দশম জাতীয় সংসদ- কেন বিরোধী দল জরুরি? by আলী রীয়াজ

Friday, January 31, 2014

দশম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন বসবে আজ ২৯ জানুয়ারি। দিনটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের রাজনীতি এবং সংসদীয় ইতিহাসের জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ দিন বলে আমাদের বিবেচনা করা দরকার।
সেটা কেবল এই কারণে নয় যে এই সংসদে আসন নেবেন এমন সাংসদের অর্ধেকেই প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হননি। কেবল এই কারণেও নয় যে এই নির্বাচন বিতর্কিত। এই কারণে যে এই সংসদে কোনো বিরোধী দল থাকবে না। গতকালের আলোচনায় আমরা দেখেছি, কেউ কেউ এই যুক্তিতে একে সমর্থন করছেন যে গত সংসদের বিরোধী দল বিএনপি তার ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে। এ বিষয়ে কোনো রকম ভিন্নমত না পোষণ করেও বলা যায়, ১৯৯১ সালে থেকেই সংসদে বিরোধী দল তার ভূমিকা পালনে সফল হয়নি।

তার পরেও আমরা কেন সংসদে বিরোধী দল থাকার ওপর জোর দিতে চাই?
সংসদীয় ব্যবস্থার উদ্ভবের ইতিহাস যাঁরা জানেন, তাঁদের এ কথা অজানা নয় যে ব্রিটেনের পার্লামেন্টে ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে সাংসদেরা যদি তাঁদের ব্যক্তিগত, স্থানীয় কিংবা বিশেষ ধরনের ক্ষোভের বাইরে কিছু বক্তব্য দিতেন, তবে তাঁর পরিণতি হতো ভয়াবহ। রাজার বিরোধিতা, উত্তরাধিকারের অধিকার, পররাষ্ট্রনীতি বা ধর্মের মতো জাতীয় বিষয় নিয়ে বিতর্ক করলে কারাবাস ছিল নিশ্চিত, প্রাণহানির আশঙ্কা কোনো কল্পিত বিষয় ছিল না। তার অর্থ হলো, পার্লামেন্ট সদস্যরা রাজার বিরোধী হতে পারবেন না; ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য তাঁরা সংসদে নির্বাচিত হননি। তাঁদের কাজ বড়জোর আলাদাভাবে ব্যক্তি হিসেবে তাঁদের ভোটারদের দৈনন্দিন সমস্যার সমাধানে রাজার দৃষ্টি আকর্ষণ করা।
ইতিহাসবিদেরা এও জানান যে অষ্টাদশ শতাব্দীর আগে সংসদীয় গণতন্ত্রের সূতিকাগার বলে পরিচিত ইংল্যান্ডেও বিরোধী দলের ধারণার উত্থান হয়নি। বিরোধী দলের ধারণার উদ্ভবের আগে ‘বিরোধী’দের প্রধান ভূমিকা কী, সেটা স্পষ্ট রূপ লাভ করতে শুরু করে। বিরোধীরা কেবল সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের বিরোধিতা করবে তা-ই নয়, তাঁরা বিকল্পও উপস্থাপনও করবে, সামগ্রিকভাবে রাজ্য শাসনের বিকল্প। এই বিকল্পের প্রশ্নেই ইংল্যান্ডে রাজনৈতিক দলের উদ্ভব ঘটে; অন্যথায় সপ্তদশ শতকের গোড়ায়ও ‘দলাদলি’ এবং ‘পার্টি’কে কলঙ্কজনক বলেই মনে করা হতো। এ শতকেই আমরা দেখতে পাই, এই ধারণা সুস্পষ্ট রূপ নিতে শুরু করেছে যে ক্ষমতাসীন শক্তির বিরোধিতা করার বিষয়টি কেবল ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়, তার জন্য সংগঠিতভাবে দল গঠন এবং আদর্শিক ও ঐক্যবদ্ধভাবে কর্মকাণ্ড পরিচালনার মধ্য দিয়েই সরকারের বিকল্প উপস্থাপন করা যেতে পারে। যে দেশে ক্ষমতাসীনের বিরুদ্ধে বলাকে বিবেচনা করা হতো রাষ্ট্রদ্রোহ বলে, সেখানে ক্ষমতাসীনেরাও বিরোধীদের দল গঠন এবং জাতীয় বিভিন্ন প্রশ্নে তাদের অবস্থানকে বৈধ এবং সংগত বলে মনে করতে থাকে। ইংল্যান্ডে সপ্তদশ শতকের শেষ ভাগে রাজার উত্তরাধিকারের প্রশ্নকে, বিশেষত রাজা দ্বিতীয় জেমসের ক্ষমতায় আরোহণকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট বিতর্কেই দল হিসেবে টোরি এবং হুইগ পার্টির আবির্ভাব ঘটে। রাজসিংহাসনে উত্তরাধিকারের প্রশ্ন সামনে নিয়েই সাংগঠনিকভাবে সংসদীয় বিরোধী দলের আবির্ভাব ঘটেছে।
জন স্টুয়ার্ট মিল ১৮৫৯ সালে অন লিবার্টি বইয়ে লিখেছেন, সুস্থ রাজনীতির জন্য যেমন দরকার স্থিতিশীলতার পক্ষের দল, তেমনি দরকার প্রগতিশীলতার বা সংস্কারের পক্ষের দল। বিপরীতমুখী চিন্তাভাবনার এবং আদর্শের মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা সমাজে উপস্থিত থাকলে আমরা তার প্রতিফলন দেখতে পাব রাজনীতিতে সংসদে এবং সংসদের বাইরেও। আধুনিক অর্থে রাজনৈতিক দলের উদ্ভবের প্রশ্নটি গণতন্ত্রের সঙ্গেই জড়িত, সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার যে কারণে রাজনৈতিক দলকে ‘গণতন্ত্রের সন্তান’ বলে বর্ণনা করেছেন। গণতন্ত্রের একটা প্রধান লক্ষণ হচ্ছে যে এই ব্যবস্থা জনসাধারণকে পছন্দের সুযোগ দেয়; বিভিন্ন বিকল্পের মধ্য থেকে তাদের ইচ্ছে অনুযায়ী ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দেওয়ার নিশ্চয়তা কেবল গণতন্ত্রই দিতে পারে। একই সঙ্গে গণতন্ত্র সেই ভুল সংশোধনের সুযোগও উন্মুক্ত রাখে। রাজনীতিতে সেই সুযোগ দেওয়ার অবকাশ থাকে কেবল বিপরীতমুখী রাজনৈতিক দলের উপস্থিতির মধ্য দিয়ে। কেবল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় একত্র মানুষের গোষ্ঠীকেই আমরা রাজনৈতিক দল বলে বিবেচনা করি না এই কারণে যে রাজনৈতিক দল গঠনের পেছনে আদর্শের প্রশ্নটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। সে কারণে রাজনৈতিক দলকে জনগণের প্রতিনিধিত্বের দাবি করতে হলে আদর্শিকভাবে তার অবস্থানকে তুলে ধরতে হয় এবং ক্ষমতাসীনের বিপরীতে তাদের নীতিকে তুলে ধরতে হয়। একইভাবে তা ক্ষমতাসীন দলের জন্যও প্রযোজ্য, তাকে দেখাতে হয় যে সে কেন বিরোধীদের থেকে শ্রেয়।
তাহলে আমরা দেখতে পাই যে রাজনৈতিক দল এবং সংসদীয় বিরোধী দলের প্রধান কাজ হচ্ছে জবাবদিহির দাবি তোলা এবং সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাওয়া। সংসদীয় ব্যবস্থায় সংসদের প্রধান কাজই হচ্ছে সেই নির্বাহী বিভাগের ওপরে নজরদারি করা। কিন্তু ১৯৯১ সালের পরে আমরা যেটা দেখতে পাচ্ছি যে প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ সেই ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাতে করে আমরা নির্বাচনের মাধ্যমে যে ধরনের সংসদ তৈরি হতে দেখেছি, তাতে যে দলই ক্ষমতায় গেছে, তারা সংসদকে তাদের প্রতিশ্রুত রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করতে পারেনি কিংবা চায়নি।
১৯৯১ সালে দেশে সংসদীয় ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তনের পেছনে দলনির্বিশেষে যে ঐক্য হয়েছিল, তার অন্যতম কারণ ছিল এই যে রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থার অভিজ্ঞতা থেকে আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, তাতে করে ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণ ঘটে এবং শাসন হয়ে পড়ে ব্যক্তিকেন্দ্রিক। এই ব্যবস্থা ব্যক্তিকে জবাবদিহির ঊর্ধ্বে নিয়ে যায়। সেই বিবেচনায়ই সংসদের কাছে নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহির ব্যবস্থাকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। সেটাই হলো সংসদীয় ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় কাজ। আর সেখানে সরকারি দলকে তাদের দায়িত্ব পালনের বিষয়ে প্রতিনিয়ত মনে করিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব বর্তায় বিরোধী দলের ওপর। মনে রাখতে হবে, তার আগে বাংলাদেশে সংসদীয় শাসনের অভিজ্ঞতা ছিল তিক্ত। কিন্তু স্বল্প সময়ের সেই অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করে দেশের রাজনীতিবিদেরা সংসদীয় ব্যবস্থাকে অগ্রহণযোগ্য মনে করেননি। বিজয়ী দল হিসেবে বিএনপি তাদের ঘোষণাপত্রে রাষ্ট্রপতি ব্যবস্থার কথা থাকা সত্ত্বেও জনমত এবং বিরোধী দলের যুক্তিসংগত সংসদীয় চাপের মুখে সংসদীয় ব্যবস্থায় ফিরে আসে। বাংলাদেশের ইতিহাসে সংবিধানের যে দুটি সংশোধনী সর্বসম্মতভাবে পাস হয়েছে, এটি তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ।
সংসদীয় ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের যে কারণ, সেই জবাবদিহির ব্যবস্থার ক্ষেত্রেই সরকারি দল এবং সংসদ দুই-ই ব্যর্থ হয়েছে। তাতে করে আমরা দেখতে পেয়েছি, সাংবিধানিকভাবেই প্রধানমন্ত্রীর হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছে এবং তার উপর্যুপরি অপব্যবহার হয়েছে। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে সাংসদেরা কার্যত এক ব্যক্তির ইচ্ছাধীন হয়ে পড়েছেন। সেটা কোন দল ক্ষমতায় থাকল, তার ওপর নির্ভর করেনি। বাংলাদেশের প্রায় সব দলের ভেতরেই গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি এবং দলের ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা রাজনীতিতে জবাবদিহির কোনো ব্যবস্থাকেই যখন তিরোহিত করে ফেলেছে, সে সময়ে সংসদে বিরোধী দলের অনুপস্থিতির কারণে গোটা সংসদই প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছাধীন একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। আর তা কোনো অবস্থাতেই ১৯৯১-পূর্ববর্তী জবাবদিহির ঊর্ধ্ব বিরাজমান ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতির চেয়ে ভিন্ন কিছু হবে না। শুধু তা-ই নয়, এ ক্ষেত্রে যেহেতু প্রধানমন্ত্রীর সাংবিধানিক এবং সংবিধান-বহির্ভূত ক্ষমতা হবে সীমাহীন, সেহেতু তার প্রয়োগ এবং অপপ্রয়োগের প্রভাব হবে গভীর ও দীর্ঘমেয়াদি।
আলী রীয়াজ: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, রাজনীতি ও সরকার বিভাগ, ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র।

দশম জাতীয় সংসদ- বিরোধী দলবিহীন সংসদ by আলী রীয়াজ

বাংলাদেশে যে অভূতপূর্ব সংসদীয় ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটেছে এবং ২৯ জানুয়ারি যার অভিষেক হতে চলেছে, তাতে বিরোধী দলের কোনো অস্তিত্ব নেই।
জেনারেল এরশাদ বা রওশন এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিকে গেজেট প্রকাশ করে বিরোধী দলের আসনে অভিষিক্ত করার পরেও একে সরকারি-বিরোধী দল বা বিরোধী-সরকারি দল বলেই আমরা জানব। কবি হলে জাতীয় পার্টির অবস্থানকে আমরা ‘ধর্মেও আছি, জিরাফেও আছি’ বলে বর্ণনা করতে পারতাম। সংসদীয় ব্যবস্থার ইতিহাসে বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দলের অনুপস্থিতির কোনো ইতিহাস না থাকলেও আমরা এখন এক নির্বাচনের মধ্য দিয়েই তার আবির্ভাব দেখতে পাচ্ছি। তার পরিণতি কী হতে পারে, সে বিষয়ে আমরা কতটুকু জ্ঞাত এবং চিন্তিত?

১৯৯০ সালের স্বৈরশাসনের অবসানের পর ১৯৯১ সালে গঠিত পঞ্চম সংসদে সব দলের সম্মতিতে সংবিধান সংশোধন করে সংসদীয় ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তনের যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল এবং একটি গণভোটের মধ্যে যাতে নাগরিকদের সম্মতি নেওয়া হয়েছিল, তার মর্মবাণীই কি এখন ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে? এই বিষয়টি আরও বেশি করে বিবেচনার দাবি করে এই কারণে যে আজকে বিকাশমান এই অবস্থায় তৎকালীন স্বৈরশাসকের ছায়া নয়, তাঁর এবং তাঁর দলের প্রত্যক্ষ উপস্থিতি দেখতে পাই। প্রশ্নবিদ্ধ একটি নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত একটি সংসদ, যাতে অধিকাংশ নাগরিকের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ ছিল না, তার গঠনই এখন সংসদের মূল দায়িত্ব থেকে সরে এসে কী ধরনের রাজনৈতিক পরিবেশের সূচনা করতে চলেছে, তার প্রতিক্রিয়া কী, সেটা গভীরভাবে ভাবা দরকার।
এই নতুন পরিস্থিতিতে যাঁরা ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে সমর্থন করেছেন, তাঁদের অনেকে এই কথা বলার চেষ্টা করছেন যে যেহেতু গত পাঁচ বছরে সংসদীয় বিরোধী দল বিএনপি কার্যত কোনো ভূমিকা পালন করেনি, সে ক্ষেত্রে বিরোধী দল থাকা না-থাকায় আদৌ কিছু যায়-আসে না। তাঁদের এই কথার পেছনে তাঁরা যে তথ্যগুলো হাজির করেন, সেটা অবশ্যই আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। নবম জাতীয় সংসদে বিরোধী দল বিএনপি ৭৪ শতাংশ অধিবেশন বর্জন করেছে এবং কার্যত কোনো ধরনের বিতর্কে অংশ নেয়নি। বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া ৪১৮টি বৈঠকের মাত্র ১০টিতে উপস্থিত ছিলেন। এটি দল হিসেবে বিএনপির এবং সাংসদ হিসেবে খালেদা জিয়ার দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ব্যর্থতা বললে সামান্যই বলা হবে। যাঁরা এখন সংসদে বিরোধী দলের না থাকাকে বড় কিছু নয় মনে করছেন, তাঁরা এখানেই আলোচনাটি শেষ করতে চাইবেন।
কিন্তু এই তথ্য আমরা কি অতীতে, ১৯৯১ সালে থেকে যত সংসদ বহাল থেকেছে, তার থেকে আলাদা করে বিবেচনা করব? প্রথমেই যেটা স্মরণ করা দরকার তা হলো ১৯৯৬ সাল থেকেই আমরা দেখতে পাচ্ছি যে সংসদে বিরোধী দলের আকার ছোট হয়ে আসছে। ১৯৯১ সালে সংসদে বিরোধী দলের আসন ছিল ১৩৯টি, ১৯৯৬ সালে তা হয় ১২০টি, ২০০১ সালে ৭৮টি এবং ২০০৮ সালে ৩৪টি। যদিও এসব আসনসংখ্যা সরকারি ও বিরোধী দলের প্রাপ্ত ভোটের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ছিল না কিন্তু বিরাজমান নির্বাচনী ব্যবস্থার কারণে বাংলাদেশের জনগণ সেটাকে অনিবার্য বলেই ধরে নিয়েছে। এর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের এও মনে রাখা দরকার, ১৯৯১-৯৬ সালে বিরোধী দল অনুপস্থিত থেকেছে ৩৪ শতাংশ অধিবেশন, ১৯৯৬-২০০১ সালে এই অনুপস্থিতির হার ছিল ৪৩ শতাংশ এবং ২০০১-০৬ সালে ছিল ৬০ শতাংশ। বিরোধীদলীয় নেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা ১৯৯১-৯৬ সালে ৪০০ বৈঠকের ১৩৫টিতে যোগ দেন, ১৯৯৬-২০০১ সালে খালেদা জিয়া যোগ দেন ৩৮২ বৈঠকের ২৮টিতে, ২০০১-২০০৬ সালে শেখ হাসিনা যোগ দেন ৩৭৩ বৈঠকের ৪৫টিতে। এই তথ্যগুলো আমাদের কাছে স্পষ্ট করে দেয় বাংলাদেশের দুই প্রধান দল, যারা পালাক্রমে সরকার ও বিরোধী দলের আসনে বসেছে, তারা সরকার চালাতে যতটা উৎসাহী হয়েছে, বিরোধী দল হিসেবে ভূমিকা পালনে ততটাই অনুৎসাহী হয়েছে।
শুধু তা-ই নয়, সংসদে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই যে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ ক্রমাগতভাবে কমেছে। খুব সোজা ভাষায় বললে বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দল হিসেবে সব দলই ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু এই প্রবণতার সঙ্গে ক্রমহ্রাসমাণ বিরোধী দলের আসনের কোনো যোগসূত্র রয়েছে কি না এবং সরকারি দলের আকার বিরোধী দলের প্রতি তাদের আচরণকে প্রভাবিত করেছে কি না,
সেটা বাংলাদেশের রাজনীতির গবেষকেরা খুব গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন বলে চোখে পড়েনি।
এই যোগসূত্র খোঁজার বদলে, তার কারণ অনুসন্ধানের বদলে আমরা কি এই শিক্ষা নেব যে বিরোধী দলেরই দরকার নেই? আমরা কি তাহলে ধরে নিচ্ছি যে আজকে যারা ক্ষমতাসীন, তাদের আর কখনোই বিরোধীদের আসনে বসতে হবে না? এই রকম ধারণার ইঙ্গিতই দেশে একদলীয় ব্যবস্থার আশঙ্কাকে সামনে নিয়ে আসছে। বিরোধী দলের দরকার নেই এই কথা মাথাব্যথার কারণে মাথা কেটে ফেলার পরামর্শের মতোই শোনায়। মাথাব্যথার কারণে মাথা কেটে ফেলার সমাধান যত সহজ শোনায় তার পরিণতি ততটাই ভয়াবহ।
বরং আমাদের এখন বিবেচনা করা উচিত যে বাংলাদেশে সংসদীয় ব্যবস্থায় বিরোধী দল কেন তার ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয় এবং এই বৃত্তচক্র ভাঙার পথ কী হতে পারে? সমাধান এটা হতে পারে না যে বিরোধী দলের ধারণাকেই সম্পূর্ণভাবে বাদ দিয়ে দিতে হবে। ২০০১
সালে বিএনপি যদি এই যুক্তি হাজির করত, তা যেমন অগ্রহণযোগ্য হতো, আজকে যাঁরা এই কথাকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমর্থন করছেন, তাঁদের বক্তব্যও ততটাই অগ্রহণীয়। সংসদীয় ব্যবস্থায় বিরোধী দলের প্রয়োজন কেন, সেটা আমাদের বুঝতে হবে সংসদীয় ব্যবস্থার এবং
সুস্থ রাজনীতির ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে এবং সংসদ এবং রাজনীতিতে দলের ভূমিকার কথা মাথায় রেখে।

আলী রীয়াজ: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, রাজনীতি ও সরকার বিভাগ, ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র।

স্বাগত ২০১৪- এমন ক্রান্তিকাল কখনো আসেনি by আলী রীয়াজ

Wednesday, January 1, 2014

অস্থিতিশীলতা, অনিশ্চয়তা ও সহিংসতার মধ্য দিয়ে ২০১৪ সালের সূচনা হতে চলেছে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক—সব ক্ষেত্রেই এই বৈশিষ্ট্যগুলো স্পষ্ট।
যেকোনো নতুন বছরের গোড়ায় যেমন অনিশ্চয়তা থাকে, এ বছরের অনিশ্চয়তা তেমন নয়; বরং অতীতের তুলনায় এই বছরের শুরুর সময়টি অনেক বেশি উদ্বেগের এবং আশঙ্কার। ২০১৩ সালের ঘটনাপ্রবাহের কারণে যেকোনো নাগরিকের মনে দেশের আগামী দিনগুলো কেমন হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন ও দুশ্চিন্তা আছে। যাঁরা বাংলাদেশের রাজনীতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন, তাঁদের মনেও এই প্রশ্ন। বাংলাদেশের ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে সেই সময়কে বর্ণনা করতে ‘ক্রান্তিকাল’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, কিন্তু বোধ করি, আর কোনো সময়ই তা এতটা যথাযথ হয়নি, যতটা আজকে নতুন বছরে পা দিয়ে এবং সামনের দিনগুলোর কথা বিবেচনা করে আমরা বলতে পারি। এই অবস্থার সৃষ্টি যদিও এক দিনে হয়নি, এমনকি একটি বছরেও হয়নি, তথাপি এ কথা মানতেই হবে যে গত বছরের ঘটনাপ্রবাহ এই ক্রান্তিকালের দিকে দেশকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। বাংলাদেশের রাজনীতি ও সমাজে বিরাজমান পরস্পরবিরোধী প্রবণতা ও দৃষ্টিভঙ্গিসমূহ ২০১৩ সালে যেভাবে প্রকাশিত এবং মুখোমুখি অবস্থানে উপনীত হয়েছে, তেমনটি আমরা আগে কখনো দেখিনি।

গণতন্ত্র, শাসনব্যবস্থা, সামাজিক বৈষম্য, জবাবদিহি, দুর্নীতি, রাজনীতি ও ধর্মের সম্পর্ক, যুদ্ধাপরাধের মতো জাতির অসমাপ্ত দায় বিষয়ে বিভিন্ন চিন্তা, দৃষ্টিভঙ্গি এবং আদর্শিক অবস্থান বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ছিল। গত ৪২ বছরে অন্যান্য ইস্যুকে কেন্দ্র করে এগুলোর কোনো কোনোটি কখনো কখনো সামনে এসেছে, কিন্তু এর অনেকগুলো একার্থে অমীমাংসিত বিষয় হিসেবেই থেকে গেছে। যেকোনো সময়ে জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়ায় কিছু বিষয় অমীমাংসিত থাকা কোনো ব্যতিক্রম নয়। কোনো জাতি ও জাতিরাষ্ট্র যত পরিপক্ব হয়ে ওঠে, সেই রাষ্ট্র ও তার নাগরিকেরা একাদিক্রমে অমীমাংসিত বিষয়গুলোর মোকাবিলা করে; সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কিছু বিষয় প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলে, কিছু বিষয় আরও বেশি জরুরি হয়ে ওঠে।

গত বছরে আমরা একই সময়ে এই বিষয়গুলো রাজনীতির কেন্দ্রে এসে হাজির হতে দেখেছি। অবশ্যই বিষয়গুলো পরস্পরবিরোধী নয়, গণতন্ত্রের প্রতি আস্থাবান মানুষ সুশাসন ও সামাজিক বৈষম্যের অবসানের দাবি করতেই পারে। রাজনীতি ও ধর্মের সম্পর্কের প্রশ্নে গণতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন দুজন নাগরিকের ভিন্নমত থাকা অসম্ভব নয়। একইভাবে কোনো এক বিষয়ে কোনো নাগরিকের অবস্থান অন্য বিষয়ে তার কী অবস্থান হবে, তা নির্ধারণ করে না। ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের জবাবদিহির দাবি তোলার মানে এটা নয় যে ওই নাগরিক অন্য প্রশ্নে সরকারের গৃহীত ব্যবস্থার সমর্থক হতে পারবে না। বিরোধী দলের দায়িত্বজ্ঞানহীন, আশু স্বার্থপ্রণোদিত আচরণের বিরোধিতা করা মাত্রই তাকে ক্ষমতাসীনদের অনুচর বলার সংস্কৃতি অগ্রহণযোগ্য। জবাবদিহি বা গণতন্ত্রের প্রশ্ন কোনো অবস্থাতেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিকে নাকচ করে দেয় না; এই দুটি পরস্পরবিরোধী নয়। দুজন নাগরিকের ভেতরে একটি বিষয়ে মতৈক্য মানে সব বিষয়ে তাদের মতৈক্য হবেই—এমন আশা করা অসমীচীন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ‘শত্রু’ বলে গণ্য করা, তার ন্যূনতম নাগরিক অধিকার হরণ করা এবং সহিংসভাবে প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক শক্তিরা নিজেদের জন্যই কেবল বিপদ ডেকে আনে তা নয়, তারা গণতন্ত্রের মৌলিক বিষয়কেই অস্বীকার করে, সমাজে অসহিষ্ণু সংস্কৃতি তৈরি করে, যার পরিণাম তাদেরও ভোগ করতে হয় আজ অথবা আগামীকাল।

জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অগ্রাধিকার তৈরিতে নিঃসন্দেহে ভিন্ন মত থাকবে। কিন্তু গত বছরে দেশের রাজনীতি ও সমাজে অগ্রাধিকারের প্রশ্নে অন্যের ওপরে নিজের পছন্দ চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। এটি গণতান্ত্রিক সমাজের লক্ষণ নয়। এই অবস্থা কেবল তাঁরাই পছন্দ করবেন, যাঁরা গণতন্ত্রের যে সামান্য অবশেষ এখনো বাংলাদেশে বিরাজমান, তাকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে একধরনের স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার অনুকূল সামাজিক ও মানসিক পরিস্থিতি তৈরি করতে চান। বল প্রয়োগ, ভীতি প্রদর্শন ও সন্ত্রাসী আচরণের মাধ্যমে, দাবি আদায়ের নামে, সাংবিধানিক ধারা চালু রাখার অজুহাতে, সংখ্যাগরিষ্ঠতার বাতাবরণ তৈরি করে, ধর্মকে আশ্রয় করে কিংবা অন্য যেকোনো আদর্শের নামেই তা করা হোক না কেন, তা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎকে এক অন্ধকার পথে চালিত করবে। অনুমান করতে পারি যে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক রাজনীতি ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা যতই অপসৃত হবে, এই প্রবণতা তত বেশি শক্তিশালী হবে। বছরের গোড়াতেই অনুষ্ঠেয় একতরফা নির্বাচন এবং তা প্রতিরোধে বিরোধীদের সহিংস আচরণ গণতন্ত্রের উল্টো পথেই বাংলাদেশকে এগিয়ে নেবে। বছরের শুরুটা এভাবেই হবে বলে আমরা জানি এবং তা আগামী দিনগুলোকে আরও কঠিন করে তুলবে। বাংলাদেশ গণতন্ত্রের উল্টো পথে এগোবে কি না, তা নির্ধারণের ক্ষেত্রে ২০১৪ সাল গুরুত্বপূর্ণ বলেই আমার অনুমান। বাংলাদেশ কোন পথে এগোবে, তা নিয়তি-নির্ধারিত নয়, রাজনীতিতে কোনো পথই অনিবার্য নয়। রাজনৈতিক নেতারা ও নাগরিকেরাই এই পথ নির্ধারণ করবেন। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের দায়িত্ব অন্যদের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশের নাগরিকেরা অতীতে গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের প্রশ্নে আপসহীন থেকেছে, ২০১৪ সাল তার ব্যতিক্রম হবে না বলেই আমার ধারণা।



দুই

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ২০১৩ সালে একধরনের মেরুকরণের সূচনা হয়েছে। প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে ঘিরে গড়ে ওঠা দুই কেন্দ্রের বাইরে যেসব দল ছিল, তাদের এক বড় অংশই এখন এই দুই কেন্দ্রমুখী হয়ে পড়েছে। বিএনপি ২০০১ সালের আগেই জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে যে চারদলীয় জোট গড়ে তুলেছে, তারই পরিবর্ধিত রূপ আমরা দেখতে পাই ১৮-দলীয় জোট হিসেবে। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ ২০০৬ সালে যে মহাজোট গড়ে তোলে, তার অনেক দল যেমন তা থেকে সরে গেছে, তেমনি অন্যদের মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করার মধ্য দিয়ে এবং জেনারেল এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিকে চাপের মুখে তাদের শরিক করে রেখেছে। এই ঐক্যে যেসব দল শরিক হয়েছে, তারা অচিরেই ভিন্ন অবস্থান নিতে সক্ষম হবে না। কিন্তু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন দল যে ধরনের আচরণ করেছে, মন্ত্রী ও দলীয় নেতাদের সম্পদের যে চিত্র প্রকাশিত হয়েছে, তা ক্ষমতাসীন দল ও জোটের জন্য ভবিষ্যতেও স্বস্তির বিষয় হবে না। জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোট গঠন ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপিকে যতটুকু সুবিধা প্রদান করেছিল ২০০১-২০০৬ সালের সরকারে থাকা অবস্থায় এবং গত কয়েক বছরে তার চেয়ে বেশি মাশুল গুনতে হয়েছে দলটিকে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে কেন্দ্র করে জামায়াতের অব্যাহত সন্ত্রাসী তৎপরতা দেশের জন্য এক বিরাট হুমকি সৃষ্টি করেছে। জামায়াতের এসব আচরণ বিএনপির রাজনৈতিক দাবিকে গত বছরে পেছনে ফেলে দিয়েছে। অন্যদিকে, বিএনপি জামায়াত-নির্ভর হয়ে পড়েছে। জামায়াতে ইসলামী সাংগঠনিকভাবেই ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত এবং গত ৪২ বছরে তাদের ভূমিকার জন্য কখনোই ক্ষমা প্রার্থনা করেনি। যুদ্ধাপরাধী হিসেবে দলের নেতাদের বিচার ও শাস্তি দলটিকে দেশের এক বড় অংশের কাছে অগ্রহণযোগ্য করে ফেলেছে।

এই প্রশ্ন বিএনপি কীভাবে তা মোকাবিলা করবে, সেটা ২০১৩ সালে যতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল এই বছরে তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়বে। এই বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য বিএনপি তার অনুকূল রাজনৈতিক পরিবেশের অপেক্ষা করবে, নাকি ঝুঁকি নিয়ে হলেও একটি পদক্ষেপ নেবে তার ওপর কেবল দলের নয়, দেশের সাংবিধানিক নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির ভবিষ্যৎ অংশত নির্ভরশীল। দায়িত্বশীল বিরোধী দল হিসেবে আচরণে বিএনপির ব্যত্যয় হয়েছে। ক্ষমতাসীন দল যদি দেশে নিয়মতান্ত্রিক সাংবিধানিক রাজনীতির ধারাকে অব্যাহত রাখতে চায়, তবে কেবল কথায় নয়, কাজেও তা প্রমাণ করতে হবে। সহিংসতা মোকাবিলা করে নাগরিকের নিরাপত্তা দেওয়া যেমন রাষ্ট্রের দায়িত্ব, তেমনি নাগরিকের ভিন্ন মত প্রকাশ এবং তার পক্ষে সংবিধান প্রদত্ত গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করাও রাষ্ট্রের কর্তব্য। এর অন্যথা হলে অসাংবিধানিক শক্তিই কেবল লাভবান হবে। তার পরিণতির জন্য খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে না; ২০১৪ সালেই আমরা তার বিবিধ পরিণতি দেখতে পাব বলে আমার আশঙ্কা। মেরুকরণের এই প্রক্রিয়ায় দুই কেন্দ্রের বাইরে যেসব দল রয়েছে, তাদের ভূমিকা মোটেই অকিঞ্চিৎকর নয়; তারা কী ভূমিকা নেয়, সেটাও লক্ষণীয়।



তিন

ভূরাজনৈতিক বিবেচনায় বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান গুরুত্বের কারণে বৈশ্বিক পরিসরে বাংলাদেশের ভূমিকা রাখার যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, সেই বিবেচনায় ২০১৪ সাল আলাদা গুরুত্ব বহন করে। আন্তর্জাতিক রাজনীতি পরিবর্তনশীল, ফলে আজকে একটি দেশ যে গুরুত্ব বহন করে, তা ভবিষ্যতে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেই ভূমিকা পালনের সুযোগ নাও থাকতে পারে। বিশ্বায়নের এই যুগে কোনো দেশের পক্ষেই বিশ্বরাজনীতির বাইরে থেকে তার সুবিধা নেওয়া সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে গত বছরগুলোতে, বিশেষত আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গত কয়েক মাসে সরকারের ভূমিকার কারণে আন্তর্জাতিক সমাজের সঙ্গে যে ধরনের টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে, তা দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উভয় ক্ষেত্রেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নতুন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার উদ্ভব হচ্ছে। সেটি আফগানিস্তান থেকে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাদের উপস্থিতির অবসান ও সেখানকার নির্বাচন যেমন একটি দিক, ভারতে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা বদলের সম্ভাবনা, মিয়ানমারের নতুন গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক সুযোগ তেমনি আরেকটি দিক। এই অঞ্চলে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর নতুন বিন্যাস হচ্ছে। এসব ঘটনার যে অভিঘাত তৈরি হবে, বাংলাদেশ তাতে তার নিজস্ব অবস্থান নিয়ে অংশগ্রহণ করতে পারবে কি না, সেটা অনেকাংশেই নির্ভর করবে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির ওপরে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে ইতিমধ্যেই অর্থনীতি বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে দেশের প্রধান রপ্তানিনির্ভর উৎপাদনশীল খাতই সবচেয়ে আগে ক্ষতির মুখোমুখি হবে।

এই যে নতুন আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি হচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশের স্বার্থে বাংলাদেশকেই প্রতিনিধিত্ব করতে হবে, বাংলাদেশ যদি অন্য কোনো একক দেশের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, তাতে তার নিজস্ব স্বার্থেরই কেবল ক্ষতি হবে তা নয়, আঞ্চলিক ক্ষমতা ভারসাম্যের ক্ষেত্রেও বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। বহুজাতিক আন্তর্জাতিক সংগঠনের সঙ্গে অস্বস্তিকর সম্পর্ক তৈরি করে বাংলাদেশ তার নিজের স্বার্থানুকূল ভূমিকা নিতে পারবে—এটা মনে করার কারণ নেই।

আন্তর্জাতিক সমাজের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বড় ধরনের একটা প্রশ্ন উঠবে আসন্ন নির্বাচনের পরেই; সে কারণে এই প্রশ্নের উত্তরের ওপরে নির্ভর করবে ২০১৪ সালে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের রূপ কী দাঁড়াবে।

l আলী রীয়াজ: অধ্যাপক, রাজনীতি ও সরকার বিভাগ, ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র

 
Support : Dhumketo ধূমকেতু | NewsCtg.Com | KUTUBDIA @ কুতুবদিয়া | eBlog
Copyright © 2013. Edu2News - All Rights Reserved
Template Created by Nejam Kutubi Published by Darianagar Publications
Proudly powered by Dhumketo ধূমকেতু