দশম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন বসবে আজ ২৯ জানুয়ারি। দিনটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের রাজনীতি এবং সংসদীয় ইতিহাসের জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ দিন বলে আমাদের বিবেচনা করা দরকার।
সেটা কেবল এই কারণে নয় যে এই সংসদে আসন নেবেন এমন সাংসদের অর্ধেকেই প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হননি। কেবল এই কারণেও নয় যে এই নির্বাচন বিতর্কিত। এই কারণে যে এই সংসদে কোনো বিরোধী দল থাকবে না। গতকালের আলোচনায় আমরা দেখেছি, কেউ কেউ এই যুক্তিতে একে সমর্থন করছেন যে গত সংসদের বিরোধী দল বিএনপি তার ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে। এ বিষয়ে কোনো রকম ভিন্নমত না পোষণ করেও বলা যায়, ১৯৯১ সালে থেকেই সংসদে বিরোধী দল তার ভূমিকা পালনে সফল হয়নি।
তার পরেও আমরা কেন সংসদে বিরোধী দল থাকার ওপর জোর দিতে চাই?
সংসদীয় ব্যবস্থার উদ্ভবের ইতিহাস যাঁরা জানেন, তাঁদের এ কথা অজানা নয় যে ব্রিটেনের পার্লামেন্টে ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে সাংসদেরা যদি তাঁদের ব্যক্তিগত, স্থানীয় কিংবা বিশেষ ধরনের ক্ষোভের বাইরে কিছু বক্তব্য দিতেন, তবে তাঁর পরিণতি হতো ভয়াবহ। রাজার বিরোধিতা, উত্তরাধিকারের অধিকার, পররাষ্ট্রনীতি বা ধর্মের মতো জাতীয় বিষয় নিয়ে বিতর্ক করলে কারাবাস ছিল নিশ্চিত, প্রাণহানির আশঙ্কা কোনো কল্পিত বিষয় ছিল না। তার অর্থ হলো, পার্লামেন্ট সদস্যরা রাজার বিরোধী হতে পারবেন না; ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য তাঁরা সংসদে নির্বাচিত হননি। তাঁদের কাজ বড়জোর আলাদাভাবে ব্যক্তি হিসেবে তাঁদের ভোটারদের দৈনন্দিন সমস্যার সমাধানে রাজার দৃষ্টি আকর্ষণ করা।
ইতিহাসবিদেরা এও জানান যে অষ্টাদশ শতাব্দীর আগে সংসদীয় গণতন্ত্রের সূতিকাগার বলে পরিচিত ইংল্যান্ডেও বিরোধী দলের ধারণার উত্থান হয়নি। বিরোধী দলের ধারণার উদ্ভবের আগে ‘বিরোধী’দের প্রধান ভূমিকা কী, সেটা স্পষ্ট রূপ লাভ করতে শুরু করে। বিরোধীরা কেবল সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের বিরোধিতা করবে তা-ই নয়, তাঁরা বিকল্পও উপস্থাপনও করবে, সামগ্রিকভাবে রাজ্য শাসনের বিকল্প। এই বিকল্পের প্রশ্নেই ইংল্যান্ডে রাজনৈতিক দলের উদ্ভব ঘটে; অন্যথায় সপ্তদশ শতকের গোড়ায়ও ‘দলাদলি’ এবং ‘পার্টি’কে কলঙ্কজনক বলেই মনে করা হতো। এ শতকেই আমরা দেখতে পাই, এই ধারণা সুস্পষ্ট রূপ নিতে শুরু করেছে যে ক্ষমতাসীন শক্তির বিরোধিতা করার বিষয়টি কেবল ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়, তার জন্য সংগঠিতভাবে দল গঠন এবং আদর্শিক ও ঐক্যবদ্ধভাবে কর্মকাণ্ড পরিচালনার মধ্য দিয়েই সরকারের বিকল্প উপস্থাপন করা যেতে পারে। যে দেশে ক্ষমতাসীনের বিরুদ্ধে বলাকে বিবেচনা করা হতো রাষ্ট্রদ্রোহ বলে, সেখানে ক্ষমতাসীনেরাও বিরোধীদের দল গঠন এবং জাতীয় বিভিন্ন প্রশ্নে তাদের অবস্থানকে বৈধ এবং সংগত বলে মনে করতে থাকে। ইংল্যান্ডে সপ্তদশ শতকের শেষ ভাগে রাজার উত্তরাধিকারের প্রশ্নকে, বিশেষত রাজা দ্বিতীয় জেমসের ক্ষমতায় আরোহণকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট বিতর্কেই দল হিসেবে টোরি এবং হুইগ পার্টির আবির্ভাব ঘটে। রাজসিংহাসনে উত্তরাধিকারের প্রশ্ন সামনে নিয়েই সাংগঠনিকভাবে সংসদীয় বিরোধী দলের আবির্ভাব ঘটেছে।
জন স্টুয়ার্ট মিল ১৮৫৯ সালে অন লিবার্টি বইয়ে লিখেছেন, সুস্থ রাজনীতির জন্য যেমন দরকার স্থিতিশীলতার পক্ষের দল, তেমনি দরকার প্রগতিশীলতার বা সংস্কারের পক্ষের দল। বিপরীতমুখী চিন্তাভাবনার এবং আদর্শের মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা সমাজে উপস্থিত থাকলে আমরা তার প্রতিফলন দেখতে পাব রাজনীতিতে সংসদে এবং সংসদের বাইরেও। আধুনিক অর্থে রাজনৈতিক দলের উদ্ভবের প্রশ্নটি গণতন্ত্রের সঙ্গেই জড়িত, সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার যে কারণে রাজনৈতিক দলকে ‘গণতন্ত্রের সন্তান’ বলে বর্ণনা করেছেন। গণতন্ত্রের একটা প্রধান লক্ষণ হচ্ছে যে এই ব্যবস্থা জনসাধারণকে পছন্দের সুযোগ দেয়; বিভিন্ন বিকল্পের মধ্য থেকে তাদের ইচ্ছে অনুযায়ী ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দেওয়ার নিশ্চয়তা কেবল গণতন্ত্রই দিতে পারে। একই সঙ্গে গণতন্ত্র সেই ভুল সংশোধনের সুযোগও উন্মুক্ত রাখে। রাজনীতিতে সেই সুযোগ দেওয়ার অবকাশ থাকে কেবল বিপরীতমুখী রাজনৈতিক দলের উপস্থিতির মধ্য দিয়ে। কেবল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় একত্র মানুষের গোষ্ঠীকেই আমরা রাজনৈতিক দল বলে বিবেচনা করি না এই কারণে যে রাজনৈতিক দল গঠনের পেছনে আদর্শের প্রশ্নটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। সে কারণে রাজনৈতিক দলকে জনগণের প্রতিনিধিত্বের দাবি করতে হলে আদর্শিকভাবে তার অবস্থানকে তুলে ধরতে হয় এবং ক্ষমতাসীনের বিপরীতে তাদের নীতিকে তুলে ধরতে হয়। একইভাবে তা ক্ষমতাসীন দলের জন্যও প্রযোজ্য, তাকে দেখাতে হয় যে সে কেন বিরোধীদের থেকে শ্রেয়।
তাহলে আমরা দেখতে পাই যে রাজনৈতিক দল এবং সংসদীয় বিরোধী দলের প্রধান কাজ হচ্ছে জবাবদিহির দাবি তোলা এবং সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাওয়া। সংসদীয় ব্যবস্থায় সংসদের প্রধান কাজই হচ্ছে সেই নির্বাহী বিভাগের ওপরে নজরদারি করা। কিন্তু ১৯৯১ সালের পরে আমরা যেটা দেখতে পাচ্ছি যে প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ সেই ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাতে করে আমরা নির্বাচনের মাধ্যমে যে ধরনের সংসদ তৈরি হতে দেখেছি, তাতে যে দলই ক্ষমতায় গেছে, তারা সংসদকে তাদের প্রতিশ্রুত রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করতে পারেনি কিংবা চায়নি।
১৯৯১ সালে দেশে সংসদীয় ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তনের পেছনে দলনির্বিশেষে যে ঐক্য হয়েছিল, তার অন্যতম কারণ ছিল এই যে রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থার অভিজ্ঞতা থেকে আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, তাতে করে ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণ ঘটে এবং শাসন হয়ে পড়ে ব্যক্তিকেন্দ্রিক। এই ব্যবস্থা ব্যক্তিকে জবাবদিহির ঊর্ধ্বে নিয়ে যায়। সেই বিবেচনায়ই সংসদের কাছে নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহির ব্যবস্থাকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। সেটাই হলো সংসদীয় ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় কাজ। আর সেখানে সরকারি দলকে তাদের দায়িত্ব পালনের বিষয়ে প্রতিনিয়ত মনে করিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব বর্তায় বিরোধী দলের ওপর। মনে রাখতে হবে, তার আগে বাংলাদেশে সংসদীয় শাসনের অভিজ্ঞতা ছিল তিক্ত। কিন্তু স্বল্প সময়ের সেই অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করে দেশের রাজনীতিবিদেরা সংসদীয় ব্যবস্থাকে অগ্রহণযোগ্য মনে করেননি। বিজয়ী দল হিসেবে বিএনপি তাদের ঘোষণাপত্রে রাষ্ট্রপতি ব্যবস্থার কথা থাকা সত্ত্বেও জনমত এবং বিরোধী দলের যুক্তিসংগত সংসদীয় চাপের মুখে সংসদীয় ব্যবস্থায় ফিরে আসে। বাংলাদেশের ইতিহাসে সংবিধানের যে দুটি সংশোধনী সর্বসম্মতভাবে পাস হয়েছে, এটি তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ।
সংসদীয় ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের যে কারণ, সেই জবাবদিহির ব্যবস্থার ক্ষেত্রেই সরকারি দল এবং সংসদ দুই-ই ব্যর্থ হয়েছে। তাতে করে আমরা দেখতে পেয়েছি, সাংবিধানিকভাবেই প্রধানমন্ত্রীর হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছে এবং তার উপর্যুপরি অপব্যবহার হয়েছে। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে সাংসদেরা কার্যত এক ব্যক্তির ইচ্ছাধীন হয়ে পড়েছেন। সেটা কোন দল ক্ষমতায় থাকল, তার ওপর নির্ভর করেনি। বাংলাদেশের প্রায় সব দলের ভেতরেই গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি এবং দলের ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা রাজনীতিতে জবাবদিহির কোনো ব্যবস্থাকেই যখন তিরোহিত করে ফেলেছে, সে সময়ে সংসদে বিরোধী দলের অনুপস্থিতির কারণে গোটা সংসদই প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছাধীন একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। আর তা কোনো অবস্থাতেই ১৯৯১-পূর্ববর্তী জবাবদিহির ঊর্ধ্ব বিরাজমান ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতির চেয়ে ভিন্ন কিছু হবে না। শুধু তা-ই নয়, এ ক্ষেত্রে যেহেতু প্রধানমন্ত্রীর সাংবিধানিক এবং সংবিধান-বহির্ভূত ক্ষমতা হবে সীমাহীন, সেহেতু তার প্রয়োগ এবং অপপ্রয়োগের প্রভাব হবে গভীর ও দীর্ঘমেয়াদি।
আলী রীয়াজ: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, রাজনীতি ও সরকার বিভাগ, ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র।
0 comments:
Post a Comment