গল্প- সংবাদ শিরোনাম by সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম

Saturday, February 1, 2014

পত্রিকায় চোখ রেখে চমকে ওঠার মানুষ মোফাজ্জেল না। অন্তত তার নিম্নমধ্যবিত্ত জীবনে দেশের-দশের খবর নিয়ে মাথাব্যথার কিছু নেই। কিন্তু রোববার সকালে কমলাপুর স্টেশনে এসে চার টাকা দামের পত্রিকার শিরোনাম দেখে মনে হলো, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে।

প্রতিদিন সকাল আটটায় স্টেশনে আসে মোফাজ্জেল। যমুনা এক্সপ্রেস ট্রেন পৌঁছায় সকাল নয়টার মধ্যে। এই সময়ে স্টেশনের চেহারাই বদলে যায়। পিলপিল করে গেট দিয়ে মানুষ বের হতে শুরু করে। তাদের ব্যাগ নেওয়ার জন্য পিছে পিছে ঘোরে কুলিরা। তখন রিকশা-সিএনজিচালিত অটোরিকশার দরদামও শুরু হয়। মোফাজ্জেল এই ট্রিপটা মিস করতে চায় না। এ সময় যাত্রীরা গন্তব্যে পৌঁছার জন্য মরিয়া থাকে। এক শ টাকার ভাড়া ঝগড়াঝাঁটি না করেই দুই শ টাকাতেও উঠে যায়। তবে স্টেশনে দিনে আরও কয়েক দফা ট্রেন এলেও তখন এদিক থেকে ট্রিপ নেয় না মোফাজ্জেল। দাঁড়ালেই প্রতিবার ১০ টাকা ফি, তার ওপর ইঞ্জিন স্টার্ট দিতে দুই মিনিট দেরি হলো তো পাহারাদার বদমাশগুলো এমনভাবে হাতের ডান্ডা দিয়ে অটোরিকশায় বাড়ি দেয়, মনে হয় পুরো কলকবজাই খুলে পড়বে। অটোরিকশার কেমন লাগে জানে না কিন্তু তার নিজের বুকে কষ্ট লাগে। পৈতৃক সম্পত্তির শেষটুকু বিক্রি করে এই অটোরিকশা রাস্তায় নামিয়েছে। প্রতিদিন ফেরার সময় চাল-ডালের বরাদ্দ, মুগদাপাড়ার ঘর ভাড়া, আজিজের স্কুলের বেতন—সবকিছুর জোগানদার এই বাহন। তাই লাঠির বাড়ি পড়লে মনে হয়, নিজের শরীরেই লাগছে। এরপর যদি জানত টাকাটা সিটি করপোরেশনে যাচ্ছে, কথা ছিল না। কিন্তু এখানকার সব ড্রাইভারই জানে টাকা যায় কোথায়। শাহজাহানপুরের শহীদ গ্রুপ দেখে কমলাপুরের এরিয়া। এত কষ্টের টাকা যায় গ্রুপের প্রধান শহীদের পকেটে। সে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নানা মাপের দল রাখে হাতে। নিশ্চয়ই সেই টাকা দিয়ে রাতে নরকগুলজারের মতো কোনো আসর বসে। এসব ভাবলে মনটাই খারাপ হয় মোফাজ্জেলের। তার ওপর এই ঠিকাদারগুলোর ব্যবহার অন্য জায়গার তুলনায় বেশি খারাপ। টাকা ভাংতি না থাকলে ২০ টাকার নোটটা ভাঁজ করে পকেটে চালান করে। পান খাওয়া দাঁতের ভেতর কাঠি দিয়ে খোঁচাতে খোঁচাতে বলে, ‘কাইল নিস।’ অথচ সেই কাল আর কখনো হয় না। শহীদকে ধরতে হুলিয়া জারি করেছে পুলিশ। তার নামে দুটো মার্ডার কেস, অবৈধ অস্ত্রের মামলাও আছে। অবাক লাগে মোফাজ্জেলের। রাস্তায় পুলিশরা গাড়ির চাকা ঘোরা দেখেই বলে দেয়, কোনটার লাইসেন্স নেই। সঙ্গে সঙ্গে আটকে ৮০০ টাকার কেস ঠুকে দেয়। আর সেই পুলিশই হাতের নাগালের একটা মানুষকে ধরতে পারছে না বছরের পর বছর! তবু স্টেশনে ট্রিপ নেওয়া ড্রাইভারগুলো এ জায়গার এক নেশায় পড়ে যায়। একে ভাড়া বেশি, তার ওপর সারা রাত ধরে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা মানুষেরা বেশ অন্য রকম হয়। কেউ কেউ গন্তব্যের জায়গার নাম ছাড়া কিছুই চেনে না, ঘুরতেই থাকে অটোরিকশা নিয়ে। এই তো গতকালও ট্রেন থেকে নেমে এক লোক উঠল তার গাড়িতে। বোকা-বোকা দেখতে মানুষ, গরমের ভেতরও ফুলহাতা শার্ট পরা। হাতল-ছেঁড়া কাপড়ের একটা কালো ব্যাগ হাতে। গ্রাম্য টানে বলল, ‘ভাইসাব, অনেকগুলা কাজ। সব জায়গায় এক মিনিট, দুই মিনিট। ঘণ্টা চুক্তিতে ভাড়ায় যাবেন?’
‘পয়সা দিলে যামু না ক্যান?’
ঘণ্টাপ্রতি দুই শ টাকা চুক্তিতে অটোরিকশায় উঠেই লোকটা প্রথমে গেল মতিঝিলের এক অফিসে। প্রায় ২০ মিনিট দেরি করে ফিরে বলে, ‘বেশি দেরি করলাম?’ মোফাজ্জেল হেসে ফেলল এ কথায়, ‘কিয়ের দেরি, আপনি তো ঘণ্টায় টাকা দিবেন।’ তারপর আবার মুগদাপাড়ার দিকে কোনো অফিসে যাওয়ার মাঝপথে থেমে বলল, ‘ভাইসাব, চলেন, দুজন নাশতা করি।’ ততক্ষণে মোফাজ্জেল বেশ আগ্রহ পেয়েছে। ঢাকার বাইরে থেকে আসা মানুষগুলোর ভেতরে এখনো মাটির ঘ্রাণ পাওয়া যায়। এরা মানুষ ভালোবাসে, তমিজ করে কথা বলে। নয়তো এই লোক তাকে দাঁড় করিয়ে রেখেই একা একা নাশতা করতে পারত অথবা বেশি চালাক হলে কিছু একটা কিনে সিএনজিতে বসেই খেতে পারত। এমন অনেক ঘটেছে এই গাড়িতেই। পিচ্চি পিচ্চি পোলাপান, তুই-তোকারিও করে মাঝেমাঝে। বেতড়িপাত পোলাপান আদব শিখে নাই! সেই তুলনায় গ্রাম থেকে আসা এই যাত্রী বেশ সরল। মানুষটা তার চেয়ে বয়সে কত ছোট, তাও আগ্রহ নিয়েই জিজ্ঞেস করল, ‘ভাইসাবের পরিবার কি ঢাকায় থাকে?’
‘জি।’
‘সদস্য কয়জন?’
‘আল্লায় দিলে দুই ছেলে মেয়ে আর আমার স্ত্রী।’
‘সিএনজি দিয়ে খরচ চলে?’
‘গরিব মানুষের প্রয়োজনও গরিব। তাই ঠেইকা থাকে না।’
‘ভালোই বলছেন। তা শাদি কি একটাই করেছিলেন?’
যাত্রীর রসিকতায় হেসে ওঠে মোফাজ্জেল। বাঁ পাশের আয়নায় দেখল, লোকটাও হাসছে। পুরুষ মানুষের হাসিতে দেখার কিছু নাই কিন্তু এই লোকের হাসি সুন্দর। মতিঝিলের শাপলা চত্বরের পাশ কেটে যাওয়ার সময় মোফাজ্জেল জিজ্ঞেস করে, ‘আপনে কোন অঞ্চল থেকা আসছেন?’
‘বাড়ি ভাই, উত্তরবঙ্গ। তবে আপনাদের এই ঝকমারি শহরে আসার জন্য দিনাজপুর থেকে রওনা হয়েছি।’
‘এইভাবে বললেন?’
‘কষ্ট থেকে বলছি। সারা রাত ট্রেনে ঝিমিয়ে সকালে দুই জায়গায় গেলাম, একটারও কাজ হলো না। এই শহরের মানুষ স্মৃতিশক্তিহীন।’
সবুজবাগের দিকে অটোরিকশা ঘুরিয়ে নিতে নিতে মোফাজ্জেল জিজ্ঞেস করল, ‘চাকরির জন্য আসছেন?’
‘জি, চাকরি একটা হওয়ার কথা কিন্তু ইন্টারভিউ বিকালে। সকালে দুইজনের সাথে দেখা করার কথা ছিল জমি-জিরাতের বিষয়ে। তারা আমায় ঠিক মনে করতে পারছে না।’
‘মন খারাপ কইরেন না। ইন্টারভিউর জন্য মন শক্ত রাখেন।’
মোফাজ্জেল আবার যাত্রীকে নিয়ে গেল বাসাবোর দিকে। এখানে যদিও লোকটা তাকে একটু বিরক্ত করেছে। ১০ মিনিটের কথা বলে ঢুকেছে এক বাসায়। মাছি মারতে মারতে সকালের পেপার মুখস্থ করে ফেলল মোফাজ্জেল, তবু লোকটার আসার নাম নেই। বাসার উল্টো দিকে একটা গাছের নিচে অটোরিকশা রেখে পাশের দোকানে গেল ফোন করতে। বউয়ের সঙ্গে দুই মিনিট কথা বলে মেয়ের খবর নিল। এই এক সমস্যা তাদের, একটাই মোবাইল। মেয়েটার শরীর ভালো না, তাই ফোনটা বউয়ের হাতে দিয়ে আসা। কথা বলে ফিরতে ফিরতে দেখে, লোকটা তাকে খুঁজছে। হেসে বলল, ‘রাগ করেছেন? একটু বেশি দেরি করে ফেললাম। আপনি ভাড়া নিয়ে ভাববেন না।’ মোফাজ্জেল নিশ্চিন্ত হয়ে বলল, ‘অসুবিধা নাই। তয় তিন ঘণ্টা তো অনেক আগেই শেষ। প্রায় সাড়ে বারোটা বাজে।’
‘গাড়ি জমা দিবেন?’
‘তা না, আমার মেয়েটার অসুখ তো। ভাইঙ্গা ভাইঙ্গা ট্রিপ দিলে ভাড়া বেশি পাই।’
‘মেয়ের কী হয়েছে?’
‘কথা শুনে না, রোইদে রোইদে ঘুরে জ্বর বাঁধাইছে।’
‘বয়স কত?’
‘সাত।’
‘মাশাল্লাহ। দুশ্চিন্তা করবেন না। সুস্থ হয়ে যাবে আর ভাড়া বাড়িয়ে দেব। আর একটা কাজ শেষ করতে ঘণ্টা খানেক লাগবে। যাবেন?’
‘চলেন।’
অটোরিকশা এবার এল নিউমার্কেটের দিকে। মোফাজ্জেল এক পাশে দাঁড়াল। লোকটা বেশ কিছু বইপত্র কিনেছে। কাগজের প্যাকেটে এক কেজি আপেলও। প্যাকেটটা মোফাজ্জেলের কাছে দিয়ে বলল, ‘সকাল থেকে অনেক কষ্ট দিলাম। এটা মেয়েকে দিয়েন।’
তখন আকাশ থেকে পড়ার অবস্থা মোফাজ্জেলের। এই লোক পাগল নাকি! কথাবার্তায় শান্ত হলেও সকাল থেকে যেভাবে রাস্তায় ঘুরছে, খুবই অস্থির লাগছে। তাই বলে দেড় শ টাকা কেজি আপেল কিনে ফেলল! আবার ভয় হলো, আপেল দিয়ে লোকটা ভাড়ার টাকা কমাবে না তো! অবশ্য অমন হলে নিউমার্কেটে ঢুকে নাও বের হতে পারত অথবা উল্টো দিকের গেট দিয়ে বেরিয়ে গেলে তার বাবারও সাধ্য নেই খুঁজে বের করার। সংশয় নিয়ে পরবর্তী গন্তব্য জিজ্ঞেস করল সে,
‘আপনি তো কমলাপুরের দিকেই যাইবেন, তাই না?’
‘জি।’
‘দুপুর তো হয়ে গেল, চলেন নীলক্ষেতে খাওয়াটা সেরে নেই।’
এবার মোফাজ্জেল মনে মনে প্রমাদ গুনল। এই লোকের মনে হয় সত্যিই মাথায় ঝামেলা আছে, ‘ভাই, আপনার না ইন্টারভিউ?’
‘জি, সেটা তো বিকেলে।’
‘এইখানে আত্মীয়স্বজন কেউ নাই?’
‘না, সে রকম কেউ নেই। অনেকগুলো কাজ নিয়ে এসেছি। তার দু-একটাই সারলাম। ইন্টারভিউ দিয়েই আবার রাতের ট্রেনে উঠব।’
অচেনা যাত্রীর জন্য মায়া লাগছে মোফাজ্জেলের। বোঝাই যায় বেচারার পকেটে টাকাকড়ি আছে কিছু। নয়তো অটোরিকশা ভাড়া করে দিনভর কাজ সারত না। কিন্তু এই শহরে একটাও আপন মানুষ নাই, যার কাছে গিয়ে একটু কাপড়চোপড় বদলে বিশ্রাম নিতে পারে। মোফাজ্জেল নীলক্ষেতের দিকে অটোরিকশা ঘোরাতে ঘোরাতে বলল,‘চাকরি হবে কোথায়?’
‘মাদারটেক হাইস্কুলে হেডমাস্টারের পোস্টের জন্য বিজ্ঞাপন দিয়েছে পত্রিকায়। যদিও এভাবে হয় না, তবু অ্যাপ্লাই করায় ডেকেছে দেখে আসলাম।’
‘হাতে বইপত্র দেইখাই বুঝছি, আপনি শিক্ষক হইবেন।’
হো হো করে হেসে উঠল লোকটা, ‘বইপত্র থাকলেই মানুষ শিক্ষক হয়?’
‘আপনি খুব সহবৎওয়ালা মানুষ।’
লোকটা আবারও হাসছে—কী সুন্দর হাসি! নীলক্ষেতের তেলের স্টেশনের পাশে গাড়ি সাইড করতে করতে আবারও সিএনজির ছোট আয়নায় চুরি করে হাসি দেখে নিল মোফাজ্জেল। তার বাড়ির অবস্থা একটু ভালো হলে নিয়ে যেতে পারত। গ্রাম থেকে আসা একটা মানুষ যদি গায়ে পানি ঢেলে একটু বিশ্রাম নিয়ে ইন্টারভিউ দিতে পারত, তার নিজেরও স্বস্তি হতো। কিন্তু অসুস্থ মানুষ ঘরে, আবার প্রস্তাব শুনে লোকটাই বা কী মনে করে ভাবতে ভাবতে বলল, ‘ভাই, কমলাপুরের দিকে গেলে ওই দিকে যেয়েই না-হয় খাইয়েন।’
বায়তুল মোকাররমের সামনে হঠাৎ গাড়ির স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ আগেই গ্যাস নিয়েছে। নিশ্চয়ই তাহলে ইঞ্জিনে কোথাও গোলমাল। স্টার্ট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিব্রত হয়ে গেল মোফাজ্জেল। আবার মনে মনে ভয়ও হচ্ছে ভাড়া নিয়ে। প্রায় মিনিট পনেরো চেষ্টার পর লোকটা অস্থির হয়ে উঠেছে। কী এক জরুরি কাজের কথা মনে পড়ায় সে খুব হুড়োহুড়ি করে নেমে গেল। যদিও ভদ্র ভাষায় বলল, ‘ভাই সাহেব, ভেবেছিলাম বিকেল পর্যন্ত আপনার সিএনজি দিয়েই কাজ সারব, কিন্তু অপেক্ষা করা সম্ভব না। ভাড়া কত দিব?’
মোফাজ্জেল হিসাব করে বলল, ‘বারো শ টাকা।’
লোকটা অবাক করে তাকে এক হাজার টাকার দুটো নোট বের করে দিয়েছে।
‘ভাংতি হবে না, ভাই।’
‘ফেরত চাইনি।’
মোফাজ্জেল এবার থ। এত অদ্ভুত যাত্রী সে আগে পায়নি। লোকটার দিকে পরম মমতা নিয়ে তাকিয়ে বলল, ‘আপনার ইন্টারভিউ তো আমাগো ওই দিকেই। জায়গাটা নিরাপদ না। সাবধানে থাইকেন।’
হাসি দিয়ে বিদায় নিয়েছে অচেনা যাত্রী। পাশের এক গ্যারেজে ঠেলে ঠেলে গাড়ি নিয়ে ঠিক করাল মোফাজ্জেল। বাড়ি ফিরে আপেল দিল মেয়েকে। নোট দুটো এখনই খরচ করতে ইচ্ছে করছে না। এক হাজার টাকার একটা নোট ভাংতি করলেই শেষ। রাতেও অনেকবার মনে মনে মানুষটার কথা ভেবেছে সে। মানুষটার চাকরিটা হলে কত ভালো হতো। কয়েক দিন পর ওই স্কুলে গিয়ে একবার ঢুঁ মেরে দেখবে, খোঁজ পাওয়া যায় কি না। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে জ্বরের মেয়েটাকে কোলের ভেতর নিয়ে ঘুমিয়েই পড়েছে সে। মেয়ে একটা আপেল খেয়ে বাকিটা রেখে দিতে বলেছে। সে আরও পাঁচ দিন খেতে পারবে। হিসাব শুনে মোফাজ্জেল বলেছে, ‘আম্মা, আপনার আব্বা কি কোনো দিন আপেল কিনে খাওয়ায় না?’ মেয়ে কী সুন্দর হাসি হেসেছে, ‘খাওয়ায়, শুধু অসুখ হইলে। আর সেইগুলা তো লাল আপেল, স্বাদ এত মিঠা না।’
মেয়ের জন্য মায়া লেগেছে মোফাজ্জেলের। যাক, পকেটে এখনো টাকা আছে, সে আবার এক কেজি সবুজ আপেল কিনবে। সকালে নতুন ক্ষ্যাপ মারলে আর এখনই নোট ভাঙাতে হবে না ভেবে খুশিমনে আজও স্টেশনেই দাঁড়িয়ে ছিল মোফাজ্জেল। কিন্তু পত্রিকার শিরোনামটা দেখার পরই সব তোলপাড় হয়ে গেল। যার কথা বলা হয়েছে, এই লোক তাদের আয়-রোজগারের ভাগীদার। এই এলাকার ফুটপাতের কাগজ বিক্রেতারাও বখরা না দিলে বসতে পারে না। অটোরিকশার পেছনে যখন বখাটে ঠিকাদারগুলা বাড়ি দিয়ে খিস্তিখেউড় করে, প্রায়ই মনে হয় স্টেশনের সব অটোরিকশার ড্রাইভারকে বলে, ‘চলেন, গুন্ডাডারে আচ্ছা ধোলাই দেই।’ সেই শীর্ষ সন্ত্রাসী শহীদ ক্রসফায়ারে নিহত। এতে তার একটু হলেও স্বস্তি পাওয়ার কথা। কিন্তু শিরোনামের নিচে যে বীভৎস ছবি, তা বড় মর্মান্তিক। লোকটা উপুড় হয়ে পড়ে আছে হাত-পা ছড়িয়ে। মাথার নিচ থেকে রক্ত এসে ভাসিয়ে নিচ্ছে কাগজের ঠোঙা, টুকরো ইট। ছবিটা বোধ হয় মৃত্যুর অনেক পর তোলা। রক্ত জমাট বেঁধে কালচে আর মাছি দেখা যাচ্ছে। কিন্তু শার্ট-প্যান্ট পরিচিত লাগছে! পায়ের জুতা জোড়া, বাঁ হাতে ঘড়ির বেল্টও দেখা যাচ্ছে। এই ঘড়িটাই উল্টে কি বলেছিল, ‘ভাইসাব, দুপুর হয়ে গেছে। চলেন একসাথে...।’ লাশের পাশে বক্স করে ছাপানো কালো ব্যাগের ছবি। তার পাশে কতগুলো বিদেশি পিস্তল। এই ব্যাগটাই কি দেখেছে সে! ঝাপসা চোখে অটোরিকশার ড্রাইভার মোফাজ্জেল খবরের অক্ষরগুলোর ওপর চোখ রাখছে, ‘কিছুদিন আত্মগোপনে থেকে গতকাল ভোরে কমলাপুর স্টেশনে নামে শীর্ষ সন্ত্রাসী শহীদ। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বিকেলে পল্টনে...।’
মোফাজ্জেলের বুকের ভেতর এখন একটা শিরোনাম হুহু করছে।

গল্প- পড়া ভূত শোনা ভূত by নাইস নূর

এক ভূতের দেশে ‘পড়া’ ভূত ও ‘শোনা’ ভূত নামে দুই যমজ ভাইবোন বাস করত। তারা দেখতে প্রায় একই রকম। তবে ভাই ‘পড়া’র চেয়ে বোন ‘শোনা’ একটু বেশি সুন্দর।
ভাইবোনের মধ্যে এক-আধটু ঝগড়া তো হতেই পারে, কিন্তু মজার ব্যাপার হলো পড়া ও শোনার কোনো দিনই এ রকম হয় না। তাদের মধ্যে অনেক মিল। একসঙ্গে তারা সব কাজ করে। আর সবাই তাদের দেখে বলে, ‘দেখেছ, পড়া আর শোনা কত ভালো, কত মিষ্টি তাদের ভাইবোনের সম্পর্ক!’

ভূতদের স্কুলে পড়ালেখায় সবচেয়ে ভালো পড়া ও শোনা। শিক্ষকেরা তাই তাদের খুব ভালোবাসত। পড়া আর শোনার কিছু ক্লাসমেট ছিল, যারা লেখাপড়ায় খুব অমনোযোগী। একবার ভূত স্কুলের সব শিক্ষক সিদ্ধান্ত নিল, ক্লাস শেষে পড়া ও শোনা দুজন মিলে সব অমনোযোগী ছাত্রছাত্রীকে পড়াবে। এই মহান দায়িত্ব পেয়ে পড়া ও শোনা তো খুব খুশি! মনে মনে তারা নিজেদের টিচার ভাবতে শুরু করল, আর প্রতিদিন ক্লাস শেষে দুষ্টু বাচ্চা ভূতদের পড়াতে লাগল। প্রথমে কেউ ঠিকমতো পড়তে চাইত না। খুব বিরক্ত করত। কিন্তু কিছুদিন যাওয়ার পর সবাই পড়া ও শোনার ভক্ত হয়ে গেল। একসময় দুষ্টুরাও মনোযোগী ছাত্র হলো। ভূতের স্কুলেরও বেশ নাম হলো। স্বীকৃতিস্বরূপ স্কুল থেকে পড়া ও শোনা পেল গোল্ড মেডেল। আর এই খবর ভূতের দেশের সব পত্রপত্রিকায় প্রকাশ পেল। ইন্টারনেটের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ল পৃথিবীব্যাপী। খবর পৌঁছে গেল লাল-সবুজের বাংলাদেশেও।
বাংলাদেশের কিছু স্কুল ‘পড়া’ ও ‘শোনা’র কাছে আমন্ত্রণপত্র পাঠাল। পত্রে লিখল, পড়া ও শোনা ভূত রাজি থাকলে এই দেশে এসে কিছু অমনোযোগী ছাত্রকে পড়ালে তারা খুব উপকৃত হবে। পড়া আর শোনা সাদরে গ্রহণ করল সেই আমন্ত্রণপত্র। বাংলাদেশে এসে তারা প্রথম ভর করল প্রান্ত নামে এক দুষ্টু ছাত্রের ওপর। কী যে দুষ্টু প্রান্ত, তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না!
একদিনের ঘটনা—
প্রান্ত হোমওয়ার্ক না করে বাসায় দুষ্টুমি করছে। আর তখনই পড়া ও শোনা ভূত প্রান্তের মাথায় ভর করল। তবুও প্রান্ত লেখাপড়া শুরু করল না। প্রান্ত উচ্চ স্বরে বলতে লাগল, ‘আমি তোমাদের কথা শুনব না। তোমরা পচা ডিমের মতো। তোমাদের আমার ভালো লাগে না।’
পড়া ভূত বলল, ‘তাহলে কি তুমি সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ হতে চাও না! তোমাকে তো সবাই অশিক্ষিত বলবে!’
‘বলুক, তবু আমি পড়ব না। আর আমি তো মানুষই। আমার চোখ, নাক, মাথা সবই আছে।’
শোনা বলল, ‘না নেই! লেখাপড়া না জানলে সবই অর্থহীন।’
প্রান্ত এবার চমকে উঠল।
পড়া ভূত বলল, ‘তুমি লেখাপড়া না করলে প্রতিদিন দুপুরে তোমাকে আমরা ভয় দেখাব, তোমার খেলনা লুকিয়ে রাখব।’
প্রান্ত এবার কেঁদে দিল। ‘আমার খেলনা লুকাবে না, আমি পড়ব।’
শোনা ভূত বলল, ‘আর যদি লেখাপড়া করো, আমরা তোমাকে অনেক খেলনা ও মজার মজার চকলেট গিফট করব।’
‘কিন্তু আমি তোমাদের দেখা পাব কোথায়? তোমাদের নাম কী?’
‘আমাদের নাম পড়া ও শোনা। তুমি যখন পড়তে বসবে, আমরা তোমার পাশেই থাকব।’
প্রান্ত এসব কথা শুনে খুব মনোযোগী হয়ে হোমওয়ার্ক শেষ করল।
তারপর বলল, ‘পড়াশোনা ভূতেরা আমাকে ভয় দেখিয়ো না।’
আমি তোমাদের বন্ধু হব আর লেখাপড়াও করব।’
এভাবেই অনেক দুষ্টু বাচ্চার মন জয় করল পড়া আর শোনা ভূত।
অভিভাবক ও শিক্ষকরাও খুব খুশি।
সবাই বলতে লাগল, ‘পড়া ও শোনা ভূত সবার বন্ধু হলে কত্ত ভালো হতো’!

চারুশিল্প- বাহারামের রূপবিদ্যা by মোবাশ্বির আলম মজুমদার

Friday, January 31, 2014

প্রতিষ্ঠান সনদ দেয়, বাহারামের সেটি নেই। তুলি ডুবিয়ে তবুও ক্যানভাসে রং মেশান তিনি। রিকশা, ট্যাক্সি, ট্রাক, লরি—এসব যানবাহনের গায়ে আঁকেন হরেক ছবি।
দুটো পয়সা জোটে। বেশ মজার এ রিকশা পেইন্টিংয়ের কাজ তিনি শুরু করেছিলেন ১১ বছর বয়সে।
‘এ মানুষটিকে একজন দর্শক হিসেবে বিভিন্ন প্রদর্শনীতে দেখতাম আমি। মাঝেমধ্যে এসে ছবি সম্পর্কে নানা প্রশ্ন করতেন। বিরক্ত লাগত। কিন্তু একদিন নিজের আঁকা দুটি ছবি নিয়ে এলেন আমার কাছে। সেদিনই বুঝলাম, তিনি নিছক একজন রিকশা-পেইন্টার নন, জাত শিল্পী।’ বাহারামের সম্পর্কে শিল্পী নিসার হোসেন কথা এমনই।

তাঁর জন্ম ১৯৫০-এ, ঢাকায়। আদিনাম সৈয়দ কোমার হোসেন সিরাজী।
১৫ বছর বয়সে পাকাপাকিভাবে রিকশা পেইন্টিং শুরু করেন বাহারাম। কল্পনাশক্তির প্রখরতায় প্রতিনিয়ত রিকশায় আঁকার অভ্যাসকে পরিণত করেন নতুন নতুন বিষয়ে। সিনেমার ব্যানার আঁকায় হাতেখড়ি শিল্পী আবদুল হাইয়ের কাছে। তখন পুরোনো ঢাকার আগামসি লেনে কাজ করতে যেতেন তিনি। ১৯৬০ সালের দিকে বাহারাম নায়ক-নায়িকাদের প্রতিকৃতি চিত্রের মাধ্যমে সিনেমার ব্যানার আঁকায় দক্ষতা দেখান। সেই থেকে শুরু ব্যানারের কাজ। সেই সময়কার অনেক চিত্রতারকার মধ্যে ওয়াহিদ মুরাদ, ভারতীয় সুপারস্টার দিলীপ কুমার, কিশোর কুমার আর মধুবালার প্রতিকৃতি বেশ রপ্ত হয়ে যায় তাঁর।
এরপর রুটি-রুজির সংগ্রামে অনেক এগিয়ে গেলেন বাহারাম। কিন্তু সিনে ব্যানার আর রিকশা পেইন্টিং করে তৃপ্তি মেলে না তাঁর। অন্যদিকে, ডিজিটাল ব্যানার তৈরির প্রযুক্তির কারণে ওই বাজার ছোট হয়ে এলো। এবার বাহারামের মাথায় হাত। নব্বইয়ের দশক-পরবর্তী সময়ে সংকট গাঢ় হয়। শাড়ির ডিজাইনের কাজ শুরু করেন তিনি । এ সময় সবার দৃষ্টি কাড়েন ‘বৃত্তে’র কর্মশালায় অংশ নিয়ে। শিল্পকলার মূল স্রোতের সঙ্গে যুক্ত হলেন বাহারাম।
প্রথাগত ব্যাকরণসিদ্ধ শিল্পরচনার দিকে না গেলেও প্রথা না মেনে আঁকা তাঁর ছবিগুলো দৃষ্টি কেড়ে নেয় সবার। রং, রেখা-জ্যামিতি, বুনটের ধার ধারেন না তিনি। কিন্তু জাতশিল্পী হয়ে ওঠার সব সম্ভাবনা তাঁর কাজে উপস্থিত। তাঁর দৃষ্টি দুটি—অন্তর্মুখী ও বহির্মুখী। প্রচলিত মিথ এসে ভর করে ছবির বিষয়ে। এ শিল্পীর ছবির বিষয় ও ছবি দেখে একটি জায়গায় এসে থমকে যান দর্শক—ছবির প্রতিটি অবয়বের ভেতর আকৃতির পুনঃস্থাপন করেছেন তিনি। যেমন: ‘আইস অব হান্টার’ কাজটিতে মানুষের মুখের চোখ দুটি ঢেকে আছে দুই হরিণের আকৃতি—হাত ও পা খর্বকায়। ছবির জমিনে গাঢ় নীলের মধ্যে সাদা চলমান রেখা। এক অদ্ভুত ভাবনা তাড়িয়ে নেয় দর্শককে। স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে অনেক সময় লাগে।
বাহারামের ছবির দৌড় অনেক দূর। বিষয়-ভান্ডার অফুরন্ত। বিষয়ের মধ্যে কোনো পরিবর্তনের স্লোগান হয়তো পাওয়া যায় না, কিন্তু একটি বার্তা পাওয়া যায় । শিল্পী কখনো নিজেই নিজের সঙ্গে কথা বলেন। প্রতিকৃতির মধ্যে হাজির করেন পশু, পাখি, প্রকৃতি। গতি তৈরি করেন বহির্মুখী ফর্ম দিয়ে। ফলে ছবির কেন্দ্রে দৃষ্টি নিবদ্ধ না হয়ে কানভাসের বাইরেও আনন্দ খুঁজে পান দর্শক।
‘এলিফ্যান্ট সোসাইটি’ ছবির মধ্যে আছে মানুষের আকৃতির ঠাসাঠাসি উপস্থিতি। জমিনে আলট্রামেরিন ব্লু। হয়তো আকাশের কথা বলেন শিল্পী। মানুষের বন্ধনকে দেখান হাতির সঙ্গে।
বাহারাম আসলে কী আঁকেন—এমন প্রশ্নের জবাবে হয়তো বলা যাবে: সমাজ, মানুষ, বোধ-বুদ্ধির অন্তর্ধান, তথাকথিত সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে চাটুকারিতা এবং অন্তর্জগতের যন্ত্রণা নির্মাণ করেন বাহারাম। প্রতিষ্ঠানের বিপক্ষে তিনি নন, কবে প্রতিষ্ঠানবঞ্চিত বাহারামের শিল্প ও রূপের বিদ্যা আমাদের বলে দেয়—শিল্প সাধনার বিষয়, জীবনও তা-ই। শিল্প ও জীবন এক হয়েই তৈরি হয় তাঁর ছবির জগত। বাহারামের ছবিগুলো আমাদের খুলে দিয়েছে নতুন এক দরোজা। ১১ জানুয়ারি ঢাকা আর্ট সেন্টারে শুরু হওয়া এ প্রদর্শনী শেষ হবে ২১ জানুয়ারি।

কার্লোস মুসসিও সায়েন্স-পেনঞা- লাতিন আমেরিকায় প্রথম রবীন্দ্র-অনুবাদক by রাজু আলাউদ্দিন

Thursday, January 30, 2014

কার্লোস মুসসিও সায়েন্স-পেনঞার নামটি যে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ১৯১৫ সাল থেকেই জড়িয়ে আছে, আমরা কজনই বা তা জানি।
ইংরেজির কারণে ইয়েটসের কথা, ফরাসি ভাষার কারণে আঁদ্রে জিদের কথা, রুশ ভাষার কারণে বরিস পাস্তেরনাকের কথা, জার্মান ভাষার কারণে হেলেন মায়ারের কথা আর এস্পানিয়ল ভাষার কারণে হুয়ান রামোন হিমেনেথ আর তাঁর স্ত্রী সোনোবিয়ার কথা আমরা জানি। কিন্তু হুয়ান রামোনের পাশাপাশি কার্লোস মুসসিওর নামটিও আমাদের স্মরণ করা উচিত। পূর্বসূরি শিশিরকুমার দাশ এবং শ্যামাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায় তাঁদের শাশ্বত মৌচাক: রবীন্দ্রনাথ ও স্পেন গ্রন্থে বলেছিলেন, হুয়ান রামোন আর সেনোবিয়া রবীন্দ্রনাথের প্রথম অনুবাদক এস্পানিয়ল ভাষায়। স্পেনে তাঁদের অনুবাদে রবীন্দ্রনাথের প্রথম বইটি বেরিয়েছিল ১৯১৫ সালের জুলাইয়ে। ঠিক একই বছর আটলান্টিকের অপর পারে, আর্হেন্তিনার বুয়েনস এইরেসের ‘এদিসিওনেস মিনিমাস’ থেকেও বেরিয়েছিল পোয়েমাস (Poemas) নামে রবীন্দ্রনাথের একটি কাব্যগ্রন্থ। এর প্রকাশকাল একই বছর হলেও প্রকাশের মাসটির উল্লেখ নেই। হিমেনেথের আগে নাকি পরে বেরিয়েছে, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে কৌতুককর ব্যাপার এই যে ভিন্ন দুই মহাদেশের দুটি দেশ থেকে একই ভাষায় দুই অনুবাদকের হাতে রবীন্দ্রনাথ প্রকাশিত হচ্ছেন গ্রন্থাকারে, প্রায় একই সময়ে—মূল লেখক এ সম্পর্কে ছিলেন পুরোপুরি অনবহিত! অবশ্য The Gardener থেকে মাত্র ২৫টি কবিতা নিয়েছিলেন কার্লোস মুসিসও। আয়তনে যদিও কৃশতনু কিন্তু গোটা এস্পানিয়ল ভাষায় এটি প্রথম বইয়ের গৌরব অর্জন না করলেও অন্তত লাতিন আমেরিকায় এটাই যে প্রথম রাবীন্দ্রিক কিরণ ছড়িয়ে দেওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করেছে তা পুরোপুরি নিশ্চিত। বইটি বেরোবার পরের বছর মাদ্রিদ থেকে প্রকাশিত নুয়েত্রো তিয়েম্পো পত্রিকার ১৯১৬ সালের মার্চ সংখ্যায় বেরিয়েছিল এর একটি অনুকূল আলোচনা, আলোচক ছিলেন হোসে সুবিরা। আলোচনা যে অনুকূল ছিল, তার প্রধান কারণ অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ প্রথম প্রাচ্য দেশীয় নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক বলেই। ওই প্রথম পশ্চিম একজন প্রাচ্যের, বিশেষ করে ভারতের বাংলা অঞ্চলের একজন লেখককে এই সম্মানে ভূষিত হতে দেখল। আর এই সম্মানের সঙ্গে যুক্ত ছিল পশ্চিমাদের মনোজগতে প্রাচ্য সম্পর্কে এক অদ্ভুত ধারণার সম্ভ্রম। এই আলোচনাটিতেও তার প্রকাশ আমরা দেখতে পাব: ‘আমাদের পশ্চিমাদের কাছে এত অদ্ভুত সব জিনিসের জন্মদাত্রী ভূখণ্ড বঙ্গদেশ উপহার দিয়েছে একজন কবিও। তবে এই কবি, অন্য সব কবির মতো নন, তিনি মুষ্টিমেয়দের একজন, যিনি কাব্যকলায় দক্ষ, তিনি কঠিনতম শিল্পের, সম্ভবত ‘সবচেয়ে কঠিনতম শিল্পের এক গুরু’—গভীরভাবে নাড়া দেওয়ার মতো।
১৯২৪ সালে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে অনুবাদক কার্লোস মুসসিও সায়েন্স-পেনঞা 
১৯১৩ সালে তাঁকে প্রাপ্য নোবেল পুরস্কার দিয়ে তাঁর বহুমুখী শিল্পীসত্তাকে arbi et orbe (আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক) রূপে অভিষিক্ত করা হয়। পশ্চিমা সভ্যতার কুসংস্কারকে এটা দেখিয়ে দিতে পেরেছে যে কলকাতায় জন্মগ্রহণকারী কবিও গৌরবের মুকুটে ভূষিত হতে পারেন।

ভারতে তিনি কবি হিসেবে এবং ধর্মপ্রাণ ও উদ্দীপক ব্যক্তি হিসেবে সম্মানিত। মরমি ভূষণে আচ্ছাদিত তিনি যখন ব্রাহ্মণ্যবাদ বা আধ্যাত্মিক জীবনের উচ্চতর ধারণাগুলো ব্যাখ্যা করেন, তখন বহু লোক এসে জড়ো হয়।

মরমিবাদ সম্পর্কে বক্তৃতা সংকলন সাধনা (জীবনবোধ), বিভিন্ন নাটক, তাঁর বাবার জীবনী, তাঁর বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থ যেমন: গীতাঞ্জলি, দ্য ক্রিসেন্ট মুন এবং দ্য গার্ডেনার গ্রন্থসমূহে মহত্তম এই শিল্পীর বিভিন্ন পর্যায়ের অভিব্যক্তি লক্ষ করা যায়।

মুসিসও সায়েনস্-পেইনঞা সাহেব দ্য গার্ডেনার থেকে পঁচিশটি কবিতা সুনিপুণ দক্ষতায় অনুবাদ করে ‘এদিসিওনেস মিনিমাস’ থেকে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। অনুবাদকের ভাষায়, কোনো কোনো স্তবককে রবীন্দ্রনাথ যে ধুয়ো দিয়ে অলংকৃত করেছেন, তা জয়দেবের গীতগোবিন্দ দ্বারা উদ্দীপিত বলে মনে হয়। জয়দেব এমন এক গীত রচনা করেছেন, যার সঙ্গে গানের গানের (Cantar de los cantares) মিল লক্ষ করা যায়, তবে তা মরমি আবেগের জন্য নয়, বরং ভালোবাসা বয়ানের ধরনের জন্য।

এই কবিতাগুলো আলো আর মৌলিকতায় পূর্ণ আত্মার যাবতীয় সূক্ষ্মতাকে চূড়ান্ত সারল্যের সঙ্গে প্রকাশ করতে গিয়ে এক প্রশান্ত ঐকতানকে তুলে ধরেছে।’

হোসে সুবিরার এই সপ্রশংস আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারছি, রবীন্দ্রনাথ এবং মুসিসও উভয়ই নন্দিত হয়েছিলেন এস্পানিয়ল ভাষায় রবীন্দ্রনাথের উদয়লগ্নে। বিশ শতকের একেবারে শুরুর দশক থেকেই লাতিন আমেরিকার মন ও মননকে অল্প যে কজন লেখক-অনুবাদক প্রাচ্যমুখী করেছিলেন, কার্লোস কার্লোস মুসিসও সায়েন্স-পেনঞা তাঁদের অন্যতম।

আর্হেন্তিনার রিও দে লা প্লাতা, যে প্লাতা অঞ্চলে বিক্তোরিয়া ওকাম্পোর আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ কয়েকটি দিন আলস্যে কাটিয়েছিলেন স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে, সেখানে ২০ শতকের শুরুতে একদল তরুণ রিও দে লা প্লাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উষ্ণ আবহে বুদ্ধিবৃত্তিক স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি করেছিলেন, মুসিসও ছিলেন সেই তরুণদের একজন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন তখনকার উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বদের মধ্যে অনুবাদক ও প্রাবন্ধিক হোয়াকিন বিক্তর গনসালেস (যিনি ১৯১৪ সালে রবীন্দ্রনাথের Hundred poems of Kabir বইটি এস্পানিয়ল ভাষায় প্রথম অনুবাদ করেন। এই বইটির প্রথম সংস্করণের ভূমিকা লিখেছিলেন বোর্হেসের মামাতো ভাই আলবারো মেলিয়ান লাফিনুর। বইয়ের পরের একটি সংস্করণে রয়েছে রুবেন দারিওর একটি ভূমিকা, যদিও সেটি আসলে প্রথমে একটা গ্রন্থালোচনা হিসেবে ১৯১৪ সালের ২১ আগস্টেLa Nacionপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল) এবং আলেহান্দ্রো কর্ন (দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ এবং রিও দে লা প্লাতার পঞ্চপাণ্ডব—স্পেনে Cinco Sabios, যার আক্ষরিক অর্থ পাঁচজন জ্ঞানী—তাঁদের একজন তিনি)। আর এই তরুণদের মধ্য থেকেই অল্প সময়ের ব্যবধানে বেরিয়ে এসেছিলেন লাতিন আমেরিকার প্রথম মহান প্রাচ্যবিদ দার্শনিক বিসেন্তে ফাতোনে।
মুসিসও এই তাতানো আবহের মধ্যে টেনে এনেছিলেন লাতিন আমেরিকায় প্রথমবারের মতো ওমর খৈয়াম ও রবীন্দ্রনাথের আত্মাকে, অনুবাদের মাধ্যমে। এটা এক আশ্চর্য কাকতাল যে পেরুর উদ্দেশে রওনা হলেও শেষ পর্যন্ত অসুস্থতার কারণে রবীন্দ্রনাথ যাত্রাবিরতি করলেন এমন এক দেশে, যেখানে প্রথম এস্পানিয়ল অনুবাদে তাঁর কাব্যগ্রন্থ বেরিয়েছিল আর্হেন্তিনা সফরের প্রায় এক দশক আগেই। এ ছাড়া আমাদের মধ্যে অস্বস্তির এক মিহি মেঘ জড়ো হয় এই দেখে যে রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্রে, স্মৃতিকথায়, ডায়েরি এমনকি তাঁর সফরসঙ্গী এলমহার্স্টের লেখায়ও মুসিসওর কোনো উল্লেখ নেই। বিক্তোরিয়া ওকাম্পোর সান ইসিদ্রোর শিখরে রবীন্দ্রনাথ  বই থেকে জানতে পারছি যে ‘বিকেলে ওদিকে শুরু হতো  অভ্যাগতের স্রোত। প্রায়ই নদীর ধারে এক উইলোগাছের নিচে গিয়ে বসতেন আর অতিথিরা তাঁকে ঘিরে বসতেন অর্ধবৃত্তে।’ আরও একটু এগোলেই আমরা আবারও বিক্তোরিয়াকে বলতে শুনি, ‘এ দেশের নির্ভরযোগ্য প্রতিভূদের সঙ্গে কবিকে মিশবার সুযোগ করে দিয়েছিলাম অনেক।’ কিন্তু এই ‘অনেক’দের মধ্যে একমাত্র প্রতিভূ হিসেবে কেবল রিকার্দো গুইরালেদসের কথা তাঁকে বলতে শুনি। এখন জানা যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তখন দার্শনিক আলেহান্দ্রো কর্ন, লেখক হোর্হে লুইস বোর্হেস, পেদ্রো এনরিকেস উরেনঞা প্রমুখের মধ্যে দেখা হয়েছিল কার্লোস মুসিসওরও।
পোয়েমাস বইয়ের প্রচ্ছদ 
এ তো হতেই পারে যে খ্যাতির মধ্যগগনে অবস্থানকারী রবীন্দ্রনাথের মনে বা মনোযোগে এসব ‘অভ্যাগতরা’ গভীর কোনো আঁচড় কেটে যায়নি। তা ছাড়া রবীন্দ্রনাথ নিজেও যে সেখানকার লেখক-অনুবাদকদের সম্পর্কে কৌতূহলী ছিলেন, তাও মনে হয় না। ওকাম্পো তো খানিকটা অসন্তোষ আর অনুযোগের সুরে বলেইছিলেন, গুরুদেব ডব্লু এইচ হাডসনের চোখ দিয়ে আর্হেন্তিনাকে দেখতে এসে হতাশ হয়েছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের এই হতাশার কারণ হিসেবে ওকাম্পো বলেছিলেন, ‘বেশ বোঝা যায় যে রবীন্দ্রনাথ এ দেশের নিজস্ব অবয়বটি খুঁজে পাওয়ার চেষ্টায় বেশ হতাশ হচ্ছিলেন। হাডসনের বইয়ে (অনেক দূরে, অনেক আগে) যে আর্জেন্টিনার বর্ণনা, ১৯২৪ সালে তার আর কোনো অস্তিত্বই ছিল না।’ (শঙ্খ ঘোষ, ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ)

আর হাডসনের বাইরে রবীন্দ্রনাথ আর্হেন্তিনাকে বা গোটা লাতিন আমেরিকাকে এক ব্যক্তিগত আবেগের সম্পর্ক থেকে, কেবল বিক্তোরিয়া ওকাম্পের মধ্য দিয়েই দেখেছিলেন। ওকাম্পোকে সে কথা তিনি জানিয়েওছিলেন এক চিঠিতে: ‘For me the spirit of the Latin America will ever dwell in my memory incarnated in your person’ (শঙ্খ ঘোষ, ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ)।

তবে রবীন্দ্রনাথের কৌতূহল থাকুক বা না থাকুক, আর্হেন্তিনার সে সময়ের তরুণ লেখকদের তীব্র কৌতূহল ছিল রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে। এক আর্হেন্তিনায়ই আমরা দেখতে পাব বিক্তোরিয়া ওকাম্পো, বোর্হেস (পরে অবশ্য রবীন্দ্রনাথ নিয়ে তিনি কোনো উচ্ছ্বাস তো প্রকাশ করেনইনি, বরং যখন প্রসঙ্গ এসেছে, কুটূক্তি করেছেন তীব্র ভাষায়), বোর্হেসের বন্ধু এদুয়ার্দো গনসালেস লানুসা, ফ্রিদা স্চুলৎস দে মান্তোবানি, ওসবালেদা বানাসসিনি, সেসার মাগ্রিনি, হোর্হে ক্রুস, হোয়াকিন বে গনসালেস এবং কার্লোস মুসিসও সায়েন্স-পেনঞা—এঁরা সবাই রবীন্দ্রনাথের লেখা অনুবাদ করেছেন কিংবা রবীন্দ্রনাথের কোনো না কোনো সাহিত্যকর্ম নিয়ে আলোচনা করেছেন।

কিন্তু আর্হেন্তিনাতে মুসিসও সায়েন্স-পেনঞা এঁদের সবার পূর্বসূরি হয়ে আছেন—আর্হেন্তিনায় তো বটেই, এমনকি গোটা লাতিন আমেরিকায়ও—রবীন্দ্রনাথের প্রথম প্রবর্তক হিসেবে। রবীন্দ্রনাথের মোট তিনটি বই তাঁর হাতে অনূদিত হয়েছিল। প্রথম বইটি পোয়েমাস (Poemas) ১৯১৫ সালে প্রকাশিত হয়। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে আবার ১৯১৭ সালে নতুন সংস্করণে প্রকাশিত হয় বইটি। দ্বিতীয় বইয়ের নাম ছিল লা কসেচা দে লা ফ্রুতা (La Cosecha de la Fruta), যা বুয়েনস এইরেসের ‘সোসিয়েদাদ কোঅপেরাতিবা এদিতোরিয়াল লিমিতাদা’ থেকে ১৯১৭ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। এটিও ছিল রবীন্দ্রনাথের কবিতার সংকলন। এ বইয়ের একটি ভূমিকা লিখেছিলেন হোয়াকিন বিক্তর গনসালেস। এরপর এল হার্দিনেরো (El Jardinero) নামে আরও একটি বই বের হয় বুয়েনস এইরেসের ‘কলেকসিয়ন নোবেল’ সিরিজের অন্তর্গত ‘এদিসিওনেস আর্হেন্তিনা কনদর’ থেকে  ১৯২৪ সালে। এই বইটি আবার ১৯৩৩ সালে সান্তিয়াগো দে চিলে থেকেও বেরিয়েছিল। এ বইয়ের প্রথম সংস্করণে এক পৃষ্ঠাজুড়ে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মুসিসওর একটি ছবি। সন্দেহ নেই, ছবিটি ১৯২৪ সালেই তোলা। কিন্তু কীভাবে সম্ভব হলো ২৪ সালেই তোলা ছবি একই সালের সংস্করণে অন্তর্ভুক্ত করা? ব্যাপারটা কি এই যে বইয়ের মুদ্রণের কাজ আগে থেকেই চলছিল এবং শেষ পর্যায়ে এসে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তোলা এই ছবিটি তিনি গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন?
ছবি যেভাবেই অন্তর্ভুক্ত হোক না কেন এ গ্রন্থে, আমরা জানতে পারছি, মুসিসওর অনুবাদগুলো ছিল খুবই সফল। মুসিসও-গবেষক আক্সেল গাসকেত তাঁর একটি নিবন্ধে জানাচ্ছেন, ‘ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াৎ-এর এস্পানিয়ল অনুবাদের লেখক হিসেবে যেমন, তেমনি বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গ্রন্থের অনুবাদক হিসেবেও কার্লোস মুসিসও সায়েন্স-পেনঞার উদ্যোগে সাংস্কৃতিক বিস্তারের জটিল কাজকে বিস্তারিতভাবে দেখাই আমাদের লক্ষ্য। সেই সময় করা খৈয়ামের বিভিন্ন এস্পানিয়ল অনুবাদগুলোর মধ্যে সায়েন্স-পেনঞারটিই সম্ভবত আজ পর্যন্ত বেশি সফল এবং পরিচিত। একই ব্যাপার তাঁর করা রবীন্দ্র অনুবাদগুলোর ক্ষেত্রেও ঘটেছে, যে অনুবাদ ছিল এস্পানিয়ল সাংস্কৃতিক আবহে প্রথম দৃষ্টান্ত।’
সায়েন্স-পেনঞার অনুবাদের সফলতার একটা বড় কারণ এই যে তা মূলানুগ। তাঁর সমসাময়িক রবীন্দ্র-অনুবাদক হুয়ান রামোন হিমেনেথ এস্পানিয়ল ভাষায় রবীন্দ্রনাথের অনুবাদ করেছেন। সেসব অনুবাদ মূলানুগতার কারণে ততটা নয়, যতটা কাব্যিক ব্যঞ্জনার জন্য নন্দিত। মূলানুগতার প্রশ্ন তুলে পরবর্তীকালে হুয়ান রামোনের রবীন্দ্রনাথকে ‘আন্দালুসীয় টেগোর’ও বলেছেন কেউ কেউ। তবে কার্লোস মুসিসও সায়েন্স-পেনঞার হাতে রবীন্দ্রনাথের যে এই পরিণতি ঘটেনি, তার কারণ ওই মূলানুগতা।
হিমেনেথ থেকে উদাহরণ হাজির করে শিশিরকুমার দাশ এবং শ্যামাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায় বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, কোথায় কীভাবে অনুবাদ মূল থেকে দূরে সরে যাচ্ছে এবং ‘ছন্দস্পন্দের সাম্য’ থাকলেও ‘অর্থের মধ্যে কিছুটা অস্পষ্টতাও এসেছে’।
 সায়েন্স-পেনঞার হাতে রবীন্দ্রনাথ এস্পানিয়ল ভাষায় এই অস্পষ্টতার শিকার হননি বলে আমার ধারণা।
তবে হিমেনেথের সঙ্গে কার্লোস মুসিসওর তুলনার আগে আমাদের স্মরণ রাখতে হবে, যত ‘অস্পষ্টতা’ই থাকুক না, হুয়ান রামোন তাঁর তীব্র সংবেদনশীলতা ও কাব্যগুণ দিয়ে অনুবাদগুলোতে মূলের ক্ষতিকে পুষিয়ে দিয়েছিলেন। আবার এও স্বীকার করতে হবে যে কাব্যগুণে ও মাধুর্যে, ধ্বনিময়তায় ও বিন্যাসের সুষমায় অতুলনীয় হয়ে উঠলেও তা শেষ পর্যন্ত, বাঙালি ও আন্দালুসীয়—এই উভয় আবেগের সুস্নিগ্ধ সৌরভ হয়ে উঠেছিল।
অন্যদিকে কার্লোস মুসিসওর অনুবাদে হয়তো মাতাল করা গীতিমাধুর্য নেই, নেই ইন্দ্রিয়সমূহের কোনো কোনো বৃত্তিকে প্রাপ্য ভোজে ও ভোগে পরিপূর্ণ করে তোলার আয়োজন, কিন্তু এতে রয়েছে মূলের প�

গল্প- অষ্টাদশী by উম্মে মুসলিমা

Sunday, January 26, 2014

তরুবুর সঙ্গে দেখা ফরিদপুর রেলওয়ে স্টেশনে। ঢাকা থেকে দেশের বাড়ি যাওয়ার পথে আমারও ফরিদপুরে ট্রেন বদল। সেই সুচিদি। অনেকটা সুচিত্রা সেনের মতো দেখতে ছিল বলে আমরা বন্ধুরা তরুবুকে ডাকতাম সুচিদি।
সুচিত্রা সেন এ বয়সে দেখতে কেমন হয়েছিলেন, জানার কোনো উপায় নেই। কদিন আগে কে যেন ফেসবুকে সুচিত্রা সেনের এখনকার একটা ছবি আপলোড করেছিল। আমি ভালো করে না তাকিয়েই দ্রুত মাউস ঘুরিয়ে নিচে চলে আসি। সেটা হতে পারে আমি সেই সাগরিকা বা হারানো সুর-এর মোহনীয়াকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই বা সুচিত্রার নিজেকে আর প্রকাশিত না করার সিদ্ধান্তকে সম্মান জানাতে চাই বলে। সুচিদিকে দেখে আন্দাজ করা যায় কি মৃত্যুর এই কদিন আগেও দেখতে কেমন ছিলেন সুচিত্রা সেন? সিঁথি অনেক চওড়া, পাতলা চুল, সাদার আধিক্য। পাবনাই তাঁতের সবুজ-কমলা শাড়ি, ব্লাউজের হাতার ভাঁজে ছেঁড়া, দুটো সোনার ক্ষয়ে যাওয়া চুড়ির সঙ্গে দুটো কাচের চুড়ি, এক পা তুলে কংক্রিটের বেঞ্চের ওপর হাতের ব্যাগটা কষে চেপে ধরে বসে আছে। পা তুলে রাখার কারণে উরুর কিছুটা অংশ বেখেয়ালে বেরিয়ে আছে। দু-একজন পথচারী আড়চোখে দেখেও নিচ্ছে। ঘাড় ঘুরিয়ে পানের পিক ফেলতে গেলে শাড়ির ওপর খানিকটা ছলকে পড়লে সুচিদি তটস্থ হয়ে কী দিয়ে তা মোছা যায় তার অনুসন্ধান করতে লাগল। পানের খিলি জড়ানো ফেলে দেওয়া কাগজটা নিচু হয়ে মাটি থেকে তুলতে গিয়ে পা নামাতে হলো। যাক, এতক্ষণে স্বস্তি পেলাম। পান চিবিয়ে চিবিয়ে দাঁতের কী ছিরি করেছে? আগে হাসলে একগালে টোল পড়ত। এখনো হেসে উঠল। কিন্তু টোলটা পুকুরের জলে ঢিল ফেলার মতো ঢেউ না তুলে বলিরেখার সঙ্গে এক লাইনে হারিয়ে গেল। দাঁড়িয়েছিলাম। আমার হাতে পানের পিকলাগা আঙুল ছুঁইয়ে পাশে বসতে বলল আমাদের সেদিনের সুচিত্রা সেন। কত বদলেছি আমি, সুচিদি—আমাদের চারপাশ। তবুও ঠিক, সেই ফেলে আসা দিনগুলোর মতোই আপনস্বরে একটুও অবাক না হয়ে সুচিদি বলল,

‘এখেনটায় বোস রুমা। কদ্দিন পর দেখা বল তো। বাড়ি যাচ্ছিস? চাচি বেঁচে আছে?’

‘না গো সুচিদি।’

সুচিদি কি একটু কেঁপে উঠল? আমার মায়ের মৃত্যু তাকে কেঁপে ওঠার মতো আঘাত দেওয়ার অতখানি যোগ্যতা রাখে না। তাহলে? ‘কদ্দিন পর নামটা শুনলাম! ভুলেই গেছলাম’—স্বগতোক্তির মতো করে বলে কী মনে করে আনমনে নিজের গালে হাত বুলাল সে। হয়তো বা কারও প্রশংসা বা হারানো যৌবনের কথা মনে হলো তার। দেখলাম, সুচিদির চিবুকের বিখ্যাত তিলটির ওপর একটা চুল। সাদা।

‘বাড়িতে কার কাছে যাচ্ছিস? কে আছে?’

‘আর বোলো না। রবুদার মেয়েটাকে নিয়ে ভারি ঝামেলা হচ্ছে। ভাবি মারা গেছে চার বছর হলো, জানো তো। ভারি জেদি আর একরোখা মেয়েটি। রবুদা সামলাতে পারছে না। গত পরশু ঘুমের ওষুধ খেয়ে সে এক কাণ্ড...’

‘ও। কত বয়স হলো ওর?’

‘এই তো আঠারো।’

সুচিদি আবার পা তুলে বসল। স্টেশনের লাল দালান ছাড়িয়ে দূরে দাঁড়িয়ে আছে ঝলমলে রাধাচূড়া। তার ওপরে ঝুঁকে আছে কৃষ্ণ মেঘ। সুচিদি কোন দিকে চেয়ে আছে বুঝলাম না। হয়তো আকাশে। কিন্তু আমি জানি, সুচিদিকে ‘এই তো আঠারো’ টেনে নিয়ে যাচ্ছে পেছনের দিকে।

সুচিদি, মানে তরুবু ছিল পাতার বড় বোন। পাতা আমার বন্ধু। আমাদের বাড়ি থেকে ওদের বাড়ির দূরত্ব মাঝে একটা মসজিদ আর ক্লাবঘরের। ক্লাবটা ওদের বাড়ির ঠিক পাশে। পাতার বাবা ছিলেন রেজিস্ট্রি অফিসের মুহুরি। তরুবু তখন তিন-চার বছর আগে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ডাইনিং চেয়ারের কভারে কাটওয়ার্ক করে, কেক-টিকিয়া-কাবাব বানানো শেখে, একতলার ছাদে রোদ পড়ে এলে আচারের বয়াম তুলতে গেলে ক্যারমবোর্ড থেকে চোখ তোলা ক্লাবের সব ছেলের একমাত্র দর্শনীয় বস্তুতে পরিণত হয়। ছেলেগুলোর সারা দিনের একমাত্র আকাঙ্ক্ষার পরিসমাপ্তি ঘটে। তো আমার ভাই রবিউল মাহমুদ ছিল ওই ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক। বাবা ওর নাম রেখেছিল মো. রবিউল হোসেন। তখন কবি আল মাহমুদের সোনালি কাবিন-এর ভক্তরা নিজেদের নামের শেষে সবাই মাহমুদ যোগ করতে শুরু করল। আমার ভাই রবু কবিতা লিখত। একদিন ক্লাবে কবিতা পাঠের আসরে মাইক এনে মাইকের মুখ পাতাদের বাসার দিকে ঘুরিয়ে ‘জন্ম আমার আজন্ম বৃথা’ নামে তার নিজের লেখা কবিতা পড়ল। ক্লাবের আর এক ত্যাঁদড় সদস্য মোমিনুল রবুদার কবিতা আবৃত্তির পরপরই মাইক কেড়ে নিয়ে ঘোষণা দিল—‘রবিউল মাহমুদ এতক্ষণ যে কবিতাটি পড়লেন, সেটি দাউদ হায়দারের “জন্ম আমার আজন্ম পাপ”-এর হুবহু নকল। এ ক্লাব থেকে নকল কবিদের উচ্ছেদ করা প্রয়োজন।’

আমি আর পাতা তখন ওদের চিলেকোঠায় সুচিদির বানানো মুড়ির মোয়া খাচ্ছিলাম আর সব কানে আসছিল। আমার ভাইয়ের ভরাট গলার কবিতা আমাকে কবির বোন হিসেবে যখন গর্বিত করতে উদ্যত, তখনই ওই ঘোষণা। আমি দ্রুত অন্য গল্পে মোড় নিলাম। কিন্তু পাতা বিশ্বাস করল না। বলল,

‘এ হতেই পারে না। মাসিক পাথরকুচিতে রবুদার কবিতা আমি পড়েছি। একটাও নকল না। বললেই হলো!’

কিন্তু যার জন্য এত কবিতা রচনা, এত কবিদের আবির্ভাব, তার কোনো বিকার নেই। কবিতা-টবিতা ওসব ওর কানেই যায় না। সুচিদি দিব্যি বালিশের ওয়ারে ক্রুশকাঁটার কাজ করছে আর মুখ না তুলেই তার জিজ্ঞাসা,

‘কীসের এত হইচই রে ক্লাবে?’

‘রাজকন্যাকে জয় করার মহড়া চলছে’—পাতার বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর। তরুর তুলনায় পাতা একেবারেই সাদামাটা। কিন্তু পাতা ক্লাসে থার্ড-ফোর্থ হয়। অনেক বই পড়ে। আমাদের বাড়ি এসে রবুদার আলমারি থেকে বই নিয়ে যায়। আমার কেন জানি মনে হয়, পাতা রবুদাকে ভালোবাসে। রবুদা অবশ্য ভাবে পাতা তরুর অনুরোধে বই নিয়ে যায়। ক্লাস নাইনে পড়া পাতা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় হজম করতে পারবে এ বিশ্বাস তার ছিল না বলেই একদিন বইয়ের মধ্যে চালান করে দেয় তরুর উদ্দেশ্যে প্রেমপত্র। পাতা আর আমি ওদের চিলেকোঠার ছাদে দরজা বন্ধ করে সে চিঠি পড়েছিলাম। এখনো মনে আছে, চিঠিতে এ রকম লেখা ছিল—‘সুচরিতাসু, আমি কত বসন্তরজনী তোমাকে নিয়ে শয্যা রচনা করেছি।’ আমার ভারি লজ্জা লাগছিল বলে আমি আর পড়িনি। পাতা তা হস্তান্তর করেনি প্রাপককে। করবেই বা কেন? সুচিদির তখন ফরিদপুর কলেজের ফিজিক্যাল ইনস্ট্রাক্টরের সঙ্গে বিয়ের কথা প্রায় পাকা। তবে পাত্র বছর খানেক সময় নিয়েছিল এমএ পাস করার জন্য। এমএ পাস করলে পাংশা কলেজে পৌরনীতির অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করতে পারবে—এ রকম নিশ্চয়তা সে পেয়েছিল। সুচিত্রা সেনকে গ্রহণের যোগ্য করে তুলতে হবে না নিজেকে!

চিঠিটা পেলে তরু কী সিদ্ধান্ত নিত জানি না। তবে তরুর ভালো গৃহিণী হওয়ার স্বপ্ন, ঘর-সংসার সামলানো, অনুগত পুত্রবধূ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা দেখে মনে হয়নি সে কোনো বিপ্লব করার ক্ষমতা রাখে। রবুদাকে বিয়ে করার মতো বোকামি কেন করতে যাবে তরু? পাত্র হিসেবে রবুদার কী পরিচয়? বিএ পাস করে কেবল সাহিত্য করলে ওর কাছে কে মেয়ে দেবে? হ্যাঁ, জমাজমি আমাদের ভালোই ছিল। কিন্তু কলেজের অধ্যাপক আর বেকারের মধ্যে তুলনা চলে? তবে কেন জানি রবুদা ধরেই নিয়েছিল, তরু তাকেই ভালোবাসে। জোর করে তরুর বিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

‘আজ তরুবুর মুখে ক্ষীর। দুলাভাইয়ের বোন আর ভগ্নিপতি আসবে। তুই আসিস কিন্তু’—একটু গলা বাড়িয়ে রবুদার ঘরের দিকে মুখ করে আমাকে দাওয়াত দিয়ে গেল পাতা।

রবুদা খানিক ঝিম ধরে বসে থেকে গায়ে একটা জামা চড়িয়ে বেরিয়ে গেল। গ্রামে ঢোকার মুখে রেলগেটের দোকানে গিয়ে সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে বসে থাকল যতক্ষণ না তরুর বৈবাহিক লোকজন আসে। রবুদা নাকি ওদের মোটরবাইক আটকেছিল। তরুর হবু ননদাইকে নামিয়ে দোকানের পেছনে দাঁড়িয়ে তরু সম্পর্কে যাচ্ছেতাই অপবাদ দিয়েছিল, যাতে ওরা ওখান থেকেই ফিরে যায়। 

ফিরে তো যায়ইনি, উপরন্তু মুখে ক্ষীরের দিন পাত্রকে ডেকে পাঠিয়ে পরদিনই কলমা পড়িয়ে সুচিত্রা সেনকে নিয়ে কেদারনাথের পগারপার। মোটা, বিরল কেশ, ভোঁতামুখের অধ্যাপককে সুচিদির ভক্তরা নাম দিয়েছিল কেদারনাথ। হূদয় ভেঙে গেল অনেক যুবকের। ক্লাবঘর কিশোরদের দখলে চলে গেল। খড়ের ছাউনির দুর্বল ক্লাবঘরের চাল অভিভাবকদের মনোযোগের অভাবে এক বৈশাখে উড়ে গিয়ে পাতাদের উঠোনে গিয়ে পড়ল। সবকিছু লন্ডভন্ড। রবুদা একমুখ দাড়ি নিয়ে দেড় মাস পর খালার বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাড়ি এল। আমার ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষ হলে পাতার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি রাজশাহী সরকারি কলেজে পড়তে গেলাম। পাতা শহরের স্থানীয় কলেজে ভর্তি হলো। মা রবুদার জন্য সুন্দরী পাত্রী জোগাড়ের প্রাণান্ত চেষ্টা চালাতে লাগল। রবুদা কবিতা ছেড়ে ঠিকাদারি শুরু করেছে। চোখের দিকে তাকানো যায় না। কেমন জিঘাংসার আগুন জ্বলজ্বল করে।

দুই বছর পর মায়ের চিঠি।

‘পর সমাচার এই যে, গতরাতে তোমার প্রাণের বান্ধবী পাতা বিষপানে আত্মহত্যা করিয়াছে। পুলিশ আসিয়াছিল। সে লিখিয়া গিয়াছে তাহার মৃত্যুর জন্য কেহ দায়ী নহে। তরু ও তরুর স্বামী আসিয়া সব ব্যবস্থা করিয়াছে। তাহার মা পাগলপ্রায়। ছুটি হইলে চলিয়া আসিও। রবুর জন্য পাত্রী পছন্দ হইয়াছে। ইতি মা।’

আমার হোস্টেলের বান্ধবীরা আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখল। আমি পাতার চিঠিগুলো বের করে পড়ার চেষ্টা করলাম। কোথায় পাতার বেদনা তা খোঁজার জন্য বারবার করে পড়তে থাকলাম। কিন্তু কান্নায় আমার সবকিছু ঝাপসা হয়ে এল। আমার রুমমেট আমার ব্যাগ গুছিয়ে দিল। ছুটি হতে আরও দিন সাতেক দেরি থাকলেও আমার রুমমেট আমাকে নিয়ে পরদিনই রওনা দিল। আমি ছুটে গিয়ে পাতার মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম। পাতার মা উদ্ভ্রান্তের মতো অন্যদিকে তাকিয়ে থাকল, তার ছড়ানো দু-হাত আমার পিঠে উঠে এল না। তরুবু তার বাঁ হাতে স্ফীত তলপেট চেপে আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে আমার মাথায় হাত দিল। সে হাতের ছোঁয়া আমার আবেগকে দু-কূল প্লাবিত করতে ব্যর্থ হলো। আমি চোখ তুলে সুচিত্রা সেনকে খুঁজলাম। এ কবছরেই সুচিদির বয়স এত বেড়েছে! নাকি গর্ভবতীদের চেহারা এ রকম হয়ে যায়? অত টিকলো নাক ওরকম মোটা দেখাচ্ছে কেন? নাকি এসবই আমার ঝাপসা চোখের প্রতিফলন? শোকে-বিহ্বলে কেমন নিষপ্রাণ আচরণ সবার। কেন পাতা এমন করল, কী হয়েছিল ওর—কাউকে জিজ্ঞাসা করার সে পরিবেশও আমাকে কেউ উপহার দিল না। আমি একাই ওর ঘরে গেলাম। ওর বইখাতা ছুঁয়ে ওর হাতের স্পর্শ নিলাম। আমার দেওয়া মানিপ্ল্যান্টটা ওর খোলা জানালা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যেতে উদ্যত। ওর বালিশ টেনে নাকে ধরলাম। নারকেল তেলে মেথি মিশিয়ে সারা বছর চুলে দিত পাতা। বালিশে পাতার জীবন্ত গন্ধ। আমি ‘পাতা পাতা’ বলে ডুকরে কেঁদে উঠলাম। মানিপ্ল্যান্টের পাতারা একটুখানি নড়ে উঠল।

সুচিদি সংবিৎ ফিরে আমার ঘাড়ে হাত রাখল। এ স্পর্শেও প্রাণের ছোঁয়া নেই। অন্যদিকে তাকিয়েই বলল,

‘আব্বা তো ছবছর হলো মারা গেছে। মাও অসুস্থ। আমার কাছে নিয়ে যেতে চাচ্ছি। যেতে চায় না।’

‘তোমার কটা গো সুচিদি?’

‘দুটো। ছেলেটা বড়। মেয়েটার বিয়ে দিয়ে দেব ভাবছি।’

‘ওমা! এত তাড়াতাড়ি?’

‘মেয়েটা পাতার মতো দেখতে।’

‘তো?’—বলে ফেলেও আমি চাইলাম না সুচিদি পাতার কথা তুলুক। পাতার জন্য আমার কষ্ট তো সুচিদির কষ্টের কাছে কিছুই না।

সুচিদি আবার আনমনা। মাথার ঘোমটা ঘাড়ে এসে পড়ল। কানে ভারী দুটো পাশা। অনেক দিন ধরে পরে থাকার কারণে কানের লতি কেটে পাশা ঝুলে পড়েছে। সুচিদিকে এখন বেশ দেখাচ্ছে। কিন্তু আলো আমার আলো-এর সুচিত্রা সেনের মতো নয়। আঁচলের খুঁটে চোখ মুছল সে। ট্রেন আসার ঘণ্টা হলে সবাই তটস্থ হয়ে নামিয়ে রাখা ব্যাগ হাতে তুলে নিল। আমার ঘাড় থেকে হাত সরিয়ে আবার মাথার ঘোমটা টেনে ব্যাগটা কোলের ওপর তুলে সুচিদি বলল,

‘পাতা তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিল।’

আমার হাতের ব্যাগ বেঞ্চের ওপর ধপ করে পড়ে গেল। মানুষজন প্লাটফর্মে জড়ো হতে শুরু করেছে। আর আমি ভারসাম্য রাখতে না পেরে বেঞ্চের ওপর বসে পড়লাম। সুচিদি উঠে দাঁড়াল।

‘রবুর মেয়ের বয়স কত বললি?’

‘আঠারো, কেন?’

‘পাতারও আঠারোই ছিল কিনা।’ 

ইঞ্জিনের মুখে ঘন ধুলো উড়িয়ে ট্রেন আরও সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সুচিদি বসে থাকা আমাকে কোনো ধরনের তাড়া না দিয়েই ট্রেনের দিকে এগিয়ে গেল। সুচিদি যে বগিতে উঠল, আমি সেটাতে উঠেও আবার নেমে এসে পরের বগির জন্য একটু জোরে পা চালালাম।

 
Support : Dhumketo ধূমকেতু | NewsCtg.Com | KUTUBDIA @ কুতুবদিয়া | eBlog
Copyright © 2013. Edu2News - All Rights Reserved
Template Created by Nejam Kutubi Published by Darianagar Publications
Proudly powered by Dhumketo ধূমকেতু