অদম্য দুই প্রতিবন্ধী- এগিয়ে চলেছে ওরা

Friday, November 22, 2013

একজনের দুই চোখের জ্যোতি নেই। অন্যজনের দুই হাত থাকলেও তা বাঁকা ও শক্তিহীন। এবারের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা (পিএসসি) দিচ্ছে অদম্য ওই দুজন। একজন পরীক্ষা দিচ্ছে শ্রুতিলেখকের সহায়তায়। অন্যজন দুই পায়ে কলম ধরে পরীক্ষা দিচ্ছে।

শিক্ষার্থীরা হলো ঠাকুরগাঁওয়ের অন্বেষা প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী কামরুজ্জামান মিঞা (১৮) ও কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার বজরা মাদ্রাসাসংলগ্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাজমিন আক্তার (১১)। দুজনই শত কষ্ট সত্ত্বেও লেখাপড়া শেষ করে প্রতিষ্ঠিত হতে চায়।
কামরুজ্জামান ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার আরাজী মাটিগাড়া গ্রামের পান-সিগারেটের দোকানি মাহাতাব মিঞার ছেলে।
মাহাতাব জানান, তাঁর ছেলে কামরুজ্জামানের বয়স যখন সাড়ে তিন বছর, তখন টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে যায়। ২০০৪ সালে শহরের অন্বেষা প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কামরুজ্জামানকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করে নেয়। শুরুতে অনিয়মিত থাকলেও গত চার বছর সে নিয়মিত পড়ালেখা করে এবং বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ওর পড়ালেখার সব খরচ বহন করে।
পরীক্ষা কেমন হলো? গতকাল বৃহস্পতিবার পরীক্ষা শেষে কামরুজ্জামানের কাছে জানতে চাইলে হেসে বলে, ‘বেশ ভালো হয়েছে। সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি।’
কামরুজ্জামানের শ্রুতিলেখক চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ুয়া জিল্লুর রহমান বলে, ‘কামরুজ্জামান অনেক সময় প্রশ্নের উত্তর খুব দ্রুত বলে ফেলেন। তখন তাঁর কথার সঙ্গে তাল মেলাতে কষ্ট হয়। তবু ভাইয়ের হয়ে পরীক্ষায় লিখে দিতে পেরে ভালো লাগছে।’
পা দিয়ে লিখে পরীক্ষা দিচ্ছে শারীরিক প্রতিবন্ধী নাজমিন আক্তার (ডানে)  ছবি: প্রথম আলো
অন্বেষা প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের পরিচালক মনিরা আহমেদ বলেন, কামরুজ্জামান দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হলেও সে খুব সহজে পড়া আয়ত্ত করতে পারে। সে কৃতিত্বের সঙ্গে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা পাস করে উচ্চতর ক্লাসে ভর্তি হতে চায়।
আরেক অদম্য নাজমিন আক্তার উলিপুরের বজরা গ্রামের দিনমজুর নুরুন্নবী মিয়ার মেয়ে। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সে সবার ছোট।
নুরুন্নবী বলেন, ‘জন্ম থেকে মেয়ের দুই হাত অচল। কিন্তু ছোটবেলা থেকে পড়াশোনার প্রতি ওর আগ্রহ দেখে বাধা দিইনি। অভাবের সংসারে বোঝা না হয়ে লেখাপড়া করে যদি স্বাবলম্বী হতে পারে তবেই পরিশ্রম সার্থক হবে।’
তিনি জানান, উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয় থেকে নাজমিন প্রতিবন্ধী ভাতা ও স্কুল থেকে উপবৃত্তির টাকা পায়। ওই টাকা দিয়ে ওর লেখাপড়ার খরচ চলছে।
বজরা মাদ্রাসাসংলগ্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক খন্দকার সেলিনা পারভীন জানান, নাজমিন মেধাবী শিক্ষার্থী। সাহায্য-সহযোগিতা পেলে সে আরও ভালো করবে।
গতকাল বেলা ১১টায় বজরা এল কে আমিন স্কুল অ্যান্ড কলেজকেন্দ্রে গিয়ে নাজমিন আক্তারের সঙ্গে কথা হয়। সে জানায়, ‘শুরুতে পা দিয়ে লিখতে কষ্ট হতো। কিন্তু নিরাশ হইনি। অব্যাহত চেষ্টা চালিয়ে যেদিন লিখতে পেরেছি সেদিন ছিল সবচেয়ে আনন্দের।’

গ্রাম বাংলার হারানো ঐতিহ্য : গরুর গাড়ি ।। জহির রহমান

Saturday, June 4, 2011

ওকি গাড়িয়াল ভাই
কত রব আমি পন্থের দিকে চাহিয়ারে...
যে দিন গাড়িয়াল উজান যায়,
নারীর মন মোর ঝুরিয়া রয় রে।
ওকি গাড়িয়াল ভাই
হাকা গাড়ি চিলমারীর বন্দরে রে...

দূর থেকে বাতাসে ভেসে আসছে গান। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে কে গাচ্ছে এ গান! কে আবার? গাড়োয়ান ভাই। গাড়োয়ান ভাই গরুর গাড়ি চালায়। ছুটে চলে দূর-দূরান্তে, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। মাল নিয়ে ছুটে চলে বন্দর থেকে বন্দরে, এক গঞ্জ থেকে আরেক গঞ্জে। দূরের যাত্রাপথে সুরেলা কণ্ঠে ভাওয়াইয়া গান ধরে গাড়োয়ান ভাই।


বাতাসে গাড়ি চলার কোঁ-ওঁ-ওঁ-ওঁ শব্দ ভেসে আসছে। বেড়ার ফাঁকে দাঁড়িয়ে দেখে বাড়ির বউ। তাই তো গরুর গাড়িই যাচ্ছে! পর্দার ফাঁকে দেখা যাচ্ছে বড় বাড়ির বউ। নিশ্চয়ই নাইওর যাচ্ছে বাপের বাড়ি। ছোট ছোট ছেলেপুলেরা গরুর গাড়ির পেছন পেছন ছুটে চলছে। গরুর গাড়ি বাতাসে ছড়িয়ে দিচ্ছে কোঁ-ওঁ-ওঁ-ওঁ আওয়াজ।

পল্লী বধূরা মাথার গোমটা পরিয়ে মিষ্টি হেসে ঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে মনে নানা পরিকল্পনার চিত্র আঁকে। এখন সবকিছু স্মৃতি। বাস্তবের সলিল সমাধি হয়ে গেছে সেই বহুকাল আগে থেকে।

শত বছর আগের এমনই ছিল গ্রাম বাংলার অবস্থা। যেখানে নৌকা চলত না, গরুর গাড়িই ছিল সেখানকার একমাত্র যানবাহন। গঞ্জ, নদী-বন্দর, ছোট শহর, হাট-বাজার সব জায়গায় সচল ছিল গরুর গাড়ি। মালপত্র আনা নেওয়া হতো গরুর গাড়িতে। অভিজাত পরিবারের সদস্যরা যাতায়াত করতো গরুর গাড়িতে। আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে যেত গরুর গাড়ি চড়েই। বাড়ির বাইরে গরুর গাড়ির আওয়াজ শুনেই বোঝা যেত অতিথি এসেছে। গরুর গাড়ি এসেছে যখন তখন নিশ্চয়ই এসেছে কোনো বিশেষ অতিথি!
গরুর গাড়ি সম্পূর্ণরূপে আমাদের দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি। আমাদের দেশের বাঁশ, কাঠ ব্যবহার করা হয় গরুর গাড়ি তৈরিতে। গরুর গাড়িতে খুব বড় বড় দুইটি চাকা থাকে। চাকা দুইটি কাঠের তৈরি। কাঠের চাকায় পুরানো থাকে লোহার রিং। তার উপর আবার রবারের টায়ারও পরনো হয়। কাঠের চাকায় খোদাই করে নানান নকশা করা হয়।
কাঠমিস্ত্রি ও কামারের যৌথ চেষ্টায় গরুর গাড়ির চাকা তৈরি হয়। গরুর গাড়িও পল্লীবাংলার এক ধরনের লোকশিল্প; কুটির শিল্পও বটে। গরুর গাড়ির চাকা তৈরি করে এক বিশেষ শ্রেণীর কারিগর। চাকা কিনে নিয়ে মূলত গায়ের মিস্ত্রি বা লোকেরা নিজেরাই গরুর গাড়ি তৈরি করেন। গরুর গাড়ি মূলত বাঁশের তৈরি। তবে কোনো কোনো অংশ যেমন- চাকা তৈরি হয় বাবলা কাঠ দিয়ে। চাকার কেন্দ্রস্থলে বিয়ারিং থাকে। দুটি চাকা একটা দণ্ড দিয়ে যুক্ত করা হয়। এর উপরেই থাকে গরুর গাড়ির সব ভার। চালির মতো বাঁশের তৈরি অংশকে বলে চালি। চালির পেছন দিক চওড়া, সামনের দিক চাপা। পুরো চালির দু'পাশে থাকে মজবুত দুটি বাঁশের দণ্ড। সামনে এ দুটি দণ্ড একটি চণ্ডি কাঠ দিয়ে যুক্ত থাকে, যাকে জোয়াল বলে। চণ্ডি কাঠের সামনে থাকে  বিষখিলি, জোয়াল ও কানখিল। জোয়াল গরুর কাঁধে তুলে দেওয়া হয়। দু'পাশে দুটি গরু জোয়াল কাঁধে গাড়ি টেনে চলে। যাত্রীবহনের গাড়িতে নৌকার মতো ছই থাকে। ছইয়ের ভেতরে চালির ওপর পাটি বা বিছানা পেতে যাত্রীরা বসে থাকে।

গাড়িতে ব্যবহৃত গরুর পায়ের খুরে দেয়া হয় এক ধরনের লোহার পাট্টা। পাট্টা লাগিয়ে দেয়ার দুইটি কারণ রয়েছে। এক-গরুর পায়ের খুরে লোহার পাট্টা লাগিয়ে দেয়ার কারণে গরু রাস্তায় চলাচলে গায়ে শক্তি পায়। এ পাট্টার কারণে পা রাস্তায় তেমন একটা সিলিপ করে না। দুই, পায়ে পাট্টা লাগানোর কারণে গরুর পায়ের খুর ক্ষয় হয় না। স্থায়ীভাবে পাট্টা লাগানোর ব্যবস্থা নেই বলে ৪/৫ দিন পর পর গরুর পায়ের খুরে পাট্টা লাগিয়ে দিতে হয়। একটি গরুর গাড়িতে পায় দুই টন মালামাল বহন করা যায়।
এখন যন্ত্রচালিত যানবাহনের যুগ। মালামাল বহনের জন্য রয়েছে ট্রাক, লরি, মালগাড়ি। মানুষের যাতায়াতের জন্য রয়েছে মোটরগাড়ি, রেলগাড়ি, বেবী ট্যাক্সি, রিকশা ইত্যাদি। মানুষ এখন খুব একটা প্রয়োজন না হলে গরুর গাড়ি ব্যবহার করে না। আধুনিক যানবাহনের ভিড়ে গরুর গাড়ি অনেকটা হারিয়ে গেছে। তারপরও মিটিমিটি করে এর অস্তিত্ব টিকে আছে।
গরুর গাড়ির একটি সুবিধা হলো এতে কোনো জ্বালানি লাগে না। ধোঁয়া হয় না। পরিবেশের কোনো ক্ষতি করে না। এটি খুবই পরিবেশ সহায়ক একটি যানবাহন।
রহিম মিয়া একজন সৌখিন গরুর গাড়ির মালিক। গ্রামীণ আবহে সে গরুর গাড়ি চালাতো। মনের অদম্য সাহস এবং উপস্থিত বুদ্ধিমত্তার জোরে রহিম মিয়া তার গাড়ির গরুগুলোকে আগলে রাখতো। গরুর ঘাড়ে যখন গাড়ির জোয়াল চাপিয়ে রহিম মিয়া তার গরুর গাড়ি নিয়ে ছুটে চলতেন তড়িৎ গতিতে। নানা ধরণের মালামাল বহনে তার গাড়ির তুলনা ছিলো না। স্থানীয় মানুষজন তাকে রহিম মিয়াকে আগেই বলে রাখতো মাল বহনের জন্য। সততা এবং সাহসের জোরে রহিম মিয়া সবার কাছে ছিল প্রিয় ব্যক্তি। চিরন্তন সত্য মৃত্যু তাকেও একদিন নিয়ে যায় না ফেরার দেশে। আজ রহিম মিয়া নেই, নেই তার বাহারি গরুর গাড়িও।

ঐতিহ্যের ধারকবাহক এই গরুর গাড়ি একদিন বইয়ের পাতায় জায়গা করে নেবে। বর্তমান প্রজন্মের কেউ গরুর গাড়ি চিনবে না।
গরুর গাড়ি ঐতিহ্যেরই একটা অংশ। গ্রামীণ পরিবেশে গরুর গাড়ির প্রচলন থাকলেও বর্তমানে তেমন একটা চোখে পড়ে না। ইতিহাস-ঐতিহ্যের অনেক কিছু আমরা ক্রমান্বয়ে হারাচ্ছি। কালের গতিধারায় উন্নয়নের গতি থেমে নেই। আমাদের জীবন থেকে হারাচ্ছে এরকম নানা ঐতিহ্য। পরিকল্পনা অনুসারে মোকাবেলা করা গেলে কিছুটা হয়তো রক্ষা পেতো। এজন্য দরকার সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সফল উদ্যোগ গ্রহণ এবং  তা বাস্তবায়ন। এভাবে করা গেলে গণ-হারে ঐতিহ্য ধ্বংস না-ও হতে পারতো।


মধুমাস জ্যৈষ্ঠ ।। মোকাররম হোসেন

Saturday, April 30, 2011

পহেলা বৈশাখ
-এর উৎসব আমেজ, বৈশাখী মেলা, হালখাতা, আরো নানান মজার পর তার আমেজ শেষ হতে না হতেই চলে আসে জৈষ্ঠ্য মাস। এই মাসটি আমাদের কাছে মধুমাস নামেও পরিচিত। কারণ মিষ্টি মধুর অনেক ফল পাওয়া যায় এ মাসে। শুধু তাই নয়, সারা বছরের মধ্যেও সবচেয়ে বেশি ফল পাওয়া যায় জ্যৈষ্ঠ মাসে। এমন দিনে বিচিত্র ফলের মধুগন্ধে ভরে ওঠে চারপাশ। মধুমাসকে ঘিরে শিশুদের উৎসাহ গ্রামেরই বেশি চোখে পড়ে।

জ্যৈষ্ঠ মাসের ফলের তালিকা
এতই দীর্ঘ যে সবার পছন্দের কিছু না কিছু ফল তখন বাজারে থাকে। গ্রামে যাদের ফল কেনার সামর্থ্য নেই তারাও এ মৌসুমে একেবারে বঞ্চিত হয় না। কারণ আমাদের জাতীয় ফল কাঁঠাল হলেও কোনো বাড়িতে একটিও আমগাছ নেই, এমন দেখা যায় না। এক সময় তো এ দেশে ফলের প্রাচুর্যও ছিল। নিজের বা পরের গাছ বলেও তেমন কোনো বিধিনিষেধ ছিলো না। অন্তত শিশুদের জন্য বাগানের পরিধি কখনই সীমিত ছিলো না।
এখন শহরের মানুষতো বটেই গ্রামের মানুষকেও ফল-ফলারির জন্য বাজারের ওপর নির্ভর করতে হয়। তবুও মজার মজার ফল নিয়ে প্রতি বছরই জ্যৈষ্ঠ আসে মধুমাস হয়ে। ফল হোক সে নিজের বাগানের কিংবা বাজারের, তার স্বাদ পেতে কম বেশি সবারই ভালো লাগে।

কাঁঠাল জাতীয় ফল হলেও সে তুলনায় আম সবার প্রিয়। আর এ ফল সারা দেশের প্রায় সবখানেই পাওয়া যায়। শুধু পাকা আম নয়, কাঁচা আমেরও নানামুখী ব্যবহার রয়েছে। আমাদের দেশের সর্বত্র আম হলেও মাটির গুণাগুণ এবং আবহাওয়ার তারতম্যের কারণে স্বাদের ভিন্নতা রয়েছে। তা ছাড়া উৎপাদন বা পর্যাপ্ত ফলনের ওপর ভিত্তি করেও কিছু বিশেষ এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে, যেখানে নানা স্বাদের আম হয় প্রচুর পরিমাণে। আমাদের দেশে রাজশাহী এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জে সবচেয়ে বেশি আম হয়। আমগাছ দেখে খুব সহজেই চেনা যায়। গাছ ১৮-২২ মিটার পর্যন্ত উঁচু হয়। মাঘ মাসে হলুদ রঙের থোকা থোকা ফুল বা মুকুল হয়। ফল পাকার মৌসুম বৈশাখ থেকে আষাঢ় পর্যন্ত। এদের প্রজাতি সংখ্যা অনেক হওয়ায় ফলও নানা আকৃতির হয়; ছোট, বড়, মাঝারি, গোল, লম্বা, সরু ইত্যাদি। কাঁচা আম সবুজ, পাকলে হলুদ বা টকটকে লাল। মিষ্টি শাঁসের ভেতর একটা শক্ত আঁটি থাকে। আম স্বাদে গন্ধে সত্যিই অতুলনীয়। শুধু তাই নয়, তার আছে অনেক পুষ্টিগুণ। 

কাঁঠাল
জ্যৈষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি সময় হচ্ছে জাতীয় ফল কাঁঠালের ভর মৌসুম। আমগাছ যতটা সহজে চোখে পড়ে সে তুলনায় কাঁটাল গাছের সংখ্যা কম। পানি এ গাছের প্রধান শত্রু হওয়ায় বাংলাদেশের নিচু এলাকার, যেসব স্থানে বর্ষায় পানি জমে থাকে সেসব স্থানে বর্ষায় পানি জমে থাকে সেসব স্থানে কাঁঠালগাছ খুব একটা নেই। কিন্তু কিছু কিছু এলাকায় কাঁঠালগাছ এতই বেশি যে সেসব এলাকা কাঁঠালের জন্য বিখ্যাত। আমাদের তিন পার্বত্য জেলা, ঢাকা, ময়মনসিংহ, গাজীপুর, টাঙ্গাইলসহ আরও কয়েকটি জেলায় প্রচুর পরিমাণে কাঁঠাল হয়। কাঁঠালের স্বাদ, গন্ধ, পুষ্টিগুণ এবং সহজলভ্যতা- সবকিছু মিলিয়েই জাতীয় ফলের মর্যাদা পেয়েছে। এ ফল কাঁচা অবস্থায়ও খাওয়া যায়। এর গাছ চিরসবুজ, ২০ মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। পাতা ডিমাকৃতির, কালচে সবুজ, ঝরেপড়া পাতা গাঢ় কমলা রঙের। একেবারে মাটির কাছাকাছি থেকে ওপরের সরু ডাল পর্যন্ত ফল হয়। ফুলের ওপরের আবরণ খড়- সাদা এবং পাতা গজানোর পর সেটি ঝরে গিয়ে আঙুলের আকার ধারণ করে, এর নাম মুচি। মুচিই হচ্ছে কাঁঠালের ফুল। ফুলের গড়ন গোলাকার বা লম্বাটে। কোনটির গা প্রায় সমান আর কোনোটির খোঁচা খোঁচা কাঁটা থাকে। পাকা কোয়া বা খাবারের অংশটুকু রসাল, মিষ্টি ও সুস্বাদু। এ ফলে পুষ্টিগুণ অনেক। কাঁঠালের বীজ খাবার উপযোগী এবং পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ।

জাম
মুখরোচক এবং রসাল ফল। পাকা জাম দেখতে ঘনকালো বলেই হয়তো এর নাম কালো জাম, প্রায় সারা দেশেই জাম গাছ পাওয়া যায়। থোকা থোকা বেগুনি রঙের ফল ছোটদের অতিপ্রিয়। ফেব্রুয়ারি- মার্চ মাসে থোকায় থোকায় সাদা সুগন্ধী ফুল ফোটে, মে- জুন মাসে ফল পাকে। ফল টকÑ মিষ্টি স্বাদের। লবণÑ মরিচ মাখিয়ে খেতে দারুণ মজা। জাম মটরশুঁটির আকৃতি থেকে আরম্ভ করে পায়রার ডিমের আকৃতি পর্যন্ত হয়। এ ফল পুষ্টিকর।

জামরুল
বেশ সুদর্শন ফল। এর গঠন, আকৃতি ও সাদা মসৃণ গায়ের রঙ সবাইকে মুগ্ধ করে। এটি গ্রীষ্মের প্রচণ্ড তাপদাহে আমাদের তৃষ্ণা মেটায়। আমাদের দেশে এক সময় অনেক গাছ থাকলেও এখন সংখ্যায় কমেছে। জামরুল মাঝারি আকারের চিরসবুজ গাছ। প্রচুর ডালপালা ও পাতা হয়। বসন্তে সাদা রঙের অসংখ্য পুং কেশরযুক্ত বড় বড় ফুলের গাছ সুন্দর দেখায়। ফল পাকে গ্রীষ্মÑ বর্ষায়। ফল দেখতে নাশপাতির মতো, থোকায় থোকায় ঝুলে থাকে। কাঁচা-পাকা উভয় অবস্থাতেই দেখতে প্রায় সাদা। ফলের খোসা নেই, তার বদলে থাকে স্বচ্ছ মোমের মতো আবরণ। ভেতরে খয়েরি রঙের ৪Ñ৫ টি বীজ থাকে।

লিচু
গ্রীষ্মের আকর্ষণীয় ফল। এই মজাদার ফলটি কিন্তু বেশি দিন থাকে না। মৌসুমের প্রথম দিকেই শেষ হয়ে যায়। এই মনলোভা ফলটি দেশের সব অঞ্চলেই সমভাবে উৎপন্ন হয়ে যায়। মাত্র কয়েকটি জেলায় উন্নত জাতের লিচু দক্ষিণÑ চীনের উদ্ভিদ প্রজাতি হলেও আমাদের দেশে এর কদর অনেক বেশি। গাছ মাঝারি আকারের, চিরসবুজ। ডালপালা ছড়ানো, পাতা লম্বাটে, সবুজ, মসৃণ। ফুল ফোটে বসন্তে। অনেকটা আমের মুকুলের মতো, থোকা খোকা, রঙ সবুজÑ হলুদে মেশানো। কাঁচা ফল সবুজ, পাকলে হালকা লাল আর তামাটে রঙের মিশ্রণে চমৎকার দেখায়। ওপরের পাতলা আবরণটা ফেলে দিয়ে খেতে হয়। শাঁস নরম, সাদা, রসালো ও মিষ্টি। ভেতরে চকলেট রঙের বীজ থাকে।

আনারস
গ্রীষ্মের টক-মিষ্টি স্বাদের সুস্বাদু ফল। তবে বাজারে প্রায় সারা বছর আনারস পাওয়া গেলেও গ্রীষ্মের আনারসের স্বাদই আলাদা। সারা বিশ্বে অসংখ্য প্রজাতির আনারস হয়। এদের তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে; কুইন, কায়েন ও স্পেনিশ। আমাদের আমাদের দেশের ক্যালেঙ্গা এবং জলডুবি জাতও এই তিন ভাগের মধ্যে পড়ে। মধুমাসের আনারসের বেশির ভাগই উৎপন্ন হয় তিন পার্বত্য জেলায়। স্বাদে গন্ধে অপূর্ব এ আনারস বাজারে আসে খুব অল্প সময়ের জন্য। আনারস গাছের কাণ্ড পাতা যুক্ত করাতের মতো। ফুল কাণ্ডের উপরিভাগে জন্মায়। একবার ফলন হলে গাছ কেটে আবার নতুনভাবে চারা লাগাতে হয়। আনারস বেশ খাদ্য গুণসম্পন্ন। প্রতিকেজি আনারস থেকে ৫০০ ক্যালরি শক্তি পাওয়া যায়। তাজা ফল ছাড়াও বাজারে আনারসের জ্যাম, জেলি, স্কোয়ালি ইত্যাদি পাওয়া যায়।

শুধু কয়েকটি ফলই নয়। মধুমাসে আরো অনেক ফল পাওয়া যায়। বাজারে অনেক দিন থাকে তরমুজ, ফুটি, অনেক বুনো ফলও থাকে। আরো আছে গোলাপ জাম, বেতফল, আতাফল, বহেড়া ইত্যাদি। 

পূর্বে মাসিক নতুন কিশোরকন্ঠে প্রকাশিত
 
Support : Dhumketo ধূমকেতু | NewsCtg.Com | KUTUBDIA @ কুতুবদিয়া | eBlog
Copyright © 2013. Edu2News - All Rights Reserved
Template Created by Nejam Kutubi Published by Darianagar Publications
Proudly powered by Dhumketo ধূমকেতু