বইপত্র- রোকেয়ার আলো by সুদীপ্ত শাহীন

Tuesday, August 16, 2011

প্রতিবন্ধকতার প্রতিবাদে বাংলাদেশের নারী ও রোকেয়ার দর্শন—সম্পাদনা করেছেন নাজমা চৌধুরী \ ২০১০ \
পাঠক সমাবেশ \ পৃষ্ঠা ৮৭ \ ২৯৫ টাকা
উপমহাদেশের নারী জাগরণের অগ্রদূত হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছেন রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। পাশাপাশি মহীয়সী একজন নারী, একজন বিদগ্ধ ব্যক্তিত্ব হিসেবেও নন্দিত। সংগঠক, সাহিত্যিক, সমাজসংস্কারক হিসেবেও তাঁর ভূমিকা অনন্য। নারীমুক্তির পথিকৃৎ ও নারীবাদের প্রবক্তা হিসেবেও তাঁর অবদান চিহ্নিত।

এ রকম বহুবিধ অভিধায় তিনি সম্মানিত। তাঁর সকল কর্ম ও সৃষ্টির বহুধা হলেও সবকিছুর মূলে রয়েছে নারীর ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সমতা নিশ্চিত করা। এ কারণে তাঁর যাপিত জীবন, কর্ম ও সৃষ্টির আলোকে নারীর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার প্রয়াস ও প্রচেষ্টা বর্তমানের বিদ্যোৎসাহী, আলোকপিয়াসী, মুক্তমনা নারীরা এগিয়ে নিয়ে চলেছেন, যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো দেশের প্রধানতম বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ প্রতিষ্ঠা। নতুন শতাব্দীতে নারীর জন্য এই প্রাপ্তি মহার্ঘ্য এক সম্পদতুল্য, যার শুরুটা হয়েছিল গত শতকের আশির দশকে। ২০০০ সালে উইমেন্স স্টাডিজ বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ২০০৬-এ পরিবর্তিত নাম দাঁড়ায় উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ, যারা প্রতিবছর আয়োজন করে রোকেয়া স্মারক বক্তৃতামালার। ২০০৬ থেকে ২০০৯ সালে উপস্থাপিত বক্তৃতার সংকলন বই প্রতিবন্ধকতার প্রতিবাদে বাংলাদেশের নারী ও রোকেয়ার দর্শন। সম্পাদনা করেছেন নাজমা চৌধুরী। লেখকেরা হলেন মাহমুদা ইসলাম, মালেকা বেগম, হাসনা বেগম ও সুলতানা কামাল। উপর্যুক্ত লেখকক্রম অনুযায়ী বিষয়গুলো হলো—রোল অব ওমেন ইন পলিটিক্স অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশের নারী আন্দোলন, রোকেয়ার নারী ও ধর্মভাবনা: জাতীয় নারীনীতি, রোকেয়ার দৃষ্টিতে পারিবারিক আইন ও বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষিত। এ ছাড়া রয়েছে লেখক পরিচিতি এবং সম্পাদকের লেখা ভূমিকা—রোকেয়ার দর্শন: রাজনীতিতে নারী, নারী আন্দোলনের স্বরূপ ও ধর্মের রাজনীতি।
বক্তৃতার শিরোনাম দেখে সহজেই অনুমিত হয় বিষয়বিন্যাসের স্বরূপ, যার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয় উপমহাদেশের নারী আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি। দীর্ঘ ইতিহাস, ঐতিহ্য ও লড়াই-সংগ্রামের সারকথা। মানুষের সারস্বত জীবনের মৌল প্রসঙ্গগুলোই এখানে উপস্থাপিত হয়েছে। রাজনীতি, নারী আন্দোলন, ধর্মভাবনা, নারীনীতি, পারিবারিক আইনের মতো অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে শিরোনামে রেখে তার ভেতরেও দৃষ্টি প্রোথিত করা হয়েছে, যাতে শুধু তথ্য সন্নিবেশন নয়, গভীর পর্যবেক্ষণ, তীক্ষ বিশ্লেষণ, নিরপেক্ষ মূল্যায়নের মধ্য দিয়ে অতীতের প্রতি যেমন দৃষ্টিপাত করা হয়েছে, তেমনি ভবিষ্যৎ রূপরেখা ও প্রত্যাশার কথাও ব্যক্ত হয়েছে। ভূমিকাংশেও এমনটিই বলা হয়েছে: রোকেয়ার অবদান এবং অভিজ্ঞতার নিরিখে বর্তমানে নারীসমাজের অবস্থান বিশ্লেষণ রোকেয়া স্মারক বক্তৃতামালার পরিধির বিস্তার ঘটবে। বর্তমান সংকলনে অন্তর্ভুক্ত বক্তৃতামালা এভাবেই বাংলাদেশে নারীর সমস্যাসংকুল অবস্থানের কয়েকটি দিক তুলে ধরেছে। রোকেয়া স্মারক বক্তৃতামালা রোকেয়া স্মরণে নিবেদিত হলেও এর একটি বৃহৎ প্রায়োগিক পরিপ্রেক্ষিত রয়েছে, যা বিভাগের রোকেয়াচর্চাকে গুরুত্ববহ ও সম্ভাবনাময় করেছে। নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা ও মর্যাদা সমুন্নত করার প্রশ্নে রোকেয়া চর্চার কোনো বিকল্প নেই। যে অবস্থায়, যে পরিধিতে এ রকম কর্ম সম্পাদন হোক না কেন, তার জন্য সাধুবাদ জানানো ছাড়া গত্যন্তর নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানে যখন এ রকম কর্ম সম্পাদন হয়, তখন সেটি আমাদের সবাইকে আশান্বিত করে। নতুন সম্ভাবনায় বুক বাঁধতে শেখায়। এ রকম আয়োজন এবং শেষাবধি তার গ্রন্থভুক্তকরণ নিঃসন্দেহে প্রশংসাযোগ্য। কেননা, রোকেয়াচর্চার মধ্য দিয়েই যাওয়া যাবে আলোকপানে, যার জন্য প্রয়োজনে আলোকের এই স্রোতধারাকে বেগবান করা। লেখক-সম্পাদকের যৌথ প্রয়াসে আলোচ্য বই শত ফুল ফোটার সুযোগ করেছে। এখন মঞ্জুরিত হওয়ার পালা। যা হলে রোকেয়ার ঋণ শোধরানোর কিঞ্চিৎ সুযোগ মিলবে আর শ্রদ্ধার্ঘ্য জানানো সম্ভব হবে সম্পাদক-লেখককে। সেই প্রত্যয় ও প্রতীতিতে জয়তু জানাই রোকেয়া স্মারক বক্তৃতামালাসংশ্লিষ্ট সবাইকে।

বইপত্র- প্রামাণ্য বাংলাদেশ

Wednesday, June 8, 2011

বাংলাদেশ: সিক্স ডিকেডস—সম্পাদনা: আনিসুজ্জামান, মুহাম্মদ জমির, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম \ এপ্রিল ২০১০ নিমফিয়া পাবলিকেশন \ প্রচ্ছদচিত্র: শিশির ভট্টাচার্য্য \ দাম: ২০০০ টাকা

১৯৪৭ থেকে ২০০৭—দীর্ঘ ছয় দশকে বাংলাদেশ নামের ভূখণ্ডটির আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে বহু আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা ঘটেছে। এ সময়ে দুই বার পতাকা বদল হয়েছে। ১৯৪৭ সালে বিদেশি শাসকেরা চলে যাওয়ার সময় এ দেশের মানুষ পাকিস্তানের মধ্যে যে মুক্তি খুঁজেছিল, তা তিরোহিত হতে সময় লাগেনি। ১৯৪৮ সালের মার্চে ঢাকায় এসে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মুহম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে দেশের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাঙালির সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকার অস্বীকার করলেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, পরবর্তীকালে শিক্ষা আন্দোলন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুথানের মাধ্যমেই পাকিস্তানি শাসকদের চরম জবাব দেয় বাঙালি জনগোষ্ঠী। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাঙালি নেতৃত্ব নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে গড়িমসি করে সামরিক জান্তা। যার পরিণতি ২৫ মার্চের গণহত্যা। এরপর দীর্ঘ নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এ দেশের মানুষ স্বাধীনতা লাভ করে, যা কেবল একটি পতাকা ও ভৌগোলিক অখণ্ডতায় সীমাবদ্ধ নয়। আমাদের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ছিল সব ধরনের অন্যায়-অবিচার, শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তি। গণতন্ত্র ও সাম্যই ছিল স্বাধীনতার মূলমন্ত্র। কিন্তু আমরা কি সেই স্বাধীনতা পেয়েছি? পেলে কতটুকু পেয়েছি, না পেলে কেন পাইনি, কাদের কারণে পাইনি—সেসব আজ ইতিহাসের বিষয়।
ছয় দশকে সাতটি প্রতিপাদ্য বিষয় বাছাই করা হয়েছে এই গ্রন্থে। এর মধ্যে ‘টারবুলেন্ট ফার্স্ট ইয়ারস, ১৯৪৭-৫২’: অধ্যাপক-শিক্ষাবিদ আনিসুজ্জামান, ‘কোয়েস্ট ফর রিজিওনাল অটোনমি’: দিলারা চৌধুরী, ‘আন্ডার মিলিটারি রুল, ১৯৫৪-৭০’: আবুল মাল আবদুল মুহিত, ‘দ্য ওয়ার অব লিবারেশন ১৯৭১’: মোহাম্মদ জমির, ‘দি মুজিব এরা: ১৯৭২-৭৫’: মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন, ‘আন্ডার জিয়া অ্যান্ড এরশাদ’: মেঘনা গুহঠাকুরতা, ‘টু ওয়ার্ল্ড ডেমোক্রেটিক পলিসি: ১৯৯১-২০০৬’: আতাউস সামাদ।
একটি বইয়ের কয়েকটি অধ্যায়ে বাঙালির রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগ্রামের বিশাল ক্যানভাস ধারণা সহজ নয়। আর এ ধরনের লেখায় বিশ্লেষণের সুযোগও কম। তার পরও আনিসুজ্জামানের ভাষাভঙ্গিটি বেশ সরস, এবং ধারাবর্ণনার মধ্যেও আছে নিখুত বিশ্লেষণ। অন্যান্য লেখকও অনেক পরিশ্রম করে তথ্য-উপাত্তের সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন, যাতে পাঠক চোখ বোলালে সব ঘটনার সারাংশ জানতে পারেন।
তবে প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো আলোকচিত্র। দীর্ঘ ৬০ বছরের চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী ঘটনার সচিত্র স্মারক হয়ে উঠেছে এটি। এতে দেশ বিভাগের সময়ের সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগের ছবি যেমন আছে, তেমনি আছে দাঙ্গাকবলিত জনপদের। আছে ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক প্রামাণ্য দলিল, আছে স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন এবং ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের ছবি। আছে স্বাধীনতা-পরবর্তী সাতটি শাসনামলের দুর্লভ কিছু আলোকচিত্রও।
সেদিক দিয়ে বলা যায়, এই বই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ রকম একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ সম্পাদনের দায়ভার যাঁরা নিজেদের কাঁধে নিয়েছেন তাঁরা হলেন আনিসুজ্জামান, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ও মোহাম্মদ জমির; এঁরা সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে ঔজ্বল্যের স্বাক্ষর রেখেছেন।

সিদ্দিকবাজার থেকে নবাবপুর by মীজানুর রহমান

Saturday, February 5, 2011

ফুলবাড়িয়া স্টেশনের পোর্টিকোয় পা দিলে প্রথমেই চোখে পড়ত রাস্তার ওপারে সারিবদ্ধ বাঁশের তৈরি আসবাবের দোকান। যে কারণে এলাকাটির নাম বাঁশপট্টি। উচ্ছিষ্ট কিছু বাঁশ ও বেতের আসবাবের দোকান কিছুকাল আগেও চোখে পড়ত। ইদানীং ওপাড়ায় যাওয়া হয়ে ওঠে না, তাই বলা যাবে না ওগুলো আছে কি নেই।
অথচ একসময় এটাই ছিল কুটিরশিল্পের আস্তানা। এখন তো শহরের নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে, বিশেষ করে, গ্রিন রোড ও পান্থপথে বেতের কাজের রমরমা ব্যবসা। হূতগৌরব বাঁশপট্টির পেছনেই সিদ্দিকবাজার এলাকা। এই নামকরণের পেছনে আছে দেওয়ান পরিবারের পীর, মিঞা মহম্মদ সিদ্দিক। এখানেই তাঁর মাজার, আজও ভক্তকুলকে কম আকর্ষণ করে না। এখানেই থাকতেন ঢাকা শহরের গণ্যমান্য সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিত্ব সৈয়দ মোহাম্মদ তৈফুর। তাঁর সম্বন্ধে আগেই বলা হয়ে গেছে।
সিদ্দিকবাজারের পাশেই আলুবাজার। মোগল আমল থেকেই আছে। এটার মালিক ছিলেন আল্লাইয়ার খান। তিনি আওরঙ্গজেবের একজন কর্মকর্তা ছিলেন। বাস করতেন লালবাগ দুর্গে। সময়ের পথ বেয়ে আল্লাইয়ার বাজার নামটি জিভের ডগায় বিকৃত হতে হতে প্রথমে হয়েছে আল্লুর বাজার। তারপর আলুবাজারে গিয়ে পৌঁছেছে। অথচ এ বাজারে আলু ছাড়া অন্য সওদাপাতিও লোকে করত বা করে থাকে।
এখন এই নবাবপুর রোড ধরে যদি এগোতে থাকি, তাহলে প্রথমেই ডান দিকে চোখে পড়ত রাস্তা থেকে উঁচুতে ওষুধের বিপণি—ডন ফার্মেসি, যার কথা এর আগে বলেছি। এই দোকানের কোল ঘেঁষে কিছু পত্রপত্রিকা নিয়ে বসে থাকতে দেখতাম কুচেল এক কলকাতিয়াকে, যাদের চেহারা আমায় চট করে কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের প্রেসিডেন্সি কলেজের ফুটপাতের পুরোনো বইয়ের পসারিদের কথা মনে করিয়ে দেয়। এর সঙ্গে গল্প করতে গিয়ে জানা হয়ে গেল ওই পাড়ারই লোক সে। স্বাধীনতার একেবারে গোড়ায়, মেডিকেল কলেজের সামনে, মানসী সিনেমার অনতিদূরে, সদরঘাটের ব্যাপটিস্ট মিশনের দোরগোড়ায় আর চকবাজারের গোলচক্করে যে কটা বুকস্টল ছিল, সবটাতেই এই কলকাতিয়াদের একচেটিয়া অধিকার ছিল। তো এই স্টলের পাশ কাটিয়ে যত এগোই পাশাপাশি ঘেঁষাঘেঁষি দোকানপাট। তখনো হিন্দু দোকানিরা আছে—পাট তুলে নেয়নি। ফাঁকফোকরে ঢুকে পড়েছে কিছু অবাঙালি মুসলমান। বামাচরণ চক্রবর্তী রোডের মোড়ে এলেই চমকে উঠতাম প্রতিবার—একটা সুন্দর ইউরোপীয় ছাদে তৈরি দোতলা বাড়ি—শহরে যেন বা হঠাৎ আলোর ঝলকানি! কেমন বেমানান মনে হতো, আজও মনে হয়। এটাই কি ছিল বুদ্ধদেব বাবুর যৌবনকালের বিলিতি মদের ঝকঝকে দোকান রায় কোম্পানি, যেখান থেকে স্কুল ছুটির পর বাড়ি ফেরার পথে তিনি তাঁর সুপ্রিয় চকলেট কিনতেন মাঝেমধ্যে? না, বুদ্ধদেব বাবুর প্রসাধনহীন অ্যালবার্ট লাইব্রেরি যেমন দেখা হয়নি, ওঁর অর্ধদগ্ধ চুরুট মুখে বসে ঢাকা শ্মশ্রুমান সমর্থ বৃদ্ধকেও না। তবে ওই যে যখন তিনি বলেন, ‘রায় কোম্পানির মুখোমুখি একটি মিষ্টান্ন ভান্ডার, যা খোলা থাকে নিশুতি রাত’—সেই ‘মতিলাল সুইটমিট’—এই সেদিনও আমার চোখে পড়ত—এত কাল ভেঙেও ‘পাছে ছদ্মবেশে পরিরা খেতে এসে ফিরে যায়’—তাই খোলা থাকত নিশুতি রাত পর্যন্তই।
তখনো স্টুডিও ওরিয়েন্ট হয়নি, কিন্তু আছে তো ৮১ নম্বর সদনে ১৯৩২ সনে স্থাপিত বনেদি দাস অ্যান্ড কোম্পানি (DOSS & Co.)—ফটো তোলা এবং ফটোর যাবতীয় সরঞ্জামের দোকান। সেকালে ফটো তোলার আরেকটি যে দোকান ছিল, সে তো ভিক্টোরিয়া পার্কে: ঢাকা মিউজিক্যাল মার্ট—A Silent Music—এই রোমান্টিক আত্মপরিচয় যার মদগর্বী ভূষণ। সে কথায় পরে আসছি। তো কথা আমাদের দাস কোম্পানি নিয়ে। এর সঙ্গে বোধকরি অগ্নিদেবের একটা যোগ আছে। চৌষট্টির সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় আগুনে ঝলসে সম্পূর্ণ পুড়ে গিয়েছিল দোকানটা। তার আগে লুটপাট তো হয়েছেই। আইয়ুবি আমলের কী সুমতি হলো, ক্ষতিপূরণ দিলে, বোধকরি, আন্তর্জাতিক চাপে মান বাঁচানোর তাগিদে। কিন্তু মাথা তুলে দাঁড়াতে না-দাঁড়াতে একাত্তরে আবার লুটের কবলে! মজা কী, এত যে ঝুটঝামেলা গেল, দাস কোম্পানি কিন্তু আজও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে—মাথা নুইয়ে পালায়নি কোথাও।
আরেকটু এগোলেই একটা বইয়ের দোকান। নামহীন। হঠাৎ চোখে পড়ত না। নানা সাইনবোর্ডে আকীর্ণ সেকেলে ঝাঁজি-ধরা বাড়িটার কোথায় শুরু, কোথায় শেষ, ধরার উপায় ছিল না। দুই-আড়াই হাত চওড়া সরু এক চিলতে গোলকধাঁধা—সুড়ঙ্গের মতো কোথায় যে শেষ, ধরার উপায় ছিল না। কলকাতিয়া কাঁচি উর্দুওয়ালার দোকান। কিছু হালকা বাংলা-ইংরেজি পত্রপত্রিকা ছাড়া সিংহ ভাগ জুড়েই ছিল উর্দু পত্রপত্রিকা ও গল্প-উপন্যাসে ঠাসা। পত্রিকার ভিড়ে শামা তো অবধারিত ছিল। দিল্লি ও করাচি থেকে বেরোত। বহু বছর ভারতবর্ষে আঞ্চলিক ভাষায় মুদ্রিত পত্রিকার মধ্যে কাটতির দিক থেকে ছিল প্রথম। এখনো বোধকরি জায়গাটা বেহাত হয়নি। এরপর গল্প-উপন্যাসের রাজ্যে যিনি সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিলেন আমাদের শরৎবাবুর মতো, তিনি সাদৎ হাসান মান্টো। কৃষণ চন্দর, ইসমত চুগতাই, খাজা আহমদ আব্বাস, গোলাম আব্বাস প্রমুখও কম জনপ্রিয় ছিলেন না। তবে যে বইয়ের বেশি কাটতি ছিল, যারা লঘু লেখা পছন্দ করেন, পৃথিবীর আর সব পাঠকের মতোই, সে তো জাসুসি দুনিয়া; অর্থাৎ গোয়েন্দাদের ভুবন। জাসুসি দুনিয়া নামেই একটা পত্রিকা ছিল, যার জনপ্রিয়তা ঈর্ষা করার মতো। এসব বই, পত্রপত্রিকা লাহোর, করাচি, দিল্লি থেকে আসা মাত্র বিক্রি হয়ে যেত, আমাদের বাংলা বইয়ের মতো বছর গুনতে হতো না। সবারই তো ক্রয়ক্ষমতা থাকত না বা সংগ্রহ করার বাতিকও ছিল না। তাদের বেলায় ছিল lending library-র সুব্যবস্থা। এখনো ‘মানসী’ সিনেমা হলের কাছে একটা বইয়ের দোকান আছে, যার মালিক বাঙালি, কিন্তু ব্যবসা অধিকাংশ উর্দু বই ও পত্রিকার, জামানত ও কিছু অর্থের বিনিময়ে বই-পত্রিকা ধার নিয়ে পড়া যায়। সন্ধে হলেই এই দোকানে ঘরমুখো উর্দু-পাঠকের ভিড় দেখে মনে শ্রদ্ধা জাগে। নিজের ভাষার প্রতি এদের কী সান্দ্র মায়া! কথায় কথায় জানতে পারি, এই ব্যবসা করে কুমিল্লার ভদ্রলোক জুরাইনে জায়গা কিনেছেন, বাড়ি করেছেন, ছেলেমেয়েদের বিয়েশাদি সবকিছু সাঙ্গ করেছেন।
আর নূরু মিঞার দোকান সম্পর্কে না বললে অনেকটাই অবলা থেকে যাবে এ সম্পর্কে। গুলিস্তানের পেছনে ওই যেখানে ফুচকার দোকানগুলো ছিল, তার পাশেই ছিল নূরু মিঞার দোকান। কে বলবে এ বিহারি নয়, নোয়াখালীর লোক! যৌবনে পালিয়ে কলকাতায় গিয়েছিল ভাগ্যান্বেষণে ওই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কালে। প্রথমে সহকারী হিসেবে, পরে নিজেই ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের ফুটপাতে পত্রপত্রিকার দোকান খুলে বসে। কমিক স্ট্রিপ, হলদে ম্যাগাজিন ও প্যারিস কার্ডের রমরমা ব্যবসা গড়ে ওঠে ওর। জি আই ব্লু ও টমিদের ক্রেতা হিসেবে পেয়ে আহ্লাদ আর ধরে না! কিন্তু সুদিন ফুরিয়ে আসে যুদ্ধ শেষে, যখন একে একে সৈনিকেরা বাড়িমুখো হয়। এক জি আই যুবা বাড়ি যাওয়ার আগে ওর সঞ্চিত সব বইপত্র এবং এক ‘থলে’ টাকা দিয়ে যায় নূরু মিঞাকে। এক গাল হেসে কেলেকিষ্টি নূরু মিঞা ওর কলকাতাই বুলিতে বলে ওঠে, মেরা সর্ ঘুমা গায়া আওর সাদি কর লিয়া!
[একটি অধ্যায়]

বইয়ের পাতায় পাখি by খসরু চৌধুরী

ফটোগ্রাফিক গাইড টু বার্ডস অব বাংলাদেশ—লেখক আলোকচিত্রী: রোনাল্ড আর হালদার \ প্রকাশক: বৈকাল \ প্রচ্ছদ: রোনাল্ড আর হালদার \ ২৬০ পৃষ্ঠা \ ছবি: ৭৩৫টি \ ১৬০০ টাকা

বাংলার সাধারণ পাখির নিয়ে বই লিখেছিলেন অজয় হোম। ১৯৬৮ সালের দিকে হারুনুর রশীদ তখনার পূর্ব পাকিস্তানের পাখিদের একটি চেকলিস্ট তৈরি করেছিলেন। ওই লিস্টটি ছিল ধারণার ওপর, মাঠ পর্যায়ের গবেষণা থেকে নেওয়া। ফলে অনেক পাখির নাম ওখানে ছিল, যেটা এ দেশের পাখি নয়। অধ্যাপক কাজী জাকের হোসেন, ড. রেজা খান বাংলাদেশের পাখি নিয়ে লেখালেখি করেছেন। ঢাকার পাখির ওপর বই লিখেছিলেন ব্রিটিশ কাউন্সিলের কর্মকর্তা হার্ভে। পাখির ওপর লেখালেখি-ছবি প্রদর্শনী করে ইনাম আল হক পাখিপ্রেমীদের সজাগ করেন। তাঁরই তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশের পাখির ওপর এশিয়াটিক সোসাইটির ফ্লোরা অ্যান্ড ফনা অব বাংলাদেশ-এর একটি খণ্ডে দেশের অধিকাংশ পাখি নিয়ে একটি সচিত্র বই প্রকাশিত হয়েছে। অধ্যাপক মনিরুল এইচ খানও দেশের অধিকাংশ পাখিসহ বন্য প্রাণীর ওপর একটি বই প্রকাশ করেছেন। আগেই শরীফ খান বাংলায় পাখির ওপর একটি চমৎকার বই লেখেন।
এত দিন পাখি দেখিয়েরা সালীম আলী ও গ্রিমেটের আঁকা ছবিওয়ালা বই-ই ফিল্ড গাইড হিসেবে ব্যবহার করে আসছিলেন। তাতে বিশেষ করে ইন্সকিফ-গ্রিমেটের বইয়ের ইলাস্ট্রেসন বেশ বাস্তবানুগ হওয়ায়, পরিবর্তিত আধুনিক ইংরেজি ও বৈজ্ঞানিক নাম যুক্ত হওয়ায় সব পক্ষীবিদই বইটি সঙ্গে রাখছেন।
পক্ষীবিদ সবাইকে আশান্বিত করে এ বছর ১২ জানুয়ারি প্রকাশিত হয় ৭৩৫টি ফটোগ্রাফসহ মোট ৪৭২টি পাখির বাংলা, ইংরেজি, বৈজ্ঞানিক নামসহ রোনাল্ড হালদারের বই এ ফটোগ্রাফিক গাইড টু বার্ডস অব বাংলাদেশ। আকার-আকৃতিতে বইটি পুরোপুরি ফিল্ড গাইডের চাহিদা পূরণ করবে। বাংলাদেশ ছোট দেশ হলেও দেশের অবস্থান ইন্দো হিমালয়ান ও ইন্দো মালয়ান, দুটি উপজৈব ভৌগোলিক অঞ্চলের মধ্যে পড়ায় উভয় বিভাগেরই পাখি এখানে আসন গেড়েছে অথবা মৌসুমি বিরতি নেয়। দেশের অবস্থান কর্কট ক্রান্তিতে হওয়ায় উত্তর-দক্ষিণের অনেক পরিযায়ী পাখি ক্ষণিক আবাস গড়ে এ দেশে। দেশে তিন ধরনের বনভূমি ও গ্রামীণ জঙ্গল থাকায় এ দেশ পাখির জন্য আদর্শ আবাসস্থল। উত্তর আমেরিকা ও কানাডা মিলে লাখ লাখ বর্গমাইলব্যাপী যেখানে মাত্র সাড়ে আট শ পাখির বাস, সেখানে বাংলাদেশের ৫৫ হাজার বর্গমাইলেই সাড়ে ছয় শ পাখির স্থায়ী বাস ও আসা-যাওয়া করে। গাছবৈচিত্র্য, সহনীয় তাপমাত্রা, বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল, খাদ্যবৈচিত্র্য এত পাখি সমাহারের কারণ।
পাখির মতো ক্ষুদ্র (বড় পাখিও অবশ্য আছে) সদাচঞ্চল, ঋতু আশ্রয়ী ডানায় ভর করা প্রাণীর ছবি তোলা অত্যন্ত দুরূহ। তার ওপর বাংলাদেশে পাখি নিদারুণ নিগ্রহের শিকার। অনেকের কাছে পাখি মানেই সুখাদ্য মাংস হাড়ের স্তূপ—সেখানে পাখির বাস করতে হয় অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে। এই আতঙ্কিত পাখির মানসম্মত ও পরিষ্কারভাবে প্রজাতি, লিঙ্গ চেনা যাবে, এ রকম ছবি তোলা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং কাজ। সেটাও দু-চারটি পাখির নয়, ৪৭২ প্রজাতির। যাঁরা কাজটি করছেন অর্থাৎ পাখির ছবি তুলছেন, তাঁরা জানেন, দিনের পর দিন, জঙ্গল থেকে মাঠ-নদী-সমুদ্রের চর, পাহাড় ডিঙিয়ে, নানা ঋতুতে নানা পাখির ছবি তোলা, চেনা কী ধরনের অভিনিবেশের কাজ। পাখির ছবি তোলার লেন্স বেশ ভারী, তেমনি দামিও। নিয়মিত মাঠে যাওয়া সময় ও খরচসাপেক্ষ। অনেক ক্ষেত্রেই রাত যাপন করতে হয় নৌকায় অথবা জঙ্গলে তাঁবু খাটিয়ে। কষ্ট-ক্লেশের এই পথচলায় একটি পাখি যদি নিতান্ত সুযোগ দেয়, তবে তার কয়েকটি ছবি তুললে একটি হয়তো ব্যবহার উপযোগী হয়, কখনো হয় না—একই পাখি আবার খুঁজতে বের হতে হয়। আবার সেই পাখি পেতে বছর পার হয়ে যায়। কোনো কোনো পাখির বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অথবা মিলন ঋতুতে দেহের পালকের রঙে পরিবর্তন আসে। একই আকারের উদীয়মান যুবক পাখির সঙ্গে পরিণত বয়সী পাখির রঙের পার্থক্য দেখা যায় অনেক পাখির মধ্যে। এসব ধোঁয়াশার জাল ছিন্ন করে একটি দেশের অধিকাংশ পাখি চিহ্নিত করে সচিত্র বইয়ের পাতায় নিয়ে আসা—নিবেদিতপ্রাণ একজন সাধকই কাজটি করতে পারেন।
একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টির গুরুত্ব কিছুটা অনুধাবন করা যাবে। ভারতে পাখি আছে এক হাজার ২০০ প্রজাতির (সারা পৃথিবীতে ২৫ হাজার) মতো। বহুকাল ধরে সে দেশে পাখিচর্চা হয়। কিন্তু ভারতে প্রাপ্ত প্রায় সব পাখির সচিত্র কোনো বই সে দেশে নেই। আমরা অত্যন্ত সৌভাগ্যবান—ইনাম আল হক প্রায় সম্পূর্ণ, মনিরুল এইচ খান অনেকটা, রোনাল্ড হালদার আরও সুস্পষ্ট করে সচিত্র পাখির গাইড বই আমাদের দিয়েছেন।
বাংলাদেশের পাখিচর্চার ইতিহাসে দুজন বিদেশি—ডেভিড জনসন ও পল টমসনকে অনেক পক্ষীবিদ গুরু হিসেবে মানেন। রোনাল্ড হালদারের ২৫০ পৃষ্ঠার এ ফটোগ্রাফিক গাইড টু বার্ডস অব বাংলাদেশ বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে ডেভিড জনসনকে। বইটির চমৎকার ভূমিকা লিখেছেন পল টমসন। প্রায় সব ছবিই গ্রন্থাকারের হলেও আরও ২৫ জন পাখি আলোকচিত্রীর ছবি বইটিকে সম্পূর্ণ করতে সাহায্য করেছে।
বইটি হাতে নিলে প্রত্যেক পক্ষীপ্রেমীর মনে হবে, বইটির অপেক্ষায়ই এত দিন ছিলাম।
 
Support : Dhumketo ধূমকেতু | NewsCtg.Com | KUTUBDIA @ কুতুবদিয়া | eBlog
Copyright © 2013. Edu2News - All Rights Reserved
Template Created by Nejam Kutubi Published by Darianagar Publications
Proudly powered by Dhumketo ধূমকেতু