নির্বাচন কমিশনকে জবাবদিহি করতে হবে- পুরোনো নির্বাচনী সংস্কৃতি

Thursday, March 27, 2014

যেমন আশঙ্কা করা হয়েছিল, তেমনটিই হয়েছে উপজেলা নির্বাচনের চতুর্থ দফায়। প্রথম দফা নির্বাচনের তুলনায় সংঘাত-সহিংসতা, কারচুপির অভিযোগ ও ভোটকেন্দ্র দখল—সবই ধারাবাহিকভাবে বেড়ে চলেছে পরবর্তী প্রতি দফায়। চতুর্থ দফায় তো তা রীতিমতো ‘কেন্দ্র দখলের’ নির্বাচনে পরিণত হয়েছে। অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের যে ধারা বাংলাদেশে সূচনা হয়েছিল, তা সম্ভবত এবারের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আরও মুমূর্ষু হয়ে পড়ল।

চতুর্থ দফার নির্বাচনে ভোট হয়েছে ৯১টি উপজেলায়। এর মধ্যে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ৪০টি উপজেলায়। মারা গেছেন চারজন। সিল মেরে ভোটের বাক্স ভরা, নির্বাচনী সরঞ্জাম ছিনতাই ও আগুন দেওয়া, এজেন্টদের বের করে দেওয়া, ভোটকেন্দ্র দখল—যে বিষয়গুলো আমাদের নির্বাচনী সংস্কৃতি থেকে বিদায় নিয়েছে বলে আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করেছিলাম, তার সবকিছুরই পুনরাবির্ভাব ঘটল চতুর্থ দফা নির্বাচনে। এবারের উপজেলা নির্বাচনের এটাই সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি (?)! এর কৃতিত্ব (?) নির্বাচন কমিশনকে দিতেই হচ্ছে!
কোনো ধরনের নির্বাচনী সহিংসতা, প্রাণহানি, ভোটকেন্দ্র দখল বা কারচুপির অভিযোগ ছাড়াই অসংখ্য নির্বাচনের অভিজ্ঞতা দেশে রয়েছে। গত নির্বাচন কমিশন এর সূচনা করে নির্বাচনী সংস্কৃতিতে এই মৌলিক পরিবর্তনটি আনতে সক্ষম হয়েছিল। বর্তমান নির্বাচন কমিশনও শুরুতে তা বজায় রাখতে পেরেছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, ২০০৬ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত এ ধরনের নির্বাচন সম্ভব হলে বর্তমানে তা সম্ভব হচ্ছে না কেন? এই সময়কালে নির্দলীয় বা তত্ত্বাবধায়ক ধরনের সরকার যেমন ক্ষমতায় ছিল, তেমনি দলীয় সরকারও ক্ষমতায় ছিল। এখন পরিস্থিতি পাল্টাল কেন?
বাংলাদেশে নির্বাচনে পুরোনো সংস্কৃতি ফিরে আসার দায় প্রথমত নির্বাচন কমিশনের। প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা আগের চেয়ে শান্তিপূর্ণ ভোট হয়েছে বলে দাবি করেছেন। তাঁর এই দাবির সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল নেই। ভোট যদি শান্তিপূর্ণই হবে প্রাণঘাতী সংঘর্ষ ও ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটল কেন? এ রকম ‘শান্তিপূর্ণ’ ভোট কারোরই কাম্য নয়। নির্বাচনের সময় প্রশাসন নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী চলতে বাধ্য। তারা যদি প্রশাসনকে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের কাজে ব্যবহার করতে না পারে, সেটা তাদেরই ব্যর্থতা।
এটা ঠিক যে এবারের উপজেলা নির্বাচনে সরকারি দল ও তাদের সমর্থকদের শক্তি প্রয়োগের বিষয়টি ক্রমাগত স্পষ্ট হয়ে উঠছে। কিন্তু আমরা মনে করি যে একটি স্বাধীন ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশন দৃঢ় অবস্থান নিতে পারলে সরকার বা সরকারি দল বড় বাধা হয়ে উঠতে পারে না। নির্বাচনে কেন সহিংসতা ও কারচুপি ফিরে আসছে, কেন আগাম আশঙ্কা সত্ত্বেও এসব ঠেকানো যাচ্ছে না, তার ব্যাখ্যা নির্বাচন কমিশনকে দিতে হবে। যদি সরকারের অসহযোগিতার কারণে তা হয়ে থাকে, তবে সেটাও নির্বাচন কমিশনকে স্পষ্ট করে বলতে হবে। এটা না করতে পারলে ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন’ বর্তমানে যে মুমূর্ষু দশার মধ্যে রয়েছে, সেটিকে আর বাঁচানো যাবে না।

উপজেলা নির্বাচন- প্রথম ধাপ: একটি সমীক্ষা by এম সাখাওয়াত হোসেন

Monday, February 24, 2014

গত ১৯ ফেব্রুয়ারি চতুর্থ উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ধাপের ৯৭টির মধ্যে ৯৬টির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তিনটি উপজেলায় বিএনপিসহ আওয়ামী লীগের তথাকথিত বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিভিন্ন কারণে ভোট গ্রহণের দুই ঘণ্টার মধ্যে কারচুপির অজুহাতে নির্বাচন বর্জন করা এবং কয়েকটি কেন্দ্রে অনিয়মের অভিযোগ ছাড়া প্রথম ধাপের নির্বাচন মোটামুটি শান্তিপূর্ণ হয়েছে।
আলোচিত নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে ইতিমধ্যেই নানা তথ্য বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম ধাপের নির্বাচন ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত তৃতীয় উপজেলা নির্বাচনে একই উপজেলার নির্বাচনী ফলাফলের সঙ্গে তুলনা করলে কয়েকটি বিষয় ধর্তব্যের মধ্যে পড়বে। প্রথমত, নানা ধরনের প্রতিকূলতা এবং পরবর্তী সময়ে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনকারী দল বিএনপি এবং এর প্রধান সহযোগী দলের চমকপ্রদ উত্থান। দ্বিতীয়ত, মামলাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা, নেতাদের ব্যাপক গ্রেপ্তার, যুদ্ধাপরাধের দায়ে শীর্ষস্থানীয় নেতাদের দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়া এবং ব্যাপক নেতিবাচক প্রচার সত্ত্বেও জামায়াতে ইসলামীর আশ্চর্যজনক প্রাপ্তি। তৃতীয়ত, এযাবৎ বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম দল জাতীয় পার্টির তৃণমূল পর্যায়ে প্রায় নিশ্চিহ্ন হওয়ার উপক্রম। চতুর্থত, মহাজোটের অন্যান্য শরিক দলে জামানত হারানোর মতো পরিস্থিতি এবং আশাতীত ভোটার সমাগম না হওয়া।

প্রথম ধাপের ভোট এবং ফলাফলের পর এসব বিষয়ে কিছু বিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে। তবে পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন করতে হলে ঘোষিত ৪৪৬টি উপজেলার ভোট গ্রহণের পর ফলাফল প্রকাশ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তথাপি প্রথম ধাপের নির্বাচনে যে গতিধারা দৃশ্যমান হয়েছে, তা শেষ পর্যন্ত বজায় থাকাটাই স্বাভাবিক। অন্যথায় নতুনভাবে বিশ্লেষণ হবে ব্যতিক্রম গতিধারা নিয়ে।
বিএনপি দল হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর থেকে তিন দশকের মধ্যে এমন সাংগঠনিক সংকটে পড়েনি। সাংগঠনিক সংকটই নয়, নেতাদের ব্যাপক ধরপাকড় ও মামলা ইত্যাদির কারণে কেন্দ্রে এবং তৃণমূল পর্যায়ে প্রায় নেতৃত্বশূন্য অবস্থায় রয়েছে। উপজেলা থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত বহু নেতা-কর্মী গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে আত্মগোপনে ছিলেন এবং রয়েছেন। তদুপরি ৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায়, সূত্রমতে, তৃণমূল পর্যায়ে হতাশা রয়েছে বলে প্রচারিত। এমতাবস্থায় অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে ওই দলের উল্লেখযোগ্য হারে শীর্ষে এগিয়ে থাকার বহুবিধ কারণ রয়েছে। এর মূলে রয়েছে সরকারি দলের অব্যাহত জনসমর্থন হ্রাস। যদিও বিভিন্ন জরিপে এ ধরনের তথ্য ইতিপূর্বে প্রকাশিত হলেও ধারাবাহিকভাবে সরকারে অধিষ্ঠিত দল বা জোট এসব ফলাফল ধর্তব্যের মধ্য না নিয়ে একধরনের আত্মপ্রবঞ্চনায় লিপ্ত ছিল। মূল কারণ খতিয়ে না দেখে তাৎক্ষণিক প্রত্যাখ্যান জনমনে আস্থা ফেরাতে পারেনি। সরকারি দল বা জোট দেয়াললিখন পড়লেও তা বিশ্বাস না করার প্রবণতায় রত ছিল।
বিএনপির এগিয়ে থাকার আরেকটি কারণ, সিংহভাগ সময় অনবরত সরকারি দল এবং দলের সমর্থকদের তৎকালীন বিরোধী দলের বিরুদ্ধে কারণে-অকারণে নানা ধরনের অপ্রিয় বক্তব্য, ব্যক্তিগত আক্রমণ এবং অনেক ভিত্তিহীন অভিযোগ উত্থাপনে জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে।
প্রথম ধাপের নির্বাচনে ভোটের যে প্রতিফলন ঘটেছে, তার বেশির ভাগ সরকারি জোটের নেতিবাচক ভোটের সংখ্যাই বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীদের বাক্সে জমা পড়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ৫ জানুয়ারির ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হওয়া এবং পরে সামগ্রিক নির্বাচন চিত্র, যেখানে প্রায় সাত কোটি ভোটার ভোট দিতে পারেননি, তার মর্মব্যথা। এ বিষয়টি হালকাভাবে দেখার উপায় নেই। ভোটারদের মনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করতে পারার যে হতাশা ছিল, তাও প্রতীয়মান হয়েছে প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচনের মাধ্যমে। বিভিন্ন জরিপে তথ্য ছিল যে, এ দেশের সিংহভাগ ভোটার একটি নিরপেক্ষ ব্যবস্থায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পক্ষে ছিল।
প্রথম ধাপের নির্বাচনে চারটি দলের সমর্থকদের মধ্যেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে, যদিও উভয় দল ঘোষিত তথাকথিত কিছু কিছু বিদ্রোহী প্রার্থীরও উপস্থিতি ছিল। চারটি দলের মধ্যে জাতীয় পার্টি না থাকার মতো, সরকারের শরিক আর কোনো দলের অস্তিত্বই ছিল না। অথচ বেশ কিছু দলের মন্ত্রীরা রয়েছেন এবং ছিলেন অতীত ও বর্তমান সরকারের মন্ত্রিসভায়। বড় দলের ছত্রচ্ছায়ায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হলেও তৃণমূল পর্যায়ে এসব দল মোটেও বিকশিত হতে পারেনি। লক্ষণীয় যে, এসব দলের বিচরণ বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বহু দশকের। প্রাক্-নির্বাচনী জোটবদ্ধ হওয়া এবং নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রেখে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার কারণে এসব দল তৃণমূল পর্যায়ে সংগঠিত হতে পারেনি বলে বিশ্বাস। বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য এমতাবস্থা কোনোভাবেই সহায়ক নয়।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো নীতিগতভাবে নির্দলীয় নির্বাচন হওয়ার কথা, তবে রাজনীতিবিবর্জিত নয়। হালে নির্বাচনগুলোকে অধিক রাজনৈতিকীকরণ করার ফলে দলের প্রত্যক্ষ মনোনয়ন প্রদান, মনোনয়নের বাইরের প্রার্থীদের ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী আখ্যায়িত করার কারণে এসব নির্বাচন কার্যত দলীয় রূপ ধারণ করেছে। বিগত কয়েকটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন থেকে এ ধরনের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব নির্বাচন উন্মুক্ত এবং স্থানীয় পর্যায়ের প্রার্থীকে ঘিরেই অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। ভোটারদের ধর্তব্যের মধ্যে স্থানীয় পর্যায়ের প্রার্থীর পরিচয় এবং স্থানীয় চাওয়া-পাওয়ার ওপর ভিত্তি করে প্রার্থী নির্বাচিত হয়ে থাকেন। উপজেলা নির্বাচনের এই পর্যায়ে এমনটি থাকেনি। ভবিষ্যতেও এমনটি হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এ ধরনের অলিখিত ব্যবস্থার ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দিক রয়েছে। এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট নেতিবাচক দিকই প্রতীয়মান হয়েছে। উপরিউক্ত বাস্তবতার আঙ্গিকে বিশ্লেষণে দেখা যায়, এবারের নির্বাচনে দলের প্রভাবের কারণে একদিকে যেমন স্থানীয়ভাবে বহু জনপ্রিয় দলীয় ব্যক্তিরা বিভিন্ন স্তরের পৃষ্ঠপোষকতা না পাওয়ার কারণে প্রার্থী হতে পারেননি, তেমনি দলের নির্দেশনাও অনেকেই ধর্তব্যের মধ্যে আনেননি। এ কারণেই স্থানীয় প্রভাবের চেয়ে জাতীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক প্রভাবে নির্বাচন আচ্ছন্ন ছিল। তদুপরি ছিল ক্ষমতাসীনদের স্থানীয় পর্যায়ের নিজস্ব বলয় তৈরি করার অতি উৎসাহ। এসব কারণে বিএনপি বা জামায়াতে ইসলামীর চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। বাকি নির্বাচনগুলোতে হয়তো একই ধারা বজায় থাকবে।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, প্রথম ধাপের নির্বাচনে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও জামায়াতে ইসলামীর কল্পনাতীত সাফল্য। জামায়াত ১৩টি চেয়ারম্যান, ২৪টি পুরুষ এবং ১০টি মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানের পদে বিজয়ী হতে সক্ষম হয়েছে। চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান পদগুলো যে শুধু জামায়াত প্রভাবিত অঞ্চলেই হয়েছে, তেমনটি নয়। এ সত্য ভাইস চেয়ারম্যান পদের বিশ্লেষণ করলেই দৃশ্যমান হবে। বিএনপি প্রভাবিত কয়েকটি উপজেলায় জামায়াতের প্রার্থী বিএনপির প্রার্থীদের পরাজিত করে জয়ী হয়েছেন। প্রসঙ্গত, বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য থেকে পাওয়া যায়, ২০০৯ সালে বর্তমানের প্রথম ধাপের নির্বাচনের উপজেলাগুলোতে জামায়াত মাত্র ছয়টিতে চেয়ারম্যান পদে জয়ী হয়েছিল। এবার তার দ্বিগুণ স্থানে জয়ী হয়েছে। বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশ, জামায়াত-সমর্থিত প্রার্থীদের নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে কোনো বিতর্ক ছিল না। ছিল না কোনো ধরনের সাধারণ অথবা আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ। অনেকে মনে করেন, জামায়াতের প্রার্থীরা গ্রামাঞ্চলের সাধারণ ভোটারদের সহানুভূতিও পেয়েছেন। অবশ্যই ধর্মীয় অনুভূতিও এ ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছে বলে বিশ্বাস। যা হোক, জামায়াতের পুনরুজ্জীবিত হওয়ার বিষয়টি আরও গভীর বিশ্লেষণের দাবি রাখে। তবে এ ধারা ভবিষ্যতে বজায় থাকে কি না, তা হবে লক্ষণীয় বিষয়।
এই নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বর্তমানে সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। তৃতীয় বৃহৎ দল বলে পরিচিত পার্টিটি প্রায় নিশ্চিহ্ন হওয়ার পর্যায়ে। বিগত ২০০৯ সালের নির্বাচনেও এমনটি হয়নি। এই দলের ওপর অবশ্যই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে এবং পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের জের যে পড়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বর্তমানে জাতীয় পার্টির দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের অবস্থান পরিষ্কার নয়। সরকারেও যোগ দিয়েছে, আবার বিরোধী দল হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত থাকার প্রয়াস জনমনে আস্থার অভাব ঘটিয়েছে। তদুপরি জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব নিয়েও রয়েছে ধোঁয়াশা। এরশাদ জাতীয় পার্টির মূল চালিকাশক্তি থেকে বিচ্যুৎ অবস্থায় রয়েছেন। অপরদিকে রওশন এরশাদের নেতৃত্ব নিয়ে পার্টির অভ্যন্তরে রয়েছে দ্ব্যর্থকতা। জাতীয় পার্টি থেকে বহুদিনের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য বর্ষীয়ান নেতা এবং জাতীয় পার্টির শাসনকালের প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর সদলবলে এরশাদকে পরিত্যাগ করায় জাতীয় পার্টির যে ক্ষতি হয়েছে, তার নেতিবাচক প্রভাবও যোগ হয়েছে তৃণমূল পর্যায়ের সমর্থনে। সংক্ষেপে বলা যায় যে এরশাদবিহীন জাতীয় পার্টির সমর্থন এবং জাতীয় পর্যায়ে পার্টির অবস্থান আগের অবস্থানে নেই। ভবিষ্যতে জাতীয় পার্টির অস্তিত্বই সংকটের মুখে পড়তে পারে।
যেমনটা আগেই বলেছি, স্থানীয় সরকার নির্বাচন নীতিগতভাবে নির্দলীয় হওয়ার কথা থাকলেও সে আবরণ আর থাকছে না। কারণ, সব দলের এই আবরণ অপসারণের কারণে। যেহেতু জাতীয় পর্যায়ে আমাদের দেশের রাজনীতি অতিরিক্ত মাত্রায় সাংঘর্ষিক হয়ে উঠেছে, মূলত সে কারণে স্থানীয় নির্বাচনকে বিভিন্ন দল জাতীয় পর্যায়ে দলের অবস্থানের মাপকাঠি হিসেবে দেখার প্রবণতা ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়েছে। এমতাবস্থায় স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে জাতীয় পর্যায়ের নীতি এবং অবস্থানের প্রতিফলন ঘটছে। এসব কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দলের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ও সংগঠন। কোন্দল মাথাচাড়া দিচ্ছে তৃণমূল পর্যায়ে। স্থানীয় সমস্যাগুলো ধামাচাপা পড়ছে। এমতাবস্থায় দল এবং প্রার্থীর অবস্থান নিয়েও ভোটাদের বিভ্রান্তির মধ্য পড়তে হচ্ছে।
ধারণা করা হয়েছিল যে ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদে সিংহভাগ ভোটার ভোট প্রয়োগে বঞ্চিত হওয়ার কারণে ভোটের হার বেশি হবে, তেমনটি হয়নি। ইডব্লিউজি-১-এর মতে, মাত্র ৫৯ শতাংশ ভোট প্রদান করা হয়েছে, যা তৃতীয় উপজেলা নির্বাচন থেকেও অনেক কম। নিম্নগামী ভোটের হারের দুটি প্রধান কারণ হতে পারে; প্রথমত, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালের রাজনৈতিক পরিস্থিতির জের এখনো কাটেনি, যার পরিপ্রেক্ষিতে জনমনে বিরূপ ভাব বিদ্যমান ছিল। হয়তো ভবিষ্যতে এই হারের বৃদ্ধি হতে পারে। দ্বিতীয়ত, বিগত সময়ে বিভিন্ন কারণে উপজেলা পরিষদ জনগণের কাছে তেমন আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে পারেনি। অনুমেয় যে, এই দুই প্রধান কারণেই ভোটের হার আশাতীত হয়নি।
পরিশেষে উপরিউক্ত পর্যালোচনা আংশিক নির্বাচনের ওপর ভিত্তি করে হলেও ভবিষ্যতে পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ উপজেলা নির্বাচন সমাপ্ত হওয়ার পরে আরও অর্থবহ হবে। অপেক্ষা করতে হবে পূর্ণাঙ্গ নির্বাচনের। দৃশ্যপটের পরিবর্তন হতে পারে।


এম সাখাওয়াত হোসেন: সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক।
hhintlbd@yahoo.com

ভোটাররা সিদ্ধান্তে অনড় by সাজেদুল হক

Friday, February 21, 2014

তারা ছিলেন একদিনের বাদশা। পাঁচ বছরে একবার ব্যালটের মাধ্যমে জানান দিতেন নিজেদের ক্ষমতার। ৫ই জানুয়ারি তাদের কাছ থেকে সে ক্ষমতাও কেড়ে নেয়া হয়।
দেশের মালিকরা দেখলেন তাদের কোন কিছু জিজ্ঞেস না করেই সরকার গঠন হয়ে গেছে। তবে আবারও সুযোগ পেয়ে নিজেদের ক্ষমতার জানান দিলেন অসহায় জনগণ। যদিও এক সহযোগী দৈনিকের ভাষায়, এই হলো দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো। ক্ষমতার কেন্দ্রে এ নির্বাচন কোন পরিবর্তনই আনবে না। তবুও আপাত অসহায়, পর্যুদস্তু ভোটাররা প্রমাণ করলেন, তারা নিজ সিদ্ধান্তে অনড় রয়েছেন। দশম সংসদ নির্বাচনের পর যে বিএনপি-জামায়াত জোটকে রাজনীতি থেকে আউট মনে হচ্ছিল উপজেলা নির্বাচনের প্রথম পর্বে সে জোটই সংখ্যাগরিষ্ঠ উপজেলায় জয়ী হয়েছে। প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা যাচ্ছে- বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা ৪২, আওয়ামী লীগ সমর্থিতরা ৩৪, জামায়াত সমর্থকরা ১২, জাতীয় পার্টি সমর্থকরা একটি উপজেলায় জয়ী হয়েছেন। এতে দেখা যাচ্ছে, বিএনপি-জামায়াত জোট একসঙ্গে ৫৪টি উপজেলায় জয়ী হয়েছে। উপজেলা নির্বাচন একটি বার্তা পরিষ্কার করেছে, সংসদে প্রতিনিধিত্ব না থাকা বিএনপিই এখন তৃণমূলে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় দল। ৫ সিটি করপোরেশনের পর ৪০টি জেলার ৯৭টি উপজেলা নির্বাচনেও এটা প্রমাণ হয়েছে সুযোগ পেলে মানুষ বিএনপিকেই ভোট দেবে। বৃহস্পতিবারের নির্বাচনে কমপক্ষে ১০টি জেলায় আওয়ামী লীগ প্রভাব বিস্তার করেছে। নির্বাচনে সরকারি দলের সরকারি ক্ষমতা ব্যবহারের বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে আবারও। জাল ভোট, অস্ত্রবাজি আর কেন্দ্র দখলের ঘটনাও ঘটে। এ কারণে নয়টি উপজেলায় বিএনপি সমর্থক প্রার্থীরা নির্বাচন বর্জন করেন। শক্তির প্রদর্শনীর ঘটনা না ঘটলে বিএনপি আরও বেশি উপজেলায় জয়ী হতেন বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকরা। শত বাধা-বিপত্তির মধ্যেও এ বিজয় বিএনপির রাজনীতির জন্য অক্সিজেন নিয়ে আসবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সব সময়ই তৃণমূলে সবচেয়ে শক্তিশালী দল হিসেবে পরিচিত আওয়ামী লীগ। তৃণমূলই ছিল দলটির সবচেয়ে বড় ভরসা। কিন্তু একের পর এক স্থানীয় নির্বাচনে পরাজয় প্রমাণ করে সে ভরসা নড়বড়ে হয়ে এসেছে অনেকখানি। বৃহস্পতিবারের উপজেলা নির্বাচনে ৯৭টি উপজেলার মধ্যে আওয়ামী লীগ ৩৪টিতে জয় পেলেও ২০০৯ সালের এসব উপজেলার নির্বাচনে প্রায় দ্বিগুণ আসনে জয়ী হয়েছিল আওয়ামী লীগ। এবারের উপজেলা নির্বাচন সবচেয়ে বিস্ময় নিয়ে এসেছে জামায়াতের জন্য। এ দলের ১২ জন প্রার্থী চেয়ারম্যান পদে জয়ী হয়েছেন, যা বিস্ময়করই বটে। কারণ যুদ্ধাপরাধের বিচার আর সহিংসতাকে ঘিরে দলটি পুরোমাত্রায় কোণঠাসা। সংসদ নির্বাচনের রাজনীতিতে নিষিদ্ধ দলটির নেতারা প্রায় সবাই পলাতক। এ অবস্থাতেও তারা জয়ী হয়েছেন, যে জয় রাজনীতির মাঠে তাদের ফেরার উপকরণ হিসেবে দেখা দিতে পারে। আর তৃণমূলের রাজনীতিতে জামায়াত যে ক্রমেই প্রবেশ করছে এ ফল তারই প্রমাণ। অন্যদিকে, এ নির্বাচন মৃত্যু বার্তা নিয়ে এসেছে জাতীয় পার্টির জন্য। সংসদে কথিত প্রধান বিরোধী দল উপজেলা নির্বাচনে মাত্র একটি উপজেলায় জয়ী হয়েছে। অথচ যেসব উপজেলায় নির্বাচন হয়েছে এসব এলাকায় একসময় জাতীয় পার্টির জনপ্রিয়তা ছিল। সংসদ নির্বাচনে প্রভাবশালী দল হিসেবে আবির্ভূত ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, তরিকত ফেডারেশন উপজেলা নির্বাচনে কোথাও জয়ী হয়নি। এতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করে তোলে। প্রায় তিন মাস আগে আপলোড করা আল-কায়েদা নেতা আল-জাওয়াহিরির একটি কথিত অডিও বার্তা বাংলাদেশে আলোচনায় আসে উপজেলা নির্বাচনের আগে। ওই বার্তায় বাংলাদেশীদের জিহাদে যোগ দেয়ার ডাক দেন তিনি। এ বার্তা নিয়ে আলোচনার ঝড় তোলেন ক্ষমতাসীনরা। নির্বাচনের আগে আবার ফিরে আসে জঙ্গি কার্ড। তবে এ কার্ড কোন সফলতা নিয়ে আসেনি। বরং বুমেরাংই হয়েছে। সরব না থাকলেও হেফাজত সমর্থকরা নীরবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। উপজেলা নির্বাচনের ফল কমপক্ষে দু’টি জরিপকে মিথ্যা প্রমাণ করেছে। যদিও এর ভিন্ন ব্যাখ্যাও দেয়া সম্ভব। দশম সংসদ নির্বাচনের আগে বাংলাদেশে প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টারের দু’টি জরিপে পরিষ্কার করে নির্বাচনে বিএনপির বিপুল জয়ের কথা বলা হয়েছিল। তবে ওই নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। নির্বাচনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল (ডিআই)-এর এক জরিপে বলা হয়, এখন ভোট হলে আওয়ামী লীগের জয়ের সম্ভাবনা বেশি। যদিও এ জরিপে প্রায় ১৪ ভাগ উত্তরদাতা কাকে ভোট দেবেন তা জানাতে অস্বীকৃতি জানান। তারাই নির্বাচনে তুরুপের তাস হবেন বলে মানবজমিনে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছিল। উপজেলা নির্বাচন তার সত্যতা প্রমাণ করে। দৈনিক ঢাকা ট্রিবিউনের জরিপেও এখন নির্বাচন হলে কম ব্যবধানে আওয়ামী লীগের জয়ী হওয়ার কথা বলা হয়েছিল। এখানেও ১৪ দশমিক ৫ ভাগ উত্তরদাতা বলেন, তারা এখনও সিদ্ধান্ত নেননি কাকে ভোট দেবেন। মূলত এ ভাসমান ভোটাররাই বাংলাদেশের নির্বাচনের ফল নির্ধারণ করে থাকেন। বহু মতের ভীতিহীন চর্চাই গণতন্ত্র। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেমস বুকাননের ভাষায়, মুক্ত মানুষের মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তির সবচেয়ে ভাল মাধ্যম ব্যালট। বাংলাদেশে ব্যালটের পরিবর্তে চলছে নির্মূলের রাজনীতি। কিন্তু উপজেলা নির্বাচন এ বার্তাই দিয়ে গেল আপনি চাইলেও ভিন্নমতকে গণতন্ত্রের ক্লাব থেকে মাইনাস করতে পারবেন না।

স্থানীয় সরকার- উপজেলা নির্বাচন ও ইসির করণীয় by তোফায়েল আহমেদ

Wednesday, February 19, 2014

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের নির্দেশনা (ধারা ৫৯) অনুযায়ী অত্যন্ত প্রাচীন ও কার্যকর ‘প্রশাসনিক একক’ হিসেবে উপজেলা পর্যায়ে নির্বাচিত স্থানীয় সরকার গঠন ও কার্যকর করা একটি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। এ বাধ্যবাধকতা জেলা ও বিভাগের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

চতুর্থ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অনেকটা মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির মতো। দাবি করার আগেই তফসিল ঘোষণা। এখনো জাতীয় রাজনীতির বেদনাদায়ক স্মৃতি সবাইকে তাড়িত করছে। বিশেষ করে, ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকেন্দ্রিক নানামুখী সহিংসতায় চাপা পড়ে আছে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর বিতর্কিত অনেক বিষয়। অতীতে সব সামরিক শাসক ‘বিরাজনীতিকরণ’-এর অন্যতম কৌশল হিসেবে স্থানীয় নির্বাচনকে ব্যবহার করেছেন এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাঁরা সাময়িকভাবে মুখ রক্ষার মতো সফলতাও পেয়েছেন। স্থানীয় নির্বাচনের টোপ দিয়ে রাজনৈতিক উত্তাপ-উত্তেজনা প্রশমনের সাময়িক দম নেওয়ার ফুরসত সৃষ্টি করেছেন। জেনারেল আইয়ুব, জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদ—সবাই একই কৌশল ভিন্ন ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত থেকে প্রয়োগ করেছেন।

এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলীয় সরকারগুলো কিছুটা ব্যতিক্রম। স্থানীয় সরকারকে নিয়ে তাদের রাজনীতির কৌশলটা কখনোই ‘বুদ্ধিদীপ্তভাবে রাজনৈতিক’  ছিল না। এবারেই প্রথমবারের মতো ক্ষমতাসীনেরা জাতীয় রাজনীতির দাবার ছকে স্থানীয় সরকারের একটি বাস্তব অবস্থান দেখতে পেয়েছেন। ক্ষমতাসীন মহাজোট দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে নির্বাচন বর্জনকারী অপর জোটের রাজনীতি মোকাবিলায় এবারের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনকে কৌশলগত অস্ত্র হিসেবে প্রয়োগ করেছে। তবে নিউটনের তৃতীয় সূত্র অনুসারে ‘সকল ক্রিয়ার সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়ার’ তত্ত্বটি বোধ হয় এখানেও প্রযোজ্য। বিরোধী জোটও পাল্টা কৌশল হিসেবেই এ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। এতে এক-দেড় মাস আগের অংশগ্রহণবিহীন যে নির্বাচনী চিত্র, তা পুরোপুরি বদলে গিয়ে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এখন সরকার ও নির্বাচন কমিশন আন্তরিকতা ও দক্ষতার সঙ্গে বিষয়টি গ্রহণ করলে শান্তিপূর্ণ, অবাধ ও সুষ্ঠু স্থানীয় নির্বাচনের সম্ভাবনা উজ্জ্বল।

এ নির্বাচনের ইতিবাচকতা: এ নির্বাচন একদিকে জাতীয় রাজনীতির একটি টার্নিং পয়েন্ট হতে পারে। প্রথমত, সব দলের অংশগ্রহণে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। নির্বাচনের ফলাফল, ভোটের হার ও প্রার্থীসংখ্যার বিচারে এ নির্বাচন রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ নিয়ে আসতে পারে। অন্যদিকে উপজেলা পরিষদের ধারাবাহিকতা এ নির্বাচনের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত পর পর দুবার উপজেলা পরিষদ মেয়াদ পূর্ণ করতে পারলে এ পরিষদের কার্যক্রমে স্থিতিশীলতা আসবে। ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতার বাইরের সব দলের স্থানীয় নেতৃত্বে সাংগঠনিকভাবে নিজেদের সংহত করার সুযোগ নিচ্ছে, পাচ্ছে এবং এ প্রতিষ্ঠানের ধারাবাহিকতা জাতীয় রাজনীতিতেও গুণগত পরিবর্তনের সুযোগ সৃষ্টি করবে। এ গুণগত পরিবর্তনের প্রধান দিক হবে উপজেলা পরিষদের নির্বাচন এবং এ পরিষদের ধারাবাহিকতা রাজনীতিতে নতুন প্রজন্মের প্রশিক্ষিত নেতৃত্ব সৃষ্টিতে অবদান রাখবে। সে হিসাবে জাতীয় নেতৃত্বকাঠামোয় ইতিবাচক ও গঠনমূলক নেতৃত্বের বিকাশ সম্ভব হবে। ঢাকামুখী ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব তৃণমূল থেকে নানামুখী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে।

গ্রামগঞ্জে জোটের বাতাস এখন প্রবল। প্রার্থী-সমর্থকদের উৎসাহ বিপুল। সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করা গেলে এ নির্বাচনে নির্বাচকমণ্ডলীর অংশগ্রহণ ৭০ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে। তবে ইতিমধ্যে বিরোধী দলগুলো গুম, খুন, ধরপাকড়ের অভিযোগ করেছে। সে বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে সরব ও সক্রিয় ভূমিকায় দেখতে চাইবে সবাই।

নির্বাচন কমিশন ও সরকার: ৪৮৭টি উপজেলার তিনটি পদের নির্বাচন পাঁচ-ছয় ধাপে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। প্রথম ধাপে ৯৭টি উপজেলায় ১৯ ফেব্রুয়ারি, একটি উপজেলায় ২৪ ফেব্রুয়ারি; দ্বিতীয় ধাপে ১১৭টি উপজেলায় ২৭ ফেব্রুয়ারি, তৃতীয় ধাপে ৮৩টি উপজেলায় ১৫ মার্চ এবং চতুর্থ ধাপে ৯২টি আসনে ২৩ মার্চ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। পরবর্তী সময়ে আরও দুই ধাপে মে মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে সব উপজেলার নির্বাচন সম্পন্ন হবে। একাধিক ধাপে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সরকারের নির্বাহী বিভাগ এবং বিচার বিভাগের জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ওপর চাপটা সহনীয় পর্যায়ে থাকবে। তাই আশা করা যায়, আচরণবিধি মেনে চলা এবং আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার ঝুঁকি কম। তবে সর্বোচ্চ সতর্কতার বিকল্প নেই। আশা করি, সরকার ও নির্বাচন কমিশন এ বিষয়ে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের করণীয় সম্পর্কে জাতি এখনো সন্দেহমুক্ত হতে পারছে না। নিচের কয়েকটি বিষয়ে তাদের আশু দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়।

১. সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ নিরপেক্ষ করার জন্য এ পর্যন্ত নেওয়া পদক্ষেপগুলো নিয়ে কমিশন সরব ও সক্রিয় নয়। তাদের নেওয়া পদক্ষেপগুলোর ওপর প্রচার-প্রচারণা, ক্যাম্পেইন ইত্যাদি চোখে পড়ছে না, যা তাদের করা উচিত।

২. নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য প্রতিটি উপজেলায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে একাধিক প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিল করলেও একক প্রার্থী নির্ধারণের জন্য রাজনৈতিক দল থেকে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের জন্য কোনো কোনো প্রার্থীকে চাপ দেওয়া হচ্ছে। বিষয়টি নির্বাচনকে প্রভাবিত করার শামিল, যা সুস্পষ্টভাবে নির্বাচনী আচরণবিধির লঙ্ঘন। আইন পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনকে নির্দলীয়ভাবে অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশন উদ্যোগী হচ্ছে না।

৩. মন্ত্রী, সাংসদেরা নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিলে সেটি আচরণবিধির লঙ্ঘন কি না, সে বিষয়েও বক্তব্য নেই। কারণ, তাঁরা ‘প্রটোকল’ নিয়ে ওসি, ইউএনওসহ বিভিন্ন স্থানে অবস্থান ও বিচরণ করছেন।

৪. নির্বাচন কমিশন কানে তুলা ও পিঠে কুলা বেঁধে প্রার্থীদের দেওয়া হলফনামাগুলো বেমালুম হজম করে আছে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামার তথ্য এখনো তারা ওয়েবসাইটে পুনরায় ফিরিয়ে দেয়নি। ইতিমধ্যে দেরিতে হলেও উপজেলা পরিষদের তথ্য উন্মুক্ত করা হচ্ছে। এ কাজটি আরও দ্রুততার সঙ্গে হওয়া উচিত। না করা হলে তা আদালতের নির্দেশনার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং ভোটারের অধিকার হরণ হিসেবে গণ্য হবে।

৫. উপজেলা পরিষদ নির্বাচন পরিচালনা ম্যানুয়েল অনুযায়ী, প্রার্থী কর্তৃক প্রদত্ত হলফনামার তিন কপি নির্বাচন কমিশনে জমা করা আবশ্যক। এর মধ্যে এক কপি নাগরিক সমাজসহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে কপি করে নেওয়ার জন্য প্রদান করার বিধান রয়েছে। কিন্তু প্রথম দফা নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রার্থীদের হলফনামা পেতে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। তাই প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, আয় ও সম্পদের তুলনামূলক চিত্র প্রস্তুত করে সময়মতো ভোটারদের মধ্যে বিতরণ করা দুরূহ হয়ে পড়ছে। শুধু সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন পরিচালনা নয়, তথ্যভিত্তিক ভোটার ক্ষমতায়নেও নির্বাচন কমিশনকে নেতৃত্ব দিতে হবে।

৬. নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট যেকোনো তথ্য ভোটারদের সময়মতো না পৌঁছানো তথ্য অধিকার আইনেরও লঙ্ঘন। এ বিষয়ে জাতীয় তথ্য অধিকারবিষয়ক কমিশন এবং নির্বাচন কমিশনের আশু ব্যবস্থা গ্রহণ আশা করি। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের এ বিষয়ে স্বতঃপ্রণোদিত পদক্ষেপ নাগরিক সমাজ আশা করতে পারে।

ড. তোফায়েল আহমেদ: স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সদস্য, স্থানীয় সরকার কমিশন।

নির্বাচনী হলফনামা- আমি আজ চোর বটে! by বদিউল আলম মজুমদার

Tuesday, February 11, 2014

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতার কথা অনেকেরই মনে আছে। মনে আছে, মিথ্যা দেনার দায়ে জমিদার ডিক্রি করে উপেনের দুই বিঘা জমি হাতিয়ে নেন।
সেই জমির কথা ভুলতে না পেরে ১৫ থেকে ১৬ বছর পরে উপেন ফিরে আসেন তাঁর হারানো বাড়িতে। প্রাচীরসংলগ্ন পুরোনো আমগাছটির নিচে কুড়িয়ে পান দুটি পাকা আম। এ কারণে জমিদার তাঁকে আম চুরির অভিযোগে অভিযুক্ত করেন। এমনই প্রেক্ষাপটে উপেন আফসোসের সুরে বলেন:
‘তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ,
আমি আজ চোর বটে।’

আমাদের সমাজে ‘ভিকটিমকে’ দোষ দেওয়ার মতো ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে, বিশেষ করে ক্ষমতাধরেরা তা সচরাচরই করে আসছেন। সম্প্রতি এমন একটি দুঃখজনক অভিজ্ঞতার শিকার আমাকেও হতে হয়েছে। গত কয়েকটি সিটি করপোরেশন ও সম্প্রতি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে উপেনের মতো করুণ অভিজ্ঞতা আমারও হয়েছে।
স্মরণ করা যেতে পারে, গত বছরের ১৫ জুন বরিশাল, খুলনা, রাজশাহী ও সিলেট সিটি করপোরেশনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের প্রাক্কালে অতীতের মতো আমরা ‘সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক’-এর উদ্যোগে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের হলফনামার মাধ্যমে এবং তাঁদের আয়কর বিবরণীতে প্রদত্ত তথ্য ভোটারদের অবগতির জন্য প্রকাশ করি। একই সঙ্গে আমরা ‘ভোটার-প্রার্থী মুখোমুখি’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করি।
প্রসঙ্গত, প্রার্থীদের সম্পর্কে ভোটারদের তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০৫ সালে বাংলাদেশ হাইকোর্টের প্রদত্ত আবদুল মোমেন চৌধুরী বনাম বাংলাদেশ মামলার রায়ে। রায়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের হলফনামার মাধ্যমে নিজেদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, পেশা, মামলার বিবরণী এবং নিজেদের ও নির্ভরশীলদের আয়-ব্যয়, সম্পদ এবং দায়-দেনার তথ্য মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। পরবর্তী সময়ে অবশ্য সম্পূর্ণ গোপন ও অকল্পনীয় জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে একটি স্বার্থান্বেষী মহল আবু সাফা বলে এক কাল্পনিক ব্যক্তির নামে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে। সুজনের অনুসন্ধানী প্রচেষ্টায় এ জালিয়াতির তথ্য উদ্ঘাটিত হয় এবং বহু নাটকীয়তার পর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন। (সর্বোচ্চ আদালতের সম্পৃক্ততায় ঘটিত এ জালিয়াতির ইতিহাস জানতে হলে দেখুন ‘ভূমিকা’, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০০৮: অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের তথ্যাবলি প্রথমা প্রকাশন, ২০১০)।
প্রসঙ্গত, সুজনের নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টার ফলে এবং উচ্চ আদালতের নির্দেশে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এসব তথ্য প্রদানের ও প্রকাশের বাধ্যবাধকতার উদ্দেশ্য হলো ভোটারদের তথ্য দিয়ে ক্ষমতায়িত করা, যাতে তাঁরা জেনে-শুনে-বুঝে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন।
উল্লেখ্য, প্রার্থীদের সম্পর্কে ভোটারদের তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য অপরিহার্য। পিইউসিএল বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া [(২০০৩)৪এসসিসি] মামলায় ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট রায় দেন যে ‘এ কথা সত্য যে, রাজনৈতিক দলগুলোই নির্বাচনী যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। তবে নির্বাচন প্রহসনে পরিণত হবে, যদি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের অতীত ইতিহাস সম্পর্কে ভোটাররা না জানে। তাদের ‘এ’ কিংবা ‘বি’-এর পক্ষে ভোট দেওয়ার কোনো ভিত্তি থাকবে না। এ ধরনের নির্বাচন সুষ্ঠুও হবে না, নিরপেক্ষও না।’ আদালত আরও বলেন, ‘গণতন্ত্র যাতে গুন্ডাতন্ত্র (mobocracy) এবং উপহাসে (mockery) বা প্রহসনে (farce) পরিণত না হয়, তা নিশ্চিত করতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য ভোটাদের তথ্য পাওয়া জরুরি।’ আমাদের আদালতের রায়েও প্রায় একই ধরনের যুক্তি উত্থাপন করা হয়।
চারটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে যে ১২ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন, তাঁদের আটজন ২০০৮ সালের নির্বাচনেও অংশ নিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে সাতজন ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থী, চার বিদায়ী মেয়র যার অন্যতম। ২০০৮ সালের নির্বাচনেও এসব প্রার্থীকে তাঁদের মনোনয়নপত্রের সঙ্গে হলফনামার মাধ্যমে তথ্য প্রদান করতে হয়েছিল।
আমরা সুজনের পক্ষ থেকে সাতজন গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থীর ২০০৮ ও ২০১৩ সালে দাখিল করা হলফনামায় অন্তর্ভুক্ত আয় ও সম্পদের তথ্যের তুলনামূলক চিত্র সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রকাশ করি। প্রকাশিত তথ্য থেকে দেখা যায় যে পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকাকালে চারজন বিদায়ী মেয়রের, যাঁরা সবাই ছিলেন সরকারদলীয়, গড়ে আয় বেড়েছে ৬৭৪৭ দশমিক ১৮ শতাংশ। অন্যদিকে বাকি তিনজন গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থী, যাঁরা বিরোধী দলের
এবং এবার মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁদের গড়ে আয় কমেছে ২২ দশমিক ৭৮ শতাংশ। একই ধরনের প্রবণতা দেখা যায় সম্পদের ক্ষেত্রেও। অর্থাৎ ক্ষমতার সঙ্গে যে জাদুর কাঠি জড়িত, তা প্রকাশিত তথ্য থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়।
আমাদের সংবাদ সম্মেলনের পর সরকারদলীয় চার বিদায়ী মেয়রের পক্ষ থেকে সুজন এবং ব্যক্তিগতভাবে আমার বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ করা হয় যে আমরা তাঁদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপপ্রচার চালাচ্ছি। প্রসঙ্গত, সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশিত সব তথ্যই ছিল প্রার্থীদের হলফনামা থেকে নেওয়া এবং এগুলো সম্পূর্ণ সঠিক। এগুলো প্রকাশ করা হয়েছিল প্রার্থীদের সততা-অসততা সম্পর্কে কোনোরূপ মন্তব্য ছাড়াই। অর্থাৎ প্রার্থীদের নিজেদের প্রদত্ত তথ্য প্রকাশ করে আমরা ‘চোর’ বনে গেলাম!
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়েও আমাদের একই ধরনের দুঃখজনক অভিজ্ঞতা হয়েছে। নির্বাচনের আগে, অতীতের মতো, আমরা প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের হলফনামা ও আয়কর বিবরণীতে প্রদত্ত তথ্য সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রকাশ করি। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, ডেপুটি স্পিকার প্রমুখের ২০০৮ ও ২০১৩ সালের হলফনামা ও আয়কর বিবরণীতে প্রদত্ত তথ্যের তুলনামূলক চিত্র আমরা সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রকাশ করি। প্রকাশিত তথ্য থেকে দেখা যায়, এসব ক্ষমতাধরের অনেকেরই আয় ও সম্পদ গত পাঁচ বছরে আকাশচুম্বী হয়েছে। উল্লেখ্য, এবারও প্রার্থীদের প্রদত্ত তথ্য তাঁদের সততা-অসততা সম্পর্কে কোনোরূপ মন্তব্য ছাড়াই প্রকাশ করা হয়।
প্রসঙ্গত, দাবি করা হয় যে সম্পদের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ গয়না ও জায়গা-জমির মূল্যবৃদ্ধি। এ দাবি সঠিক নয়। কারণ, হলফনামায় গয়না ও জায়গা-জমির ক্ষেত্রে অর্জিত মূল্যই দেখানো হয়। আবার অনেকে এসবের কোনো মূল্যই দেখাননি। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই সম্পদ বৃদ্ধির হার অহেতুকভাবে কমে যায়। এ ছাড়া এটি জানা কথা যে অনেকেই তাঁদের হলফনামায় সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন। তাই প্রার্থীদের হলফনামায় প্রদত্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রকাশিত সম্পদ বৃদ্ধির হার প্রকৃত সম্পদ বৃদ্ধির হার থেকে কম হতে বাধ্য।
কিন্তু সংবাদ সম্মেলনের পর থেকে আমরা বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছি। বিভিন্ন ধরনের শারীরিক নিগ্রহের হুমকি ছাড়াও আমরা আইনি লড়াইয়ের মুখোমুখি হচ্ছি। এ পর্যন্ত আমরা একাধিক ‘উকিল নোটিশ’ পেয়েছি, যেগুলোর পেছনে কোনোরূপ যৌক্তিক কারণ নেই। যেমন, আমাদের ক্যালকুলেশন অনুযায়ী, একজন অতি সম্মানিত ব্যক্তির গত পাঁচ বছরে আয় ও সম্পদ বেড়েছে যথাক্রমে ৪,৪৩৫ শতাংশ ও ২৩৮ শতাংশ। তাঁর উকিল নোটিশে আয় ও সম্পদ বৃদ্ধির হার সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন তোলা হয়নি। অর্থাৎ আমাদের ক্যালকুলেশনে কোনো ভুল নেই, তবু তিনি আমাদের বিরুদ্ধে তাঁর মানহানি হওয়ার অভিযোগ তুলেছেন।
আমরা শুনেছি যে আমাদের এসব তথ্য প্রকাশ এবং গণমাধ্যমের বিভিন্ন প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কিছু বিতর্কিত ব্যক্তি মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়েছেন এবং কারও কারও বিরুদ্ধে দুদক ব্যবস্থা নিচ্ছে, যা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। তবে দেশকে সত্যিকারার্থে দুর্নীতিমুক্ত করতে হলে দুদককে শক্তিশালী এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি সর্বাত্মক অভিযান পরিচালনা করতে হবে। দলীয় বিবেচনার ঊর্ধ্বে উঠে চিহ্নিত দুর্নীতিবাজদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। সরকারের উচ্চ পদ থেকে সব বিতর্কিতকেও বাদ দিতে হবে।
পরিশেষে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কার্যকারিতার জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান ও যথার্থ ‘সিস্টেম’ বা পদ্ধতি আবশ্যক। কিন্তু সৎ, যোগ্য ও জনকল্যাণে নিবেদিত ব্যক্তিরা এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনা না করলে গণতন্ত্র অকার্যকর ও সাধারণ জনগণের জন্য অকল্যাণকর হতে বাধ্য। এ জন্যই সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার এবং নির্বাচিত হয়ে আসার সুযোগ সৃষ্টি করা আবশ্যক। সুজনের প্রচেষ্টায় এবং আদালতের নির্দেশে প্রার্থীদের সম্পর্কে ভোটারদের তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এ সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এ সুযোগ কাজে লাগানোর লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ এবং গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের সক্রিয়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতাধরদের পক্ষ থেকে রক্তচক্ষু প্রদর্শন ও হয়রানির অবসানের, যা নাগরিক সক্রিয়তার জন্য অপরিহার্য।
আমাদের রাজনীতিকে পরিচ্ছন্ন করতে হলে নির্বাচন কমিশনকে একাধিক উদ্যোগ নিতে হবে। প্রথমত, কমিশনকে হলফনামার ছকটিতে পরিবর্তন আনতে হবে। যেমন, ছকটিতে প্রার্থীদের ‘প্রাইভেন্ট ইন্টারেস্ট’ ও আয়ের বিস্তারিত উৎস প্রদর্শনের বাধ্যবাধকতা থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, বিরুদ্ধ হলফনামা প্রদানের বিধান সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। তৃতীয়ত, হলফনামার তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখতে হবে এবং মিথ্যা তথ্য প্রদানকারী ও তথ্য গোপনকারীদের বিরুদ্ধে দ্রুততার সঙ্গে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রসঙ্গত, হলফ করে মিথ্যা তথ্য দেওয়া ফৌজদারি অপরাধও বটে। চতুর্থত, সাম্প্রতিক নির্বাচনে কিছু ব্যক্তি নির্বাচিত হয়েছেন, যাঁরা সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্কের কারণে নির্বাচিত হওয়ার এবং সাংসদ থাকার অযোগ্য। তাঁদের সাংসদ পদ বাতিলের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। পঞ্চমত, হলফনামাসহ মনোনয়নপত্র ‘ইলেকট্রনিক ফাইলিং’-এর বিধান করা জরুরি, যাতে তথ্যগুলো দ্রুততার সঙ্গে ভোটারদের কাছে পৌঁছানো যায়।

বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।

আজ-কাল-পরশু- একটাই এজেন্ডা: দ্রুত নির্বাচন by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর

আপাতদৃষ্টিতে দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক। সরকার, জাতীয় সংসদ, অর্থনৈতিক কাজকর্ম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপন—প্রায় সবই এখন স্বাভাবিক। কিন্তু সবাই জানেন, এই ‘স্বাভাবিকের’ পেছনে রয়েছে ‘অস্বাভাবিক’ ও ‘অস্বস্তিকর’ পটভূমি।
তাই প্রচলিত অর্থে যাকে আমরা ‘স্বাভাবিক’ বলি, বর্তমান পরিস্থিতি সেই অর্থে ‘স্বাভাবিক’ নয়। তবে গায়ের জোরে (বা দলের জোরে) এই অস্বাভাবিকতাকে অস্বীকার করা যায়। যেমন এখন অনেকে করেছেনও। তাতে অস্বাভাবিকতাকে মাটিচাপা দেওয়া যায় না। বর্তমান মন্ত্রিপরিষদ ও সংসদ সদস্যদের দিকে তাকালেই ভোটের পুরো চিত্রটি জনমানসে ভেসে ওঠে। গায়ের জোরে তা মুছে ফেলা সম্ভব হয় না।

তবে দেশের রাজনীতির ইতিহাসে এ রকম অস্বাভাবিক ‘স্বাভাবিক অবস্থা’ যে আগে কখনো হয়নি, এমন নয়। তবে সেগুলো হয়েছিল সেনাশাসনের সময়। আমাদের দুর্ভাগ্য, এবার এমন অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে গণতান্ত্রিক আমলে এবং আরও কষ্টের হলো, তা হয়েছে গণতন্ত্রের নামে, গণতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্য।
পুরোনো কাসুন্দি বেশি ঘেঁটে লাভ নেই। তবু দু-একটি কথা বলতেই হবে বর্তমান পরিস্থিতি বোঝার জন্য। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ নির্বাচনপূর্ব অন্তর্বর্তী সরকারের বেশ কয়েকজন মন্ত্রীই বলেছিলেন: ‘৫ জানুয়ারির নির্বাচন সংবিধান রক্ষা ও গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতার নির্বাচন। প্রকৃত নির্বাচন পরে অনুষ্ঠিত হবে।’ এই বক্তব্যকে ভিত্তি ধরে এখনকার রাজনৈতিক আলোচনা, কলাম লেখা, টক শো ইত্যাদি আবর্তিত হওয়া উচিত। অন্য যেকোনো আলোচনা এখন অর্থহীন ও সময় নষ্ট করা মাত্র। আমাদের ধারণা, ২০১৪ সালে এটাই প্রধান এজেন্ডা হতে হবে। কার্যকর সংসদ, স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা, সরকারের ছয়টি অগ্রাধিকার মেগা প্রকল্প ইত্যাদি বিষয় এখন আলোচনায় প্রাধান্য পেতে পারে না। এগুলো বাংলাদেশের জন্য খুবই জরুরি, সন্দেহ নেই। কিন্তু তার চেয়েও জরুরি একটি সঠিক, স্বচ্ছ, অংশগ্রহণমূলক সংসদ নির্বাচন। যে সংসদে জনগণ (ভোটার) ভোট দিয়ে তাঁদের প্রতিনিধি নির্বাচন করবেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনপ্রতিনিধিদের সরকার গঠন করবেন। সেই নির্বাচনে কে জিতবে, তা কেউ বলতে পারে না। আওয়ামী লীগ যদি জেতে, তাহলে তারা তাদের নির্বাচনী অঙ্গীকার অবশ্যই বাস্তবায়ন করবে। কিন্তু এখন যে সরকার ক্ষমতায় রয়েছে, তারা নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়ন শুরু করলে তা সঠিক কাজ হবে না। তা জনগণের কাছে দেওয়া অঙ্গীকার বরখেলাপ করা হবে।
প্রকৃত অর্থে বর্তমান সরকার একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। একটি অর্থপূর্ণ সংসদ নির্বাচন আয়োজনে নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করাই বর্তমান সরকারের প্রধান কাজ হওয়া উচিত। এখন প্রশ্ন হলো, সেই কাজ কীভাবে শুরু হতে পারে। এ ব্যাপারে সরকার তথা মন্ত্রিসভার সদস্যরা ভালো জানেন। তবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক হিসেবে আমরা কয়েকটি প্রস্তাব দিতে পারি। আমরা মনে করি, ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দলের সাধারণ সম্পাদক দেশের প্রধান সব দলের কয়েকজন প্রতিনিধিকে একটি সভায় আমন্ত্রণ জানাতে পারেন। সভার এজেন্ডা হবে: ‘একাদশ সংসদ নির্বাচনের আয়োজন।’ সেই সভা থেকেই আমরা জানতে পারব, বিএনপিসহ বিভিন্ন দল কীভাবে নির্বাচন চায়। বিষয়টা শুধু আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমস্যা নয়। জাতীয় সমস্যা। কাজেই প্রধান রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন, সক্রিয় নাগরিক ফোরাম, মিডিয়া ফোরাম ইত্যাদির প্রতিনিধিদের সঙ্গেও আলোচনা হওয়া উচিত। গণতন্ত্রের নিয়ম অনুযায়ী বেশির ভাগ দল ও ফোরাম যেভাবে আগামী নির্বাচন আয়োজন করার পরামর্শ দেবে, সরকারের উচিত হবে সেটাই বাস্তবায়ন করা। গণতন্ত্র হলো আলাপ-আলোচনা ও সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া। আমরা কিন্তু কেউ জানি না, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বা বিভিন্ন ফোরাম ৫ জানুয়ারির প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের পর নতুন নির্বাচন আয়োজন সম্পর্কে কী মতামত বা মনোভাব পোষণ করে। শুধু এটুকু আমরা দেখেছি, ১৪-দলীয় জোট ও আওয়ামী ঘরানার সংগঠন ও ব্যক্তিরা ছাড়া দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন নাগরিক ফোরাম, বেশির ভাগ মিডিয়া ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে প্রহসনের নির্বাচন, প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন বা নিয়মরক্ষার নির্বাচন বলে অভিহিত করেছে। আশা করি, সরকারের তথ্য ও গবেষণা বিভাগ এ ব্যাপারে অবহিত।
দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, সরকার যদি ফেব্রুয়ারি মাসে এ ব্যাপারে কোনো সভা না ডাকে, তাহলে কী হবে? বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ফোরাম ও মিডিয়া সরকারকে এই সভা ডাকার জন্য নানাভাবে চাপ দিতে হবে। নানা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে সরকারকে চাপ দিতে হবে। এসব কর্মসূচিতে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। বিদেশি বন্ধুদের বলতে হবে, তারাও যেন সরকারকে এ ব্যাপারে প্রভাবিত করে।
তৃতীয় প্রশ্ন হলো, নানামুখী চাপের পরও যদি সরকার এ ব্যাপারে কোনো সভা না ডাকে, অনড় থাকে, তাহলে বিভিন্ন দল কী করতে পারে? বিভিন্ন দল ও ফোরামকে তখন আলাপ-আলোচনা করে ঠিক করতে হবে, তাদের পরবর্তী কর্মসূচি কী হতে পারে। নানা গণতান্ত্রিক, স্বীকৃত ও শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি ছাড়া সরকারকে নতি স্বীকার করানোর আর কোনো পথ নেই।

এখানে একটা কথা আমরা পরিষ্কার করে বলতে চাই। সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে নতুন নির্বাচন ছাড়া বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে অন্য কোনো বিষয়ে কথা হতে পারে না। এই সরকারের অন্য কোনো নীতি বা কাজের সমালোচনা করাও অপ্রয়োজনীয়। মনে রাখতে হবে, এই সরকার কোনো বড় কাজ করার জন্য নির্বাচিত হয়নি। তারা শুধু নিয়মরক্ষার জন্য নির্বাচিত হয়েছে। যদি তারা বড় বা ছোট কোনো প্রকল্প হাতে নেয়, তা নিয়ে পরে নানা সমস্যা হতে পারে, যদি অন্য দল ক্ষমতায় আসে। বর্তমান সরকার শুধু সরকার পরিচালনার রুটিন কাজ করবে। এবং সত্যিকার অর্থে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের আয়োজন করবে। এটাই একমাত্র কাজ। সেই নির্বাচনে ১৪-দলীয় জোট বিজয়ী হলে তারা তখন তাদের স্বপ্নের সব প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারবে। কেউ তাদের বাধাও দেবে না, সমালোচনাও করবে না।
চতুর্থ প্রশ্ন হলো, সব রকম গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করেও যদি সরকার নির্বাচন না দেয়, তাহলে কী করতে হবে? কিছুই করার নেই। তখন সরকার ও ১৪-দলীয় জোটের শক্তির কাছে বাকি সব দল, ফোরাম, মিডিয়া, গণতন্ত্রকামী জনগণ পরাজয় মেনে নেবে। যেমন ১৮-দলীয় (এখন ১৯-দলীয়) জোট ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহত করতে না পেরে পরাজয় মেনে নিয়েছে। রাজনীতিতে কৌশল ও শক্তিরও জয়-পরাজয় আছে এবং তা মেনে নিতে হয়। তবে কোনো জয় বা পরাজয় চিরস্থায়ী নয়। রাজনৈতিক দল ও নেতাদের এ জন্য ধৈর্য ধারণ করতে হবে।
বর্তমান সরকার যদি গায়ের জোরে পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকতে চায়, তাহলে বুঝতে হবে, তারা বাস্তবতা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা গায়ের জোরে একটা ‘অস্বাভাবিক অবস্থা’ জিইয়ে রাখতে চায়। জনগণ এগুলো পছন্দ করে না। নেতার জোরে, দলের জোরে, সরকারের জোরে, নানা বাহিনীর জোরে কোনো ‘অস্বাভাবিক কর্মকাণ্ড’ জনগণ কখনো পছন্দ করে না। সব মানুষ রাস্তার প্রতিবাদে শামিল হয় না নানা কারণে। তবে মনের মধ্যে পুষে রাখে যত ক্ষোভ ও প্রতিবাদ। সময় হলে তার প্রকাশ ঘটে। বাংলাদেশে অতীতের রাজনৈতিক ঘটনাবলি তারই সাক্ষ্য দেয়।
অনেক মন্ত্রী পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার জন্য হুংকার দিচ্ছেন। এসব হুংকারকে গুরুত্ব দেওয়ার দরকার নেই। তৃণমূলের দলীয় কর্মীদের আশ্বস্ত করার জন্য এসব হুংকার দিতেই হয়। এসব মন্ত্রীও জানেন, কীভাবে তাঁরা এমপি হয়েছেন। তা ছাড়া পাঁচ বছর থাকার কথা না বললে ক্লায়েন্টের কাছ থেকে ‘অগ্রিম’ পাওয়া যাচ্ছে না। ছয় মাসের মন্ত্রীকে কে ‘অগ্রিম’ দেবে? সরকার বড় বড় প্রকল্প হাতে নিচ্ছে।
দেশে-বিদেশে অনেকে ভান্ড নিয়ে বসে আছে। বারবার ‘পাঁচ বছরের’ হুংকার না দিলে ক্লায়েন্টের আগ্রহ চলে যায়। যারা বেশি বেশি ‘পাঁচ বছর’ ধ্বনি তুলছে, বুঝতে হবে ‘অগ্রিম’ নিয়ে তাদের সমস্যা হচ্ছে। দেশি-বিদেশি ক্লায়েন্টরা এখন অনেক সচেতন। তারা প্রশ্নবিদ্ধ সরকারের নড়বড়ে মন্ত্রীকে সহজে ‘অগ্রিম’ দিতে রাজি হয় না। কখন কী হয়! সুতরাং নিজেদের ‘স্বার্থেও’ একটা প্রকৃত অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করা দরকার।
আমাদের ধারণা, তা ২০১৪ সালের মধ্যেই সম্পন্ন করা উচিত।

মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: উন্নয়ন ও মিডিয়াকর্মী।

সপ্তাহের হালচাল- বিএনপি কি তাহলে হেরে যেত? by আব্দুল কাইয়ুম

Friday, February 7, 2014

বিএনপি হারত না, কিন্তু এখন হেরে গেছে!!! সর্বশেষ এক জরিপে দেখা যাচ্ছে, সব দল অংশগ্রহণ করলে ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপি অন্তত সাড়ে ৫ শতাংশ ভোট কম পেত।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের (ডিআই) এই জরিপ নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ কম। তাহলে প্রশ্ন, নির্বাচনের আগে একাধিক জরিপে দেখা গেছে, ভোটে আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপি অনেক বেশি এগিয়ে থাকবে, সেটা কি ভুল ছিল?

না, তা নয়। ওই জরিপের ফলাফলও যথার্থই ছিল। ওই সময় যদি বিএনপি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলত, ঠিক আছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন করব, তাহলে বিএনপির বিজয় ছিল অবধারিত। এটা মনগড়া কথা নয়। গত ২৪ জানুয়ারি রাতের ট্রেনে রাজশাহী যাচ্ছিলাম। সেখানে পরদিন গণিত উৎসব হবে। আমাদের কক্ষের বাকি দুজনের সঙ্গে আড্ডা জুড়ে দিলাম। তাঁরা রাজশাহীর অধিবাসী। বললেন, নির্বাচনে না গিয়ে বিএনপি মারাত্মক ভুল করেছে। তাদের বিজয় ছিল অবশ্যম্ভাবী। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আওয়ামী লীগের সাংসদেরা বহাল, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায়, এ অবস্থায় কি বিএনপিকে জিততে দেওয়া হতো? তাঁরা কথাটা উড়িয়ে দিলেন। বললেন, কারচুপির কোনো সুযোগই ছিল না। মানুষের বন্যায় সব ভেসে যেত।

আমি রাজশাহীতে গিয়ে বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, নির্বাচনে গেলে মোট ছয়টি আসনের সব কটিতেই বিএনপি চোখ বন্ধ করে জিতে যেত। কারও মধ্যে কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখা যায়নি। যেমন রাজশাহী-৬, বাঘা-চারঘাট আসনে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এক লাখ ২৭ হাজার ভোট পেয়ে জিতেছিলেন। এবারও তিনি জিতেছেন। বিএনপির প্রার্থী ছিল না। ছিল আওয়ামী লীগেরই বিদ্রোহী প্রার্থী। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে এই দুই আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বীর মিলিত ভোটের পরিমাণ মোট মাত্র ৯১ হাজার। গত নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগ প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোটের চেয়েও প্রায় ৩০ হাজার কম! তাহলে দেখুন, আওয়ামী লীগের অবস্থান কত পড়ে গেছে। বিএনপি থাকলে তাদের বিজয় কে ঠেকাত?

দুই দিন আগে ঢাকায় সাতক্ষীরার একজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি বললেন, ওদের ওখানে নির্বাচন হলে চারটি আসনের সব কটিতেই আওয়ামী লীগ পরাজিত হতো। সেখানে মূলত জামায়াতের প্রভাব। বিএনপির তেমন প্রভাব নেই। কিন্তু কথা তো একই। জামায়াত জিতলেও তো বিএনপির ভাগেই যেত। হয়তো সদর আসনে জাতীয় পার্টি জিতত। বাকি তিনটির মধ্যে জামায়াত একটি ও বিএনপি দুটি আসন পেত। আমি ওখানের লোকজনের সঙ্গে ফোনে কথা বলে দেখেছি, তাদের চিন্তার সঙ্গে সব মিলে যায়।

সিলেটে কথা বললাম। পরিচিতজনেরা জানালেন, সিলেট বিভাগের ১৯টি আসনের মধ্যে ১৭টিতেই বিএনপি চোখ বন্ধ করে জিতে যেত। আওয়ামী লীগ হয়তো দুটি আসনে জিততে পারত।

অবশ্য আলোচ্য তিন জেলায় বিএনপির পাল্লা ভারী। ফরিদপুর, দিনাজপুরসহ অন্য অনেক জেলায় হয়তো আওয়ামী লীগের প্রার্থীরাও জিতত। ফলে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে বিএনপি জিতলেও দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া কঠিন হতো। বিএনপি হয়তো ভেবেছিল সরকারের পতন ঘটিয়ে নির্বাচনে গেলে তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য থাকবে। এই চিন্তাই তাদের কাল হয়েছে। মানুষ এখন আর কোনো দলের একাধিপত্য চায় না। এটা সত্যিই দুর্ভাগ্য যে বিএনপি মানুষের মনের কথা বুঝতে পারেনি।

মোটের ওপর নির্বাচনে গেলে বিএনপি অনায়াসে জিততে পারত। প্রশ্ন ওঠে, অবস্থাটা যদি ওই রকমই হয়ে থাকে, তাহলে আজ কেন জরিপে মানুষ বলছে যে ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপি কম ভোট পেত? এর কারণ হলো, বিএনপি নির্বাচন বর্জনের জন্য যে মারাত্মক ও নির্মম সহিংসতার পথ ধরেছিল, তার ফলে মানুষ ক্রমে দূরে সরে গেছে। পেট্রলবোমা, ককটেল, পুলিশ হত্যা, বাস-ট্রাকের চালক হত্যা, শিশু হত্যা, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া, দিনের পর দিন হরতাল-অবরোধ—এর প্রতিটি কর্মসূচি মানুষের মন বিষিয়ে তুলেছে। কৃষক থেকে শুরু করে গরিব দিনমজুর-খেটে খাওয়া মানুষ ছিল অসহায়। অনেক ব্যবসায়ী শিল্পপতিকে লোকসান গুনতে হয়েছে।

বিএনপি যদি সেপ্টেম্বর-অক্টোবর থেকেই নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করত, তাহলে মানুষের ঢল নামত বিএনপির পক্ষে। কিন্তু পরে যখন দেখল দেশকে বিএনপি সহিংসতার বিপজ্জনক পথে ঠেলে দিচ্ছে, তখনই ভোটারদের মনোভাব বদলাতে থাকে। এ জন্যই নির্বাচনের আগে ও পরে জরিপের ফলাফল উল্টে গেছে। বিএনপি বলবে, ওরা কোনো সহিংসতা করেনি, করেছে জামায়াত। হতে পারে। কিন্তু তাদের মৌন সমর্থন
ছাড়া কি জামায়াতের সাধ্য ছিল সহিংসতা করার? এটা তো মানুষ বোঝে।

আরেকটি প্রশ্ন হলো, নির্বাচনের আগে বিএনপির পক্ষে এত বিশাল সমর্থন থাকা সত্ত্বেও মানুষ কেন রাস্তায় নেমে নির্বাচন প্রতিহত করল না? কারণ, মানুষ সহিংসতার পথে নয়, গণতন্ত্রের পথেই ওই একতরফা নির্বাচনকে ‘না’ বলাকে শ্রেয় মনে করেছে। দু-চারটি ছাড়া বাকি সব কটি আসনেই মানুষ বাসায় বসে থেকে, ভোটকেন্দ্রে না গিয়ে তাদের প্রতিবাদ জানিয়েছে। একই সঙ্গে তাদের একটা বড় অংশ বলতে গেলে বিএনপির সহিংসতার প্রতিও ‘না’ জানিয়ে দিয়েছে। তাদের দলে দলে রাস্তায় নেমে না আসার কারণ এটাই। এখানে বিএনপি ভুল করেছে। তাদের হিসাব ছিল জনপ্রতিরোধ নির্বাচন রুখে দেবে, সরকারের পতন ঘটবে। মানুষ কিন্তু সেই মেজাজে ছিল না।

বিএনপির সহিংসতা ও একটানা হরতাল-অবরোধে বিপর্যস্ত হয়ে আজ, নির্বাচনের পর, মানুষ আগের মতো আর বিএনপিকে ঢালাওভাবে ভোট দিতে আগ্রহী না। ডিআই জরিপের ফলাফলের এটাই তাৎপর্য। নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর মানুষ একটু স্বস্তি পেয়েছে। দিনের পর দিন হরতাল-অবরোধ-ককটেল খেতে কেউ রাজি নয়। এখন শান্তিতে চলাফেরা করা যাচ্ছে। পথেঘাটে বোমা-ককটেলে মারা যাওয়ার আশঙ্কা কম। এটাই ভালো।

একটা বিষয় পরিষ্কার। বোমা মেরে সরকারের পতন ঘটানোর স্বপ্ন থেকে বিরোধী দলকে বেরিয়ে আসতে হবে। জামায়াত যে বৃহস্পতিবার আবার হরতাল ডেকেছে, তার বোঝা কিন্তু ওই বিএনপিকেই টানতে হবে। তাই জামায়াতের সংশ্রব ছাড়তে হবে, অথবা পরিষ্কার বলতে হবে জামায়াতের হরতাল বিএনপি সমর্থন করে না। তারা সংবাদ সম্মেলন করে, পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে বলুক যে জামায়াতের সঙ্গে ওরা নেই।

যদি বিএনপির বোধোদয় হয় ভালো। না হলে মানুষ তার পথ বেছে নেবে। বাঙালির টিকে থাকার অসাধারণ ক্ষমতা। সেদিন প্রথম আলো কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাবেক মহাসচিব আইরিন খান বলছিলেন, সাধারণ বাঙালি ইটালিতে যায়। প্রথমে রাস্তায় ফুটপাতে দাঁড়িয়ে পথচারীদের কাছে গোলাপ ফুল বিক্রি করে দুই পয়সা কামাই করেন। একটু পয়সা জমলেই ছোটখাটো ব্যবসা খুলে বসেন। তাঁরাই দেশে টাকা পাঠান। দেশের বৈদেশিক মুদ্রাভান্ডার সমৃদ্ধ করেন।

অবরোধের সময় আমি বাসে করে যাচ্ছিলাম। খুব ভিড়। হঠাৎ একজন আসন ছেড়ে আমাকে প্রায় জোর করে বসিয়ে দিলেন। জানতে পারলাম, তিনি আমাদের পত্রিকা অফিসের সামনে রোজ বিকেলে জুতার খুচরা দোকান বসান। রমজান মিঞা। তিনি বাসে করে গুলিস্তানে যান আর সেখান থেকে জুতা কিনে এনে কারওয়ান বাজারে বিক্রি করেন। লাভ মোটামুটি ভালো। তিনি জানালেন, এত হরতালের মধ্যেও ক্রেতা মোটামুটি ছিল, তিনি খেয়েপরে বেঁচে আছেন। অল্পে খুশি বলেই তাঁর মুখে হাসিটি অমলিন। বলেন, হরতাল-অবরোধের মধ্যেও তো সংসার চালাতে হবে। রোববার তাঁর সঙ্গে দেখা হলে বলেন, স্যার, আমাদের ব্যবসা আবার পুরোদমে শুরু হয়ে গেছে। রমজান মিঞাকে হাজার সালাম জানাই। তাঁরা আছেন বলেই দেশ অচল হয় না।

রাজশাহীতে কথা হচ্ছিল আলমিরা আর্টস অ্যান্ড ফার্নিচারের স্বত্বাধিকারী আরাফাত রুবেলের সঙ্গে। পারটেক্সের ব্যবসা করেন। নিজে ডিজাইন করেন, তাঁর আসবাব জনপ্রিয়। তিনি বললেন, রাজনৈতিক গোলযোগে যেটুকু লোকসান হয়েছিল, গত তিন সপ্তাহে পুষিয়ে গেছে। এখন কেনাকাটার ধুম পড়েছে। আর চিন্তা নেই।

এই মানুষগুলো আছে বলেই বাংলাদেশ টিকে আছে। টিকে থাকবে।

আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।

quayum@gmail.com     

চাচার পাঁচালি- বাকশাল by মাহবুব তালুকদার

Wednesday, January 29, 2014

চাচা বললেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আসলেই ঝানু পলিটিশিয়ান। নির্বাচনটা তিনি করিয়েই ছাড়লেন।
আমি বললাম, অপারেশন সাকসেসফুল, বাট পেশেন্ট ইজ ডেড।

পেশেন্ট কোন বড় বিষয় নয়, বড় বিষয় হচ্ছে অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে কিনা! এক্ষেত্রে ডাক্তার  
হাসিনা শতভাগ সফল। চাচা আরও বললেন, এরপর তার কাজ হচ্ছে মৃতদেহে প্রাণ সঞ্চার করা।
সেটা কি করে সম্ভব?
শেখ হাসিনার জন্য সবকিছুই সম্ভব। চাচা উদ্দীপ্ত হয়ে জানালেন, দেখছো না বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এখন তাকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন যেভাবে পাশে দাঁড়িয়েছিল, সেভাবেই তারা পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। খালেদা জিয়া নির্বাচনে না আসার সমালোচনা পর্যন্ত করেছে রাশিয়া।
এটা আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ হয়ে গেল না?
তারা তো সরকার বা রাষ্ট্রের বিপক্ষে কোন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেনি। বিরোধী দলের কি করা উচিত ছিল আর কি করা উচিত হয়নি বললে তা অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ হয় কি করে? চাচা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললেন, বলতে পারো বেগম খালেদা জিয়া নির্বাচন বর্জন করে কি অর্জন করলেন?
একটা প্রহসনের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেই বা তিনি কি অর্জন করতেন?
শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে অংশ নিলে তিনি বিরোধীদলীয় নেত্রী তো হতে পারতেন। এখন তার আমও গেছে, ছালাও গেছে। আওয়ামী লীগ আগামী ২০৪১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবে। সে জন্যই তো তারা ২০৪১ সাল পর্যন্ত রূপকল্প ঘোষণা করেছে।
তাহলে কি দেশে আর কোন নির্বাচন হবে না?
নির্বাচন অবশ্যই হবে। এবারের নির্বাচনে একটা মডেল তৈরি হয়ে গেছে। আশা করি নির্বাচন কমিশন মডেলটির স্থায়ী রূপ দেবে। এই মডেল অনুসরণ করলেই আওয়ামী লীগের পোয়া বারো। ‘শেখ হাসিনার সরকার বারবার দরকার’ স্লোগানটি এখন জাতীয় স্লোগানে পরিণত হয়েছে।
চাচার কথাবার্তায় আমি রীতিমতো বিভ্রান্ত। আরও বিভ্রান্ত সরকারি দলের সিনিয়র নেতাদের কথাবার্তা শুনে। যেসব সরকারি নেতা ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনকে ‘সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা’ কিংবা ‘নিয়ম রক্ষার নির্বাচন’ বলে অভিহিত করেছেন, তারাই এখন বলছেন পাঁচ বছরের আগে আর কোন নির্বাচন নয়। নির্বাচন বিষয়ে সংলাপ হতে পারে পাঁচ বছর পরে। মাননীয় অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেব পর্যন্ত এমন স্ববিরোধী উক্তি করেছেন। তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়ালো? আমি চাচাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি যে নির্বাচনের মডেলের কথা বলেছেন, তা কি রকম?
সব কথা তো প্রকাশ্যে বলা যায় না। চাচা রহস্যময় হাসি হাসলেন। বললেন, বাংলাদেশে যে নির্বাচন হয়েছে, তাতে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ব্যাপার ছিল, তা মানি। মেনিপুলেশনের ব্যাপার ছিল, তা-ও মানি। ভোটার সংখ্যা বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে, এ কথা স্বীকার করতেও আপত্তি নেই। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা হলো, ইলেকশন হয়েছে কিনা। যে কোন মূল্যে ইলেকশন হওয়াই হচ্ছে এই মডেল।
আমি বললাম, কিন্তু ইলেকশন গ্রহণযোগ্য হয়েছে কিনা, সেটা কোন ব্যাপার নয়?
চাচা দু’চোখে অগ্ন্যুৎপাত সৃষ্টি করে আমার দিকে তাকালেন। সরোষে বললেন, কার কাছে গ্রহণযোগ্য? কে গ্রহণযোগ্যতার সার্টিফিকেট দেবে? বিদেশীরা? ইলেকশনের ব্যাপারে আমরা তাদের বয়কট করেছি।
তাহলে আপনি বলছেন, নির্বাচন যথাযোগ্য হয়েছে?
চাচা কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক করে বললেন, তোমার এই ‘যথাযোগ্য’ শব্দটা আমার খুব মনঃপূত হয়েছে। সত্যি বলতে কি, আমাদের যোগ্যতা অনুসারে এই নির্বাচন ‘যথাযোগ্য’ হয়েছে। খোদ আমেরিকা পর্যন্ত নবনির্বাচিত সরকারের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়ন, বৃটিশ পার্লামেন্ট তো পুনরায় নির্বাচন দাবি করেছে।
যার বিয়ে তার মনে নেই, পাড়া-পড়শির ঘুম নেই। চাচা বললেন, বিদেশীদের দাবিনামা আস্তে আস্তে চাপা পড়ে যাবে। সবাই বুঝতে পেরেছে, দেশের মানুষ নির্বাচন মেনে নিয়েছে। যেসব দুষ্কৃতকারী নির্বাচন মেনে নেয়নি, সহিংসতার সৃষ্টি করেছে কিংবা উস্কানি দিয়েছে, তাদের পরিণতি তো চোখের সামনে দেখতেই পাচ্ছো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এর মধ্যে দু’টি হার্ডল পার হলেন।
কি রকম?
প্রথমত তিনি নির্বাচনে জয়লাভ করলেন এবং কৌশলে বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখলেন। দ্বিতীয়ত তিনি বিএনপি থেকে জামায়াতকে বিচ্ছিন্ন করতে সফল হচ্ছেন এবং হয়েছেন।
কিন্তু জামায়াতকে তিনি নিষিদ্ধ করছেন না কেন? আমি বললাম।
নিষিদ্ধ করার দরকার কি? কাজ সুসিদ্ধ হলেই হলো। চাচা শান্তকণ্ঠে বললেন, একবারে নয়, জামায়াতকে ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন করা হবে। বিএনপিও ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
বিএনপি নিশ্চিহ্ন হবে কিভাবে?
ওরা তো ইলেকশনেই আসতে পারবে না। এরপর যত ইলেকশন হবে, সংবিধান মেনে নিয়ে সবই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অধীনেই হতে হবে।
বিএনপি যদি তাতেই রাজি হয়ে যায়?
তখন নতুন কোন কৌশল করে ওদের বাদ দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন।
এ কথার অর্থ কি?
নির্বাচন কমিশন যেন সরকারের সাহায্য ছাড়াই বিএনপিকে বসিয়ে দেয়ার ক্ষমতা অর্জন করতে পারে!
চাচা! একটা বিষয় আমি ঠিক বুঝতে পারি না।
কি বিষয়?
নির্বাচনী প্রতীক ব্যবহারের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী অন্যান্য দলের সদস্যদের নৌকা প্রতীক ব্যবহার করার সম্মতি দিয়ে কমিশনে চিঠি দিয়েছেন। সে অনুযায়ী রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনুরা নৌকায় চড়ে বৈতরণী পার হলেন। কিন্তু এরশাদ যখন লাঙ্গল প্রতীক ব্যবহারের অনুমতি না দিতে নির্বাচন কমিশনে চিঠি দিলেন, তার চিঠি আমলেই নেয়া হলো না। এক যাত্রায় এমন পৃথক ফল হয় কি করে? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
এটাই তো নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতার প্রমাণ। এরশাদের সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী জেনেই তা কমিশন আমলে নেয়নি।
কিন্তু এরশাদকেও লাঙ্গল প্রতীক নিয়েই নির্বাচনে জিতিয়ে আনা হলো। তিনি তো নির্বাচনই করতে চাননি।
এটা সরকার ও নির্বাচন কমিশনের মহানুভবতা বলতে পারো। এরশাদ সাহেব নিজের ভালমন্দ বোঝার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। আসলেই তিনি খুব অসুস্থ। সত্যি কথা হলো, তিনি একজন মানসিক রোগী।
এ কি কথা বলছেন আপনি?
ঠিকই বলছি। মানসিক রোগী না হলে কেউ নিজের মাথায় পিস্তল ধরে! পিস্তলের ভেতরে যদি গুলিভর্তি থাকতো তখন কি হতো? বারবার যার মুখের কথা ফসকে যায়, তার হাত ফসকে যাওয়াটা কি অস্বাভাবিক কিছু?
আমি কথা অন্যদিকে ঘুরিয়ে বললাম, চাচা! দেশের এ অবস্থা কি আপনি স্বাভাবিক মনে করছেন?
অবশ্যই স্বাভাবিক। এখনকার মন্ত্রিসভা আওয়ামী লীগের আগের মন্ত্রিসভাগুলোর চেয়ে অনেক বেশি পাকাপোক্ত। আমু তোফায়েল নাসিম- এরা সবাই তারকা রাজনীতিবিদ।
কিন্তু বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গেও তো কয়েকজন তারকা রাজনীতিবিদ ছিলেন।
খালেদা জিয়া কি রাজনীতি বোঝেন? মোটেই না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেই দিয়েছেন, খালেদা জিয়াকে তার ভুলের খেসারত দিতে হবে।
রাজনীতিতে কাকে কখন ভুলের খেসারত দিতে হয়, সেটা সময় বলে দেবে। তবে খালেদা জিয়ার ভুলটা কি?
তার তো সবটাই ভুল। তিনি জনগণের ভোটে সংসদ সদস্য হলেন, কিন্তু জনগণের কথা বলতে সংসদে বসলেন না। তিনি যাতে আদৌ সংসদ অভিমুখী না হতে পারেন, শেখ হাসিনা তার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তবে তুমি হয়তো বলবে, খালেদা জিয়া নির্বাচিত হয়েও যখন সংসদে যাননি, তার আর নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদে যাওয়ার দরকার কি?
আমি তা বলবো না। সংসদ বর্জন আর সংসদে যেতে না পারা এক কথা নয়। তবে বিরোধী দলবিহীন সংসদ গণতন্ত্রের জন্য শুভ নয়।
বিরোধী দলবিহীন কে বললো? বেগম রওশন এরশাদ এখন বিরোধী দল নেতা। তিনি সরকারের সঙ্গেও আছেন আবার বিরোধী দলেও আছেন। সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে এটা এক বিরল দৃষ্টান্ত।
বিরল কথাটা বোধ হয় ঠিক হলো না। পৃথিবীতে এমন দৃষ্টান্ত আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
তা বলতে পারো। এটা সাধারণ বিরোধী দল নয়, গঠনমূলক বিরোধী দল। দলের নেতারা বলেছেন, তারা কেবল গঠনমূলক বিষয়ে বক্তব্য রাখবেন। জাতীয় পার্টির মন্ত্রীরা সরকারের পক্ষেও যেমন আছেন, আছেন তেমন বিরোধী দলেও।
সংসদে হ্যাঁ কিংবা না ভোটের সময় তারা কোনদিকে ভোট দেবেন?
চাচা বললেন, তারা সরকারি দলের হয়ে সর্বদা হ্যাঁ ভোট দেবেন, আবার বিরোধী দল হিসেবে না ভোট দেবেন।
তাহলে কি তারা দু’বার ভোট দেবেন?
তা হতেই পারে। তবে এসব ভোটাভুটিতে সরকারি দল সর্বদাই জয়যুক্ত হবে। বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টি না ভোট দিলেও তাতে সিদ্ধান্তের কোন নড়চড় হবে না। ফলে কিছুই আসবে যাবে না।
দেশে তাহলে বাকশাল চালু হয়ে গেল না?
চাচা ভ্রু-কুঞ্চিত করে আমার দিকে তাকালেন। বললেন, বাকশালের ব্যাপারটা কিছু বোঝো তুমি? বাকশাল অর্থ বোঝো?
বললাম, বাকশাল হচ্ছে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা।
মোটেই না। বাকশাল হচ্ছে বহুদলীয় গণতন্ত্র। পঁচাত্তর সালে যে বাকশাল হয়েছিল, তা-ও একদলীয় ছিল না। বহুদলীয় গণতন্ত্রই ছিল তার রূপরেখা। বাকশাল হচ্ছে গণতন্ত্রের সর্বশেষ কথা। গণতন্ত্রের নির্যাসও বলতে পারো।
বলছেন কি চাচা!
ঠিকই বলছি। চাচা হাসিমুখে বললেন, শেখ হাসিনা বাকশাল কায়েম করতে চাইলে সমগ্র জাতি সাধুবাদ জানাবে। তিনি যদি বিএনপিকে তাতে যোগ দিতে বলেন, বিএনপি’র উচিত হবে অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে তাতে যোগদান করা। কথাটা পারলে খালেদা জিয়ার কানে পৌঁছে দিও।

নয়া নির্বাচনের পরিবেশ তৈরির তাগিদ যুক্তরাষ্ট্রের by কাউসার মুমিন

বাংলাদেশে ৫ই জানুয়ারির একপাক্ষিক নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকার গঠনের পর এই প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিশালের সঙ্গে বৈঠক করলেন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আকরামুল কাদের।
আর প্রথম বৈঠকেই বাংলাদেশের বিতর্কিত নির্বাচন বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া এবং সরকারের আশু করণীয় সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের দৃঢ় অবস্থানের এক ‘তেতো স্বাদ’ নিতে হলো রাষ্ট্রদূতকে। বৈঠকে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কথা বলে রাষ্ট্রদূত যত বেশি এই নির্বাচনের পক্ষে যুক্তি দেখাচ্ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়ার মাত্রাটাও তত বেশি হচ্ছিল। বাংলাদেশের সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার স্বার্থে নয়া সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়মিত কূটনৈতিক সম্পর্ক এবং দ্বিপক্ষীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে আলাপ-আলোচনা অব্যাহত থাকলেও নির্বাচন বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র সাফ জানিয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশে যথাশিগগির নয়া নির্বাচন দিতে হবে। রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশে একটি ইনক্লুসিভ ও ক্রেডিবল নির্বাচন অনুষ্ঠানের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরির পরামর্শ দেয়া হয়েছে সরকারকে।

কিন্তু বৈঠক শেষে রাষ্ট্রদূত নিজে মিডিয়াকে ঠিক বিপরীত তথ্য দিয়েছেন। রাষ্ট্রদূত আকরামুল কাদেরকে উদ্ধৃত করে সেদিনই বাংলাদেশের বিভিন্ন মিডিয়ায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে ‘হাসিনা সরকারকে বৈধতা দিলো যুক্তরাষ্ট্র’; ‘যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে পুনঃনির্বাচনের কথা বলছে না’। এ বিষয়ে গতকাল প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক মুখপাত্র এমিলি হর্ন গতকাল দুপুরে এ প্রতিনিধিকে বলেন, মিডিয়ায় প্রকাশিত বক্তব্য যদি রাষ্ট্রদূতের নিজস্ব বক্তব্য হয়ে থাকে, তবে তা রাষ্ট্রদূত আকরামুল কাদেরের সঙ্গে বৈঠকে সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আলোচ্য বিষয়বস্তুর সঠিক প্রতিফলন নয়, বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের সম্পূর্ণ বিপরীত। কেননা, সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিশালের সঙ্গে রাষ্ট্রদূত আকরামুল কাদেরের বৈঠকে অন্যান্য দ্বিপক্ষীয় বিষয়াবলীর সঙ্গে বাংলাদেশে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের তাগাদার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বর্তমান সরকারকে দেশটিতে নতুন নির্বাচনের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরির তাগাদা দিয়েছে।
উল্লেখ্য, বিগত ২৪শে জানুয়ারি সকাল ১০টায় ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিশালের সঙ্গে বৈঠক করেন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আকরামুল কাদের। এটি একটি নিয়মিত বৈঠক। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিবেচনায় এ বৈঠকটি ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বৈঠকের পর ওই দিনই বাংলাদেশের একটি অনলাইন বার্তা সংস্থা তার নিউ ইয়র্ক প্রতিনিধির বরাতে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আকরামুল কাদেরকে উদ্ধৃত করে ‘হাসিনা সরকারকে বৈধতা দিলো যুক্তরাষ্ট্র’ বলে সংবাদ প্রকাশ করে। প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, নিশা দেশাই বিশালের সঙ্গে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকের পর রাষ্ট্রদূত আকরামুল কাদের জানিয়েছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে পুনঃনির্বাচনের কথা বলছে না’, বরং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপের তাগিদ দেয়াটা যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক অবস্থান মাত্র। এই সংবাদ ওই দিনই বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি জাতীয় দৈনিকেও ফলাও করে প্রকাশিত হয়।
এরপর যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি বাংলা মিডিয়ার পক্ষ থেকে রাষ্ট্রদূত আকরামুল কাদেরের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলার চেষ্টা করা হলেও কোনভাবেই রাষ্ট্রদূতকে পাওয়া যায়নি। আর মিডিয়ায় প্রকাশিত সংবাদে যেহেতু রাষ্ট্রদূতকে উদ্ধৃত করা হয়েছে সেহেতু দূতাবাসের অন্য কোন কর্মকর্তা এ বিষয়ে কোন রকম মন্তব্য করতে রাজি হননি। এমনকি এই সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার তিনদিন পরও এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত দূতাবাসের পক্ষ থেকে মিডিয়ায় প্রকাশিত রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যকে অস্বীকার করা হয়নি।
এরই প্রেক্ষিতে গতকাল যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরে যোগাযোগ করা হলে স্টেট ডিপার্টমেন্টের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক মুখপাত্র এমিলি হর্ন এক লিখিত বার্তায় এই প্রতিনিধিকে বলেন, ২৪শে জানুয়ারি রাষ্ট্রদূত কাদেরের সঙ্গে বৈঠকে সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিশাল বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও রাজনৈতিক সহিংসতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত উদ্বেগের কথা আবারও পুনর্ব্যক্ত করেছেন। বৈঠকে সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিশাল বাংলাদেশ সরকারকে একটি নতুন নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরির আহ্বান জানিয়েছেন। এই উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের মানুষের দৃষ্টিতে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, ‘ইনক্লুসিভ’ ও ‘ক্রেডিবল’ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে প্রধান প্রধান দলগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক সংলাপ শুরুর আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
এদিকে বাংলাদেশে খুব দ্রুত একটি নয়া নির্বাচন বিষয়ে দেশটিতে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনার উপর্যুপরি আহ্বান নিয়ে বাংলাদেশের প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার একটি অংশে বিতর্ক চলছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা কি তার ‘ব্যক্তিগত অতি উৎসাহ’ থেকে এমন অবস্থান নিয়েছেন না কি সত্যি সত্যি তিনি স্টেট ডিপার্টমেন্টের নীতি বাস্তবায়ন করছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মুখপাত্র এমিলি হর্ন পৃথক এক লিখিত বার্তায় এই প্রতিনিধিকে বলেন, বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতা বন্ধ করা এবং একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের গুরুত্ব বিষয়ে স্টেট ডিপার্টমেন্ট ধারাবাহিক ভাবে নির্দিষ্ট অবস্থানে থেকে অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাবে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের কথা অব্যাহতভাবে জানিয়ে আসছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনার ভিন্নরকম অবস্থানের সুযোগ নেই। মুখপাত্র বলেন, ‘সকলেরই সুস্পষ্ট ভাবে জানা উচিত, রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা বাংলাদেশে তার ব্যক্তিগত নীতি নয়, প্রেসিডেন্ট ওবামার নীতি বাস্তবায়ন করেন।’

এ কেমন গণতন্ত্র? by বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম

Tuesday, January 28, 2014

৫ই জানুয়ারি গণতন্ত্রের জানাজা হয়েছে। সারা পৃথিবী অমন নির্বাচন কখনও দেখেনি। ভোটার নেই, প্রার্থী নেই, অর্ধেকের বেশি আসনে এমনিই জয়ী- এমন ন্যক্কারজনক ঘটনাকে বর্তমান শাসক দল যেভাবে হেলাফেলা করছে তাতে মনে হয় সরকার যেন সমুদ্র জয়ের মতো বিশ্ব জয় করে  ফেলেছে।
এ দেশের মানুষ কখনও অন্যায় মাথা পেতে নেয় না। ঘোর কেটে গেলে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর অবকাশ পেলে সরকারের এসব ভানুমতির খেল হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে। কেউ যদি তার ব্যর্থতা বুঝতে না চায় তাহলে কার কি করার থাকে? ৩০০ আসনের ১৫৩টি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, বাকিগুলোতেও নিজেরা নিজেরাই ভাগাভাগি। সর্বদলীয় ভাগাভাগির নির্বাচন, ভাগাভাগির সংসদ, ভাগাভাগির মন্ত্রিসভা এবং বিরোধী দল। এমন ব্যর্থ সংসদ আর হয়নি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলতে পারতেন তার সংসদে বিরোধী দল নেই। কিন্তু না। জাতীয় পার্টির কিছু সরকারে, কিছু বিরোধী দলে। বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ। যে লাউ, সে-ই কদু। আগে ছিলেন সংসদ নেতা বেগম খালেদা জিয়া, বিরোধী নেতা শেখ হাসিনা। তারপর সংসদ নেতা শেখ হাসিনা, বিরোধী দলে বেগম খালেদা জিয়া। সংসদ উপনেতা সাজেদা চৌধুরী, স্পিকার শিরিন শারমিন চৌধুরী। এবার সংসদ নেতা শেখ হাসিনা, উপনেতা সাজেদা চৌধুরী, বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ। গতবার শেষের দিকে শিরিন শারমিন চৌধুরী স্পিকার ছিলেন। ভোটে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছাড়া সাধারণত স্পিকার হন না। এবার মহিলা সদস্য না হওয়ায় শিরিন শারমিন চৌধুরীর স্পিকার হওয়ায় অসুবিধা আছে। তবে আওয়ামী লীগ নেত্রী সব করতে পারেন। শিরিন শারমিনের দক্ষতা নিয়ে আমার কোন প্রশ্ন নেই। আমার প্রশ্ন, সমান নারী-পুরুষের দেশে পুরুষের স্থান কোথায়? এসবের পরও কিন্তু সাধারণ নারীরা বড় বেশি বঞ্চিত। তা ছাড়া পরোক্ষ নির্বাচিত স্পিকার পৃথিবীর কোথাও তেমন মর্যাদা পায় না। স্পিকারের পদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ, অভিভাবকের পদ। তাই তার বয়স, গ্রহণযোগ্যতা, মেধা ও মননের দিকে অবশ্যই দৃষ্টি রাখা দরকার।
স্বৈরাচার পতনের পর একটা গণতান্ত্রিক রূপ নেয়ায় দেশবাসী বেশ ভালই ছিল। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ঘাড়ে সরাসরি যতক্ষণ জাতীয় পার্টি ও জামায়াত না ছিল ততক্ষণ মোটামুটি একটা গণতান্ত্রিক চরিত্র ছিল। কিন্তু এখন আর সেসবের কোন বালাই নেই। যুদ্ধাপরাধী বিএনপির গলার মালা, স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের বরমালা। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের কপাল! নির্বাচনের আগে বারবার বলেছেন এমন নির্বাচনে গেলে দেশবাসী থুতু দেবে। মনোনয়নপত্র জমা দিয়েই প্রত্যাহারের আবেদন করেছিলেন। কোন আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত আবার কোন আসনে জামানত হারিয়েছেন। দুনিয়ায় এমনও হয় যে, একটায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী, অন্যটায় জামানত হারায়? এটাও কি মেনে নিতে হবে? একজন নারীর পুরুষ হওয়া এমন অবাস্তবতা মেনে নিলেও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বৃহত্তর রংপুরে জামানত হারিয়েছেন- এটা মেনে নেয়া খুব একটা সহজ নয়। এরশাদের আগে এ অঞ্চলে কোন স্বৈরশাসক ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর রাজনীতি করতে পারেননি। এরশাদ ভালভাবেই করেছেন। তিনবার একাধিক আসনে জয়ী হয়েছেন যা আর কেউ হননি। সেই ভদ্রলোক যে একটি আসনে এবার জামানত খোয়ালেন, একটু লজ্জাও পেলেন না, নাকি সব লজ্জা চুলায় গেছে? তিনি তো নির্বাচন করতে চাননি, মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করতে চেয়েছেন, তাহলে এ প্রতারণা কেন? শপথ কেন? দূত হওয়ায় গর্বের কি? তার স্ত্রী গৃহপালিত বিরোধী দলের নেতা, তিনি গৃহপালিত দূত। বর্তমানে তার যে ভাবমূর্তি তাতে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হয়ে দেশের ভাবমূর্তি মন্দ ছাড়া ভাল কিছু করতে পারবেন বলে মনে হয় না। বুঝতে পারছি না আগামী দিনে কপালে কি আছে! আগে ছিল মহাজোট, এখন ভোটহীন সরকার। এটা জোট না আওয়ামী লীগ কিছু বোঝা যাচ্ছে না। তবে নির্বাচনের আগে সংবিধানের অজুহাত দিয়েছেন, এখন বলছেন ৫ বছরের জন্যই তারা নির্বাচিত। ভাল কথা, ৫ কেন, ২৫ বছর থাকলেই বা দোষ কি? ২০৪১ সাল পর্যন্ত তো নানা কথা বলছেন। তবে সমস্যা হলো মানুষ ভাবে এক, আল্লাহতায়ালা করেন আরেক। আল্লাহর মাইর দুনিয়ার বাইর। যখন মারে কেউ আর সোজা হতে পারে না। সংবিধান থেকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করে যত সব অরাজকতা সৃষ্টি করা হয়েছিল তার শেষ পরিণতি ৫ তারিখের নির্বাচন। সেই নির্বাচনে যে সহিংসতা ঘটেছে বাংলাদেশে আর কখনও তেমন হয়নি। হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টানের হাজার বছরের সহাবস্থান। সেটাকে ধ্বংস করার একটা চেষ্টা এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে। হাজার বছর আমরা একত্র বাস করেছি। আর্য-অনার্য-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান একসঙ্গে বাস করতে আমাদের কোন অসুবিধা হয়নি। মুসলমান বাদশাহর হিন্দু সেনাপতি, মন্ত্রী। হিন্দু রাজার মুসলমান সেনাপতি মন্ত্রী কোন অসুবিধা হয়নি। ভাই ভাই হিসেবে আমরা পাশাপাশি বাস করেছি। ’৪৭-এ ইংরেজ ভারত ত্যাগের সময় আমাদের অসামপ্রদায়িক সমাজ ভেঙে সামপ্রদায়িকতার বীজ বুনে যায়। যাতে আমরা মাঝেমধ্যেই আক্রান্ত হই। কখনও স্তিমিত আবার কখনও আগ্নেয়গিরির মতো সামপ্রদায়িক লাভা উদগীরণ শুরু হয়।
অতি সমপ্রতি নির্বাচন নিয়ে সে রকম দাঙ্গা-হাঙ্গামার বহিঃপ্রকাশ দিনাজপুরের কর্নাই, ঠাকুরগাঁওয়ের গড়েয়া, যশোরের অভয়নগর এলাকায়। দাঙ্গা-হাঙ্গামার কথা পত্রপত্রিকায় ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচারিত হয়। তাই গত ২২শে জানুয়ারি দিনাজপুরের কর্নাই এবং ঠাকুরগাঁওয়ের গড়েয়া, গোপালপুরের দেওনিয়া বাজার গিয়েছিলাম। দিনাজপুরের কর্নাইয়ে এবং ঠাকুরগাঁওয়ের দেওনিয়া বাজারের ঘটনা প্রায় একই। দিনাজপুর থেকে ঠাকুরগাঁওয়ের পথে হাজী দানেশ প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় পাড় হয়ে পশ্চিমে কয়েক কিলোমিটার গেলেই কর্নাই প্রাথমিক বিদ্যালয়- সেখানেই ভোটকেন্দ্র। কর্নাই ভোটকেন্দ্রের পাশে ৪০-৫০ গজও হবে না কয়েকটি দোকান পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। দোকানের পিছে খুবই দরিদ্র কয়েক ঘর সাহা শুঁড়ি সমপ্রদায়ের বাস। সেখানে একটি মাটির ঘরের চাল পুড়েছে, ঘরের একমাত্র দরজা-জানালা অক্ষত। ৪০-৪৫ ফুট লম্বা মাটির ঘর মাঝামাঝি দেয়াল দিয়ে ৩-৪টি রুম করা হয়েছে। লম্বা ১০-১২ ফুট, পাশ ৮ ফুট। চারদিকে দেয়াল ঠিক আছে শুধু উপরের চাল পুড়েছে। কি করে যে দরজা-জানালা চারপাশের সব কিছু ঠিকঠাক রেখে ওভাবে পুড়লো বারবার দেখেও বুঝতে পারলাম না। পোড়া ঘরে ঢুকতেই ঘরের মালিক সন্তোষ চন্দ্র সাহা বললো, মালিরা চাপিরা এই কাজ করেছে। প্রথম বুঝতে পারিনি মালি, চাপি কি। পরে বুঝলাম মালদার থেকে যারা এসেছে তারা মালি, আর চাঁপাই নবাবগঞ্জ থেকে যারা এসেছে তারা চাপি। আমাদের কাছে কিছু শীতবস্ত্র ছিল যা ডা. জাহিদ এবং প্রিয় নুরুল ফজল বুলবুল এক্সিম ব্যাংকের পক্ষ থেকে দিয়েছিল। কষ্ট হলেও প্রায় ১৫ হাজার টাকা গাড়ি ভাড়া দিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম। ছিন্নমূল মানুষের কাড়াকাড়ির জন্য সেগুলো ভালভাবে দিতে পারিনি। কিন্তু যা পেরেছি তাতেই আনন্দে মনটা ভরে গেছে। সেখান থেকে গিয়েছিলাম কাঞ্চন নদীর পাড়ে মহাদেবপুর। যেখানে মালি আর চাপিরা থাকে। কর্নাইতে হিন্দু, মহাদেবপুরে মুসলমানের বাস। যাওয়ার সময় কেউ কেউ বলছিল সেখানে যাবেন না। আমি যখন যাই তখন আসরের সময় ছিল। মহাদেবপুরে ৩টা মসজিদ- সাহাপাড়া, বকরীপাড়া আর কাঞ্চন নদীর ধার জামে মসজিদ। মসজিদ ভাঙচুর করা হয়েছে, ইটপাটকেল পড়ে আছে। ঘটনার ১৮ দিন পরও মহাদেবপুরের অনেক বাড়ির দরজা-জানালা, চুলা ও অন্যান্য জিনিসপত্র ভাঙা পড়ে থাকতে দেখেছি। নামাজ পড়েছি মসজিদের সামনে বারান্দায় ঝাড়ু দিয়ে। ইটপাটকেল তখনও ছড়ানো-ছিটানো ছিল। ১৮ দিন আজান হয়নি। শতকরা ৯০ জন মুসলমানের দেশে মহাদেবপুর গ্রামে একটি পুরুষও নেই, এমনকি নামাজ পড়ার ইমাম, আজান দেয়ার মুয়াজ্জিন নেই। ৪০-৪৫ বছরের শহর বানু, স্বামী বেলাল হোসেন, ইসমত আরাসহ ১০-১২ জন বারবার পায়ে পড়তে চেষ্টা করছিল। ছোট-বড় যেই হোক কেউ পায়ে পড়তে নিলে এখন আর ভাল লাগে না, বুক কেঁপে ওঠে। অনেক বলে কয়ে অনুনয় বিনয় করে তাদের থামানো হয়েছিল। গ্রামে একটা পুরুষ নেই। খুব অবাক হয়েছি, যৌথবাহিনীর সঙ্গে গিয়ে সন্ত্রাসীরা তাদের বাড়িঘর ভেঙেছে, ছোটখাটো লুটতরাজ করেছে সেসবের বিচারের কথা না বলে শুধু কান্নাকাটি করেছে ‘শান্তি চাই আর শান্তি চাই, স্বামী-সন্তান নিয়ে নিরাপদে থাকতে চাই’। মহাদেবপুর কাঞ্চন নদীর পাড়ে বিস্তীর্ণ এলাকায় আলুর চাষ। পুরুষ নেই, কেউ আলু তুলতে পারছে না। আর ক’দিন গেলেই পচে যাবে। দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁও ডিসি, এসপিদের চিঠি দিয়েছি শান্তিপ্রিয় মানুষদের যেন হয়রানি না করা হয়। আর কিছু না হোক কয়েক শ’ হেক্টর জমির আলু তুলে যেন বাজারে সরবরাহ করা হয়। আর যদি নেয়াহেতই তা না পারেন তাহলে নিজেরাই গিয়ে মহাদেবপুরবাসীর ক্ষেতের আলু তুলে নেন। জানি না আমার কথা শুনবেন কিনা। শোনা না শোনা তাদের ব্যাপার। আমার কাজ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া।
কর্নাই ও মহাদেবপুরের ঘটনায় আমি কোন সামপ্রদায়িকতা দেখিনি। ঘটনাটি সম্পূর্ণই রাজনৈতিক। আরও অবাক হয়েছি, ভোটকেন্দ্রের ৪০-৫০ গজের মধ্যে বেলা ১টায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী উপস্থিত থাকতে আগুন দেয়া হলো কি করে? আরও মজার ব্যাপার, সেনাবাহিনীর ভ্রাম্যমাণ টিম কর্নাইয়ের এ ঘটনার সময় শামীম, পিতা লুৎফর রহমান, আরেকজন কামরুল ওরফে কামু, পিতা বাটু মিয়াকে হাতেনাতে ধরে দু’জনকে থানায় সোপর্দ করেছিল। যাদের গভীর রাতে দিনাজপুরের বর্তমান হুইপ আমাদের নেতা রহিম ভাইয়ের ছেলে ইকবালুর রহিম ছাড়িয়ে এনেছে। তাই এ ব্যাপারে আর কি বলি? শত বছর যারা পাশাপাশি বাস করছে, কর্নাইয়ের যে ক’টি দোকানপাট পুড়েছে, একটা হিন্দুর দোকান পাশের দু’টি মুসলমানের। ২২-২৩টা দোকানের মধ্যে মুসলমানদের ১৫-১৬টা। কোন দিন ওই এলাকায় সামপ্রদায়িক অশান্তি হয়নি। কিন্তু এখন হিন্দু মুসলমান ভাগ হয়ে গেছে। অথচ উভয় সমপ্রদায়ই খুব গরিব। ফেরার পথে মাগরিবের নামাজের সময় পার হয়ে যাচ্ছিল। তাই হাজী দানেশ প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. ওয়াজেদ মিয়া হলের পাশে রাস্তায় নামাজ আদায় করেছি। সেখানেই শুনলাম ছাত্রলীগ, যুবলীগ চাঁদাবাজদের কারণে ঠিকাদাররা ৩-৪ মাস ড. ওয়াজেদ মিয়া হলের কাজ করতে পারেনি। কথাটা শুনে আসমান থেকে পড়েছিলাম। ভাল করে খোঁজখবর নিয়ে জানলাম ঘটনা সত্য। অবাক হয়ে গেলাম, দেশের প্রধানমন্ত্রীর স্বামীর নামে একটি হলের নির্মাণকাজ তারই দলের চাঁদাবাজদের জন্য যদি ৩-৪ মাস বন্ধ থাকে তাহলে অন্যদের উপায় কি? দেশের আইনশৃঙ্খলা কত উন্নত! ভাবতে ভাবতে ঠাকুরগাঁওয়ের পথে চলেছিলাম। কখন গভীর রাত হয়ে গিয়েছিল বুঝতে পারিনি।

রাজনীতি- ‘অল্প’ নয়, আরও গণতন্ত্র by এ কে এম জাকারিয়া

Monday, January 27, 2014

নির্বাচন না হওয়ার চেয়ে কম অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনও ভালো—এ ধারণা বোস্টন গ্লোব-এর নিয়মিত কলাম লেখক ও মার্কিন রাজনৈতিক বিশ্লেষক টম কিনের। একেবারেই মার্কিন অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও সিনেটের আগাম বিশেষ নির্বাচনে ভোটারদের কম অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে তিনি এ মন্তব্য করেছেন এক কলামে।
লিখেছেন, একেবারে গণতন্ত্র না পাওয়ার চেয়ে অল্প একটু গণতন্ত্র পাওয়াও ভালো। বাংলাদেশের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পক্ষে এটা একটা ভালো যুক্তি হতে পারে! নির্বাচন না হওয়ার চেয়ে তো অন্তত একটি নির্বাচন হয়েছে, গণতন্ত্র রক্ষা পেয়েছে। কিন্তু আমরা কি এখন ‘অল্প’ গণতন্ত্র নিয়েই খুশি থাকার অবস্থায় আছি, নাকি আমাদের চাওয়াটা বেড়েছে? ২০০৮ সালে সব পর্যায়ে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার হিসেবে আওয়ামী লীগ গত মেয়াদের পাঁচ বছর পুরো করেছে। ২০১৪ সালের নির্বাচন আরও গ্রহণযোগ্য হবে বা এর মধ্য দিয়ে যে নতুন সরকার এসেছে তাদের কাছ থেকে তো আরও গণতন্ত্রই স্বাভাবিক চাওয়া! গণতন্ত্রের পথে এগোনো মানে ‘অল্প’ গণতন্ত্র নয়, আরও গণতন্ত্র, বেশি গণতন্ত্র।

কেনের মত হচ্ছে, একটি মন্দ নির্বাচনের বিকল্প নির্বাচন না-হওয়া হতে পারে না। সে দিক থেকে দেখলে নির্বাচন না-হওয়ার চেয়ে ৫ জানুয়ারি অন্তত একটি ‘মন্দ’ নির্বাচন হয়েছে। মানে মন্দের মধ্যে ভালো। কিন্তু এ ধরনের ‘বিতর্কিত’ বা ‘একতরফা’ মন্দ নির্বাচন সব সময়ই আগাম নির্বাচনের পরিস্থিতি তৈরি করে। নব্বইয়ের পর এ ধরনের একটি মন্দ নির্বাচনের নজির ছিল ’৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন। সেই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে সরকার হয়েছিল, তা টিকে ছিল দুই মাসের কম।
ইতিহাসের কখনো হুবহু পুনরাবৃত্তি হয় না। এবারের ৫ জানুয়ারির মন্দ নির্বাচনের পর এই নির্বাচন বর্জন ও প্রতিরোধের ডাক দিয়েছিল যে দল ও জোটটি, তার নেতা বেগম খালেদা জিয়াও কার্যত এই সরকারকে ‘পুনরায় জাতীয় সংসদ নির্বাচন’ অনুষ্ঠানের জন্য এর চেয়ে বেশি সময় দিয়ে ফেলেছেন। ‘অতি দ্রুত সংলাপে বসে নির্দলীয় সরকারের অধীনে অতি দ্রুত নির্বাচন’ দেওয়ার যে আহ্বান তিনি ২০ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশে জানিয়েছেন, তাতেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। খালেদা জিয়ার আহ্বানে সাড়া দিয়ে সরকার যদি আজই সংলাপ শুরু করে এবং ‘পুনরায় একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন’ অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নেয়, তার পরও মাস ছয়েক সময় লেগে যাওয়ার কথা। ২০১৪ সালের মন্দ নির্বাচন যে সরকার উপহার দিয়েছে তা যে ’৯৬-এর মন্দ নির্বাচনে ক্ষমতায় আসা সরকারের চেয়ে দীর্ঘস্থায়ী হবে, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
এবারের মন্দ নির্বাচনের আরও একটি দিক হচ্ছে, এই নির্বাচনের পর দেশে এখন একটি স্বস্তির পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ’৯৬-এর মন্দ নির্বাচনের পর পরিস্থিতি ছিল পুরো উল্টো। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সবগুলো প্রধান বিরোধী দলের হরতাল ও আন্দোলনের কর্মসূচিতে তখন দেশ কার্যত অচল হয়ে পড়েছিল। এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। ২০১৪ সালের ‘বিতর্কিত’ ও ‘একতরফা’ নির্বাচনের পর আমরা দেখলাম বেগম খালেদা জিয়া পতন না-হওয়া পর্যন্ত বর্তমান ‘অবৈধ সরকারের’ বিরুদ্ধে ‘শান্তিপূর্ণ’ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। দেশে আপাতত হরতাল বা অবরোধের মতো কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি নেই। নির্বাচন বর্জন বা প্রতিরোধে সহিংস ও নাশকতার কৌশল নিয়ে পুরো ব্যর্থ দলটির নেতা খালেদা জিয়ার সামনে অবশ্য এখন ‘শান্তিপূর্ণ’ কর্মসূচি না দেওয়ার কোনো বিকল্প আছে বলেও মনে হয় না।
তবে নির্বাচন-পরবর্তী এই যে স্বস্তির পরিস্থিতি, এটা নিয়ে নতুন সরকারের স্বস্তি বা আত্মতৃপ্তির কোনো সুযোগ নেই। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার নিয়ে দেশে যে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করেছিল জামায়াত-শিবির ও হেফাজত, তার সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮-দলীয় জোটের হরতাল-অবরোধ ও নাশকতার কর্মসূচি যুক্ত হওয়ায় দেশবাসী এক দমবন্ধ অবস্থার মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। যেভাবেই হোক, এই অসহনীয় পরিস্থিতি থেকে মুক্তি চাইছিল জনগণ। একটি মন্দ নির্বাচন হলেও ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সেই পরিস্থিতি থেকে দেশবাসীকে মুক্তি দিয়েছে। জনগণের মধ্যে স্বস্তির ভাবটি সে কারণেই।
কিন্তু এ ধরনের স্বস্তির পরিস্থিতি অনির্দিষ্ট সময় বা বর্তমান সরকারের পাঁচ বছর মেয়াদ পর্যন্ত বজায় থাকবে—এমন আশা নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কিছু নয়। ২০০৬ সালে বিএনপি সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে যে সহিংস পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, তাতে এক-এগারোর সরকারে স্বস্তি খুঁজে পেয়েছিল জনগণ। সেই স্বস্তি যে বেশি দিন থাকেনি, তা নিশ্চয়ই আমরা ভুলে যাইনি। সেনাসমর্থিত সেই সরকারের ভুল ও বাড়তি নানা পদক্ষেপ জনগণ মেনে নেয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সামান্য একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেই ক্ষোভের বিস্ফোরণ টের পেয়েছিল এক-এগারোর সরকার। সবকিছু থেকে সরে এসে সেই সরকারকে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দিকেই পুরো মনোযোগ দিতে হয়েছিল এবং তা অনুষ্ঠান করে মানে মানে সরে যেতে হয়েছিল।
তবে আবারও বলি, ইতিহাসের কখনো হুবহু পুনরাবৃত্তি হয় না আর বর্তমান সরকার এক-এগারোর সরকারের মতো অনির্বাচিত সরকারও নয়, একটি মন্দ নির্বাচনের মাধ্যমে হলেও নির্বাচিত সরকার। কিন্তু বর্তমান স্বস্তির পরিস্থিতি যে বেশি দিন থাকবে না, সেটা অনুমান করা যায়। আর দল হিসেবে বিএনপি বর্তমানে যে কোণঠাসা অবস্থায় আছে, সেই পরিস্থিতির আদৌ কোনো পরিবর্তন হবে না—এমন ভাবাটাও বোকামি হবে। বিএনপি নিশ্চয়ই ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করবে। আগামী ১৯ ফেব্রুয়ারি দেশের ৯৭টি উপজেলায় যে নির্বাচন হতে যাচ্ছে, সেখানে বিএনপি জোরেশোরেই নামছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। এই স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলকে সক্রিয় করার চেষ্টা করবে বিএনপি, এই নির্বাচনের ফলাফলও একটি বড় প্রভাব ফেলবে সামনের দিনগুলোর রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশে। ৫ জানুয়ারির মন্দ নির্বাচন তাই যেকোনো সময়ে আগাম নির্বাচনের পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে।
আমরা মানি বা না মানি নির্বাচন বা দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বিষয়টি এখন আর কোনো অর্থেই ‘অভ্যন্তরীণ’ ব্যাপার নয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মুখে যতই ‘দেশটি ও দেশটির জনগণের নিজস্ব ব্যাপার’ ধরনের শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করুক, বাস্তবে বিষয়টি তা নয়। যদি সেটাই হতো, তবে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এত দৌড়ঝাঁপের কোনো ব্যাপার ছিল না। আর আওয়ামী লীগও নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে বা এখন ভাবমূর্তি উদ্ধারে এত তত্পর হতো না অথবা ঘরে বসে কর্মসূচি ডেকে বিএনপি নির্বাচনের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মুখাপেক্ষী হয়ে বসে থাকত না।
বিশ্বের যেকোনো দেশের নির্বাচনেরই এখন একটি আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা লাগে। জিম্বাবুয়ে, তাজিকিস্তান বা ঘানা, টোগো বা মালির মতো দেশগুলো অবশ্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এসব গ্রহণযোগ্যতার ধার না ধেরেই টিকে আছে। কিন্তু এসব দেশ আন্তর্জাতিক মহলে আর যা-ই হোক, ‘গণতান্ত্রিক দেশ’ হিসেবে খুব একটা বিবেচিত হয় না। বাংলাদেশ কি এই দেশগুলোর কাতারে নাম লেখাতে চায়? এই দেশগুলোর নামের সঙ্গে বাংলাদেশের নাম উচ্চারিত হোক সেটাই কি আমাদের চাওয়া?
৫ জানুয়ারির মন্দ নির্বাচন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। নির্বাচন পর্যবেক্ষণের বিষয়টি সবাই এড়িয়ে গেছে। নির্বাচনের পর বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশ ও সংস্থাগুলো বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করে যাওয়ার প্রসঙ্গটি ছিল ঠিকই, কিন্তু নির্বাচন নিয়ে অসন্তুষ্টির বিষয়টিও ছিল পরিষ্কার। সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে দ্রুত সমঝোতায় আসা, জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন হয়, এমন একটি নির্বাচনের দ্রুত ব্যবস্থা করা—এটাই ছিল প্রতিক্রিয়াগুলোর মূল সুর। মানে ৫ জানুয়ারি যে নির্বাচন হয়েছে, তার বদলে একটি অংশগ্রহণমূলক ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাওয়া।
৫ জানুয়ারি যে নির্বাচন হয়েছে তা বাংলাদেশের একটি বাস্তবতা। নির্বাচন না হওয়ার চেয়ে হয়তো মন্দ নির্বাচন ভালো। আবার মন্দ নির্বাচন আগাম নির্বাচনের পরিস্থিতি তৈরি করে এবং সেটি একটি ভালো নির্বাচনের সম্ভাবনাকেই সামনে নিয়ে আসে। অল্প গণতন্ত্র নয়, আমাদের চাওয়া বেশি গণতন্ত্র। মন্দ নির্বাচন নয়, আমাদের চাওয়া ভালো নির্বাচন। আগামী নির্বাচন যখনই হোক, সেটি হতে হবে আরও গণতন্ত্রের নির্বাচন!
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com

রাজসিক সংবর্ধনা- বর্ণিল তোরণ আর সোনার নৌকা by আলী ইমাম মজুমদার

অতীতে ভূরি ভূরি হয়েছে। সমালোচনা যতই হোক, থেমে থাকেনি। তবে আশা করা হয়েছিল, এবার অন্তত এসব কিছু পরিহার করা হবে। কেননা, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি স্বাভাবিক পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়নি, এটা সবার জানা।
জনগণের প্রকৃত অংশগ্রহণ কী পরিমাণ ছিল, তা দেশ কিংবা বিদেশেও অনেকের জানা। তাই নির্বাচনের পর সরকার গঠনে কিছুটা ইতিবাচক দিক নজরে এল। দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ কতিপয় নেতা সরকারে যোগ দিলেন। বাদ পড়লেন বিতর্কিত কিছু ব্যক্তি। এতে ধারণা করা হয়, সরকার নির্বাচনের ঘাটতিটি আপাতত সুশাসনের মাধ্যমে পূরণের চেষ্টা করবে। অবশ্য উল্লেখ করা আবশ্যক যে সুশাসন গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রতিকল্প নয়; বরং পরিপূরক।

যে কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত, তা উপেক্ষা করার নয়। প্রথমটি যমুনার অপর পারের এক জেলার। একজন সাংসদ মন্ত্রী হয়ে আসছেন নিজ এলাকায়। এক শ মাইক্রোবাস আর তিন হাজার মোটরসাইকেলের বহর তাঁকে স্বাগত জানায়। স্বাগত জানায় প্রায় দেড় শ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা। তীব্র ঠান্ডায় তারা তিন ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ছিল। বন্ধ করে দেওয়া হয় সেদিনের পাঠক্রম। অপর ঘটনাটিও একই জেলার। একজন সাংসদকে সংবর্ধনার খবর। তিনি নির্বাচিত হওয়ার পর শপথ নিয়ে ঢাকা থেকে ফিরলেন। খবরে প্রকাশ, নিজ এলাকার কাছাকাছি আসতেই শতাধিক গাড়ি আর সহস্রাধিক মোটরসাইকেলের বহর যুক্ত হয় তাঁর গাড়ির সামনে-পেছনে। রাস্তার দুই পাশে স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকেরা প্ল্যাকার্ড, ব্যানার, ফেস্টুন আর রঙিন বেলুন হাতে নিয়ে তাঁকে স্বাগত জানান। নির্মিত হয়েছে শতাধিক তোরণ।
হরতাল-অবরোধে ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনা গোল্লায় যেতে বসেছে। সেখানে এক দিনের জন্য হলেও মন্ত্রী-সাংসদকে স্বাগত জানাতে ছাত্র-শিক্ষকেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছেড়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবেন কেন? এভাবে স্বাগত না জানানোর জন্য সরকারের নির্দেশও রয়েছে। তা সত্ত্বেও এমনটা ঘটে চলছে। পরবর্তী ঘটনাটি ব্রহ্মপুত্রতীরের একটি জেলা শহরের। সেই শহরের একজন নেতা মন্ত্রী হয়ে জেলা সদর সফরে আসছেন। জানা যায়, শহরেই নির্মিত হয়েছে গোটা ত্রিশেক তোরণ। তার বেশ কয়েকটি বর্ণিল ও ব্যয়বহুল। তদুপরি আগমনপথে অন্যান্য স্থানেও এ ধরনের সংবর্ধনার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
কেউ মন্ত্রিত্ব পেলে তাঁকে সংবর্ধনা জানানোর রেওয়াজ রয়েছে। তবে তাতে এরূপ রাজসিক আয়োজন করার আবশ্যকতা আছে কি? সরকারের টাকায় না হলেও যারা এগুলো করছে, তারা বিনিয়োগের সহস্র গুণ কড়ায়-গন্ডায় উশুল করে নেবে। সেটা নেবে মন্ত্রী-সাংসদদের আশীর্বাদধন্য হয়ে। অপর খবরটি হচ্ছে, দেশের উত্তরাঞ্চলের একটি উপজেলায় একজন সাংসদকে সংবর্ধনায় উপহার দেওয়া হয়েছে সোনার নৌকা। সমালোচনা হলে আয়োজকেরা বলেন, নৌকাটি রুপার। সোনার প্রলেপ দেওয়া হয়েছে মাত্র। হতেও পারে। তবে রাজসিক মানসিকতার প্রমাণ কিন্তু এতেই মেলে। ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন। তবে ইদানীং প্রতিদিনই ঘটে চলছে দেশের বিভিন্ন স্থানে।
অনেক মন্ত্রী-সাংসদ এ ধরনের সংবর্ধনা নেন। আর তা আয়োজন করতে কর্মী-সমর্থকদের একটি অংশ নেমে পড়েন চাঁদা তোলায়। কেউ বা ভবিষ্যতের বিনিয়োগ হিসেবে শুরুতে নিজেই দেন কিছু অর্থ। তদুপরি একেবারে হাতের মুঠোয় থাকা ছাত্র-শিক্ষকদের ব্যবহার করেন বিবেচনাহীনভাবে। এ ধরনের রাজসিক চমকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী-সাংসদ তৃপ্ত হতে পারেন। তবে তাঁদের জনপ্রিয়তার ব্যারোমিটার নিম্নমুখী হওয়ারই কথা। কেননা, আমাদের মতো দেশে সাধারণ মানুষের কোনো ভাষা নেই। তবে তারা সব বোঝে। আর সুযোগ পেলেই ব্যালটের মাধ্যমে এই রাজসিক বিলাসিতার বিরুদ্ধে মতামত দেয়। অতীতে তা-ই দিয়েছে। উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে যে চারদলীয় জোট সরকারের সময়েও একই ধরনের রাজসিক সংবর্ধনা মানুষ দেখেছে। জেনেছে একজন সাংসদের সোনার মুকুট উপহার নেওয়ার কাহিনি। সময়ে ব্যালটে এর মীমাংসা করেছে তারা।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক। ২০০৯-এর সূচনায় যে ধরনের জনসমর্থন নিয়ে সরকার গঠিত হয়েছিল, ২০১৪-তে তা কিন্তু হয়নি। এই সরকারের সাংবিধানিক ও আইনি বৈধতা থাকলেও রাজনৈতিক বিবেচনায় অসম্পূর্ণতার ভার বহন করতে হবে। আর তা দেশে ও বিদেশে সমান তালে। যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট, ব্রিটিশ হাউস অব কমন্স আর ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্ট—সবাই আমাদের গেল নির্বাচনটি নিয়ে ব্যক্ত করেছে হতাশা। আশঙ্কা করছে গণতান্ত্রিক পথ থেকে আমাদের বিচ্যুতির। ক্ষোভ প্রকাশ করেছে সহিংসতা ও অস্থিরতার বিষয়ে। আশা প্রকাশ করেছে, রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে একটি বিশ্বাসযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্পর্কে সমঝোতার। এই দুটি মহাদেশ আমাদের রপ্তানির প্রধান বাজার। আমাদের উন্নয়নের অংশীদার বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ আর এডিবির ওপরও তাদের রয়েছে প্রভূত প্রভাব। সুতরাং বাংলাদেশকে নিজ স্বার্থেই এসব মতামত বিবেচনায় নিতে হবে।
অন্যদিকে, জাতীয় বাস্তবতার বিষয়টিও উপেক্ষা করার নয়। নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতিতে দেশে আপাতত একটি স্বস্তির পরিবেশ বইছে। তবে একে স্থায়ী ও নিশ্চিত বলে ধরে নেওয়া যৌক্তিক হবে না। এটা সবাই জানেন ও বোঝেন যে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটকে নির্বাচনে আনতে সরকার তেমন কোনো জোরদার উদ্যোগ নেয়নি। তেমনি তারাও নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আগ্রাসী প্রচেষ্টা গ্রহণ করেনি। ফলে ভোটারের উপস্থিতি খুব কম হলেও নির্বাচনটি হয়ে গেছে। তবে এটাকে জনসমর্থিত বলার সুযোগ নেই।
উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক যে সুশাসন জনগণের অধিকার। আর সেই অধিকার নিকট অতীতে আমরা ভোগ করতে পারিনি। চারদলীয় জোট সরকারের শাসনে হতাশ হয়ে ২০০৮-এর শেষে মহাজোটকে মহাবিজয় দিয়েছিল দেশবাসী। কিছু ক্ষেত্রে সাফল্য থাকলেও তারা সুশাসন দিতে পারেনি জাতিকে। দলীয়করণ, মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিচারহীনতা, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি ইত্যাদি মিলিয়ে তাদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ প্রায় কাছাকাছি। নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা সম্পর্কে সমঝোতার অভাব গেল নির্বাচনটিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তাই এই নির্বাচনে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে, এটা জোর দিয়ে বলার সুযোগ নেই। অন্যদিকে যারা নির্বাচন বর্জন করে বিভিন্ন কর্মসূচি দিয়েছিল, তাদের পক্ষে জনমত সৃষ্টি হয়েছে—এমন ভাবারও কোনো কারণ নেই। বিশেষ করে তাদের লাগাতার সহিংস কর্মসূচি সরকারের বিরুদ্ধে দাবি করা হলেও অনেক ক্ষেত্রে এটাকে জনগণের বিরুদ্ধে বলেই মনে করলে দোষ দেওয়া যাবে না। তাই জনগণ অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু নির্বাচন চাইলেও তাদেরই সমর্থন দেবে, এমনটা জোর দিয়ে বলা যায় না।
এ ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারের সুযোগ রয়েছে তাদের নিকট অতীতের কালিমা দূর করে আবার জনগণের মুখোমুখি হওয়ার। সরকারের গঠনকাঠামো কিছু ব্যতিক্রম ব্যতিরেকে অনেকটা সেই প্রত্যাশারই ইঙ্গিত দেয়। এমনকি সরকারের একজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী নয়াদিল্লি সফরকালে গণমাধ্যমের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, অদূর ভবিষ্যতে নির্বাচনের সম্ভাবনা নেই। তাঁর ভাষায়, ‘ভোট নয়। আমাদের মাথায় এখন সুশাসনের চিন্তা। হিংসা থামানোর চিন্তা।’ এ চিন্তা বাস্তবায়ন করতে হলে সরকারকে দলমত-নির্বিশেষে যেকোনো হিংসাত্মক কর্মসূচির বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে তা করতে গিয়ে একের পর এক মামলার আসামিকে এখানে-সেখানে নিহত অবস্থায় উদ্ধার হলে হিংসার রাজনীতি আবারও জোরদার হতে পারে। পাশাপাশি বাদ দিতে হবে বিরোধী দলের নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে বিঘ্ন সৃষ্টি। বিবেচনায় রাখা দরকার, প্রকৃতপক্ষে প্রধান বিরোধী দল সংসদে নেই। তবে মাঠে আছে। আর তার কলেবর উপেক্ষা করার নয়। সংসদের বিরোধী দলটি সরকারের রাজনৈতিক কর্মসূচির জন্য কতটা সহায়ক হবে, এটা বোধগম্য হচ্ছে না। যা-ই হোক, প্রধান বিরোধী দলের অস্তিত্বকে উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই।
বলা হয়তো যায়, মন্ত্রী-সাংসদেরা কেউ কেউ জাঁকজমকপূর্ণ সংবর্ধনা নিলেই সুশাসনের ঘাটতি হতে পারে না। বক্তব্যটি সমর্থনযোগ্য নয়। কেননা, এর ব্যয় জনগণই কোনো না কোনোভাবে মেটাবে। তদুপরি স্কুল-কলেজ বন্ধ করে ছাত্র-শিক্ষকদের এতে অংশ নিতে উৎসাহ দেওয়া সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। আবার জানা যায়, ইতিমধ্যে সাংসদদের কেউ কেউ খবরদারি শুরু করেছেন স্থানীয় প্রশাসনসহ বিভিন্ন সংস্থার ওপর। এগুলো অনুচিত, অযাচিত আর সুশাসনের প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে। একজন সাংসদ তো একটি সিটি করপোরেশনের ময়লা নিষ্কাশন স্থানটি বন্ধ করে দেওয়ার ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন। কোনো বিকল্প পরামর্শ তিনি দেননি। তাঁর বিরুদ্ধে কতিপয় পরিবহন কোম্পানির অভিযোগ ছিল চাঁদাবাজির। এখন তাদের বিরুদ্ধেই চাঁদাবাজির মামলা হচ্ছে। বিচ্ছিন্নভাবে হলেও এ ধরনের ঘটনা সুশাসনের অন্তরায়। আর সরকারের সদিচ্ছার পরিপন্থী। যাঁরা এগুলো করছেন, তাঁরা তাঁদের নির্বাচনে নৈতিক ভিত্তিটা কি তলিয়ে দেখেছেন? দেখলে এমন হওয়ার কথা ছিল না। তাঁরা না দেখলেও কিন্তু দেশ-বিদেশের অনেকেই তা দেখছেন। আর সবাইকে দীর্ঘকাল অব্যাহতভাবে উপেক্ষা করা যাবে না।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com

রাজনীতি ও নির্বাচন- আস্থা ফিরবে কীভাবে by এম সাখাওয়াত হোসেন

বহু নাটকের মধ্যে সমাপ্ত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কে কী পেল তার অঙ্ক অনেকে করছেন। নির্বাচন কমিশনের হিসাবমতে, দুই কোটির কম ভোটার ভোট দিয়েছেন। অবশ্য অনেকেই এই তথ্যের সঙ্গে একমত নন।
অনেকের ধারণা, ১০-১২ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছেন। কিছু কেন্দ্রে কোনো ভোটই পড়েনি। ফলে দেশের নির্বাচনব্যবস্থায় কিছুটা হলেও যে শৃঙ্খলা ফিরে এসেছিল, এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তা বহুলভাবে ব্যাহত হয়েছে। ভবিষ্যতে সুস্থ ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে যথেষ্ট বেগ পেতে হবে।

নির্বাচন নিয়ে যত বিতর্ক এবং পশ্চিমা দেশের কাছে যতই অগ্রহণযোগ্য হোক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে একটি নির্বাচন হয়েছে এবং তা সংবিধান ও আইনের দৃষ্টিতে বৈধ। ফলাফলের গেজেট প্রকাশ ও দশম জাতীয় সংসদের সদস্যদের শপথ গ্রহণ সম্পন্ন করার পর এক নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। ২৯ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরু হওয়ার কথা। নবম সংসদের মেয়াদকালেই দশম জাতীয় সংসদকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের বিষয়টি কতখানি সংবিধানসম্মত বা আইনানুগ, তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। নবম সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া এই সরকারকে অবৈধ আখ্যা দিয়েছেন। আর ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা, বিশিষ্ট নাগরিক ফজলে হাসান আবেদ বলেছেন, ‘এ সরকার অবৈধও নয়, বৈধও নয়’।
বর্তমান সরকার ‘জনপ্রিয়’ হিসেবে জোর গলায় দাবি করতে পারে তেমন নয়। কাজেই প্রধানমন্ত্রী যেখানে এই নির্বাচনকে সংবিধান ও নিয়মরক্ষার নির্বাচন বলেছেন, সেখানে সরকারের মেয়াদ নিয়ে অহেতুক অতি মন্তব্য জনগণের কাছে শ্রুতিমধুর হওয়ার কথা নয়। দলমত-নির্বিশেষে এসব ভোটার, বিশেষ করে তরুণ ভোটারদের মধ্যে একটা হতাশা বিরাজমান। কারণ, তাঁরা সংসদ ও সরকার গঠনে অংশ নিতে পারেননি। সিংহভাগ ভোটারের ভোটদানে বিরত থাকা বা ভোট দিতে না পারার মধ্য দিয়ে গঠিত সংসদ ও সরকার প্রকৃতপক্ষে জনসমর্থিত বলে বিবেচিত হয় না।
এ ধরনের সরকার আগাম নির্বাচনের মাধ্যমে আবার জনমত নিয়ে থাকে বা নেওয়া বাঞ্ছনীয় হয়ে পড়ে। নবগঠিত সরকার কখন এ ধরনের জনমত পুনর্যাচাইয়ে যাবে তা দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দুটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করবে বলে মনে হয়। সরকারের ওপর বিদেশের চাপ রয়েছে, তবে এটা ছাড়াও যে দুটি অভ্যন্তরীণ কারণে সরকার আগাম নির্বাচনে যেতে পারে, তার একটি রাজনৈতিক ও অপরটি নৈতিক। ২৮টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। ভবিষ্যতে তাদের রাজনৈতিক চাপ কতখানি সরকারকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধ্য করবে, তা পরের বিষয়। রাজনৈতিক চাপ তেমন অনুভব না করলেও নৈতিক কারণেও সরকার আগাম বা মধ্যবর্তী নির্বাচনের মাধ্যমে সুবিধামতো সময়ে, জনসমর্থন পুনর্যাচাই করতে পারে।
শুধু বিরোধী ১৮-দলীয়জোট নয়, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছে আরও প্রায় ডজন খানেক দল, যার মধ্যে রয়েছে এ অনেক পুরোনো দলও। এমন অনেক দলও রয়েছে, যেগুলো একটি আদর্শিক ভাবধারায় পরিচালিত। তবে বৃহত্তর দল হিসেবে সর্বাগ্রে রয়েছে তিনবার ক্ষমতায় থাকা বিএনপি, যার রয়েছে ব্যাপক জনসমর্থন ও অনুসারী। মূলত গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবিতে ১৮-দলীয় জোটের সঙ্গে কিছু কিছু বিষয়ে মতানৈক্য থাকলেও আদর্শভিত্তিক এবং অন্যান্য নির্বাচন বর্জনকারী দল একটি নিরপেক্ষ ব্যবস্থার তত্ত্বাবধানে স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবিতে নিজেদের অবস্থান থেকে বৃহত্তর বিরোধী দল বিএনপির সমমনা ছিল। লক্ষণীয় বিষয় হবে আগাম নির্বাচনের দাবিতে এসব দলের অবস্থান।
বিএনপি এ নির্বাচন শুধু বর্জনই করেনি, প্রতিহত করার ঘোষণাও দিয়েছিল। এ ঘোষণার পর ১৮-দলীয় জোটের অন্যতম শরিক দল জামায়াতে ইসলামীর সহিংস তৎপরতাও নির্বাচন প্রতিহত করতে পারেনি। তবে শুধু সহিংসতার মাধ্যমে অতীতেও যেমন এ ধরনের নির্বাচন বানচাল করা যায়নি, তেমনিভাবে এ নির্বাচনও বানচাল করা যায়নি। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তাতে জনসম্পৃক্ততা যত কমই থাকুক না কেন। নির্বাচন কেমন হয়েছে তার সাক্ষী এ দেশের জনগণ। বিরোধী দলের আন্দোলনে জনসম্পৃক্ততা দৃশ্যত কম থাকলেও একাধিক কারণে ভোটার সমাগম হয়নি। তবে সর্বক্ষেত্রে সহিংসতা একমাত্র কারণ নয়। এর উদাহরণ ঢাকা শহর, যেখানে নির্বাচনের দিনের পরিস্থিতি দেশের যেকোনো স্থানের তুলনায় শান্তিপূর্ণ থাকলেও ভোটের বাক্সে আশাতীত ভোট পড়েনি। এর কারণ বিরোধী বিএনপিসহ সিংহভাগ দলের নির্বাচন বর্জনও বটে।
তাই বিরোধী দলের আন্দোলন যে একেবারেই ব্যর্থ হয়েছে এমনটা বলা যায় না। ১৪৭টি আসনে যেভাবে, যে পরিবেশে, ব্যাপক কারচুপির অভিযোগের এবং অব্যবস্থার মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে আমাদের দেশে ক্ষমতায় থেকে সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার মতো পরিস্থিতি, পরিবেশ ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি এখনো গড়ে ওঠেনি। কাজেই বিশ্বাসযোগ্য নিরপেক্ষ পরিবেশ না হলে ভবিষ্যতে ভোটারদের আস্থা ফেরানো কঠিন হবে।
বিরোধী জোট হয়তো সহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে এ নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পেরেছে কিন্তু বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে কাছে টানতে পারেনি। জনগণকে আন্দোলনে তেমনভাবে উদ্বুদ্ধ করতেও পারেনি। দেশের আপামর জনসাধারণ সহিংস নয় অহিংস আন্দোলন সমর্থন করতে পারে আর বিরোধী দল যদি সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে চায় তবে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে, তাদের উদ্বুদ্ধ করে আন্দোলন করতে হবে। আর আন্দোলন করতে হবে নিজস্ব ক্ষমতায়।
গত কয়েক মাসের আন্দোলন দমাতে সরকারের তরফ থেকে বলপ্রয়োগ করা হয়েছে যে মাত্রায়, সহিংসতাও ওই মাত্রায় হয়েছে। এ সহিংসতার শিকার শুধু রাজনৈতিক কর্মীই হননি, হয়েছে জনগণ, যাঁরা রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয় নন। মানুষ আগুনে পুড়েছে। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সাধারণ মানুষের জানমালের। দুঃখের বিষয়, এর দায়দায়িত্বের কথা উঠলে দোষারোপের বিতর্ক উঠে আসে। যেহেতু বিরোধী জোট সহিংস আন্দোলনে ছিল, তাই দৃশ্যত দায়দায়িত্বের সিংহভাগ তাদের ওপরই বর্তায়। অপরদিকে সরকারি দল বা জোট বিরোধী জোটকে দায়ী করেও ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলছে কিন্তু প্রকৃত দোষী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে এখনো সুষ্ঠু তদন্তের ব্যবস্থা করেনি।
তবে সবচেয়ে দুঃখজনক ও নিন্দনীয় হলো নির্বাচনোত্তর সহিংস কর্মকাণ্ড। নির্বাচনের বলি হতে হয়েছে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের। শুধু ভোট দেওয়া না-দেওয়ার অথবা নির্ধারিত ব্যক্তিকে ভোট দেওয়াসহ অন্যান্য কারণে গরিব শ্রেণীর এসব বাংলাদেশিকে এবং ভোটারের নিরাপত্তা বিধানে ব্যর্থ হয়েছে সরকার ও নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব ভোটারদের সুরক্ষা করা। শুধু ভোট দেওয়ার জন্য কাউকে নির্যাতন যাতে না করা হয়, তার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিশাল আয়োজন করা হয়। এ ধরনের ঘটনা নতুন নয়। কেন এবারও এ ধরনের ঘটনা ঘটল তার সঠিক কারণ নিরূপণ করা জরুরি। এ ধরনের হামলা শুধু দোষারোপ অথবা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য ব্যবহার না করে একটি বিচার বিভাগীয় নিরপেক্ষ তদন্তের ব্যবস্থা করা হোক।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার এবং নির্বাচনের বাইরে থাকা বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ভবিষ্যতে কোন পথে হাঁটবে, তা হয়তো দু-এক মাসের মধ্যেই পরিষ্কার হবে । তবে এ কথা ঠিক যে দুই পক্ষই জনসম্পৃক্ততা হারিয়েছে এবং এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় হবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ও শান্তিপূর্ণ একটি নির্বাচন। এ জন্য দরকার জাতীয় সংলাপের, যার মাধ্যমে সুদূরপ্রসারী ব্যবস্থা গ্রহণ করা সময়ের দাবি। আর প্রয়োজন ভেঙে পড়া নির্বাচনব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। অন্যথায় জনগণ নির্বাচন-প্রক্রিয়ার ওপর ফের আস্থা হারিয়ে ফেলবে। নির্বাচন যেভাবেই হোক, একটি সরকার গঠিত হয়েছে এবং এ সরকারের অন্যান্য দায়িত্বের মধ্যে প্রধান দায়িত্ব হবে জনগণের মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং নির্বাচন-প্রক্রিয়ায় আস্থা ফিরিয়ে আনা।

এম সাখাওয়াত হোসেন: সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক।
hhintlbd@yahoo.com

অরণ্যে রোদন- ভাই, শান্তিতে থাকতে দিন by আনিসুল হক

Sunday, January 26, 2014

গণতন্ত্রে তাঁরাই দেশ শাসন করবেন, যাঁরা জনগণের প্রতিনিধি। জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটে, এমন একটা নির্বাচনের মাধ্যমে এই প্রতিনিধিরা ক্ষমতায় আসবেন। তাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের সমর্থনধন্য হবেন।
কাজেই একটা সুন্দর, অর্থবহ, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন গণতন্ত্রের একেবারে প্রাথমিক ও মৌলিক একটা শর্ত। তবে, এটা অন্যতম শর্ত। গণতন্ত্রের আরও কতগুলো শর্ত আছে, লক্ষণ আছে।

আবার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থিতরাই কেবল দেশ চালাবে, গণতন্ত্রে তা সব সময় না-ও হতে পারে। দুটো উদাহরণ দিই। যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় বুশ যখন দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হন, বাস্তবে তিনি তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে বেশি ভোট পেয়েছিলেন কি না, এটা নিয়ে বিতর্ক আছে। কিন্তু যেহেতু আদালত তাঁকে নির্বাচিত ঘোষণা করেছেন, তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্র্যাটরা এবং তাঁদের দেশের সব মানুষ এটা মেনে নিয়েছিলেন। শুধু তাঁদের দেশের মানুষ মেনে নিয়েছিলেন, তা-ই বা বলি কেন, সারা পৃথিবীর মানুষ হাসিমুখে কিংবা বেজারমুখে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। আর ভারতে তো হরহামেশাই কম ভোট পাওয়া দল বেশি ভোট পাওয়া দলের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় বসছে। সেটা পরোক্ষভাবে জনগণের সমর্থন নিয়েই ক্ষমতায় বসা। যাঁদের জনগণ ভোট দিয়েছেন, তাঁরা আবার সরকার গঠনের জন্য আমাদের সমর্থন দিয়েছেন, কাজেই আমরাই জনপ্রতিনিধি।
এই নিয়ে নৈতিক বিতর্ক তোলা যায়, জনগণ কেন তোমাদেরই সরাসরি ভোটে জেতাল না, কাজেই তোমরা সেই রকম সরাসরি প্রতিনিধি কি? কিন্তু সেই প্রশ্ন কেউ তোলে না। কারণ, আবারও বলি, নির্বাচন গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান ও মৌলিক শর্ত বটে, কিন্তু গণতন্ত্রের আরও অনেক অপরিহার্য উপাদান আছে, যেগুলো না থাকলে নির্বাচিত সরকার থাকলেও আসলে গণতন্ত্র থাকে না।
সেসব উপাদানের এক নম্বর হলো আইনের শাসন। তা ছাড়া আছে সরকারের জবাবদিহি, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, দক্ষতা ও কার্যকারিতা। আরেকটা হলো, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা। একটা দেশে সব মানুষই সমান। রাজার ছেলেরও এক ভোট, রাস্তার ধারে পড়ে থাকা খঞ্জ ভিখারিরও এক ভোট। রাজার ছেলের যতটুকু মর্যাদা, রাখাল বালকেরও ততটুকু মর্যাদা। সেটা কে বিধান করবে? প্রতিনিয়তই তো আমরা দেখি, রাষ্ট্র, ক্ষমতাবানেরা কীভাবে ব্যক্তি মানুষের অধিকার খর্ব করে থাকে। তাহলে এই বিপুল বিশাল ক্ষমতাসম্পন্ন রাষ্ট্র বা ক্ষমতাদর্পী শাসকদের হাত থেকে একজন ব্যক্তি মানুষ কীভাবে তার অধিকার রক্ষা করে চলবে? কে তাকে রক্ষা করবে? আইনের শাসন, স্বাধীন ও দক্ষ বিচার বিভাগ এবং স্বাধীন সংবাদমাধ্যম। কাজেই আমরা যদি গণতন্ত্র নিশ্চিত করতে চাই, তাহলে ভোটের সঙ্গে সঙ্গে অবশ্যই আমাদের বলতে হবে আইনের শাসনের কথা, মানবাধিকারের কথা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা, বলতে হবে জবাবদিহির কথা।
এই সরকার যে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে, সেটা বিতর্কিত। কিন্তু বাস্তবে এটাই এখন আমাদের সরকার। বিএনপিকেও এখন বলতে হচ্ছে এই সরকারের সঙ্গেই আলোচনায় বসার কথা।
আমেরিকানরা নির্বাচনের পরে প্রথম যে বিবৃতি দিয়েছিল, তাতেও আছে সরকারের সঙ্গেই আলোচনায় বসার সুপারিশ। অর্থাৎ এখন এই সরকারই সরকার, এই সরকার নিয়েই আমাদের চলতে হবে। সেটা কত দিন, তা উভয় পক্ষ মিলেমিশে ঠিক করুক। কিন্তু সরকার কী? সরকার তো আমাদের ম্যানেজার। একটা ফ্ল্যাট ভবনে একটা সমিতি থাকে। এক বছর বা দুই বছরের জন্য তারা নির্বাচিত হয়। কেউ সভাপতি, কেউ সাধারণ সম্পাদক, কেউ বা কোষাধ্যক্ষ। আমরা তাঁদের চাঁদা দিই। তার বিনিময়ে তাঁরা কোনো মাসোহারা নেন না, তাঁরা আমাদের বিদ্যুৎ বা পানির দেখভাল করেন, আমাদের নিরাপত্তা দেন, রক্ষণাবেক্ষণ করেন, মাঝেমধ্যে আমাদের বিনোদনেরও ব্যবস্থা করেন। মেয়াদ শেষে নতুন কর্মকর্তা নির্বাচিতও হন। তাঁরা আবার কর্মচারী নিয়োগ দেন, সুপারভাইজার, দ্বাররক্ষী। এখন এই সমিতির কর্মকর্তারা যদি এই দারোয়ান বা হিসাবরক্ষক নিয়োগের সময় ঘুষ খান, কিংবা নিজের ঘরে বেশি বিদ্যুৎ নিয়ে অন্যদের কম দেন, তাহলে কি হবে? এটা কখনো হয় না।
সরকারের কাজ আমাদের নিরাপত্তা দেওয়া, অবকাঠামোসুবিধা দেওয়া, আমাদের অর্থনীতি চালানো। তারা দেশের মালিক নয়। তারা দেশের সেবক। এই কথাটা সরকারি লোকজন ভুলে যান। কথায় আছে, ক্ষমতা মানুষকে নীতিভ্রষ্ট করে; চূড়ান্ত ক্ষমতা নীতিভ্রষ্ট করে চূড়ান্তভাবে। সারা পৃথিবীতে চিরটাকাল দুর্নীতি ছিল। কোথাও খুব কম, কোথাও খুব বেশি। আমাদের দেশে মোগল আমলে দুর্নীতি হয়েছে, ইংরেজ আমলে হয়েছে, পাকিস্তানি আমলে হয়েছে, স্বাধীন বাংলাদেশে তো দুর্নীতির সাগরে আমরা ভাসছি। কিন্তু এটার তো লাগাম টানতে হবে। কে টানবে? রাষ্ট্র যখন মানবাধিকার লঙ্ঘন করে, কে তাকে বাধা দেবে? বিচার বিভাগকে দিতে হবে, নাগরিকদের উচ্চকণ্ঠ হতে হবে, সংবাদমাধ্যমকে সজাগ ও সোচ্চার থাকতে হবে। এই সরকারকে তা-ই বলব, যেহেতু আপনারা একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে এসেছেন, আপনাদের উচিত খুব বেশি করে ভালো ভালো কাজ করা। দেশের মানুষের উপকার হয়, এই রকম কাজ করতে থাকুন, যেন আপনার মেয়াদটার কথা স্বস্তির সঙ্গে স্মরণ করতে পারে।
সেখানেই আসবে মানবাধিকার রক্ষার কথা। সত্য বটে, গত এক বছরে সারা দেশে প্রতিক্রিয়াশীল চক্র, জামায়াত-শিবির বা এই ধরনের শক্তি যেভাবে হামলা করেছে, যেভাবে বাড়িঘর পুড়িয়েছে, যেভাবে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর, ব্যববসায়িক স্থাপনা, উপাসনালয়ে আক্রমণ করেছে, যেভাবে আওয়ামী লীগারদের হত্যা করেছে, তার প্রতিবিধানে শক্ত হওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। কিন্তু এই শক্ত হওয়াটাও যেন হয় আইনানুগ। মানবাধিকারের সব বিধান ও রীতি মান্য করে। দরকার হলে দ্রুত বিচার আদালত করুন, দরকার হলে স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল করুন। তবু স্বচ্ছ বিচারের মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করুন। কোনো অপরাধী যেন ছাড়া না পায়, তেমনি বিনা বিচারে কাউকে যেন শাস্তি দেওয়া না হয়।
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। নইলে ভবিষ্যতে ইতিহাস ক্ষমা করবে না। আমরা জানি, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার নামে কীভাবে দাঙ্গায় উৎসাহিত করা হয়েছে, কীভাবে ব্যক্তি অধিকার ক্ষুণ্ন করা হয়েছে। এসব সংবাদমাধ্যমের পক্ষে কথা বলার মুখ তারা নিজেরাই রাখেনি। তবু যা করা হয়, তা যেন করা হয় আইনের মাধ্যমে। এবং আইনটি যেন কালো আইন না হয়। এই সরকার যেহেতু একপক্ষীয় নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত, কাজেই সরকারকেই এসব দিক সবচেয়ে বেশি সতর্কতার সঙ্গে রক্ষা করতে হবে। সাধারণত মানুষের প্রবণতা থাকে, যে নৈতিক দিক থেকে দুর্বল অবস্থানে থাকে, সে তত বলপ্রয়োগের চেষ্টা করে। এ বিষয়ে সরকারের নীতিনির্ধারক মহলকে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে সবচেয়ে বেশি।
আর দেশে ও বিদেশে একটা ব্যাপক জনমত তৈরি হয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর মতো মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি, যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে গঠিত দল, যারা গণ-আন্দোলনের নামে নৃশংসতার প্রমাণ একাত্তরে রেখেছে, এখনো রেখে চলেছে, তাদের বর্জন করার। এখন বিএনপি নেতারা তো টেলিভিশনগুলোর টক শোয় এবং সভা-সেমিনারে প্রকাশ্যে বলছেন, সরকার নিষিদ্ধ করে দিক জামায়াতে ইসলামীকে। এই সুযোগ রাজনৈতিক নেতাদের গ্রহণ করতে হবে। বিএনপিকে বুঝতে হবে, জামায়াতের ভোট কখনো সাত থেকে আট শতাংশের বেশি ছিল না, সর্বশেষ জরিপে তা নেমে এসেছিল তিন শতাংশের নিচে। কিন্তু বিএনপি বা আওয়ামী লীগ যখন নির্বাচনে জয়লাভ করে, একাই জয়লাভ করার মতো জনপ্রিয়তা অর্জন করে বলেই করে।
এই কলামে বহুবার বলা হয়েছে, বিএনপির উচিত সংবিধানের অধীনেই নির্বাচনে যাওয়া। বলা হয়েছিল, আওয়ামী লীগ চায় না বিএনপি নির্বাচনে আসুক, সে কারণেই তো বিএনপির নির্বাচন করা উচিত। আজ প্রমাণিত হয়েছে, শুধু আওয়ামী লীগ চায়নি বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণ, কথা শুধু এতটুকুনই সত্য নয়, সত্য এই যে বিএনপিও চায়নি নির্বাচনে অংশ নিতে। তারা ভেবেছিল, তারা সরকারকে টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে তারপর নির্বাচনে যাবে। কিন্তু গণ-আন্দোলনের বদলে আমরা দেখেছি পেট্রলবোমা। আগুনে পুড়ে যাওয়া মানুষ, গরু ও সবজির ট্রাক। দেখেছি হাজার হাজার গাছ কেটে ফেলা। দেরিতে হলেও বিএনপির নেতারা বুঝেছেন, সন্ত্রাস করে আন্দোলনে জেতা যায় না।
এটা আরও আগে বুঝলে তাঁরাও ভালো করতেন, দেশের ও মানুষের এত ক্ষতিও হতো না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের অগ্নিঝরা ভাষণে একবারও আক্রমণ করার কথা বলেননি, সবচেয়ে কঠিন কথাটা ছিল, আমরা ভাতে মারব, পানিতে মারব। কিন্তু দম ফেলার আগেই তিনি বলেছেন, তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে ফিরে যাও, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। আর বলেছেন, এই বাংলার হিন্দু, মুসলিম, বাঙালি, অবাঙালি সবাইকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের, আমাদের যেন বদনাম না হয়।
কথা শেষ করি। সরকারকে বলতে চাই, অপরাধীদের কঠোর হাতে দমন করুন, কিন্তু মানবাধিকার রক্ষা করে চলুন, বিচার বিভাগ ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত রাখুন, ভালো ভালো কাজ করে দেশের মানুষের চিত্ত জয়ের চেষ্টা করুন। বিএনপিকে বলব, যুদ্ধাপরাধী স্বাধীনতাবিরোধীদের বর্জন করুন। অহিংস আন্দোলন করুন। আন্দোলনে জনগণের অংশগ্রহণ বৃদ্ধির চেষ্টা করুন। আমরা সামনের দিনগুলোয় শান্তি চাই। এখন যেখানেই যাই, সবাই বলে, ভাই, আমাদের শান্তিতে থাকতে দিন, কাজ করতে দিন, ছেলেমেয়েদের স্কুলে যেতে দিন, চলাফেরা করতে দিন। জনগণের এই চাওয়াটা যেন আমাদের নেতাদের কানে পৌঁছায়।
আনিসুল হক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক।

ভারতে কংগ্রেস যুগের অবসান ঘটতে চলেছে?

আগামী মে মাসে ভারতের লোকসভা নির্বাচন নিয়ে এখন থেকেই জনমত সমীক্ষায় যে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে তাতে ভারতে কংগ্রেস যুগের অবসান ঘটতে চলেছে। উত্থান হওয়ার সম্ভাবনা হিন্দুত্ববাদী শক্তি বিজেপির।
ভারতীয় গণমাধ্যমের বিভিন্ন সমীক্ষায় জানানো হয়েছে, কংগ্রেসের প্রতি মানুষের আস্থা তলানিতে ঠেকেছে এবং একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে উঠে আসছে বিজেপি। জনমত সমীক্ষার ইঙ্গিত সব সময় যে মিলে যায় তা মোটেই নয়। বরং নানা সমীকরণের অঙ্কে অনেক কিছুরই বদল ঘটতে পারে শেষ মুহূর্তে। তবে এখন পর্যন্ত সমীক্ষার ফলাফলে বিজেপি শিবিরে খুশির হওয়া। বিজেপির নেতৃত্বাধীন জোট জাতীয় গণতান্ত্রিক জোট এনডিএ পেতে পারে সর্বোচ্চ ২৩১টি আসন ও সর্বনিম্ন ২০৭টি আসন। অন্যদিকে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন জোট ইউপিএ জোট অনেক কষ্টে পৌঁছতে পারে ১০০টিতে। সর্বোচ্চ পেতে পারে ১২৭টি আসন। কংগ্রেসের পক্ষে যে দুই অঙ্ক পেরোনো সম্ভব নয়- তা ফুটে উঠেছে সব ক’টি সমীক্ষাতেই। তবে তাৎপর্যপূর্ণভাবে আগামী লোকসভায় তৃতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে উঠে আসতে পারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস। সমীক্ষাগুলোর অনুমান, তৃতীয় বৃহত্তম দল হওয়ার দৌড়ে জয়ললিতার এআইডিএমকে, মায়াবতীর বিএসপি ও মুলায়মের সমাজবাদী পার্টিকে পেছনে ফেলে দিতে পারেন মমতা। লোকসভা নির্বাচনে দিল্লির বাইরে উত্তর প্রদেশ, হরিয়ানা, চন্ডীগড় ও মহারাষ্ট্রের মতো রাজ্যে কয়েকটি করে আসন পেলেও অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টি দেশজুড়ে তেমন প্রভাব ফেলতে পারবে না। আইবিএন-সিএসডিএস-এর সমীক্ষা যেখানে এনডিএ জোটের সম্ভাব্য আসন হিসেবে জানানো হয়েছে ২১১ থেকে ২৩১, সেখানে ইন্ডিয়া টুডে-সি ভোটার জানাচ্ছে, এই জোট পেতে পারে ২০৭ থেকে ২১৭টি আসন। আর এবিপি আনন্দ-এসি নিয়েলসেনের সমীক্ষা বলছে, এনডিএ জোট পেতে পারে ২২৬টি আসন। এর মধ্যে বিজেপি একাই পেতে পারে ২১০টি আসন। অন্য দিকে কংগ্রেস-সহ ইউপিএ জোটকে আইবিএন-সিএসডিএস-এর সমীক্ষা ১০৭ থেকে ১২৭টি আসন দিলেও ইন্ডিয়া টুডে-সি ভোটার দিয়েছে ৯৮ থেকে ১০৮টি আসন। আর এবিপি আনন্দ-এসি নিয়েলসেনের বক্তব্য, ইউপিএ জোট পেতে পারে মাত্র ১০১টি আসন। এবিপি আনন্দ-এসি নিয়েলসেনের দাবি, তৃণমূল কংগ্রেস পেতে পারে ২৬টি আসন। বামরা সব মিলিয়ে ৩০টি আসন জিততে পারে। এবিপি আনন্দ-এসি নিয়েলসেনের সমীক্ষায় ৫৩ শতাংশই জানিয়েছেন, তারা মোদীকে প্রধানমন্ত্রীর গদিতে চাইছেন। রাহুলকে চাইছেন মাত্র ১৫ শতাংশ মানুষ। ৫ শতাংশ মানুষ জানিয়েছেন, তারা অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চান। তবে, রাজধানী দিল্লিতে ৪১ শতাংশ মানুষ জানিয়েছেন, তারা কেজরিওয়ালকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চান। তিনটি সমীক্ষার ফলে আসন সংখ্যায় কম-বেশি ফারাক থাকলেও একটি বিষয় স্পষ্ট যে, বিজেপি ও কংগ্রেসের মধ্যে প্রায় ১০০টি আসনের ফারাক থাকতে পারে। কিন্তু ভারতে কে সরকার গঠন করবে? লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজন ২৭২-এর ম্যাজিক সংখ্যা। বর্তমান চেহারার এনডিএ এতগুলো আসন পাবে বলে কোন সমীক্ষাই মনে করছে না। যা থেকে স্পষ্ট, পাঁচ বছরের জন্য স্থায়ী সরকার গঠন করতে হলে বিজেপিকে নতুন শরিকের সন্ধানে নামতেই হবে। সেক্ষেত্রে, বিজেপি যদি এনডিএ জোটের পুরনো শরিকদের ফিরিয়ে আনতে পারে এবং টিআরএস-এর মতো নতুন শরিকদের কাছে টানতে পারে, তা হলে মোদীর প্রধানমন্ত্রীর গদিতে বসা হয়তো কঠিন হবে না। তবে এবারের লোকসভা নির্বাচনের পরে সরকার গঠনে আঞ্চলিক দলগুলোর ভূমিকা যে বিশেষ গুরুত্ব পাবে- সেটা এক প্রকার নিশ্চিত।
 
Support : Dhumketo ধূমকেতু | NewsCtg.Com | KUTUBDIA @ কুতুবদিয়া | eBlog
Copyright © 2013. Edu2News - All Rights Reserved
Template Created by Nejam Kutubi Published by Darianagar Publications
Proudly powered by Dhumketo ধূমকেতু