রাজনীতি ও অর্থনীতি- ব্যাংকঋণ পুনর্বিন্যাসের প্রণোদনা by ফারুক মঈনউদ্দীন

Tuesday, February 4, 2014

বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি এবং নীতি বিভাগ (বিআরপিডি) অতিসম্প্রতি দুটো সার্কুলারের মাধ্যমে মেয়াদোত্তীর্ণ এবং খেলাপি ঋণ পুনর্গঠন,
পুনঃ তফসিলীকরণ এবং ডাউন পেমেন্ট আদায়ের ব্যাপারে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে কিছুটা নমনীয় হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। উভয় সার্কুলারে স্বীকার করা হয়েছে দেশের অস্থিতিশীল (রাজনৈতিক) পরিস্থিতির কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি ও শিল্প খাতের উপকরণ ও পণ্যের স্বাভাবিক পরিবহন বিঘ্নিত হয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিরূপ প্রভাব পড়ছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ঋণ পরিশোধে সক্ষমতা হারাচ্ছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প।

এমন পরিস্থিতিতে অর্থনীতির সব খাতের ঋণখেলাপি হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এই বিবেচনায় ঋণগ্রহীতা এবং ঋণদানকারী ব্যাংক—উভয় পক্ষের নাজুক অবস্থার কথা বিবেচনা করে এই দুই সার্কুলারের মাধ্যমে ডাউন পেমেন্ট আদায়, সুদের হার নির্ধারণ এবং ঋণ পুনর্গঠন কিংবা পুনঃ তফসিলীকরণের বিষয়টি যৌক্তিক পর্যায়ে রাখার শর্ত সাপেক্ষে ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তবে এসএমই কিংবা কৃষিঋণ ছাড়া অন্যান্য ঋণের মেয়াদকাল পুনর্গঠন করার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদন নিতে হবে। উল্লেখ্য, এই শিথিলতার সুযোগ গ্রহণের মেয়াদ ৩০ জুন ২০১৪ সাল পর্যন্ত বলবৎ থাকবে।
স্মরণে থাকার কথা, ২০০৯ এবং ২০১০ সালে ভোগ্যপণ্য, ইস্পাত—এসব খাতে বিশ্বমন্দার কবলে পড়ে বহু আমদানিকারক ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হলেও শেয়ারবাজারের উল্লম্ফনের সময় এবং পতনের আগে পর্যন্ত ব্যাংকগুলো এই বাজার থেকে প্রচুর মুনাফা তুলে নিতে পেরেছিল। ২০১০ সালের শেষ প্রান্তে এসে শেয়ারবাজারের সেই মাতাল বুদ্বুদ বিস্ফোরিত হলে বহু অসতর্ক ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী প্রায় পথে বসে যান, তার সঙ্গে আটকা পড়ে যায় বিভিন্ন ব্যাংকের বিপুল ঋণ। বিশ্বের পণ্য বাজারের পতনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের আটকে পড়া ঋণের সঙ্গে যুক্ত হয় শেয়ারবাজারে লগ্নি করা ঘোষিত এবং অঘোষিত বিপুল ঋণ। এই ঋণের মধ্যে সাধারণ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের ভোক্তা ঋণ যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে ভিন্ন দিকে সরিয়ে নেওয়া ব্যবসায়িক ঋণ।
এমন পরিস্থিতির ধারাবাহিকতায় ব্যাংকগুলো যখন খেলাপি ঋণ ব্যবস্থাপনায় কঠিন সময় পার করছিল, তখন ২০১২ সালের শেষে খেলাপি ঋণ পুনঃ তফসিলীকরণ, মেয়াদ নির্ধারণ এবং ডাউন পেমেন্ট আদায়ের নিয়মগুলো আরও কঠোর করা হয়। সেই নতুন নীতিমালায় মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ ৯০ দিনের সীমা অতিক্রম করলেই ‘নিম্নমান’ শ্রেণীকৃত হয়ে পড়ে, যার সীমা আগে ছিল ১৮০ দিন। একইভাবে আগের ২৭০ দিনের মেয়াদোত্তীর্ণ ‘সন্দেহজনক’ ঋণের সময়সীমা কমিয়ে করা হয় ১৮০ দিন এবং ৩৬০ দিনের মেয়াদোত্তীর্ণ ‘মন্দ’ শ্রেণীর মেয়াদ কমিয়ে করা হয় ২৭০ দিন।
ঋণ শ্রেণীকরণের এই কঠোরতর নীতিমালার কারণে বহু মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ দ্রুত শ্রেণীকৃত হয়ে পড়ে এবং প্রাথমিক ধাপের শ্রেণীকৃত ঋণগুলো আচমকা পরবর্তী বিরূপ ধাপে নেমে যায়। শ্রেণীকরণের আইন পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব প্রতিফলিত হয়েছিল ব্যাংকগুলোর ২০১২ সালের হ্রাসকৃত মুনাফায়। অথচ সে সময় ব্যবসায়ী মহল এবং ব্যাংকগুলোর অধিকাংশই ২০০৮-পরবর্তী বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য হ্রাসের ধকল সামলাতে ব্যস্ত। তবু একটি আন্তর্জাতিক মানের শ্রেণীকরণ নীতিমালা প্রবর্তনের স্বার্থে স্থিতিপত্রে বিরূপ ফলাফল সত্ত্বেও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিবর্তিত নীতিমালা বাস্তবায়ন করতে তৎপর হয়েছিল। তবে তার জন্য ২০১৩ সালে নতুন মাত্রায় উন্নীত হয়েছিল ব্যাংকিং খাতের মোট শ্রেণীকৃত ঋণ।
উল্লেখ্য, ২০১২ সালের ডিসেম্বরে সমাপ্ত বছরে ব্যাংকিং খাতের নিট মুনাফা কমেছিল ১০৪ শতাংশ, যার প্রধান কারণ ছিল খেলাপি ঋণের উল্লম্ফন। মুনাফা হ্রাসের এই হার বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতে ছিল ২৮ শতাংশ, অর্থাৎ সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতেই মূলত মুনাফা হ্রাস পেয়েছিল সবচেয়ে বেশি হারে। এখানে একটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য যে ২০১১ এবং ২০১২ উভয় বছরেই ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফা ছিল ১৯,৭০০ কোটি টাকা, অথচ নিট মুনাফা ছিল যথাক্রমে ৯,১০০ এবং ৪,৪০০ কোটি টাকা। দুই বছরে একই পরিমাণ পরিচালন মুনাফা থাকা সত্ত্বেও নিট মুনাফার এই বিশাল পার্থক্য থেকে সহজেই বোঝা যায়, ২০১২ সালের পরিচালন মুনাফার একটা বিশাল অংশ চলে গিয়েছিল শ্রেণীকৃত ঋণের বিপরীতে সংস্থান বাবদ। কারণ, কেবল বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বেড়ে গিয়েছিল প্রায় ৮১ শতাংশ। (সাধারণ পাঠকদের জন্য জানানো প্রয়োজন, খেলাপি বা মন্দ ঋণের বিপরীতে পরিচালন মুনাফা থেকে নির্দিষ্ট হারে কুঋণ সংস্থান রাখতে হয়, যার ফলে কমে যায় নিট মুনাফা)।
এ ছাড়া বিরূপ বিনিয়োগ পরিবেশ, তারল্যসংকট, আমানতের উচ্চ সুদ ব্যয়, আমদানি বাণিজ্যে ভাটা—এসব কারণে ২০১২ সাল ব্যাংকগুলোর জন্য খুব সুখকর বছর ছিল না। তার সঙ্গে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো যুক্ত হয় হল-মার্ক কেলেঙ্কারি, যা ব্যাংকগুলোকে আরও নাজুক পরিস্থিতিতে ঠেলে দেয়। এ রকম বিরূপ পরিস্থিতিতেও বিভিন্ন মহলের চাপ উপেক্ষা করে ঋণ শ্রেণীকরণ এবং পুনঃ তফসিলীকরণ নীতিমালা কঠোরতর করার উদ্যোগ বাস্তবায়ন করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
২০১২ সালের ডিসেম্বরে বাড়তি শ্রেণীকরণের চাপ হজম করে ব্যাংকগুলো নতুন বছর শুরু করার পরপরই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়কে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে শুরু হয় রাজনৈতিক অস্থিরতা। এই অস্থিরতা পর্যবসিত হয় তাণ্ডবে, যার বৈশিষ্ট্য ছিল পরিকল্পিত নাশকতা। লক্ষণীয়, এই নাশকতা পরিচালিত হয়েছে অবকাঠামো—যেমন রেললাইন, সড়ক, ট্রেন ও যানবাহন, বিদ্যুৎকেন্দ্র, সরকারি দপ্তর ইত্যাদির বিরুদ্ধে। সবচেয়ে অপূরণীয় ক্ষতি করা হয়েছে দেশের বৃক্ষ সম্পদের।
নজিরবিহীন এই সহিংসতা, জাতীয় ও ব্যক্তিগত সম্পদের ধ্বংসযজ্ঞ ইত্যাকার তৎপরতায় দেশের পরিস্থিতি যেমন ছিল উত্তাল, তেমনি স্থবির ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য। ফলে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগবিমুখ হয়ে পড়েন, বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা কমে যায় উদ্বেগজনক হারে। তার বিরূপ প্রভাব পড়ে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের ওপর। আগের বছরের বাড়তি শ্রেণীকৃত ঋণের বোঝা বাড়লেও নতুন ঋণ বিতরণ প্রায় স্থবির হয়ে পড়ে। ২০১৩ সালের নভেম্বরে ব্যাংকগুলোর বাড়তি তারল্যের পরিমাণ দাঁড়ায় ৮৬ হাজার কোটি টাকা, জানুয়ারিতে যা ছিল ৬০ হাজার কোটি টাকা, এ রকম অলস তহবিল ব্যাংক বা অর্থনীতির জন্য কোনোভাবেই মঙ্গলকর নয়।
রাজনীতি কখনোই অর্থনীতিকে বাদ দিয়ে চলতে পারে না। একসময় বাণিজ্য, উৎপাদন ও বণ্টন, জাতীয় আয় ও সম্পদ ইত্যাদির সঙ্গে সরকার ও কানুনের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করার শাস্ত্রটিরই নাম ছিল রাজনৈতিক অর্থনীতি। সুতরাং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে রাষ্ট্র ও সরকার তথা রাজনীতি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। আবার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডও পরিচালিত হয় দেশ ও মানুষের কল্যাণের জন্য। কিন্তু ২০১৩ সালের প্রায় পুরোটাজুড়েই একযোগে ও বিচ্ছিন্নভাবে চলেছে বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড, যার কুফল জাতি ভোগ করবে আগামী বছরগুলোতে।
গত বছরের এই অস্থিরতা ও ধ্বংসলীলায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের উৎপাদন ও সুস্থির কর্মকাণ্ডের ধারায় ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে ঋণ পুনর্বিন্যাস ও শ্রেণীকরণের নিয়মাচারে ছাড় দেওয়ার গৃহীত উদ্যোগ থেকে সহজেই অনুমান করা যায়, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং শিল্প ও অর্থনীতির কতখানি ক্ষতি হয়েছে। পুনঃ তফসিলীকরণ, ডাউন পেমেন্ট এবং পুনর্গঠিত মেয়াদ নির্ধারণের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত শিথিল নিয়মাবলি ক্ষতিগ্রস্ত ঋণগ্রহীতাদের কিছুটা অবকাশ দিতে পারে।
এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ করা হবে, নির্যাতিত সংখ্যালঘুরাও বিভিন্নভাবে সহায়তা ও অনুদান পেতে পারেন। তবে ঋণগ্রহীতা নন, কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত বা সর্বস্বান্ত হয়েছেন দেশজুড়ে এমন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর সংখ্যা নগণ্য নয়। এঁদেরও উৎপাদন ও বাণিজ্যের ধারায় নিয়ে আসার জন্য দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। কারণ, অর্থনীতিতে এই অপ্রাতিষ্ঠানিক প্রণোদনাহীন খাতের অদৃশ্য সমধিক গুরুত্ববহ। এ ব্যাপারে এনজিও বা মাইক্রোক্রেডিট প্রতিষ্ঠানগুলো সামাজিক দায়িত্বের আওতায় স্বল্প সুদে সহায়তা প্রদান করতে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এই বিষয়ে দিতে পারে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা।
বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি বা মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ পুনঃ তফসিলীকরণ বিষয়ে যে শিথিলতার অবকাশ দিয়েছে, তার সুফল ঋণগ্রহীতাদের পাশাপাশি ব্যাংকগুলোও ভোগ করতে পারবে। কারণ, এতে শ্রেণীবিন্যাসিত ঋণের হার কমে আসার ফলে মন্দ ঋণ সংস্থানের পরিমাণও হ্রাস পাবে। তবে এই সুযোগের অপব্যবহার করে স্বেচ্ছাখেলাপি এবং ২০১৩-পূর্ব খেলাপি ঋণগুলো যাতে পুনর্গঠিত না করা হয়, সেদিকেও নজর রাখতে হবে। অনেক কিছুর বিনিময়ে আমাদের ব্যাংকিং খাতে আন্তর্জাতিক মানের ঋণ শ্রেণীকরণ এবং প্রকৃত মুনাফা প্রদর্শনের যে স্বচ্ছ নিয়ম চালু হয়েছিল, তা এই শিথিলতার সুযোগে যাতে বিনষ্ট না হয়।

ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার।
fmainuddin@hotmail.com

খাতুনগঞ্জ- ব্যবসায়িক ঐতিহ্যের সুরক্ষা জরুরি by ফারুক মঈনউদ্দীন

Thursday, December 26, 2013

চট্টগ্রামবাসীকে প্রবোধ দেওয়ার জন্য নামকাওয়াস্তে ঘোষিত ‘বাণিজ্যিক রাজধানী’ চট্টগ্রাম কি অবশেষে তার জৌলুশ এবং ব্যবসায়িক সততার মুকুটটি হারাতে বসেছে? চট্টগ্রামের কেউ কেউ একসময় আহ্লাদের আতিশয্যে যে খাতুনগঞ্জকে বাংলাদেশের
তথা চট্টগ্রামের ‘ওয়াল স্ট্রিট’ বলেও অভিহিত করতেন, যে খাতুনগঞ্জ বা চাক্তাই ছিল মৌখিক অঙ্গীকার রক্ষা এবং ব্যবসায়িক বিশ্বাসের এক উজ্জ্বল উদাহরণ—সেই খাতুনগঞ্জ থেকে হয়তো শিগগির মুখ ফিরিয়ে নেবে ব্যাংকগুলো, অবশিষ্ট থাকবে না পারস্পরিক ব্যবসায়িক বিশ্বাস। কারণ, প্রায় দেড় দশক ধরে খাতুনগঞ্জে একের পর এক ঘটতে থাকা বিভিন্ন প্রতারণামূলক ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ব্যাংকগুলো এবং ব্যবসায়ী সম্প্রদায়।

সম্প্রতি মোজাহের হোসেন নামের প্রতিষ্ঠিত ও বিশ্বস্ত ব্যবসায়ীর বিপুল অঙ্কের ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক ঋণ অপরিশোধিত রেখে গা-ঢাকা দেওয়ার পর নড়েচড়ে বসেছে ব্যাংকগুলো। জানা গেছে, দেশি-বিদেশি মিলিয়ে প্রায় পাঁচটি ব্যাংকের কাছে এই ব্যবসায়ীর প্রতিষ্ঠানের নামে ৪৫০ কোটি টাকার মতো অনাদায়ি মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ রয়ে গেছে। এ ছাড়া চট্টগ্রামের বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে নেওয়া অনাদায়ি ব্যক্তিগত ঋণের পরিমাণও ১৫০ কোটি টাকার মতো। ব্যাংকগুলোর কাছে যৎসামান্য বন্ধকি জমি জামানত হিসেবে থাকলেও অন্যান্য ব্যবসায়ীর কাছ থেকে নেওয়া ঋণের বিপরীতে চেক ছাড়া কিছুই নেই।

বলা বাহুল্য, দেশের আইন সঠিক পথে চললে এবং ঋণগ্রহীতার সততা ও নৈতিক মূল্যবোধ সমুন্নত থাকলে এই চেকই হতে পারত যথেষ্ট শক্ত জামানত। কারণ, চেকে লিখিত অঙ্কের টাকা ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে না থাকার কারণে সেই চেক প্রত্যাখ্যাত হলে দেশের প্রচলিত আইনে (নেগোশিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট অ্যাক্ট) চেকদাতার বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা করা যায়। কিন্তু আমাদের দেশে এ আইনটি বলবৎ থাকলেও এর অধীনে উল্লেখযোগ্য প্রতিবিধান বা শাস্তি হয়েছে, এমন প্রমাণ খুব বেশি নেই। অথচ একসময় খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা কোনো চেকের জামানত ছাড়াই কেবল মুখের কথার ভিত্তিতে কোটি টাকার পণ্য বাকিতে দিয়েছেন।

এখনকার জটিল এবং বিশ্বাসহীনতার যুগে নতুন প্রজন্মের কাছে এসব হয়তো অবাস্তব মনে হবে। ব্যবসায়িক বিশ্বাসের কারণে বিভিন্ন ব্যাংকের খাতুনগঞ্জকেন্দ্রিক শাখাগুলো প্রায় বিনা জামানতে সেখানকার ব্যবসায়ীদের ঋণ দিতে দ্বিধা করত না। এক দশক আগেও ঢাকার তুলনায় প্রায় সবগুলো ব্যাংকের চট্টগ্রামভিত্তিক খেলাপি ঋণ ছিল কম এবং এমনকি কোনো কোনো ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখায় খেলাপি বা শ্রেণীবিন্যাসিত ঋণের পরিমাণ থাকত শূন্য। কোনো ঋণগ্রহীতা অনিবার্য কারণে খেলাপি হয়ে পড়লেও অতি দ্রুত তার নিষ্পত্তি করে ফেলার একটা দায়বদ্ধতা ছিল।

কিন্তু খাতুনগঞ্জের সেই স্বর্ণযুগ আর অবশিষ্ট নেই। খাতুনগঞ্জের ক্ষীয়মাণ জৌলুশ, পরিকল্পনাহীন নাগরিক ও ব্যবসায়িক পরিবেশ এবং ক্রমবর্ধমান অবকাঠামোগত সমস্যার কারণে এখানকার অনেক প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী এ এলাকা ছেড়ে অন্যত্র স্থানান্তরিত হয়েছেন আধুনিক সুসজ্জিত ভবনে। এককালের সওদাগরি সংস্কৃতির পরিবর্তে গড়ে উঠেছে করপোরেট সংস্কৃতি। ঋণখেলাপি হওয়ায় অনেক ব্যবসায়ীকে একাধিক ব্যাংকের সঙ্গে  নামতে হচ্ছে আইনি লড়াইয়ে।      

প্রায় ১৩৮ বছর আগে শেখ মোহাম্মদ হামিদুল্লা খানের পত্নী খাতুন বিবির দান করা জায়গার ওপর যে খাতুনগঞ্জের গোড়াপত্তন হয়েছিল, সেই খাতুনগঞ্জ এবং তার সন্নিহিত এলাকা পরবর্তী সময়ে পরিণত হয়েছিল সমগ্র বাংলাদেশের আমদানি করা পণ্যের প্রায় ৮০ শতাংশের মূল সরবরাহের কেন্দ্র।

প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে হাজার দুয়েক দোকান, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের অফিস এবং বিভিন্ন পণ্যের আড়ত ও গুদাম নিয়ে একদা জমজমাট আমদানিনির্ভর ব্যবসায়িক কার্যক্রমের প্রাণকেন্দ্র ছিল খাতুনগঞ্জ। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কর্ণফুলী নদী হয়ে চাক্তাই খাল দিয়ে পণ্য পরিবহনের সুবিধার কারণে একচেটিয়া উৎকর্ষ লাভ করে খাতুনগঞ্জ প্রসারিত হয় কোরবানীগঞ্জ ও চাক্তাই পর্যন্ত।

প্রাচীন এ বাণিজ্যকেন্দ্রটির মূল কার্যক্রম ছিল আমদানি এবং ইনডেন্টিং (বিদেশি রপ্তানিকারকের দেশীয় প্রতিনিধিত্ব) ব্যবসানির্ভর। অথচ খাতুনগঞ্জ তথা চট্টগ্রামকেন্দ্রিক যে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালিত হতো, তার উদ্যোক্তারা যে খুব উচ্চশিক্ষিত ছিলেন তা নয়; প্রখর ব্যবসায়িক জ্ঞান ও দূরদর্শিতার পাশাপাশি মৌখিক অঙ্গীকার রক্ষা এবং ব্যবসায়িক সততার কারণে তাঁরা গড়ে তুলেছিলেন বিশ্বস্ততার একটি নিরবচ্ছিন্ন ধারা। সাদামাটা বহিরঙ্গের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের একটা অতি সাধারণ গদিঘর বা অফিস নিয়ে খুব সাদাসিধা জীবন যাপন করলেও অতীত প্রজন্মের এঁদের অনেকেই হয়তো নিয়ন্ত্রণ করতেন সারা বাংলাদেশের নির্দিষ্ট কোনো পণ্যের আমদানি, মজুত ও সরবরাহ। এঁদের প্রায় সবাই ছিলেন আর্থিকভাবে সচ্ছল এবং প্রভূত ব্যবসায়িক সুনামের অধিকারী, ফলে তাঁদের সঙ্গে ব্যবসায়িক লেনদেন ঘটত মূলত মৌখিক অঙ্গীকারের ভিত্তিতে।

খাতুনগঞ্জভিত্তিক ব্যবসায়ীরা পণ্য আমদানি করলেও তার বিপণনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। পণ্য বন্দরে পৌঁছার পর কখনো ব্রোকাররা, কখনো বা পাইকারি ব্যবসায়ীরা পণ্যের চাহিদা বুঝে আগাম দিয়ে কিংবা আংশিক বাকিতে ডেলিভারি অর্ডার (ডিও) কিনে নিতেন। যদিও সেই পণ্য হয়তো তখনো বন্দরের শেডে কিংবা অমুক মাঝির গুদামে (উল্লেখ্য, চট্টগ্রামের গুদামগুলোর পরিচিতি হয় কুলিসর্দার বা মাঝিদের নামে)। পরবর্তী সময়ে প্রকৃত পণ্যের কোনো স্থানান্তর ছাড়াই এই ডিও হাতবদলের মাধ্যমে মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীরা পণ্যবিশেষে লাখ থেকে কোটি টাকা মুনাফা অর্জন করতে পারতেন।

উল্লেখ্য, এসব কেনাবেচা কখনো কেবল মুখের কথা বা টেলিফোন কিংবা নিদেনপক্ষে একটা ছোট স্লিপের মাধ্যমে চলত। এভাবে কয়েকবার হাতবদলের কারণে পণ্যের দামও বেড়ে যেত কয়েক দফা। সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় এই ডিও ব্যবসা একসময় লাগাম ছাড়া হয়ে ওঠে, সেই সঙ্গে যুক্ত হয় ডিও জালিয়াতির মতো তৎপরতা। ভুয়া ডিও তৈরি করে অন্যায়ভাবে বিপুল অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে যেমন উধাও অনেক ব্যবসায়ী, তেমনি ক্ষতিগ্রস্তও হয়েছে অপর পক্ষ।

২০০৬ সালেও ডিও জালিয়াতি করে কিছু ব্যবসায়ী কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে গা ঢাকা দিয়েছিলেন। এ রকম ডিও জালিয়াতির বেশ বড় কিছু ঘটনার পর অবশেষে ‘কন্ট্রোল অব অ্যাসেনশিয়াল কমোডিটিজ অ্যাক্ট ১৯৫৬’-এর আওতায় চিনি ও ভোজ্যতেল ব্যবসায় ডিও প্রথা বাতিল করে জারি করা হয় ‘অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিপণন ও পরিবেশক নিয়োগ আদেশ ২০১১’। এ ব্যবস্থায় ডিওর পরিবর্তে দিতে হবে সেলস অর্ডার (এসও); যার মেয়াদ হবে ১৫ দিন। কিন্তু এ আইনটি মান্য করা হচ্ছে কি না, কিংবা বরখেলাপিদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না, তার কোনো তথ্য-প্রমাণ আমাদের হাতে নেই।

ডিও জালিয়াতির মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নেওয়া ছাড়াও মাঝেমধ্যে পাওনাদার এবং ব্যাংকের ঋণ অপরিশোধিত রেখে গা ঢাকা দেওয়ার ঘটনার পর খাতুনগঞ্জকে এখন আর নিরাপদ বলে মনে করছে না ব্যাংকগুলো, বিশেষ করে সর্বশেষ মোজাহের হোসেন আমদানিকারকের পাওনাদার এবং ব্যাংকের বিপুল দেনা ফেলে দেশান্তরি হওয়ার ঘটনা সব মহলের বিশ্বাসের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে।

এখানে প্রণিধানযোগ্য যে, জামানতবিহীন বা স্বল্প জামানতের বিপরীতে ব্যাংকের পক্ষ থেকে ঋণদান-পরবর্তী যে কঠোর তদারকি প্রয়োজন হয়, এ ক্ষেত্রে তার ব্যত্যয় ঘটেছে। কারণ, ব্যাংকগুলো দালিলিক তথ্য-উপাত্তের ওপর যতখানি ভরসা করে, বাস্তব পরিস্থিতির ওপর ততখানি করেনি। ফলে এই পলাতক আমদানিকারকের গুদামে কী পরিমাণ মজুত আছে কিংবা আদৌ আছে কি না, ব্যাংক ছাড়াও বাজারে এই ব্যক্তির বিশাল অঙ্কের হ্যান্ড লোনের কারণ, ক্রমাগত মূল্যহ্রাসের কারণে সৃষ্ট লোকসানজনিত গহ্বর কতখানি গভীর—এসব বাস্তব তথ্যানুসন্ধান করে কঠোর তদারকির মধ্যে রাখলে এই ব্যবসায়ী হয়তো এতখানি ক্ষতি করতে পারতেন না।

ব্যাংক এবং অন্যান্য পাওনাদার ব্যবসায়ীর আর্থিক ক্ষতি ছাড়াও তিনি ভূলুণ্ঠিত করেছেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের সততা ও অঙ্গীকার রক্ষার ভাবমূর্তি। ফলে ব্যাংক বা অন্য ব্যবসায়ীরা অতীতের মতো চোখ বন্ধ করে তাঁদের আর বিশ্বাস করবেন না। অথচ এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে দেশের শিল্প-বাণিজ্যে চট্টগ্রামের যে ভূমিকা ও অবদান, টোলখাওয়া ভাবমূর্তির কারণে তা ক্ষুণ্ন হলে তার বিরূপ প্রভাব পড়বে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর ।

তাই চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী নেতাদের সচেষ্ট ও সক্রিয় হতে হবে, যাতে বাণিজ্যনগরের ব্যবসায়িক বিশ্বাস ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ, জালিয়াতি, ঋণখেলাপ ইত্যাদি কারণে তাঁদের ক্ষতিগ্রস্ত ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করা যায়। চট্টগ্রাম তথা খাতুনগঞ্জ আবারও যাতে পরিণত হয় ব্যবসা-বাণিজ্যের সততা এবং অঙ্গীকার রক্ষার অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত ও কেন্দ্রবিন্দুতে। চট্টগ্রাম তথা খাতুনগঞ্জের এমনকি ঢাকার মৌলভীবাজার বা ইমামগঞ্জের ব্যবসার যা ধরন, তাতে একটি কমোডিটি এক্সচেঞ্জ স্থাপন করা যায় কি না (যদিও বিষয়টি যথেষ্ট বিতর্ক এবং যথার্থ নিরীক্ষাসাপেক্ষ) তা ভেবে দেখতে পারেন ব্যবসায়ী নেতারা। চট্টগ্রাম এ ক্ষেত্রে নিতে পারে অগ্রণী ভূমিকা।  

ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার।

fmainuddin@hotmail.com 

 
Support : Dhumketo ধূমকেতু | NewsCtg.Com | KUTUBDIA @ কুতুবদিয়া | eBlog
Copyright © 2013. Edu2News - All Rights Reserved
Template Created by Nejam Kutubi Published by Darianagar Publications
Proudly powered by Dhumketo ধূমকেতু