সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়ার মৃত্যুর পর নয়টি বছর পূর্ণ হলো। ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জ বৈদ্যেরবাজারে এক জনসভায় ভাষণদানকালে তাঁকে হত্যা করে ঘাতকেরা।
বিএনপি-জামায়াত সরকার তখন ক্ষমতায়। তারা কিবরিয়া হত্যার বিচার করেনি। কিন্তু শেখ হাসিনার সরকারের বিগত আমলেও কিবরিয়া হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার না হওয়া দুঃখজনক।
কিবরিয়া কেবল একজন সফল অর্থমন্ত্রীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও জাতিসংঘের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে তাঁর অনন্য অবদান দেশের মানুষ চিরদিন মনে রাখবে। কিন্তু তিনি যে দলের জন্য জীবন দিলেন, সেই আওয়ামী লীগ কি তাঁকে মনে রেখেছে? দল বা নেতা-নেত্রীরা ভুলে গেলেও বাংলাদেশের মানুষ এই ব্যতিক্রমী ও প্রজ্ঞাবান রাজনীতিককে ভুলবে না।
১৯৯৬ সালে ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। সে সময় সরকারের কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়ন। দুই ক্ষেত্রেই শাহ এ এম এস কিবরিয়া সফল হয়েছিলেন। দেশের অর্থনীতিকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছিলেন তিনি। তাঁর সময়েই বাংলাদেশ ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করে। এর আগে কম্পিউটারের দাম ছিল সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। মোবাইল ফোনের ব্যবহার ছিল উচ্চ ও ধনিক শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিবরিয়াই কম্পিউটার ও মোবাইল ফোন সাধারণ মানুষের কাছে সহজলভ্য করেন। তিনি ভাবতেন, এই দরকারি জিনিস দুটি সুলভে সাধারণ মানুষকে দিতে পারলে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে।
আমি ছিলাম তাঁর অনুজ। তাই অনেক সময়ই দেশের রাজনীতি, মানুষ, অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে তাঁকে প্রশ্ন করতাম। একবার তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম, ব্রিটেনের মতো দেশ যদি বৃদ্ধ, বিধবা, বিকলাঙ্গ রোগীদের বছরের পর বছর ভাতা দিতে পারে, তাহলে বাংলাদেশ সরকার তা করছে না কেন? জবাবে তিনি বললেন, ‘আমরা গরিব দেশের মানুষ, এতটা মূলধন এখনো গড়ে তুলতে পারিনি। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে যারা নিতান্তই অসহায় তাদের জন্য রাষ্ট্রেরও কর্তব্য আছে। আর সে কারণেই বৃদ্ধ, বিধবা ও দুস্থ ভাতা চালু করেছি।’ প্রথম দিকে এই ভাতার পরিমাণ কম থাকলেও উত্তরোত্তর বেড়েছে এবং পরবর্তী সব সরকারই কিবরিয়ার এই নীতি চালু রেখেছে। তাঁর আরেকটি বড় সাফল্য আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। শহরে গরিব ও বেকারদের চাপ কমাতে তিনি গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙা করেছিলেন। গ্রামে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছিলেন।
অর্থমন্ত্রী হিসেবে কিবরিয়ার আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল ভৈরব সেতু। রাজধানী ঢাকা শহরের সঙ্গে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের যোগাযোগের জন্য এটি খুবই জরুরি ছিল। তাঁর পূর্বসূরি সাইফুর রহমান অনেক চেষ্টা-তদবির করেও এই সেতুর প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড় করতে পারেননি। কিবরিয়া প্যারিসে গিয়ে বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন অর্থ প্রদানকারী সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেনদরবার করে এর অর্থ জোগাড় করেন। আওয়ামী লীগ আমলে সেতুর অধিকাংশ কাজ হলেও শেষ হয় চারদলীয় জোট আমলে এবং তাঁরা জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এটি উদ্বোধন করেন। অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় হলো যে সেই অনুষ্ঠানে কিবরিয়াকে দাওয়াত পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। এটাই বাংলাদেশের সংকীর্ণ রাজনীতি।
২০০১ সালের নির্বাচনের পর বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। আমার সুযোগ হয়েছিল কিবরিয়াকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করার। এ প্রসঙ্গে তিনি দাদা শাহ ফোরকান আলীর একটি ঘটনা বলেছিলেন। ১৯৪৬ সাল। তিনি রাতে গদিঘরে ঘুমাতেন। এর খুব কাছে গান-বাজনা করতেন হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন। দাদা পরহেজগার ব্যক্তি, সারা রাত নামাজ পড়তেন ও কোরআন তেলাওয়াত করতেন। একদিন হিন্দুদের কীর্তন শুরু হলে হাজার খানেক লোক দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে দাদার কাছে হাজির হন। তাঁরা তাঁর কাছে জানতে চান, এই গান-বাজনার জন্য তিনি নিশ্চয়ই নামাজে মনোযোগ দিতে পারছেন না। তাঁর অনুমতি পেলে তাঁরা আখড়া উড়িয়ে দেবেন। জবাবে দাদা বললেন, ‘কেন? আমি যখন নামাজে দাঁড়াই, আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন থাকি, তখন তো কিছুই শুনি না। ওরা তো যুগ যুগ ধরে গান-বাজনা করে আসছে, এতে আমার মোটেই অসুবিধা হচ্ছে না।’ তাঁর এই দৃঢ় মনোভাব দেখে সবাই চলে যায়।
কিবরিয়া বলতেন, এ দেশে হিন্দু-মুসলমান শত শত বছর একসঙ্গে বসবাস করে আসছে। কোনো সমস্যা হয়নি, এখন কেন হবে? তিনি এ জন্য সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকেই দায়ী করতেন। কিবরিয়া শৈশব থেকে যে অসাম্প্রদায়িক শিক্ষা পেয়েছেন আজীবন সেটিই লালন করেছেন। ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নিয়েছেন।
আরেকটি ঘটনা। সবেমাত্র দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিবরিয়া পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পয়লা মস্কো সফর। আবদুস সামাদ আজাদ তখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশকে কীভাবে এই পরাশক্তির কাছে তুলে ধরা হবে, তা নিয়ে কূটনৈতিক মহলে ব্যাপক জল্পনা। শেষ পর্যন্ত কিবরিয়ার প্রাজ্ঞ ভূমিকায় সবাই খুশি হলেন।
১৯৭৫ সালে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর কিবরিয়া এসকাপের সেক্রেটারি পদে যোগ দেন। বাংলাদেশ সরকার তাদের পছন্দসই এক ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করলেও জাতিসংঘের মহাসচিব কুট ওয়াল্ডহাম কিবরিয়াকেই বেছে নেন।
কিবরিয়া ছিলেন একজন বড় মনের সমাজসেবক ও নিবেদিতপ্রাণ মানুষ। তিনি দেশের স্বার্থকে সবার ওপর দেখতেন। সংকীর্ণতা তাঁকে কখনো স্পর্শ করতে পারেনি। রাজনীতি করে সম্পদের পাহাড় গড়াকে তিনি মনে-প্রাণে ঘৃণা করতেন। আজ যদি কিবরিয়া বেঁচে থাকতেন, তাহলে সাহস, ধৈর্য ও প্রজ্ঞা দিয়ে দেশের এই কঠিন সংকটময় মুহূর্তে সঠিক নির্দেশনা দিতে পারতেন।
শাহ মোহাম্মদ ইমাম মেহদী: লন্ডন প্রবাসী আইনজীবী।
0 comments:
Post a Comment