গণতন্ত্রে তাঁরাই দেশ শাসন করবেন, যাঁরা জনগণের প্রতিনিধি। জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটে, এমন একটা নির্বাচনের মাধ্যমে এই প্রতিনিধিরা ক্ষমতায় আসবেন। তাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের সমর্থনধন্য হবেন।
কাজেই একটা সুন্দর, অর্থবহ, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন গণতন্ত্রের একেবারে প্রাথমিক ও মৌলিক একটা শর্ত। তবে, এটা অন্যতম শর্ত। গণতন্ত্রের আরও কতগুলো শর্ত আছে, লক্ষণ আছে।
আবার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থিতরাই কেবল দেশ চালাবে, গণতন্ত্রে তা সব সময় না-ও হতে পারে। দুটো উদাহরণ দিই। যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় বুশ যখন দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হন, বাস্তবে তিনি তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে বেশি ভোট পেয়েছিলেন কি না, এটা নিয়ে বিতর্ক আছে। কিন্তু যেহেতু আদালত তাঁকে নির্বাচিত ঘোষণা করেছেন, তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্র্যাটরা এবং তাঁদের দেশের সব মানুষ এটা মেনে নিয়েছিলেন। শুধু তাঁদের দেশের মানুষ মেনে নিয়েছিলেন, তা-ই বা বলি কেন, সারা পৃথিবীর মানুষ হাসিমুখে কিংবা বেজারমুখে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। আর ভারতে তো হরহামেশাই কম ভোট পাওয়া দল বেশি ভোট পাওয়া দলের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় বসছে। সেটা পরোক্ষভাবে জনগণের সমর্থন নিয়েই ক্ষমতায় বসা। যাঁদের জনগণ ভোট দিয়েছেন, তাঁরা আবার সরকার গঠনের জন্য আমাদের সমর্থন দিয়েছেন, কাজেই আমরাই জনপ্রতিনিধি।
এই নিয়ে নৈতিক বিতর্ক তোলা যায়, জনগণ কেন তোমাদেরই সরাসরি ভোটে জেতাল না, কাজেই তোমরা সেই রকম সরাসরি প্রতিনিধি কি? কিন্তু সেই প্রশ্ন কেউ তোলে না। কারণ, আবারও বলি, নির্বাচন গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান ও মৌলিক শর্ত বটে, কিন্তু গণতন্ত্রের আরও অনেক অপরিহার্য উপাদান আছে, যেগুলো না থাকলে নির্বাচিত সরকার থাকলেও আসলে গণতন্ত্র থাকে না।
সেসব উপাদানের এক নম্বর হলো আইনের শাসন। তা ছাড়া আছে সরকারের জবাবদিহি, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, দক্ষতা ও কার্যকারিতা। আরেকটা হলো, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা। একটা দেশে সব মানুষই সমান। রাজার ছেলেরও এক ভোট, রাস্তার ধারে পড়ে থাকা খঞ্জ ভিখারিরও এক ভোট। রাজার ছেলের যতটুকু মর্যাদা, রাখাল বালকেরও ততটুকু মর্যাদা। সেটা কে বিধান করবে? প্রতিনিয়তই তো আমরা দেখি, রাষ্ট্র, ক্ষমতাবানেরা কীভাবে ব্যক্তি মানুষের অধিকার খর্ব করে থাকে। তাহলে এই বিপুল বিশাল ক্ষমতাসম্পন্ন রাষ্ট্র বা ক্ষমতাদর্পী শাসকদের হাত থেকে একজন ব্যক্তি মানুষ কীভাবে তার অধিকার রক্ষা করে চলবে? কে তাকে রক্ষা করবে? আইনের শাসন, স্বাধীন ও দক্ষ বিচার বিভাগ এবং স্বাধীন সংবাদমাধ্যম। কাজেই আমরা যদি গণতন্ত্র নিশ্চিত করতে চাই, তাহলে ভোটের সঙ্গে সঙ্গে অবশ্যই আমাদের বলতে হবে আইনের শাসনের কথা, মানবাধিকারের কথা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা, বলতে হবে জবাবদিহির কথা।
এই সরকার যে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে, সেটা বিতর্কিত। কিন্তু বাস্তবে এটাই এখন আমাদের সরকার। বিএনপিকেও এখন বলতে হচ্ছে এই সরকারের সঙ্গেই আলোচনায় বসার কথা।
আমেরিকানরা নির্বাচনের পরে প্রথম যে বিবৃতি দিয়েছিল, তাতেও আছে সরকারের সঙ্গেই আলোচনায় বসার সুপারিশ। অর্থাৎ এখন এই সরকারই সরকার, এই সরকার নিয়েই আমাদের চলতে হবে। সেটা কত দিন, তা উভয় পক্ষ মিলেমিশে ঠিক করুক। কিন্তু সরকার কী? সরকার তো আমাদের ম্যানেজার। একটা ফ্ল্যাট ভবনে একটা সমিতি থাকে। এক বছর বা দুই বছরের জন্য তারা নির্বাচিত হয়। কেউ সভাপতি, কেউ সাধারণ সম্পাদক, কেউ বা কোষাধ্যক্ষ। আমরা তাঁদের চাঁদা দিই। তার বিনিময়ে তাঁরা কোনো মাসোহারা নেন না, তাঁরা আমাদের বিদ্যুৎ বা পানির দেখভাল করেন, আমাদের নিরাপত্তা দেন, রক্ষণাবেক্ষণ করেন, মাঝেমধ্যে আমাদের বিনোদনেরও ব্যবস্থা করেন। মেয়াদ শেষে নতুন কর্মকর্তা নির্বাচিতও হন। তাঁরা আবার কর্মচারী নিয়োগ দেন, সুপারভাইজার, দ্বাররক্ষী। এখন এই সমিতির কর্মকর্তারা যদি এই দারোয়ান বা হিসাবরক্ষক নিয়োগের সময় ঘুষ খান, কিংবা নিজের ঘরে বেশি বিদ্যুৎ নিয়ে অন্যদের কম দেন, তাহলে কি হবে? এটা কখনো হয় না।
সরকারের কাজ আমাদের নিরাপত্তা দেওয়া, অবকাঠামোসুবিধা দেওয়া, আমাদের অর্থনীতি চালানো। তারা দেশের মালিক নয়। তারা দেশের সেবক। এই কথাটা সরকারি লোকজন ভুলে যান। কথায় আছে, ক্ষমতা মানুষকে নীতিভ্রষ্ট করে; চূড়ান্ত ক্ষমতা নীতিভ্রষ্ট করে চূড়ান্তভাবে। সারা পৃথিবীতে চিরটাকাল দুর্নীতি ছিল। কোথাও খুব কম, কোথাও খুব বেশি। আমাদের দেশে মোগল আমলে দুর্নীতি হয়েছে, ইংরেজ আমলে হয়েছে, পাকিস্তানি আমলে হয়েছে, স্বাধীন বাংলাদেশে তো দুর্নীতির সাগরে আমরা ভাসছি। কিন্তু এটার তো লাগাম টানতে হবে। কে টানবে? রাষ্ট্র যখন মানবাধিকার লঙ্ঘন করে, কে তাকে বাধা দেবে? বিচার বিভাগকে দিতে হবে, নাগরিকদের উচ্চকণ্ঠ হতে হবে, সংবাদমাধ্যমকে সজাগ ও সোচ্চার থাকতে হবে। এই সরকারকে তা-ই বলব, যেহেতু আপনারা একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে এসেছেন, আপনাদের উচিত খুব বেশি করে ভালো ভালো কাজ করা। দেশের মানুষের উপকার হয়, এই রকম কাজ করতে থাকুন, যেন আপনার মেয়াদটার কথা স্বস্তির সঙ্গে স্মরণ করতে পারে।
সেখানেই আসবে মানবাধিকার রক্ষার কথা। সত্য বটে, গত এক বছরে সারা দেশে প্রতিক্রিয়াশীল চক্র, জামায়াত-শিবির বা এই ধরনের শক্তি যেভাবে হামলা করেছে, যেভাবে বাড়িঘর পুড়িয়েছে, যেভাবে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর, ব্যববসায়িক স্থাপনা, উপাসনালয়ে আক্রমণ করেছে, যেভাবে আওয়ামী লীগারদের হত্যা করেছে, তার প্রতিবিধানে শক্ত হওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। কিন্তু এই শক্ত হওয়াটাও যেন হয় আইনানুগ। মানবাধিকারের সব বিধান ও রীতি মান্য করে। দরকার হলে দ্রুত বিচার আদালত করুন, দরকার হলে স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল করুন। তবু স্বচ্ছ বিচারের মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করুন। কোনো অপরাধী যেন ছাড়া না পায়, তেমনি বিনা বিচারে কাউকে যেন শাস্তি দেওয়া না হয়।
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। নইলে ভবিষ্যতে ইতিহাস ক্ষমা করবে না। আমরা জানি, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার নামে কীভাবে দাঙ্গায় উৎসাহিত করা হয়েছে, কীভাবে ব্যক্তি অধিকার ক্ষুণ্ন করা হয়েছে। এসব সংবাদমাধ্যমের পক্ষে কথা বলার মুখ তারা নিজেরাই রাখেনি। তবু যা করা হয়, তা যেন করা হয় আইনের মাধ্যমে। এবং আইনটি যেন কালো আইন না হয়। এই সরকার যেহেতু একপক্ষীয় নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত, কাজেই সরকারকেই এসব দিক সবচেয়ে বেশি সতর্কতার সঙ্গে রক্ষা করতে হবে। সাধারণত মানুষের প্রবণতা থাকে, যে নৈতিক দিক থেকে দুর্বল অবস্থানে থাকে, সে তত বলপ্রয়োগের চেষ্টা করে। এ বিষয়ে সরকারের নীতিনির্ধারক মহলকে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে সবচেয়ে বেশি।
আর দেশে ও বিদেশে একটা ব্যাপক জনমত তৈরি হয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর মতো মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি, যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে গঠিত দল, যারা গণ-আন্দোলনের নামে নৃশংসতার প্রমাণ একাত্তরে রেখেছে, এখনো রেখে চলেছে, তাদের বর্জন করার। এখন বিএনপি নেতারা তো টেলিভিশনগুলোর টক শোয় এবং সভা-সেমিনারে প্রকাশ্যে বলছেন, সরকার নিষিদ্ধ করে দিক জামায়াতে ইসলামীকে। এই সুযোগ রাজনৈতিক নেতাদের গ্রহণ করতে হবে। বিএনপিকে বুঝতে হবে, জামায়াতের ভোট কখনো সাত থেকে আট শতাংশের বেশি ছিল না, সর্বশেষ জরিপে তা নেমে এসেছিল তিন শতাংশের নিচে। কিন্তু বিএনপি বা আওয়ামী লীগ যখন নির্বাচনে জয়লাভ করে, একাই জয়লাভ করার মতো জনপ্রিয়তা অর্জন করে বলেই করে।
এই কলামে বহুবার বলা হয়েছে, বিএনপির উচিত সংবিধানের অধীনেই নির্বাচনে যাওয়া। বলা হয়েছিল, আওয়ামী লীগ চায় না বিএনপি নির্বাচনে আসুক, সে কারণেই তো বিএনপির নির্বাচন করা উচিত। আজ প্রমাণিত হয়েছে, শুধু আওয়ামী লীগ চায়নি বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণ, কথা শুধু এতটুকুনই সত্য নয়, সত্য এই যে বিএনপিও চায়নি নির্বাচনে অংশ নিতে। তারা ভেবেছিল, তারা সরকারকে টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে তারপর নির্বাচনে যাবে। কিন্তু গণ-আন্দোলনের বদলে আমরা দেখেছি পেট্রলবোমা। আগুনে পুড়ে যাওয়া মানুষ, গরু ও সবজির ট্রাক। দেখেছি হাজার হাজার গাছ কেটে ফেলা। দেরিতে হলেও বিএনপির নেতারা বুঝেছেন, সন্ত্রাস করে আন্দোলনে জেতা যায় না।
এটা আরও আগে বুঝলে তাঁরাও ভালো করতেন, দেশের ও মানুষের এত ক্ষতিও হতো না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের অগ্নিঝরা ভাষণে একবারও আক্রমণ করার কথা বলেননি, সবচেয়ে কঠিন কথাটা ছিল, আমরা ভাতে মারব, পানিতে মারব। কিন্তু দম ফেলার আগেই তিনি বলেছেন, তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে ফিরে যাও, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। আর বলেছেন, এই বাংলার হিন্দু, মুসলিম, বাঙালি, অবাঙালি সবাইকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের, আমাদের যেন বদনাম না হয়।
কথা শেষ করি। সরকারকে বলতে চাই, অপরাধীদের কঠোর হাতে দমন করুন, কিন্তু মানবাধিকার রক্ষা করে চলুন, বিচার বিভাগ ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত রাখুন, ভালো ভালো কাজ করে দেশের মানুষের চিত্ত জয়ের চেষ্টা করুন। বিএনপিকে বলব, যুদ্ধাপরাধী স্বাধীনতাবিরোধীদের বর্জন করুন। অহিংস আন্দোলন করুন। আন্দোলনে জনগণের অংশগ্রহণ বৃদ্ধির চেষ্টা করুন। আমরা সামনের দিনগুলোয় শান্তি চাই। এখন যেখানেই যাই, সবাই বলে, ভাই, আমাদের শান্তিতে থাকতে দিন, কাজ করতে দিন, ছেলেমেয়েদের স্কুলে যেতে দিন, চলাফেরা করতে দিন। জনগণের এই চাওয়াটা যেন আমাদের নেতাদের কানে পৌঁছায়।
আনিসুল হক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক।
0 comments:
Post a Comment