কমরেড চলে গেছেন ১১ বছর হয়। কিন্তু কমরেড অমল সেন বেঁচে আছেন এ দেশের মানুষের স্মৃতিতে। সবার কাছে নয়। শহুরে বুদ্ধিজীবীরা তাঁকে চিনতেন হয়তো বা। কিন্তু যে প্রচার আলোক একজন অখ্যাত ব্যক্তিকেও পরিচিতি দেয়, সে ধরনের কোনো প্রচার তাঁর সম্পর্কে ছিল না।
এমনকি তাঁর মৃত্যুর সংবাদও দেশের প্রধান সংবাদপত্রগুলোতে বিশেষ ফলাও করে প্রচার হয়নি। কিন্তু তিনি বেঁচে ছিলেন এবং আছেন সেই কৃষক ও সাধারণ মানুষের মধ্যে, যাদের তিনি কেবল আন্দোলনেই সংগঠিত করেননি, তাদের জীবনবোধে পরিবর্তন এনে দিয়েছিলেন। তাদের উন্নত চিন্তায় উন্নত করেছেন।
এ দেশে কৃষক আন্দোলনের অনন্য অধ্যায় তেভাগা সংগ্রাম। চল্লিশের দশকে এই সংগ্রাম গড়ে উঠেছিল উত্তর বাংলার দিনাজপুর, রংপুর, কোচবিহার ও মেদিনীপুর অঞ্চলে। দক্ষিণ বাংলায় সেই সংগ্রাম গড়ে উঠেছিল যশোর, খুলনাকে কেন্দ্র করে। এই তেভাগা সংগ্রামের মূল অঞ্চল ছিল নড়াইলের এগারখান অঞ্চল। এ অঞ্চলজুড়ে কমরেড অমল সেন কৃষকদের সংগঠিত করেছিলেন প্রথমে হাটতোলা, খাজনা ইত্যাদি প্রশ্নে। পরবর্তীকালে তেভাগার দাবিতে। নড়াইল অঞ্চলের তেভাগার সংগ্রামই দাবি আদায় ও কার্যকারিতার দিক থেকে সবচেয়ে সফল সংগ্রাম ছিল। নড়াইলের কৃষকেরা তেভাগার দাবি আদায়ের পাশাপাশি ওই অঞ্চলে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতেও সক্ষম হয়েছিল। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কৃষকের দৃঢ় অবস্থান এই সংগ্রামের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল। এ কারণে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে দেশ ভাগ হলেও তা নড়াইলকে বিশেষ স্পর্শ করেনি। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কর্মীরা দেশভাগের কারণে ওপার বাংলায় গিয়ে আশ্রয় নিলেও অমল সেনসহ তাঁর কৃষক সংগ্রামীরা দেশ ত্যাগ করতে রাজি হননি। পাকিস্তানের প্রায় পুরো সময় জেলে থাকতে হলেও দেশত্যাগের শর্তে মুক্তি লাভে তিনি রাজি হননি।
কমরেড অমল সেন যখন তাঁর বিপ্লবী জীবন শুরু করেন, তখন দেশে ব্রিটিশ শাসন চলছে। সেই শাসনের বিরুদ্ধে সে সময়ের তরুণেরা অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। অমল সেন অবশ্য তাঁর কিশোর বয়সেই এই বিপ্লবী মন্ত্রে দীক্ষিত হন। বিপ্লবের সেই দীক্ষা তাঁর শেষ দিন পর্যন্ত বহাল ছিল। তাঁর সেই বিপ্লবী চেতনা পরিশীলিত হয়েছিল মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী চিন্তাচেতনার সংস্পর্শে। তারুণ্যের শুরুতেই এই চেতনায় উদ্বুদ্ধ তিনি জনগণের মুক্তির সংগ্রামে নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন। এ জনগণ সমাজের একেবারে নিচের মানুষ। নড়াইলের এগারখান অঞ্চলে এই কৃষক মানুষগুলোর মধ্যেই তিনি অবস্থান নিয়েছিলেন। সেই কৃষকের পরিচয়েই পরিচিত হতে চেয়েছেন তিনি সারাটা জীবন।
কমরেড অমল সেন যে তেভাগার সংগ্রাম গড়ে তুলেছিলেন, তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক লড়াইয়ের কারণে তা পরিণতিতে পৌঁছাতে পারেনি। কিন্তু এ আন্দোলন থেকে তিনি জনগণের নিজস্ব রাষ্ট্র গড়ে তুলতে বিকল্প শক্তি গড়ে তোলার যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন, সেটাকেই বাস্তবায়ন করতে চেয়েছেন সারাটি জীবন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও তিনি এ বিকল্প শক্তি গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। না হলে নতুন রাষ্ট্র যে জনগণের হবে না, ক্ষমতার হাত বদল হয়ে বিদেশি শাসকশ্রেণীর বদলে দেশীয় শাসকশ্রেণীর কুক্ষিগত হবে, সে কথাটাই তিনি বারবার উচ্চারণ করেছেন। বাংলাদেশের এযাবৎকালের অভিজ্ঞতা তাঁর ওই উপলব্ধিরই প্রমাণ দিয়েছে।
অমল সেনের মানুষের প্রতি ছিল অগাধ বিশ্বাস। মানুষের প্রতি তাঁর এই আস্থা ও বিশ্বাসই তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। রাজনীতিতে সক্রিয় রেখেছিলেন জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষের মধ্যে যে শক্তি লুকিয়ে আছে, তার বিকাশ ঘটালে সে তার ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে। নিজ ভাগ্যের নিয়ন্তা হতে পারে। তেভাগার কৃষক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তিনি সেই শক্তির সন্ধান পেয়েছিলেন। আর এর ভিত্তিতেই তিনি তাদের সংগঠিত হতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। বিপ্লব আর বিপ্লবী আদর্শের প্রতি তাঁর এই বিশ্বাস কেবল শিক্ষণীয়ই নয়, নতুন প্রজন্মের জন্য অমূল্য সম্পদও বটে। তাঁর রেখে যাওয়া পথ ধরেই বর্তমানের এই অন্ধকারময় সময়ে নতুন প্রজন্মের সামনের দিকে তাকানো সম্ভব।
অমল সেন কেবল একজন বিপ্লবীই ছিলেন না। তিনি ছিলেন পরিপূর্ণ এক মানুষ। আমাদের দেশে এই পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠা খুবই কম পাওয়া যায়। অমল সেন ছিলেন সে ধরনের এক ব্যতিক্রমী। বিপ্লব ও বিপ্লবী আদর্শের প্রতি তিনি যেমন একনিষ্ঠ ছিলেন, একই সময় মানুষ হিসেবে তাঁর জীবনবোধ, রসবোধ, জীবনকে উপভোগ করার শক্তি ছিল অতুলনীয়। জীবনকে তিনি নিজে ভালোবাসতেন তা-ই নয়, সেই ভালোবাসার ভাগ দিতেন অন্যদের। তাঁর সংস্পর্শে এসে যেকোনো মানুষই আনন্দ পেত। কি বয়স্ক, কি যুবক-কিশোর-শিশু সবার কাছেই তিনি ছিলেন আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। সাধারণ আলাপচারিতা থেকে শুরু করে জটিল তাত্ত্বিক বিষয়—সব ক্ষেত্রেই তিনি সবার মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারতেন। জীবন উপভোগ করার শক্তি তাঁর ছিল অপরিসীম। নিজের বিয়ে করার সময় হয়নি। কিন্তু পরিবার ও পারিবারিক জীবন কীভাবে পরিচালিত হবে, কী হওয়া উচিত—সে বিষয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা ঘর-সংসারী মানুষের চেয়ে বেশি ছিল। সে কারণেই তিনি যে পরিবারে থাকতেন, তখন তিনি ওই পরিবারেরই একজন হয়ে উঠতেন। তাদের ঘর গৃহস্থালি থেকে শুরু করে বাচ্চা প্রতিপালন, তাদের লেখাপড়া শেখানো—সবকিছুতেই তাঁর পরামর্শ হয়ে উঠত অমূল্য।
বিপ্লবের প্রয়োজনে অমল সেনকে আনুষ্ঠানিক পড়াশোনা ত্যাগ করতে হয়েছিল। কিন্তু অনানুষ্ঠানিক পড়াশোনায়, কেবল মার্ক্সীয় দর্শন ও তত্ত্বই নয়, সাহিত্য, শিল্পকলা, বিজ্ঞান, এমনকি চিকিৎসাশাস্ত্র সম্পর্কেও তাঁর পারদর্শিতা ছিল। ইতিহাস থেকে শুরু করে আধুনিক সব বিষয়ই তাঁর মনোযোগ পেয়েছে। ওই বিনয়ী নম্র মানুষটি আবার সংগ্রামে ছিলেন দৃপ্তচিত্ত; সে রাজনৈতিক সংগ্রামই হোক, তাত্ত্বিক সংগ্রামই হোক।
অমল সেন চলে গেছেন। কিন্তু রেখে যান এমন আদর্শ, যার মৃত্যু ঘটে না। তিনি বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন এ দেশের মাটিতে। কমরেড অমল সেন, লাল সালাম।
রাশেদ খান মেনন: মন্ত্রী, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং সভাপতি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি।
0 comments:
Post a Comment