তাণ্ডব ও চেতনা by মাকসুদুল আলম

Saturday, February 22, 2014

কারও তাঁবেদারি না করার স্লোগানে অবিচল দৈনিক মানবজমিনের ১৭তম বর্ষে পদার্পণ উপলক্ষে দেরিতে হলেও সংশ্লিষ্ট সবাইকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা।
প্রবাসে দীর্ঘদিন পত্রিকাটির একজন নিয়মিত পাঠক। গুণগত মান, সার্বিক পরিবেশন, স্বাস্থ্য বিষয়ক ফিচার ও পত্রিকাটির গভীর অনুসন্ধানী প্রতিবেদন আমার খুবই পছন্দের। প্রধান সম্পাদক একজন অভিজ্ঞ পেশাদার সাংবাদিক। টেলিভিশনে চেনামুখ। সাহসী সৎ নীতিবান ও নির্লোভ বলেই অধিক পরিচিত। প্রধান সম্পাদকের সঠিক দিকনির্দেশনায় সব স্টাফের সাধনায় ট্যাবলয়েড দৈনিকটির জনপ্রিয়তা পাঠক মহলে দিন দিন বছর বছর বেড়েই চলেছে বলে আমার বিশ্বাস। দ্বিমত পোষণ করার সুযোগ খুব কম। হালুয়া রুটির ভাগবাটোয়ারা আর ক্ষমতার সুবিধাভোগের অপরাজনীতির প্রতি আকর্ষণ থাকলে আজ  হয়তো সম্পাদক নিজে সরকারের মন্ত্রিসভায় ঠাঁই করে নিতে পারতেন। সম্পদের পাহাড় গড়তে পারতেন। খুবই স্বাভাবিক। আর  সাংবাদিক না হয়ে প্রবাসী হলে হয়তো বিদেশের মাটিতে স্ত্রী-সন্তানাদি নিয়ে সুখে শান্তিতে বসবাস করতেন। বিলেতেও বাড়ি-গাড়ি ধন-সম্পদ অর্জন করতেন। জানের ভয় নিয়ে মাঝরাতে বাড়ি ফিরতে হতো না। তবে সমাজের অতিসাধারণ মানুষের ভালবাসায় সিক্ত হতেন কি-না জানা নেই। মধ্যরাত পর্যন্ত টিভির সামনে সচেতন দর্শক তার সংবাদপত্র বিষয়ক অনুষ্ঠান দেখার জন্য অপেক্ষা করত কিনা বলতে পারছি না। মানুষের ভালবাসা মনের অনেক বড় শান্তি। যে কেউ তা পায় না। ক্ষমতার জোরেও তা অর্জন করা যায় না। ধন-সম্পদ আর বিত্তবৈভবের পাহাড়ের বিনিময়েও এ শান্তির দেখা মেলে না। এ শান্তি উপলব্ধি করতে হয়।
ভাষা ও সংস্কৃতির মাস ফেব্রুয়ারি। এ মাসেই ঢাকার পশ্চিম রাজাবাজারে নিজেদের বেডরুমে খুন হয়েছিলেন সাংবাদিক সাগর সারওয়ার ও তার স্ত্রী মেহেরুন রুনি। দু’বছরেও শেষ হয়নি তদন্তের সেই দু’দিন। তদন্তের অগ্রগতি জানতে মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে তলব করেছে হাইকোর্ট। ন্যায় বিচার এদেশে সোনার হরিণ। আশায় আশায় দিন যাবে। আশা পূরণ হবে না। শেষ পর্যন্ত গুঁড়েবালি পড়বে তাতে। ফেব্রুয়ারি এলেই বাংলা ভাষার কদর বাড়ে। ঢাকায় বসে প্রাণের বইমেলা। প্রদান করা হয় একুশে পদক। আমার এক বন্ধু বলেছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পর এখন নাকি হাইজ্যাক হয়েছে একুশের চেতনাও। দলীয়করণ হয়েছে একুশে পদকও। বন্ধুর মতে, জন্মবার্ষিকী ও মৃত্যুবার্ষিকী নিয়ে এদেশে পত্রিকার পাতায় বাহারি বিজ্ঞাপন দেখা গেলেও তাতে স্থান পায় না মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এমএজি ওসমানীর কথা। পাঠ্যপুস্তক থেকে উধাও হওয়ার পর এখন পত্রিকার পাতা থেকেও উধাও এই মহান নেতা। অথচ এ মাসেই ছিল ওসমানীর মৃত্যুবার্ষিকী। নব্য-চেতনার আবেগের পানিতে ধুয়ে মুছে গেছে তার সব স্মৃতি। ওদিকে এক মাসের মধ্যে ইলেকট্রনিক মিডিয়া, বিজ্ঞাপন, গাড়ির নম্বরপ্লেট, সাইনবোর্ড ও ব্যক্তিগত নামফলক বাংলায় লেখার নির্দেশ দিয়েছে উচ্চ আদালত। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার যথাযথ প্রয়োগ হলে খুব ভাল কথা। আপত্তি থাকার কথা নয়। নির্দেশ প্রদানকারী উচ্চ আদালতেও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলার প্রচলন হলে আরও ভাল হয়। এটা এখন জনদাবিতে পরিণত হয়েছে।
এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গ টানছি। পরপর বিগত দু’সপ্তাহ জাপানের রাজধানী টোকিও সহ গোটা পূর্ব জাপানে তীব্র তুষারপাত হয়েছে। আবহাওয়া কর্তৃপক্ষের পূর্বাভাসের চেয়েও অনেক বেশি বরফ পড়েছে। পিচ্ছিল রাস্তায় গাড়ি চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হতে হয়েছে অনেককে। দু’দফায় প্রবল তুষার ঝড়ে একেবারেই ভেঙে পড়েছিল টোকিওর যোগাযোগ ব্যবস্থা। ব্যাহত হয়েছিল স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। স্থানে স্থানে ঘর-বাড়ি রেলস্টেশন ও স্টেডিয়ামের ছাদ ভেঙে পড়ে, রাস্তাঘাটে বড় গাছের ডালপালা ভেঙে পড়ে ইত্যাদি নানা কারণে দু’দফায় সব মিলিয়ে প্রায় ৩০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। আহত  হয়েছে কয়েক হাজার লোকজন। বিগত দেড় যুগেও টোকিওতে এমন তুষারপাত হয়নি। সর্দিজ্বর, ইনফ্লুয়েঞ্জা ছড়িয়ে পড়েছিল চারদিকে। অবস্থার এখন কিছুটা উন্নতি হয়েছে। এবার দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়া যাক বাংলাদেশের দিকে। শুরু হয়েছে স্থানীয় সরকার নির্বাচন। প্রথম পর্বে ১৯শে ফেব্রুয়ারি ৯৭টি উপজেলায় ভোটগ্রহণ শেষ হলো। নির্বাচনকে ঘিরে জেলায় জেলায় ছিল টান টান উত্তেজনা ও উৎকণ্ঠা। ছিল উৎসবমুখর পরিবেশ। এ নির্বাচনে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে মাঠে ছিল সেনাবাহিনী। তাদের সঙ্গে ছিল র‌্যাব, বিজিবি, পুলিশ ও আনসার বাহিনী। কাগজে কলমে অরাজনৈতিক স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলেও বাস্তবে জাতীয় নির্বাচনের আমেজ পরিলক্ষিত হয়েছে। জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনের পর দেশের মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পেরেছে। দুধের স্বাদ কিছুটা হলেও ঘোলে মিটিয়েছে। লড়াই হয়েছে তবে হাড্ডাহাড্ডি বলা যায় না। বিস্তারিত ফলাফল পাঠকের জানা। মান-সম্মান রক্ষার ভোটযুদ্ধে আপাতত বিএনপি-জামায়াত জোট বিজয়ী হয়েছে। সরকারি দল সমর্থিত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতিতেই ভোটকেন্দ্র দখল করে জালভোট প্রদান, ব্যালট বাক্স ছিনতাই ও ভোট কারচুপির অভিযোগ উঠেছে। সরকার সমর্থিত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে বিএনপির ভোট জালিয়াতির অভিযোগ নির্বাচন কমিশন আমলে নেয়নি। সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেছেন ‘করিম রহিমের অভিযোগ চলবে না। সেলিমের অভিযোগ আমলে নেয়া হবে। নির্বাচন কমিশনের এমন দ্বৈত ভূমিকা অগ্রহণযোগ্য।’ ব্যাপক কারচুপির পরও এই ফলাফল। একেবারে ভরাডুবি। অদ্ভুত নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের তাণ্ডবের প্রতিবাদে ৯টি উপজেলায় স্থানীয়ভাবে নিরুত্তাপ হরতাল পালিত হয়েছে। নির্বাচন অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলে জয়-পরাজয়ের ব্যবধান আরও বাড়তে পারতো। সন্দেহ নেই।
অতীত নিয়ে খুব বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করতে নেই। বেশি দূর যাচ্ছি না। বিগত দু’বছরে আমাদের দেশে সংঘটিত বিভিন্ন ঘটনাবলী মনে করলে স্পষ্ট হয়ে উঠতে পারে নানা ছলচাতুরি ও কলাকৌশল। সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যার পর থেকে ঘটেছিল নানারকম লোমহর্ষক ঘটনা। গুলশানের কূটনীতিপাড়ায় খুন হয়েছিল সৌদি কূটনীতিক খালাফ আলী। মধ্যরাতে ঘটেছিল সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ৭০ লাখ টাকার অর্থ কেলেঙ্কারির চাঞ্চল্যকর ঘটনা। এরপর ঘটে ইলিয়াস আলীর গুমের ঘটনা। আগারগাঁও এলাকায় ঘটে ব্যাপক সাংবাদিক নির্যাতন। দিনদুপুরে সিএমএম কোর্ট সংলগ্ন এলাকায় পুলিশ ক্লাবের ভেতরে ঘটে তরুণীর শ্লীলতাহানির মতো ঘটনা। এরপর জাতীয় সংসদের সাবেক বিরোধী দলের চিফ হুইপের পা ও মাথা ভেঙে দেয়া পুলিশের পদোন্নতি হয়। মাসখানেক  সভা-সমাবেশে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্পর্কে চলে সরকারের মন্ত্রীদের মুখরোচক অশ্লীল কটূক্তি। এরপর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের একটি বক্তব্যকে বিকৃত করে জাতীয় সংসদে তুচ্ছতাচ্ছিল্য ও অসম্মান করা হয়। ঘণ্টাব্যাপী তার বিরুদ্ধে চলে বিষোদগার। এরপর শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীরা ফটকাবাজ বলে বেফাঁস মন্তব্য করা হয়েছিল। একের পর এক ঘটেছিল এরকম হাজারও ঘটনা। এবারও অবস্থা অনেকটা অপরিবর্তিত। যথেষ্ট মিল রয়েছে। ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে গণতন্ত্রকে হত্যা করা। হবু বিশেষ দূতকে জোর করে হাসপাতালে বন্দি করে রাখা। সাবেক বিরোধীদলীয় প্রধানকে গৃহবন্দি করে রাখা। সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় প্রশাসন যন্ত্র ব্যবহার করে বিরোধীদলের ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচি লণ্ডভণ্ড করে দেয়া। অপহরণ-খুন, ক্রসফায়ার-এনকাউন্টার, গুম তথা বিচারবহির্ভূত রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ডকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া। আত্মরক্ষার নামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রলীগের অস্ত্রধারীরা বন্দুকযুদ্ধে লিপ্ত হওয়া। সাবেক বিরোধীদলের নেত্রীকে লেডি লাদেন বলে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করা। বিরোধীদলীয় নেত্রীর প্রবাসে অবস্থানরত ছেলেকে আল-কায়েদার বাংলাদেশী এজেন্ট বলে তাচ্ছিল্য করা। হেয় করা। প্রকাশ্য গণসংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ‘ক্যাশ চাই ক্যাশ’ বলে বেফাঁস মন্তব্য করা। সর্বশেষে আল-কায়েদা প্রধান আয়মান আল জাওয়াহিরির কথিত অডিও বার্তাটি ইন্টারনেট ব্লগে ছড়িয়ে দেয়া ও এ সংক্রান্ত ভারতীয় সাংবাদিক সুবীর ভৌমিকের কাল্পনিক গাড়িবোমা তত্ত্ব আবিষ্কার করা। সব যেন একই সূত্রে গাঁথা। সুবীর ভৌমিক হয়তো সত্যিসত্যিই দক্ষিণ এশিয়ায় আগুন লাগিয়ে দিতে চাইছেন। প্রতিবেদন লেখার নামে দক্ষিণ এশিয়ায় হয়তো রক্তাক্ত সহিংসতার বীজ বপন করতে চাইছেন। তার কল্পিত বাংলাদেশের সঙ্গে বাস্তবতার তফাৎ অনেক। আগামী দিনগুলোতেও এভাবেই হয়তো ঘটতে থাকবে একের পর এক ঘটনা। সময়ের ব্যবধানে একই ছলচাতুরি ও কলাকৌশলের ভিন্ন রূপ দেখতে পাচ্ছি চোখের সামনে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদাকে জড়িয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার ছলচাতুরি বলা যায় ভেস্তে গেছে। নতুন বোতলে পুরনো মদ পরিবেশন করায় সবাই তা টের পেয়ে গেছে। প্রত্যাশিত সুফল বয়ে আনতে ব্যর্থ হয়েছে জঙ্গিবাদ কার্ড। দাম্ভিকতাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেছে জনগণ। না বলেছে ভয়ভীতির অপসংস্কৃতিকে। অপহরণ, খুন, ক্রসফায়ার, গুম তথা বিচারবহির্ভূত রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে তারা। ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে গণতন্ত্র হত্যাকারী এক ব্যক্তির নিরঙ্কুশ তাণ্ডবের নীরব প্রতিবাদ জানিয়েছে। ব্যালটের মাধ্যমে তারা চলমান রাজনৈতিক অপসংস্কৃতিকে ধিক্কার জানিয়েছে।

২১শে ফেব্রুয়ারি ২০১৪, টোকিও

‘গণমাধ্যমে অনুরোধ এখন উপদ্রব’ by জাকারিয়া পলাশ

Saturday, February 15, 2014

দৈনিক আমাদের অর্থনীতি সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খান বলেছেন, স্বাধীন সাংবাদিকতায় বৈরিতা-হুমকির সঙ্গে ইদানীং নতুন উপদ্রব হচ্ছে ‘অনুরোধ’। এর সঙ্গে রয়েছে ভীতি ও মিত্রতাজনিত সেলফ সেন্সরশিপ।
এ নিয়েই চলছে দেশের গণমাধ্যম। মানবজমিনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সাংবাদিকতার রূপ বদলায়, ক্রমান্বয়ে বিবর্তন হয়। ক্ষেত্র বিস্তৃত হয়। এটা হলো দার্শনিক সত্য। আমরা ২০ বছর আগে সাংবাদিকতায় যে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতাম এখনকার চ্যালেঞ্জ তার চেয়ে ভিন্নতর। অনেক ক্ষেত্রে আরও কঠিন, আরও দুরূহ। একই সঙ্গে প্রযুক্তির উন্নয়নের কারণে কিছু কিছু কাজ সহজ, স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ হয়েছে। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের মতো ঘটনা আমাদের জাতীয় জীবনে আগে কখনও ঘটেনি। এমন একটা ঘটনার সঙ্গে সাংবাদিকদেরও মানিয়ে নিতে সময় লাগছে। এর আগেও নতুন অবস্থায় মানিয়ে নিতে গিয়ে এমন অবস্থা দেখা গেছে। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা কতটা স্পর্শকাতরতা মাথায় রেখে কাভার করতে হবে তা খাপ খাইয়ে নিতে একটু সময় লেগেছে। সিলেটে মাগুরছড়ায় গ্যাস ফিল্ডে আগুন লাগার পর তা নেভাতে যে যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয় তার নাম লিখতেও আমরা ভুল করেছি। আন্তর্জাতিক সাংবাদিকতাতেও এমনটা হয়ে থাকে। বাবরি মসজিদ যখন ভাঙা হলো তখন পাশ্চাত্যের অনেক নামী পত্রিকাও তার বিবরণ দিতে অক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে। একটা মসজিদের কোনটা মিনার কোনটা মিম্বর- এ পার্থক্য তাদের কাছে সহজ ব্যাপার ছিল না। সাংবাদিকতায় নতুন পরিস্থিতির চ্যালেঞ্জ, বৈরিতার চ্যালেঞ্জ, হুমকি-ধমকি সব কিছুই নতুন রকম। এ সময়েও আমাদের নতুন অভিজ্ঞতা। এখন টেলিভিশনের ব্যাপক বিস্তৃতি হয়েছে। নতুন নতুন সংবাদপত্র এসেছে। এগুলোর মালিকানার আবার স্বরূপ আছে। ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর মালিকানায় বড় প্রকাশনার পত্রিকা আসছে। পয়সাওয়ালারা পত্রিকা করবে, টিভি করবে এটা আমি খারাপ অর্থে বলি না। কিন্তু এই যে ব্যবসায়িক নিয়ন্ত্রণ এটা অসুবিধার। আর অন্যদিকে রয়েছে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ। অনেকেই গণমাধ্যম করছেন যার একটা রাজনৈতিক পরিচয় আছে বা তারা কোন দলের সদস্য। তার সঙ্গে চিরন্তন হুমকি তো কমবেশি অব্যাহত আছে ঢাকার ভেতরে ও বাইরে। সঙ্গে আবার সাম্প্রতিককালে নতুন শব্দ হলো ‘অনুরোধ’। অনুরোধের ঢেঁকি গেলা এখন নতুন উপদ্রব। অনেক ক্ষেত্রে হুমকি আসে না। অনুরোধ আসে, প্লিজ! এ কথাটা লিখবেন না। এই যে অনুরোধ এটা ব্যক্তির কাছ থেকে আসে। প্রতিষ্ঠান থেকে আসে। এটাও সাংবাদিকতার জন্য একটা চ্যালেঞ্জ। তিনি বলেন, ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের চরিত্র এবং আমাদের রাজনীতির সংঘাতময় পরিবেশের কারণে হুমকি ও অনুরোধের চ্যালেঞ্জ বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে আমরা সেলফ সেন্সরশিপেও যাচ্ছি। এটি আবার দুই প্রকার আছে। একটা হচ্ছে ভীতিজনিত সেলফ সেন্সরশিপ। আরেকটা রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা বা মিত্রতার জন্য সেলফ সেন্সরশিপ। বাংলাদেশের সাংবাদিকতা যদি আরেকটু ফেয়ার হয়, ভাল হয়- জাতিসংঘের দূত অসকার ফারনান্দেজ-তারানকোর এ বক্তব্য উল্লেখ করে নাঈমুল ইসলাম খান বলেন, তার মানে তিনি কি উপলব্ধি করেছিলেন, আমরা সম্ভবত সম্পূর্ণ ফ্রি ও ফেয়ার থাকতে পারছি না। এর সব কিছুই আমাদের সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জ। এ অবস্থায় তিনি নিজের নীতি প্রসঙ্গে বলেন, আমি সাংবাদিকতার স্বাধীনতার জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত না। আজকে আমি যেটুকু পারলাম না সেটা আগামী দিনের আমার বুদ্ধি-বিবেচনা, সাহস ও কৌশলের সমন্বয়ে আগামীতে করবো। এখন টিকে থেকে অস্তিত্ব রক্ষা করতে চাই। যদি প্রতিকূলতার জন্য আমি একটা রিপোর্ট না করতে পারি আপাতত সময়-সুযোগের জন্য আমি অপেক্ষা করবো। এতে হতাশাবোধ করলেও আমার মধ্যে কোন আত্মাহুতির প্রবণতা কাজ করে না। আমি শহীদ হয়ে যাওয়ায় বিশ্বাস করি না। চ্যালেঞ্জের মধ্যেও গণমাধ্যম কাজ করছে দাবি করে তিনি বলেন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে বহুত্ববাদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখতে হবে। নিজের স্বার্থে, মালিকের স্বার্থে, ভয়ে বা চাপে এক পত্রিকা যা করতে পারছে না অন্য পত্রিকা তা করছে। সুতরাং, সামগ্রিক অর্থে কেউ না কেউ দায়িত্ব পালন করছে। সেটা দিয়েই আমি আমাদের অর্জনগুলো হিসাব করি। প্রতিটি পত্রিকা সব বিষয়ে দায়িত্ব পালন করবে- এমনটা বাস্তবসম্মত নয়, সেটা আশা করাও অন্যায় মনে করি। বর্তমান অবস্থা দীর্ঘদিন চললে কি হবে? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, যে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকার এসেছে তাতে রাজনৈতিকভাবে প্রধান বিরোধী দল সংসদের বাইরে রয়েছে। দীর্ঘমেয়াদে এ অবস্থা বিরাজ করলে তা আমাদের গণতন্ত্র, অর্থনীতি এবং সাধারণ মানুষের স্বার্থের অনুকূল নয়। এর একটা পরিবর্তন হতে হবে। পরিবর্তন কত দ্রুত হবে তার চেয়ে জরুরি বিষয় হচ্ছে সব পক্ষ সমাধানের জন্য কতটুকু এগিয়ে আসছে। সব পক্ষ এগিয়ে এলে তাতে একটু বেশিও যদি সময় লাগে সে সময়টা তো কাটবে সমঝোতার প্রয়াসে। সে সময়টুকু তো খারাপ কাটবে না। তাতে একটা দীর্ঘস্থায়ী সমাধান হতে পারে। সব বিষয়ে সমঝোতা হতে পারে।

সাগর-রুনি হত্যার বিচার দাবিতে ৩১শে মার্চ অনশন

Wednesday, February 12, 2014

দু’বছর পার হলেও উদ্ঘাটন হয়নি সাংবাদিক সাগর সারোয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডের রহস্য। হত্যাকাণ্ডের বিচারে কোন প্রকার কিনারা না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে সাংবাদিক সমাজ। এ হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে চাওয়ার অনুরোধ করেছেন সাগর সারোয়ারের মা সালেহা মুনীর। অপরদিকে অপরাধী শনাক্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতার কারণে লজ্জা ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু।
গতকাল সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তিতে পরিবার, সাংবাদিক সমাজের পক্ষ প্রয়াত সাগর-রুনিকে স্মরণ করা হয়। প্রকৃত খুনিদের বিচারের আওতায় আনার দাবিতে ৩১শে মার্চ অনশন কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন সাংবাদিক নেতারা। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে আয়োজিত এক সমাবেশে সাংবাদিক নেতারা দাবি করেন, সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের বিচার নিয়ে একটি মহল সরকারকে বিভ্রান্ত করেছে। এ হত্যাকাণ্ডের বিচারসহ সাংবাদিকদের সকল সমস্যায় ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। সমাবেশে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের দুই অংশের নেতৃবৃন্দ ও বিভিন্ন সাংবাদিক ও সামাজিক সংগঠন যোগ দেয়।

সমাবেশের সভাপতির বক্তব্যে বিএফইউজের একাংশের সভাপতি মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল বলেন, সাগর-রুনির পরিবার অভিমান থেকে আজ বলছে আমরা তাদের ভুলে যাই। এতে সরকারের লজ্জা হওয়া উচিত। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এ হত্যাকাণ্ডের বিচার না করে সরকার তিন ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। প্রথমত, দেশের সাধারণ নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ। দ্বিতীয়ত, গণমাধ্যমকর্মীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ। তৃতীয়ত, জনগণ যাদের বেতন দেয় সে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ। তিনি সরকারের কাছে প্রশ্ন রাখেন, খুনিরা এতটাই প্রভাবশালী, এতটাই দক্ষ যে সরকার তাদের স্পর্শ করতে পারছে না। তিনি তথ্যমন্ত্রী গণমাধ্যমের ওয়েজবোর্ড নিয়ে যে অসত্য তথ্য দিয়েছেন তার কঠোর সমালোচনা করে বলেন, এ বিষয় নিয়ে তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সাংবাদিক নেতারা দেখা করবেন। বন্ধ গণমাধ্যম খুলে দেয়া, জেলে থাকা সাংবাদিকদের মুক্তি ও সাংবাদিকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ঘোষণাও দেন তিনি। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সেক্রেটারি সৈয়দ আবদাল আহমদ বলেন, সকল ভেদাভেদ ভুলে সাংবাদিকদের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন অব্যাহত রাখতে হবে। ডিইউজে এক অংশের সভাপতি আলতাফ মাহমুদ বলেন, প্রশাসন চাইলে খুনিদের সহজেই ধরতে পারে। বিভিন্ন ঘটনায় তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। প্রশাসনের ব্যর্থতা মানে সরকারের ব্যর্থতা। বিএফইউজে একাংশের মহাসচিব ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি শওকত মাহমুদ বলেন, সাগর-রুনির বিচার নিয়ে সাংবাদিকদের মাঝে একটা ভয় ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল। গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা করা হয়েছে। সাংবাদিকদের মাঝে যে ঐক্যের সৃষ্টি হয়েছে তা যেন কোন বেঈমানির বিনিময়ে বিক্রি না হয়ে যায়। কেউ যেন সরাকরের কাছ থেকে সুবিধার বিনিময়ে বিপথগামী না হয়।

বিএফইউজে একাংশের সভাপতি রুহুল আমিন গাজী বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের ক্লু উদ্ঘাটনে ব্যর্থতা স্বীকার করেছে। ফলে তারা কিভাবে চাকরিতে বহাল থাকেন? এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে নানা রকম ছলচাতুরি ও প্রতারণা চলছে। বিচারহীনতার কারণে সাগরের মা সাংবাদিকদের যে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন তা থেকে কেউ মুক্তি পাবে না বলে  মন্তব্য করেন তিনি। সমাবেশে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বিএফইউজে মহাসচিব আবদুল জলিল ভূঁইয়া, ডিইউজে মহাসচিব কুদ্দুস আফ্রাদ, জাহাঙ্গীর আলম প্রধান প্রমুখ।

এদিকে সাগর-রুনির দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক স্মরণসভায় সাগর সারোয়ারের মা সালেহা মুনীর হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান। সাংবাদিকদের উদ্দেশে তিনি বললেন, আন্দোলন থামিও না, যত সাংবাদিক মারা গেছে, সবার বিচারের দাবিতে তোমরা আন্দোলন চালিয়ে যাও। আমি বিচার চাই, আমার মেঘের জন্য আমি বিচার চাই। তিনি বলেন, সরকারের বহু আশ্বাসের পরেও এ হত্যাকাণ্ডের কোন কিনারা হয়নি। বিচার প্রক্রিয়া ধামাচাপা দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হতে পারে। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি শাহেদ চৌধুরী বলেন, সাগর-রুনির হত্যার বিচার নিয়ে ইতিপূর্বে সরকার ও স্বরাষ্টমন্ত্রী জজ মিয়া নাটক সাজিয়েছিল। এখন আমরা এটা হতে দেবো না। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, আপনি বলেছিলেন দারোয়ানকে ধরলেই হত্যাকারীদের কূল-কিনারা পাওয়া যাবে। আপনি তা করতে পারেননি। এর মানে কি এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কি তাহলে আপনিও আছেন? দুর্নীতি করার কারণে এবার মন্ত্রিসভায় আপনি ঠাঁই পাননি। স্মরণসভায় ৩১শে মার্চ ডিআরইউর সামনে দিনব্যাপী প্রতীকী অনশনের কর্মসূচি ঘোষণা করে তিনি বলেন, কেউ পাশে থাক আর না থাক, সাগর-রুনির হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে ডিআরইউ আন্দোলন চালিয়ে যাবে। ৩১শে মার্চের মধ্যে দাবি আদায় না হলে কাফনের কাপড় পরে মিছিল, আমরণ অনশন ও রাজপথ অবরোধের মতো কর্মসূচি দিতে আমরা বাধ্য হবো। এক মিনিট নীরবে দাঁড়িয়ে সাগর-রুনিকে স্মরণ করার পর শেষ হয় এ স্মরণসভা। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ)-র সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খানের সঞ্চালনায় স্মরণসভায় ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে)-র সাবেক সভাপতি ওমর ফারুক ও সাধারণ সম্পাদক শাবান মাহমুদ, ডিআরইউ সাবেক সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন বাদশা, সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম খান তপু, সাংগঠনিক সম্পাদক মুরসালিন নোমানী প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। এদিকে দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীর দিনে সাগর-রুনির কবরে ফুল দিয়ে তাদের স্মরণ করেন স্বজনরা।

সাগর-রুনি হত্যা- আমরা শপথ রাখতে পারিনি by দিপন দেওয়ান

Tuesday, February 11, 2014

কী ঘটেছিল সেদিন? যে ঘটনার পর সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছিলেন হত্যাকারীদের খুঁজে বের করার?
যে ঘটনার পর পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতির আশ্বাস দিয়েছিলেন? মামলার প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতির জন্য তদন্তের ভার গোয়েন্দা বিভাগের কাছ থেকে সরিয়ে র‌্যাবের কাছে হস্তান্তর করা হয়। র‌্যাবের দায়িত্ব গ্রহণের পর কবর থেকে ঘটা করে লাশ ওঠানো হয়, ডিএনএ সংগ্রহের নামে বয়ে গেল দুটি বছর। লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যান তদন্ত কর্মকর্তারা।
আরও একজন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর, যিনি সেই ঘটনা উদ্ঘাটন করতে না পারলেও কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করতে পিছপা হননি। সচিবালয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করেছিলেন একজন সাংবাদিক নেতা। শেষ ভরসা ছিল সরকারপ্রধানের কাছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেই সেই হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে বলেছিলেন, সবার বেডরুমে নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব নয়। তাহলে কি বিচারের বাণী নিভৃতেই কেঁদে যাবে?

যে ঘটনা নিয়ে এত নাটকীয়তা, আসলে কী ঘটেছিল সেদিন? আজও জানা হলো না। প্রতিদিন কত ঘটনাই তো ঘটে, সব খবর কি আমরা জানতে পারি? তবে সাংবাদিক হিসেবে সহকর্মীর এমন অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর অন্তরালে লুকিয়ে আছে কোন রহস্য, তা জানতে আজও উদ্গ্রীব আমরা। মনের মধ্যে একটি প্রশ্ন সব সময় ঘুরপাক খায়, সাংবাদিক ফরহাদ খাঁ দম্পতি, ফটোসাংবাদিক আফতাব হত্যা, পুলিশ কর্মকর্তা মাহফুজ দম্পতির মতো অনেক হত্যার জট খুলতে পেরেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কারণ, এসব হত্যার পেছনে কোনো রাজনৈতিক স্বার্থ জড়িত ছিল না। তাহলে কি ১১ ফেব্রুয়ারি সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার-মেহেরুন রুনি হত্যার পেছনে কোনো স্বার্থ লুকিয়ে আছে?
সাগর-রুনি হত্যার পর সাংবাদিকেরা এক হয়ে লাগাতার আন্দোলনে রাস্তায় নামেন। একের পর এক কর্মসূচি দেওয়া হয় হত্যার নেপথ্য কারণ উদ্ঘাটনে, যেসব কর্মসূচিতে নিয়মিত অংশ নিয়েছেন সাধারণ সংবাদকর্মীরা। প্রেসক্লাবের সামনে বিভিন্ন অংশের বিভিন্ন মতাদর্শের সাংবাদিকেরা বিক্ষোভ কর্মসূচিতে হাতে হাত রেখে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, সাগর-রুনি, তোমাদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছি। এই ঐক্য অটুট থাকবে। তখনকার একটি শপথের কথা খুব বেশি কানে বাজে আজও—যারা সাংবাদিকদের এই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করবে, ফাটল ধরানোর চেষ্টা করবে, তারা আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে।
কিন্তু সেই সাগর-রুনির রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে নেওয়া ঐক্যবদ্ধ থাকার শপথ ভঙ্গ করেছেন নেতৃত্বে থাকা সাংবাদিকেরা। খোলস পাল্টিয়েই ক্ষান্ত হননি, সেই সঙ্গে বোল পাল্টাতেও দেরি করেননি।
নিঃস্বার্থভাবে আমরা যারা সাগর-রুনিসহ সব সাংবাদিক হত্যার বিচার চেয়েছি, একই দাবিতে অটল রয়েছি। নিজেদের অধিকার আদায়ে আমরা এক থাকতে পারি না, নিজেদের গুণের প্রকট অভাব থাকলেও দোষের ছড়াছড়ি, তাহলে অন্যের কথা তুলে ধরব কীভাবে আমরা? সাগর-রুনির একমাত্র বংশধর ‘মেঘ’ আজ সবার মধ্যেও একা। আলোচিত এই সাংবাদিক দম্পতির হত্যার নেপথ্য নায়কদের পর্দার আড়াল থেকে বের করে আনা হবে কি না, জানি না মেঘ মা-বাবার হত্যার বিচার পাবে কি পাবে না। তাতে কারও কোনো ক্ষতি না হলেও সাংবাদিকতার জগতে যে এক বিশাল ক্ষতি হলো, তা নিশ্চিত। সাংবাদিকদের জীবনের নিরাপত্তা নেই, এটা সাধারণ মানুষের কাছে পরিষ্কার। শুধু মেঘের জন্য বলতে চাই, অনিশ্চিত এই পেশা থেকে শত মাইল দূরে থাকো। ঝড়ের আকাশে কালো মেঘ নয়, তুমি এক ফালি সাদা মেঘ হয়ে ভেসে থেকো বিশাল আকাশে।
দিপন দেওয়ান: স্টাফ রিপোর্টার, বাংলাভিশন।

যেভাবে থেমে গেল নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড by ফখরুজ্জামান চৌধুরী

Monday, January 20, 2014

যে সাম্রাজ্যের গোড়া পত্তন হয়েছিল দ্বীপ-মহাদেশ অস্ট্রেলিয়ায়, কালক্রমে তার বিস্তার ঘটে এশিয়া, ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এক জীবনে এতো অর্জন খুব কম লোকের ভাগ্যেই ঘটে থাকে।
তাকে একদা দেশছাড়া করার সংকল্পের কথা ঘোষণা করেছিলেন যে আরেক অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়া মুঘল, কিছুকাল পাদপ্রদীপের আলোয় উজ্জ্বল উপস্থিতির পর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বিস্মৃতির অন্ধকারে হারিয়ে গেলেন তিনি। স্যার কেরি ফ্রান্সিস বুলমোর প্যাকার বয়সে ছোট ছিলেন কিথ রূপার্ট মারডকের (১১ মার্চ, ১৯৩১-)। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ান প্রথম মিডিয়া মুঘল হিসেবে তার নামই উচ্চারিত হতো সর্বত্র। নানা রকম চমক সৃষ্টিতে তার জুড়ি মেলা ছিল ভার!

স্যার ফ্রাংক প্যাকার ও গ্রেটেল বুলমোর দম্পতির প্রথম সন্তান জীবনাচরণে ছিলেন বেহিসেবি। বিতর্ক জন্ম দিতেই তিনি ভালবাসতেন। অস্ট্রেলিয়ার আয়কর বিভাগের সঙ্গে প্রতিনিয়ত ঝগড়া- বিতর্কে জড়ানো ছিল যেন তার কাছে আনন্দময় খেলা! জনপ্রিয় স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল নাইন (৯)-এর জন্য ক্রিকেট খেলা প্রচারের স্বত্ব দাবি করে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট কর্তৃপক্ষের কাছে নেতিবাচক জবাব পেয়ে এতোটাই রুষ্ট হলেন যে, বিশ শতকের সত্তরের দশকে বিশ্বের নামীদামি ক্রিকেটারদেরকে নিয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করে ক্রিকেট সংস্থাসমূহের অস্তিত্ব ধরেই টান দিয়েছিলেন। ১৯৭৭ সালে তিনি চালু করলেন ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেট-যাতে অন্তর্ভুক্ত হতে পেরেছিলেন ভারত ছাড়া বিশ্বের অন্যান্য দেশের সেরা ক্রিকেটাররা। আর খেলোয়াড়দেরকে বিদ্রোহ করতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন একদা ইংল্যান্ড ক্রিকেট দলের অধিনায়ক টনি গ্রেগ।
কেরি শুধু চেয়েছিলেন তার চ্যানেল-৯ ক্রিকেট ম্যাচ প্রচার স্বত্ব লাভ করুক। ১৯৭৬ সালের চূড়ান্ত বৈঠক থেকে যখন তাকে না করেছিল অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট কর্তৃপক্ষ, ক্ষুব্ধ কেরি সভায় দাঁড়িয়ে উচ্চকণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আমাদের সবার মধ্যেই রয়েছে বারবনিতার কিঞ্চিৎ সত্তা। ভদ্র মহোদয়গণ, দয়া করে বলবেন কি, এতো দামে বিক্রি হবেন?’
পরবর্তী ঘটনা ইতিহাস, কেরি প্যাকারের ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেটের কারণে বিশ্বব্যাপী প্রাতিষ্ঠানিক ক্রিকেট মুখ থুবড়ে পড়ে। পরবর্তীকালে কেরির সঙ্গে সমঝোতা করে এবং খেলোয়াড়দের স্বার্থ রক্ষা করে চুক্তির বলে বর্তমান ক্রিকেট হাল পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিশ্বব্যাপী ক্রিকেটাররা কেরিকে স্মরণ করেন কৃতজ্ঞতার সঙ্গে।
আর দ্বিতীয় অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়া মুঘল রূপার্ট মারডকের জন্ম মেলবোর্নে। স্যার কিথ মারডক ও এলিজাবেথ জয়-এর একমাত্র সন্তান বেড়ে উঠেছেন ধনী সংবাদপত্র ব্যবসায়ী পরিবারে। সন্তানকে পারিবারিক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠিত করার আগে যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে পড়াশোনা করার জন্য ভর্তি করে দেন মারডক দম্পতি।
রূপার্টের যখন ২১ বছর, পিতা মারা গেলেন। যুক্তরাজ্য থেকে ফিরে এসে তরুণ বয়সে পারিবারিক ব্যবসার দায়িত্ব নিতে হলো তাকে। সেটা ১৯৫৩ সালের কথা। এডেলেইডের একটি সংবাদপত্র দিয়ে শুরু হলো তার মিডিয়া সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন। এরপর অস্ট্রেলিয়ার আরও দু’ একটি রুগ্‌ণ সংবাদপত্রের মালিকানা কিনে নিলো তার কোম্পানি নিউজ লিমিটেড।
১৯৭২ সালে মারডক সিডনির সকাল বেলার ট্যাবলয়েড দি ডেইলি টেলিগ্রাফ কিনে নিলেন স্যার ফ্রাংক প্যাকারের কাছ থেকে। পরবর্তীকালে স্যার ফ্রাংক এই বিক্রয় কাজের জন্য দুঃখপ্রকাশ করেছিলেন। অন্যদিকে এই বেচাকেনাকে মারডক তার প্রতিপত্তি বৃদ্ধির সূচক হিসেবে বিবেচনা করতেন। তরুণ কেরি প্যাকার এই পত্রিকার মালিকানা বদলকে খুব ভালো চোখে দেখেননি। তিনি নাকি তার অন্তরঙ্গদের এই সময়ে বলেছিলেন, মারডকের জীবনকে তিনি কষ্টকর করে তুলবেন।
১৯৫০-এর দশকে অস্ট্রেলিয়ায় টিভি নেটওয়ার্কে মারডক তার ব্যবসায়িক সংশ্লিষ্টতার সূচনা করেন। চ্যানেল-৭ নামক এই বাণিজ্যিক চ্যানেলটি কেরি প্যাকারের চ্যানেল-৯ এর সঙ্গে প্রতিনিয়ত প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে থাকে। বিভিন্ন রকম জনপ্রিয় অনুষ্ঠান, যেমন ‘সেলস অফ সেঞ্চুরি’ প্রচার করেও দর্শক ধরে রাখতে ব্যর্থ হয় তার চ্যানেলটি। পরবর্তীকালে তিনি তার টিভি চ্যানেলটি বিক্রি করে দেন। নিউজ করপ, অস্ট্রেলিয়ার ব্যবসা শুধু সীমাবদ্ধ থাকলো প্রিন্ট মাধ্যমে।
যুক্তরাষ্ট্রে মারডকের প্রথম টেলিভিশন ব্যবসায়ে বিনিয়োগ হলো ১৯৮৬ সালে যখন ফক্স ব্রডকাস্টিং কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করা হলো। ২০০০ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান লগ্নিকারক হিসেবে শেয়ার বাজারে তার নাম তালিকাভুক্ত হলো। স্যাটেলাইট টেলিভিশন, চলচ্চিত্র ও ইন্টারনেট ব্যবসায় প্রচুর মূলধন বিনিয়োগ করলেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রে রূপার্ট মারডকের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগটি ঘটে প্রভাবশালী ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে। চার্লস ডাও, এডওয়ার্ড জোনস ও চার্লস বার্গট্রেসার ১৮৭৪ সালে যে পত্রিকাটির যাত্রা শুরু করেন তৎকালীন সময়ে অত্যন্ত সাদামাটাভাবে, তা যে একদিন সময়ের বিবর্তনে এবং পরিচালনার দক্ষতার কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাধিক বিক্রীত এবং বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী পত্রিকায় পরিণত হবে, তা অনেকেই ভাবতে পারেননি।
২০০৭ সালের মে মাসে রূপার্ট মারডক ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিটি শেয়ার তার অভিহিত মূল্যের তিন গুণ বেশি দাম দিয়ে কেনার ঘোষণা দিয়ে নিউ ইয়র্কের স্টক মার্কেটে চমক সৃষ্টি করেন। পত্রিকার তৎকালীন মালিক ব্যানক্রফট পরিবার অনেক দেন-দরবারের পর ৫ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের মালিকানা রূপার্ট মারডকের নিউজ করপ-এর কাছে হস্তান্তর করলেন। বিশ্ব মিডিয়ায় খবরটি প্রচারিত হলো এই শিরোনামে: ‘মারডকের ডাও জোনস-এর মালিকানা অর্জন!’
বিশ্বব্যাপী মিডিয়া জগতে রূপার্ট মারডক তার আধিপত্য বিস্তার করে চললেন অপ্রতিরোধ্য গতিতে। একটা সময়ে তাকেই একমাত্র তার নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী বিবেচনা করতে শুরু করলেন মিডিয়া সংশ্লিষ্টরা।
বর্তমানে যে ট্যাবলয়েড নিউজ অফ দি ওয়ার্ল্ড-এর কারণে একদা নন্দিত মিডিয়া মুঘল এখন নিন্দিত এবং ব্রিটিশ পার্লামেন্টে নিজের কৃতকর্মের জবাবদিহি করতে গিয়ে সংক্ষুব্ধ এক ব্যক্তির আক্রমণের শিকার হলেন, সেই রবিবাসরীয় সাপ্তাহিকটির মালিকানা তিনি কিনেছিলেন ১৯৬৮ সালে। শোনা যায়, তার মা এই পত্রিকা কিনতে পুত্রকে বার বার নিষেধ করেন এই বলে যে, এই পত্রিকা তোমার জন্য নয়! এই সাপ্তাহিকীর মালিকানা অর্জনের পর তিনি একে একে কিনে নেন ব্রডশিট পত্রিকা দি সান, দি টাইমস, দি সানডে টাইমস।
শুধু পত্রিকার মালিকানাই অর্জন করলেন না মারডক, ব্রিটিশ রাজনীতির অন্যতম নিয়ামক হিসেবেও তার আবির্ভাব ঘটলো। ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে রূপার্ট মারডক ব্রিটিশ রাজনীতিতে রক্ষণশীল দলের প্রার্থী মার্গারেট থ্যাচারকে নির্বাচনে সমর্থন করলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি টনি ব্লেয়ারের দল লেবার পার্টিকেও সমর্থন করেন। টনি ব্লেয়ারের সঙ্গে তার নিবিড় সখ্য ব্রিটিশ রাজনীতিতে অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়।
রূপার্ট মারডক বুঝতে পারেন প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের সঙ্গে তার নিবিড় সম্পর্ক এবং মাঝে মাঝে তার সঙ্গে জাতীয় সমস্যা নিয়ে বৈঠকের খবর প্রকাশ হওয়ার ফলে তার ও তার ব্যবসা নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এই পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য তিনি তার মালিকানাধীন দি সান পত্রিকাকে নিয়োজিত করেন ডেভিড ক্যামেরনের রক্ষণশীল দলকে সমর্থন করতে!
যুক্তরাজ্যের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া এক অদভুত সম্পর্কে সম্পর্কিত। এখনো দেশটি বৃটেনের রানীর প্রতিনিধি গভর্নর জেনারেল দ্বারা শাসিত। অস্ট্রেলিয়ার রাষ্ট্রীয় পরিচয় কমনওয়েলথ অফ অস্ট্রেলিয়া এবং যুক্তরাজ্যের গর্বিত অধিবাসীদের মনে আছে, একদা তাদের দেশের দাগি অপরাধীদেরকে নির্বাসনে পাঠানো হয় দ্বীপ দেশটিতে। ক্যাপ্টেন জেমস কুক নামক একজন ইংরেজ নৌ-পরিব্রাজক এন্ডেভার নামক জাহাজে চড়ে সাগর পথে অভিযান চালিয়ে ১৭৬৯ সালে অস্ট্রেলিয়া নামক বিশাল দ্বীপ দেশটি আবিষ্কার করেন এবং ইংরেজদের কর্তৃত্বাধীনে দেশটি দীর্ঘ দুই শতাধিক বছর ধরে আছে।
গত শতকের আশির দশকে অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থানকালীন দেখেছি, একজন অস্ট্রেলিয়ান হাসতে হাসতে নিজের পরিচয় দেয়, ‘পমিজ বাস্টার্ড’ বলে। পম মানে ইংরেজ আর বাস্টার্ডের বাংলা নাই বা বলা হলো। আর সিডনির হারবার ব্রিজ অতিক্রম করার সময় টোল দিতে গিয়ে মনে মনে এবং কখনো প্রকাশ্যে ইংরেজকে কষে গাল দিতে কতো যে শুনেছি, আজ মনে হলে হাসি পায়। তবু অস্ট্রেলিয়ানরা গণভোটে বর্তমান অবস্থানের পক্ষেই ভোট দেন!
অস্ট্রেলিয়ার একজন মানুষ বৃটেনে গিয়ে মিডিয়া সাম্রাজ্যের মুঘল হবেন, ইংরেজদের পক্ষে বিষয়টি হজম করা সহজ ছিল না। সহ্য তারা করেছেন, দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে রূপার্ট মারডকের সঙ্গে ইংরেজদের ছিল এক ধরনের ভালবাসা-ঘৃণার সম্পর্ক। যার বহিঃপ্রকাশ ঘটলো এবার যখন মারডকের মালিকানাধীন নিউজ অফ দি ওয়ার্ল্ড ফোনে আড়িপাতার কেলেঙ্কারির দায় মাথায় নিয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরের নানাবিধ প্রতিক্রিয়ায়।
যুক্তরাজ্য পার্লামেন্টের সংস্কৃতি-মিডিয়া-স্পোর্টস কমিটিতে শুনানিতে উপস্থিত রূপার্ট মারডক ও তার ছেলে জেমস মারডক যখন আড়িপাতার বিষয়ে নিজেদের সংশ্লিষ্টতার কথা অস্বীকার করে বক্তব্য দিচ্ছিলেন, তখন জোনাথন মে-বওয়েনস নামক এক আত্মস্বীকৃত কৌতুকাভিনেতাকে এক প্লেট কেডিং ক্রিম ছুড়ে মারলেন তা ছিল অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়া-মুঘলের প্রতি বৃটিশ জনগণের মনোভাবেরই পরিচায়ক! রূপার্ট মারডক শুধু একটি পত্রিকাই বন্ধ করেননি। তিনি ব্রিটিশ সমাজ, রাজনীতি এক কথায় জাতীয় জীবনে বিশাল কম্পনের সৃষ্টিও করেছেন। নিউজ অফ দি ওয়ার্ল্ডের প্রাক্তন সম্পাদক এন্ডি কৌলসনকে গণসংযোগ প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়ার ফলে ব্র্র্র্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন এখন নানা প্রশ্নের মুখোমুখি। আর ফোনে আড়িপাতায় সহায়তা করার অভিযোগে অভিযুক্ত লন্ডনের পুলিশ বিভাগ, ইতিমধ্যে লন্ডনের পুলিশ কমিশনার ও উপ-পুলিশ প্রধান পদত্যাগও করেছেন। আর সাংবাদিকতার নীতি নৈতিকতাই তো আজ বিরাট সমস্যায় পড়ে গেছে।
যে নিউজ অফ দি ওয়ার্ল্ড কেলেঙ্কারির কারণে রূপার্ট মারডকের মিডিয়া সাম্রাজ্যের ভিত্তি আজ টালমাটাল, তা একদিনে অর্জিত হয়নি। অস্ট্রেলিয়ার এডেলেইডে মাত্র একটি সংবাদপত্র নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন যে রূপার্ট মারডক গত শতকের পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি, তার সব অর্জন বুঝি আজ এই পত্রিকার কারণে ম্লান হয়ে যায়। তার ব্যবসার প্রসার ঘটে আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়ায়। এবং তা ঘটে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে।
ইউরোপে তার ব্যবসার শুরু ১৯৬৮ সালে। এবং তা শুরু হয় নিউজ অফ দি ওয়ার্ল্ড-এর মালিকানা কেনার মাধ্যমে।
১৯৮৬ সালে তিনি তার সংবাদপত্র শিল্পে ইলেক্ট্রনিক পদ্ধতির ছাপা প্রক্রিয়া প্রবর্তন করেন যা তখনকার দিনে ছিলো এক বৈপ্লবিক পদক্ষেপ। এর ফলে অবশ্য তার পত্রিকায় কর্মীর সংখ্যা কমে গেলো। এর কারণে তাকে শ্রমিক-সাংবাদিকদের তুমুল প্রতিবাদের সম্মুখীন হতে হয়। মারডক লন্ডনের ডকল্যান্ড এলাকার ওয়াপিঙে আধুনিক প্রযুক্তি সমৃদ্ধ প্রেস স্থাপন করেন। সেই এলাকায় শ্রমিকরা তুমুল বিক্ষোভ করেন। তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধীরা অভিযোগ আনেন যে, সরকার রূপার্ট মারডককে সহায়তা করেছেন শ্রমিক আন্দোলন বানচাল করতে।
যুক্তরাষ্ট্রের রূপার্ট মারডকের মিডিয়া সাম্রাজ্য স্থাপনের কাজ শুরু হলো ১৯৭৩ সালে।
এশিয়ায় রূপার্ট মারডকের ব্যবসার শুরু ১৯৯৩ সালে যখন তার প্রতিষ্ঠান হংকংভিত্তিক স্টার টিভি নেটওয়ার্ক-এর স্বত্ব কিনে নেন।
সামপ্রতিককালে ফোন-হ্যাকিংয়ের কারণে ক্রীড়া জগতে হৈচৈ ফেলার মতো ঘটনাটি ঘটায় নিউজ অফ দি ওয়ার্ল্ড যখন পাকিস্তান ক্রিকেট টিম ২০১০ সালের ২৭ জুলাই থেকে ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইংল্যান্ড সফর করে।
নিউজ অফ দি ওয়ার্ল্ড-এর সাংবাদিক মাযহার মাহমুদ।
মাযহার মজিদ নামে এক আরব শেখ এবং জুয়াড়ির ছদ্মবেশে তিন পাকিস্তানি খেলোয়াড়-অধিনায়ক সালমান বাট, উদীয়মান ও প্রতিশ্রুতিবান দুই ফাস্ট বোলার মোহাম্মদ আসিফ ও মোহাম্মদ আমিরকে অর্থের প্রলোভনে আটকে ফেলেন এবং তাদের সঙ্গে তার পুরো আলাপ-আলোচনার টেপে ধারণকৃত রেকর্ড পত্রিকায় সরবরাহ করেন। নিউজ অফ দি ওয়ার্ল্ডে ওই জুয়াড়ির সঙ্গে খেলোয়াড়দের জড়িত থাকার খবর প্রচার করার ফলে তিনজন খেলোয়াড়েরই খেলোয়াড়ি জীবন আজ ধ্বংস হয়ে গেছে।
তবে অনুরূপভাবে আরেক প্রাক্তন পাকিস্তানি ক্রিকেটার ইয়াসির হামিদকে ফাঁসাতে গিয়ে ২০১০ সালের শেষ দিকে যে কাহিনী ফাঁদে নিউজ অফ দি ওয়ার্ল্ড, তাতে পত্রিকা নিজেই ফেঁসে যায়। ২০১১ সালে জুন মাসে ইউ কে প্রেস কাউন্সিলের রায়ে সংবাদটি ভুয়া প্রমাণিত হয় এবং কর্তৃপক্ষ সংবাদটির ভিডিও চিত্র তাদের ওয়েবসাইট থেকে প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন।
এই একটি ঘটনায় পত্রিকার বিশ্বাসযোগ্যতা কিছুটা হলেও তখন ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং পরবর্তী ঘটনাগুলো দ্রুত ঘটতে থাকে, যার ফলে ১৬৮ বছরের ঐতিহ্যবাহী একটি পত্রিকা বন্ধই হয়ে গেল। মানুষের বিশ্বাসে পত্রিকার ব্যাপারে আগেই চিড় ধরেছিল।
যে পত্রিকাটি ১৬৮ বছর ধরে গড়ে উঠেছিল। বন্ধ হওয়ার প্রক্রিয়া শেষ হতে তার মাস দুয়েকের বেশিও সময় লাগলো না!
ফোনে আড়িপাতার প্রথম অভিযোগটি শোনা যায় ২০০৬ সালে। ভাসা ভাসা প্রথমদিকে শোনা গেলেও যখন শোনা গেল রূপার্ট মারডক ব্রিটিশ স্কাই ব্রডকাস্টিং-এর মালিকানা নিতে চেষ্টা করছেন, অভিযোগ আরো তীব্র হলো।
অভিযোগ উঠলো ব্রিটিশ রাজ পরিবারের টেলিফোনে আড়িপাতার। সবচেয়ে বেশি হৈচৈ উঠলো যখন জানা গেল ২০০২ সালে গুম হওয়া তেরো বছরের বালিকা মিলি ডওলারের ফোনেও নিউজ অফ দি ওয়ার্ল্ড-এর সাংবাদিক আড়ি পেতেছিলেন। পরবর্তীকালে যখন গুম হওয়া মেয়েটির খুন হওয়ার খবর জানা গেল তখন পত্রিকার বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভের মাত্রা আরো বেড়ে গেল। ২০০৫ সালে লন্ডনে আত্মঘাতী বোমা হামলায় নিহত বায়ান্ন জনের অন্যতম বাইশ বছর বয়সী ডেভিডের পিতা গ্রাহাম ফোলকেজের পরিবারের সঙ্গে পত্রিকার সাংবাদিকরা যা করেছেন, তা ভুলতে তারা সহজে পারবেন না। লন্ডন পুলিশের কাছ থেকে মি. গ্রাহাম জানতে পারেন, নিউজ অফ দি ওয়ার্ল্ড গ্লেন মুঘলফেয়ার নামক একজন বেসরকারি গোয়েন্দা নিয়োগ করেছে তার ফোনে আড়িপাতার জন্য।
এতসব অভিযোগ মাথায় নিয়ে পত্রিকা চালানো যে সম্ভব হবে না তা বুঝতে দেরি হয়নি রূপার্ট মারডকের। ১০ জুলাই (২০১১) পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠা জুড়ে ‘থ্যাক ইউ এ্যান্ড’, ‘গুডবাই’-ধন্যবাদ এবং বিদায় লিখে বের হলো দেড় শতাধিক বছরের পুরানো একটি পত্রিকা।
প্রতিপক্ষ ব্যঙ্গ করে লিখলো: নিউজ অফ দি ওয়ার্ল্ড তো নয়, এ যেন ‘এন্ড অফ দি ওয়ার্ল্ড’। পৃথিবীরই শেষ!
আরও রসিকতা করে ছবি ছাপলো দু’টি- একটি মারডকের ছেলেদের (উত্তরাধিকারী: এয়ারস) অন্যটি কন্যার স্নেহে বেড়ে ওঠা পত্রিকার শেষ সম্পাদক রেবেকা ব্রুক্‌স্‌-এর মাথাভর্তি তার ঝাঁকড়া চুল। ছবির নিচে লেখা হলো: চুল (হেয়ারস)! ঐবরৎং ও ঐধরৎং-এর উচ্চারণের সমিলতা রসিকতার জন্ম দেয়।
পত্রিকা তো বন্ধ হলো। কিন্তু প্রশ্ন হলো: নিকট ভবিষ্যতে রূপার্ট মারডকের বিশাল অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য অক্ষত থাকবে তো? মারডকের নিউজ করপ-এর সম্পদের তালিকায় রয়েছে:
৭.৬ বিলিয়ন ডলার- চলচ্চিত্রে
৭.০ বিলিয়ন ডলার- কেবল টিভিতে
৬.১ বিলিয়ন ডলার- সংবাদপত্রে
৪.২ বিলিয়ন ডলার- ফক্সটিভি নেটওয়ার্কে
১.৩ বিলিয়ন ডলার- পুস্তক প্রকাশনায়
১.২ বিলিয়ন ডলার- মার্কেটিং-এ
১.৫ বিলিয়ন ডলার- অন্যান্য খাতে।
অশীতিপর রূপার্ট মারডক, তার পুত্র জেমস এবং চীনা বংশোদভূত স্ত্রী ওয়েনডি ডেং সম্মিলিত মেধা ও বুদ্ধি দিয়ে কি করে এই সঙ্কট মোকাবিলা করেন তা-ই এখন দেখার বিষয়।

প্রতিক্রিয়া- টিভি টক শো নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা হচ্ছে? by মনজুরুল আহসান বুলবুল

Tuesday, December 24, 2013

মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর বিস্মিত, সে জন্যই আশ্চর্যবোধক চিহ্ন দিয়েছেন শিরোনামে: টিভি টক শো নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা! কিন্তু বিস্ময়ের কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত নন, সে কারণেই বলছেন: ...
বহুদলীয় সরকার নির্বাচনের প্রাক্কালে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করার পাঁয়তারা করছে বলে জানা গেছে [প্রথম আলো, ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৩, পৃষ্ঠা: ১০]। এই ‘জানা গেছে’র সূত্র ধরেই তাঁর রচনা।

উদ্বিগ্ন হয়েই খোঁজ নিয়েছি, সরকারের কোনো নির্দেশনার হদিস যেমন পাইনি, তেমনি টেলিভিশন চ্যানেলের মালিকদেরও মন্তব্য পাইনি। মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর একটি টেলিভিশনে টক শোর একজন উপস্থাপক বদল থেকেই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। সে কারণে খোঁজ নিয়ে জানলাম: ওই উপস্থাপক সেই চ্যানেলটির মালিকের উপদেষ্টাও বটে। অর্থাৎ চ্যানেলটির ব্যবস্থাপনার সঙ্গেও তিনি জড়িত। চ্যানেলটির অভ্যন্তরীণ সূত্র জানিয়েছে: উপদেষ্টা ও মালিকের সম্মতিতেই টক শোর উপস্থাপক বদলের সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবু মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলছেন, এটা বুঝতে কারও অসুবিধা হবে না যে মালিকপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টি করায় এই ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু না মালিক, না উপদেষ্টা, না চ্যানেলটির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ এই ‘সরকারি চাপের’ প্রতিবাদ করেছেন। তাঁরা সুনির্দিষ্টভাবে প্রতিবাদটি করলে পেশাদার সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের কর্মীরা নিশ্চয়ই পাশে দাঁড়াবেন।
এই প্রেক্ষাপটেই পরের দুটি প্রশ্নের জবাব খুঁজতে চেষ্টা করি। প্রথম প্রশ্ন, সরকার কেন টক শো নিয়ন্ত্রণ করবে? টিভি টক শোতে সরকারের বিরুদ্ধে আর কি কথা বলার বাকি আছে? ‘শেখ হাসিনার পরিণতি তাঁর বাবার মতো হবে’, ‘এই ফ্যাসিস্ট সরকার পালাবার পথ খুঁজে পাবে না’, ‘আওয়ামী লীগকে দেখলে সবাই বলবে চোর’, ‘শেখ হাসিনা এখন গণপ্রজাতন্ত্রী ঢাকার প্রধানমন্ত্রী’, ‘এই সরকারের আমলেই সাতক্ষীরা স্বাধীন হয়ে গেছে,’ ‘শেখ হাসিনার তো কিছু হবে না, কিন্তু তাঁর দলের লোকজনের পিঠের চামড়া থাকবে না, ছাত্রলীগ-যুবলীগের খুনিরা সব অপকর্ম করছে’, ‘বিরোধী দলের কর্মসূচিতে সরকারি দলের গুন্ডারা বাসে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মানুষ মারছে, এই জালিম সরকারের পতন আসন্ন...’ এসবই হালফিল টক শোর ভাষা। এসব যদি সরকার সহ্যই করে থাকে, তাহলে আর টক শো নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়োজন কী? দ্বিতীয় প্রশ্ন: টক শোগুলোতে আর কী বলার স্বাধীনতা প্রয়োজন? এই প্রতিক্রিয়া যখন লিখছি, তখন বিশ্বজিৎ হত্যা মামলার রায় হলো: আটজনের মৃত্যুদণ্ড আর ১৩ জনের যাবজ্জীবন। কিছুকাল আগে এক টেলিভিশন চ্যানেলের টক শোতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক আলোচক বললেন: ‘লিখে রাখতে পারেন, এই সরকারের আমলে বিশ্বজিৎ হত্যার বিচার হবে না।’ লিখে রেখেছিলাম। সেই আলোচক আর সেই টেলিভিশন চ্যানেল এখন কী বলে, তা পর্যবেক্ষণ করে পরবর্তী মন্তব্য করব।
নিবন্ধে মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর সুনির্দিষ্ট মন্তব্য করেছেন: ‘কোনো কোনো টিভি চ্যানেলে বিশেষ বিশেষ আলোচককে আমন্ত্রণ না করার জন্য চাপ আছে। এই চাপ প্রয়োগের কারণ বেশির ভাগ টিভি চ্যানেল বর্তমান সরকারের অনুগ্রহে লাইসেন্স পেয়েছে।’
এ বিষয়ে বিতর্কে না গিয়ে একটি আদর্শ পরিবেশের কথা যদি চিন্তা করি, তাহলে প্রশ্ন করা যায়, কোন টেলিভিশন কাকে কখন টক শোতে ডাকবে বা ডাকবে না, সেটি কে ঠিক করে দেবে? কোন পত্রিকা কার লেখা ছাপাবে অথবা ছাপাবে না, তা নিয়ে কি প্রশ্ন তোলা যায়? এই প্রশ্ন ওঠে না এই কারণে যে প্রতিটি সংবাদপত্র পরিচালিত হয় তার নির্ধারিত সম্পাদকীয় নীতিমালার অধীনে। যদি সংবাদপত্রের বেলায় প্রশ্ন না তোলা যায়, তাহলে টেলিভিশনের বেলায় কেন যাবে? টক শোতে কবে, কাকে অতিথি করা হবে, তা একান্তই টেলিভিশনের নিজস্ব সম্পাদকীয় নীতির বিষয়। যদি টক শোর অতিথি নির্বাচনে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়, তাহলে তো নাটক, নৃত্য বা গানের অনুষ্ঠান নির্মাণে শিল্পী নির্বাচনের বেলায়ও একই প্রশ্ন তোলা যাবে। চাপ, অনুরোধ, আগ্রহ বা পরামর্শ হয়তো থাকবে কিন্তু অতিথি নির্বাচনের চূড়ান্ত ক্ষমতা শুধু টেলিভিশন কর্তৃপক্ষের।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেছেন, আওয়ামী লীগের আমলে লাইসেন্স পাওয়াদের ওপর সরকারের চাপ বেশি। কিন্তু অ-আওয়ামী আমলে লাইসেন্স পাওয়া টেলিভিশনগুলোও তো তাদের টক শোতে তাদের পছন্দসই তালিকার বাইরে কাউকে ডাকে না! সেখানে কারা চাপ দেয়—এ প্রশ্ন কি করা যায়? না, করা যায় না। কারণ, সেটিও তাদের স্বাধীন সম্পাদকীয় সিদ্ধান্ত। তবে চাপ সম্পর্কে একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি। এক-এগারোর আগে বিএনপির তখনকার মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া দলের প্রতিনিধিদলসহ বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে যান একটি তালিকা নিয়ে। বলেন, এই তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের টক শোতে নিলে তাঁর দলের স্বার্থ রক্ষা হয়। এর কিছুদিন পর এক-এগারো ঘটে যায়। নতুন পরিস্থিতিতে মহাপরাক্রমশালী সেনা গোয়েন্দা সংস্থা। এ পর্যায়ে তাঁরা এলেন আরেক তালিকা নিয়ে। নির্দেশ: টেলিভিশন টক শোতে যাতে তাঁদের তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের সুযোগ দেওয়া হয়। মজার ব্যাপার হলো, মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে বিএনপির পক্ষ থেকে দেওয়া তালিকায় যাঁদের নাম ছিল, তার সঙ্গে সেনা গোয়েন্দা সংস্থার তালিকার ভিন্নতা খুব বেশি ছিল না।
এ বিষয়টি সবাইকে বুঝতে বলি: টক শোতে আমন্ত্রণ পাওয়া কিন্তু কোনো অতিথির সরাসরি ‘অধিকার (রাইট)’ নয়, এটি হচ্ছে তাঁদের ‘বিশেষ সম্মান (প্রিভিলেজ)’। টেলিভিশনের অনুষ্ঠান পরিকল্পনাকারীরাই সিদ্ধান্ত নেবেন কাকে কখন সেই বিশেষ সম্মান জানাবেন। কয়েকটি টক শোতে কথা বললেই কারও ইচ্ছামাফিক যেমন আমন্ত্রিত হওয়ার অধিকার জন্মায় না, তেমনি কোনো চ্যানেল ডাকলেই সেখানে যেতে তাঁরা বাধ্য নন।
এ তো গেল অতিথি প্রসঙ্গ; এবার উপস্থাপক নির্বাচন। টেলিভিশনের অনুষ্ঠান পরিকল্পনায় কিছু প্রচলিত ও স্বীকৃত বিধান আছে। এই রীতি অনুযায়ী টেলিভিশনে বিশেষ কোনো অনুষ্ঠানের জন্য বিশেষ বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদেরই উপস্থাপক নির্বাচন করা হয়। তবে সম্পাদকীয় নীতি সরাসরি দৃশ্যমান হয় সে ধরনের স্পর্শকাতর অনুষ্ঠান উপস্থাপনা বা পরিচালনার জন্য সাধারণভাবে সেই টেলিভিশনের পূর্ণকালীন কর্মীকে দায়িত্ব দেওয়াটাই রীতি। কারণ, নিজের প্রতিষ্ঠানের সম্পাদকীয় নীতিটি সেই কর্মীর মাথায় থাকবে, এই নীতির লঙ্ঘন করলে তাঁর বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাও নেওয়া যাবে। উপমহাদেশের স্বনামখ্যাত চ্যানেলগুলোর সম্পাদকীয় নীতিসংশ্লিষ্ট স্পর্শকাতর অনুষ্ঠানগুলোর উপস্থাপকদের দেখুন, তাঁরা কারা। তবে যোগ্য নিজস্ব কর্মী পাওয়া না গেলে অতিথি উপস্থাপক নেওয়া যেতে পারে। নির্বাচিত উপস্থাপককে এ শর্ত মেনে নিজস্ব মত ও পথ সম্পর্কে নৈর্ব্যক্তিক থেকেই তাঁকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। কাজটি কঠিন বটে। একটি চ্যানেল কর্তৃপক্ষ এ ধরনের উপস্থাপক দিয়ে অনুষ্ঠান উপস্থাপনার সিদ্ধান্ত যেমন নিতে পারে, তেমনি যেকোনো সময় তাঁকে বদলও করতে পারে। এতে কেউ অসম্মানিত হলেন এমনটি মনে করার কারণ নেই। একজন উপস্থাপক বদল করার সঙ্গে সব সময়ই গণমাধ্যমে চাপ বা স্বাধীনতা হরণের প্রসঙ্গটি যুক্ত না-ও থাকতে পারে।
অনেক টেলিভিশনের সিনিয়র সাংবাদিকেরা প্রায়ই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, তাঁদের নিউজ পলিসির সঙ্গে টক শোর পলিসি মেলে না। কারণ, নিউজ তো চালান টেলিভিশনের পূর্ণকালীন কর্মীরা এবং তাঁরা জানেন তাঁদের স্টেশনের বা চ্যানেলের সম্পাদকীয় নীতি কী? কিন্তু টক শো চালান আমন্ত্রিত বিশেষজনেরা, চ্যানেলের সম্পাদকীয় নীতির প্রতি তাঁদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। সরাসরি রাজনীতি করেন এমন বাগ্মী ও মেধাবী ব্যক্তিরাও টক শোর উপস্থাপক হয়ে আসেন, কিন্তু উপস্থাপকের নৈর্ব্যক্তিকতা বজায় রাখা তাঁদের জন্য খুবই মুশকিল হয়ে পড়ে। নিজস্ব রাজনৈতিক মতাদর্শভিত্তিক বিরাগ বা অনুরাগধর্মী মন্তব্য থেকে অনেক সময়ই নিজেকে বিযুক্ত রাখতে পারেন না অনেকেই। ফলে তিনি নিজে হয়তো লাভবান হন কিন্তু প্রশ্নবিদ্ধ হয় চ্যানেলের নিরপেক্ষতা; বিভ্রান্ত হন দর্শক-শ্রোতারা।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরের সঙ্গে সহমত পোষণ করে বলি, শুধু টক শো বা টিভি অনুষ্ঠান নয়; কোনো গণমাধ্যমের উপস্থাপনায় কেউ ক্ষুব্ধ হলে পর্যাপ্ত তথ্য দিয়েই তার মোকাবিলা করতে হবে। তথ্যের লড়াই তথ্য দিয়েই করতে হবে, অন্য কোনো পন্থায় তথ্যের প্রবাহ বন্ধ করতে চাইলে তা হবে আত্মঘাতী। অন্যদিকে চ্যানেলগুলোকেও স্পষ্ট করতে হবে তাদের সম্পাদকীয় নীতি; এই নীতির আলোকে অনুষ্ঠান পরিকল্পনা, উপস্থাপনা আর সম্প্রচারে হতে হবে আরও সতর্ক, দায়িত্বশীল, পেশাদারি। মনে রাখতে বলি, শুধু বহিরঙ্গের চাপ বা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা নয়, অভ্যন্তরীণ পরিকল্পনাহীনতা এবং সংকীর্ণ স্বার্থে বা উদ্দেশ্যমূলকভাবে গণমাধ্যমের যথেচ্ছ ব্যবহারই গণমাধ্যমের বড় শত্রু।
মনজুরুল আহসান বুলবুল: সাংবাদিক।

দেশ ও সময়ের দাবি উন্মুক্ত গণতন্ত্র by মিলন মিয়াজী

Friday, December 20, 2013

এ দেশে নেতা-নেত্রীরা বহু বিশেষণে বিশিষ্টতা পান, পরে কালের পরিক্রমায় তারাই প্রমাণ করেন সবই ভুল। শ্রদ্ধেয় জনৈক নেতাও বলেই ফেললেন, আমার চারদিকে চাটুকার দল, তিনি অবশ্য চাটুকার হতে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেছেন বলে মনে হয় না।
করলে উত্তরোত্তর এ ধরনের চরিত্রের লোক বৃদ্ধি পেতো না। চাটুকারা যতই বলুক অমুক আদর্শের সৈনিক, তমুক আদর্শের সৈনিক যতই বলুক না কিন্তু আদর্শের ধরন কি? তা কিভাবে বাস্তবায়ন করবেন দেশ ও জনগণের কল্যাণে তার রূপরেখা সম্পর্কে তারা কিছু জানেন বলে আমার মনে হয় না। এগুলো নিতান্তই চটুল কথা ছাড়া আর কিছুই নয়। আমরা জানি, কোন আদর্শ বাস্তবায়ন করতে সমমনা লক্ষ লোকের দরকার জনগণের কাছে সে আদর্শের বাণী পৌঁছাতে। আদর্শগত দ্বন্দ্ব নয়, শুধুমাত্র ক্ষমতা দখলের রাজনীতিতে, অত্যাধুনিক মিডিয়ার যুগে এত লোকের দরকার কি? এ অবস্থায় সুন্দর সমাধান দিতে পারে উন্মুক্ত গণতন্ত্র। কারণ, এখানে সরকার পরিচালনায় এবং সমগ্র দেশ উপস্থাপনায় সর্বমোট ৩৬১ জনবল প্রয়োজন। এই তো গেল মহান বিজয় দিবস। কেউ কেউ তার প্রতিষ্ঠান কাগজের জাতীয় পতাকা দ্বারা সাজালো ভাল দেশপ্রেমিক। কিন্তু আজ ওই সব কাগজের পতাকা ধুলায় গড়াগড়ি খায়। দেশপ্রেমিক বোঝানোর এ ধরনের চেষ্টার সঙ্গে জড়িত অনেকেই সরাসরি রাজনৈতিক দলের সদস্য। এদের অজ্ঞতা এত বেশি জাতীয় পতাকার মর্যাদা সম্পর্কে তারা ওয়াকিবহাল নয় কিন্তু উন্মুক্ত গণতন্ত্রে এ ধরনের লোকের অস্তিত্ব নেই। কারণ, এ ক্ষেত্রে প্যানেলগুলো সাজবে বিবেকবান জাতির কাছে গ্রহণযোগ্য করে। এরা জানে কাকে কতটুকু মর্যাদা দেয়া উচিত। এই জাতি বিবেকবান, একটি বাস্তবতা থেকে তা সহজেই বোঝা যায়, মরহুম জিয়াউর রহমানের শাসনামলে পরিবেশ পরিস্থিতি কিছুটা বুঝি। তার ক্ষমতা আহরণে খুব স্বচ্ছতা না থাকলেও তিনি নিজেকে ভাল শাসক ও সাধু হিসেবে পরিচয় দিতে পেরেছিলেন। এ জাতি এর প্রতিদান দিয়েছিলেন ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে তার ছাত্রদল-নির্ভর দলকে জয়ী করে। বর্তমানে জনগণ ভাল ব্যক্তি এবং দল খুঁজে পাচ্ছেন না, তাই তারা অসহায়, বরং তারা বিরক্তি অনুভব করছেন তাদের জড়িয়ে নেতাদের মিথ্যা কথা বলার জন্য। কিন্তু উন্মুক্ত গণতন্ত্রে এ অবস্থা হবে না, এখানে দেশবরেণ্য সন্তানরা দেশ পরিচালনায় আসতে চাইবেন শুধুমাত্র সম্মানের জন্য। এ দেশে বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলোর রীতিনীতি অনুসারে সৃষ্টি হয়েছে রাজনৈতিক পরিবার। তাদের নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা কতটা আছে আমি জানি না, তবে বছরের পর বছর আছেন তা দেখি। কিন্তু উন্মুক্ত গণতন্ত্রে সে সুযোগ নেই। ১০টি প্যানেলে ১০ক্ম৫০=৫০০ জন প্রার্থী হচ্ছেন যে ৩টি প্যানেল সবচেয়ে কম ভোট পাবে ওই প্যানেল তিনটি পরবর্তী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না, এতে কমপক্ষে ১৫০ জন নতুন প্রতিযোগী আসবেন পরবর্তী নির্বাচনে। এ ছাড়াও দেশের সম্মানিত সন্তান তিনবারের বেশি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না এবং দু’বারের বেশি দেশ পরিচালনায় থাকতে পারবেন না। ফলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নেতা সৃষ্টি হবে। এবার দুর্নীতিতে আমরা ১৬তম অর্থাৎ দুর্নীতির রিকটার স্কেলে আমরা বিশ্বের বুকে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবেই রয়ে গেলাম। এ দেশের প্রায় ৮০ ভাগ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট না। এরা নিজের দোষ, ভুল অকপটে স্বীকার করার সাহস রাখে এবং নিজের অন্যায়কারী সন্তানের বিচার করার ক্ষমতা রাখে। সুতরাং ২০ ভাগ লোকের যাদের বেশির ভাগই শিক্ষিত, তাদের দুর্নীতির দায়ভার তারা নেবে কেন?

এ দেশে মোটামুটিভাবে তিন ধরনের লোক দুর্নীতিগ্রস্ত
(১) চাকরিজীবী দুর্নীতিবাজ- এরা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়ে কৃতকার্য হয়ে চাকরি নিচ্ছে। সুতরাং তাদের মেধা আছে, মূলধন নেই। একই ভাবে বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধিই মূলধন।
(২) ব্যবসায়ী দুর্নীতিবাজ- এরা কিছুটা মেধা ও মূলধন খাটান। অনেক সময় ব্যবসায়ী রাজনীতিবিদ আছেন, তাদের বেলায় দেখতে হবে তারা রাজনীতি হতে কোন ফায়দা নেন কিনা।
(৩) রাজনৈতিক দুর্নীতিবাজ (বেশির ভাগ)। এরা রাজনীতির প্রমোশন পেতে কোন মেধা পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন এমন কোন প্রমাণ নেই এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মূলধন খাটিয়েছে প্রমাণ মিলে না। উপরের দু’টি এককভাবে দুর্নীতি করেন, নিচেরটি দল বেঁধে দুর্নীতি করেন। এটা আমার কথা নয়, তাদেরই কথা।
রাজনৈতিক দুর্নীতি যতটা কমবে দেশের মোট দুর্নীতি ততটাই কমবে। সুতরাং দেশ ও সময়ের দাবি উন্মুক্ত গণতন্ত্র।

মিডিয়া ভাবনা- টিভি টক শো নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা! by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর

Wednesday, December 18, 2013

মহাজোট সরকারের নানা সমালোচনা ও ব্যর্থতা রয়েছে, তা সত্য। কিন্তু একটা ব্যাপারে সরকারের প্রশংসা করতে হবে। তাহলো, তাদের সরকারের আমলে গণমাধ্যম সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করেছে।
দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া বিগত পাঁচ বছরে গণমাধ্যমের ওপর তেমন নিয়ন্ত্রণ আসেনি। সংবাদপত্রে কলামিস্টরা স্বাধীনভাবে সরকারের সমালোচনা লিখেছেন। টিভির টক শোতে আলোচকেরাও স্বাধীনভাবে সরকারের দোষত্রুটি দেখিয়ে দিয়েছেন। বিভিন্ন সংবাদপত্রে সরকারের নানা দুর্নীতি, ভুলনীতি, দলীয়করণ, অপরাজনীতি, ছাত্রলীগের টেন্ডার-বাণিজ্য নিয়ে অসংখ্য অনুসন্ধানী ও সরেজমিন প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এ ব্যাপারে কয়েকটি দৈনিক পত্রিকা অত্যন্ত সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে। যারা পারেনি, তারা তাদের দক্ষতার অভাবে পারেনি অথবা মালিকের আগ্রহের অভাবে পারেনি। সরকার বাধা দেয়নি। সরকারের এই মুক্ত সাংবাদিকতার নীতি প্রশংসনীয়। গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত হলো স্বাধীন সাংবাদিকতা। মহাজোট সরকার গণতন্ত্রের নানা শর্ত লঙ্ঘন করলেও স্বাধীন সাংবাদিকতার শর্তটি বাস্তবায়নে বাধা দেয়নি।

মহাজোট সরকার বিদায় নিয়েছে। ক্ষমতায় এখন নির্বাচনকালীন বহুদলীয় সরকার। যেসব দল সরকারে রয়েছে, তারা প্রায় সবাই আওয়ামী লীগবান্ধব। প্রকৃত বিরোধী দল এই সরকারে নেই। নির্বাচনের সময় গণমাধ্যম সবচেয়ে বেশি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করবে, এটাই প্রত্যাশিত। অথচ সেই বহুদলীয় সরকার নির্বাচনের প্রাক্কালে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করার পাঁয়তারা করছে বলে জানা গেছে।

একটি দর্শকপ্রিয় টিভি চ্যানেলের টক শোর উপস্থাপনা থেকে মাহমুদুর রহমান মান্নাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা বুঝতে কারও অসুবিধে হবে না যে মালিকপক্ষের ওপর সরকার চাপ সৃষ্টি করায় এই ঘটনা ঘটেছে। উল্লেখ করা যায় যে মাহমুদুর রহমান মান্না একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ ও সফল বাগ্মী হওয়াতে টিভির রাজনৈতিক টক শো দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করতেন। তাঁর অনুরাগী দর্শকের সংখ্যা প্রচুর। এই ঘটনা থেকে অনেকে আশঙ্কা করছেন সরকার নির্বাচনের আগে টিভির টক শোর ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের চেষ্টা করবে। কোনো কোনো টিভি চ্যানেলে বিশেষ বিশেষ আলোচককে আমন্ত্রণ না করার জন্য চাপ আছে। এই চাপ প্রয়োগের কারণ বেশির ভাগ টিভি চ্যানেল বর্তমান সরকারের অনুগ্রহে লাইসেন্স পেয়েছে। বেশির ভাগ মালিকই আওয়ামীপন্থী। চ্যানেল মালিক ব্যবসায়ীদের নানা দুর্বলতার কথা সরকার জানে। কাজেই সরকার চাইলে ব্যবসায়ীদের ওপর চাপ দিতে পারে। অনেককে দিচ্ছেও।

টিভির টক শো শুধু সরকারের সমালোচনা করে, এই ধারণা ঠিক নয়। অনেক আলোচক সরকারের নীতির পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন এবং নানা বিষয়ে সরকারের সাফল্য তুলে ধরেন। পাশাপাশি বা একই অনুষ্ঠানে সরকারের সমালোচনা হচ্ছে বলেই এই অনুষ্ঠানগুলোর জনপ্রিয়তা ও বিশ্বাসযোগ্যতা এত বেশি। ‘বিটিভির’ মতো শুধু একতরফা প্রশংসা হলে দর্শক এসব অনুষ্ঠান দেখতেন না। সরকার টক শোর ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে কি সব প্রাইভেট চ্যানেলকে বিটিভির অবস্থানে নিতে চায়?

সম্প্রতি আলোচ্য বিষয়ে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরার জন্য টক শোর মডারেটর, আলোচক ও নাগরিক সমাজের কয়েকজন বিশিষ্ট প্রতিনিধি জাতীয় প্রেসক্লাবে এক প্রতিবাদ সভায় মিলিত হয়েছিলেন। সেখানে এবিএম মূসা ‘টেলিভিশন টক শো: সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে নাগরিক উদ্যোগ’ শিরোনামে যে বক্তব্য পাঠ করেছেন, তা উদ্ধৃত করা হলো:

‘সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমসহ বিভিন্ন সূত্রে আমরা টেলিভিশন টক শোতে স্বাধীন মতামত প্রকাশে সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বিধিনিষেধ আরোপের কথা জানতে পেরেছি। এরই অংশ হিসাবে বিভিন্ন টিভি চ্যানেল থেকে টক শো উপস্থাপককে পরিবর্তন করা হয়েছে বলেও আমরা জানতে পেরেছি। সরকারের সমালোচনাকারী বা ভিন্নমতাবলম্বী বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক বিশ্লেষককে টক শোতে আমন্ত্রণ না জানানোর জন্য টিভি চ্যানেলগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে এবং সরকারের পছন্দমতো আলোচকদের বাধ্যতামূলক আমন্ত্রণ জানানোর জন্য টিভি চ্যানেলগুলোকে নানাভাবে প্রভাবিত করা হচ্ছে। এর আগে দেশের বরেণ্য কয়েকজন রাজনৈতিক বিশ্লেষকের ওপর হামলা, আক্রমণ এবং হয়রানির মতো কিছু শোচনীয় ঘটনাও সাম্প্রতিককালে ঘটেছে।

আমরা তাকে অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিক বলে মনে করি। আমরা এর তীব্র নিন্দা ও সমালোচনা করছি এবং সরকারকে এ ধরনের পদক্ষেপ থেকে অনতিবিলম্বে বিরত হওয়ার দাবি করছি।’

আমরা মনে করি, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের চর্চা এবং এতে নাগরিকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত রাখার স্বার্থে সরকারসহ সব মহলের বিভিন্ন কার্যক্রমের সমালোচনা করা বা তার সঙ্গে ভিন্নমত প্রকাশ করা বা গঠনমূলক বিভিন্ন মতামত প্রদান করার অধিকার বাংলাদেশ সংবিধান বাংলাদেশের নাগরিকদের প্রদান করেছে। বিশেষ করে, দেশে নির্বাচনকালীন সময়ে নাগরিকদের বাকস্বাধীনতাসহ এসব মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করা এবং এসব অধিকার হরণকারী সব কার্যক্রম থেকে বিরত থাকা। টক শো নিয়ন্ত্রণের চেষ্টার মাধ্যমে সরকার তার এই কর্তব্যেও বরখেলাপ করছে। সরকারের এ ভূমিকা জনগণের মুক্ত মননশীলতা, চিন্তা ও বাকস্বাধীনতার চর্চা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য হুমকিস্বরূপ বলে মনে করি।

আমরা বাকস্বাধীনতা, গণমাধ্যমের অধিকার এবং ভিন্নমতাবলম্বী মানুষের নিরাপত্তা বিঘ্নকারী সব মহলের সব কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে জোর অনুরোধ জানাচ্ছি। একই সঙ্গে জনগণকে মুক্তভাবে কথা বলতে দিয়ে দেশে গণতন্ত্র ও সুশাসন নিশ্চিতকরণে তাদের অংশগ্রহণের অধিকারকে যথাযথ মর্যাদা প্রদান করারও আহ্বান জানাই।

আমরা আশা করি, সরকার এই ভুল পথে পা বাড়াবে না। গণমাধ্যম যদি সরকারের বিপক্ষে চলে যায়, তাহলে সেই সরকারকে আর কেউ রক্ষা করতে পারবে না। এমনিতে নানা কারণে বর্তমান সরকারের অবস্থা টালমাটাল। টক শো নিয়ন্ত্রণ করে সরকার কফিনের শেষ পেরেকটি যেন না মারে।

মহাজোট সরকার বিদায় নেওয়ার আগে আরও ১৩টি টিভি চ্যানেলের লাইসেন্স দিয়ে গেছে। আমাদের দলীয় রাজনীতি ও সরকার কতটা দূষিত হলে এ রকম একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারে, তার একটা বড় প্রমাণ এটি। টিভি লাইসেন্স, বেতার লাইসেন্স, ব্যাংক ও বিমা কোম্পানির লাইসেন্স বর্তমান সরকার একমাত্র রাজনৈতিক বিবেচনায় দিয়েছে। ব্যতিক্রম খুব কম। যেহেতু এগুলোর প্রায় প্রত্যেকটি দিয়ে প্রচুর মুনাফা করা সম্ভব। এমনকি শুধু লাইসেন্স বিক্রি করে দিলে বা অন্যদের ভাগ দিলেও বিরাট অঙ্কের টাকা আয় করা সম্ভব। আমাদের দুই বড় দলের রাজনীতি যে প্রধানত হালুয়া-রুটির রাজনীতি, তা এই ঘটনাতে আবার প্রমাণিত হয়েছে। টিভি চ্যানেলের লাইসেন্স নিয়ে দল ও সরকারের ওপর মহলে যে অনেক লেনদেন হয়েছে, তা অনুমান করা কঠিন নয়। কারা লাইসেন্স পেয়েছেন, তাঁদের নাম, পরিচয় দেখলেও তা অনুমান করা যায়। টিভি মাধ্যমের উন্নয়ন নিয়ে তাঁরা যে খুব উদগ্রীব, তা কারও মনে হবে না। টাকা রোজগার ও নিজের প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়ানোই এই টিভি লাইসেন্স সংগ্রহের প্রধান উদ্দেশ্য।

এখন যেসব টিভি চ্যানেল চলছে তার মধ্যে বেশ কয়েকটি মূলধন, স্পনসর, বিজ্ঞাপন ও উপযুক্ত লোকবলের অভাবে ধুঁকছে। বাংলাদেশে টিভি মিডিয়ায় উপযুক্ত লোকবল, শিল্পী, লেখক, উপস্থাপক পাওয়াই এক বড় সমস্যা। টিভির পর্দায় শুধু লাইসেন্স দেখালে তো আর দর্শক সেই চ্যানেল দেখবে না। আমাদের বিজ্ঞাপনের বাজারও সীমিত। সরকার এই বাস্তব সত্যটিও মনে রাখে না। লাইসেন্স বিতরণ করে দুর্নীতি করা যাদের একমাত্র লক্ষ্য, তাদের অবশ্য অন্যান্য বিষয় বিবেচনা করার কথা নয়। যে সরকার বা মন্ত্রণালয় পাঁচ বছরে একটা সম্প্রচার নীতিমালা তৈরি করতে পারেনি, সেই সরকারের মন্ত্রীরা আবার মাইক পেলে বড় বড় কথা বলেন।

একটা সুষ্ঠু নীতিমালা তৈরি না করে খেয়ালখুশি মতো এ ধরনের টিভির লাইসেন্স দেওয়া কতটা যুক্তিসংগত? দ্বিতীয়ত, নির্বাচনকালীন সরকারের দায়িত্ব তো রুটিন কাজ চালিয়ে যাওয়া, নীতিগত বিষয়ে তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা নয়। সে ক্ষেত্রে এই ১৩টি টিভি লাইসেন্স প্রদানের সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখার জন্য আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি।


মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়ন কর্মী।

 
Support : Dhumketo ধূমকেতু | NewsCtg.Com | KUTUBDIA @ কুতুবদিয়া | eBlog
Copyright © 2013. Edu2News - All Rights Reserved
Template Created by Nejam Kutubi Published by Darianagar Publications
Proudly powered by Dhumketo ধূমকেতু