‘ক্রিকেট একটি ভারতীয় খেলা, যা ঘটনাচক্রে আবিষ্কৃত হয়েছে ইংল্যান্ডে। এটা অনেকটা মরিচের মতো, যা আবিষ্কৃত হয়েছিল দক্ষিণ আমেরিকায়, সেখান থেকে ভারতে এসেছিল মধ্যযুগে।
এখন ভারতীয় খাবারের অন্যতম অনুষঙ্গ এই মরিচ। ভারতে ক্রিকেটকে বিদেশি খেলা হিসেবে দেখতে পান শুধু ইতিহাসবিদ আর ভারতবিদ্যার বিশেষজ্ঞরা। অধিকাংশ ভারতীয়ের কাছে ক্রিকেট এখন ইংলিশদের চেয়েও বেশি ভারতীয়।’ ভারতীয় রাজনৈতিক মনস্তত্ত্ববিদ ও সমাজতাত্ত্বিক আশিষ নন্দী এই মন্তব্য করেছিলেন তাঁর দ্য তাও অব ক্রিকেট বইয়ে। ভারতে এখন ক্রিকেট যে পরিমাণ জনপ্রিয় আর সেখানে এই খেলার ‘বাজার’ এতই বড় যে এমন দাবি এখন ভারতীয়রা করতেই পারে। কিন্তু ‘অধিকাংশ ভারতীয়’ কি এখন ক্রিকেটকে ইংলিশদের চেয়ে বেশি ভারতীয় ভেবেই খুশি থাকতে রাজি নয়? খেলাটির ওপর খবরদারি ও কর্তৃত্বের নেশাও কি এখন তাদের মনোজগতে চেপে বসেছে? বোর্ড অব কন্ট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়ার (বিসিসিআই) প্রেসিডেন্ট এন শ্রীনিবাসনের মাথা থেকে বের হওয়া ন্যক্কারজনক প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে কি এরই প্রতিফলন ঘটল?
ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া (সিএ) আর ইংল্যান্ড ও ওয়ালস ক্রিকেট বোর্ডের (ইসিবি) সঙ্গে মিলে বিসিসিআই বিশ্ব ক্রিকেটে নিজেদের ‘জমিদারি’ কায়েম করার যে চেষ্টা করেছিল, তা আপাতত ঠেকেছে। দুবাইয়ের প্রতিরোধপর্ব শেষ হওয়ার পর ৮ ফেব্রুয়ারি সিঙ্গাপুরে সমঝোতা পর্বের প্রত্যাশা করা হচ্ছে। কিন্তু ক্রিকেট বিশ্বের তিন শক্তিশালী দেশের যে মনোভাবের পরিচয় মিলল বিশ্ব ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সংস্থা আইসিসির বোর্ড মিটিংকে কেন্দ্র করে, তার রেশ সহজেই মিটবে বলে মনে হয় না। কারণ, যে শ্রীনিবাসনের মাথা থেকে ক্রিকেটে তিন দেশের জমিদারি কায়েমের প্রস্তাব এসেছে, তিনিই হতে যাচ্ছেন আইসিসি বোর্ডের পরবর্তী চেয়ারম্যান।
‘আধুনিক’ ক্রিকেট বলতে আমরা যা বুঝি, তার বয়সই ২০০ ছাড়িয়েছে। তবে আধুনিক ক্রিকেটের দুই শতকের এই পথচলা ও অনেক পরিবর্তনের পরও কিছু বিষয় শুধু ক্রিকেটের জন্যই তোলা রয়েছে। কিছু ধ্রুপদি বাক্য এখনো আমরা শুধু ক্রিকেটকে নিয়েই ব্যবহার করে থাকি: ‘আপনি হারলেন কি জিতলেন, এটা বড় কথা নয়, খেলাটা কীভাবে খেললেন, সেটাই বড় কথা’ (It is not whether you win or lose, it is how you play the game) অথবা ‘এটা ক্রিকেট নয়’ (It is not cricket) অথবা ‘আম্পায়ারের কথাই চূড়ান্ত, কোনো প্রশ্ন করা যাবে না’ (The umpires word is final, not to be questioned)। এই কথাগুলো শুধুই ক্রিকেটের। ক্রিকেটের এই দীর্ঘ যাত্রার পর ২০১৪ সালে এসে ‘পজিশন পেপারের’ নামে তিন বোর্ড মিলেমিশে যে প্রস্তাব তৈরি করেছিল, সে প্রসঙ্গে যে কথা সবচেয়ে বেশি যায়, তা সম্ভবত; It is not cricket.
তিন দেশের পজিশন পেপারের মূল বিষয়টি তুলে ধরতে প্রথম আলোতে প্রকাশিত উৎপল শুভ্রের প্রতিবেদনের তথ্য ও মন্তব্যের ওপর ভর করছি। তিনি যা লিখেছেন, তা অনেকটা এ রকম: মূল প্রস্তাবগুলোর সব কটির একটাই লক্ষ্য, আইসিসিতে ওই তিন দেশের নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা। যেটির প্রথমেই আছে, আইসিসির পূর্ণ সদস্যদেশগুলোর সম-অধিকার ক্ষুণ্ন করে এক্সপো নামে নতুন একটি কমিটি গঠনের প্রস্তাব। এর স্থায়ী সদস্য হিসেবে থাকবে ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের ক্রিকেট বোর্ড। কমিটিতে বাকি সাতটি দেশের প্রতিনিধি হিসেবে থাকবে একটি দেশ। আইসিসির বাকি সব কমিটির ওপর এর কর্তৃত্ব থাকবে। অর্থাৎ, এটিই হবে বিশ্ব ক্রিকেটের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। তিনি আরও লিখেছেন, টাকার লোভের কাছে খেলার মূল চেতনা অনেক দিন ধরেই গৌণ হয়ে বসেছে। প্রস্তাবিত পজিশন পেপারে সেটি প্রকাশিত হয়েছে আরও উৎকট রূপে। কারণ, সেখানে সদস্যদেশগুলোর মধ্যে টাকার ভাগাভাগিটা আগের মতো সমান না থাকার প্রস্তাব করা হয়েছে।
পজিশন পেপারের সবচেয়ে আপত্তিকর প্রস্তাবটি ছিল টেস্টে উত্তরণ ও অবনমনের বিষয়। র্যাঙ্কিংয়ের ৯ ও ১০ নম্বর দল আইসিসির সহযোগী দেশগুলোর সঙ্গে ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ খেলবে ও জয়ী দল ৮ নম্বর দলের সঙ্গে প্লে অফ খেলে ওপরে ওঠার সুযোগ পাবে। সব দলের জন্য একই বিধান হলো না হয়, এমন একটি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করা যায়, কিন্তু পয়েন্ট তালিকার শেষে থাকলেও ওই তিন দেশকে কখনো নামানো যাবে না—এমন একটি অগণতান্ত্রিক প্রস্তাবও করেছে তিন ‘গণতান্ত্রিক’ দেশের সর্বোচ্চ ক্রিকেট সংস্থা! ভারতের ইতিহাসবিদ ও বিশিষ্ট ক্রিকেট লেখক রামচন্দ্র গুহ টুইট করেছেন, ‘টেস্টের দ্বিস্তর লিগে অবনমনের ক্ষেত্রে ভারত, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়াকে ছাড় দেওয়ার প্রস্তাবটি ন্যক্কারজনক, আশা করছি অন্য দেশগুলো তা প্রত্যাখ্যান করবে।’ এসব চরম অগণতান্ত্রিক প্রস্তাব ও বিধিবিধান কার্যকর করার চেষ্টা ছিল গোপনে। তিন দেশ তলে তলে পজিশন পেপার তৈরি করে কয়েকটি দেশের ক্রিকেট বোর্ডকে নানা আর্থিক সুবিধা ও প্রলোভন দেখিয়ে হাতও করে ফেলেছিল। কিন্তু পজিশন পেপারের বিষয়টি গোপন থাকেনি। দুবাই বৈঠকে আইসিসি প্রেসিডেন্ট নিউজিল্যান্ডের অ্যালান আইজ্যাক স্বীকার করলেন যে সমস্যাটি তৈরি হয়েছে তিন দেশের তৈরি পজিশন পেপার গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ায়। ভাগ্যিস বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল, তা না হলে দুবাইয়ের প্রতিরোধপর্ব যে মঞ্চস্থ হতো না!
২০১১ সালে বাংলাদেশে যখন বিশ্বকাপ ক্রিকেট অনুষ্ঠিত হয়, তখন একটি লেখা লিখেছিলাম ক্রিকেট ও গণতন্ত্র বিষয়ে। শিরোনাম ছিল ‘ক্রিকেট ও গণতন্ত্রের কাকতালীয় সম্পর্ক!’ লিখেছিলাম, ‘রাষ্ট্রের একটি সংবিধান লাগে, আবার রাষ্ট্র চালানোর জন্য নিয়মিত সংবিধান মেনে নতুন বিধিবিধান তৈরি করতে হয়। রাষ্ট্রের আইনসভা বা পার্লামেন্ট তা করে থাকে। ক্রিকেটের ক্ষেত্রেও বিষয়টি একইভাবে সত্য। খেলার নতুন নতুন বিধিবিধান তৈরি ও ক্রিকেট আইনের ব্যাখ্যা করার একক কর্তৃত্ব খাঁটি ব্রিটিশদের প্রতিষ্ঠান এমসিসির। তাদের করা ক্রিকেট আইনের সর্বশেষ সংস্করণ, যা “2000 Code 4th Edition 2010” নামে পরিচিত, তা ১ অক্টোবর ২০১০ সাল থেকে কার্যকর হয়েছে। তবে আইন কার্যকর করার একক ক্ষমতা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট পরিষদের (আইসিসি)। বিষয়টি অনেকটা আধুনিক রাষ্ট্রের আইনসভা ও নির্বাহী বিভাগের মতো। এ ক্ষেত্রে “আইনসভা” এমসিসি আর “নির্বাহী বিভাগ” হচ্ছে আইসিসি। তবে গঠনের দিক দিয়ে এই প্রতিষ্ঠান দুটির চরিত্র “আইনসভা” আর “নির্বাহী বিভাগের” প্রায় উল্টো। “নির্বাহী বিভাগ” হলেও আইসিসি বিভিন্ন ক্রিকেট খেলুড়ে দেশের সদস্যদের নিয়ে গঠিত, বলা যায় প্রতিনিধিত্বমূলক, গণতান্ত্রিক।...২০০৫ সালের আগ পর্যন্ত এমসিসি ও আইসিসি—দুটোরই মূল দরবার ছিল লন্ডনের লর্ডসের মাঠ। সে বছর আইসিসির সদর দপ্তর দুবাইয়ে সরে আসার পর ক্রিকেটের ওপর ইংল্যান্ডের আধিপত্য প্রতীকীভাবে হলেও কমছে।...২০০৬ সালে এসে অবশ্য “এমসিসি বিশ্ব ক্রিকেট কমিটি” নামে একটি নতুন কমিটি তৈরি হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বর্তমান ও সাবেক ক্রিকেটার ও আম্পায়ারদের নিয়ে গঠিত হয়েছে এই কমিটি। তাঁরা বছরে দুবার বসেন খেলাটির “prevalent issues” নিয়ে আলোচনার জন্য। এমসিসিও পরিবর্তন ও গণতন্ত্রায়ণের পথে হাঁটা শুরু করেছে বলে মনে হচ্ছে।’
২০১৪ সালে এসে কি তবে উল্টো পথে নেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে আইসিসিকে? আর ব্রিটিশ আধিপত্য থেকে ক্রিকেটকে মুক্ত করা বা ক্রিকেটের আরও গণতন্ত্রায়ণের বদলে অতীতের দিকে যাত্রার এই আয়োজনে নেতৃত্ব দিচ্ছে ভারত! এশিয়ার সব কটি দেশকে বাদ দিয়ে ভারতের গাঁটছড়া এখন ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে। পাকিস্তান দলের সাবেক অধিনায়ক ইমরান খান টুইট করেন, ‘বড় তিনটি দেশের এই প্রস্তাব ক্রিকেট দুনিয়াকে বিভক্ত করবে। মনে আছে, আমি ১৯৯৩ সালে আইসিসিতে পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেছিলাম। সেখানে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার স্বৈর মনোভাব ভুলিনি।...আর এখন শুধু আর্থিক শক্তির জোরে ভারত ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে মিলেছে।’
বিশ্ব ক্রিকেটে মোড়লির আশায় এশীয় ক্রিকেটের সঙ্গে দূরত্বই তৈরি করে ফেলল ভারত। ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ভারতের এই গাঁটছড়া কি চিরস্থায়ী কোনো বিষয়? এই তিন দেশের মধ্যে কোনো ইস্যুতে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া যদি এক থাকে, সেখানে তো একাই হয়ে পড়বে ভারত! ক্রিকেটে গণতন্ত্রায়ণের পথ বন্ধ করলে ভারতের বিপদে পড়ার আশঙ্কাই বেশি। অতি লোভেই তো তাঁতি নষ্ট হয়!
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com
0 comments:
Post a Comment