রবণতা ভারতকে ক্রমান্বয়ে ‘বলকানাইজেশন’-এর পথে নিতে পারে। এ ধরনের মতামত পোষণকারীদের মধ্যে কুলদীপ নায়ারের মতো প্রথিতযশা সাংবাদিকও রয়েছেন। উল্লেখ্য, ‘বলকানাইজেশন’ একটি ভূরাজনৈতিক শব্দ। একটি দেশ বা অঞ্চল পরস্পরের প্রতি বৈরীভাবাপন্ন ছোট ছোট অঞ্চলে বিভক্ত হওয়াকে ‘বলকানাইজেশন’ বলে অভিহিত করা হয়। এ শব্দটি মূলত ১৮১৭ থেকে ১৯১২ সময়কালে অটোমান সাম্রাজ্যের বলকান উপদ্বীপের অঙ্গরাজ্যগুলো বিভিন্ন রাজ্যের বিভক্তি থেকে নেওয়া হয়। ভারতের ক্ষেত্রে এ যুক্তি গ্রহণযোগ্য বলে অনেকে মনে করেন না। তাঁদের বিবেচনায় এখানে ফেডারেল সরকারব্যবস্থা থাকলেও শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার, সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দল, সুসংগঠিত সামরিক বাহিনী ও দক্ষ আমলাতন্ত্র রয়েছে। ব্যাপকভাবে না হলেও এ ধরনের দু-একটি ক্ষেত্রে নতুন রাজ্য গঠনকে প্রয়োজনীয় বিকেন্দ্রীকরণ বলে ইতিবাচক রূপে চিহ্নিত করছেন তাঁরা।
কেবল কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা কোনো দেশের জন্য সুফল আনে না। শুরু থেকেই ভারত এ সত্য উপলব্ধি করে শক্তিশালী কেন্দ্রের অধীনেই কার্যকর রাজ্য প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করেছে। আর সময়ের প্রয়োজনে এসব রাজ্য নিয়ে কিছু ভাঙাগড়া চলতেই পারে। অন্ধ্র প্রদেশ ভাঙা নিয়ে দাবি দীর্ঘদিনের। কয়েক যুগ পর দাবিটি পূরণ হতে চলছে। কতিপয় ক্ষেত্রে সাময়িক অসুবিধা হলেও শেষাবধি তা কেটে যাবে বলে ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয়। অন্য রাজ্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। আর একে নজির রেখে নতুন রাজ্য প্রতিষ্ঠার দাবিও আসতে পারে। আসলেই সথেষ্ট যৌক্তিকতা না থাকলেও তা দেওয়া হবে এরূপ মনে করার কোনো কারণ নেই। সব আশঙ্কাকে ভুল প্রমাণিত করে ভারতের ২৯তম রাজ্য তেলেঙ্গানা সুষম উন্নয়ন ও সংহতির পথে এগিয়ে যাবে—এটিই প্রত্যাশা।

আলী ইমাম মজুমদার
: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com

দুর্নীতি দমন- চাই দুদকের দৃপ্ত পদচারণ by আলী ইমাম মজুমদার

Tuesday, February 11, 2014

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আইনে তাদের ক্ষমতায় কিছু সীমাবদ্ধতা এনে একটি সংশোধনী বিল সংসদে যায় বছর তিনেক আগে।
দুদকের ক্ষমতা সীমিতকরণ-সংক্রান্ত প্রস্তাবটিতে দেশের সুশীল সমাজ ব্যাপক আপত্তি জানায়। আপত্তি জানায় দুদক। তদানীন্তন দুদক চেয়ারম্যান বলেছিলেন, এ সংশোধনী আনা হলে সংস্থাটি একটি নখ, দন্তহীন ব্যাঘ্রে পরিণত হবে। আইনটি দীর্ঘকাল পড়ে ছিল সংসদে। দুদকের নখ, দাঁত ছিল অক্ষত। কিন্তু সেগুলো কতটুকু, কীভাবে প্রয়োগ হয়েছে, দেশবাসীর তা জানা। হঠাৎ করে গত নভেম্বরে সংশোধনী বিলটি পাস হয়ে যায়। দুদক আইনে নতুন সংযোজিত ৩২ ধারায় বিধান করা হয়, এ আইনে কোনো জজ, ম্যাজিস্ট্রেট বা পাবলিক সার্ভেন্টকে অভিযুক্ত করতে হলে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৭ ধারা অনুসরণ করতে হবে। সে বিধি অনুসারে আবশ্যক রয়েছে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন। এতে দুদকের স্বাধীন সত্তা সীমিত হয়। কার্যকারিতা কমে যাবে বলে আশঙ্কা করেন অনেকেই। সুশীল সমাজ এবারও তীব্র আপত্তি করতে থাকে।

শেষ পর্যন্ত এ বছরের জানুয়ারি মাসে এক জনস্বার্থ মামলার রিটে হাইকোর্ট বিভাগ বিধানটি বেআইনি ও বৈষম্যমূলক বলে বাতিল করে দিয়েছেন। সে ক্ষেত্রে তাদের নখ আর দাঁত অক্ষতই রইল। দেশবাসী আশা করতে পারে, এ নখ আর দাঁতের ব্যবহার তারা করবে মনুষ্য রূপধারী হিংস্র কিছু দানবের প্রতি। যে দানবেরা ঘুষ, জালিয়াতি, চাঁদাবাজি আর ক্ষমতার অপপ্রয়োগের মাধ্যমে জনস্বার্থ বিপন্ন করে নিজেরা লাভবান হচ্ছে।
এখানে স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন গঠনের পটভূমিকা কিছুটা আলোচনার দাবি রাখে।
আমরা অনেক চড়া মূল্যে এ দেশের স্বাধীনতা অর্জন করেছি। স্বাধীনতাযুদ্ধের চেতনাগুলোর মধ্যে ছিল আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে সমতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা। স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর আমাদের অর্জন ও ব্যর্থতার হিসাব-নিকাশ করলে দেখা যাবে, শাসনব্যবস্থা কার্যকর হলে অর্জন আরও বেশি হতো। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার আমাদের শাসনব্যবস্থার অংশ হয়ে পড়েছে—এমনটাই দেখা যায়। এ বিষয়ে আমাদের প্রচলিত আইন ও বিধিবিধান অকার্যকর বলেই প্রতিপন্ন হয়। দাবি ওঠে একটি স্বাধীন, শক্তিশালী দুর্নীতি দমন কমিশন প্রতিষ্ঠার। দাবি ওঠায় সুশীল সমাজ। পাশাপাশি দাবিটির প্রতি সমর্থন দেয় উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থাগুলো। এর মাঝে বাংলাদেশ জাতিসংঘের দুর্নীতি দমন কনভেনশন অনুসমর্থন করে। এসব কিছুর ফলে ২০০৪ সালে সংসদে গৃহীত হয় স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন আইন।
আইন প্রণয়নের পর কয়েক দফায় কমিশন গঠন-পুনর্গঠন হয়েছে। চারদলীয় জোট সরকারের সময়কার প্রথম কমিশন তো নিজদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি করে দিব্যি দুই বছর কাটিয়ে দিয়েছিল। নিষ্ফলা ছিল সে কমিশনটি। ২০০৭ সালে রাজনৈতিক পালাবদলের পর নতুনভাবে আরেকটি কমিশন গঠিত হয়। এটার ওপর আবার তখনকার সরকারের একটি অংশের প্রবল নিয়ন্ত্রণ ছিল। ফলে অতি সক্রিয় ছিল সে সময়কার কমিশন।
অভিযোগ আছে পক্ষপাতিত্বসহ আরও অনেক কিছুর। কিছু অভিযোগের সত্যতা থাকতেও পারে। তবে দুর্নীতি করলে কোনো না কোনো সময় আইনের আওতায় আসতে হবে—এ চরম বার্তাটি সে কমিশন সব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সাফল্যের সঙ্গে দেশবাসীকে দেয়। দুর্ভাগ্যজনক হলো, তবে বিভিন্ন কারণে তাদের সে প্রয়াস স্থায়ী রূপ পায়নি। বরং ২০০৯ সালে ক্ষমতার পালাবদলের পর একশ্রেণীর লোক দলবল নিয়ে নেমে পড়লেন দুর্নীতির মহোৎসবে। এটাই আমরা দেখলাম। আগেকার জোট সরকার থেকে ভিন্ন কিছু ঘটল—এমন দেখা গেল না। ফলে পাঁচ বছরের ব্যবধানে তাঁদের কারও কারও সম্পদের নিট স্ফীতি ক্ষেত্রবিশেষে কয়েক সহস্র গুণ হওয়ার অবিশ্বাস্য ঘটনা আমাদের সামনে এল। আর তা এল নির্বাচন কমিশনে ২০০৮ ও ২০১৩ সালে তাঁদের দাখিল করা সম্পদ বিবরণী পর্যালোচনা করেই।
প্রথমত, দুদক এ বিষয়ে তাদের কিছু করার নেই বলে এড়িয়ে যেতে চাইল। পরে তীব্র সমালোচনার মুখে জানাল, তারা এই জনপ্রতিনিধিদের সম্পদের উৎস নিয়ে তদন্ত করবে। দু-একটি ক্ষেত্রে তা শুরু হয়েছে বলেও মনে হয়। তবে এ ‘কৃষ্ণগহ্বর’ থেকে দুদক উল্লেখযোগ্য কিছু বের করতে পারবে—এমনটা বিশ্বাস করতে ভরসা হয় না। তাদের বরাবরের মতো সরকারের সন্তুষ্টি বিধান করেই চলতে হবে। অন্তত নিকট অতীতের ঐতিহ্য তারা ভাঙতে সক্ষম হবে—এমন মনে হয় না। এ আশঙ্কা করলে আমাদের সংশয়বাদী বলে গাল দিতে পারে। কিন্তু কঠোর বাস্তবতা সামনে চোখ রাঙাচ্ছে।
২০০৯ সালে ক্ষমতার পালাবদলের পর প্রথমত আগের চেয়ারম্যান পদত্যাগ করেন। নিযুক্ত হন নতুন চেয়ারম্যান। মেয়াদ সম্পন্ন হলে কমিশনার দুজনও নতুনদের দ্বারা স্থলাভিষিক্ত হলেন। এ নতুন কমিশন সরকারের বিরুদ্ধে যাঁরা আছেন, তাঁদের মামলাগুলো গুরুত্ব দিয়ে করার চেষ্টা করছে। এর বেশি কিছু নয়। ২৭০ কোটি ডলারের পদ্মা সেতু প্রকল্পটি আটকে যায় মূলত দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগে। এ অভিযোগের ক্ষেত্রে শুরু থেকেই দুদক জাতির কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা পালন করেনি। বরং দেখা গেছে, বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ প্রসঙ্গে সরকারের যে বক্তব্য, তার আগ বাড়িয়ে আরও জোরালো বক্তব্য দিচ্ছেন তদানীন্তন দুদক চেয়ারম্যান। কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিকে অকারণে ফাঁসিয়ে দিতে কেউ বলবে না। তবে সম্ভাব্য সন্দেহের ক্ষেত্রে অনুসন্ধান, মামলা দায়ের আর তদন্ত দোষের কিছু নয়। বিষয়টি নিয়ে কানাডার আদালতে কিন্তু একটি মামলা বিচারাধীন রয়েছে।
পদ্মা সেতু নিশ্চয়ই একদিন হবে। স্বাভাবিকভাবেই এর ব্যয় বৃদ্ধি পাবে দুই-তিন গুণ। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে অবশিষ্টাংশের সঙ্গে সংযুক্ত করার প্রয়াসও পিছিয়ে গেল। এখানে মূল দায় যাদেরই হোক, স্বাধীন সংস্থা হিসেবে দুদকের কাছে একটি বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত দেশবাসীর কাম্য ছিল। এমন আশা করছিল উন্নয়ন সহযোগীরাও। এতে ঋণ চুক্তিটি হয়তো বা রক্ষা পেত। আইন ও অবয়বে ভিন্ন রূপ নিলেও কাজেকর্মে দুদক কিন্তু তার পূর্বসূরি ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানগুলোর ছায়াই অনুসরণ করে চলছে। অথচ কমিশনারদের নিয়োগ-প্রক্রিয়া অনেক মর্যাদাসম্পন্ন। তাঁদের অপসারণও সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের মতো একটি জটিল প্রক্রিয়াসাপেক্ষ। দায়িত্ব পালনে তাঁদের কারও কাছে জবাবদিহি করতে হয় না। সামান্য সময়ের জন্য যেটুকু আইনি জটিলতা সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল, তা-ও অপসারিত। তা সত্ত্বেও সংস্থাটি তার স্বাধীন ও নিরপেক্ষতার ছাপ রাখতে কিছুমাত্র সক্ষম হয়েছে—এমন দাবি করা যাবে না।
আমাদের দেশে এ-জাতীয় অবস্থা শুধু দুদকেই, তা নয়। অনেক প্রতিষ্ঠানেই এ ব্যাধি ছড়িয়ে পড়েছে। সরকার কিসে তুষ্ট হবে, সেটা বিবেচনায় নিয়ে কাজ করতে চায় অনেকে। এতে অনেক প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতা ভেঙে পড়েছে। জাতীয় প্রয়োজনে তারা সাড়া দিতে সক্ষম হচ্ছে না। দুদক প্রসঙ্গ এখানে বারবার আসবে। দুর্নীতির ব্যাধি আজ গোটা জাতিকে গ্রাস করে ফেলছে। সংবর্ধনা সভায় সরকারের উচ্চ পদাধিকারী ‘ঠাট্টা করে’ আজ মাইক্রোফোনে ক্রেস্টের পরিবর্তে ক্যাশ চাইছেন। এ ধরনের ‘ঠাট্টা’ ক্ষমতার অপব্যবহার তথা দুর্নীতির পর্যায়ে পড়ে কি না, তা দুদকেরই দেখার কথা। তারা কিছুটা সক্রিয় হলে এর আংশিক নিরাময়ও সম্ভব। আইনি সমর্থন, অবকাঠামো ও লোকবল সবই আছে তাদের। কোথাও অপূর্ণতা থাকলে এটা মেটাতে দাবি জানাতে পারেন। একটু নড়েচড়ে উঠলেই সতর্ক হতে শুরু করবেন দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তিরা।
তবে জানা যায়, দুদকের নিম্নপদস্থ ব্যক্তিদের হাতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনাবশ্যক হয়রানির শিকার হয় কিছু ‘পাবলিক সার্ভেন্ট’। প্রতিষ্ঠানটির সর্বোচ্চ পর্যায়ে এ বিষয়ে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা ও নিবিড় তদারকির ব্যবস্থা থাকলে এ-জাতীয় অবস্থার অবসান ঘটাতে সহায়ক হবে। আর যেসব ‘পাবলিক সার্ভেন্ট’ দুর্নীতি করে না, তারা কোনো স্বার্থান্বেষী ব্যক্তির দ্বারা সাময়িক হয়রানি হলেও ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কমিশনের অনুমোদন ব্যতীত এ আইনে কোনো মামলা রুজু করার কোনো আইনি সুযোগ নেই। তবে নিজে লোভের বশীভূত হয়ে বা অন্যের চাপে বেআইনি কাজ করলে যথাযথ ফল ভোগ করতেই হবে।
পরিশেষে থাকছে, প্রতিষ্ঠানটিকে সবাই স্বাধীন ও সক্রিয় দেখতে চায়। আশা করে, সব জড়তা কাটিয়ে এরা আইনের বাতাবরণে এ-জাতীয় দায়িত্ব পালনে তৎপর হবে। এখন কিন্তু নখ, দাঁত সবই রয়ে গেল তাদের। তাই অক্ষমতার কোনো অজুহাত দেওয়া যাবে না। অবশ্য নখ-দন্তধারী কিছু হিংস্র প্রাণীও পোষা থাকতেই পছন্দ করে। দুদক অন্তত নিজেদের এ ধরনের সন্দিহান অবস্থা থেকে বাইরে আনতে সচেষ্ট হবে—এ প্রত্যাশা রইল।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com

জাতীয় সংসদ- অনুগত বিরোধী দলের অবিচল আস্থা by আলী ইমাম মজুমদার

Friday, February 7, 2014

দশম সংসদের উদ্বোধনী দিনে বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ সরকারের প্রতি অবিচল আস্থার কথা বলেছেন তাঁর সূচনা বক্তব্যে।
তাঁর নেতৃত্বে বিরোধী দল স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার পদে নির্বাচনে কোনো প্রার্থী দেয়নি। ‘হ্যাঁ’ ধ্বনি তুলে সমর্থন জানায় সরকারি দল-প্রস্তাবিত প্রার্থীদের। তাঁরা নির্বাচিত হলে টেবিল চাপড়ে উল্লাসও করেন সরকারি দলের সঙ্গে। বিরোধী দলের নেতা বলেছেন, কোনো দল না এলে তাদের জন্য নির্বাচন থেমে থাকতে পারে না। গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতার জন্য নির্বাচন প্রয়োজন ছিল। এটা সম্পন্ন করতে পারার জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদও জানান। সরকারে তিনজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী আছেন তাঁর দল থেকে। আছেন মন্ত্রীর মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। তাঁরা আসন নিয়েছেন ট্রেজারি বেঞ্চে নয়, বিরোধী দলের সারিতে। বিরোধী দলের নেতা এটাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার মতোই ‘নিউ কনসেপ্ট’ বলে মন্তব্য করেছেন। আরও বলেছেন, এভাবেই তিনি সরকারকে সহযোগিতা আর আবশ্যক হলে সমালোচনা— উভয়টাই করতে সক্ষম হবেন। সেটা কীভাবে কতটা পারেন, তা দেখার অপেক্ষায় রয়েছে দেশবাসী। কৌতূহলী অনেকেই।

এটা অনেকটাই অচেনা আর ব্যতিক্রমী এক সংসদ। প্রথমত বলতে হয়, এ সংসদের অধিকাংশ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত। এটা অভূতপূর্ব। বাকি আসনগুলোয় খুব কম ক্ষেত্রেই কার্যকর প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে। মনে হয়েছে যেন ‘ফ্রেন্ডলি ম্যাচ’ চলছে ক্ষেত্রবিশেষে ওয়াকওভার। দেশের বৃহত্তর দুটো দলের একটির নেতৃত্বাধীন জোট নির্বাচনে অংশ নেয়নি। সুতরাং, ভোট দেওয়ার উৎসাহ ছিল খুব কমসংখ্যক লোকেরই। তদুপরি, ব্যাপক সন্ত্রাস হয়েছে, বিশেষ করে দেশের উত্তরাঞ্চলে। হতাহত অনেক। ভোট গ্রহণ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল চার শতাধিক কেন্দ্রে। ভোটকেন্দ্র হিসেবে নির্ধারিত পাঁচ শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ করা হয় আগের রাতে। ভোটকর্মী নিহত হয়েছেন একাধিক। সুতরাং, একে ব্যতিক্রমী একটি সংসদ বলা যেতেই পারে।

তারপর আসছে বিরোধী দলের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত জাতীয় পার্টির সরকারি দায়িত্ব গ্রহণ প্রসঙ্গে। রওশন এরশাদ সংসদের কার্যপ্রণালি বিধিমালা অনুসারে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। আবার আসন বিন্যাসে তাঁর পাশাপাশি বসছেন সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্ত এ দলের সদস্যরাও। কিন্তু তাঁদের দায়িত্ব পালন করতে হবে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে। উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী সংসদ নেতাও বটে। বিরোধী দলের নেতার বক্তব্য অনুসারেই এটা ‘নিউ কনসেপ্ট’। তাই আমাদের অনেকের কাছেই অচেনা ঠেকছে। এমনকি সরকারি দলের কারও কারও কাছেও। সে দলের একজন প্রবীণ সাংসদের (যিনি গেল মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন) মতে, জাতীয় পার্টির এ আচরণ গাছেরটি খাওয়া আর তলারটি কুড়ানোর মতো। কাঁঠালের আমসত্ত্ব হয় না বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। এ নিউ কনসেপ্টের ভবিষ্যৎ আমাদের অজানা। তবে আপাতত আমরা সংসদে সক্রিয় বিরোধী দলের অবস্থান থেকে বঞ্চিত হলাম।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ১৯৯১ সালের পর পালাক্রমে সরকার ও বিরোধী দলের ভূমিকায় ছিল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। তাদের যখন যারা বিরোধী দলে ছিল, তারা সংসদীয় দায়িত্ব পালন করেনি বললেই চলে। অথচ বেতন-ভাতাসহ সব সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে। উপভোগ করেছে মর্যাদা। সংসদ বর্জন একটি স্বাভাবিক সংস্কৃতি হয়ে পড়েছিল। বর্তমান বিরোধী দল হয়তো তা করবে না। কিন্তু তারা প্রকৃত বিরোধী দল কি না, সেটা নিয়েই সংশয় রয়েছে। তদুপরি যারা নির্বাচনে অংশ না নিয়ে সংসদের বাইরে রইল, তারা কিন্তু এ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশীদার নয়। অংশীদার নয় তাদের সমর্থক জনগোষ্ঠী। এ অবস্থায় একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। আপাতত পরিস্থিতি শান্ত। একে স্থিতিশীল রাখতে হলে সংলাপের মাধ্যমে প্রধান দলগুলোকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশীদার হতে হবে। ‘বন্দুকযুদ্ধ’ আর ‘ক্রসফায়ার’ সাময়িক সমাধান দিলেও স্থায়ী স্থিতিশীলতার জন্য সহায়ক হবে না। তবে দলমত-নির্বিশেষে সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনার জন্য সরকারি পদক্ষেপের আবশ্যকতা অস্বীকার করা যায় না। স্বার্থান্ধ ব্যক্তি ব্যতীত কেউ নৈরাজ্য সমর্থন করে না। তবে এর নামে বিরোধী দল দমনও সমর্থনযোগ্য নয়। এ কার্যক্রম পক্ষপাতহীন হলে ব্যাপক জনসমর্থন পাওয়া যাবে।

সংসদের বর্তমান বিরোধী দল সব জাতীয় সমস্যাতেই সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে বলে জানিয়েছে। এটাই হওয়ার কথা এবং অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশেও তাই হয়। মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে যোগাযোগ হয়। হয় না শুধু আমাদের এ দুর্ভাগা দেশে। বর্তমান বিরোধী দলের নেতার এ মনোভাব গুরুত্বের সঙ্গে গৃহীত হতো, যদি তিনি প্রকৃতই বিরোধী দলে অবস্থান নিতেন। এ ছাড়া তাঁর দলটি ব্যাপক জনসমর্থিতও নয়। ভাগাভাগির নির্বাচন না হয়ে সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে এককভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে এ দলের আসন সংখ্যা বর্তমানের ধারে-কাছেও আসবে না বলে অনেকে মনে করেন। তাই তাদের সহযোগিতার প্রস্তাবটি শিষ্টাচারের বিবেচনায় প্রশংসনীয় হলেও রাজনৈতিকভাবে তেমন মূল্য বহন করে না। এতে উৎসাহিত হওয়ার কোনো কারণও লক্ষণীয় হয় না।

দলটি ১৯৯০ সালে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে দ্বৈত নীতি নিয়ে চলছে। এমনকি ক্ষমতায় থাকাকালেও প্রধান দুটো দলকে বিপরীতমুখী রাখতে সদা সচেষ্ট ছিল। সেটা যখন সম্ভব হয়নি, তখনই ক্ষমতা হারায়। শুরুতে তাদের পতিত স্বৈরাচার বলত উভয় প্রধান দল। সে পতনের দিনটিও উদ্যাপন করত। দুমুখো নীতির জন্য দলটির এখন কিন্তু বেশ কদর। বড় শরিকেরা এখন ‘পতিত’ আর ‘স্বৈরাচার’ শব্দগুলো মুখেও তোলে না। অবশ্য গেল নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলটি আরেক দফা ভেঙেছে। যেটুকু আছে, সেখানেও নেতৃত্বের মেরুকরণ লক্ষণীয়। শেষতক কোথায় দাঁড়ায়, এটাও দেখার বিষয়।

এ দেশ ১৯৮৮ আর ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচন দেখেছে। দেখেছে এ বছরের জানুয়ারির নির্বাচন। প্রতিটি নির্বাচনের ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষিত রয়েছে। তবে মাত্রার হেরফের হলেও কোনোটিই জনসমর্থিত এমন দাবি করা যাবে না। এখানে ‘ফ্রেন্ডলি ম্যাচ’-এর জন্য জাতীয় পার্টিকে নেওয়া হয়েছে। আর তারা যখন গেছেই, শুধু বিরোধী দলের নেতার পদ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকার কথা নয়। মন্ত্রিত্ব আর বিশেষ দূতের পদও চেয়েছে। পেয়েছেও। তাই তাদের কোনো নেতা সরকারের সমালোচনা করলেও তা ‘ফ্রেন্ডলি’ হবে। তির্যক হবে না—এটা অন্তত বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে জোর দিয়ে বলা যায়।

সরকারের কাছে এ বিরোধী দলের নেতার কদর কিন্তু অনেক। নির্বাচন নিয়ে এরশাদ যখন একপর্যায়ে বিগড়ে যান বা তা করার ভান করেন, তখন হাল ধরেন এ নেতাই। এরশাদ ‘র‌্যাবের সহায়তায়’ সিএমএইচে ভর্তি হন। মাস খানেক তথায় থাকেন। মাঝেমধ্যে খেলেন গলফ। জনৈক মুখপাত্রের মাধ্যমে নির্বাচন বর্জনের আহ্বান জানাতে থাকেন। তখন রওশন এরশাদ নির্বাচনে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি বলেন, এরশাদের নির্দেশেই তা করা হচ্ছে। তাই সরকারি দল তাদের একজন প্রবীণ নেতার আসন ছেড়ে দেয় তাঁকে। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে আসেন তিনি।
ওই প্রবীণ নেতাকেও টেকনোক্র্যাট কোটায় মন্ত্রী করে সব দিক সামাল দেওয়া হয়েছে। বিরোধী দলের নেতার পদ ছাড়াও মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্তি আর প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত পদে নিয়োগ দলটিকে ক্ষমতার অংশীদার করেছে। সুতরাং, সরকারের প্রতি তাঁর আস্থা অবিচল থাকারই কথা।

এরশাদ বর্তমান প্রধান দুটো দলের সঙ্গেই সময়ে সময়ে জোট করেছেন। কখনো তারা তাঁকে ঠকিয়েছে। কিংবা তিনি তাদের। কারাবাস করেছেন দুটো দলের সরকারের সময়েই। তাঁর দলের মধ্যেও এ দুই দলের প্রতি চিহ্নিত অনুরাগী কয়েকজন নেতা আছেন। হুমকি-ধমকি যা-ই দিক, একা তাঁরা এগোতে পারবেন না। এটা এরশাদ ও রওশন এরশাদ উভয়ই ভালোভাবে বোঝেন। বোঝেন দলের অন্যরাও। তাই যখন যেদিকে সুবিধা, সেদিকেই ঝুঁকে পড়েন। অতীতের অবজ্ঞা, অবহেলা আর কথা না রাখার বিষয়গুলোও উপেক্ষা করেন নিজেদের গরজেই। আর তা করতে গিয়ে চৈতন্য মহাপ্রভুর শিষ্য ও বন্ধু নিত্যানন্দ রচিত একটি গানের কলি হয়তো বা স্মরণে আনেন। সে গানের কলিটি হচ্ছে:

মেরেছিস কলসির কানা,

তাই বলে কি প্রেম দেব না?

চৈতন্য মহাপ্রভু আর তাঁর শিষ্য সেই প্রেম বিলিয়েছিলেন নিছক সদিচ্ছায়। আর আমাদের বর্তমান সংসদের বিরোধী দলের প্রেম কিন্তু অনেক চড়া মূল্যে কেনা।

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।

majumder234@yahoo.com

রাজসিক সংবর্ধনা- বর্ণিল তোরণ আর সোনার নৌকা by আলী ইমাম মজুমদার

Monday, January 27, 2014

অতীতে ভূরি ভূরি হয়েছে। সমালোচনা যতই হোক, থেমে থাকেনি। তবে আশা করা হয়েছিল, এবার অন্তত এসব কিছু পরিহার করা হবে। কেননা, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি স্বাভাবিক পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়নি, এটা সবার জানা।
জনগণের প্রকৃত অংশগ্রহণ কী পরিমাণ ছিল, তা দেশ কিংবা বিদেশেও অনেকের জানা। তাই নির্বাচনের পর সরকার গঠনে কিছুটা ইতিবাচক দিক নজরে এল। দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ কতিপয় নেতা সরকারে যোগ দিলেন। বাদ পড়লেন বিতর্কিত কিছু ব্যক্তি। এতে ধারণা করা হয়, সরকার নির্বাচনের ঘাটতিটি আপাতত সুশাসনের মাধ্যমে পূরণের চেষ্টা করবে। অবশ্য উল্লেখ করা আবশ্যক যে সুশাসন গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রতিকল্প নয়; বরং পরিপূরক।

যে কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত, তা উপেক্ষা করার নয়। প্রথমটি যমুনার অপর পারের এক জেলার। একজন সাংসদ মন্ত্রী হয়ে আসছেন নিজ এলাকায়। এক শ মাইক্রোবাস আর তিন হাজার মোটরসাইকেলের বহর তাঁকে স্বাগত জানায়। স্বাগত জানায় প্রায় দেড় শ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা। তীব্র ঠান্ডায় তারা তিন ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ছিল। বন্ধ করে দেওয়া হয় সেদিনের পাঠক্রম। অপর ঘটনাটিও একই জেলার। একজন সাংসদকে সংবর্ধনার খবর। তিনি নির্বাচিত হওয়ার পর শপথ নিয়ে ঢাকা থেকে ফিরলেন। খবরে প্রকাশ, নিজ এলাকার কাছাকাছি আসতেই শতাধিক গাড়ি আর সহস্রাধিক মোটরসাইকেলের বহর যুক্ত হয় তাঁর গাড়ির সামনে-পেছনে। রাস্তার দুই পাশে স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকেরা প্ল্যাকার্ড, ব্যানার, ফেস্টুন আর রঙিন বেলুন হাতে নিয়ে তাঁকে স্বাগত জানান। নির্মিত হয়েছে শতাধিক তোরণ।
হরতাল-অবরোধে ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনা গোল্লায় যেতে বসেছে। সেখানে এক দিনের জন্য হলেও মন্ত্রী-সাংসদকে স্বাগত জানাতে ছাত্র-শিক্ষকেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছেড়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবেন কেন? এভাবে স্বাগত না জানানোর জন্য সরকারের নির্দেশও রয়েছে। তা সত্ত্বেও এমনটা ঘটে চলছে। পরবর্তী ঘটনাটি ব্রহ্মপুত্রতীরের একটি জেলা শহরের। সেই শহরের একজন নেতা মন্ত্রী হয়ে জেলা সদর সফরে আসছেন। জানা যায়, শহরেই নির্মিত হয়েছে গোটা ত্রিশেক তোরণ। তার বেশ কয়েকটি বর্ণিল ও ব্যয়বহুল। তদুপরি আগমনপথে অন্যান্য স্থানেও এ ধরনের সংবর্ধনার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
কেউ মন্ত্রিত্ব পেলে তাঁকে সংবর্ধনা জানানোর রেওয়াজ রয়েছে। তবে তাতে এরূপ রাজসিক আয়োজন করার আবশ্যকতা আছে কি? সরকারের টাকায় না হলেও যারা এগুলো করছে, তারা বিনিয়োগের সহস্র গুণ কড়ায়-গন্ডায় উশুল করে নেবে। সেটা নেবে মন্ত্রী-সাংসদদের আশীর্বাদধন্য হয়ে। অপর খবরটি হচ্ছে, দেশের উত্তরাঞ্চলের একটি উপজেলায় একজন সাংসদকে সংবর্ধনায় উপহার দেওয়া হয়েছে সোনার নৌকা। সমালোচনা হলে আয়োজকেরা বলেন, নৌকাটি রুপার। সোনার প্রলেপ দেওয়া হয়েছে মাত্র। হতেও পারে। তবে রাজসিক মানসিকতার প্রমাণ কিন্তু এতেই মেলে। ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন। তবে ইদানীং প্রতিদিনই ঘটে চলছে দেশের বিভিন্ন স্থানে।
অনেক মন্ত্রী-সাংসদ এ ধরনের সংবর্ধনা নেন। আর তা আয়োজন করতে কর্মী-সমর্থকদের একটি অংশ নেমে পড়েন চাঁদা তোলায়। কেউ বা ভবিষ্যতের বিনিয়োগ হিসেবে শুরুতে নিজেই দেন কিছু অর্থ। তদুপরি একেবারে হাতের মুঠোয় থাকা ছাত্র-শিক্ষকদের ব্যবহার করেন বিবেচনাহীনভাবে। এ ধরনের রাজসিক চমকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী-সাংসদ তৃপ্ত হতে পারেন। তবে তাঁদের জনপ্রিয়তার ব্যারোমিটার নিম্নমুখী হওয়ারই কথা। কেননা, আমাদের মতো দেশে সাধারণ মানুষের কোনো ভাষা নেই। তবে তারা সব বোঝে। আর সুযোগ পেলেই ব্যালটের মাধ্যমে এই রাজসিক বিলাসিতার বিরুদ্ধে মতামত দেয়। অতীতে তা-ই দিয়েছে। উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে যে চারদলীয় জোট সরকারের সময়েও একই ধরনের রাজসিক সংবর্ধনা মানুষ দেখেছে। জেনেছে একজন সাংসদের সোনার মুকুট উপহার নেওয়ার কাহিনি। সময়ে ব্যালটে এর মীমাংসা করেছে তারা।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক। ২০০৯-এর সূচনায় যে ধরনের জনসমর্থন নিয়ে সরকার গঠিত হয়েছিল, ২০১৪-তে তা কিন্তু হয়নি। এই সরকারের সাংবিধানিক ও আইনি বৈধতা থাকলেও রাজনৈতিক বিবেচনায় অসম্পূর্ণতার ভার বহন করতে হবে। আর তা দেশে ও বিদেশে সমান তালে। যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট, ব্রিটিশ হাউস অব কমন্স আর ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্ট—সবাই আমাদের গেল নির্বাচনটি নিয়ে ব্যক্ত করেছে হতাশা। আশঙ্কা করছে গণতান্ত্রিক পথ থেকে আমাদের বিচ্যুতির। ক্ষোভ প্রকাশ করেছে সহিংসতা ও অস্থিরতার বিষয়ে। আশা প্রকাশ করেছে, রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে একটি বিশ্বাসযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্পর্কে সমঝোতার। এই দুটি মহাদেশ আমাদের রপ্তানির প্রধান বাজার। আমাদের উন্নয়নের অংশীদার বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ আর এডিবির ওপরও তাদের রয়েছে প্রভূত প্রভাব। সুতরাং বাংলাদেশকে নিজ স্বার্থেই এসব মতামত বিবেচনায় নিতে হবে।
অন্যদিকে, জাতীয় বাস্তবতার বিষয়টিও উপেক্ষা করার নয়। নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতিতে দেশে আপাতত একটি স্বস্তির পরিবেশ বইছে। তবে একে স্থায়ী ও নিশ্চিত বলে ধরে নেওয়া যৌক্তিক হবে না। এটা সবাই জানেন ও বোঝেন যে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটকে নির্বাচনে আনতে সরকার তেমন কোনো জোরদার উদ্যোগ নেয়নি। তেমনি তারাও নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আগ্রাসী প্রচেষ্টা গ্রহণ করেনি। ফলে ভোটারের উপস্থিতি খুব কম হলেও নির্বাচনটি হয়ে গেছে। তবে এটাকে জনসমর্থিত বলার সুযোগ নেই।
উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক যে সুশাসন জনগণের অধিকার। আর সেই অধিকার নিকট অতীতে আমরা ভোগ করতে পারিনি। চারদলীয় জোট সরকারের শাসনে হতাশ হয়ে ২০০৮-এর শেষে মহাজোটকে মহাবিজয় দিয়েছিল দেশবাসী। কিছু ক্ষেত্রে সাফল্য থাকলেও তারা সুশাসন দিতে পারেনি জাতিকে। দলীয়করণ, মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিচারহীনতা, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি ইত্যাদি মিলিয়ে তাদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ প্রায় কাছাকাছি। নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা সম্পর্কে সমঝোতার অভাব গেল নির্বাচনটিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তাই এই নির্বাচনে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে, এটা জোর দিয়ে বলার সুযোগ নেই। অন্যদিকে যারা নির্বাচন বর্জন করে বিভিন্ন কর্মসূচি দিয়েছিল, তাদের পক্ষে জনমত সৃষ্টি হয়েছে—এমন ভাবারও কোনো কারণ নেই। বিশেষ করে তাদের লাগাতার সহিংস কর্মসূচি সরকারের বিরুদ্ধে দাবি করা হলেও অনেক ক্ষেত্রে এটাকে জনগণের বিরুদ্ধে বলেই মনে করলে দোষ দেওয়া যাবে না। তাই জনগণ অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু নির্বাচন চাইলেও তাদেরই সমর্থন দেবে, এমনটা জোর দিয়ে বলা যায় না।
এ ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারের সুযোগ রয়েছে তাদের নিকট অতীতের কালিমা দূর করে আবার জনগণের মুখোমুখি হওয়ার। সরকারের গঠনকাঠামো কিছু ব্যতিক্রম ব্যতিরেকে অনেকটা সেই প্রত্যাশারই ইঙ্গিত দেয়। এমনকি সরকারের একজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী নয়াদিল্লি সফরকালে গণমাধ্যমের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, অদূর ভবিষ্যতে নির্বাচনের সম্ভাবনা নেই। তাঁর ভাষায়, ‘ভোট নয়। আমাদের মাথায় এখন সুশাসনের চিন্তা। হিংসা থামানোর চিন্তা।’ এ চিন্তা বাস্তবায়ন করতে হলে সরকারকে দলমত-নির্বিশেষে যেকোনো হিংসাত্মক কর্মসূচির বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে তা করতে গিয়ে একের পর এক মামলার আসামিকে এখানে-সেখানে নিহত অবস্থায় উদ্ধার হলে হিংসার রাজনীতি আবারও জোরদার হতে পারে। পাশাপাশি বাদ দিতে হবে বিরোধী দলের নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে বিঘ্ন সৃষ্টি। বিবেচনায় রাখা দরকার, প্রকৃতপক্ষে প্রধান বিরোধী দল সংসদে নেই। তবে মাঠে আছে। আর তার কলেবর উপেক্ষা করার নয়। সংসদের বিরোধী দলটি সরকারের রাজনৈতিক কর্মসূচির জন্য কতটা সহায়ক হবে, এটা বোধগম্য হচ্ছে না। যা-ই হোক, প্রধান বিরোধী দলের অস্তিত্বকে উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই।
বলা হয়তো যায়, মন্ত্রী-সাংসদেরা কেউ কেউ জাঁকজমকপূর্ণ সংবর্ধনা নিলেই সুশাসনের ঘাটতি হতে পারে না। বক্তব্যটি সমর্থনযোগ্য নয়। কেননা, এর ব্যয় জনগণই কোনো না কোনোভাবে মেটাবে। তদুপরি স্কুল-কলেজ বন্ধ করে ছাত্র-শিক্ষকদের এতে অংশ নিতে উৎসাহ দেওয়া সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। আবার জানা যায়, ইতিমধ্যে সাংসদদের কেউ কেউ খবরদারি শুরু করেছেন স্থানীয় প্রশাসনসহ বিভিন্ন সংস্থার ওপর। এগুলো অনুচিত, অযাচিত আর সুশাসনের প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে। একজন সাংসদ তো একটি সিটি করপোরেশনের ময়লা নিষ্কাশন স্থানটি বন্ধ করে দেওয়ার ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন। কোনো বিকল্প পরামর্শ তিনি দেননি। তাঁর বিরুদ্ধে কতিপয় পরিবহন কোম্পানির অভিযোগ ছিল চাঁদাবাজির। এখন তাদের বিরুদ্ধেই চাঁদাবাজির মামলা হচ্ছে। বিচ্ছিন্নভাবে হলেও এ ধরনের ঘটনা সুশাসনের অন্তরায়। আর সরকারের সদিচ্ছার পরিপন্থী। যাঁরা এগুলো করছেন, তাঁরা তাঁদের নির্বাচনে নৈতিক ভিত্তিটা কি তলিয়ে দেখেছেন? দেখলে এমন হওয়ার কথা ছিল না। তাঁরা না দেখলেও কিন্তু দেশ-বিদেশের অনেকেই তা দেখছেন। আর সবাইকে দীর্ঘকাল অব্যাহতভাবে উপেক্ষা করা যাবে না।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com

এরশাদ- কার হাসি কে হাসে? by আলী ইমাম মজুমদার

Friday, January 17, 2014

২০০১ সালের নির্বাচনের আগে দুটো প্রধান শিবিরই এরশাদের জাতীয় পার্টিকে নিজেদের জোটে নিতে সক্রিয় ছিল। এর আগে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের পর তিনি আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় যেতে সমর্থন দেন। বিনিময়ে তাঁর পাঁচ বছরের বন্দিজীবনের আপাতসমাপ্তি ঘটে।
তবে সে সরকারের মেয়াদকালেই জনতা টাওয়ার মামলায় দুর্নীতির দায়ে দণ্ডিত হন তিনি। তাই ২০০১ সালে অভিমানে আওয়ামী লীগের দিকে হাত বাড়াননি। আস্থা-অনাস্থার দোলাচলে যাননি সরাসরি অপর পক্ষের দিকেও। ভেবেছিলেন ঝুলন্ত সংসদ হবে। তাঁর দল হবে ক্ষমতার নির্ণায়ক। যেমন কিছুটা হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। সে প্রত্যাশায় ওই বছরে এককভাবেই প্রার্থী দেন। বারবার ঘোষণা করেন, শেষ হাসি তিনি হাসবেন। হাসতে পারেননি তিনি। সেই নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়েই চারদলীয় জোট সরকার গঠন করে। ২০০৭ সালের নির্ধারিত নির্বাচনের আগে মহাজোটের সঙ্গে করেন আঁতাত। সে নির্বাচনটি হয় ২০০৮ সালের শেষে। জানা যায়, মহাজোট নির্বাচিত হলে তাঁকে রাষ্ট্রপতি করাসহ আরও কিছু দাবি ছিল তাঁর। মহাজোটই বিজয়ী হয়েছিল।

মহাজোটের ছিল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। তাই তারা এসব দাবি মেটানোর কোনো গরজই অনুভব করেনি। সেবারেও তিনি তাঁর সে ঈপ্সিত হাসি হাসতে পারেননি। ক্ষুব্ধ ছিলেন বরাবর। সমঝোতা ও মোকাবিলা দুই ধরনের নিয়েই মহাজোটের সঙ্গে চলেছেন। বারবার নেতা-কর্মীদের বলেছেন দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাঁর দল এককভাবে অংশ নিয়ে জয়লাভ করবে। গঠন করবে সরকার। ‘শেষ হাসির’ কথা উল্লেখ না করলেও বক্তব্যের সুর অনেকটা সে ধরনের ছিল।
কিন্তু দশম সংসদ নির্বাচনের সময়সীমা ঘনিয়ে আসতেই তিনি ডিগবাজিতে নেমে পড়েন। তাঁর ডিগবাজির সঙ্গে দেশবাসীর পরিচয় দীর্ঘদিনের। উল্লেখ্য, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার সময় সেনাপ্রধান ছিলেন এরশাদ। খবর পেয়েই অসুস্থ উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তারকে হাসপাতাল থেকে এনে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিতে মুখ্য ভূমিকা ছিল তাঁর। আরও ভূমিকা রেখেছিলেন, যাতে তিনি (বিচারপতি সাত্তার) দলের মনোনয়ন লাভ করেন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে। তা-ই ঘটেছিল। রাষ্ট্রপতি হন বিচারপতি সাত্তার। দ্রুত ভোল পাল্টে যায় এরশাদের। তিনি গণমাধ্যমে বিবৃতি দিতে থাকেন সামরিক বাহিনীকে ক্ষমতার অংশীদার করার দাবিতে। এক অন্ধকার রাতে বন্দুকের নলের মুখে নিজেই নিয়ে নেন রাষ্ট্রক্ষমতা। তবে সামরিক বাহিনীকে ক্ষমতার অংশীদার করেননি তিনি। করেছিলেন তাঁর আস্থাভাজন কিছু সামরিক-বেসামরিক ব্যক্তিকে।
তখনো বহু নাটক দেখেছে দেশবাসী। তারা জানল, তাদের রাষ্ট্রপতি একজন কবি আর প্রেমিকও বটে। ‘কবি’ এরশাদ কবিতা লিখে পীড়িত করেছেন জাতিকে। ‘প্রেমিক’ হিসেবে ভেঙেছেন বেশ কিছু সুখের সংসার। পাশাপাশি দেশবাসীকে দিয়েছেন গণতন্ত্রের নতুন পাঠ। দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলকে বিপরীতমুখী রেখে ক্ষমতার বলয় টিকিয়ে রাখেন লম্বা সময়। কিন্তু একসময় অঘটন ঘটে যায়।
অবশ্য অঘটন তাঁর জন্য। জাতির ঘটে রাহুমুক্তি। এর পরপর তাঁকে দীর্ঘ কারাবাস করতে হয়। মোকাবিলা করতে হয় অনেক মামলার। আবার প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের চরম বিপরীতমুখী অবস্থানের সুযোগ নিতে থাকেন তিনি। একবার এদিক, একবার সেদিক করে নিজের প্রয়োজনীয়তা ধরে রাখতে সফলও হন। আর সরকারপক্ষের দুর্বল প্রচেষ্টায় তিনি উভয় দলের সরকারের সময়ই বেশ কিছু মামলা থেকে মুক্তি পেয়ে যান।
দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচনের বেশ আগে থেকেই বরাবরের মতো তিনি বিভিন্ন রকম অবস্থান নিতে থাকেন। কখনো মহাজোট ছাড়ার হুমকি আবার কখনোবা তাদের সঙ্গে চিরদিনের বন্ধনের কথাও বলতে থাকেন তিনি। তবে সর্বশেষ দুই মাসে মানুষ দেখেছে তাঁর নানা নাটক। একবার বললেন, সব দলসহ নির্বাচন না হলে তিনি তাতে যাবেন না। জনগণ থুতু দেবে। আবার কদিন বাদেই বলতে শুরু করেন, নির্বাচনে না গেলে জনগণ সব দলকেই থুতু দেবে।
মহাজোট থেকে বেরিয়ে এসে দলীয় প্রার্থীদের মনোনয়ন দেন তিনি। দাখিল করেন মনোনয়নপত্র। এমনকি নির্বাচনকালীন সরকারে নিজ দলের বেশ কয়েকজন সদস্যকে মন্ত্রী বা উপদেষ্টা নিয়োগ করা হয় তাঁর সুপারিশে। হঠাৎ আবার নির্বাচন থেকে সরে আসার ঘোষণা দেন। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার আর নির্বাচনকালীন সরকার থেকে সরে আসার লোক দেখানো চেষ্টাও চলে। অবশ্য তাঁর কথায় বিশ্বাস রেখে বেশ কিছু প্রার্থী মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। তবে মানুষ ধাঁধায় ছিল। একপর্যায়ে ১১ ডিসেম্বর রাতের বেলায় র‌্যাব তাঁকে সিএমএইচে ‘নিয়ে যায়’। বলা হয়, তিনি অসুস্থ। চিকিৎসার জন্য তাঁকে তথায় নেওয়া হয়েছে। সেখানেই ছিলেন ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত। সেখান থেকে তাঁর মাঝেমধ্যে
গলফ খেলার খবরও আসত। আবার তাঁর একজন মুখপাত্র দাবি করতে থাকেন, এরশাদকে আটকে রাখা হয়েছে। তিনি নির্বাচনে অংশ না নিতে সংকল্পবদ্ধ। তাঁর দলীয় প্রতীক লাঙ্গল কাউকে বরাদ্দ না দিতে তিনি সিইসিকে একটি চিঠিও দেন। কিন্তু তাঁকেসহ তাঁর দলের সবাইকে সে প্রতীক দেওয়া হয় রওশন এরশাদের সুপারিশে।
প্রধান বিরোধী দলের অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে নির্বাচনে যা হওয়ার, তা-ই হলো। নির্বাচনপর্ব শেষ হয় ৫ জানুয়ারি। এরশাদসহ তাঁর দল লাভ করল ৩৩টি আসন। এরশাদ তাঁর ভাষায় ‘বর্জন করা’ নির্বাচনে সাংসদ হলেন। দাখিল করা মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের ‘আবেদনও করেছিলেন’ তিনি। তা সত্ত্বেও সাংসদ যখন হয়েই গেছেন, তা টিকিয়ে রাখতে শপথ গ্রহণ করতে হয়। প্রথম দিন দলের সঙ্গে যাননি। দলটির সংসদীয় নেতা নির্বাচিত হলেন রওশন এরশাদ। সংসদের কার্যপ্রণালি বিধি অনুসারে স্পিকার তাঁকে বিরোধী দলের নেতা বলে বিজ্ঞপ্তিও জারি করেছেন। এগুলো
কতটা এরশাদের ইচ্ছায় কিংবা দলের অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহে, তা নিয়ে ভিন্নমত আছে। তবে অন্যদের শপথ দেওয়ার পরদিন জানা গেল, সিএমএইচ থেকে এরশাদ চুপিচুপি এসে সাংসদ হিসেবে শপথ নিয়ে আবার সেখানেই চলে যান।
প্রশ্ন আসছে, চুপিচুপি শপথ নিতে হবে কেন? উত্তরটাও সবার জানা। গণমাধ্যমের নজর এড়াতে। তাদের নজরে এলেই হাজার প্রশ্ন হবে—নির্বাচন বর্জন, মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার, দলীয় সদস্যদের নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগের নাটক আর বর্জন করা নির্বাচনে বিজয়ের জাদুর কাঠি নিয়ে। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসবে, তাঁঁর কথিত অসুস্থতা ও র‌্যাবের সহায়তায় সিএমএইচে যাওয়া নিয়েও। সুতরাং যতক্ষণ সম্ভব
বা প্রয়োজন, ততক্ষণ তাদের নজর এড়িয়ে থাকতে পারলেই মঙ্গল। কিন্তু তারা নাছোড়বান্দা। তাঁর সঙ্গে দেখা হোক আর না-ই হোক, সংবাদ সংগ্রহ করে চলছে প্রতিযোগিতা করে। আর সেসব সংবাদ স্বাভাবিকভাবেই তাঁর ক্রমাগত ডিগবাজি খাওয়া অতীতকে সামনে নিয়ে আসছে।
জাতীয় জীবনের স্পর্শকাতর বিষয়গুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করতে তিনি পছন্দ করেন। এতে জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও লাভবান হয়েছেন তিনি। যেমন সংবিধানে রাষ্ট্রধর্মের বিধান সংযোজন আর সরকারি ছুটির দিন পরিবর্তন। পীর-দরবেশদের দরবারে আসা-যাওয়াও তিনি সুযোগ পেলেই করেন। উদ্দেশ্য একটিই—তাঁদের সমর্থন নিজের দিকে টেনে আনা। সম্প্রতি হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচির প্রতি নৈতিক ও বৈষয়িক সমর্থন দিয়েছেন। নিয়েছেন তাঁদের কারোর দোয়া আর কারও বা বদদোয়া। কিন্তু এখন সাংসদ হিসেবে সে কর্মসূচি গ্রহণের জন্য সংসদে কি তিনি একটি সিদ্ধান্ত প্রস্তাব আনবেন? তাঁর অতীত অন্তত বলে, তিনি তা করবেন না। আর যদি করেনই, তাঁর দলের সমর্থন পাবেন বলে মনে হয় না। বিশেষ করে দলটি সরকারের অংশ হওয়ায় এ ধরনের কর্মসূচির সমর্থন দেওয়ার সুযোগই নেই।
পরিশেষে এল ১২ জানুয়ারি। বঙ্গভবনের দরবার হলে নতুন মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ। সে মন্ত্রিসভায় তাঁর দল থেকে একজন কেবিনেট মন্ত্রী ও দুজন প্রতিমন্ত্রী নেওয়া হয়। সেদিনই এক গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে তিনি হন মন্ত্রী পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। ‘ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স’-এর বিধান অনুসারে তাঁর মানক্রম হবে মন্ত্রীর এক ধাপ নিচে। অবশ্য সাবেক রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি মানক্রমে মন্ত্রীর অনেক ওপরে। সুতরাং, নতুন নিয়োগ তাঁর মর্যাদা উন্নীত করেছে, এমনটি বলার সুযোগ নেই। বঙ্গভবনের জনাকীর্ণ দরবার হলে তিনি যখন প্রবেশ করেন, তখন তাঁর মুখ ছিল মলিন। প্রবেশের সময়ে কেউ দেয় করতালি, আর কেউবা হাসি। সে হাসি পরিহাস, কৌতুক কিংবা স্বাগতসূচক—যেকোনোটাই হতে পারে। যেটাই হোক, হেসেছেন অন্যরা। এবারেও তিনি হাসতে পারেননি।

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com

নিরাপত্তা- পুলিশ কেন হামলার শিকার হবে? by আলী ইমাম মজুমদার

Wednesday, January 1, 2014

২০১৩ সালের সূচনা থেকে পুলিশের ওপর অব্যাহতভাবে হামলার ঘটনা ঘটে চলছে। এই সময়কালে এ ধরনের নৃশংস হামলায় পুলিশের ১৫ জন সদস্য নিহত ও প্রায় আড়াই হাজার আহত হন।
নিহত হয়েছেন বিজিবির দুজন সদস্যও। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে একাধিক সাব-ইন্সপেক্টর এমনকি ওসিও রয়েছেন। এই ডিসেম্বর মাসেরই সূচনায় রাজশাহীর মতিহার থানার ওসির পা ভেঙে দেয় হামলাকারীরা। বিস্ময়কর হলেও সত্যি যে হামলাকারীরা এ কাজটি করে পুলিশের থেকে কেড়ে নেওয়া অস্ত্র দিয়েই। পুলিশের ছয়জন সদস্য ছিলেন দলটিতে। সঙ্গে ছিল আগ্নেয়াস্ত্র। আইনের সমর্থন তো ছিলই। ছিল আত্মরক্ষার অধিকার। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাদের অসহায় অবস্থাতেই আমরা দেখলাম। সংবাদপত্র থেকে জানা যায়, এসব হামলা প্রতিরোধ ও হামলাকারীদের খুঁজে বের করতে পারছে না পুলিশ। এসব ঘটনায় করা মামলার তদন্তেও তেমন অগ্রগতি নেই বলে জানা যায়। অথচ বেশ কিছু ক্ষেত্রে হামলার ঘটনার ছবি ও ভিডিও ফুটেজ গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে।
এ ধরনের হামলার ঘটনায় জনগণ উদ্বিগ্ন হয়। যখন জানতে পারে, প্রকৃত অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে, তখন প্রবল নৈরাশ্যে ভোগে। কেননা, পুলিশ রাজপথে রাষ্ট্রশক্তির প্রতীক। রাষ্ট্রের সব কটি অঙ্গের অনেক সিদ্ধান্ত ও নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে হয় পুলিশকে। পুলিশ সম্পর্কে যত অভিযোগই থাকুক, বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিকে তাদেরই সহায়তা নিতে হয়। জনগণ চায় একটি শক্তিশালী, দায়িত্বশীল ও জনবান্ধব পুলিশ বাহিনী। আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে পুলিশ বাহিনীর কোনো কোনো সদস্য ক্ষেত্রবিশেষে জনহয়রানির কারণ ঘটান, এটা সত্য। আমাদের দেশে এটা আরও বেশি ঘটে। তা সত্ত্বেও পুলিশ ছাড়া কিন্তু কোনো দেশ চলে না। আমরাও চলতে পারব না। অবশ্যই সে পুলিশের সক্ষমতা থাকতে হবে দায়িত্ব সম্পাদনের। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে বেশ কিছু ক্ষেত্রে এ ধরনের হামলায় তাদের অসহায় অবস্থা আমাদের বিচলিত করেছে। এ ধরনের ঘটনা জনমনে স্বাভাবিকভাবেই শঙ্কা জাগায়। প্রশ্ন আসে, যারা নিজেদের রক্ষা করতে পারছে না, তারা কীভাবে জনগণের নিরাপত্তা বিধান করবে?

একটু তলিয়ে দেখার দরকার এ ধরনের ঘটনা কেন আর কীভাবে ঘটে? ২০১৩ সালের সূচনা থেকে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মামলার রায় দেওয়া শুরু হয়। মামলাগুলোর দণ্ডাদেশের বিরোধিতা করে জামায়াতে ইসলামী ও তাদের ছাত্রসংগঠন ছাত্রশিবির একের পর এক কর্মসূচি দেয়। ঘটতে থাকে হিংসাত্মক ঘটনা। হতাহত হয়েছেন কর্মসূচি বাস্তবায়নকারী দলের সদস্যসহ সাধারণ মানুষও। বস্তুতপক্ষে সে কর্মসূচির সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক না থাকলেও বিরোধীদলীয় জোট কর্তৃক নির্বাচনকালীন সরকারপদ্ধতি-সংক্রান্ত আন্দোলনের কর্মসূচি একাকার হয়ে যায়। পুলিশের ওপর হামলার এ ঘটনাগুলোর বেশ কিছু এসব কর্মসূচি চলাকালীন। কোনো কর্মসূচি ব্যতিরেকেই অতর্কিত হামলার ঘটনাও কিছু আছে। তবে হামলাকারীদের খুঁজে বের করতে অসুবিধা কোথায়, এটা বোধগম্য হচ্ছে না। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় প্রচণ্ড ব্যস্ততার কারণে তারা সুযোগ পাচ্ছে না। তাদের ব্যস্ততার বিষয়টি যথার্থ। সংস্থাটি প্রবল চাপের মুখে আছে। তবে এটা বিবেচনায় নেওয়া দরকার যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার প্রয়োজনেই এ ধরনের হামলাকারীদের আইনের আওতায় নেওয়া প্রয়োজন। বিষয়টিকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। নির্বাচনকালীন সরকারপদ্ধতি নিয়ে একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান আর অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যবস্থা করা গেলে আন্দোলনটির তীব্রতা কমে যেত বলে অনেকের ধারণা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা হয়নি।
দেখার বিষয়, এসব ঘটনা যারা ঘটায়, তারা কীভাবে পার পেয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে পুলিশের কিছু স্ববিরোধী ভূমিকা নজরে আসার মতো। কিছু ক্ষেত্রে এ-জাতীয় ঘটনার পর মামলার আসামির সংখ্যা হাজার হাজার দেখানো হয়। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে পুলিশের চারজন সদস্যকে নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয় গত ফেব্রুয়ারিতে। সে সংশ্লিষ্ট ঘটনাগুলোয় ৩২টি মামলা করা হয় ৬০ হাজার ব্যক্তিকে আসামি করে। এযাবৎ গ্রেপ্তার হয়েছে তিন শতাধিক। তবে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত হয়নি কেউ। উত্তরাঞ্চলের একজন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সঙ্গে এসব অভিযোগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জনৈক জামায়াতের নেতার জমি লেনদেন নিয়ে একটি প্রতিবেদন সংবাদপত্রে দেখা গেল। পুলিশ বাহিনীর ভেতরেই কারও কারও এ ধরনের মনোভাব থাকলে প্রকৃত আসামি চিহ্নিত হবে কীভাবে? অন্যদিকে, অকারণে বৈরী করা হচ্ছে হাজার হাজার পরিবারকে। পালিয়ে থাকছে তারা গ্রেপ্তার এড়াতে।অনেক ক্ষেত্রে নাশকতার মামলা হলেই প্রথম দিককার আসামি করা হচ্ছে বিরোধী দলের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের নেতাদের। নাশকতার ঘটনায় তাঁরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দায়ী হলে অবশ্যই আইনের আওতায় আসবেন। তবে যাচাই-বাছাই না করে শুধু শায়েস্তা করার জন্য এটা করা হচ্ছে বলেই অনেকে মনে করেন। ফলে পুলিশের প্রতি তাঁদের সমর্থকেরাও বৈরী হচ্ছেন। প্রকৃত অপরাধীরা গা ঢাকা দেওয়ার উৎকৃষ্ট সুযোগও পায়। আরেকটি নিকৃষ্ট সংস্কৃতি চালু রয়েছে গত কয়েকটি সরকারের সময় থেকে। যারা সরকারে থাকে, তাদের কর্মী-সমর্থকেরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিরোধী দলের ওপর সশস্ত্র হামলা চালান পুলিশকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। এ ধরনের কার্যক্রম পুলিশের মর্যাদা কমিয়ে দিচ্ছে।
পত্রপত্রিকার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে আরও জানা গেছে, এ ধরনের ঘটনা যাঁরা ঘটান, তাঁরা বেশ কিছু ক্ষেত্রে সরকারি দলের স্থানীয় পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের আশ্রয় ও প্রশ্রয় পান। জামিন লাভের সুবিধার্থে পেয়ে যান সরকারি দলের সমর্থক বলে স্বীকৃতির সনদ। এটা আত্মীয়তা কিংবা অন্য যেকোনো সুবিধার বিনিময়ে দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সরকারি দলের নেতা-কর্মীরা অবশ্যই দেখতে পারেন নিরপরাধ কোনো লোক যেন হয়রানির শিকার না হন। প্রকৃতপক্ষে ঘটছে ভিন্ন কিছু। সীতাকুণ্ডে মাসাধিক কাল মহাসড়ককে অগ্নিকুণ্ড করে রেখেছিল কিছু আন্দোলনকারী। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক কার্যত পরিত্যক্ত হওয়ার উপক্রম হয়েছিল হামলার ভয়ে। দেশের অর্থনীতিতে অপরিসীম গুরুত্ব রয়েছে এ মহাসড়কের। যৌথ বাহিনী নিয়োগ করে অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করা হয় বেশ কিছু ব্যক্তিকে। সবাই হয়তো বা অপরাধী না-ও হতে পারেন। সেটা দ্রুত তদন্ত করে শনাক্ত আর নিরপরাধ ব্যক্তিদের মুক্তির ব্যবস্থা করাই যৌক্তিক ছিল। কিন্তু জানা যায়, সরকারি দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সুপারিশে পার পেয়ে যাচ্ছে অনেকেই। এ ধরনের ঘটনা কিন্তু দেশের অন্যত্রও ঘটে চলছে।
পুলিশের এ বেহাল অবস্থার জন্য চলমান অস্থিতিশীল রাজনীতি অনেকাংশে দায়ী। তবে এ-জাতীয় পরিস্থিতিতেও তারা নিরপেক্ষ ভূমিকায় থাকলে হয়তো বা প্রতিক্রিয়া ভিন্নরূপ হতে পারত। সরকারি দলে যারা থাকে, তারা গত কয়েক যুগ বিবেচনাহীনভাবে ব্যবহার করে চলছে পুলিশসহ গোটা বেসামরিক প্রশাসনকে। সাংবিধানিক ও বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলো বেশ কিছুও এ নির্দয় দলীয়করণের করুণ শিকার। এটা একা পুলিশের দায় নয়। তবে যেহেতু তাদের সামনে থেকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সামাল দিতে হয়, তাই দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রতিহিংসার দায় প্রথমে তারাই ভোগ করছে। অবশ্য অন্যরাও বাদ থাকছে না। হামলাকারীরা ইউএনও অফিস পুড়িয়ে দিচ্ছে। আক্রান্ত হচ্ছেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা। এভাবে চলতে দিলে ভবিষ্যতে আরও হবে, এমনটাই স্বাভাবিক। তবে এ ব্যাধি জটিল। এর সহজ সমাধান নেই। বলা হয়, বর্তমান পুলিশ আইন তাদের যথাযথ দায়িত্ব পালনে অন্তরায়। প্রয়োজন হতে পারে আইনের সংস্কার কিংবা নতুন আইন। তবে শুধু আইনই তাদের নিরপেক্ষতার নিশ্চয়তা দেবে না। যেমনটা দেয়নি দুর্নীতি দমন কমিশনকে। সংবিধান ও আইনে পূর্ণ স্বাধীন হলেও বাস্তবে নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতাও অনেক ক্ষেত্রে পক্ষপাতসুলভ বলে অভিযোগ আসে। এটা শুধু বর্তমান কমিশনের ক্ষেত্রেই নয়, আগেও হয়েছে।
এখন মাঠপর্যায়ে সামরিক বাহিনী আছে। তাদের অবস্থান সাময়িক। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার দায়িত্ব পুলিশকেই পালন করতে হবে। এ-জাতীয় হামলা মোকাবিলায় তাদের সক্ষমতার অভাব আমাদের মর্মাহত ও হতাশ করে। মেধাসম্পন্ন সাহসী কর্মকর্তা যথেষ্ট আছেন পুলিশে। তাঁরা দায়িত্ব পালনে অবিচল ও নিষ্ঠাবান থাকলে এরূপ চলতে পারে না। আকস্মিক দু-এক জায়গায় হলেও ত্বরিত প্রতিকার এর পুনরাবৃত্তি রোধে সহায়ক হবে। অস্ত্রধারী পুলিশ দলের কাউকে নির্মমভাবে পেটায় হামলাকারীরা। আগুন ধরিয়ে দেয় তাঁদের গাড়িতে। অন্যরা পালিয়ে থাকেন। এসব ক্ষেত্রে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা অগ্রহণযোগ্য। ধৈর্য ধারণ অবশ্যই ভালো। তবে তা দুর্বলতার রূপ নিতে পারে না। সহিংস হামলা সব ক্ষেত্রে অহিংসভাবে মোকাবিলা করা যায় না। এভাবে ছাড় দিলে ঘটনাগুলো দিন দিন বেড়েই চলবে। সব শঙ্কা ঝেড়ে ফেলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য দৃঢ়সংকল্প হতে হবে তাদের। নিজদের সুরক্ষার পূর্ণ ব্যবস্থা নিতে হবে। দলমত-নির্বিশেষে জনগণের যানমাল রক্ষায়ও আপসহীন দৃষ্টিভঙ্গি আবশ্যক। অকারণে শক্তি প্রয়োগ আর প্রয়োজনের সময়ে নিষ্ক্রিয়তা—উভয়ই আইনত অগ্রহণযোগ্য।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com
 
Support : Dhumketo ধূমকেতু | NewsCtg.Com | KUTUBDIA @ কুতুবদিয়া | eBlog
Copyright © 2013. Edu2News - All Rights Reserved
Template Created by Nejam Kutubi Published by Darianagar Publications
Proudly powered by Dhumketo ধূমকেতু