তরুবুর সঙ্গে দেখা ফরিদপুর রেলওয়ে স্টেশনে। ঢাকা থেকে দেশের বাড়ি যাওয়ার পথে আমারও ফরিদপুরে ট্রেন বদল। সেই সুচিদি। অনেকটা সুচিত্রা সেনের মতো দেখতে ছিল বলে আমরা বন্ধুরা তরুবুকে ডাকতাম সুচিদি।
সুচিত্রা সেন এ বয়সে দেখতে কেমন হয়েছিলেন, জানার কোনো উপায় নেই। কদিন আগে কে যেন ফেসবুকে সুচিত্রা সেনের এখনকার একটা ছবি আপলোড করেছিল। আমি ভালো করে না তাকিয়েই দ্রুত মাউস ঘুরিয়ে নিচে চলে আসি। সেটা হতে পারে আমি সেই সাগরিকা বা হারানো সুর-এর মোহনীয়াকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই বা সুচিত্রার নিজেকে আর প্রকাশিত না করার সিদ্ধান্তকে সম্মান জানাতে চাই বলে। সুচিদিকে দেখে আন্দাজ করা যায় কি মৃত্যুর এই কদিন আগেও দেখতে কেমন ছিলেন সুচিত্রা সেন? সিঁথি অনেক চওড়া, পাতলা চুল, সাদার আধিক্য। পাবনাই তাঁতের সবুজ-কমলা শাড়ি, ব্লাউজের হাতার ভাঁজে ছেঁড়া, দুটো সোনার ক্ষয়ে যাওয়া চুড়ির সঙ্গে দুটো কাচের চুড়ি, এক পা তুলে কংক্রিটের বেঞ্চের ওপর হাতের ব্যাগটা কষে চেপে ধরে বসে আছে। পা তুলে রাখার কারণে উরুর কিছুটা অংশ বেখেয়ালে বেরিয়ে আছে। দু-একজন পথচারী আড়চোখে দেখেও নিচ্ছে। ঘাড় ঘুরিয়ে পানের পিক ফেলতে গেলে শাড়ির ওপর খানিকটা ছলকে পড়লে সুচিদি তটস্থ হয়ে কী দিয়ে তা মোছা যায় তার অনুসন্ধান করতে লাগল। পানের খিলি জড়ানো ফেলে দেওয়া কাগজটা নিচু হয়ে মাটি থেকে তুলতে গিয়ে পা নামাতে হলো। যাক, এতক্ষণে স্বস্তি পেলাম। পান চিবিয়ে চিবিয়ে দাঁতের কী ছিরি করেছে? আগে হাসলে একগালে টোল পড়ত। এখনো হেসে উঠল। কিন্তু টোলটা পুকুরের জলে ঢিল ফেলার মতো ঢেউ না তুলে বলিরেখার সঙ্গে এক লাইনে হারিয়ে গেল। দাঁড়িয়েছিলাম। আমার হাতে পানের পিকলাগা আঙুল ছুঁইয়ে পাশে বসতে বলল আমাদের সেদিনের সুচিত্রা সেন। কত বদলেছি আমি, সুচিদি—আমাদের চারপাশ। তবুও ঠিক, সেই ফেলে আসা দিনগুলোর মতোই আপনস্বরে একটুও অবাক না হয়ে সুচিদি বলল,
‘এখেনটায় বোস রুমা। কদ্দিন পর দেখা বল তো। বাড়ি যাচ্ছিস? চাচি বেঁচে আছে?’
‘না গো সুচিদি।’
সুচিদি কি একটু কেঁপে উঠল? আমার মায়ের মৃত্যু তাকে কেঁপে ওঠার মতো আঘাত দেওয়ার অতখানি যোগ্যতা রাখে না। তাহলে? ‘কদ্দিন পর নামটা শুনলাম! ভুলেই গেছলাম’—স্বগতোক্তির মতো করে বলে কী মনে করে আনমনে নিজের গালে হাত বুলাল সে। হয়তো বা কারও প্রশংসা বা হারানো যৌবনের কথা মনে হলো তার। দেখলাম, সুচিদির চিবুকের বিখ্যাত তিলটির ওপর একটা চুল। সাদা।
‘বাড়িতে কার কাছে যাচ্ছিস? কে আছে?’
‘আর বোলো না। রবুদার মেয়েটাকে নিয়ে ভারি ঝামেলা হচ্ছে। ভাবি মারা গেছে চার বছর হলো, জানো তো। ভারি জেদি আর একরোখা মেয়েটি। রবুদা সামলাতে পারছে না। গত পরশু ঘুমের ওষুধ খেয়ে সে এক কাণ্ড...’
‘ও। কত বয়স হলো ওর?’
‘এই তো আঠারো।’
সুচিদি আবার পা তুলে বসল। স্টেশনের লাল দালান ছাড়িয়ে দূরে দাঁড়িয়ে আছে ঝলমলে রাধাচূড়া। তার ওপরে ঝুঁকে আছে কৃষ্ণ মেঘ। সুচিদি কোন দিকে চেয়ে আছে বুঝলাম না। হয়তো আকাশে। কিন্তু আমি জানি, সুচিদিকে ‘এই তো আঠারো’ টেনে নিয়ে যাচ্ছে পেছনের দিকে।
সুচিদি, মানে তরুবু ছিল পাতার বড় বোন। পাতা আমার বন্ধু। আমাদের বাড়ি থেকে ওদের বাড়ির দূরত্ব মাঝে একটা মসজিদ আর ক্লাবঘরের। ক্লাবটা ওদের বাড়ির ঠিক পাশে। পাতার বাবা ছিলেন রেজিস্ট্রি অফিসের মুহুরি। তরুবু তখন তিন-চার বছর আগে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ডাইনিং চেয়ারের কভারে কাটওয়ার্ক করে, কেক-টিকিয়া-কাবাব বানানো শেখে, একতলার ছাদে রোদ পড়ে এলে আচারের বয়াম তুলতে গেলে ক্যারমবোর্ড থেকে চোখ তোলা ক্লাবের সব ছেলের একমাত্র দর্শনীয় বস্তুতে পরিণত হয়। ছেলেগুলোর সারা দিনের একমাত্র আকাঙ্ক্ষার পরিসমাপ্তি ঘটে। তো আমার ভাই রবিউল মাহমুদ ছিল ওই ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক। বাবা ওর নাম রেখেছিল মো. রবিউল হোসেন। তখন কবি আল মাহমুদের সোনালি কাবিন-এর ভক্তরা নিজেদের নামের শেষে সবাই মাহমুদ যোগ করতে শুরু করল। আমার ভাই রবু কবিতা লিখত। একদিন ক্লাবে কবিতা পাঠের আসরে মাইক এনে মাইকের মুখ পাতাদের বাসার দিকে ঘুরিয়ে ‘জন্ম আমার আজন্ম বৃথা’ নামে তার নিজের লেখা কবিতা পড়ল। ক্লাবের আর এক ত্যাঁদড় সদস্য মোমিনুল রবুদার কবিতা আবৃত্তির পরপরই মাইক কেড়ে নিয়ে ঘোষণা দিল—‘রবিউল মাহমুদ এতক্ষণ যে কবিতাটি পড়লেন, সেটি দাউদ হায়দারের “জন্ম আমার আজন্ম পাপ”-এর হুবহু নকল। এ ক্লাব থেকে নকল কবিদের উচ্ছেদ করা প্রয়োজন।’
আমি আর পাতা তখন ওদের চিলেকোঠায় সুচিদির বানানো মুড়ির মোয়া খাচ্ছিলাম আর সব কানে আসছিল। আমার ভাইয়ের ভরাট গলার কবিতা আমাকে কবির বোন হিসেবে যখন গর্বিত করতে উদ্যত, তখনই ওই ঘোষণা। আমি দ্রুত অন্য গল্পে মোড় নিলাম। কিন্তু পাতা বিশ্বাস করল না। বলল,
‘এ হতেই পারে না। মাসিক পাথরকুচিতে রবুদার কবিতা আমি পড়েছি। একটাও নকল না। বললেই হলো!’
কিন্তু যার জন্য এত কবিতা রচনা, এত কবিদের আবির্ভাব, তার কোনো বিকার নেই। কবিতা-টবিতা ওসব ওর কানেই যায় না। সুচিদি দিব্যি বালিশের ওয়ারে ক্রুশকাঁটার কাজ করছে আর মুখ না তুলেই তার জিজ্ঞাসা,
‘কীসের এত হইচই রে ক্লাবে?’
‘রাজকন্যাকে জয় করার মহড়া চলছে’—পাতার বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর। তরুর তুলনায় পাতা একেবারেই সাদামাটা। কিন্তু পাতা ক্লাসে থার্ড-ফোর্থ হয়। অনেক বই পড়ে। আমাদের বাড়ি এসে রবুদার আলমারি থেকে বই নিয়ে যায়। আমার কেন জানি মনে হয়, পাতা রবুদাকে ভালোবাসে। রবুদা অবশ্য ভাবে পাতা তরুর অনুরোধে বই নিয়ে যায়। ক্লাস নাইনে পড়া পাতা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় হজম করতে পারবে এ বিশ্বাস তার ছিল না বলেই একদিন বইয়ের মধ্যে চালান করে দেয় তরুর উদ্দেশ্যে প্রেমপত্র। পাতা আর আমি ওদের চিলেকোঠার ছাদে দরজা বন্ধ করে সে চিঠি পড়েছিলাম। এখনো মনে আছে, চিঠিতে এ রকম লেখা ছিল—‘সুচরিতাসু, আমি কত বসন্তরজনী তোমাকে নিয়ে শয্যা রচনা করেছি।’ আমার ভারি লজ্জা লাগছিল বলে আমি আর পড়িনি। পাতা তা হস্তান্তর করেনি প্রাপককে। করবেই বা কেন? সুচিদির তখন ফরিদপুর কলেজের ফিজিক্যাল ইনস্ট্রাক্টরের সঙ্গে বিয়ের কথা প্রায় পাকা। তবে পাত্র বছর খানেক সময় নিয়েছিল এমএ পাস করার জন্য। এমএ পাস করলে পাংশা কলেজে পৌরনীতির অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করতে পারবে—এ রকম নিশ্চয়তা সে পেয়েছিল। সুচিত্রা সেনকে গ্রহণের যোগ্য করে তুলতে হবে না নিজেকে!
চিঠিটা পেলে তরু কী সিদ্ধান্ত নিত জানি না। তবে তরুর ভালো গৃহিণী হওয়ার স্বপ্ন, ঘর-সংসার সামলানো, অনুগত পুত্রবধূ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা দেখে মনে হয়নি সে কোনো বিপ্লব করার ক্ষমতা রাখে। রবুদাকে বিয়ে করার মতো বোকামি কেন করতে যাবে তরু? পাত্র হিসেবে রবুদার কী পরিচয়? বিএ পাস করে কেবল সাহিত্য করলে ওর কাছে কে মেয়ে দেবে? হ্যাঁ, জমাজমি আমাদের ভালোই ছিল। কিন্তু কলেজের অধ্যাপক আর বেকারের মধ্যে তুলনা চলে? তবে কেন জানি রবুদা ধরেই নিয়েছিল, তরু তাকেই ভালোবাসে। জোর করে তরুর বিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
‘আজ তরুবুর মুখে ক্ষীর। দুলাভাইয়ের বোন আর ভগ্নিপতি আসবে। তুই আসিস কিন্তু’—একটু গলা বাড়িয়ে রবুদার ঘরের দিকে মুখ করে আমাকে দাওয়াত দিয়ে গেল পাতা।
রবুদা খানিক ঝিম ধরে বসে থেকে গায়ে একটা জামা চড়িয়ে বেরিয়ে গেল। গ্রামে ঢোকার মুখে রেলগেটের দোকানে গিয়ে সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে বসে থাকল যতক্ষণ না তরুর বৈবাহিক লোকজন আসে। রবুদা নাকি ওদের মোটরবাইক আটকেছিল। তরুর হবু ননদাইকে নামিয়ে দোকানের পেছনে দাঁড়িয়ে তরু সম্পর্কে যাচ্ছেতাই অপবাদ দিয়েছিল, যাতে ওরা ওখান থেকেই ফিরে যায়।
ফিরে তো যায়ইনি, উপরন্তু মুখে ক্ষীরের দিন পাত্রকে ডেকে পাঠিয়ে পরদিনই কলমা পড়িয়ে সুচিত্রা সেনকে নিয়ে কেদারনাথের পগারপার। মোটা, বিরল কেশ, ভোঁতামুখের অধ্যাপককে সুচিদির ভক্তরা নাম দিয়েছিল কেদারনাথ। হূদয় ভেঙে গেল অনেক যুবকের। ক্লাবঘর কিশোরদের দখলে চলে গেল। খড়ের ছাউনির দুর্বল ক্লাবঘরের চাল অভিভাবকদের মনোযোগের অভাবে এক বৈশাখে উড়ে গিয়ে পাতাদের উঠোনে গিয়ে পড়ল। সবকিছু লন্ডভন্ড। রবুদা একমুখ দাড়ি নিয়ে দেড় মাস পর খালার বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাড়ি এল। আমার ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষ হলে পাতার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি রাজশাহী সরকারি কলেজে পড়তে গেলাম। পাতা শহরের স্থানীয় কলেজে ভর্তি হলো। মা রবুদার জন্য সুন্দরী পাত্রী জোগাড়ের প্রাণান্ত চেষ্টা চালাতে লাগল। রবুদা কবিতা ছেড়ে ঠিকাদারি শুরু করেছে। চোখের দিকে তাকানো যায় না। কেমন জিঘাংসার আগুন জ্বলজ্বল করে।
দুই বছর পর মায়ের চিঠি।
‘পর সমাচার এই যে, গতরাতে তোমার প্রাণের বান্ধবী পাতা বিষপানে আত্মহত্যা করিয়াছে। পুলিশ আসিয়াছিল। সে লিখিয়া গিয়াছে তাহার মৃত্যুর জন্য কেহ দায়ী নহে। তরু ও তরুর স্বামী আসিয়া সব ব্যবস্থা করিয়াছে। তাহার মা পাগলপ্রায়। ছুটি হইলে চলিয়া আসিও। রবুর জন্য পাত্রী পছন্দ হইয়াছে। ইতি মা।’
আমার হোস্টেলের বান্ধবীরা আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখল। আমি পাতার চিঠিগুলো বের করে পড়ার চেষ্টা করলাম। কোথায় পাতার বেদনা তা খোঁজার জন্য বারবার করে পড়তে থাকলাম। কিন্তু কান্নায় আমার সবকিছু ঝাপসা হয়ে এল। আমার রুমমেট আমার ব্যাগ গুছিয়ে দিল। ছুটি হতে আরও দিন সাতেক দেরি থাকলেও আমার রুমমেট আমাকে নিয়ে পরদিনই রওনা দিল। আমি ছুটে গিয়ে পাতার মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম। পাতার মা উদ্ভ্রান্তের মতো অন্যদিকে তাকিয়ে থাকল, তার ছড়ানো দু-হাত আমার পিঠে উঠে এল না। তরুবু তার বাঁ হাতে স্ফীত তলপেট চেপে আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে আমার মাথায় হাত দিল। সে হাতের ছোঁয়া আমার আবেগকে দু-কূল প্লাবিত করতে ব্যর্থ হলো। আমি চোখ তুলে সুচিত্রা সেনকে খুঁজলাম। এ কবছরেই সুচিদির বয়স এত বেড়েছে! নাকি গর্ভবতীদের চেহারা এ রকম হয়ে যায়? অত টিকলো নাক ওরকম মোটা দেখাচ্ছে কেন? নাকি এসবই আমার ঝাপসা চোখের প্রতিফলন? শোকে-বিহ্বলে কেমন নিষপ্রাণ আচরণ সবার। কেন পাতা এমন করল, কী হয়েছিল ওর—কাউকে জিজ্ঞাসা করার সে পরিবেশও আমাকে কেউ উপহার দিল না। আমি একাই ওর ঘরে গেলাম। ওর বইখাতা ছুঁয়ে ওর হাতের স্পর্শ নিলাম। আমার দেওয়া মানিপ্ল্যান্টটা ওর খোলা জানালা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যেতে উদ্যত। ওর বালিশ টেনে নাকে ধরলাম। নারকেল তেলে মেথি মিশিয়ে সারা বছর চুলে দিত পাতা। বালিশে পাতার জীবন্ত গন্ধ। আমি ‘পাতা পাতা’ বলে ডুকরে কেঁদে উঠলাম। মানিপ্ল্যান্টের পাতারা একটুখানি নড়ে উঠল।
সুচিদি সংবিৎ ফিরে আমার ঘাড়ে হাত রাখল। এ স্পর্শেও প্রাণের ছোঁয়া নেই। অন্যদিকে তাকিয়েই বলল,
‘আব্বা তো ছবছর হলো মারা গেছে। মাও অসুস্থ। আমার কাছে নিয়ে যেতে চাচ্ছি। যেতে চায় না।’
‘তোমার কটা গো সুচিদি?’
‘দুটো। ছেলেটা বড়। মেয়েটার বিয়ে দিয়ে দেব ভাবছি।’
‘ওমা! এত তাড়াতাড়ি?’
‘মেয়েটা পাতার মতো দেখতে।’
‘তো?’—বলে ফেলেও আমি চাইলাম না সুচিদি পাতার কথা তুলুক। পাতার জন্য আমার কষ্ট তো সুচিদির কষ্টের কাছে কিছুই না।
সুচিদি আবার আনমনা। মাথার ঘোমটা ঘাড়ে এসে পড়ল। কানে ভারী দুটো পাশা। অনেক দিন ধরে পরে থাকার কারণে কানের লতি কেটে পাশা ঝুলে পড়েছে। সুচিদিকে এখন বেশ দেখাচ্ছে। কিন্তু আলো আমার আলো-এর সুচিত্রা সেনের মতো নয়। আঁচলের খুঁটে চোখ মুছল সে। ট্রেন আসার ঘণ্টা হলে সবাই তটস্থ হয়ে নামিয়ে রাখা ব্যাগ হাতে তুলে নিল। আমার ঘাড় থেকে হাত সরিয়ে আবার মাথার ঘোমটা টেনে ব্যাগটা কোলের ওপর তুলে সুচিদি বলল,
‘পাতা তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিল।’
আমার হাতের ব্যাগ বেঞ্চের ওপর ধপ করে পড়ে গেল। মানুষজন প্লাটফর্মে জড়ো হতে শুরু করেছে। আর আমি ভারসাম্য রাখতে না পেরে বেঞ্চের ওপর বসে পড়লাম। সুচিদি উঠে দাঁড়াল।
‘রবুর মেয়ের বয়স কত বললি?’
‘আঠারো, কেন?’
‘পাতারও আঠারোই ছিল কিনা।’
ইঞ্জিনের মুখে ঘন ধুলো উড়িয়ে ট্রেন আরও সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সুচিদি বসে থাকা আমাকে কোনো ধরনের তাড়া না দিয়েই ট্রেনের দিকে এগিয়ে গেল। সুচিদি যে বগিতে উঠল, আমি সেটাতে উঠেও আবার নেমে এসে পরের বগির জন্য একটু জোরে পা চালালাম।
‘এখেনটায় বোস রুমা। কদ্দিন পর দেখা বল তো। বাড়ি যাচ্ছিস? চাচি বেঁচে আছে?’
‘না গো সুচিদি।’
সুচিদি কি একটু কেঁপে উঠল? আমার মায়ের মৃত্যু তাকে কেঁপে ওঠার মতো আঘাত দেওয়ার অতখানি যোগ্যতা রাখে না। তাহলে? ‘কদ্দিন পর নামটা শুনলাম! ভুলেই গেছলাম’—স্বগতোক্তির মতো করে বলে কী মনে করে আনমনে নিজের গালে হাত বুলাল সে। হয়তো বা কারও প্রশংসা বা হারানো যৌবনের কথা মনে হলো তার। দেখলাম, সুচিদির চিবুকের বিখ্যাত তিলটির ওপর একটা চুল। সাদা।
‘বাড়িতে কার কাছে যাচ্ছিস? কে আছে?’
‘আর বোলো না। রবুদার মেয়েটাকে নিয়ে ভারি ঝামেলা হচ্ছে। ভাবি মারা গেছে চার বছর হলো, জানো তো। ভারি জেদি আর একরোখা মেয়েটি। রবুদা সামলাতে পারছে না। গত পরশু ঘুমের ওষুধ খেয়ে সে এক কাণ্ড...’
‘ও। কত বয়স হলো ওর?’
‘এই তো আঠারো।’
সুচিদি আবার পা তুলে বসল। স্টেশনের লাল দালান ছাড়িয়ে দূরে দাঁড়িয়ে আছে ঝলমলে রাধাচূড়া। তার ওপরে ঝুঁকে আছে কৃষ্ণ মেঘ। সুচিদি কোন দিকে চেয়ে আছে বুঝলাম না। হয়তো আকাশে। কিন্তু আমি জানি, সুচিদিকে ‘এই তো আঠারো’ টেনে নিয়ে যাচ্ছে পেছনের দিকে।
সুচিদি, মানে তরুবু ছিল পাতার বড় বোন। পাতা আমার বন্ধু। আমাদের বাড়ি থেকে ওদের বাড়ির দূরত্ব মাঝে একটা মসজিদ আর ক্লাবঘরের। ক্লাবটা ওদের বাড়ির ঠিক পাশে। পাতার বাবা ছিলেন রেজিস্ট্রি অফিসের মুহুরি। তরুবু তখন তিন-চার বছর আগে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ডাইনিং চেয়ারের কভারে কাটওয়ার্ক করে, কেক-টিকিয়া-কাবাব বানানো শেখে, একতলার ছাদে রোদ পড়ে এলে আচারের বয়াম তুলতে গেলে ক্যারমবোর্ড থেকে চোখ তোলা ক্লাবের সব ছেলের একমাত্র দর্শনীয় বস্তুতে পরিণত হয়। ছেলেগুলোর সারা দিনের একমাত্র আকাঙ্ক্ষার পরিসমাপ্তি ঘটে। তো আমার ভাই রবিউল মাহমুদ ছিল ওই ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক। বাবা ওর নাম রেখেছিল মো. রবিউল হোসেন। তখন কবি আল মাহমুদের সোনালি কাবিন-এর ভক্তরা নিজেদের নামের শেষে সবাই মাহমুদ যোগ করতে শুরু করল। আমার ভাই রবু কবিতা লিখত। একদিন ক্লাবে কবিতা পাঠের আসরে মাইক এনে মাইকের মুখ পাতাদের বাসার দিকে ঘুরিয়ে ‘জন্ম আমার আজন্ম বৃথা’ নামে তার নিজের লেখা কবিতা পড়ল। ক্লাবের আর এক ত্যাঁদড় সদস্য মোমিনুল রবুদার কবিতা আবৃত্তির পরপরই মাইক কেড়ে নিয়ে ঘোষণা দিল—‘রবিউল মাহমুদ এতক্ষণ যে কবিতাটি পড়লেন, সেটি দাউদ হায়দারের “জন্ম আমার আজন্ম পাপ”-এর হুবহু নকল। এ ক্লাব থেকে নকল কবিদের উচ্ছেদ করা প্রয়োজন।’
আমি আর পাতা তখন ওদের চিলেকোঠায় সুচিদির বানানো মুড়ির মোয়া খাচ্ছিলাম আর সব কানে আসছিল। আমার ভাইয়ের ভরাট গলার কবিতা আমাকে কবির বোন হিসেবে যখন গর্বিত করতে উদ্যত, তখনই ওই ঘোষণা। আমি দ্রুত অন্য গল্পে মোড় নিলাম। কিন্তু পাতা বিশ্বাস করল না। বলল,
‘এ হতেই পারে না। মাসিক পাথরকুচিতে রবুদার কবিতা আমি পড়েছি। একটাও নকল না। বললেই হলো!’
কিন্তু যার জন্য এত কবিতা রচনা, এত কবিদের আবির্ভাব, তার কোনো বিকার নেই। কবিতা-টবিতা ওসব ওর কানেই যায় না। সুচিদি দিব্যি বালিশের ওয়ারে ক্রুশকাঁটার কাজ করছে আর মুখ না তুলেই তার জিজ্ঞাসা,
‘কীসের এত হইচই রে ক্লাবে?’
‘রাজকন্যাকে জয় করার মহড়া চলছে’—পাতার বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর। তরুর তুলনায় পাতা একেবারেই সাদামাটা। কিন্তু পাতা ক্লাসে থার্ড-ফোর্থ হয়। অনেক বই পড়ে। আমাদের বাড়ি এসে রবুদার আলমারি থেকে বই নিয়ে যায়। আমার কেন জানি মনে হয়, পাতা রবুদাকে ভালোবাসে। রবুদা অবশ্য ভাবে পাতা তরুর অনুরোধে বই নিয়ে যায়। ক্লাস নাইনে পড়া পাতা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় হজম করতে পারবে এ বিশ্বাস তার ছিল না বলেই একদিন বইয়ের মধ্যে চালান করে দেয় তরুর উদ্দেশ্যে প্রেমপত্র। পাতা আর আমি ওদের চিলেকোঠার ছাদে দরজা বন্ধ করে সে চিঠি পড়েছিলাম। এখনো মনে আছে, চিঠিতে এ রকম লেখা ছিল—‘সুচরিতাসু, আমি কত বসন্তরজনী তোমাকে নিয়ে শয্যা রচনা করেছি।’ আমার ভারি লজ্জা লাগছিল বলে আমি আর পড়িনি। পাতা তা হস্তান্তর করেনি প্রাপককে। করবেই বা কেন? সুচিদির তখন ফরিদপুর কলেজের ফিজিক্যাল ইনস্ট্রাক্টরের সঙ্গে বিয়ের কথা প্রায় পাকা। তবে পাত্র বছর খানেক সময় নিয়েছিল এমএ পাস করার জন্য। এমএ পাস করলে পাংশা কলেজে পৌরনীতির অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করতে পারবে—এ রকম নিশ্চয়তা সে পেয়েছিল। সুচিত্রা সেনকে গ্রহণের যোগ্য করে তুলতে হবে না নিজেকে!
চিঠিটা পেলে তরু কী সিদ্ধান্ত নিত জানি না। তবে তরুর ভালো গৃহিণী হওয়ার স্বপ্ন, ঘর-সংসার সামলানো, অনুগত পুত্রবধূ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা দেখে মনে হয়নি সে কোনো বিপ্লব করার ক্ষমতা রাখে। রবুদাকে বিয়ে করার মতো বোকামি কেন করতে যাবে তরু? পাত্র হিসেবে রবুদার কী পরিচয়? বিএ পাস করে কেবল সাহিত্য করলে ওর কাছে কে মেয়ে দেবে? হ্যাঁ, জমাজমি আমাদের ভালোই ছিল। কিন্তু কলেজের অধ্যাপক আর বেকারের মধ্যে তুলনা চলে? তবে কেন জানি রবুদা ধরেই নিয়েছিল, তরু তাকেই ভালোবাসে। জোর করে তরুর বিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
‘আজ তরুবুর মুখে ক্ষীর। দুলাভাইয়ের বোন আর ভগ্নিপতি আসবে। তুই আসিস কিন্তু’—একটু গলা বাড়িয়ে রবুদার ঘরের দিকে মুখ করে আমাকে দাওয়াত দিয়ে গেল পাতা।
রবুদা খানিক ঝিম ধরে বসে থেকে গায়ে একটা জামা চড়িয়ে বেরিয়ে গেল। গ্রামে ঢোকার মুখে রেলগেটের দোকানে গিয়ে সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে বসে থাকল যতক্ষণ না তরুর বৈবাহিক লোকজন আসে। রবুদা নাকি ওদের মোটরবাইক আটকেছিল। তরুর হবু ননদাইকে নামিয়ে দোকানের পেছনে দাঁড়িয়ে তরু সম্পর্কে যাচ্ছেতাই অপবাদ দিয়েছিল, যাতে ওরা ওখান থেকেই ফিরে যায়।
ফিরে তো যায়ইনি, উপরন্তু মুখে ক্ষীরের দিন পাত্রকে ডেকে পাঠিয়ে পরদিনই কলমা পড়িয়ে সুচিত্রা সেনকে নিয়ে কেদারনাথের পগারপার। মোটা, বিরল কেশ, ভোঁতামুখের অধ্যাপককে সুচিদির ভক্তরা নাম দিয়েছিল কেদারনাথ। হূদয় ভেঙে গেল অনেক যুবকের। ক্লাবঘর কিশোরদের দখলে চলে গেল। খড়ের ছাউনির দুর্বল ক্লাবঘরের চাল অভিভাবকদের মনোযোগের অভাবে এক বৈশাখে উড়ে গিয়ে পাতাদের উঠোনে গিয়ে পড়ল। সবকিছু লন্ডভন্ড। রবুদা একমুখ দাড়ি নিয়ে দেড় মাস পর খালার বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাড়ি এল। আমার ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষ হলে পাতার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি রাজশাহী সরকারি কলেজে পড়তে গেলাম। পাতা শহরের স্থানীয় কলেজে ভর্তি হলো। মা রবুদার জন্য সুন্দরী পাত্রী জোগাড়ের প্রাণান্ত চেষ্টা চালাতে লাগল। রবুদা কবিতা ছেড়ে ঠিকাদারি শুরু করেছে। চোখের দিকে তাকানো যায় না। কেমন জিঘাংসার আগুন জ্বলজ্বল করে।
দুই বছর পর মায়ের চিঠি।
‘পর সমাচার এই যে, গতরাতে তোমার প্রাণের বান্ধবী পাতা বিষপানে আত্মহত্যা করিয়াছে। পুলিশ আসিয়াছিল। সে লিখিয়া গিয়াছে তাহার মৃত্যুর জন্য কেহ দায়ী নহে। তরু ও তরুর স্বামী আসিয়া সব ব্যবস্থা করিয়াছে। তাহার মা পাগলপ্রায়। ছুটি হইলে চলিয়া আসিও। রবুর জন্য পাত্রী পছন্দ হইয়াছে। ইতি মা।’
আমার হোস্টেলের বান্ধবীরা আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখল। আমি পাতার চিঠিগুলো বের করে পড়ার চেষ্টা করলাম। কোথায় পাতার বেদনা তা খোঁজার জন্য বারবার করে পড়তে থাকলাম। কিন্তু কান্নায় আমার সবকিছু ঝাপসা হয়ে এল। আমার রুমমেট আমার ব্যাগ গুছিয়ে দিল। ছুটি হতে আরও দিন সাতেক দেরি থাকলেও আমার রুমমেট আমাকে নিয়ে পরদিনই রওনা দিল। আমি ছুটে গিয়ে পাতার মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম। পাতার মা উদ্ভ্রান্তের মতো অন্যদিকে তাকিয়ে থাকল, তার ছড়ানো দু-হাত আমার পিঠে উঠে এল না। তরুবু তার বাঁ হাতে স্ফীত তলপেট চেপে আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে আমার মাথায় হাত দিল। সে হাতের ছোঁয়া আমার আবেগকে দু-কূল প্লাবিত করতে ব্যর্থ হলো। আমি চোখ তুলে সুচিত্রা সেনকে খুঁজলাম। এ কবছরেই সুচিদির বয়স এত বেড়েছে! নাকি গর্ভবতীদের চেহারা এ রকম হয়ে যায়? অত টিকলো নাক ওরকম মোটা দেখাচ্ছে কেন? নাকি এসবই আমার ঝাপসা চোখের প্রতিফলন? শোকে-বিহ্বলে কেমন নিষপ্রাণ আচরণ সবার। কেন পাতা এমন করল, কী হয়েছিল ওর—কাউকে জিজ্ঞাসা করার সে পরিবেশও আমাকে কেউ উপহার দিল না। আমি একাই ওর ঘরে গেলাম। ওর বইখাতা ছুঁয়ে ওর হাতের স্পর্শ নিলাম। আমার দেওয়া মানিপ্ল্যান্টটা ওর খোলা জানালা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যেতে উদ্যত। ওর বালিশ টেনে নাকে ধরলাম। নারকেল তেলে মেথি মিশিয়ে সারা বছর চুলে দিত পাতা। বালিশে পাতার জীবন্ত গন্ধ। আমি ‘পাতা পাতা’ বলে ডুকরে কেঁদে উঠলাম। মানিপ্ল্যান্টের পাতারা একটুখানি নড়ে উঠল।
সুচিদি সংবিৎ ফিরে আমার ঘাড়ে হাত রাখল। এ স্পর্শেও প্রাণের ছোঁয়া নেই। অন্যদিকে তাকিয়েই বলল,
‘আব্বা তো ছবছর হলো মারা গেছে। মাও অসুস্থ। আমার কাছে নিয়ে যেতে চাচ্ছি। যেতে চায় না।’
‘তোমার কটা গো সুচিদি?’
‘দুটো। ছেলেটা বড়। মেয়েটার বিয়ে দিয়ে দেব ভাবছি।’
‘ওমা! এত তাড়াতাড়ি?’
‘মেয়েটা পাতার মতো দেখতে।’
‘তো?’—বলে ফেলেও আমি চাইলাম না সুচিদি পাতার কথা তুলুক। পাতার জন্য আমার কষ্ট তো সুচিদির কষ্টের কাছে কিছুই না।
সুচিদি আবার আনমনা। মাথার ঘোমটা ঘাড়ে এসে পড়ল। কানে ভারী দুটো পাশা। অনেক দিন ধরে পরে থাকার কারণে কানের লতি কেটে পাশা ঝুলে পড়েছে। সুচিদিকে এখন বেশ দেখাচ্ছে। কিন্তু আলো আমার আলো-এর সুচিত্রা সেনের মতো নয়। আঁচলের খুঁটে চোখ মুছল সে। ট্রেন আসার ঘণ্টা হলে সবাই তটস্থ হয়ে নামিয়ে রাখা ব্যাগ হাতে তুলে নিল। আমার ঘাড় থেকে হাত সরিয়ে আবার মাথার ঘোমটা টেনে ব্যাগটা কোলের ওপর তুলে সুচিদি বলল,
‘পাতা তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিল।’
আমার হাতের ব্যাগ বেঞ্চের ওপর ধপ করে পড়ে গেল। মানুষজন প্লাটফর্মে জড়ো হতে শুরু করেছে। আর আমি ভারসাম্য রাখতে না পেরে বেঞ্চের ওপর বসে পড়লাম। সুচিদি উঠে দাঁড়াল।
‘রবুর মেয়ের বয়স কত বললি?’
‘আঠারো, কেন?’
‘পাতারও আঠারোই ছিল কিনা।’
ইঞ্জিনের মুখে ঘন ধুলো উড়িয়ে ট্রেন আরও সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সুচিদি বসে থাকা আমাকে কোনো ধরনের তাড়া না দিয়েই ট্রেনের দিকে এগিয়ে গেল। সুচিদি যে বগিতে উঠল, আমি সেটাতে উঠেও আবার নেমে এসে পরের বগির জন্য একটু জোরে পা চালালাম।
0 comments:
Post a Comment