দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সারা দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার মধ্য দিয়ে নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতির একটি পূর্বাভাস পাওয়া গিয়েছিল।
তবে এসবের পরও প্রশাসন কিংবা সরকারের টনক নড়েনি। কিন্তু যখন সংখ্যালঘুদের পাড়াগুলো সাম্প্রদায়িকতার আগুনে পুড়ে বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে, তখনই প্রশাসন এগিয়ে এসেছে। অথচ হামলার আশঙ্কায় প্রশাসন কিংবা সরকারি দলের নেতাদের সাহায্য চাওয়া হলেও তাঁরা সম্পূর্ণ নির্বিকার ছিলেন।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হলেও অন্যান্য ধর্ম শান্তিপূর্ণভাবে পালনের কথা সংবিধানে বলা আছে। কিন্তু এ দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর প্রতিটি হামলায় উগ্র ধর্মান্ধতা কাজ করেছে। দেশের বাইরে কোথাও ‘ইসলাম ধর্ম’ আঘাতপ্রাপ্ত হলে এর প্রভাব এ দেশের সংখ্যালঘুদের ওপর এসে বর্তায়! এখানে জাতীয় নির্বাচনের জয়-পরাজয়ের দায়ও যেন সংখ্যালঘুদের অবধারিতভাবে বহন করতে হয়! এ দেশে সংখ্যালঘু পরিবারের জমি বেদখল করার অন্যতম কৌশলও হলো খোঁড়া অজুহাতে তাদের ওপর হামলা চালানো এবং রাতের আঁধারে অথবা ক্ষেত্রবিশেষে দিনদুপুরে তাদের পরিবারের নারীর ইজ্জত লুণ্ঠন করা! যাতে করে নিজের ও পরিবারের সম্মান বাঁচাতে ওই পরিবার কোনো এক নিশীথে দেশ থেকে নিরুদ্দিষ্ট হয়ে যায়! আর পরিবারটির রেখে যাওয়া সম্পত্তি দখলে আর কোনো বাধা রইল না! মানবিকতা আর মনুষ্যত্ববোধ কতটা নিচে নামলে এ ধরনের প্রবৃত্তি উদয় হতে পারে! এমন পরিস্থিতিতে আজকের বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের মানসিক প্রকৃতিটাই ভয়ের সংস্কৃতিতে বাঁধা পড়ে গেছে।
নির্বাচনের দিন মালোপাড়ার আক্রান্ত হিন্দু পরিবারগুলোর চোখে-মুখে এখনো চাপা কান্না আর আতঙ্ক ভর করে আছে। এই চাপা কান্না আর আতঙ্ক শুধু মালোপাড়ার নয়, এ দৃশ্য সংখ্যালঘু প্রতিটি পাড়ায়। আজ হয়তো ঘটনা ঘটেছে বলে তাদের খোঁজ নিতে গিয়ে এ চাপা কান্নার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি আর আতঙ্কভরা মুখ দেখতে পাচ্ছি; কিন্তু এই চাপা কান্না আর আতঙ্কিত নীল মুখ তো এক দিনে তৈরি হয়নি। জীবনের প্রতিটি পদে সংখ্যালঘুদের অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তার অভাব থেকেই তাদের মানসপটে ভীতি ও শঙ্কার ভিত্তি এত বেশি গভীরে গেঁথে গিয়েছে, সেই আতঙ্ক সাময়িক ত্রাণ দিয়ে কিংবা পুলিশি নিরাপত্তা দিয়ে দূর করা সম্ভব নয়। সংখ্যালঘুদের এই মানস-সংকট রচনায় কেবল উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীই দায়ী নয়, এর জন্য রাষ্ট্রের চরিত্রও দায়ী। কারণ, দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিনিয়ত মন্দির, প্রতিমা, বুদ্ধমূর্তি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটলেও এখনো এই অপরাধের দায়ে কোনো অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়েছে, এমন নজির আমাদের চোখে পড়েনি।
গত শতকের বিভীষিকাময় কালো অধ্যায়কে পেছনে ফেলে একবিংশ শতকে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশ হবে, সে প্রত্যাশাই ছিল আমাদের সবার। কিন্তু এই শতকের শুরু থেকেই যেন এ দেশে সাম্প্রদায়িকতার দৈত্য চেপে বসেছে। ২০০১ সালে নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে সংখ্যালঘুদের ওপর ন্যক্কারজনক হামলার কথা কারোর অজানা নয়। এ ছাড়া, ২০০৩ সালের আগস্টে খাগড়াছড়ি জেলার মহালছড়ির সাম্প্রদায়িক হামলা, ২০০৬ সালের এপ্রিলে মাইসছড়ির ঘটনা, ২০০৭ সালে চলেশ রিশিলের হত্যাকাণ্ড, খাগড়াছড়িতে বৌদ্ধদের ভাবনাকেন্দ্র গুঁড়িয়ে দিয়ে দুজন সন্ন্যাসীকে আটক, ২০০৮ সালে দিনাজপুরে জমি বেদখলের জন্য দুজন সাঁওতালকে পিটিয়ে হত্যা, খাগড়াছড়ির সারনাথ অরণ্য কুটিরের জমি বেদখল করে কুটিরের ভিক্ষুকে গ্রেপ্তার, ২০০৮ সালের এপ্রিলে সাজেকের চারটি পাহাড়ি গ্রামে হামলা চালিয়ে কমপক্ষে ৭৭টি বসতবাড়ি, একটি গির্জা ও দুটি ইউনিসেফ পরিচালিত পাড়াকেন্দ্র আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া, লাদুমনি চাকমাকে বাড়ি থেকে টেনে-হিঁচড়ে বের করে হত্যা করা, ২০০৯ সালে নওগাঁর পোরশা উপজেলায় ৭৪টি আদিবাসী বাড়িতে আগুন দেওয়া, ২০১০ সালের ১৯-২০ ফেব্রুয়ারিতে সাজেকে পুনরায় হামলা চালিয়ে ১১টি গ্রামের শতাধিক বাড়ি, দুটি বৌদ্ধবিহার ও একটি গির্জা আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া, এর তিন দিন পর ২৩ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ি জেলা সদরের সহিংসতা, ২০১১ সালে লংগদু ও রামগড়-মানিকছড়িতে হামলা, ২০১২ সালের মে মাসে টেকনাফের চাকমাপল্লিতে পুলিশি হামলা, একই বছরের সেপ্টেম্বরে রাঙামাটি ও রামুর ঘটনা, ২০১৩ সালের আগস্টে খাগড়াছড়ির তাইন্দং ঘটনা, নোয়াখালী, সাতক্ষীরা, পাবনার সাঁথিয়া, যশোরের ঋষিপল্লি, অভয়নগরের মালোপাড়া... আর কত সাম্প্রদায়িক হামলার কথা মনে রাখা যায়! উগ্র ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতার আগুনে বারবার ঝলসে যাচ্ছে সংখ্যালঘুদের বেঁচে থাকার আশাটুকুও। কিন্তু সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়ে সরকারের কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙতে আর কতগুলো সংখ্যালঘুর গ্রাম পুড়তে হবে?
প্রথম আলো (১৪ জানুয়ারি) পত্রিকার ভেতরের পাতায় ‘ত্রাণ চাই না, মনের আগুন নেভানোর ব্যবস্থা করুন’ শিরোনামের খবরটি দেখে পাঁচ মাস আগের কথা মনে পড়ল। তাইন্দং হামলা-পরবর্তী পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য ঢাকার একটি নাগরিক প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আমি যখন তাইন্দংয়ে যাই, তখন হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলোর একটাই আর্তি ছিল—‘ত্রাণ নয়, আগে আমাদের নিরাপত্তা দিন। আজ ত্রাণ দিয়ে যাবেন, আগামীকাল আবার হামলা হবে না, এ নিশ্চয়তা কে দেবে?’ অনুরূপ ‘আর্তি’ শুনতে পাচ্ছি দেশের আরেক প্রান্তে নির্যাতিত-আক্রান্তদের কণ্ঠে।
সম্প্রতি রাজধানীর এক মতবিনিময় সভায় উপস্থাপিত এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত ৬২ বছরে এ দেশে সংখ্যালঘুর সংখ্যা নেমে এসেছে ৯ শতাংশে। উক্ত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৬১ সালে ১৯ দশমিক ৬, ’৭৪ সালে ১৪ দশমিক ৬, ’৮১ সালে ১৩ দশমিক ৩, ’৯১ সালে ১১ দশমিক ৭ এবং ২০০১ সালে সেই সংখ্যা দাঁড়ায় ১০ দশমিক ৪ শতাংশে, এবং সর্বশেষ ২০১৩ সালে এ সংখ্যা ৯ শতাংশেরও নিচে। (সূত্র: প্রথম আলো)
এই দেশ থেকে সংখ্যালঘু মানুষদের এ নিরুদ্দিষ্টতার পরিসংখ্যানও কি রাষ্ট্রের নিশ্চুপতাকে ভাঙতে পারবে না?
ইলিরা দেওয়ান: হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক।
ilira.dewan@gmail.com
0 comments:
Post a Comment