বিএনপি হারত না, কিন্তু এখন হেরে গেছে!!! সর্বশেষ এক জরিপে দেখা যাচ্ছে, সব দল অংশগ্রহণ করলে ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপি অন্তত সাড়ে ৫ শতাংশ ভোট কম পেত।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের (ডিআই) এই জরিপ নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ কম। তাহলে প্রশ্ন, নির্বাচনের আগে একাধিক জরিপে দেখা গেছে, ভোটে আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপি অনেক বেশি এগিয়ে থাকবে, সেটা কি ভুল ছিল?
না, তা নয়। ওই জরিপের ফলাফলও যথার্থই ছিল। ওই সময় যদি বিএনপি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলত, ঠিক আছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন করব, তাহলে বিএনপির বিজয় ছিল অবধারিত। এটা মনগড়া কথা নয়। গত ২৪ জানুয়ারি রাতের ট্রেনে রাজশাহী যাচ্ছিলাম। সেখানে পরদিন গণিত উৎসব হবে। আমাদের কক্ষের বাকি দুজনের সঙ্গে আড্ডা জুড়ে দিলাম। তাঁরা রাজশাহীর অধিবাসী। বললেন, নির্বাচনে না গিয়ে বিএনপি মারাত্মক ভুল করেছে। তাদের বিজয় ছিল অবশ্যম্ভাবী। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আওয়ামী লীগের সাংসদেরা বহাল, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায়, এ অবস্থায় কি বিএনপিকে জিততে দেওয়া হতো? তাঁরা কথাটা উড়িয়ে দিলেন। বললেন, কারচুপির কোনো সুযোগই ছিল না। মানুষের বন্যায় সব ভেসে যেত।
আমি রাজশাহীতে গিয়ে বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, নির্বাচনে গেলে মোট ছয়টি আসনের সব কটিতেই বিএনপি চোখ বন্ধ করে জিতে যেত। কারও মধ্যে কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখা যায়নি। যেমন রাজশাহী-৬, বাঘা-চারঘাট আসনে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এক লাখ ২৭ হাজার ভোট পেয়ে জিতেছিলেন। এবারও তিনি জিতেছেন। বিএনপির প্রার্থী ছিল না। ছিল আওয়ামী লীগেরই বিদ্রোহী প্রার্থী। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে এই দুই আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বীর মিলিত ভোটের পরিমাণ মোট মাত্র ৯১ হাজার। গত নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগ প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোটের চেয়েও প্রায় ৩০ হাজার কম! তাহলে দেখুন, আওয়ামী লীগের অবস্থান কত পড়ে গেছে। বিএনপি থাকলে তাদের বিজয় কে ঠেকাত?
দুই দিন আগে ঢাকায় সাতক্ষীরার একজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি বললেন, ওদের ওখানে নির্বাচন হলে চারটি আসনের সব কটিতেই আওয়ামী লীগ পরাজিত হতো। সেখানে মূলত জামায়াতের প্রভাব। বিএনপির তেমন প্রভাব নেই। কিন্তু কথা তো একই। জামায়াত জিতলেও তো বিএনপির ভাগেই যেত। হয়তো সদর আসনে জাতীয় পার্টি জিতত। বাকি তিনটির মধ্যে জামায়াত একটি ও বিএনপি দুটি আসন পেত। আমি ওখানের লোকজনের সঙ্গে ফোনে কথা বলে দেখেছি, তাদের চিন্তার সঙ্গে সব মিলে যায়।
সিলেটে কথা বললাম। পরিচিতজনেরা জানালেন, সিলেট বিভাগের ১৯টি আসনের মধ্যে ১৭টিতেই বিএনপি চোখ বন্ধ করে জিতে যেত। আওয়ামী লীগ হয়তো দুটি আসনে জিততে পারত।
অবশ্য আলোচ্য তিন জেলায় বিএনপির পাল্লা ভারী। ফরিদপুর, দিনাজপুরসহ অন্য অনেক জেলায় হয়তো আওয়ামী লীগের প্রার্থীরাও জিতত। ফলে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে বিএনপি জিতলেও দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া কঠিন হতো। বিএনপি হয়তো ভেবেছিল সরকারের পতন ঘটিয়ে নির্বাচনে গেলে তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য থাকবে। এই চিন্তাই তাদের কাল হয়েছে। মানুষ এখন আর কোনো দলের একাধিপত্য চায় না। এটা সত্যিই দুর্ভাগ্য যে বিএনপি মানুষের মনের কথা বুঝতে পারেনি।
মোটের ওপর নির্বাচনে গেলে বিএনপি অনায়াসে জিততে পারত। প্রশ্ন ওঠে, অবস্থাটা যদি ওই রকমই হয়ে থাকে, তাহলে আজ কেন জরিপে মানুষ বলছে যে ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপি কম ভোট পেত? এর কারণ হলো, বিএনপি নির্বাচন বর্জনের জন্য যে মারাত্মক ও নির্মম সহিংসতার পথ ধরেছিল, তার ফলে মানুষ ক্রমে দূরে সরে গেছে। পেট্রলবোমা, ককটেল, পুলিশ হত্যা, বাস-ট্রাকের চালক হত্যা, শিশু হত্যা, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া, দিনের পর দিন হরতাল-অবরোধ—এর প্রতিটি কর্মসূচি মানুষের মন বিষিয়ে তুলেছে। কৃষক থেকে শুরু করে গরিব দিনমজুর-খেটে খাওয়া মানুষ ছিল অসহায়। অনেক ব্যবসায়ী শিল্পপতিকে লোকসান গুনতে হয়েছে।
বিএনপি যদি সেপ্টেম্বর-অক্টোবর থেকেই নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করত, তাহলে মানুষের ঢল নামত বিএনপির পক্ষে। কিন্তু পরে যখন দেখল দেশকে বিএনপি সহিংসতার বিপজ্জনক পথে ঠেলে দিচ্ছে, তখনই ভোটারদের মনোভাব বদলাতে থাকে। এ জন্যই নির্বাচনের আগে ও পরে জরিপের ফলাফল উল্টে গেছে। বিএনপি বলবে, ওরা কোনো সহিংসতা করেনি, করেছে জামায়াত। হতে পারে। কিন্তু তাদের মৌন সমর্থন
ছাড়া কি জামায়াতের সাধ্য ছিল সহিংসতা করার? এটা তো মানুষ বোঝে।
আরেকটি প্রশ্ন হলো, নির্বাচনের আগে বিএনপির পক্ষে এত বিশাল সমর্থন থাকা সত্ত্বেও মানুষ কেন রাস্তায় নেমে নির্বাচন প্রতিহত করল না? কারণ, মানুষ সহিংসতার পথে নয়, গণতন্ত্রের পথেই ওই একতরফা নির্বাচনকে ‘না’ বলাকে শ্রেয় মনে করেছে। দু-চারটি ছাড়া বাকি সব কটি আসনেই মানুষ বাসায় বসে থেকে, ভোটকেন্দ্রে না গিয়ে তাদের প্রতিবাদ জানিয়েছে। একই সঙ্গে তাদের একটা বড় অংশ বলতে গেলে বিএনপির সহিংসতার প্রতিও ‘না’ জানিয়ে দিয়েছে। তাদের দলে দলে রাস্তায় নেমে না আসার কারণ এটাই। এখানে বিএনপি ভুল করেছে। তাদের হিসাব ছিল জনপ্রতিরোধ নির্বাচন রুখে দেবে, সরকারের পতন ঘটবে। মানুষ কিন্তু সেই মেজাজে ছিল না।
বিএনপির সহিংসতা ও একটানা হরতাল-অবরোধে বিপর্যস্ত হয়ে আজ, নির্বাচনের পর, মানুষ আগের মতো আর বিএনপিকে ঢালাওভাবে ভোট দিতে আগ্রহী না। ডিআই জরিপের ফলাফলের এটাই তাৎপর্য। নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর মানুষ একটু স্বস্তি পেয়েছে। দিনের পর দিন হরতাল-অবরোধ-ককটেল খেতে কেউ রাজি নয়। এখন শান্তিতে চলাফেরা করা যাচ্ছে। পথেঘাটে বোমা-ককটেলে মারা যাওয়ার আশঙ্কা কম। এটাই ভালো।
একটা বিষয় পরিষ্কার। বোমা মেরে সরকারের পতন ঘটানোর স্বপ্ন থেকে বিরোধী দলকে বেরিয়ে আসতে হবে। জামায়াত যে বৃহস্পতিবার আবার হরতাল ডেকেছে, তার বোঝা কিন্তু ওই বিএনপিকেই টানতে হবে। তাই জামায়াতের সংশ্রব ছাড়তে হবে, অথবা পরিষ্কার বলতে হবে জামায়াতের হরতাল বিএনপি সমর্থন করে না। তারা সংবাদ সম্মেলন করে, পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে বলুক যে জামায়াতের সঙ্গে ওরা নেই।
যদি বিএনপির বোধোদয় হয় ভালো। না হলে মানুষ তার পথ বেছে নেবে। বাঙালির টিকে থাকার অসাধারণ ক্ষমতা। সেদিন প্রথম আলো কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাবেক মহাসচিব আইরিন খান বলছিলেন, সাধারণ বাঙালি ইটালিতে যায়। প্রথমে রাস্তায় ফুটপাতে দাঁড়িয়ে পথচারীদের কাছে গোলাপ ফুল বিক্রি করে দুই পয়সা কামাই করেন। একটু পয়সা জমলেই ছোটখাটো ব্যবসা খুলে বসেন। তাঁরাই দেশে টাকা পাঠান। দেশের বৈদেশিক মুদ্রাভান্ডার সমৃদ্ধ করেন।
অবরোধের সময় আমি বাসে করে যাচ্ছিলাম। খুব ভিড়। হঠাৎ একজন আসন ছেড়ে আমাকে প্রায় জোর করে বসিয়ে দিলেন। জানতে পারলাম, তিনি আমাদের পত্রিকা অফিসের সামনে রোজ বিকেলে জুতার খুচরা দোকান বসান। রমজান মিঞা। তিনি বাসে করে গুলিস্তানে যান আর সেখান থেকে জুতা কিনে এনে কারওয়ান বাজারে বিক্রি করেন। লাভ মোটামুটি ভালো। তিনি জানালেন, এত হরতালের মধ্যেও ক্রেতা মোটামুটি ছিল, তিনি খেয়েপরে বেঁচে আছেন। অল্পে খুশি বলেই তাঁর মুখে হাসিটি অমলিন। বলেন, হরতাল-অবরোধের মধ্যেও তো সংসার চালাতে হবে। রোববার তাঁর সঙ্গে দেখা হলে বলেন, স্যার, আমাদের ব্যবসা আবার পুরোদমে শুরু হয়ে গেছে। রমজান মিঞাকে হাজার সালাম জানাই। তাঁরা আছেন বলেই দেশ অচল হয় না।
রাজশাহীতে কথা হচ্ছিল আলমিরা আর্টস অ্যান্ড ফার্নিচারের স্বত্বাধিকারী আরাফাত রুবেলের সঙ্গে। পারটেক্সের ব্যবসা করেন। নিজে ডিজাইন করেন, তাঁর আসবাব জনপ্রিয়। তিনি বললেন, রাজনৈতিক গোলযোগে যেটুকু লোকসান হয়েছিল, গত তিন সপ্তাহে পুষিয়ে গেছে। এখন কেনাকাটার ধুম পড়েছে। আর চিন্তা নেই।
এই মানুষগুলো আছে বলেই বাংলাদেশ টিকে আছে। টিকে থাকবে।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com
না, তা নয়। ওই জরিপের ফলাফলও যথার্থই ছিল। ওই সময় যদি বিএনপি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলত, ঠিক আছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন করব, তাহলে বিএনপির বিজয় ছিল অবধারিত। এটা মনগড়া কথা নয়। গত ২৪ জানুয়ারি রাতের ট্রেনে রাজশাহী যাচ্ছিলাম। সেখানে পরদিন গণিত উৎসব হবে। আমাদের কক্ষের বাকি দুজনের সঙ্গে আড্ডা জুড়ে দিলাম। তাঁরা রাজশাহীর অধিবাসী। বললেন, নির্বাচনে না গিয়ে বিএনপি মারাত্মক ভুল করেছে। তাদের বিজয় ছিল অবশ্যম্ভাবী। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আওয়ামী লীগের সাংসদেরা বহাল, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায়, এ অবস্থায় কি বিএনপিকে জিততে দেওয়া হতো? তাঁরা কথাটা উড়িয়ে দিলেন। বললেন, কারচুপির কোনো সুযোগই ছিল না। মানুষের বন্যায় সব ভেসে যেত।
আমি রাজশাহীতে গিয়ে বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, নির্বাচনে গেলে মোট ছয়টি আসনের সব কটিতেই বিএনপি চোখ বন্ধ করে জিতে যেত। কারও মধ্যে কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখা যায়নি। যেমন রাজশাহী-৬, বাঘা-চারঘাট আসনে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এক লাখ ২৭ হাজার ভোট পেয়ে জিতেছিলেন। এবারও তিনি জিতেছেন। বিএনপির প্রার্থী ছিল না। ছিল আওয়ামী লীগেরই বিদ্রোহী প্রার্থী। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে এই দুই আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বীর মিলিত ভোটের পরিমাণ মোট মাত্র ৯১ হাজার। গত নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগ প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোটের চেয়েও প্রায় ৩০ হাজার কম! তাহলে দেখুন, আওয়ামী লীগের অবস্থান কত পড়ে গেছে। বিএনপি থাকলে তাদের বিজয় কে ঠেকাত?
দুই দিন আগে ঢাকায় সাতক্ষীরার একজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি বললেন, ওদের ওখানে নির্বাচন হলে চারটি আসনের সব কটিতেই আওয়ামী লীগ পরাজিত হতো। সেখানে মূলত জামায়াতের প্রভাব। বিএনপির তেমন প্রভাব নেই। কিন্তু কথা তো একই। জামায়াত জিতলেও তো বিএনপির ভাগেই যেত। হয়তো সদর আসনে জাতীয় পার্টি জিতত। বাকি তিনটির মধ্যে জামায়াত একটি ও বিএনপি দুটি আসন পেত। আমি ওখানের লোকজনের সঙ্গে ফোনে কথা বলে দেখেছি, তাদের চিন্তার সঙ্গে সব মিলে যায়।
সিলেটে কথা বললাম। পরিচিতজনেরা জানালেন, সিলেট বিভাগের ১৯টি আসনের মধ্যে ১৭টিতেই বিএনপি চোখ বন্ধ করে জিতে যেত। আওয়ামী লীগ হয়তো দুটি আসনে জিততে পারত।
অবশ্য আলোচ্য তিন জেলায় বিএনপির পাল্লা ভারী। ফরিদপুর, দিনাজপুরসহ অন্য অনেক জেলায় হয়তো আওয়ামী লীগের প্রার্থীরাও জিতত। ফলে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে বিএনপি জিতলেও দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া কঠিন হতো। বিএনপি হয়তো ভেবেছিল সরকারের পতন ঘটিয়ে নির্বাচনে গেলে তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য থাকবে। এই চিন্তাই তাদের কাল হয়েছে। মানুষ এখন আর কোনো দলের একাধিপত্য চায় না। এটা সত্যিই দুর্ভাগ্য যে বিএনপি মানুষের মনের কথা বুঝতে পারেনি।
মোটের ওপর নির্বাচনে গেলে বিএনপি অনায়াসে জিততে পারত। প্রশ্ন ওঠে, অবস্থাটা যদি ওই রকমই হয়ে থাকে, তাহলে আজ কেন জরিপে মানুষ বলছে যে ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপি কম ভোট পেত? এর কারণ হলো, বিএনপি নির্বাচন বর্জনের জন্য যে মারাত্মক ও নির্মম সহিংসতার পথ ধরেছিল, তার ফলে মানুষ ক্রমে দূরে সরে গেছে। পেট্রলবোমা, ককটেল, পুলিশ হত্যা, বাস-ট্রাকের চালক হত্যা, শিশু হত্যা, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া, দিনের পর দিন হরতাল-অবরোধ—এর প্রতিটি কর্মসূচি মানুষের মন বিষিয়ে তুলেছে। কৃষক থেকে শুরু করে গরিব দিনমজুর-খেটে খাওয়া মানুষ ছিল অসহায়। অনেক ব্যবসায়ী শিল্পপতিকে লোকসান গুনতে হয়েছে।
বিএনপি যদি সেপ্টেম্বর-অক্টোবর থেকেই নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করত, তাহলে মানুষের ঢল নামত বিএনপির পক্ষে। কিন্তু পরে যখন দেখল দেশকে বিএনপি সহিংসতার বিপজ্জনক পথে ঠেলে দিচ্ছে, তখনই ভোটারদের মনোভাব বদলাতে থাকে। এ জন্যই নির্বাচনের আগে ও পরে জরিপের ফলাফল উল্টে গেছে। বিএনপি বলবে, ওরা কোনো সহিংসতা করেনি, করেছে জামায়াত। হতে পারে। কিন্তু তাদের মৌন সমর্থন
ছাড়া কি জামায়াতের সাধ্য ছিল সহিংসতা করার? এটা তো মানুষ বোঝে।
আরেকটি প্রশ্ন হলো, নির্বাচনের আগে বিএনপির পক্ষে এত বিশাল সমর্থন থাকা সত্ত্বেও মানুষ কেন রাস্তায় নেমে নির্বাচন প্রতিহত করল না? কারণ, মানুষ সহিংসতার পথে নয়, গণতন্ত্রের পথেই ওই একতরফা নির্বাচনকে ‘না’ বলাকে শ্রেয় মনে করেছে। দু-চারটি ছাড়া বাকি সব কটি আসনেই মানুষ বাসায় বসে থেকে, ভোটকেন্দ্রে না গিয়ে তাদের প্রতিবাদ জানিয়েছে। একই সঙ্গে তাদের একটা বড় অংশ বলতে গেলে বিএনপির সহিংসতার প্রতিও ‘না’ জানিয়ে দিয়েছে। তাদের দলে দলে রাস্তায় নেমে না আসার কারণ এটাই। এখানে বিএনপি ভুল করেছে। তাদের হিসাব ছিল জনপ্রতিরোধ নির্বাচন রুখে দেবে, সরকারের পতন ঘটবে। মানুষ কিন্তু সেই মেজাজে ছিল না।
বিএনপির সহিংসতা ও একটানা হরতাল-অবরোধে বিপর্যস্ত হয়ে আজ, নির্বাচনের পর, মানুষ আগের মতো আর বিএনপিকে ঢালাওভাবে ভোট দিতে আগ্রহী না। ডিআই জরিপের ফলাফলের এটাই তাৎপর্য। নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর মানুষ একটু স্বস্তি পেয়েছে। দিনের পর দিন হরতাল-অবরোধ-ককটেল খেতে কেউ রাজি নয়। এখন শান্তিতে চলাফেরা করা যাচ্ছে। পথেঘাটে বোমা-ককটেলে মারা যাওয়ার আশঙ্কা কম। এটাই ভালো।
একটা বিষয় পরিষ্কার। বোমা মেরে সরকারের পতন ঘটানোর স্বপ্ন থেকে বিরোধী দলকে বেরিয়ে আসতে হবে। জামায়াত যে বৃহস্পতিবার আবার হরতাল ডেকেছে, তার বোঝা কিন্তু ওই বিএনপিকেই টানতে হবে। তাই জামায়াতের সংশ্রব ছাড়তে হবে, অথবা পরিষ্কার বলতে হবে জামায়াতের হরতাল বিএনপি সমর্থন করে না। তারা সংবাদ সম্মেলন করে, পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে বলুক যে জামায়াতের সঙ্গে ওরা নেই।
যদি বিএনপির বোধোদয় হয় ভালো। না হলে মানুষ তার পথ বেছে নেবে। বাঙালির টিকে থাকার অসাধারণ ক্ষমতা। সেদিন প্রথম আলো কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাবেক মহাসচিব আইরিন খান বলছিলেন, সাধারণ বাঙালি ইটালিতে যায়। প্রথমে রাস্তায় ফুটপাতে দাঁড়িয়ে পথচারীদের কাছে গোলাপ ফুল বিক্রি করে দুই পয়সা কামাই করেন। একটু পয়সা জমলেই ছোটখাটো ব্যবসা খুলে বসেন। তাঁরাই দেশে টাকা পাঠান। দেশের বৈদেশিক মুদ্রাভান্ডার সমৃদ্ধ করেন।
অবরোধের সময় আমি বাসে করে যাচ্ছিলাম। খুব ভিড়। হঠাৎ একজন আসন ছেড়ে আমাকে প্রায় জোর করে বসিয়ে দিলেন। জানতে পারলাম, তিনি আমাদের পত্রিকা অফিসের সামনে রোজ বিকেলে জুতার খুচরা দোকান বসান। রমজান মিঞা। তিনি বাসে করে গুলিস্তানে যান আর সেখান থেকে জুতা কিনে এনে কারওয়ান বাজারে বিক্রি করেন। লাভ মোটামুটি ভালো। তিনি জানালেন, এত হরতালের মধ্যেও ক্রেতা মোটামুটি ছিল, তিনি খেয়েপরে বেঁচে আছেন। অল্পে খুশি বলেই তাঁর মুখে হাসিটি অমলিন। বলেন, হরতাল-অবরোধের মধ্যেও তো সংসার চালাতে হবে। রোববার তাঁর সঙ্গে দেখা হলে বলেন, স্যার, আমাদের ব্যবসা আবার পুরোদমে শুরু হয়ে গেছে। রমজান মিঞাকে হাজার সালাম জানাই। তাঁরা আছেন বলেই দেশ অচল হয় না।
রাজশাহীতে কথা হচ্ছিল আলমিরা আর্টস অ্যান্ড ফার্নিচারের স্বত্বাধিকারী আরাফাত রুবেলের সঙ্গে। পারটেক্সের ব্যবসা করেন। নিজে ডিজাইন করেন, তাঁর আসবাব জনপ্রিয়। তিনি বললেন, রাজনৈতিক গোলযোগে যেটুকু লোকসান হয়েছিল, গত তিন সপ্তাহে পুষিয়ে গেছে। এখন কেনাকাটার ধুম পড়েছে। আর চিন্তা নেই।
এই মানুষগুলো আছে বলেই বাংলাদেশ টিকে আছে। টিকে থাকবে।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com
0 comments:
Post a Comment