নির্বাচনের আগে ও পরে সারা দেশে যে সংঘাত, সহিংসতা, গাড়ি পোড়ানো, বাড়ি জ্বালানোর ঘটনা ঘটেছে; তার মূল হোতা যে জামায়াতে ইসলামী ও তার ছাত্রসংগঠন ছাত্রশিবির—এ ব্যাপারে কারও সন্দেহ নেই।
সরকারের দমন-পীড়নও এর পক্ষে কোনো সাফাই হতে পারে না। এসব নারকীয় ঘটনা অস্বীকার কিংবা সেই ঘটনাকে একমাত্র রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা—দুটোই রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের পরিচয়।
কিন্তু আমাদের প্রশ্ন হলো জামায়াতে ইসলামীর মতো একটি প্রায় গণবিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক দল, সারা দেশে যাদের জনসমর্থন এখন ৩ শতাংশে এসে ঠেকেছে; দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যার অংশ নেওয়ারই যোগ্যতা ছিল না এবং নবম জাতীয় সংসদে মাত্র দুটি আসন পেয়েছিল, সেই দলটি কীভাবে বছরজুড়ে এত সব তাণ্ডব ঘটাল? এটি কি নিছক বিএনপির সঙ্গে জোট বাধার জন্য, না আরও গভীরে এর কারণ লুকিয়ে আছে?
নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ কেন তাঁর নির্বাচনী এলাকার জামায়াতের একজন রুকনকে ফুলের মালাসমেত দলে নিয়ে এলেন, তার ব্যাখ্যা নেই। এখন যদি ওই রুকনের পথ অনুসরণ করে জামায়াতের সব নেতা-কর্মী আওয়ামী লীগে যোগদানের জন্য লাইন দেন, তাহলে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব কি তাঁদের সাদরে বরণ করে নেবে? ক্ষমতার রাজনীতির অঙ্ক এমন সরলরেখায় চালিত হলেও আদর্শের রাজনীতি বড় কঠিন। সেই কঠিনকে আওয়ামী লীগ ভালোবাসতে প্রস্তুত আছে বলে মনে হয় না।
বিএনপি জামায়াতে ইসলামী নামের দলটির সঙ্গে গাঁটছড়া রাখবে কি রাখবে না, সেটি তাদের একান্ত নিজস্ব বিষয়। কিন্তু বিএনপি নেতৃত্বকে মনে রাখতে হবে যে জামায়াতের কারণেই আজ তাদের মৌলবাদের দোসর, জঙ্গিবাদের সহযোগী এবং যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষকের যে বদনাম হয়েছে, তা ঘোচানো কঠিন হবে। মধ্যপন্থী বিএনপি কী করে একটি মৌলবাদী দলের সঙ্গে একীভূত হলো?
এসব কথা বললে নিশ্চয়ই বিএনপি-সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা হইচই করে উঠবেন এবং জানান দিতে চাইবেন, জামায়াতের সঙ্গে কেবল বিএনপিই জোটবদ্ধ হয়নি; আশির দশকে ও নব্বইয়ের দশকে আওয়ামী লীগও জোট বেঁধেছিল। আওয়ামী লীগ ছিয়াশি সালে ও পঁচানব্বই-ছিয়ানব্বইয়ে জামায়াতের সঙ্গে জোট বাঁধেনি। ছিয়াশিতে দলটি তার নিজের স্বার্থেই নির্বাচন করেছিল; যেমনটি করেছিল আওয়ামী লীগ। আর ১৯৯৫-৯৬ সালে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে যে আন্দোলন গড়ে তোলে, সেই আন্দোলনে জামায়াত ও জাতীয় পার্টিও যোগ দিয়েছিল রাজনৈতিক সুবিধা পেতে। এরশাদ আমলে তিন জোটের পাশাপাশি জামায়াত যে যুগপৎ আন্দোলন করেছিল, তার যোগসূত্রটি ছিল বিএনপিই। ১৯৯৫-৯৬ সালের আন্দোলনে জামায়াত সহযাত্রী হওয়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধের বিচারের আন্দোলনেও জোরালো ভূমিকা রেখেছিল। অন্যদিকে সেই আন্দোলনের কারণে বিএনপি সরকার জাহানারা ইমামসহ ২৪ বিশিষ্ট নাগরিকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করে। বিএনপির বাকি আমল সেই মামলা ঝুলে ছিল; বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে তা প্রত্যাহার করে নেয়।
এখন বিএনপি যদি যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রতি সমর্থন জানিয়ে জামায়াতের সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলন করত, তাহলে কারও কিছু বলার থাকত না। দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। বিএনপির নেতৃত্ব কেবল জামায়াতকেই আন্দোলনের সহযাত্রী করেনি, ১৮-দলীয় জোটে এমন কিছু ধর্মান্ধ দলকে যুক্ত করেছে, যারা কখনোই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিশ্বাস করে না। তারা বিশ্বাস করে হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফায়। আর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের শরিকেরা যত কমজোরিই হোক না কেন, তারা চিন্তাচেতনায় বামপন্থার অনুসারী। দুই জোটের মৌলিক পার্থক্যটাও এখানে। তবে আমরা একইভাবে সাবেক স্বৈরাচারের সঙ্গে আওয়ামী লীগের গাঁটছড়া বাঁধাকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারি না। বিগত নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে সবচেয়ে বিপদে ফেলেছে এরশাদ। তার অস্বাভাবিক কর্মকাণ্ডই নির্বাচনকে বেশি প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। রাজাকারের মতো স্বৈরাচারও গণতন্ত্রের জন্য বিপজ্জনক।
বিএনপির নেতৃত্ব স্বীকার করুক আর না করুক জামায়াত-শিবির যে তাদের ঘাড়ে বন্দুক রেখেই যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে সারা দেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়েছিল, তা দিবালোকের মতো স্পষ্ট। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকেই সরকার ও প্রশাসনকে অকেজো করে দিতে তারা একের পর এক বোমা হামলা চালিয়েছে, বাস-ট্রাক পুড়িয়েছে, পুলিশ খুন করেছে। বিএনপির মতো একটি নিয়মতান্ত্রিক দল কেন সেই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে নিজেদের যুক্ত করল সেটাই বড় প্রশ্ন। শত্রুর শত্রু যে সব সময় মিত্র হয় না, সেটা আবার প্রমাণিত হলো।
বিএনপির নেতৃত্বের ব্যর্থতা হলো, তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলনটিকে জামায়াত-শিবিরের যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধে পরিচালিত আন্দোলন থেকে পৃথক করতে পারেনি। যুদ্ধাপরাধের বিচার এবং জোটের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে জামায়াত-শিবিরের নাশকতায় তারা সমভাবে মৌনতা অবলম্বন করেছে। ক্ষেত্রবিশেষে বিএনপির স্থানীয় নেতা-কর্মীরাও যুক্ত হয়েছেন। নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতা তিন মাস ধরে চললেও জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাস ও নাশকতা চলেছে বছরজুড়েই; নির্বাচনের প্রাক-মুহূর্তে এবং পরে যা সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতায় রূপ নিয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত যে বাংলাদেশ, সেই বাংলাদেশে এ ধরনের সাম্প্রদায়িক সহিংসতা কীভাবে ঘটল? গণতন্ত্রের সঙ্গে স্বৈরতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের যতটুকু দূরত্ব, তার চেয়ে কম দূরত্ব নয় সাম্প্রদায়িকতার। আমাদের দুর্ভাগ্য, এক পক্ষ কেবল স্বৈরতন্ত্রকে গণতন্ত্রের বিপদ মনে করে, সাম্প্রদায়িকতাকে নয়। অন্য পক্ষ সাম্প্রদায়িকতাকে বিপদ ভাবলেও স্বৈরতন্ত্রের বিপদ আমলে নেয় না।
প্রধানমন্ত্রী অভয়নগরের মালোপাড়ায় আক্রান্ত ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উদ্দেশ করে বলেছেন, ‘এই মাটির সন্তান আপনারা। অধিকার নিয়েই আপনারা এখানে থাকবেন। কেউ আপনাদের অধিকার ছিনিয়ে নিতে পারবে না। মনে জোর নিয়ে আপনাদের রুখে দাঁড়াতে হবে। আমরা আপনাদের পাশে আছি।’ প্রধানমন্ত্রীর কথায় আবেগ ও আন্তরিকতা আছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের প্রতিটি নেতা-কর্মী কি প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য হূদয়ে ধারণ করেন? করেন না। করলে আক্রান্ত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সাহায্য চেয়েও কেন পায়নি? কেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা সময়মতো এগিয়ে এলেন না। কেন প্রশাসন ও পুলিশ নির্বিকার ছিল? আসলে সাম্প্রদায়িকতা যখন সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মনের গভীরে বাসা বাঁধে, তখন আওয়ামী লীগ-বিএনপি থাকে না; সব এক হয়ে যায়। কেউ আক্রমণ করে, কেউ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। ৪২ বছর ধরেই সংখ্যালঘুদের ওপর এ নির্যাতন চলে আসছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ওহাবের বিরুদ্ধে উসকানির অভিযোগ আছে। সরকার কি তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে? এ রকম একজন ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে কীভাবে গেলেন? সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার কারণ এই বিচারহীনতা। অপরাধীদের শাস্তি না পাওয়া।
সরকার সংখ্যালঘুদের পুড়িয়ে দেওয়া বাড়িঘর দ্রুত নির্মাণ করেছে। কিন্তু তাদের মনে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে, ইটপাথরের দেয়াল তা মুছে ফেলতে পারবে না। সে জন্য চাই সরকার, রাজনৈতিক দল ও সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের সম্মিলিত উদ্যোগ।
মওলানা ভাসানী একবার বলেছিলেন, নকশাল কারও গায়ে লেখা থাকে না। সেই কথাটি একটু ঘুরিয়ে বলা যায়, সাম্প্রদায়িকতাও কারও গায়ে লেখা থাকে না। খালেদা জিয়া কিংবা বিএনপির অন্যান্য নেতা যখন কথায় কথায় ভারতীয় জুজুর ভয় দেখান, তখন তার মধ্যে বৃহৎ প্রতিবেশী সম্পর্কে ক্ষোভের পাশাপাশি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতিও দলটির প্রচ্ছন্ন হুমকি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। যাঁরা আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে মসজিদে উলুধ্বনি শোনা যাবে বলে বক্তৃতা করেন এবং যাঁরা ভোটের হিসাবে সংখ্যালঘুদের নাম বাদ দিয়ে রাখেন; সংখ্যালঘুরা কোন ভরসায় তাঁদের ভোট দেবেন?
ডেইলি স্টার-এ মাহ্ফুজ আনাম বিএনপিকে উদ্দেশ করে লিখেছেন, পুরোনো ধ্যানধারণা, পুরোনো কৌশল, পুরোনো মিত্র কোনো সুফল বয়ে আনবে না; বরং বোঝা হয়ে থাকবে। তবে এটি কেবল বিএনপির জন্য নয়, ক্ষমতাসীন দলটির জন্যও সমান সত্য। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে বুঝতে হবে সবকিছুর দায় বিএনপি-জামায়াতের ওপর চাপালে দেশে শান্তি আসবে না, সুশাসনও প্রতিষ্ঠিত হবে না।
প্রধানমন্ত্রী বিএনপিকে জামায়াতমুক্ত হতে বলেছেন। তিনি বোঝাতে চাইছেন, জামায়াতমুক্ত হলে বিএনপি সন্ত্রাসমুক্ত হবে। কিন্তু দেশকে সন্ত্রাসমুক্ত করার এবং রাখার দায়িত্ব সরকারেরই। অতএব আওয়ামী লীগকেও পুরোনো কৌশল, দোষারোপের পুরোনো রাজনীতি পরিহার করে দেশকে সামনে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতে হবে। অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হবে। সমালোচনা সহ্য করার ধৈর্য থাকতে হবে। সবকিছু বিএনপি-জামায়াতের কাজ বলে দায় এড়ানোর প্রবণতা কাজে দেবে না।
বিএনপি সংসদে থাকুক বা না থাকুক, তার সঙ্গে একটি কর্মসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সেটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য ও শক্তি।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিএনপি নেত্রী নির্বাচনে না গিয়ে যে ভুল করেছেন, এখন তাঁকে খেসারত দিতে হবে। খেসারত দিচ্ছেনও। তবে একটি রাজনৈতিক দল বা নেত্রী ভুল করলে তার খেসারত দলের ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকে মনে রাখতে হবে যে, একটি সরকার ভুল করলে তার খেসারত গোটা জাতিকেই দিতে হয়।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
0 comments:
Post a Comment