মনমোহন সিং ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন ২০০৪ সাল থেকে। তাঁর চলতি দ্বিতীয় মেয়াদ যখন দ্রুত ফুরিয়ে আসছে, তখন তিনি দ্বিতীয়বারের মতো একটি সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেছেন সম্প্রতি।
সেখানে সমবেত সাংবাদিকদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা যেভাবে তাঁর শাসনামলের মূল্যায়ন করেন, ইতিহাস তার থেকে বেশি সদয়ভাবে সেটা করবে বলে তিনি আশা করেন।
কিন্তু সে রকম সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। বরং মনমোহন সিংয়ের দল, একসময়ের মহান কংগ্রেস দল এখন এক রাজনৈতিক কানাগলিতে ঘুরপাক খাচ্ছে। দলটি তার ধ্বংসাত্মক পরিবারতান্ত্রিক নেতৃত্ব থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারলেই কেবল এই কানাগলি থেকে বেরোবার পথ খুঁজে পেতে পারে। একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে ভারত ইতিমধ্যে অর্ধশতকের বেশি সময় পেরিয়ে এসেছে। এই সময়ের অধিকাংশটাই সরকারের দায়িত্বে ছিল কংগ্রেস দল। এখন মনে হচ্ছে, কংগ্রেসের এই আধিপত্যের যুগ শেষ হতে চলেছে।
দলটির অবক্ষয়ের সবচেয়ে পরিষ্কার লক্ষণটি ফুটে উঠেছে গত ডিসেম্বরে, যখন ভারতের চারটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের ভরাডুবি ঘটেছে। রাজস্থানে কংগ্রেস পেয়েছে মাত্র ২১টি আসন, আর ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) জিতেছে ১৬২টি আসন। অথচ ২০০৮ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস সেখানে পেয়েছিল ৯৬টি আর বিজেপি পেয়েছিল ৭৮টি আসন।
একইভাবে দিল্লিতে টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পর কংগ্রেস এবার ৭০টি আসনের মধ্যে পেয়েছে মাত্র আটটি; এমনকি দলটির যে নেত্রী সবচেয়ে লম্বা সময় ধরে মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন, সেই শিলা দীক্ষিতও আসন হারিয়েছেন এমন এক ব্যক্তির কাছে, যিনি রাজনীতিতে নবাগত। উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ছোট্ট রাজ্য মিজোরামেই শুধু কংগ্রেস তার সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখতে পেরেছে।
এটা কংগ্রেসের জন্য এক নজিরবিহীন ভরাডুবি। আগামী জাতীয় সাধারণ নির্বাচনে দলটির জন্য ভালো কিছুর পূর্বাভাস এতে নেই। কেন এ রকম হলো এবং কংগ্রেস নিজের ক্ষয় ঠেকাতে পারবে কি না, এসব বুঝতে হলে বিজেপির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ডেমেক্রেটিক অ্যালায়েন্সের (এনডিএ) হাত থেকে ২০০৪ সালে কংগ্রেস জাতীয় নেতৃত্ব ফিরে পাওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত কী ঘটেছে, তা বুঝতে হবে।
ভারতের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে কংগ্রেস ২০০৪ সালে নবনির্বাচিত ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ অ্যালায়েন্সের (ইউপিএ) কেন্দ্রীয় শক্তিতে পরিণত হয়। কিন্তু অবাক ব্যাপার হলো, দলটির প্রধান নেতা সোনিয়া গান্ধী প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিতে সম্মত হলেন না, তিনি এই পদের জন্য ইউপিএর প্রার্থী হিসেবে প্রস্তাব করলেন মনমোহন সিংয়ের নাম। মনমোহন সিং একজন অধ্যাপক ও আমলা, যাঁর কোনো নির্বাচনী অভিজ্ঞতা ছিল না। প্রায় ৪০ দিন নানা নাটকীয়তার পর মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন, যদিও কোনো নির্বাচনী এলাকায় তাঁর প্রতি কোনো প্রত্যক্ষ ভোটার-সমর্থন ছিল না।
এই অস্বাভাবিক বন্দোবস্ত তাৎক্ষণিকভাবে নানা রকমের তিক্ত মন্তব্য-সমালোচনার কারণ ঘটায়। একজন পর্যবেক্ষক বিচক্ষণতার সঙ্গে মন্তব্য করেছিলেন, ‘যেখানে কর্তৃত্ব আছে, সেখানে যোগ্যতা নেই; কিন্তু যেখানে কিছুটা যোগ্যতা আছে, সেখানে কোনো কর্তৃত্ব নেই।’ মনমোহন সিংয়ের শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ভারতের শীর্ষ রাজনৈতিক পদে তাঁর কর্তৃত্বের সম্ভাবনা ছিল অত্যন্ত সীমিত। যতই দিন গড়িয়েছে, ততই পরিষ্কার হয়ে উঠেছে যে, মনমোহন সিংয়ের সরকার একেবারেই অকার্যকর। তাঁর ব্যর্থতাই ছিল অবধারিত, কারণ মনমোহন সিংয়ের যা কিছু শক্তি-সামর্থ্য ছিল, তা একজন অনুগত ও সামর্থ্যবান অধস্তন কর্মকর্তা হিসেবে; কার্যসূচি নির্ধারণ করে দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করার মতো নেতৃত্বের গুণ তাঁর ছিল না।
১৯৯০-এর দশকে মনমোহন সিং যখন ভারতের অর্থমন্ত্রী ছিলেন, তখন দেশটির অর্থনৈতিক রূপান্তরের ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপক হিসেবে তাঁর ভূমিকার কথা বিবেচনা করে দেখা যাক। অর্থনৈতিক রূপান্তরের উদ্যোগকে তাঁর সমর্থকেরা তাঁর দূরদৃষ্টি ও যোগ্যতা-সক্ষমতার দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রায়ই উল্লেখ করতেন। গত বছর সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী নটবর সিং হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়েছেন যে, ভারতের অর্থনৈতিক সংস্কার ও পুনর্গঠনের উদ্যোগটি আসলে ছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাওয়ের, যিনি ছিলেন কংগ্রেসের একজন চতুর ও বর্ষীয়ান নেতা। প্রয়োজনীয় কাজ করার ক্ষেত্রে মনমোহন সিংয়ের অনাগ্রহ ছিল; নরসীমা রাও ক্ষেত্র প্রস্তুত করে না দিলে এবং সংস্কারের পক্ষে প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক সমর্থন সংগঠিত না করলে মনমোহন তেমন কিছুই অর্জন করতে পারতেন না। সরকারের এজেন্ডা অনুসারে কাজ করতেও মনমোহনের অনীহা ছিল। আগে এমন বলাবলি হতো যে, রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তাঁর যোগ্যতাকে খাটো করে দেখা যেমন উচিত নয়, তেমনি অর্থনীতির ব্যবস্থাপক হিসেবে তাঁর দক্ষতার অতিমূল্যায়ন করাও ঠিক হবে না।
কিন্তু নরসীমা রাওয়ের ভূমিকা উন্মোচিত হওয়ার আগেই একজন নেতা হিসেবে মনমোহন সিংয়ের অযোগ্যতা-অদক্ষতা দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচি শুধু যে স্থবির হয়ে গেছে তা-ই নয়, তিনি সোনিয়া গান্ধীর সব কথা মান্য করে গেছেন, সেগুলো বৈধ হোক বা না হোক। ফলে শাসনব্যবস্থা ও অর্থনীতির অবস্থা ক্রমেই খারাপ হয়েছে। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) সমন্বয়ে গঠিত একটি সংবিধানবহির্ভূত প্রতিষ্ঠানের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে ভারত; সেই সংস্থার নাম ন্যাশনাল অ্যাডভাইজরি কাউন্সিল (এনএসি), সোনিয়া গান্ধী যার সভানেত্রী। মন্ত্রিসভা হয়ে পড়েছে অর্থহীন, ইউরোপীয় কল্যাণরাষ্ট্রের অপুষ্ট ধারণার দ্বারা অনুপ্রাণিত এনএসির ফরমানগুলোই হয়ে উঠেছে সরকারি নীতি।
ফলে মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বে অর্থনীতির অবস্থা ভীষণ খারাপ হয়েছে, জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, বিশেষত খাদ্যদ্রব্যের দাম। এ ছাড়া ২০০৪ সাল থেকে কংগ্রেসের শাসনামলে রাজনৈতিক কেলেঙ্কারি ও অর্থসংক্রান্ত কেলেঙ্কারি বেড়েছে, বিস্তার ঘটেছে নানা রকমের অপরাধবৃত্তি। ইউপিএ শাসকগোষ্ঠী দক্ষতার সঙ্গে লুটপাট চালিয়েছে; ব্যাপক দুর্নীতি ও জবাবদিহির অভাবে এই জোটের প্রধান শরিক দল কংগ্রেসের গ্রহণযোগ্যতা নিঃশেষিত হয়েছে। এসব কিছু ঘটেছে অর্থনীতিতে আপাত-শিক্ষিত মনমোহন সিংয়ের নীরব দর্শকের ভূমিকায়; তিনি শুধু দায়িত্বশীলতা দেখাতেই অস্বীকৃতি জানিয়েছেন আর রাজনৈতিক অঙ্গনের বাইরের অবস্থান থেকে তুচ্ছ মন্তব্য ছুড়ে দিয়েছেন। মনমোহন সিং কংগ্রেস দলের যে ক্ষতির কারণ ঘটিয়েছেন, সেটা পূরণ করার কাজ দলটিরই। আর তাঁর নির্লিপ্ততার কারণে প্রধানমন্ত্রী নামের প্রতিষ্ঠানটির যে ক্ষতি হয়েছে, সেটা ভারতের সব মানুষের সমস্যা। মনমোহন সিংয়ের বিপর্যয়কর নেতৃত্বের এক দশকের বৈশিষ্ট্য হলো দুর্বলতা ও ক্ষয়। এর পরিণামে সামনের অনেক বছর ধরে ভারতকে ভুগতে হবে। তাঁর কাজের ন্যায্যতা প্রতিপাদন দূরে থাক, ইতিহাসবিদেরা জানবেন, নিশ্চিতভাবে কাকে দায়ী করতে হবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
যশবন্ত সিং: ভারতের অর্থমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী ছিলেন। জিন্না: ইন্ডিয়া-পার্টিশন—ইনডিপেনডেন্স গ্রন্থের লেখক।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
0 comments:
Post a Comment