ব্রিটেনে ইংরেজি শব্দ ‘হাইন্ডসাইট’ একটি বহুল প্রচলিত শব্দ। বিশেষ করে রাজনীতিকদের কাছে। যখনই কোনো কৈফিয়তের প্রশ্ন আসে, তখনই তাঁরা এই শব্দটি ব্যবহার করে ‘কী করিলে কী হইত’-এর বিভিন্ন সম্ভাব্য চিত্র তুলে ধরে তাঁদের নিজেদের অক্ষমতা বা না পারার যৌক্তিকতা ব্যাখা করে থাকেন।
বাংলা একাডেমির অভিধান এবং গুগল-এর অনুবাদ অনুযায়ী এর অর্থ হচ্ছে ‘সংঘটনের পর বোধোদয়’। এটি বাংলা প্রবাদ ‘চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে’র অনুরূপ। বাংলাদেশেও রাজনীতিক ও বিভিন্ন নাগরিক গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বের দাবিদার গোষ্ঠীগুলো ক্রমেই
এই অঘটন-উত্তর বোধোদয়ে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। তা না হলে বছর খানেক ধরে যে অঘটনের আশঙ্কা সবাই করছিলেন, তা ঠেকানোর কোনো চেষ্টাই কেন হয়নি? বরং মনে হয়, রাজনীতির খোরাক হিসেবে এই অঘটনকে পুঁজি করার জন্য এঁদের অধিকাংশই অপেক্ষায় ছিলেন।
সাংবাদিকদের কলম অথবা ক্যামেরায় দেশের নানা জায়গায় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপর হামলার যেসব চিত্র উঠে এসেছে, তাতে কোথাও তো এসব ক্ষমতাধর রাজনীতিক, আমলা, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার কাউকে নিপীড়িত-নির্যাতিতের পাশে দাঁড়াতে দেখা যায়নি। অথচ, এখন তাঁরাই ডজন ডজন ক্যামেরার সামনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পরিবারগুলোকে সাহায্য দেওয়ার আয়োজন করছেন এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দুষছেন। কয়েক সপ্তাহ ধরে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার বিষয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় বেশ কিছু সরেজমিন প্রতিবেদন দেখছি। আর দেখছি মানববন্ধন, লংমার্চ এবং বক্তৃতা-বিবৃতি, যেগুলোর সবই অঘটনোত্তর প্রতিক্রিয়া।
অনেক দিন থেকেই বাংলাদেশে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর জন্য নির্বাচনকালীন মৌসুম ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাঁদের ওপর হামলার বিষয়টি চরমে পৌঁছায় ২০০১ সালে। এর পর একমাত্র ব্যতিক্রম ২০০৯। এ ধরনের একটি সর্বজনবিদিত ঝুঁকি প্রশাসন, পুলিশ, নির্বাচন কমিশন এবং স্থানীয় রাজনীতিকদের উপেক্ষা করার কারণ নেই। অথচ সে রকমটিই ঘটেছে। কিন্তু সংবাদমাধ্যমে এসব বিষয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তেমন একটা চোখে পড়ছে না। হামলাকারী দুর্বৃত্তদের রাজনৈতিক পরিচয় প্রকাশে প্রয়োজনীয় গুরুত্ব দেওয়া হলেও নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব রাষ্ট্রের যেসব প্রতিষ্ঠানের, তাদের ব্যর্থতা কিংবা গাফিলতি অথবা সম্ভাব্য কোনো রাজনৈতিক দুরভিসন্ধির বিষয়গুলো অনুসন্ধানে কারও কোনো আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না। প্রধান দুই দল বা জোট বিষয়টি নিয়ে রাজনীতি করতে যতটা আগ্রহী, তার কারণ অনুসন্ধান, অপরাধীদের বিচার এবং ভবিষ্যতে তার পুনরাবৃত্তি রোধের শিক্ষা গ্রহণে ততটাই উদাসীন। সুতরাং, এসব হামলার বিষয়ে ইউরোপীয় জনপ্রতিনিধিরা কিংবা বহির্বিশ্ব থেকে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্তের যেসব আহ্বান জানানো হয়েছে, সেগুলো কেউ কানে তুলছেন না। রাজনৈতিক কারণ না থাকলে এ ধরনের তদন্তে সরকারের অনাগ্রহের কোনো কারণ থাকার কথা নয়। নাগরিক গোষ্ঠীগুলোর গণতদন্ত কমিশনের মতো বেসরকারি উদ্যোগ গ্রহণেও তো কোনো বাধা দেখি না।
তদন্তে মাঠপর্যায়ে হামলাগুলোর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার পাশাপাশি বৃহত্তর পরিসরে অন্য যেসব বিষয় নজর দেওয়া প্রয়োজন সেগুলো হলো—নির্বাচন কমিশন, পুলিশ, প্রশাসন, অন্তর্বর্তী সরকার এবং মানবাধিকার কমিশনের মতো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা।
১. নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রশ্নবিদ্ধ। সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন স্পষ্ট করেই বলেছেন যে নির্বাচনকালীন নিরাপত্তার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের, অন্য কারও নয় (‘নির্বাচন কমিশন দায় এড়াতে পারে না’, প্রথম আলো, ১১ জানুয়ারি)। বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার একজন অভিজ্ঞ প্রশাসক। অতীতে সচিবের দায়িত্ব পালনের কারণে বেসামরিক নিরাপত্তা বাহিনীর কাজের ধরন, রীতিনীতি, প্রটোকল তাঁর অজানা থাকার কথা নয়। কমিশনারদের মধ্যে একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তাও আছেন, যাঁর ব্রিগেড পরিচালনার অভিজ্ঞতা রয়েছে। সুতরাং, জাতীয় নির্বাচনের মতো একটা বিশাল আয়োজনের প্রস্তুতি নেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁরা প্রয়োজনীয় অনুশীলন করেননি এমনটা ভাবা দুষ্কর। যেকোনো নির্বাচন আয়োজনের আগে সেই নির্বাচনে সম্ভাব্য ঝুঁকি নির্ধারণের একটি বিষয় থাকে। স্বভাবতই তাই প্রশ্ন উঠছে যে কমিশন কি সেসব ঝুঁকি নির্ধারণ করেছিল, নাকি সেগুলো উপেক্ষা করেছে? নাকি ঝুঁকি নির্ধারণের পর তা মোকাবিলায় পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে? কমিশনের তরফ থেকে সংখ্যালঘুদের বিপদ এবং তা মোকাবিলার বিষয়ে কী ধরনের প্রস্তুতি বা নির্দেশনা ছিল? আর, প্রশাসনের ওপরই বা কমিশন কতটা নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছিল?
২. মাঠপর্যায়ে নিরাপত্তার মূল দায়িত্ব যেহেতু পুলিশের, সেহেতু তাদের ভূমিকাও পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। জানা দরকার যে নির্বাচনকালীন এবং নির্বাচনোত্তর সময়ে পুলিশের প্রতি কী ধরনের নির্দেশনা ছিল? সংখ্যালঘুদের বসতিগুলোর নিরাপত্তার বিষয়ে কোনো নির্দেশনা না থেকে থাকলে কেন ছিল না? পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীকে মোতায়েনের সময় তাদের অপারেশনাল গাইডলাইন কি দেওয়া হয়েছিল? কে বা কারা এসব নির্দেশনা দিয়েছিলেন? অপারেশনের নিয়ন্ত্রণ কার কাছে ছিল? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, নাকি নির্বাচন কমিশনের কাছে? নাকি পুলিশ নিজেদের মতো স্বাধীনভাবে তা পরিচালনা করেছে? সম্ভাব্য হামলার বিষয়ে গোয়েন্দা তথ্য ছিল কি না? এসব নির্দেশনা নথিভুক্ত থাকার কথা। সেগুলো পর্যালোচনা করলেই জানা সম্ভব যে তাদের প্রতি এমন কোনো নির্দেশনা ছিল কি না যে নির্বাচনবিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সামাল দিতে হবে, অথবা প্রার্থী ও নির্বাচনী কর্মকর্তাদের সুরক্ষা দেওয়াই তাদের প্রধান কাজ। বিরোধী জোটের নির্বাচন বর্জন এবং প্রতিরোধের ঘোষণা আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বাড়তি চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছিল এ কথা সত্য। কিন্তু সেই কারণে সমাজে সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে থাকা জনগোষ্ঠী, যাদের নিরাপত্তার বিষয়ে বিদেশিরাও আগাম সর্তকবার্তা দিয়েছে, তারা কীভাবে উপেক্ষিত হলো তা বোঝা মুশকিল।
৩. এরপর মাঠ প্রশাসনের ভূমিকাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বিশেষ করে যেসব জেলায় লুটপাট, অগ্নিসংযোগ এবং নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। উদাহরণ হিসেবে সাতক্ষীরা, যশোর, গাইবান্ধা, বগুড়া ও রংপুরের কথা বলা যায়, যেসব জেলায় যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর থেকেই জামায়াত-শিবির একধরনের অঘোষিত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিল। নির্বাচনের মতো বড় আয়োজনের প্রাক্কালে জেলা পর্যায়ে একাধিক প্রশাসনিক প্রস্তুতি সভা হয়ে থাকে। সময়ে সময়ে জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটি নামক একটি কমিটিরও সভা হয়ে থাকে। সেসব সভায় সংখ্যালঘুদের ঝুঁকি এবং তাদের নিরাপত্তার বিষয়ে কী আলোচনা হয়েছিল? নাকি তা উপেক্ষিত থেকেছে? কেন্দ্রীয়ভাবে জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে কী ধরনের নির্দেশনা ছিল? এসব নির্দেশনা কোত্থেকে এসেছে? নির্বাচন কমিশন নাকি অন্তর্বর্তী সরকারের মন্ত্রী-উপদেষ্টাদের কাছ থেকে?
৪. নির্বাচনকালীন সরকারের যেসব প্রকাশ্য কার্যকলাপ দৃশ্যমান ছিল, সেগুলো নাটকীয়তায় সরেস হলেও গণতান্ত্রিক রাজনীতির ইতিহাসকে কলুষিত করেছে সন্দেহ নেই। নিরাপত্তা বাহিনী এবং সেনাবাহিনীর হাসপাতাল ব্যবহূত হয়েছে রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের হাতিয়ার হিসেবে। র্যাবের গাড়িতে করে জেনারেল এরশাদকে হাসপাতালে নেওয়ার দৃশ্য দেখে অনেকেই বলতে শুরু করেছিলেন যে কারও হার্ট অ্যাটাক হলে অ্যাম্বুলেন্সের বদলে র্যাবকে ফোন করা উচিত, তাহলেই দ্রুত হাসপাতালে যাওয়া যাবে। নিরাপত্তার নামে বিরোধীদলীয় নেত্রীকে কার্যত গৃহবন্দী করা, হরেদরে বিরোধী রাজনীতিকদের গ্রেপ্তার, এগুলো সামাল দিতে সরকার যতটা তৎপর ছিল, তাতে করে ঝুঁকিতে থাকা সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর দিকে তাদের নজর দেওয়ার সময় কোথায়? সে কারণেই যেসব এলাকায় এসব সহিংসতা হয়েছে, সেসব জায়গার স্থানীয় রাজনীতিক এবং সরকারের পরিকল্পনা কিছু ছিল কি না সেটাও বিশেষভাবে অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। বৈশ্বিক মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলোর উদ্বেগ এবং দাবির মুখে লন্ডনে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম এবং বিএনপির নেতা এম কে আনোয়ার ২০১২ সালের ডিসেম্বরেই অঙ্গীকার করেছিলেন যে ধর্মীয় এবং জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীগুলোর ঝুঁকি মোকাবিলায় তাঁরা একযোগে কাজ করবেন। নির্বাচনকালীন সরকারের ধরন নিয়ে রাজনৈতিক বিরোধের তোড়ে সেই সহযোগিতা ভেসে গেলেও সরকার তার দায়িত্ব এড়াতে পারে না।
নির্বাচনী সহিংসতার ক্ষেত্রে ৫ জানুয়ারির একতরফা এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচন নতুন রেকর্ড করেছে বলে বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে জানা যাচ্ছে। আর এই সহিংসতার একটা বড় ক্ষত বহন করছে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। এ ক্ষেত্রে হতাহত ব্যক্তিদের পরিবার এবং ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি উদ্যোগী হতে পারে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। কমিশনের চেয়ারম্যান ক্ষতিগ্রস্ত কয়েকটি এলাকা পরিদর্শন করে নির্যাতনের শিকার লোকজনের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। নিঃসন্দেহে এটা ভালো উদাহরণ। রাষ্ট্রের অন্তত একটি প্রতিষ্ঠান কিছুটা হলেও নৈতিক দায় স্বীকার করেছে। কিন্তু এটা যথেষ্ট নয়। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের আইনে কমিশনকে যে ক্ষমতা দেওয়া আছে তার সদ্ব্যবহার করে তাদের উচিত হবে অচিরেই একটি ব্যাপকভিত্তিক তদন্ত শুরু করা। সময় চলে গেলে অনেক স্মৃতিই ফিকে হয়ে যাবে, সাক্ষী হারিয়ে যাবেন, সাক্ষ্য-প্রমাণ নষ্ট হবে। আইন তাদের যে ক্ষমতা দিয়েছে, সেই ক্ষমতার বলে নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষের নথিপত্র তলব করার এখতিয়ার মানবাধিকার কমিশনের রয়েছে। সুতরাং, সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে রাষ্ট্র কেন ব্যর্থ হলো, তার কারণ উদ্ঘাটনের জন্য আশা করি কমিশন আরেকটু সাহসী হবে। মাঠ পর্যায়ের অপরাধীদের বিচারের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়দায়িত্ব নির্ধারণে বৃহত্তর তদন্ত ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্যোগের পুনরাবৃত্তি রোধের জন্যই বেশি প্রয়োজন। শুধু ধর্মীয় বা জাতিগত পরিচয়ের কারণে এত বিপুলসংখ্যক মানুষের জীবন, পরিবার এবং সম্পদের ওপর হামলা হবে, রাষ্ট্র নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হবে, অথচ দায়িত্বহীনতার জন্য কারও শাস্তি হবে না—এই বিচারহীনতার সংস্কৃতির অবসান প্রয়োজন।
কামাল আহমেদ: প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি, লন্ডন।
সাংবাদিকদের কলম অথবা ক্যামেরায় দেশের নানা জায়গায় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপর হামলার যেসব চিত্র উঠে এসেছে, তাতে কোথাও তো এসব ক্ষমতাধর রাজনীতিক, আমলা, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার কাউকে নিপীড়িত-নির্যাতিতের পাশে দাঁড়াতে দেখা যায়নি। অথচ, এখন তাঁরাই ডজন ডজন ক্যামেরার সামনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পরিবারগুলোকে সাহায্য দেওয়ার আয়োজন করছেন এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দুষছেন। কয়েক সপ্তাহ ধরে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার বিষয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় বেশ কিছু সরেজমিন প্রতিবেদন দেখছি। আর দেখছি মানববন্ধন, লংমার্চ এবং বক্তৃতা-বিবৃতি, যেগুলোর সবই অঘটনোত্তর প্রতিক্রিয়া।
অনেক দিন থেকেই বাংলাদেশে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর জন্য নির্বাচনকালীন মৌসুম ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাঁদের ওপর হামলার বিষয়টি চরমে পৌঁছায় ২০০১ সালে। এর পর একমাত্র ব্যতিক্রম ২০০৯। এ ধরনের একটি সর্বজনবিদিত ঝুঁকি প্রশাসন, পুলিশ, নির্বাচন কমিশন এবং স্থানীয় রাজনীতিকদের উপেক্ষা করার কারণ নেই। অথচ সে রকমটিই ঘটেছে। কিন্তু সংবাদমাধ্যমে এসব বিষয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তেমন একটা চোখে পড়ছে না। হামলাকারী দুর্বৃত্তদের রাজনৈতিক পরিচয় প্রকাশে প্রয়োজনীয় গুরুত্ব দেওয়া হলেও নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব রাষ্ট্রের যেসব প্রতিষ্ঠানের, তাদের ব্যর্থতা কিংবা গাফিলতি অথবা সম্ভাব্য কোনো রাজনৈতিক দুরভিসন্ধির বিষয়গুলো অনুসন্ধানে কারও কোনো আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না। প্রধান দুই দল বা জোট বিষয়টি নিয়ে রাজনীতি করতে যতটা আগ্রহী, তার কারণ অনুসন্ধান, অপরাধীদের বিচার এবং ভবিষ্যতে তার পুনরাবৃত্তি রোধের শিক্ষা গ্রহণে ততটাই উদাসীন। সুতরাং, এসব হামলার বিষয়ে ইউরোপীয় জনপ্রতিনিধিরা কিংবা বহির্বিশ্ব থেকে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্তের যেসব আহ্বান জানানো হয়েছে, সেগুলো কেউ কানে তুলছেন না। রাজনৈতিক কারণ না থাকলে এ ধরনের তদন্তে সরকারের অনাগ্রহের কোনো কারণ থাকার কথা নয়। নাগরিক গোষ্ঠীগুলোর গণতদন্ত কমিশনের মতো বেসরকারি উদ্যোগ গ্রহণেও তো কোনো বাধা দেখি না।
তদন্তে মাঠপর্যায়ে হামলাগুলোর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার পাশাপাশি বৃহত্তর পরিসরে অন্য যেসব বিষয় নজর দেওয়া প্রয়োজন সেগুলো হলো—নির্বাচন কমিশন, পুলিশ, প্রশাসন, অন্তর্বর্তী সরকার এবং মানবাধিকার কমিশনের মতো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা।
১. নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রশ্নবিদ্ধ। সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন স্পষ্ট করেই বলেছেন যে নির্বাচনকালীন নিরাপত্তার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের, অন্য কারও নয় (‘নির্বাচন কমিশন দায় এড়াতে পারে না’, প্রথম আলো, ১১ জানুয়ারি)। বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার একজন অভিজ্ঞ প্রশাসক। অতীতে সচিবের দায়িত্ব পালনের কারণে বেসামরিক নিরাপত্তা বাহিনীর কাজের ধরন, রীতিনীতি, প্রটোকল তাঁর অজানা থাকার কথা নয়। কমিশনারদের মধ্যে একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তাও আছেন, যাঁর ব্রিগেড পরিচালনার অভিজ্ঞতা রয়েছে। সুতরাং, জাতীয় নির্বাচনের মতো একটা বিশাল আয়োজনের প্রস্তুতি নেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁরা প্রয়োজনীয় অনুশীলন করেননি এমনটা ভাবা দুষ্কর। যেকোনো নির্বাচন আয়োজনের আগে সেই নির্বাচনে সম্ভাব্য ঝুঁকি নির্ধারণের একটি বিষয় থাকে। স্বভাবতই তাই প্রশ্ন উঠছে যে কমিশন কি সেসব ঝুঁকি নির্ধারণ করেছিল, নাকি সেগুলো উপেক্ষা করেছে? নাকি ঝুঁকি নির্ধারণের পর তা মোকাবিলায় পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে? কমিশনের তরফ থেকে সংখ্যালঘুদের বিপদ এবং তা মোকাবিলার বিষয়ে কী ধরনের প্রস্তুতি বা নির্দেশনা ছিল? আর, প্রশাসনের ওপরই বা কমিশন কতটা নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছিল?
২. মাঠপর্যায়ে নিরাপত্তার মূল দায়িত্ব যেহেতু পুলিশের, সেহেতু তাদের ভূমিকাও পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। জানা দরকার যে নির্বাচনকালীন এবং নির্বাচনোত্তর সময়ে পুলিশের প্রতি কী ধরনের নির্দেশনা ছিল? সংখ্যালঘুদের বসতিগুলোর নিরাপত্তার বিষয়ে কোনো নির্দেশনা না থেকে থাকলে কেন ছিল না? পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীকে মোতায়েনের সময় তাদের অপারেশনাল গাইডলাইন কি দেওয়া হয়েছিল? কে বা কারা এসব নির্দেশনা দিয়েছিলেন? অপারেশনের নিয়ন্ত্রণ কার কাছে ছিল? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, নাকি নির্বাচন কমিশনের কাছে? নাকি পুলিশ নিজেদের মতো স্বাধীনভাবে তা পরিচালনা করেছে? সম্ভাব্য হামলার বিষয়ে গোয়েন্দা তথ্য ছিল কি না? এসব নির্দেশনা নথিভুক্ত থাকার কথা। সেগুলো পর্যালোচনা করলেই জানা সম্ভব যে তাদের প্রতি এমন কোনো নির্দেশনা ছিল কি না যে নির্বাচনবিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সামাল দিতে হবে, অথবা প্রার্থী ও নির্বাচনী কর্মকর্তাদের সুরক্ষা দেওয়াই তাদের প্রধান কাজ। বিরোধী জোটের নির্বাচন বর্জন এবং প্রতিরোধের ঘোষণা আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বাড়তি চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছিল এ কথা সত্য। কিন্তু সেই কারণে সমাজে সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে থাকা জনগোষ্ঠী, যাদের নিরাপত্তার বিষয়ে বিদেশিরাও আগাম সর্তকবার্তা দিয়েছে, তারা কীভাবে উপেক্ষিত হলো তা বোঝা মুশকিল।
৩. এরপর মাঠ প্রশাসনের ভূমিকাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বিশেষ করে যেসব জেলায় লুটপাট, অগ্নিসংযোগ এবং নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। উদাহরণ হিসেবে সাতক্ষীরা, যশোর, গাইবান্ধা, বগুড়া ও রংপুরের কথা বলা যায়, যেসব জেলায় যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর থেকেই জামায়াত-শিবির একধরনের অঘোষিত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিল। নির্বাচনের মতো বড় আয়োজনের প্রাক্কালে জেলা পর্যায়ে একাধিক প্রশাসনিক প্রস্তুতি সভা হয়ে থাকে। সময়ে সময়ে জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটি নামক একটি কমিটিরও সভা হয়ে থাকে। সেসব সভায় সংখ্যালঘুদের ঝুঁকি এবং তাদের নিরাপত্তার বিষয়ে কী আলোচনা হয়েছিল? নাকি তা উপেক্ষিত থেকেছে? কেন্দ্রীয়ভাবে জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে কী ধরনের নির্দেশনা ছিল? এসব নির্দেশনা কোত্থেকে এসেছে? নির্বাচন কমিশন নাকি অন্তর্বর্তী সরকারের মন্ত্রী-উপদেষ্টাদের কাছ থেকে?
৪. নির্বাচনকালীন সরকারের যেসব প্রকাশ্য কার্যকলাপ দৃশ্যমান ছিল, সেগুলো নাটকীয়তায় সরেস হলেও গণতান্ত্রিক রাজনীতির ইতিহাসকে কলুষিত করেছে সন্দেহ নেই। নিরাপত্তা বাহিনী এবং সেনাবাহিনীর হাসপাতাল ব্যবহূত হয়েছে রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের হাতিয়ার হিসেবে। র্যাবের গাড়িতে করে জেনারেল এরশাদকে হাসপাতালে নেওয়ার দৃশ্য দেখে অনেকেই বলতে শুরু করেছিলেন যে কারও হার্ট অ্যাটাক হলে অ্যাম্বুলেন্সের বদলে র্যাবকে ফোন করা উচিত, তাহলেই দ্রুত হাসপাতালে যাওয়া যাবে। নিরাপত্তার নামে বিরোধীদলীয় নেত্রীকে কার্যত গৃহবন্দী করা, হরেদরে বিরোধী রাজনীতিকদের গ্রেপ্তার, এগুলো সামাল দিতে সরকার যতটা তৎপর ছিল, তাতে করে ঝুঁকিতে থাকা সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর দিকে তাদের নজর দেওয়ার সময় কোথায়? সে কারণেই যেসব এলাকায় এসব সহিংসতা হয়েছে, সেসব জায়গার স্থানীয় রাজনীতিক এবং সরকারের পরিকল্পনা কিছু ছিল কি না সেটাও বিশেষভাবে অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। বৈশ্বিক মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলোর উদ্বেগ এবং দাবির মুখে লন্ডনে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম এবং বিএনপির নেতা এম কে আনোয়ার ২০১২ সালের ডিসেম্বরেই অঙ্গীকার করেছিলেন যে ধর্মীয় এবং জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীগুলোর ঝুঁকি মোকাবিলায় তাঁরা একযোগে কাজ করবেন। নির্বাচনকালীন সরকারের ধরন নিয়ে রাজনৈতিক বিরোধের তোড়ে সেই সহযোগিতা ভেসে গেলেও সরকার তার দায়িত্ব এড়াতে পারে না।
নির্বাচনী সহিংসতার ক্ষেত্রে ৫ জানুয়ারির একতরফা এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচন নতুন রেকর্ড করেছে বলে বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে জানা যাচ্ছে। আর এই সহিংসতার একটা বড় ক্ষত বহন করছে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। এ ক্ষেত্রে হতাহত ব্যক্তিদের পরিবার এবং ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি উদ্যোগী হতে পারে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। কমিশনের চেয়ারম্যান ক্ষতিগ্রস্ত কয়েকটি এলাকা পরিদর্শন করে নির্যাতনের শিকার লোকজনের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। নিঃসন্দেহে এটা ভালো উদাহরণ। রাষ্ট্রের অন্তত একটি প্রতিষ্ঠান কিছুটা হলেও নৈতিক দায় স্বীকার করেছে। কিন্তু এটা যথেষ্ট নয়। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের আইনে কমিশনকে যে ক্ষমতা দেওয়া আছে তার সদ্ব্যবহার করে তাদের উচিত হবে অচিরেই একটি ব্যাপকভিত্তিক তদন্ত শুরু করা। সময় চলে গেলে অনেক স্মৃতিই ফিকে হয়ে যাবে, সাক্ষী হারিয়ে যাবেন, সাক্ষ্য-প্রমাণ নষ্ট হবে। আইন তাদের যে ক্ষমতা দিয়েছে, সেই ক্ষমতার বলে নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষের নথিপত্র তলব করার এখতিয়ার মানবাধিকার কমিশনের রয়েছে। সুতরাং, সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে রাষ্ট্র কেন ব্যর্থ হলো, তার কারণ উদ্ঘাটনের জন্য আশা করি কমিশন আরেকটু সাহসী হবে। মাঠ পর্যায়ের অপরাধীদের বিচারের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়দায়িত্ব নির্ধারণে বৃহত্তর তদন্ত ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্যোগের পুনরাবৃত্তি রোধের জন্যই বেশি প্রয়োজন। শুধু ধর্মীয় বা জাতিগত পরিচয়ের কারণে এত বিপুলসংখ্যক মানুষের জীবন, পরিবার এবং সম্পদের ওপর হামলা হবে, রাষ্ট্র নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হবে, অথচ দায়িত্বহীনতার জন্য কারও শাস্তি হবে না—এই বিচারহীনতার সংস্কৃতির অবসান প্রয়োজন।
কামাল আহমেদ: প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি, লন্ডন।
0 comments:
Post a Comment