কালের পুরাণ- মেধা ও তারুণ্যের প্রতি রাষ্ট্রের উপেক্ষা by সোহরাব হাসান

Saturday, February 15, 2014

গত বছরের এপ্রিল-মে মাসে এইচএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। বিরোধী দলের আন্দোলন, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সংঘাতের কারণে দীর্ঘ সময় নিয়ে এই পরীক্ষা নিতে হয়েছে। বেশির ভাগ পরীক্ষা হয়েছে শুক্র ও শনিবার।
অন্য দিন বিরোধী দলের হরতাল-অবরোধ থাকায় পরীক্ষা হতে পারেনি। গত বছর একই সমস্যা হয়েছিল এসএসসি, জেএসসি ও পিএসসি পরীক্ষার বেলায়ও।

এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয় গত বছর আগস্টের মাঝামাঝি। এখন ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি। এর মধ্যে
ছয় মাস চলে গেলেও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভর্তির প্রক্রিয়া শেষ হয়নি। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন পর্যন্ত ভর্তির প্রক্রিয়া শুরুই হয়নি। মার্চ নাগাদ ভর্তির প্রক্রিয়া শেষ হলেও ক্লাস শুরু হতে এপ্রিল-মে পর্যন্ত গড়াবে।
মাঝখানে পুরো একটি বছর হারিয়ে যাবে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জীবন থেকে।
সাধারণত একটি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর নতুন শ্রেণীতে ভর্তির প্রক্রিয়া তিন মাসের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা। গত এক বছরে রাজনৈতিক সহিংসতার অজুহাত দেওয়া হলেও ভর্তি প্রক্রিয়ার এই বিলম্ব সব সময় ঘটে থাকে। কেন ঘটে, কারা ঘটান, তার ব্যাখ্যা নেই। ইতিমধ্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একাধিক সেমিস্টার শেষ করেছে। আমাদের প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনগুলোও এ নিয়ে আন্দোলন করে না। আর সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনের নেতারা মনে করেন, পরীক্ষা যত বিলম্বে হবে, তত তাঁদের লাভ। নেতৃত্ব প্রলম্বিত হবে; সেই সঙ্গে চাঁদাবাজি আর দখলবাজিও।
কেবল ভর্তি পরীক্ষা নয়, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের সব পরীক্ষা, ক্লাস ও কোর্স শেষ হয় নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে। সব বিশ্ববিদ্যালয়েই কম-বেশি সেশনজট আছে। তবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এ ক্ষেত্রে রেকর্ড সৃষ্টি করে চলেছে। গড়ে দুই থেকে তিন বছর সেশনজট চলছে এই প্রতিষ্ঠানটিতে। এর কুফল ভোগ করতে হচ্ছে গরিব ও সুবিধাবঞ্চিত ছাত্রছাত্রীদেরই এবং বলা বাহুল্য, তাঁদের সংখ্যাই বেশি।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে স্নাতক ও স্নাতক সম্মান, স্নাতকোত্তর পর্যায়ে শিক্ষার্থীসংখ্যা ২১ থেকে ২২ লাখ। যার মধ্যে ১৩ থেকে ১৪ লাখ পড়াশোনা করেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। অন্যরা অর্থাৎ তুলনামূলক সুবিধাভোগীরা ভর্তি হন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজে। কেউ কেউ উচ্চতর মাদ্রাসায়ও পড়েন। কিন্তু অর্ধেকের বেশি ছাত্রছাত্রী যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আওতায় পড়েন, সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির মা-বাপ আছে বলে মনে হয় না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজট অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব হলেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় চলছে সেই পুরোনো নিয়মেই। সেখানে অধ্যয়নরত প্রত্যেক শিক্ষার্থী গড়ে দুই বছর সেশনজটে পড়লে জাতীয় ক্ষতির পরিমাণটি ভাবা যায়। ১৩-১৪ লাখ ছাত্রছাত্রীর জীবন থেকে দুটি বছর করে হারিয়ে যাচ্ছে। কমপক্ষে ২৬ লাখ ইউনিট বছর। গত বছর এইচএসসিতে পাস করেছেন পাঁচ লাখ ৭৯ হাজার। এঁদের সবাই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে না পড়লেও অধিকাংশ পড়বেন। কিন্তু তাঁদের জীবনের হারিয়ে যাওয়া দিন, মাস ও বছরগুলোর হিসাব কে দেবেন?

দুই
প্রতিদিন পাঠকের কাছ থেকে বহু চিঠি পাই। তরুণদের চিঠির বেশির ভাগই চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ও বিসিএস পরীক্ষা-সংক্রান্ত। গতকাল প্রথম আলোয় খবর বের হয়েছে, প্রিলিমিনারি পরীক্ষার ফল প্রকাশের সাত মাস পার হলেও ৩৪তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করা হয়নি। ফলে দুশ্চিন্তায় আছেন ৪৬ হাজার ২৫০ জন পরীক্ষার্থী। ভাবা যায়! এই কর্মকমিশন নিয়ে আমরা কী করব?
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের আগের বয়সসীমা ছিল ২৮ বছর। এখন করা হয়েছে ৩০ বছর। কিন্তু অনেকেরই অভিযোগ, এই সময়ের মধ্যে তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হতে পারেন না। পারলেও চাকরি খোঁজার বয়স থাকে না। সে জন্য চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩২ বা ৩৫ করার দাবি তাঁদের। পৃথিবীর আর কোনো দেশে তরুণদের নিয়ে রাষ্ট্র ও সরকার এমন তামাশা করতে পারে না। সব সম্ভবের দেশে সবকিছু করে পার পাওয়া যায়।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে রাজনৈতিক বিরোধ আছে। আছে পথ ও মতের বিস্তর ফারাক। কিন্তু একটি জায়গায় তাদের মধ্যে অদ্ভুত মিল দেখা যায়। সেটি হলো, তরুণ প্রজন্মকে ক্রমাগত উপেক্ষা করা। তাদের তারুণ্য, প্রাণশক্তি ও মেধাকে অগ্রাহ্য করা। আর এই কাজটি শুরু হয় প্রাথমিক স্তর থেকেই। স্বাধীনতার ৪৩ বছরেও অভিন্ন প্রাথমিক শিক্ষা চালু হয়নি। প্রাথমিক শিক্ষা অতিশয় বাণিজ্যিকীকরণ হয়ে পড়েছে। প্রথম শ্রেণীতে পড়ার আগেই ছেলেমেয়েকে দুই থেকে তিন বছর পড়তে হয়, প্লে গ্রুপ, কেজি ওয়ান, কেজি টু। তাই একটি শিশুকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চৌকাঠ পার হতেই আট থেকে নয় বছর লেগে যায়। চার বছর বয়সেও শিশুটি বিদ্যালয়ে ভর্তি হলে এসএসসি পাস করতে লাগে ১৮-১৯ বছর। এরপর কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও ছয়-সাত বছর। আর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের খপ্পরে পড়লে তো বাড়তি দুই বছর যোগ করতে হবে। এরশাদের আমলে আশির দশকে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশি নৈরাজ্য চলছিল। তখন আমাদের এক অনুজ শিক্ষার্থী এইচএসসি পাস করার পর এখানে ভর্তির প্রক্রিয়া বিলম্ব দেখে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন ইংরেজি বিভাগে। সেখানে চার বছরে অনার্স ও এমএ করার পর দেশে এসে দেখেন, তাঁর সতীর্থরা অনার্সই শেষ করতে পারেননি। এই অপচয়ের জবাব কী?
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার এই মস্ত বড় দুর্বলতার দিক নিয়ে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকেরা কিংবা শিক্ষাবিদেরা ভাবেন না। ভাবলে প্রতিবছর লাখ লাখ পরীক্ষার্থীকে এভাবে পরীক্ষা, ফল প্রকাশ কিংবা ভর্তি পরীক্ষার তারিখের জন্য হয়রানি ও দুর্ভোগে পড়তে হতো না। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যে ভয়াবহ অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, তা তাঁরা একবারও চিন্তা করেন না।
আমাদের নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকেই বড় বড় কথা বলেন। তাঁদের হাতে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ বলে দাবি করেন,
কিন্তু নতুন প্রজন্মের প্রায় প্রত্যেকের জীবন থেকে যে তিন-চারটি বছর হারিয়ে যাচ্ছে, সে সম্পর্কে তাঁরা কেউ কিছু বলেন না।
এর পেছনে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ যেমন দায়ী, তেমনি দায়ী শিক্ষার এবং তরুণ প্রজন্মের প্রতি রাষ্ট্রের ও শিক্ষার অভিভাবকদের চরম উদাসীনতা।
১৯৯২ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কলেজ পর্যায়ের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে। আগে যার দায়িত্ব ছিল কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর। এসব বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব শিক্ষাক্রম পরিচালনার পাশাপাশি কলেজগুলোর তদারকির কাজ করত; বিশ্ববিদ্যালয় সনদও প্রদান করত তারা। কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষায় শৃঙ্খলা আনার বদলে দুর্গতি এনেছে। এই বিশ্ববিদ্যালয় সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত ও কলঙ্কিত হয় বিগত বিএনপি সরকারের আমলে, যখন আফতাব উদ্দিন আহমাদ উপাচার্য ছিলেন। পরবর্তীকালে পদ্মা-যমুনায় অনেক পানি গড়িয়েছে। একাধিকবার সরকার ও উপাচার্য বদল হয়েছেন। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়টির দুর্নীতি, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা কমেছে এমন দাবি করা যাবে না। সেশনজট আগেও ছিল, এখনো আছে। দলীয়করণ আগেও ছিল, এখনো আছে। আর এসব রোগের উপসর্গ এখন আর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়েই সীমিত নেই, প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই স্বজনপ্রীতি ও দলীয়করণের মচ্ছব চলছে। যখন যাঁরা ক্ষমতায় থাকেন, তাঁরাই বিশ্বদ্যািলয়গুলোকে দলীয় কর্মীদের কর্মসংস্থান কেন্দ্রে পরিণত করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র ও শিক্ষক-কর্মচারী অনুপাত কত হওয়া উচিত? উন্নত বিশ্বে ছাত্র ও শিক্ষকের অনুপাত ১০:১। অর্থাৎ ১০ জন শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষক। আমাদের দেশে সেটি সম্ভব না হলেও ইউজিসি এই অনুপাত বেঁধে দিয়েছে ১৪:১। কিন্তু যেখানে ছাত্র ও কর্মকর্তা-কর্মচারীর অনুপাত বেশি হওয়ার কথা, সেখানে অনেক কম। উপাচার্য মহোদয়েরা দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম যে কাজটি করেন সেটি হলো, কিছু অপ্রয়োজনীয় কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে দল ভারী করা। বিশ্ববিদ্যালয় মানেই এখন মাথাভারী প্রশাসন। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ও কর্মচারী অনুপাত ৪: ১। অর্থাৎ চারজন ছাত্র বা ছাত্রীকে দেখাশোনার জন্য একজন কর্মকর্তা বা কর্মচারী রয়েছেন।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ফি ও বেতন বাড়ানোর বিরুদ্ধে আন্দোলন হচ্ছে। এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্ধিত ফি ও বেতন থেকে আয় বাড়বে ৫০ লাখ টাকারও কম। অথচ বাড়তি শ্রমিক-কর্মচারী নিয়োগ করে তাঁদের পেছনে ব্যয় করা হচ্ছে কয়েক কোটি টাকা। জনগণের অর্থ নিয়ে এমন স্বেচ্ছাচারিতা চালানোর সাহস পান কীভাবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা?
একটি দেশের মানবসম্পদ তৈরি করার প্রধান মাধ্যম হলো বিশ্ববিদ্যালয় বা সমমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। অথচ আমাদের দেশে এর মানই নাজুক। পশ্চিমের উন্নত বিশ্ববিদ্যালয় দূরে থাক, প্রতিবেশী দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গেও আমরা প্রতিযোগিতায় পেরে উঠছি না।
বিশ্ব, এমনকি এশীয় সূচকেও বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান ক্রমেই নিচের দিকে নামছে। আর কত নিচে নামলে মহাত্মনদের চৈতন্যোদয় হবে?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি সংস্কারের সুপারিশ

Tuesday, January 21, 2014

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি সংস্কারের সুপারিশ করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) দেশের প্রেসিডেন্ট ও বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলরকে দেয়া বার্ষিক প্রতিবেদনে এ সুপারিশ করে।
৯ই জানুয়ারি ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরীর নেতৃত্বে ওই প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়। প্রচলিত ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার পর ইউজিসি এ ধরনের সুপারিশ করল। বর্তমান পদ্ধতিতে প্রশ্নপত্রে ভুল ও প্রশ্নফাঁস হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। এমনকি পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে ঘটনার জের ধরে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জন জনপ্রিয় শিক্ষক পদত্যাগও করেছিলেন। বর্তমান পরীক্ষা পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য একপ্রকার যুদ্ধ করতে হয়। কেউ কেউ ১০টি বা তার অধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিয়েও চান্স পান না। কাঙ্ক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দিতে হয়। তাতেও চান্স না পেলে দু’টি বছর পিছিয়ে যেতে হয়। এছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়। এক্ষেত্রে অর্থ ও শ্রম দু’টোই যায়। সমপ্রতি গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে আলোচনায় এলেও বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিরোধিতার কারণে তা আলোর মুখ দেখেনি। এছাড়া এই পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষার জের ধরে সমপ্রতি অধ্যাপক জাফর ইকবাল ও তার স্ত্রী অধ্যাপক ইয়াসমিন হক শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদত্যাগ করেন। পরে আলোচনা সাপেক্ষে বিষয়টি নিয়ে সমঝোতা করা হয়। আলোচনার পর তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন। এছাড়া শিক্ষামন্ত্রণালয়ও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে। ইউজিসির প্রতিবেদনে বলা হয়- বর্তমানে দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে প্রথম বর্ষে ভর্তির প্রক্রিয়া পর্যালোচনার উপর কমিশন গুরুত্ব আরোপ করে। ভর্তিচ্ছুক শিক্ষার্থীদের জন্য চলমান প্রক্রিয়া অত্যন্ত ব্যয়বহুল। ভর্তি পরীক্ষাসমূহ কেবলমাত্র বোর্ড পরীক্ষার একটি অতি সংক্ষিপ্ত রূপ এবং এ পরীক্ষার গুণগতমান বর্তমানে প্রশ্নবিদ্ধ। একাধিক ক্ষেত্রে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে ভুল ধরা পড়েছে। এছাড়া প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। বোর্ড পরীক্ষায় ভাল ফল অর্জনকারী শিক্ষার্থীরা এক ঘণ্টার সংক্ষিপ্ত পরীক্ষায় কোন কারণে ব্যর্থ হলে তারা কাঙ্ক্ষিত প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে ব্যর্থ হয়। যা তাদের প্রতি অবিচার বলে কমিশন মনে করে। এছাড়া বর্তমান পদ্ধতিতে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীকে ৬-১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে হয় এবং দীর্ঘসময় তাদের কোচিং সেন্টারের শরণাপন্ন হতে হয়। মানসিক চাপ ও একই বিষয়বস্তু নিয়ে দীর্ঘকাল অধ্যয়নরত থাকার ফলে তাদের সৃজনশীলতা বহুলাংশে হ্রাস পায়। এছাড়া ভর্তি পরীক্ষা সংক্রান্ত বিভিন্ন কাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের যে সময় ব্যয় হয় তার পরিমাণও উল্লেখযোগ্য। এই সময়টুকু শিক্ষকরা বিভিন্ন শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারেন। ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠাসমূহের এবং সংশ্লিষ্ট শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অতিরিক্ত আয়ের একটি সুযোগ সৃষ্টি হয় বটে, তবে এই আয়ের নৈতিক বৈধতা প্রশ্নসাপেক্ষ। কমিশন প্রচলিত ভর্তি পরীক্ষার বিকল্প উদ্ভাবন করে ভর্তি প্রক্রিয়ার আমূল সংস্কারের সুপারিশ করছে ইউজিসি। তবে ইউজিসির এ সুপারিশ নিয়ে আপত্তি তুলেছে শীর্ষ স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ইউজিসির এ ধরনের সুপারিশ কাল্পনিক। পৃথিবীর কোথাও এ ধরনের পদ্ধতি নেই। তিনি বলেন, প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা আলাদা স্বাতন্ত্র্য আছে। অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন বলেন, বোর্ড পরীক্ষার ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কোন যৌক্তিকতা নেই। কেননা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের সিলেবাস রয়েছে। অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন বলেন, অর্থ ব্যয়ের বিষয়ে কেন কথা বলা হচ্ছে? আমরা একজন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে একমাসে মাত্র ১২ টাকা বেতন নিই। সেখানে প্রাইভেট বিশ্বদ্যিালয়ে বিভিন্ন নামে ৭০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা নেয়। সেখানে ইউজিসি কোথায় থাকে। অনামিকা ভট্টাচার্য  এ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে চান্স পেয়েছেন। তিনি এর আগে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন। তিনি প্রচলিত পদ্ধতিকেই সমর্থন করেন। অনামিকা বলেন, একেকটা বিশ্ববিদ্যালয় একেকভাবে পরীক্ষা নেয়। এতে শিক্ষার্থীদের মেধার বিকাশ হয়। একটা পদ্ধতিতে পরীক্ষা নিয়ে মেধা বিকাশের সুযোগ থাকবে না। ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, বর্তমানে দেশে ৩৪টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। কোন শিক্ষার্থী তার পছন্দ বিষয়ে পড়তে চাইলে তার ১০-১৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়। এতে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের হয়রানির শিকার হতে হয়। তাদের টাকা ব্যয় হয়। শ্রম ও সময় ব্যয় হয়। এটা না করে গুচ্ছভিত্তিক পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করলে এতো সময় ও অর্থ ব্যয় হবে না। তিনি বলেন, মানবিকের জন্য একটি, সামাজিক বিজ্ঞানের জন্য একটি, বিজ্ঞানের জন্য একটি পরীক্ষা নিলেই হয়। অধ্যাপক চৌধুরী বলেন, আমেরিকার বিশ্বদ্যিালয়গুলোতে এ ধরনের পদ্ধতি চালু রয়েছে। কোন শিক্ষার্থী গ্র্যাজুয়েট রেকর্ড এক্সামিনেশনে (জিআরই) অংশ নিয়ে যে নম্বর পায় তা দিয়ে যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করতে পারে।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে ইউজিসি’র ৫ দফা সুপারিশ by সোলায়মান তুষার

Friday, January 3, 2014

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে ৫ দফা সুপারিশ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। ইউজিসি’র সর্বশেষ প্রতিবেদনে এ সুপারিশ করা হয়।
দেশের উচ্চশিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। স্নাতক পর্যায়ের মোট শিক্ষার্থীর প্রায় ৪৮ ভাগই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজে অধ্যয়নরত। তবে এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্ত স্নাতকদের গুণগত মান মোটেই আশানুরূপ নয়। অধিভুক্ত কলেজগুলোর উচ্চশিক্ষা কার্যক্রমের সার্বিক অবস্থা উদ্বেগজনক বলে মনে করে ইউজিসি। এর পরিপ্রেক্ষিতেই পাঁচ দফা সুপারিশ করা হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি পরিপূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত স্নাতকোত্তর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করে সেখানে কেবল এমএস ও পিএইচডি পর্যায়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা। এ ছাড়া ঢাকা বিভাগের স্নাতক পর্যায়ে শিক্ষা প্রদানকারী কলেজগুলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত থাকবে। অন্য ছয়টি বিভাগীয় শহরে একটি করে স্বায়ত্তশাসিত স্নাতকোত্তর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে ওই বিভাগের স্নাতক পর্যায়ে শিক্ষা প্রদানকারী কলেজগুলো অধিভুক্ত করা। যেসব কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক এবং স্নাতক উভয় পর্যায়ে শিক্ষা কার্যক্রম রয়েছে, সেগুলোকে পৃথক দু’টি কলেজে রূপান্তরিত করতে বলা হয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিভাগীয় নতুন বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া কেবল কয়েকটি নির্বাচিত কলেজে মাস্টার্স পর্যায়ে শিক্ষা কার্যক্রম সীমিত রাখা; মাস্টার্স পর্যায়ে ভর্তির ক্ষেত্রে বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা স্নাতকদের জন্য উন্মুক্ত রাখা এবং প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থী বাছাই করার পদ্ধতি প্রবর্তন করার সুপারিশ করা হয়েছে। অধিভুক্ত কলেজগুলোর শিক্ষক নিয়োগের দায়িত্ব বিভাগীয় বা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রদান করে এসব শিক্ষকের চাকরির বিধিমালা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অনুরূপ করার কথা বলা হয়েছে। দেশে ৩৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে একমাত্র অ্যাফিলিয়েটিং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজস্ব কোন শিক্ষার্থী না থাকলেও এর অধীনে ২ হাজার সাতটি অধিভুক্ত ও অঙ্গীভূত কলেজে ১২ লাখ ৬৮ হাজার ৪৫০ শিক্ষার্থী রয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থিত দু’ হাজারেরও বেশি কলেজ সম্পর্কে খোঁজখবর রাখা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে একটি দুরূহ কাজ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজট বর্তমানে গুরুতর পর্যায়ে পৌঁছেছে। সেশনজট নিরসনে বিশ্ববিদ্যালয় কার্যকর কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে দেশের সাতটি বিভাগীয় শহরে আঞ্চলিক কেন্দ্র স্থাপন করে স্ব-স্ব বিভাগের কলেজগুলোর শিক্ষাসংক্রান্ত কার্যক্রম তদারকির দায়িত্ব ওই সব কেন্দ্রের ওপর অর্পণ করার উদ্যোগকে কমিশন স্বাগত জানিয়েছে। তবে শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য কলেজগুলোর একাডেমিক মনিটরিং প্রয়োজন বলে মনে করে ইউজিসি। এ ক্ষেত্রে শিক্ষক এবং গবেষণা-সংক্রান্ত জনবল নিয়োগ করে কেন্দ্রগুলোকে পর্যায়ক্রমে স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করা যেতে পারে। উচ্চশিক্ষা কার্যক্রমের সার্বিক অবস্থায় ইউজিসি’র উদ্বেগের কারণ সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেশির ভাগ কলেজে একাদশ শ্রেণী থেকে মাস্টার্স পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রম চালু রয়েছে। এতে শিক্ষা কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কেবল স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে কারিকুলাম প্রণয়ন এবং পরীক্ষার ব্যবস্থা করে। এ ছাড়া বেসরকারি কলেজগুলোর গভর্নিংবডিতেও শিক্ষক নিয়োগের জন্য নির্বাচনী কমিটিতে প্রতিনিধি নিয়োগ করে। সরকারি ও বেসরকারি কলেজের শিক্ষাকার্যক্রম তদারকি করার দায়িত্ব থাকলেও এটি করা সম্ভব হচ্ছে না। শিক্ষক নিয়োগ, এক কলেজ থেকে অন্য কলেজে পোস্টিং অর্থাৎ বদলি-সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন ভূমিকা নেই। এর ফলে শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। ১৯৯২ সালে অ্যাফিলিয়েটিং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হচ্ছে নিজস্ব আয় থেকে। তারা ছাত্র ভর্তি থেকে শুরু করে ডিগ্রি প্রদান পর্যন্ত সব কার্যক্রমের জন্য নির্ধারিত হারে ফি আদায় করে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেটে উল্লেখ করা হয়েছে, আয় ১২৮ কোটি ৩৭ লাখ ৩৬ হাজার টাকা এবং ব্যয় ১২৩ কোটি ৪৯ লাখ ৯১ হাজার টাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ের রিজার্ভ ফান্ডের রয়েছে, ৭০০ কোটি টাকার বেশি। এ ফান্ড থেকেও প্রতি অর্থবছরে বিপুল আয় হয় বিশ্ববিদ্যালয়টির। ফলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক ব্যয়ের চেয়ে আয়ের পরিমাণ বেশি হওয়ায় ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছর থেকে কমিশন অনুন্নয়ন খাতে কোন অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয় না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ বলেন, এ প্রতিষ্ঠানটিতে বহুমুখী সমস্যা রয়েছে। এর একটি সেশনজট। এ সমস্যার সমাধান হলেই বাকি সমস্যা এমনিতেই কেটে যাবে। আমরা বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছি। তিনি বলেন, একদিনে সব সমস্যার সমাধান হবে না। এ জন্য সময় প্রয়োজন।
 
Support : Dhumketo ধূমকেতু | NewsCtg.Com | KUTUBDIA @ কুতুবদিয়া | eBlog
Copyright © 2013. Edu2News - All Rights Reserved
Template Created by Nejam Kutubi Published by Darianagar Publications
Proudly powered by Dhumketo ধূমকেতু