মিসর- কে হবেন প্রেসিডেন্ট, সিসি না সাবাহি by কামাল গাবালা

Wednesday, February 26, 2014

মিসরীয়রা এখন পড়েছে নতুন দোলাচলে। বিশেষ করে ঝানু বামপন্থী হামদিন সাবাহি নিজেকে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার পর। ২০১২ সালে যে নির্বাচনে মোহাম্মদ মুরসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাতে সাবাহি অধিকার করেছিলেন তৃতীয় স্থান।
সাবাহির এই ঘোষণা এল আরেক দফা প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার প্রাক্কালে, যে নির্বাচনে সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আবদেল ফাতাহ আল-সিসির প্রার্থী হওয়ার জোর সম্ভাবনা রয়েছে।

গত বছরের জুন মাসে মিসরজুড়ে বিক্ষোভের মুখে ইসলামপন্থী প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে উচ্ছেদ করে সিসি আরবের সবচেয়ে জনবহুল দেশে বিপুল জনপ্রিয় হন।
মিসরীয়রা এখন যার যার রাজনৈতিক পক্ষ, মতামত ও আদর্শিক অবস্থান থেকে তর্ক ও আলোচনা চালাচ্ছে। সেসব আলোচনা প্রকাশ্যে উঠেও আসছে। এরই একটা উদাহরণ হলো ন্যাশনাল সালভেশন ফ্রন্ট আর তামারোদ মুভমেন্টের এক সারিতে চলে আসা। প্রথমটি গঠিত হয়েছিল ২০১২ সালের শেষে মুরসি প্রশাসনের বিরোধিতা করার জন্য আর গত বছরজুড়ে বিক্ষোভ সংঘটিত করে যাচ্ছিল তামারোদ, যার পরিণতি হলো মুরসির অপসারণ। এমনকি তাদের নামকরণও বোঝায় যে একই উদ্দেশ্যে তারা গঠিত। এবং অবশ্যই তাদের সঙ্গে ছিল নাসেরপন্থীসহ বিভিন্ন বামপন্থী গোষ্ঠী। এই বামপন্থীদের থেকেই এসেছেন সাবাহি।
মিসরের এখন প্রতিটি বাড়িতেই কান পাতলে শোনা যাবে সিসি আর সাবাহিকে নিয়ে আলোচনা। সব পরিবারই যেন একটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে: এই দুজনের কে হবেন মিসরের যোগ্যতম প্রেসিডেন্ট?
এ বছরের গোড়াতেই প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের তৈরি করা সংবিধান স্থগিত করে আধুনিক, নাগরিক ও গণতান্ত্রিক মিসরের লক্ষ্যে নতুন সংবিধান পাস হয়েছে। তা ছাড়া ইসলামপন্থী আমলের অভিজ্ঞতা ফিরে আসার যে ভয় সবকিছু আচ্ছন্ন করে ছিল, তা কাটিয়ে মিসরীয়রা এখন এমন একজন সেনানায়ক চায়, যিনি তাদের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা রক্ষা করবেন। এই সেনানায়ক ‘ধর্মের’ লেবাসের আড়ালে ভেসে ওঠা পুনর্জীবিত সন্ত্রাসবাদকে মোকাবিলা করছেন। ২০১১ সালে হোসনি মোবারকের বিতাড়নের পর থেকে মিসরের অর্থনীতি যে নাটকীয় দুর্দশার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, তা থেকেও উঠে আসার লক্ষণমিলছে।
এখনকার মিসরে সাবাহি ও সিসির (যিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য উর্দি খুলে নামবেন বলে ভাবা হচ্ছে) মধ্যে কে ভালো হবেন তা নিয়ে দোলাচলের সঙ্গে অতীতের দোলাচলের কোনো তুলনা চলে না। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতো করে সাবাহিও একে বর্ণনা করেছেন ‘ভালো’ আর ‘উত্তমের’ মধ্যকার লড়াই বলে। গত বছরের ২৫ জানুয়ারির গণ-অভ্যুত্থান এবং তার সংশোধনে আসা ৩০ জুনের ঘটনার সমর্থক বিপ্লবীদের দৃষ্টিতে ব্যাপারটা এ রকমই। আজকের পরিস্থিতি ২০১২ সালের থেকে এখানেই আলাদা যে তখন মিসরীয়দের বেছে নিতে হচ্ছিল মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রার্থী মোহাম্মদ মুরসি বনাম মোবারকের শাসনের প্রতিনিধি আহমেদ শফিকের মধ্যে। সে রকম অবস্থায় পরিস্থিতিটা ছিল ‘খারাপ’ আর ‘নিকৃষ্টের’ মধ্যকার প্রতিযোগিতার মতো। অথবা ব্যাপারটা ছিল যেন কলেরায় মরব নাকি প্লেগে মরব; তা বাছাই করে নেওয়ার প্রশ্ন।
মিসরে চলমান বিতর্কের বিষয় দুই প্রার্থীর মধ্যকার মিল ও ভিন্নতা নিয়ে। দুজনই জনপ্রিয় হওয়ায় বেছে নেওয়াও কঠিন হয়ে গেছে ভোটারদের পক্ষে। এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে সাবাহি বিনয়ের সঙ্গে বলেছেন যে আমি সব মিসরীয় ও সিসিকে বলছি, তিনি একজন উত্তম প্রার্থী, তবে আমিও ‘উত্তম’ প্রার্থী হতে পারি।
প্রখ্যাত মিসরীয় রাজনীতিবিদ মোহামেদ সালমাওয়ি এককথায় এভাবে বলেছেন, সাবাহি ও সিসি এই অর্থে মিসরীয়দের চোখে সম্পর্কিত যে উভয়ই তাঁদের মনে করিয়ে দিচ্ছে সাবেক জাতীয়তাবাদী প্রেসিডেন্ট গামাল আবদেল নাসেরের কথা। সিসি যেভাবে জনগণের ইচ্ছাকে তুলে ধরেছেন, যেভাবে তিনি আন্তর্জাতিক শক্তি ও ইসলামপন্থী গোষ্ঠীর বিপরীতে জনগণের স্বার্থকে গ্রহণ করেছেন, তাতে অনেক মিসরীয়র মনেই তাঁকে নাসেরের প্রতীক বলে মনে হয়।
অন্যদিকে সাবাহি হলেন নাসেরের সরাসরি অনুসারীদের মধ্যে প্রধানতম নাসেরপন্থী নেতা। বাল্যকাল থেকেই তিনি নাসেরপন্থার সঙ্গে যুক্ত এবং তাঁরই প্রতিনিধি হিসেবে চিত্রিত হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে নাসেরপন্থী হিসেবে তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০১২ সালের নির্বাচনেও তিনি নাসেরপন্থী হিসেবেই তৃতীয় স্থান অর্জন করেন, যেমন এখন তিনি সংসদে নাসেরের ধারারই নেতার ভূমিকা পালন করছেন।
সালমাওয়ি আরও বলেন যে ২০১৪ সালের নির্বাচনী দৌড়ে সিসি আর সাবাহিই হবেন প্রধান প্রতিযোগী। এর অর্থ হলো, যে নাসের তাঁর পরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার আল সাদাতের আমলে ব্যাপকভাবে আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন, সেই নাসেরের প্রত্যাবর্তন ঘটছে। এখন তাহরির স্কয়ারে নাসেরের পোস্টারের পাশে শোভা পাচ্ছে সিসির পোস্টার। আর তারা স্লোগান দিচ্ছে, ‘মুক্তি, ইনসাফ ও মানবতার সম্মান’-এর জন্য।
সাবাহি বলেছেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে আমার বিশ্বাস, সিসি একজন দেশপ্রেমিক ব্যক্তি এবং আমি তাঁর জন্য শুভকামনা ছাড়া অন্য কিছু বোধ করি না। কারণ, তিনি এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁকে নিরাপদ রাখার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো বর্তমানের মতোই তাঁর প্রতিরক্ষামন্ত্রীর অবস্থানে থেকে যাওয়া।’
সাবাহি যুক্তি দেন, চারপাশে ঘিরে থাকা লোকজনের চাপে যদি সিসি প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে নির্বাচন
কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্য দিয়ে শেষ হবে। এই বামপন্থী রাজনীতিবিদ মনে করেন, প্রেসিডেন্ট হিসেবে সিসির নির্বাচিত হওয়া তেমন অবধারিত নয়, যদিও গণমাধ্যম ও অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক তেমনটাই ভাবেন।
এরই মধ্যে প্রখ্যাত মিসরীয় সাংবাদিক মোহামেদ হাসানাইয়েন হেকেল নিজের অতীতের উক্তি সংশোধন করে বলেন যে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠতে মিসরের দরকার অলৌকিক ঘটনা। এর আগে তিনি বলেছিলেন যে সিসিই ন্যায্য প্রার্থী। তিনি আরও বলেন, সিসি যদিও অনেক জনপ্রিয়তা উপভোগ করেন, তাহলেও অন্যান্য প্রার্থীও নিজেদের মনোনীত করতে সক্ষম হবেন। আর এটা ঘটতে হবে সত্যিকার নির্বাচনী প্রক্রিয়ায়।
হেকেল বলেন, সাবাহির মনোনীত হওয়া খুবই ন্যায়সংগত। কারণ, তাঁর রাজনৈতিক মেধা রয়েছে এবং ছাত্র আন্দোলনের কর্মী হওয়া থেকে শুরু করে পরের দিকে তিনি নিজেকে জাতীয় রাজনীতির জন্য যোগ্য হিসেবে বিকশিত করেছেন। তিনি আরও বলেন, সাবাহির তেমন আকাঙ্ক্ষা রয়েছে, রয়েছে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও জনপ্রিয় সমর্থন। এই সমর্থন দিচ্ছে তরুণ উৎসাহী জনতা। এ কথা বলে
তিনি ইঙ্গিত করেন ২০১২ সালের নির্বাচনের কথা, যেখানে সাবাহি পেয়েছিলেন ৫০ লাখ ভোট। ওই নির্বাচনে সাবাহির সাফল্য বিস্ময়কর ছিল। কারণ, অন্য প্রার্থীরা বিপুল অর্থ ও যোগাযোগ বিনিয়োগ করে তাঁর জন্য পরিস্থিতি কঠিন করে তুলেছিলেন।
সিসির প্রেসিডেন্ট হওয়ার আকাঙ্ক্ষার পথে হুমকি হলো মোবারকের স্বৈরাচারী শাসনের সমর্থকদের পুনরাবির্ভাব। এরা যদি সিসিকে সমর্থন দেয়, তাহলে মিসরের ভেতরে ও বাইরে তাঁর প্রতিপক্ষ সুবিধা পাবে। আর তাহলে গত বছরের ৩০ জুন মিসরীয় সেনাবাহিনী মুরসিকে উচ্ছেদ করে যে বাহবা কুড়িয়েছিল, তাতে চিড় ধরবে।

কামাল গাবালা: মিসরের আলআহরাম পত্রিকাগোষ্ঠীর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক।

মিসর ও তিউনিসিয়া- এক যাত্রা পৃথক ফল by রোকেয়া রহমান

Friday, January 31, 2014

মিসর ও তিউনিসিয়া—আরব বিশ্বের দুটি দেশ। তাদের মধ্যে যোজন যোজন দূরত্ব তৈরি করেছে লিবিয়া। এই দূরত্ব সত্ত্বেও দেশ দুটির মধ্যে কত-না মিল ছিল।
দেশ দুটি দীর্ঘদিন স্বৈরশাসকদের শাসনে ছিল। ধর্মীয় কট্টরপন্থা যাতে সে দেশের শাসনব্যবস্থায় গেড়ে না বসতে পারে, এ জন্য মিসর ও তিউনিসিয়ার শাসকেরা ছিলেন নির্দয়। কিন্তু তলে তলে দেশ দুটিতে কট্টর ইসলামপন্থীদের সক্রিয় হয়ে ওঠা ও ক্ষমতা দখল—দুটোই কঠিন বাস্তব।

কিন্তু এই বাস্তবতা মোকাবিলায় দেশ দুটি আবার ভিন্ন পথে হেঁটেছে। একজন বেছে নিয়েছে আলোচনার পথ, অন্যজন বলপ্রয়োগের। অথচ ‘কথিত’ আরব বসন্তের সূত্রপাত করেছিল এই মিসর ও তিউনিসিয়া। এখন দুই বিপরীতমুখী ধারার সম্মিলন গোটা আরব বিশ্বকে বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দিয়েছে বলা যায়।
১৯৫৬ সালে ফ্রান্সের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পর থেকে তিউনিসিয়া সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবেই পরিচিত ছিল। নামে গণতন্ত্র হলেও ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বৈরাচার ও অনাচার দেশটিকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। শেষমেশ ২০১১ সালের জানুয়ারিতে এক গণ-অভ্যুত্থানে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বেন আলী। এরপর অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে সংবিধান পরিষদ নির্বাচিত হয়। ১৫ জানুয়ারি এই সংবিধান পরিষদ ঐকমত্যের ভিত্তিতে নতুন সংবিধান গ্রহণ করেছে, যা আরব বিশ্বে এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে উদার সংবিধানই বলা যায়। তিউনিসিয়ার পার্লামেন্ট গত রোববার দেশটির নতুন সংবিধান অনুমোদন দিয়েছে। সংবিধানে অনুমোদনের পক্ষে ২১৬ ভোটের মধ্যে ২০০টি ভোট পড়ে। গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয়ে এই সংবিধানে শব্দ চয়ন করা হয়েছে এমনভাবে, যাতে শাসক ইসলামপন্থী দল ও এর বিরোধী ধর্মনিরপেক্ষ দলের কাছে তা গ্রহণযোগ্য বলেই মনে হয়েছে। সামাজিক জীবনে ইসলামের ভূমিকা ঠিক কী হবে, এই কঠিন প্রশ্নে দল দুটি মতৈক্যে আসতে পেরেছে, যা আপস বা সমন্বয়ের এক বিরল নিদর্শন।
তিউনিসিয়ার নতুন সংবিধানে বলা হয়েছে, ‘তিউনিসিয়া হবে মুক্ত, স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ; ইসলাম এর ধর্মীয় পরিচয়; আরবি এর ভাষা এবং এর শাসনব্যবস্থা প্রজাতান্ত্রিক।’ এতে আরও বলা হয়েছে, ‘তিউনিসিয়া হবে নাগরিক রাষ্ট্র, যা জনমতের ইচ্ছায় গড়ে উঠবে এবং এখানে আইনই সর্বোচ্চ।’ ভবিষ্যতে কোনো দল যত গরিষ্ঠতা নিয়েই ক্ষমতায় আসুক না কেন, সংবিধানের এই দুই মৌলিক বিষয়কে তারা কখনো সংশোধন করতে পারবে না।
তিউনিসিয়ার পার্লামেন্ট গত বুধবার একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের বিষয়টি অনুমোদন করে। নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত এই সরকার দেশ পরিচালনা করবে।
অন্যদিকে, পিরামিডখ্যাত মিসরকে দেখুন। উত্তাল তাহরির স্কয়ারের কথা এ দেশের পাঠকের কে না জানে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে সংগঠিত আন্দোলন ও হাজারো তরুণের আত্মত্যাগ স্বৈরশাসকবিরোধী এ আন্দোলনকে স্মরণীয় করে রেখেছে। ২০১১ সালের জানুয়ারির সেই হোসনি মোবারকবিরোধী আন্দোলন ও ফেব্রুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট মোবারকের পতন মিসরবাসীকে নতুন স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছিল।
কিন্তু তারুণ্যের এই আত্মত্যাগের ফসল তুলল মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুড। ২০১১ সালের ২৮ নভেম্বর দেশের প্রথম সংসদ নির্বাচনে জয় ছিনিয়ে নিয়ে প্রেসিডেন্ট হলেন ব্রাদারহুডের নেতা মোহাম্মদ মুরসি। চলতে শুরু করলেন নিজের পথে, নিজের মতো করে। এক বছরের মধ্যে নতুন সংবিধান অনুমোদনের জন্য গণভোটের ব্যবস্থা করলেন। বিরোধী রাজনীতিকেরা শুরু থেকে ব্রাদারহুডের বিপক্ষে অবস্থান নেন। বুদ্ধিমান মুরসি তাঁদের কাছে আলোচনার প্রস্তাব দিলেও নিজের উদ্দেশ্য পূরণে অটল থাকলেন; যার ফলে গত বছরের মাঝামাঝি মিসরজুড়ে শুরু হয় মুরসিবিরোধী আন্দোলন।
জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবের আইনকানুনের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ নাথান ব্রাউন বলছেন, প্রথমত, বিরোধীরা এটা জানত যে পরের নির্বাচনেও তারা কোনোভাবেই জিততে পারবে না। দ্বিতীয়ত, সেনাবাহিনী সেখানে ছিল। কার্যক্ষেত্রে হলোও তা-ই।
ঘরে-বাইরে মুরসিবিরোধী তীব্র মনোভাবের সুযোগ নিল সে দেশের সেনাবাহিনী, যারা ১৯৫২ সাল থেকে একটানা ৬০ বছর মিসরের শাসন পরিচালনা করেছে। ক্ষমতা হারালেন মুরসি। সেনাশাসনকে পাকাপোক্ত করতে কোনো ধরনের মতৈক্য ছাড়াই আয়োজিত গণভোটে রায় এল ‘হ্যাঁ’-এর পক্ষে এবং বিপুলভাবে। আসলে ‘না’ যে বলা যাবে, এটাই বহু ভোটার জানতেন না। মিসরের নতুন শাসকেরা ব্রাদারহুডকে ‘সন্ত্রাসী’ তকমা দিয়ে নিষিদ্ধ করেছেন, কারাগারে পাঠিয়েছেন এ দলের নেতাদের, জব্দ করেছেন সম্পদ। ইজিপশিয়ান ইনিশিয়েটিভ ফর পার্সোনাল রাইটসের প্রতিষ্ঠাতা হোসাম বাঘাতের ভাষায়, এই শাসকেরা মোবারকের জামানাকেও হার মানিয়েছে। উল্লেখ্য, হোসনি মোবারক নিজেও সেনাবাহিনী থেকে এসে প্রায় ৪০ বছর মিসর শাসন করে গেছেন।
সামরিক বাহিনী ক্ষমতায় আসার মিসরের উদারপন্থীরা খুশি। তাদের সেই খুশি ঝরে পড়ছে সেনাশাসক সিসির প্রতি আপ্লুত ভাবাবেগে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সেনাবাহিনী কি শেষ পর্যন্ত দেশটিতে শান্তি আনতে পারবে? নাকি এখানেও দুই পক্ষের মধ্যে একটা সমঝোতার দরকার ছিল, যে পথ ইতিমধ্যে তিউনিসিয়া দেখিয়ে দিয়েছে। কায়রোর আইনজ্ঞ জায়েদ আল-আলীর কথায়, ‘তিউনিসিয়ায় পুরো পাতাটাই উল্টানো হয়েছে এবং তাই তুমি বুঝতে পারবে যে সেখানে বিপ্লব এসেছিল। কিন্তু মিসরের ক্ষেত্রে তা (বিপ্লব/আরব বসন্ত) তা বিতর্কিতই থেকে গেল।’
২০১১ সালের একই সময়ে একই পথে যাত্রা করে আরব বিশ্বের দুটি দেশের যাত্রা কেন বিপরীতমুখী হয়ে গেল, তা হয়তো ভবিষ্যতের গবেষকদের জন্য তোলা থাকবে। তত দিনে নীল নদের তীরের এই দেশে আর কত রক্তপাত হবে কে জানে!
ইন্টারন্যাশনাল নিউইয়র্ক টাইমস অবলম্বনে

বদলে যেতে পারে আরবের চেহারা

Sunday, February 13, 2011

মিসরে যে অভূতপূর্ব ঘটনাটি ঘটল তার একমাত্র তুলনা চলে ১৯৫২ সালে সংঘটিত মিসর বিপ্লব ও রাজতন্ত্রের অবসানের দিনটির সঙ্গে। মিসরের আধুনিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবেই ওই দিনটি বিবেচিত। শুক্রবার আরেকটি যুগান্তকারী ঘটনা দেখল আরব বিশ্ব।

প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারকের পতনের মধ্যদিয়ে একনায়কতান্ত্রিক শাসনের অবসানের সূচনা হয়েছে আরব বিশ্বে। এটা এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। এর মাধ্যমে মিসরের সম্ভাবনার দ্বার যেমন খুলে গেছে, তেমনি সৃষ্টি হয়েছে নতুন করে সংকটের আবর্তে পড়ার আশঙ্কা। মুবারক চলে গেছেন, রেখে গেছেন একটা ভাঙা দেশ। আগের অবস্থায় ফিরে যেতে হয়তো কয়েক দশক লেগে যেতে পারে। অন্তত বিশ্লেষকদের তাই ধারণা।
মুবারকের পদত্যাগের দাবিতে রাজধানী কায়রোসহ সারা দেশ উত্তাল ছিল টানা ১৮ দিন। তাদের এ আন্দোলন শুধু মুবারকের পদত্যাগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল সেটা ভাবা ঠিক হবে না। দীর্ঘ ৩০ বছর যে রাজনৈতিক নিপীড়নের শিকার হয়েছে জনতা_তার অবসান, গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংবিধান সংশোধন, অর্থনৈতিক মুক্তি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদ, বেকারত্বের অবসান ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি, ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে বিদ্যমান পার্থক্য দূর_এসবই ছিল জনতার দাবি।
১৯৮১ সালে আততায়ীর হাতে প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত খুন হওয়ার পর মুবারক তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসেন। মিসরীয়রা তাঁকে বিশাল এক আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হিসেবে স্বপ্ন দেখেছিলেন সে সময়। কিন্তু জনগণের সেই আশা ধুলায় মিশিয়ে দিয়ে তিনি দেশটিকে পরিণত করলেন এক পুলিশি রাষ্ট্রে। নিরাপত্তা বাহিনীর প্রায় ১৫ লাখ সদস্যের ভয়ে জনগণ রীতিমতো আতঙ্কিত থেকেছে দীর্ঘ ৩০ বছর। প্রায় আট কোটি জনসংখ্যার দেশটিতে মুষ্টিমেয় এই লোকগুলোই এত দিন ক্ষমতা ভোগ করে আসছিল। আজ মুবারক নেই। কী ঘটবে এখন তাদের ভাগ্যে?
বিশ্বের কোনো দেশেই সেনাশাসনের ইতিহাস সুখের নয়। অথচ সেই সেনা পরিষদের হাতেই ক্ষমতা হস্তান্তর করে গেছেন মুবারক। মুবারকের সঙ্গে সেনাবাহিনীর সম্পর্ক তো একদিনের নয়, বহু বছরের। তার ওপর তিনি ছিলেন বিমানবাহিনীরও প্রধান। বহু সেনা কর্মকর্তা আছেন, যাঁরা এখনো মুবারকের শাসনব্যবস্থাই চালু রাখতে চাইবেন। দেশটির মাত্র ১০ ভাগ লোকের প্রতিনিধিত্বকারী সম্ভ্রান্ত শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গেও তাঁদের রয়েছে মিত্রতা। এটাই মিসরের ট্রাজেডি। এমন অবস্থায় সেনাশাসকরা জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন কতটা দেখাতে পারবেন তা নিয়ে সংশয়ে আছেন বিশ্লেষকরা। সেনা পরিষদ ইতিমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছে, তারা ৩০ বছরের জরুরি অবস্থা তুলে নেবে, সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংস্কারসহ একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করবে। বর্তমান সরকারের প্রধান মোহাম্মদ হুসেইন তান্তাবি মুবারকের একজন ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত বলেই এত সব ঘোষণা সত্ত্বেও তাঁর সদিচ্ছা নিয়ে উৎকণ্ঠিত অনেকেই। বর্তমান আন্দোলনের ফসল হিসেবে হয়তো মিসরীয়রা একটি সংশোধিত সংবিধান পাবে, যে সংবিধান এত দিন মুবারকের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার কাজে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। কিন্তু তান্তাবির ওপর ভরসা রাখতে পারছেন না অনেকেই। তাদের যুক্তি_যে তান্তাবিকে ২০ বছর ধরে সেনা কুজকাওয়াজে মুবারকের ঠিক পাশের আসনে দেখা গেছে, তিনি জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি কতটা সন্মান দেখাবেন? জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে কতটা প্রস্তুত তিনি? তবে এসব প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য মিসরবাসীকে আরো অনেক দিন অপেক্ষা করতে হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
মিসর এখনো আরব বিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু, সাংস্কৃতিক রাজধানী। এখানে যাই ঘটুক, তার প্রভাব আরব বিশ্বে পড়বেই। তাই মুবারকের পতন শুধু মিসরের চেহারাই বদলে দেবে না, দেবে আরব বিশ্বের চেহারাও। আরব নেতারা তাই এখন চিন্তায় পড়েছেন, কিভাবে তাঁদের তরীটি ডোবার হাত থেকে রক্ষা করবেন। কী হয় দেখার জন্য অবশ্য আরো কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে। সূত্র : মিরর, রয়টার্স।

বিজয়ে উন্মাতাল মিসর তবুও শঙ্কার ছায়া

সূর্য প্রতিদিনই ওঠে। কিন্তু কোনো কোনো সূর্যোদয় মানুষকে আলোড়িত করে দারুণভাবে। যেমন, গতকালের দিনটায় আলোড়িত হয়েছে মিসরের কোটি কোটি মানুষ। গতকাল শনিবার ছিল মিসরের গত ৩০ বছরের ইতিহাসে প্রথম আলোকিত অনাবিল এক দিন।

তবে মুবারকবিহীন এই দিন পুরো দ্বিধাহীন নয়। কারণ গণতন্ত্র স্বরূপে প্রতিষ্ঠা পায়নি এখনো। ক্ষমতা আপাতত সেনাবাহিনীর হাতে ন্যস্ত হওয়ায় পুরনো শঙ্কাও কাজ করছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মনে। কেননা মুবারকরা এভাবেই মিসরে ক্ষমতাসীন হয়েছেন। আবারও যে কেউ হবেন না, এর নিশ্চয়তা কী? ফলে এখনো বাকি রয়েছে অপেক্ষার প্রহর।
টানা ১৮ দিন দেশজুড়ে তীব্র গণবিক্ষোভের পর হোসনি মুবারককে পদত্যাগে বাধ্য করতে পারায় মিসরবাসীর মনে এখন বাঁধভাঙা আনন্দের জোয়ার। গত শুক্রবার রাতে ভাইস প্রেসিডেন্ট ওমর সুলেইমান পলাতক হোসনি মুবারকের পদত্যাগের বার্তাটি পাঠ করার পর থেকেই কায়রো যেন নির্ঘুম নগরী। লাখ লাখ মিসরীয় শুক্রবার রাত থেকেই আনন্দে উদ্বেল। গতকালও তারা মনের আনন্দে গেয়েছে বিজয়ের গান, উড়িয়েছে দেশের পতাকা।
এদিকে মিসরের বরখাস্ত হওয়া প্রধানমন্ত্রী আহমেদ নাফিজের দেশত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন প্রধান কেঁৗসুলি। এ ছাড়া আত্মগোপন করে থাকা দেশটির সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হাবিব আল-আদলির ভ্রমণের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এ ছাড়া হাবিব আল-আদলিসহ ক্ষমতাচ্যুত হোসনি মুবারক সরকারের কয়েকজন মন্ত্রীর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়েছে। মিসরের বার্তা সংস্থা মেনার উদ্ধৃতি দিয়ে গতকাল শনিবার রাতে এ খবর দিয়েছে বার্তা সংস্থা এএফপি।
মেনার খবরে বলা হয়, রাষ্ট্রের প্রধান কেঁৗসুলির দপ্তর দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে মুবারকের ঘনিষ্ঠ ও এনডিপির একজন শীর্ষ নেতা ইস্পাত ব্যবসায়ী আহমেদ ইজের অর্থসম্পদ জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছে। মেনা জানায়, সাবেক গৃহায়ণমন্ত্রী আহমেদ আল-মাগরাবি এবং সাবেক শিল্পমন্ত্রী রশিদ মোহাম্মদ রশিদের অর্থসম্পদ নিয়েও তদন্ত চলছে। কায়রো শহরে গতকালও হয়েছে বিজয় মিছিল। যুবকরা হাতে হাত মিলিয়ে পরস্পর
অনুভূতি বিনিময় করেছে। মিসরীয়দের এ যেন পুনর্জন্মের দিন।
দুই রাত আগেও যারা বিক্ষোভে অংশ নিয়ে তাহরির স্কয়ারে ফেলা অস্থায়ী তাঁবুর ভেতর উদ্বেগ ও শঙ্কায় রাত পার করেছিল, গতকাল তারাই ছিল বিজয় মিছিলগুলোর সম্মুখভাগে। তাদেরই একজন ৪০ বছর বয়সী কৃষি প্রকৌশলী ওসামা সাদাল্লাহ গতকাল মিছিল থেকে বলেন, 'আজ শুধুই উৎসবের দিন। আমাদের জাতির পুনর্জন্ম হয়েছে। আমরা পৃথিবীকে দেখিয়ে দিয়েছি_আমরা পারি। আজ পৃথিবীজুড়ে শুধুই আমাদের বিজয়ের সংবাদ। এ জন্য আমরা গর্বিত। এটা ভীষণ সুখের মুহূর্ত।'
অবশ্য মুবারকের পতনের পর মিসরের রাষ্ট্রক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ সেনাবাহিনীর হাতে চলে যাওয়ায় এ সুখ তাদের কপালে সইবে কি না, সেটা নিয়েও উৎসবের মধ্যেই চলছে নানা আলোচনা। মুবারকের পতনের আনন্দে আত্মহারা হলেও এখন মিসরীয়দের মুখে মুখে এটাও ঘুরছে_সেনাবাহিনী কি তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে?
সেনা নিয়ন্ত্রণের কারণে এত দিন ধরে গণমানুষের সঙ্গে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া রাজনৈতিক দলগুলো হঠাৎ করেই যেন চলে গেছে দৃশ্যপটের আড়ালে। তবে মিসরের সেনাবাহিনী গতকালও এক ঘোষণায় দেশবাসীকে দেওয়া তাদের প্রতিশ্রুতি অক্ষুণ্ন রাখার ব্যাপারে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। দেশটির রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে সেনাবাহিনীর এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার দেওয়া ভাষণে খুব শিগগিরই নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরকারের পরিবর্তন ঘটবে এবং দেশটিতে গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেওয়া হবে বলে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। তবে ওই বিবৃতির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলোর বিষয়ে সেনা সরকার তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। তারা জানিয়েছে, এর আগে মুবারকের শাসনামলে ইসরায়েলসহ সারা পৃথিবীর সঙ্গে মিসরের যেসব চুক্তি ছিল, সেগুলো মেনে চলা হবে। বিশেষ করে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পাদিত শান্তিচুক্তি অব্যাহত থাকবে বলে ঘোষণা দেওয়ায় পাশের দেশটিতে স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়েছে। বিবৃতিতে নতুন সরকার গঠন না হওয়া পর্যন্ত দেশটির বর্তমান সরকার ও প্রশাসনকে কাজ চালিয়ে যাওয়ার আহ্বানও জানানো হয়।
এদিকে সেনা সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মেদ হোসেইন তানতাভি খুব শিগগিরই তাঁর সরকারের অবস্থান ও নীতি ঘোষণা করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট পদ থেকে হোসনি মুবারক পদত্যাগ করে সেনাবাহিনীর হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ায় দেশটির সামরিক বাহিনীর প্রধান হিসেবে ৭৫ বছর বয়সী তানতাভি গত শুক্রবার জাতীয় প্রতিরক্ষা কাউন্সিলে মুবারকের স্থলাভিষিক্ত হন। তাঁর ভাষণে সরকার পরিবর্তনের সম্ভাব্য পথ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়ার আশা করছেন মিসরের রাজনীতিবিদরা।
মিসরের রাস্তাগুলো থেকে সেনাবাহিনীর ট্যাংকসহ ভারী সাঁজোয়া যানগুলোকে গতকাল সরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে। গত ১৮ দিনের গণবিদ্রোহের সময় সরকারি নির্দেশে সম্ভাব্য সহিংসতা মোকাবিলার উদ্দেশ্যে এসব সাঁজোয়া যান কায়রো শহরের বিভিন্ন স্থানে মোতায়েন করা হয়। কিন্তু উদ্বেগজনক পরিস্থিতির ভেতরেও দেশটির সেনাবাহিনী আশ্চর্যজনকভাবে শান্ত থাকায় এসব ভারী অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহারের প্রয়োজন পড়েনি। অন্যদিকে সেনাবাহিনী গণমানুষের বিক্ষোভ চলাকালে সরাসরি কোনো অবস্থান না নেওয়ায় বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা ক্ষমতায় আসার পরও তাদের প্রতি দেশটির সাধারণ মানুষ বিশ্বাস রেখেছে। এটা মিসরের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য দিক বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মত প্রকাশ করেছেন। তবে সেনাবাহিনী অঙ্গীকার পাল্টে নিজেরাই ক্ষমতাসীন হওয়ার পরিকল্পনা করলে সাধারণ মানুষ আবারও মাঠে নামবে বলেই তাঁদের ধারণা।
প্রেসিডেন্ট পদ থেকে হোসনি মুবারক পদত্যাগ করায় মিসরের বিরোধী দলগুলো এবং পশ্চিমা রাষ্ট্রপ্রধানরা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন, 'মিসরবাসী পরিবর্তনের জন্য আকুল হয়ে ছিল। ক্ষমতা ছেড়ে মুবারক সে ডাকে সাড়া দিতে বাধ্য হয়েছেন। মিসরবাসী প্রমাণ করেছে, বর্তমান সময়ে আদর্শ গণতন্ত্র ছাড়া আর কিছুই গ্রহণযোগ্য নয়।'
মিসরের বৃহত্তম বিরোধী দল মুসলিম ব্রাদারহুড মুবারক ক্ষমতা ছাড়ায় আনন্দিত হলেও সতর্ক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছে, সেনাবাহিনী তাদের প্রতিশ্রুতি অক্ষুণ্ন রাখবে এটাই তাদের প্রত্যাশা।'
এদিকে গতকাল সুয়েজ খালের নিকটবর্তী ইসমাইলিয়া শহরে শত শত পুলিশ ইউনিফর্ম পরা অবস্থায় রাস্তায় নেমে আসে। তাদের সঙ্গে সাদা পোশাকের গোয়েন্দা পুলিশও এ বিক্ষোভে যোগ দেয়। বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলিবর্ষণের জন্য অনুতাপ প্রকাশ করে তারা অভিযোগ করে, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণের জন্য তাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। চাকরিবিধি অনুযায়ী তারা কেবল এ নির্দেশ পালন করেছে। তবে কাজটা ছিল জঘন্য অন্যায়। এ সময় তারা 'পুলিশ ও জনতা ভাই ভাই'-জাতীয় স্লোগান দিয়েও রাস্তা প্রকম্পিত করে। এই নির্দেশের জন্য তারা সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হাবিব আল-আদরিকেও দায়ী করে। উল্লেখ্য, গণ-অভ্যুত্থানের সময় পুলিশের হামলায় ৩০০ মিশরীয় আন্দোলনকারী নিহত ও কায়েক হাজার আহত হয়।
এদিকে গতকাল শনিবারও কায়রোর একটি জেল থেকে ৬০০ বন্দি পালিয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। পুলিশ জানায়, জেলের ভেতরে বন্দিরা প্রথমে বিক্ষোভ করে। এরপর দাঙ্গা বাধিয়ে দেয়। এ সময় পুলিশ দাঙ্গা থামানোর চেষ্টা করলে জেলখানার বাইরে থেকে একদল সশস্ত্র বন্দুকধারী পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। পুলিশ পাল্টা গুলি ছোড়ার সময় বন্দিদের একটি অংশ পুলিশের ওপর অতর্কিতে আক্রমণ করে। এ সময় সৃষ্ট সংঘর্ষে কয়েকজন নিহত এবং বেশ কিছু আহত হলেও প্রায় ৬০০ বন্দি পালিয়ে যায়। আহত-নিহতের সংখ্যা তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশ জানাতে পারেনি। তবে অন্য একটি সূত্র দাবি করেছে, পুলিশের একটি অংশ বিচারাধীন এসব আসামিকে জেল থেকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছে।
এদিকে মিসরের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত দৈনিক 'আল-আহরাম' মুবারকের পতনের পর তাদের শিরোনামে লিখেছে 'দেশের তরুণ প্রজন্ম মুবারককে গদি ছাড়তে বাধ্য করল'। এ শিরোনামের মধ্য দিয়ে পত্রিকাটি তাদের অবস্থান পরিবর্তনের চেষ্টা চালিয়েছে বলে অন্যান্য প্রচারমাধ্যম জানিয়েছে।
সূত্র : এএফপি, এপি, বিবিসি, রয়টার্স।

পদত্যাগে বাধ্য হলেন মোবারক

Friday, February 11, 2011

বশেষে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হলেন মিসরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক। জয় হয়েছে মিসরে জনতার। টানা ১৮ দিনের নাটকীয় পরিস্থিতির যবনিকা টেনে গতকাল শুক্রবার স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ছয়টায় রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে ভাইস প্রেসিডেন্ট ওমর সুলাইমান মোবারকের ইস্তফা দেওয়ার কথা জানান।

ওমর বলেন, জাতীয় বিষয়াদি দেখভালের জন্য ঊর্ধ্বতন সামরিক পর্ষদের কাছে তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করে গেছেন। পদত্যাগের ঘোষণা শোনার সঙ্গে সঙ্গে রাজধানী কায়রোর তাহরির স্কয়ারে বিক্ষোভকারীরা উল্লাসে ফেটে পড়ে। খবর বিবিসি, এএফপি ও রয়টার্সের।
এর আগে প্রবল গণবিক্ষোভের মুখে গতকাল সকালে কায়রোর প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ ছেড়ে যান প্রেসিডেন্ট মোবারক। সরকারের ঘনিষ্ঠ সূত্রের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, প্রেসিডেন্ট মোবারক তাঁর পরিবার নিয়ে কায়রো ছেড়েছেন। পরে ক্ষমতাসীন দলের এক মুখপাত্র নিশ্চিত করেন, মিসরের অবকাশযাপন কেন্দ্র শারম আল-শেখে গেছেন মোবারক।
শারম আল-শেখে মোবারকের যাওয়ার বিষয়টিকে ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে অভিহিত করেছেন মার্কিন কর্মকর্তারা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা গতকাল তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, মিসরের সামরিক বাহিনীকে অবশ্যই আস্থার সঙ্গে গণতন্ত্রে উত্তরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে।
মোবারকের পদত্যাগের ঘোষণায় কায়রোর তাহরির স্কয়ারে বিক্ষোভরত লাখো জনতা উল্লাসে ফেটে পড়ে। বাঁধভাঙা খুশিতে তাদের নেচে-গেয়ে আনন্দ-উল্লাস করতে দেখা যায়। তারা পরস্পরের সঙ্গে কোলাকুলি করতে থাকে। আবেগে অনেককে এ সময় চোখের পানি মুছতে দেখা যায়। টানা ১৮ দিন তাহরির স্কয়ারে অবস্থান করার কারণে অনেকেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু মোবারকের ৩০ বছরের শাসনের অবসানের খবরে এক মুহূর্তে তাদের সে ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। বিক্ষোভের আয়োজকদের অন্যতম নেতা মোহাম্মাদ ইব্রাহিম চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘তাঁকে গদিছাড়া করতে আমরা ১৮ দিন এখানে অনড় হয়ে ছিলাম। শেষ পর্যন্ত আমরা সফল হয়েছি। এবার আমরা বাড়ি ফিরব।’
আহমেদ জাহরান নামের এক তরুণ বলেন, ‘এত শিগগির মোবারককে উৎখাত করতে পারব, ভাবতে পারিনি।’ শুধু তাহরির স্কয়ার নয়, রাজধানীর বাইরের সব গুরুত্বপূর্ণ শহরে মিসরবাসীকে উল্লাস করতে দেখা যায়।
হোসনি মোবারকের পদত্যাগের পর আন্দোলনকারীদের অন্যতম নেতা এলবারাদি বলেন, ‘আমরা আবার আমাদের জীবন ফিরে পেয়েছি।’ মিসরবাসীর উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘তোমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছো। এর সদ্ব্যবহার করতে হবে। আল্লাহ তোমাদের সহায় হোন।’
মিসরের প্রধান বিরোধী দল মুসলিম ব্রাদারহুড বলেছে, তারা মোবারকের বিদায়ে উচ্ছ্বসিত। দলের মুখপাত্র এসাম এল এরিয়ান এএফপিকে বলেন, ‘আমরা সেনাবাহিনীকে সালাম জানাই। তারা তাদের কথা রেখেছে।’
এদিকে, সুইজারল্যান্ডের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মোবারকের পদত্যাগের পরপরই এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, সে দেশে মোবারকের থাকা সব ধরনের সম্পদ জব্দ করা হয়েছে। ধারণা করা হয়, সে দেশে হোসনি মোবারকের কোটি কোটি ডলারের সম্পদ রয়েছে।
এদিকে, এ ঘটনায় ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন বলেছেন, মিসরকে অবশ্যই একটি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যেতে হবে। তিনি এটিকে একটি ‘স্মরণীয় দিন’ হিসেবে অভিহিত করেন। তবে এ বিষয়ে মার্কিন আইনপ্রণেতারা সাবধানী মন্তব্য করেছেন। তাঁরা বলেছেন, মিসরে গণতন্ত্রের পথে উঠে আসতে হবে। একই সঙ্গে তাঁরা হোসনি মোবারকের পদত্যাগে মধ্যপ্রাচ্য শান্তি-প্রক্রিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
সিনেটের ফরেন রিলেশনস কমিটির চেয়ারম্যান জন কেরি বলেন, ‘এটা মিসরের জন্য এক অভাবনীয় মুহূর্ত। তবে গণতন্ত্রের পথে উঠে আসতে তাদের আরও অনেক পরিশ্রম করতে হবে।’
রিপাবলিকান সিনেটর জন ম্যাককেইন বলেন, ওয়াশিংটন মিসরের পাশে আছে। গণতন্ত্রের পথে উত্তরণের জন্য তারা মিসরকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দেবে।
বৃহস্পতিবার রাতে মোবারক জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তাঁর ক্ষমতা না ছাড়ার ঘোষণা দেওয়ার পর গতকাল সকাল থেকেই মোবারকের তাৎক্ষণিক পদত্যাগের দাবিতে কায়রো, আলেকজান্দ্রিয়া, সুয়েজসহ মিসরের বিভিন্ন শহর ছিল উত্তাল। বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, কায়রোর রাজপথে গতকাল ১০ লাখ লোকের ঢল নেমেছিল।
কায়রোয় তাহরির স্কয়ারে বিক্ষোভকারীরা স্লোগান দেয়, ‘মোবারক তুমি এখনই যাও।’ বিক্ষোভকারীরা সাধারণ নাগরিকদের প্রতি আহ্বান জানায়, তাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে ‘লাখো মানুষের বিক্ষোভে সমাবেশ’ সফল করতে। দিনটিকে তারা আবারও মোবারকের ‘বিদায়ী শুক্রবার’ হিসেবে ঘোষণা করে। এর আগের শুক্রবারও তারা একই কর্মসূচি পালন করেছিল।
গতকাল বেশ কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা তাহরির স্কয়ারে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে যোগ দেন। বিক্ষোভকারী তাহরির স্কয়ারে সরকারবিরোধী স্লোগানের সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে বলে, সেনাবাহিনী ও জনতা ঐক্যবদ্ধ। দুপুরের দিকে তারা কায়রোয় প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করে। প্রাসাদের সামনে তারা জুমার নামাজ আদায় করে। প্রাসাদ অবরোধ করে তারা স্লোগান দেয়, ‘সরে দাঁড়াও, সরে দাঁড়াও মোবারক।’ কেন তুমি পদ আঁকড়ে আছো? ৩০ বছর যথেষ্ট।’ বিক্ষোভকারীদের আরেকটি অংশ রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন চ্যানেলের কার্যালয়ের সামনে অবরোধ করে। দুই হাজারের বেশি মানুষ সেখানে বিক্ষোভে যোগ দেয়। বেতার কার্যালয়ের সামনেও অবরোধ করা হয়। কায়রোর বিভিন্ন সরকারি ভবনের সামনেও বিক্ষোভ অব্যাহত ছিল।
এর আগে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, সুস্থিতি ফিরে এলে জরুরি অবস্থা তুলে নেওয়া হবে। তবে এ ব্যাপারে কোনো দিনক্ষণ ঘোষণা করা হয়নি।
হোসনি মোবারককে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করার জন্য গত ২৫ জানুয়ারি থেকে মিসরে গণবিক্ষোভ শুরু হয়। কায়রোর তাহরির স্কয়ারকে কেন্দ্র করে সারা দেশে সরকারবিরোধী এই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষোভের শুরুর দিকে আন্দোলনকারী ও পুলিশের সংঘর্ষে শতাধিক ব্যক্তি প্রাণ হারায়। টানা ১৮ দিন ধরে তাহরির স্কয়ারে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী তাঁবু খাটিয়ে অবস্থান করেছে।
জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন মোবারকের পদত্যাগকে স্বাগত জানিয়ে জোর দিয়ে বলেন, এখন মিসরের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অবশ্যই দেশটির জনগণই ঠিক করবে। তিনি একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানান।
মোবারক হলেন আরব বিশ্বে দ্বিতীয় নেতা, যিনি এক মাসের মধ্যে গণ-অভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হলেন। অবসান হলো মোবারকের ৩০ বছরের দীর্ঘ স্বৈরশাসনের। এর আগে তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট বেন আলী গণবিক্ষোভের মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান।
এদিকে হোসনি মোবারকের পদত্যাগের খবরে গতকাল ওয়াল স্ট্রিট শেয়ারবাজার চাঙা হয়ে ওঠে।

সাংবিধানিক সংস্কারের জন্য কমিটি মুবারকবিরোধীরা অনড়

Tuesday, February 8, 2011

টানা দুই সপ্তাহ ধরে চলা বিরোধী আন্দোলনের মুখে গণতান্ত্রিক সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছেন মিসরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারক। চলতি বছরের শেষ দিকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্য সামনে রেখে প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংস্কারের জন্য একটি কমিটি করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।

এ সত্ত্বেও তাঁর পদত্যাগের দাবিতে এখনো রাজপথ দখল করে রেখেছে বিরোধীরা। গতকাল মঙ্গলবার নতুন উদ্যমে বৃহত্তর আন্দোলনের ডাক দিয়েছে তারা। নতুন সরকার পরিস্থিতি আয়ত্তে আনার কৌশল হিসেবে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন ভাতা ১৫ শতাংশ বাড়িয়ে দিয়েছে।
গতকাল জাতির উদ্দেশে এক টেলিভিশন ভাষণে ভাইস প্রেসিডেন্ট ওমর সোলাইমান সাংবিধানিক সংস্কারের জন্য মুবারকের কমিটি করার নির্দেশের কথা জানান। বর্তমান পরিস্থিতিতে সোলাইমানকে মিসরের রাষ্ট্রক্ষমতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বলে অনেকেই মনে করছেন। সোলাইমান জানান, শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খলভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের সুনির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করে রোডম্যাপ তৈরি করা হচ্ছে। তিনি বলেন, 'বিরোধী নেতাদের সঙ্গে জাতীয় সংলাপে নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন করার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে একটি কমিটি গঠন করারও নির্দেশ দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট।'
ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ পালাবদলের একটি রূপরেখা তৈরির উদ্দেশ্যে দেশটির সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক দল অথচ নিষিদ্ধ মুসলিম ব্রাদারহুডসহ বিরোধী দলগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছেন সোলাইমান। বিক্ষোভকারীদের ওপর কোনো দমন-পীড়ন চালানো হবে না বলেও জানান তিনি। তবে কাকে কাকে নিয়ে ওই কমিটি গঠন করা হবে, সে ব্যাপারে স্পষ্ট করেননি তিনি। আর যেসব দল মিসরের রাস্তায় গত দুই সপ্তাহ ধরে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের সবার প্রতিনিধিদেরও ডাকা হয়নি আলোচনায়। এর আগে পদত্যাগের দাবি প্রত্যাখ্যান করে মুবারক আগামী সেপ্টেম্বরের নির্বাচনে দাঁড়াবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু বিরোধী দলগুলো বলছে, মিসরের বর্তমান সংবিধান অনুসারে কোনো নির্বাচনই নিরপেক্ষ হবে না।
মুবারকের ৩০ বছরের শাসনের অবসানের দাবিতে টানা দুই সপ্তাহের আন্দোলন গতকাল তৃতীয় সপ্তাহে গড়াল। মুবারকের পদত্যাগের দাবিতে মঙ্গলবার দেশজুড়ে নতুন উদ্যমে বৃহত্তর আন্দোলনের ডাক দিয়েছে আন্দোলনকারীরা। এই আন্দোলনের নাম দিয়েছে তারা 'নীল বিপ্লব'। কায়রোর তাহরির স্কয়ারে গণসমাবেশ ক্রমেই বাড়ছে। আন্দোলনের দুই সপ্তাহ পূর্তি উদ্যাপন উপলক্ষে জোরালো বিক্ষোভের এই ডাক দেওয়া হয়। এরই মধ্যে কয়েক হাজার বিক্ষোভকারী তাহরির স্কয়ারে স্থায়ীভাবে অবস্থান নিয়েছে। অনেকেই তাঁবু খাটিয়ে, কেউ কেউ কম্বল মুড়ি দিয়ে রাস্তা বা ফুটপাত দখল করে আছে। অনেকে আবার সেখানে অবস্থান নেওয়া সেনাবাহিনীর ট্যাংকের ভেতরেও রাত কাটাচ্ছে। আন্দোলনকারীদের চাঙ্গা রাখার জন্য বিভিন্ন গ্রুপ গণসংগীত গাইছে। তাহরির স্কয়ারে বিশাল এক ব্যানার টানানো হয়েছে, যাতে লেখা_'জনগণ এই সরকারের অবসান চায়।' মুবারক পদত্যাগ না করা পর্যন্ত রাজপথ ছাড়বে না বলছে তাহরির স্কয়ারে অবস্থান নেওয়া আন্দোলনকারীরা।
এদিকে দুই সপ্তাহ আটক থাকার পর ইন্টারনেট সার্চ ইঞ্জিন গুগলের কর্মকর্তা ভায়েল ঘোনিম সোমবার ছাড়া পেয়েছেন। মিসরের বেসরকারি চ্যানেল ড্রিম টিভিকে তিনি বলেন, 'আমি কোনো প্রতীক, নায়ক বা এ ধরনের কিছু নই। তবে আমার ওপর যা ঘটেছে তা অপরাধ। ঘোনিমের মুক্তিতে মুবারকবিরোধী বিক্ষোভ আরো জোরদার হবে বলে আশা করা হচ্ছে।'
বেতন ভাতা বাড়াল সরকার
পরিস্থিতি আয়ত্তে নিতে এবং ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার এক নতুন কৌশল হাতে নিয়েছেন মুবারক। সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন ভাতা ১৫ শতাংশ বাড়িয়েছে তার নতুন সরকার। গতকাল মঙ্গলবার দেশের ব্যাংকগুলো খুলেছে। তবে ১৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শেয়ারবাজার বন্ধ থাকবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রয়েছে। কায়রো, আলেকজান্দ্রিয়া ও সুয়েজে কারফিউ অব্যাহত রয়েছে। এ পরিস্থিতির মধ্যে গত সোমবার প্রথম পূর্ণ বৈঠক করেছে নতুন মন্ত্রিসভা। তবে সরকারের এ উদ্যোগ আন্দোলন কতটা প্রশমিত করতে পারবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। সালিত আবদেল আজিজ নামের এক ইঞ্জিনিয়ার বলেন, 'আমরা তাঁকে (মুবারক) বিশ্বাস করি না। তিনি একজন মিথ্যাবাদী। অতীতেও তিনি বহু প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি আমাদের বেতন ভাতা ১৫ ভাগ কেন ৬৫ ভাগও বাড়ানোর ঘোষণা দিতে পারেন। তাঁকে আমরা বিশ্বাস করি না। সূত্র : এএফপি, রয়টার্স।

গামাল মুবারকসহ ক্ষমতাসীন দলের পলিটব্যুরোর পদত্যাগ

Sunday, February 6, 2011

মিসরে ক্ষমতাসীন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্যরা একযোগে পদত্যাগ করেছেন। দেশটিতে টানা ১২ দিন ধরে মুবারকবিরোধী অব্যাহত গণবিক্ষোভ এবং প্রেসিডেন্টকে পদত্যাগের জন্য আন্তর্জাতিক চাপের প্রেক্ষাপটে গতকাল রাতে তাঁদের বেশির ভাগই একযোগে সরে দাঁড়ান।

মিসরের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন জানায়, পদত্যাগীদের মধ্যে মিসরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারকের ছেলে গামাল মুবারকও রয়েছেন। ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির সংস্কারপন্থী নেতা হিসেবে পরিচিত হোসাম বিকে দলের জেনারেল সেক্রেটারি ও রাজনৈতিক ব্যুরোর প্রধান করা হয়েছে। তিনি পেশায় একজন চিকিৎসক এবং বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক রয়েছে।
এদিকে সর্বশেষ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার বিশেষ দূত ফ্রাংক উহসনার বলেছেন, রাজনৈতিক পালাবদলের এই সময়ে মুবারকের ক্ষমতায় থাকা উচিত।
এদিকে প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের দাবিতে গতকালও রাজধানী কায়রোর কেন্দ্রস্থল তাহরির স্কয়ারে সমাবেশ হয়েছে। গত শুক্রবারের সমাবেশে কয়েক লাখ মিসরীয় অংশ নিলেও মুবারক নিজ মুখে পদত্যাগ করার ঘোষণা দেওয়ায় বিক্ষোভকারীদের অনেকে গতকাল বাড়ি ফিরে গেছে। তবে তাহরির স্কয়ারের বিক্ষোভকারীরা সারা দিন শান্ত থাকলেও রাতে ক্ষমতাসীন দলটির পলিটব্যুরোর বেশির ভাগ নেতা পদত্যাগ করায় তারা উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। গত রাতে তারা মুবারকের পতনের দাবিতে আবারও সোচ্চার হয়।
এদিকে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য দেশটির ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপ অব্যাহত রয়েছে। নতুন ভাইস প্রেসিডেন্ট ওমর সুলাইমান ও শীর্ষস্থানীয় সেনা কর্মকর্তারা হোসনি মুবারকের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে করণীয় নির্ধারণের জন্য বৈঠকে মিলিত হয়েছেন। তাঁরা হোসনি মুবারককে কিভাবে সম্মানজনক উপায়ে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ থেকে বিদায় দেওয়া যায়, এর সম্ভাব্য উপায়ের খোঁজ করছেন। অন্যদিকে একটি অসমর্থিত খবরে জানা গেছে, ভাইস প্রেসিডেন্ট ওমর সুলাইমানকে গতকাল হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে এ ব্যাপারে বিস্তারিত কিছুই জানা যায়নি।
মিসরের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যম মেনা জানিয়েছে, গতকাল প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারক তাঁর নবনিযুক্ত মন্ত্রিপরিষদের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন। তবে সেখানে কী বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, সে সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি। তবে গত কয়েক দিনের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মিসরের বিপর্যস্ত অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পুনরুদ্ধারে প্রেসিডেন্ট মুবারক গতকাল আবার উদ্যোগ নিয়েছেন বলে জানা গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা মিসরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারককে ইঙ্গিত করে গতকাল বলেছেন, 'দেশপ্রেমিক' নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, তাঁর দেশের জনগণ কী চায়। তিনি সঠিক সিদ্ধান্তই নেবেন, আশা করি। তবে ওবামা যা-ই বলুন, তাঁর প্রশাসনের বাতলে দেওয়া 'অর্ডারলি ট্রানজিশন'-এর ব্যাখ্যা নিয়ে দ্বিমত পোষণ করেছেন মিসরের প্রধানমন্ত্রী আহমেদ শফিক। মিসর এখন স্বাভাবিক জীবনযাত্রার দিকে ফিরে যাচ্ছে উল্লেখ করে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, 'প্রেসিডেন্ট মুবারক ইতিমধ্যে আগামী সেপ্টেম্বরের নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এর ফলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। আমাদের উচিত প্রয়োজনীয় সংবিধান সংশোধনের জন্য তাঁকে আগামী ৯ মাস সময় দেওয়া।' পরে তিনি আল আরাবিয়া টিভিকে দেওয়া আরেক সাক্ষাৎকারে বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা বলেছেন। আবার ভাইস প্রেসিডেন্ট ওমর সুলাইমানের কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে মুবারককে চলেও যেতে বলছেন তিনি। যদি বিষয়টি নিয়মতান্ত্রিকভাবে করতে হয়, তাহলে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে সংবিধানের দিকে এবং সেখানে এ ধরনের কোনো সুযোগ নেই। সুতরাং নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের স্বার্থেই মুবারককে আরো কিছুদিন সময় দিতে হবে, যাতে তিনি সংবিধান পরিবর্তন করতে পারেন। বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।' বিষয়টিকে মিসরের নতুন প্রধানমন্ত্রী আহমেদ শফিক ও ভাইস প্রেসিডেন্ট ওমর সুলাইমানের মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে সুস্পষ্ট দ্বন্দ্বের ইঙ্গিত বলেই মনে হচ্ছে।
মিসরের ভাইস প্রেসিডেন্ট ওমর সুলাইমানকে গতকাল হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে বলে একটি সংবাদ প্রচারিত হয়। সুলাইমান অল্পের জন্য বেঁচে গেলেও তাঁর দুই দেহরক্ষী নিহত হয়েছেন। ফঙ্ নিউজের বরাত দিয়ে এনডিটিভি এ খবর জানিয়েছে। তবে এ ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি।
গতকাল রাজধানী কায়রোর কেন্দ্রস্থলে বিক্ষোভকারীরা মুবারকবিরোধী সমাবেশ অব্যাহত রাখলেও গত শুক্রবারের তুলনায় তাদের সংখ্যা ছিল অনেক কম। বিক্ষোভ সমাবেশ ছিল শান্তিপূর্ণ। এখনো সেনাবাহিনী তাহরির স্কয়ারের সামনে ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অবস্থান করছে। তবে গতকাল কোনো গোলযোগ হয়নি। সেনাবাহিনী রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোও পাহারা দিচ্ছে।
সম্মিলিত বিরোধী মোর্চার ডাকে গত শুক্রবার মুবারক পতন দিবসের কর্মসূচিতে লাখ লাখ লোক অংশ নেয়।
এদিকে গত এক সপ্তাহে মিসরের গণ-অভ্যুত্থানের সংবাদ কাভার করতে আসা ১০১ জন দেশি-বিদেশি সাংবাদিকের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে 'কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট' (সিপিজে)।
হোয়াইট হাউস মিসরের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার জন্য ইরানকে সতর্ক করে দিয়েছে। হোয়াইট হাউস বলেছে, যে দেশটি ২০০৯ সালের জুনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে গণ-অভ্যুত্থানের মুখে পড়েছিল, তাদের এ বিষয়ে বড় গলায় কোনো কথা বলা বা পরামর্শ দেওয়ার নৈতিক ভিত্তি নেই। গত শুক্রবার জুমার নামাজের খুতবা পড়ার সময় ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি মিসরের গণ-অভ্যুত্থানকে ইসলামপন্থী নাগরিকদের নবজাগরণ ঘোষণা দিয়ে মিসরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারককে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের 'চাকর' অভিহিত করেছিলেন।
মিসরে প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারকের উত্তরসূরি যিনি-ই হোন না কেন, তাঁকে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ইসরায়েলের সঙ্গে অতীতের শান্তিচুক্তি পালন করে যাওয়ার পরামর্শও দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। মিসরে নতুন সরকার গঠন নিয়ে সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন ইসরায়েল। তাদের আশঙ্কা, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটিতে মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো ডানপন্থী কোনো দল ক্ষমতায় এলে ১৯৭৯ সালে সম্পাদিত ইসরায়েল-মিসর শান্তিচুক্তি ভেঙে দেশ দুটি আবারও যুদ্ধে জড়িয়ে যেতে পারে।
সূত্র : বিবিসি, এএফপি, দ্য হিন্দু।

কায়রো জনসমুদ্র: সেনাবাহিনী মাঠে, তবে গুলি চালাবে না

Tuesday, February 1, 2011

মিসরের রাজধানী কায়রো জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছিল গতকাল মঙ্গলবার। প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারকবিরোধী গণবিক্ষোভ তুঙ্গে উঠেছে। গতকাল সেখানে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। একদিকে প্রবল গণ-আন্দোলন, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক চাপ মাথায় নিয়ে গত ৩০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় আছে মুবারক সরকার। বলা যেতে পারে, মুবারক সরকারের পতনের ক্ষণ-গণনা শুরু হয়েছে।

মিসরে গতকাল টানা দ্বিতীয় দিনের মতো দেশজুড়ে পালিত হয়েছে সর্বাত্মক ধর্মঘট। সোমবারের গণসমাবেশের পরদিন গতকাল আরো বড় মহাসমাবেশ করার ঘোষণা দিয়ে দেশবাসীকে মুবারকবিরোধী বিক্ষোভে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল বিরোধী সংগঠনগুলো। জনতার স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনে গতকাল রাজধানী কায়রোর তাহরির স্কয়ারের সেই মহাসমাবেশ জনসমুদ্রে পরিণত হয়। কয়েক লাখ বিক্ষোভকারী প্রেসিডেন্ট মুবারকের
পতন না হওয়া পর্যন্ত ঘরে ফিরে যাবে না বলে ঘোষণা দেওয়ায় গভীর রাত পর্যন্ত তাহরির স্কয়ার মুবারকবিরোধী মুহুর্মুহু স্লোগানে প্রকম্পিত হতে থাকে। তবে সহিংস আন্দোলনের পথ থেকে সরে আসায় গতকাল পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের কোনো সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি।
এদিকে তাহরির স্কয়ারসহ গোটা রাজধানী মুবারকবিরোধী ব্যানার ও পোস্টারে ছেয়ে গেছে। তাহরির স্কয়ার এখন সমাবেশকারীদের দেশাত্মবোধক গান, বিপ্লবী স্লোগান, বিদ্রুপ-ব্যঙ্গাত্মক বক্তৃতা ও জনগণকে মাঠ না ছাড়ার উদ্দীপ্ত আহ্বান জানানো শাণিত বক্তৃতায় মুখরিত। শত শত মিসরীয় আরবি অক্ষরে মুবারকের উদ্দেশে প্লাকার্ডে লিখছে, ‘ইরহাল’ যার অর্থ ‘ভাগো’ বা ‘কেটে পড়ো’।
এ পরিস্থিতিতে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে সেনাবাহিনী এবার মাঠে নেমেছে। এত দিন শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থান, প্রেসিডেন্টের প্রাসাদসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে অবস্থান করলেও গতকাল থেকে বিক্ষুব্ধ জনতাকে তাহরির স্কয়ারের গণসমাবেশে যোগদানে বাধা দেওয়ার জন্য তাদের ব্যবহার শুরু করেছে সরকার। বাইরে থেকে আগত মিসরীয়দের ঠেকানোর জন্য তারা গতকাল কায়রো ও আলেকজান্দ্রিয়া শহরের প্রবেশমুখগুলোতে চেকপয়েন্ট বসিয়েছে। শহরের বাইরে থেকে আগত প্রতিটি যানবাহন ও ব্যক্তিদের দেহতল্লাশি করা হচ্ছে। বেশির ভাগ ব্যক্তিকেই শহরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। তবে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, গণদাবি বৈধ। তারা বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালাবে না।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নব নিযুক্ত ভাইস প্রেসিডেন্ট ওমর সুলাইমান বলেছেন, বিরোধীদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে সংকট উত্তরণের জন্য প্রেসিডেন্ট মুবারক তাঁকে দায়িত্ব দিয়েছেন। তবে জনতার দাবি যেখানে মুবারকেরই পদত্যাগ, সেখানে তিনি সফল হবেন কি না এ নিয়ে অনেকেই সংশয় প্রকাশ করেছেন।
উল্লেখ্য, আট দিন ধরে কায়রো শহরে প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারক সরকারের ৩০ বছরের শাসনামলের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন চলছে। আন্দোলনের পাঁচ দিনের সহিংসতায় কমপক্ষে শতাধিক লোক নিহত ও কয়েক হাজার আহত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট মুবারক মন্ত্রিসভার রদবদলসহ নতুন করে ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেন এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বরখাস্ত করেন। কিন্তু এসব পরিবর্তন মুবারকবিরোধী আন্দোলনে এখনো কোনো প্রভাব ফেলেনি, বরং সহিংস আন্দোলনের পথ ছাড়াই বিরোধীদের আন্দোলন এখন গণ-আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। মুবারক সরকারের দীর্ঘদিনের বন্ধু হিসেবে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্র সরকারও দেশটিতে একটি ‘অন্তর্বর্তী সরকার’ প্রতিষ্ঠা করে আগামী সেপ্টেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পর্যন্ত উভয় পক্ষকে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়েছে। এতে মুবারক সরকার স্পষ্টতই বেকায়দায় পড়েছে।
এদিকে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ন্যাভি পিল্লাই দাবি করেছেন, মিসরজুড়ে সরকারবিরোধী বিক্ষোভে অন্তত ৩০০ বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে এবং তিন হাজারের বেশি আহত হয়েছে। এ ঘটনায় সরকারের বিরুদ্ধে তদন্ত হওয়া উচিত। তিনি বলেন, সরকারি নিরাপত্তারক্ষীরা শতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে। এ ঘটনা পুরোপুরি মানবাধিকারের পরিপন্থী এবং এজন্য তিনি ভীষণভাবে ব্যথিত।
মুবারকের পদত্যাগ ও দেশটিতে সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চালিয়ে আসা নোবেল বিজয়ী নেতা মোহামেদ এল বারাদি গতকালও একটি ব্রিটিশ সংবাদপত্রকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘মিসরের জনগণ ফুঁসে উঠেছে। এখন নিজের পিঠের চামড়া বাঁচাতেই মুবারককে প্রেসিডেন্টের পদ ছাড়তে হবে।’ মুবারকের ঘনিষ্ঠ লোকজন ও তাঁর প্রশাসনের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘যখন সারা দেশের মানুষ আন্দোলনে নেমেছে, তখন ওঁনার (মুবারকের) কাছের কিছু লোক তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন, এটা অল্প কিছু লোকের ঝগড়া-ফ্যাসাদ মাত্র। তাঁরা মুবারককে বোঝানোর চেষ্টা করছেন, লোকজন একসময় সরে যাবে। তাঁর কিছু হবে না। এ ধরনের আচরণ ভীষণ হাস্যকর এবং একই সঙ্গে অন্যায়। মুবারককে সত্য কথাটি জানতে হবে এবং সেটা জেনে এখনই তাঁর পদত্যাগ করা মঙ্গল।’
বিক্ষুব্ধ পরিস্থিতিতে বিদেশি নাগরিকদের কায়রো ছাড়ার হিড়িক পড়েছে। কায়রো বিমানবন্দর বিদেশি নাগরিকে ঠাসা। কিন্তু নতুন করে সেখানে কোনো বিদেশিকে আসতে দেখা যাচ্ছে না। কিছু বিদেশি কায়রো শহর ছাড়ারও চেষ্টা করছেন। তাঁদের সবাই উদ্বিগ্ন এবং ভীষণভাবে আতঙ্কিত।
কায়রোর বিশাল জনসমাবেশের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে মুবারকবিরোধী প্রায় ৫০ হাজার মানুষ গতকাল আলেকজান্দ্রিয়া নগরীতেও বিক্ষোভ সমাবেশ শুরু করেছে। কয়েক দিন ধরেই এ শহরে মুবারকবিরোধী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হলেও গতকালের সমাবেশ ছিল বৃহত্তম। সমাবেশে মুবারকের কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়, কেউ কেউ মুবারকের প্রতীকী কফিনও বয়ে নিয়ে যায়। আন্দোলনকারীরা মুবারকের পদত্যাগের দাবিতে পুরো আলেকজান্দ্রিয়া শহর প্রকম্পিত করে। সাংবাদিক ও বিশ্লেষকদের ধারণা, আলেকজান্দ্রিয়ার এই বিক্ষোভ সমাবেশ কায়রোর তাহরির স্কয়ারের চেয়ে ছোট হলেও এটি আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই আরো বড় সমাবেশে পরিণত হতে পারে। তার চেয়ে বড় কথা, এ ঘটনার দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে মিসরের ছোট-বড় সব শহরে অচিরেই মুবারকবিরোধী বড় বড় সমাবেশ ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে।
এদিকে দুই সপ্তাহর কিছু বেশি সময় আগে তিউনিসিয়ার গণ-আন্দোলনের মুখে সে দেশের সরকার পতনের পর এবং মিসরে মুবারকবিরোধী আন্দোলন চলার মাঝেই গতকাল হঠাৎ করেই জর্দানেও গণবিক্ষোভের মুখে দেশটির সরকার পতন হওয়ায় মিসরবাসীর গণ-আন্দোলন আরো তীব্রতর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা।
সূত্র : বিবিসি, এএফপি, আল জাজিরা, দ্য গার্ডিয়ান, দ্য হিন্দু, ইয়াহু নিউজ।

মোবারকের পদত্যাগ ছাড়া কোনো সমঝোতা নয়

প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের পদত্যাগের দাবিতে গতকাল মঙ্গলবার মিসরে লাখ লাখ মানুষ বিক্ষোভ করে। জনসমুদ্র হয়ে পড়ে রাজধানী কায়রো ও বন্দরনগর আলেকজান্দ্রিয়া। কায়রোতে দুই লাখের বেশি মানুষের সমাবেশ ঘটে। হোসনি মোবারকের ৩০ বছরের শাসনামলে সবচেয়ে বড় গণবিক্ষোভের ঘটনা এটি।

এদিকে মিসরের বিরোধী গোষ্ঠীগুলোর প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি গতকাল ঘোষণা করেছে, হোসনি মোবারক পদত্যাগ না করা পর্যন্ত শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে সমঝোতায় বসতে রাজি না তারা। দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষ থেকে জনগণকে আশ্বস্ত করা হয়েছে, বিক্ষোভ দমনে বল প্রয়োগ করা হবে না। খবর বিবিসি, রয়টার্স, আলজাজিরা ও এএফপির।
মিসরের অন্যতম পুরোনো রাজনৈতিক দল ওয়াফদ গতকাল ঘোষণা করেছে, দেশের এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কিছুসংখ্যক বিরোধী দল ‘একটি জাতীয় ফ্রন্ট’ গঠনের ব্যাপারে একমত হয়েছে। এক বিবৃতিতে ওই দলের পক্ষ থেকে বলা হয়, প্রেসিডেন্ট মোবারক তাঁর বৈধতা হারিয়েছেন।
সরকারবিরোধী এই আন্দোলনের অন্যতম নেতা হয়ে ওঠা মোহাম্মদ এলবারাদি স্থানীয় আল-অ্যারাবিয়া টেলিভিশন চ্যানেলকে বলেছেন, মোবারকের শুক্রবারের মধ্যেই পদত্যাগ করা উচিত। তাঁকে অবশ্যই দেশ ছাড়তে হবে। এর আগে সরকারের সঙ্গে বিরোধী পক্ষের কোনো সমঝোতা আলোচনায় বসা সম্ভব না। এদিকে জাতিসংঘ জানিয়েছে, এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলা এই সরকারবিরোধী বিক্ষোভে ৩০০ জনের মৃত্যু হয়েছে। হোসনি মোবারকের পদত্যাগের দাবিতে গত ২৫ জানুয়ারি মিসরের বিভিন্ন স্থানে গণবিক্ষোভ শুরু হয়। মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সু চি গতকাল মিসরের বিক্ষোভকারীদের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন।
গত সোমবারের ঘোষিত পরিকল্পনা অনুযায়ী গতকাল বিক্ষোভের অষ্টম দিনে কারফিউ উপেক্ষা করে সকাল থেকেই কায়রোর কেন্দ্রস্থল তাহরির স্কয়ারে জড়ো হতে শুরু করে মোবারকবিরোধীরা। সকাল ১০টার মধ্যেই সেখানে ১০ হাজারের বেশি মানুষ সমবেত হয়। দিনভর মোবারক ও সরকারবিরোধী স্লোগানে জমজমাট থাকে সমাবেশস্থল। সেখানে অনেকটাই উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করে। মানুষ নানা ধরনের বাদ্য বাজিয়ে, চিৎকার করে স্বতঃস্ফূর্ত এই জমায়েতকে প্রাণবন্ত করে রাখে। তবে কায়রোতে প্রবেশে গতকাল কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। শহরের সংযোগ সড়কগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়, যাতে বাইরে থেকে কেউ সমাবেশে যোগ দিতে না পারে। বিক্ষোভ দমনে বাস, ট্রেন ও অভ্যন্তরীণ বিমান চলাচলও সীমিত রাখা হয়। তারপরও বিভিন্ন স্থান থেকে দলে দলে মানুষ শহরের কেন্দ্রস্থলে জড়ো হতে থাকে।
দ্বিতীয় বৃহত্তম নগর আলেকজান্দ্রিয়াতেও বিশাল গণসমাবেশের আয়োজন করা হয়। শহরের এল-রামল স্টেশনের কাছে কায়েদ ইব্রাহিম মসজিদ প্রাঙ্গণে দুপুরের মধ্যে ৫০ হাজারের বেশি মানুষের জমায়েত হয়। বিক্ষোভকারীদের হাতে মোবারকের বিকৃত চেহারার ছবি, সরকারবিরোধী প্ল্যাকার্ড, ব্যানার, ফেস্টুন দেখা গেছে। তারা মিসরের পতাকা হাতে মোবারকের কুশপুত্তলিকা দাহ করেন। একটি অংশকে মোবারকের প্রতীকী কফিন বহন করতে দেখা গেছে।

জনতার নিয়ন্ত্রণে কায়রো

Monday, January 31, 2011

মিসরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের পদত্যাগের দাবিতে রাজপথে নামা মানুষের বিক্ষোভ আরও জোরালো হয়েছে। গতকাল রোববার কায়রোর কেন্দ্রস্থল তাহরির স্কয়ার ছিল বিক্ষোভকারীদের নিয়ন্ত্রণে। স্কয়ারের আশপাশ ও বিভিন্ন রাজপথে ট্যাংকসহ সেনাসদস্যদের দেখা গেলেও তাঁরা বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি।

বরং জনতার সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানেই আগ্রহ দেখা গেছে তাঁদের মধ্যে। আলেকজান্দ্রিয়া ও সুয়েজ শহরেও টানা ষষ্ঠ দিনের মতো বিক্ষোভ হয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠক করেছেন প্রেসিডেন্ট মোবারক। গণবিক্ষোভ অব্যাহত থাকায় প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে।
নজিরবিহীন সরকারবিরোধী বিক্ষোভের মধ্যে মিসরের বিভিন্ন স্থানে লুটপাটসহ নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। দেশটির বেশ কয়েকটি কারাগার থেকে হাজার হাজার বন্দী পালিয়ে গেছে। গত মঙ্গলবার শুরু হওয়া সরকারবিরোধী বিক্ষোভে আইনশৃৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে এ পর্যন্ত অন্তত ১২৫ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে দুই হাজারেরও বেশি মানুষ।
বিক্ষোভের খবর প্রচার করায় কাতারভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল আল-জাজিরার প্রচার বন্ধ করে দিয়েছে মিসরীয় কর্তৃপক্ষ। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানি সরকার-বিরোধী বিক্ষোভকারীদের ওপর বলপ্রয়োগ না করতে এবং সহিংসতা বন্ধে প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে মোবারকের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
কারফিউ সত্ত্বেও কায়রোর তাহরির স্কয়ারে অনেক বিক্ষোভকারী রাতভর অবস্থান করেন। গতকাল সকালের দিকে বিক্ষোভকারীরা সেখানে জড়ো হতে থাকেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। লোকজন দলে দলে বিক্ষোভে যোগ দিতে থাকেন। একপর্যায়ে এটি প্রেসিডেন্ট মোবারকের ৩০ বছরের শাসনামলের মধ্যে সবচেয়ে বড় সমাবেশে পরিণত হয়। গতকালের বিক্ষোভে বিরোধীদলীয় নেতা মোহাম্মদ এলবারাদি যোগ দেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সমাবেশস্থলে যাওয়ার মুখে বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভকারীদের দেহ তল্লাশি করেন। স্কয়ারে জড়ো হয়ে বিক্ষোভকারীরা মোবারকবিরোধী স্লোগান দিতে থাকেন। তাঁরা বলেন, ‘মোবারক চলে যাও, তোমার জন্য বিমান প্রস্তুত রয়েছে’, ‘মোবারক, আর নয়’। একজন বিক্ষোভকারী আশা প্রকাশ করে বলেন, মোবারক পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে চলে যাবেন। বিক্ষোভে যোগ দিতে যাওয়ার পথে আরেকজন বিক্ষোভকারী বলেন, ‘মিসরের জনগণ আমূল পরিবর্তন চায়। তার শুরু হতে হবে প্রেসিডেন্ট মোবারকের পদত্যাগের মধ্য দিয়ে।’ এলবারাদি বলেন, ‘আমরা নতুন যুগের সূচনা করতে যাচ্ছি। মোবারককে ক্ষমতা ছাড়তেই হবে।’
বিক্ষোভের মধ্যে কায়রোসহ বিভিন্ন শহরে, বিশেষ করে, আলেকজান্দ্রিয়ায় ব্যাপক লুটপাটের খবর পাওয়া গেছে। স্থানীয় লোকজন দল বেঁধে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছেন। স্থানীয় একজন অভিযোগ করেন, এই লুটপাটের সঙ্গে সরকারের পুলিশ বাহিনী জড়িত। লুটপাটের সময় একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে আটক করে তাঁরা সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছেন বলেও ওই ব্যক্তি জানান। আলেকজান্দ্রিয়া শহরে একটি সুপার মার্কেটেও লুটপাটের খবর পাওয়া গেছে। এ ছাড়া কায়রোতে একটি জাদুঘর লুটপাটের চেষ্টা করা হয়েছে।
প্রত্নসম্পদের জন্য বিশ্বখ্যাত মিসরের এ বিষয়ক সর্বোচ্চ পরিষদের মহাসচিব জাহি হাওয়াস জানান, লুটপাটের উদ্দেশ্যে দুই ব্যক্তি ছাদ দিয়ে জাদুঘরে প্রবেশ করে। তারা কোনো কিছু নিতে না পারলেও কিছু জিনিসের ক্ষতি করেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বেশ কয়েকটি কারাগারের নিরাপত্তাকর্মীরা দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ায় বন্দীরা কারাগার ভেঙে পালিয়ে গেছে। কায়রোর উত্তরাঞ্চলের একটি কারাগার থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় পদপিষ্ট হয়ে আটজন বন্দীর মৃত্যু হয়েছে। কোনো কোনো কারাগারে বন্দীরা দাঙ্গা সৃষ্টি করে ফটক ভেঙে পালিয়ে যায়। পালিয়ে যাওয়া বন্দীদের মধ্যে দেশটির নিষিদ্ধঘোষিত দল মুসলিম ব্রাদারহুডের ৩৪ নেতা-কর্মীও রয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার ওই নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়।
তাহরির স্কয়ারের আশপাশে গতকালও সেনাসদস্যদের ট্যাংক নিয়ে অবস্থান করতে দেখা যায়। আশপাশের গুরুত্বপূর্ণ ভবনে সেনাসদস্যদের সতর্ক অবস্থান লক্ষ করা গেছে। তবে তাঁদের আগের দিনের মতো অ্যাকশনে যেতে দেখা যায়নি। বরং বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সেনাদের আচরণ ছিল বন্ধুসুলভ। বিক্ষোভকারীরা ট্যাংকের ওপরে উঠে মোবারকবিরোধী স্লোগান দেন। সেনাসদস্যদের সঙ্গে তাঁদের কোলাকুলিও করতে দেখা যায়। একপর্যায়ে বিক্ষোভকারীরা একজন সেনাসদস্যকে কাঁধে তুলে নিয়ে নাচতে থাকেন।
এদিকে প্রেসিডেন্ট মোবারক গতকাল দেশটির সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। তিনি দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করেন।
গতকাল কায়রোসহ বিভিন্ন শহরের প্রধান সড়ক ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে পুলিশ দেখা যায়নি। বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিক্ষোভ দমনে ব্যর্থ হওয়ায় পুলিশ প্রত্যাহার করা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট মোবারক এখন বিক্ষোভ দমনে সেনাসদস্যদের দৃঢ় অবস্থান নেওয়ার জন্য নির্দেশ দিতে পারেন। আর এই উদ্দেশ্যেই ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। বিশ্লেষকেরা এও বলছেন, রোববার বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সেনাসদস্যদের আচরণ দেখে মন হয় না জনগণের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে মোবারককে প্রেসিডেন্ট হিসেবে টিকিয়ে রাখার দায় তাঁরা নেবেন। তবে সেনাবাহিনীর সঙ্গে বৈঠকের পর তাহরির স্কয়ারের ওপর দুটি জঙ্গি বিমান ও একটি হেলিকপ্টারকে বারবার চক্কর দিতে দেখা গেছে।
জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন মিসরের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়েছেন। মিসরের পরিস্থিতি নিয়ে গত শনিবার জাতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। পরে হোয়াইট হাউসের এক বিবৃতিতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে শান্ত থাকতে এবং মানবাধিকার নিশ্চিত করা ও রাজনৈতিক সংস্কার এগিয়ে নিতে মিসরের কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন, জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নিকোলা সারকোজি এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, ‘আমরা নিরস্ত্র জনগণের প্রতি কোনো ধরনের বলপ্রয়োগ না করতে ও শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের অধিকার নিশ্চিত করতে প্রেসিডেন্ট মোবারকের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।’
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বেশ কিছু দেশ তাদের নাগরিকদের মিসর ভ্রমণ না করতে সতর্ক করে দিয়েছে। কায়রোতে মার্কিন দূতাবাসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কোনো মার্কিন নাগরিক মিসর ছাড়তে চাইলে তাকে সহায়তা দেওয়া হবে।
প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক প্রায় ৩০ বছর ধরে মিসরের ক্ষমতায় রয়েছেন। ‘এপ্রিল ৬ মুভমেন্ট’ নামের একটি যুবসংগঠন দুর্নীতি, বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়ন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলে তাঁর পদত্যাগের দাবিতে সরকারবিরোধী বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এএফপি, রয়টার্স ও বিবিসি।

বিক্ষোভে জ্বলছে মিসর, সংঘর্ষে নিহত ৭৪

Saturday, January 29, 2011

প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের পদত্যাগের দাবিতে অব্যাহত বিক্ষোভে টালমাটাল হয়ে পড়েছে মিসর। গতকাল শনিবার বিক্ষোভের পঞ্চম দিনে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের সংঘর্ষে তিনজন নিহত হয়েছে। এ নিয়ে গত মঙ্গলবার থেকে শুরু হওয়া বিক্ষোভে ৭৪ জন নিহত হলো।

গণবিক্ষোভের মুখে মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়েছেন হোসনি মোবারক। গত শুক্রবার মধ্যরাতে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী গতকাল মন্ত্রিসভা ভেঙে দেন তিনি। তবে নিজে পদত্যাগ না করার সিদ্ধান্তে অনড় রয়েছেন মোবারক। বিক্ষোভকারীরা তাঁর এই উদ্যোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, মোবারককে অবশ্যই পদত্যাগ করতে হবে। এই দাবিতে তারা গতকাল কারফিউ ভেঙে ব্যাপক বিক্ষোভ করে। এতে করে আরও বিপাকে পড়েছেন মোবারক।
বিক্ষোভের মধ্যেই প্রেসিডেন্ট মোবারক (৮২) গতকাল ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর নাম ঘোষণা করেন। ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে তিনি গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান ওমর সুলাইমানের (৭৫) নাম ঘোষণা করেন। এরপর একটি নতুন সরকার গঠনের জন্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেসামরিক বিমান চলাচলমন্ত্রী আহমেদ শফিকের নাম ঘোষণা করেন। ১৯৮১ সালে মিসরের ক্ষমতা নেওয়ার পর এই প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে কাউকে নিয়োগ দিলেন মোবারক। ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর নাম ঘোষণা করায় অনেকে ধারণা করছেন, মোবারক হয়তো ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
এর আগে শুক্রবার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রেসিডেন্ট মোবারক বলেন, জ্বালাও-পোড়াও করে, ব্যক্তিগত বা সরকারি সম্পদ ধ্বংস করে জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে না। আলোচনা, সচেতনতা ও বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে এই লক্ষ্য অর্জন করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি বিক্ষোভকারীদের কষ্টের কারণ বুঝতে পারছি। কিন্তু কোনোভাবেই দেশকে অস্থিতিশীল হতে দিতে পারি না।’ বক্তব্যে তিনি মিসরের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারেরও প্রতিশ্রুতি দেন।
মোবারকের পদত্যাগের দাবিতে রাজধানী কায়রোর তাহরির স্কয়ারে গতকাল ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। কয়েক হাজার মানুষ বিক্ষোভে অংশ নেয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভবনে ভাঙচুর চালাতে গেলে সেনারা বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা চালায়। এ সময় উভয় পক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এর আগে রাফার সিনাই শহরে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে তিনজন পুলিশ নিহত হয়। এ নিয়ে গত মঙ্গলবার থেকে মোট ৭৪ জন নিহত হলো। বিক্ষোভে আহত হয়েছে এক হাজারেরও বেশি মানুষ। কায়রো, আলেক্সান্দ্রিয়া ও সুয়েজ শহরে কারফিউয়ের সময় বাড়ানো হয়েছে।
এর আগে শুক্রবার বিক্ষোভ দমনে রাজপথে সেনাবাহিনী মোতায়েনের নির্দেশ দেন প্রেসিডেন্ট মোবারক। সেনাসদস্যরা ট্যাংক নিয়ে রাজপথে নেমে আসেন। প্রথমে বিক্ষোভকারীরা সেনাদের স্বাগত জানালেও পরে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। বিক্ষোভকারী মারজুক বলেন, ‘সেনাবাহিনী জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। সেনাসদস্যরা তাহরির স্কয়ারে এলে আমরা তাঁদের স্বাগত জানাই। কিন্তু খুব দ্রুতই তাঁরা দাঙ্গা পুলিশের মতো আচরণ করতে থাকেন। আমরা বাধ্য হয়ে তাঁদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ি।’
মধ্যরাতে প্রেসিডেন্ট মোবারকের সরকার ভেঙে দেওয়ার ঘোষণার পরও তাহরির স্কয়ারে বিক্ষোভ চলতে থাকে। বিক্ষোভকারীরা প্রেসিডেন্টের এই ঘোষণাকে তামাশা বলে উল্লেখ করেন। একজন বিক্ষোভকারী বলেন, ‘শুধু সরকার ভেঙে দেওয়া নয়, প্রেসিডেন্ট মোবারকের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করছি আমরা।’ বিক্ষোভকারীদের স্লোগান ছিল, জনগণ প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ চায়। পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দিতে টিয়ার গ্যাস শেল ও জলকামান ব্যবহার করে। বন্দরনগর ইসমাইলিয়াসহ বেশ কিছু এলাকায় বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে।
কায়রোতে গত শুক্রবার বিক্ষোভকারীদের দেওয়া আগুনে ক্ষমতাসীন দলের সদর দপ্তর গতকালও জ্বলতে দেখা যায়। কায়রোর মোহান্দিসেন জেলায় একটি স্বর্ণালংকারের দোকান ও একটি ব্যাংকে লুটপাট চালানোরও খবর পাওয়া গেছে। বিক্ষোভকারীরা মিসরের প্রায় ৬০ শতাংশ থানায় হামলা চালিয়েছে বলে জানা গেছে।
রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে এক বিবৃতিতে গতকাল জানানো হয়, কায়রো, আলেক্সান্দ্রিয়া ও সুয়েজ শহরে স্থানীয় সময় বিকেল চারটা থেকে সকাল আটটা পর্যন্ত কারফিউ বলবৎ করা হয়েছে। এর আগে সন্ধ্যা ছয়টা থেকে সকাল সাতটা পর্যন্ত কারফিউ বলবৎ ছিল।
প্রেসিডেন্ট মোবারকের ভাষণকে ‘হতাশাজনক’ উল্লেখ করেছেন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ও আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) সাবেক প্রধান এলবারাদি। ফ্রান্স ২৪ টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, শুধু ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর নাম ঘোষণা যথেষ্ট নয়। এতে করে বিক্ষোভ থামবে না। এলবারাদি বলেন, বিক্ষোভের মাধ্যমে দেওয়া জনগণের বার্তা প্রেসিডেন্ট মোবারক বুঝতে পারছেন না। মোবারকের পতন না হওয়া পর্যন্ত বিক্ষোভ চলবে। তিনি আরও বলেন, সরকার ভেঙে দেওয়ার পর অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য দায়িত্ব নিতে তিনি প্রস্তুত আছেন। এদিকে এলবারাদিকে গৃহবন্দী করা হয়েছে বলে একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
দেশটিতে নিষিদ্ধঘোষিত বিরোধী দল মুসলিম ব্রাদারহুড শান্তিপূর্ণভাবে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে প্রেসিডেন্ট মোবারকের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
মিসরের বর্তমান পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। তিনি শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে সহিংস আচরণ না করতে মিসরের কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান। প্রেসিডেন্ট মোবারকের সঙ্গে টেলিফোনে ৩০ মিনিট কথা বলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তিনি রাজনৈতিক সংস্কারের পদক্ষেপ নিতেও প্রেসিডেন্ট মোবারকের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
সৌদি বাদশাহ আবদুল্লাহ প্রেসিডেন্ট মোবারকের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। মিসরের বর্তমান পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে একটি পক্ষ দেশটিতে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাইছে।
প্রেসিডেন্ট মোবারক প্রায় ৩০ বছর ধরে মিসরের ক্ষমতায় রয়েছেন। ‘এপ্রিল ৬ মুভমেন্ট’ নামের একটি সংগঠন দুর্নীতি, বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়ন ও মত প্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলে তাঁর পদত্যাগের দাবিতে সরকারবিরোধী বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এএফপি, রয়টার্স, বিবিসি।

বিক্ষোভ-সংঘর্ষে অগ্নিগর্ভ মিসর

মিসরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারকের পদত্যাগের দাবিতে গতকাল শনিবারও মিসর ছিল অগ্নিগর্ভ। কারফিউ উপেক্ষা করে হাজার হাজার মানুষ দেশটির সব বড় শহরে বিক্ষোভ করছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে মন্ত্রিসভা ভেঙে দিলেও মুবারক তাঁর নিজের পদত্যাগের দাবি নাকচ করে দেওয়ার খবর বিক্ষোভকারীদের আরো উত্তেজিত করে তোলে।

গতকাল রাত ১০টার দিকে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত রাজধানী কায়রো, আলেকজান্দ্রিয়া, ইসমাইলিয়া, সুয়েজসহ পুরো দেশে রাস্তায় রাস্তায় বিক্ষোভকারীরা অবস্থান করছিল। গতকাল কোথাও কোথাও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ হয়। গত শুক্রবার রাত থেকে শুরু হওয়া সহিংসতায় এ পর্যন্ত অন্তত ৭৩ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আহত হয়েছে দুই হাজারেরও বেশি। কয়েক হাজার বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা মেনা জানায়, দেশের সাবেক গোয়েন্দাপ্রধান ওমর সোলাইমান ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন। ৩০ বছরের শাসনামলে মুবারক এই প্রথম এ পদে কাউকে নিয়োগ দিলেন। এ ছাড়া সাবেক বিমানমন্ত্রী আহমাদ শফিককে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। হোসনি মুবারক তাঁকে নতুন সরকার ঠিক করতে বলেছেন। এদিকে মুবারক তাঁর কাছের লোকদের নিয়ে জরুরি বৈঠকে বসেছেন বলেও খবর দিয়েছে মেনা। বিক্ষোভ পরিস্থিতির কারণে আজ শেয়ারবাজার এবং সব ব্যাংকের লেনদেন বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলির ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মহল। দেশটির সবচেয়ে বড় মিত্র যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো মুবারকের প্রতি সংযত আচরণের আহ্বান জানিয়েছে। তারা আরো বলেছে, মিসরের রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য এটিই উপযুক্ত সময়। তবে সৌদি আরব মুবারকের পক্ষে সুস্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে।
সহিংসতার কারণে বিভিন্ন দেশ মিসর ভ্রমণের ওপর সতর্কতা জারি করেছে। হাজার হাজার বিদেশি মিসর ছাড়তে বিমানবন্দরে ভিড় করে আছে বলে গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে।
সম্প্রতি তিউনিসিয়ায় সফল গণ-আন্দোলনের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে মুবারকের পদত্যাগের দাবিতে গত মঙ্গলবার থেকে মিসরে বিক্ষোভ শুরু হয়। ৩০ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা এ একনায়কের বিরুদ্ধে এটি প্রথম বড় কোনো আন্দোলন। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর মুবারকের কঠোর নিয়ন্ত্রণ এড়িয়ে ইন্টারনেটে প্রচারের মাধ্যমে এ বিক্ষোভ আয়োজন করে তরুণরা। সরকারি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেই মঙ্গলবার থেকে দেশটির সব শহরে বিক্ষোভ অব্যাহত রাখে তারা। বিক্ষোভকারীরা শুক্রবার জুমার নামাজ শেষে সর্বাÍক আন্দোলন শুরুর ঘোষণা দেয়। এ পরিস্থিতিতে সন্ধ্যায় কারফিউ জারি করা হলেও জনগণ রাতভর রাস্তায় অবস্থান নেয়। তারা ক্ষমতাসীন দলের প্রধান কার্যালয় জ্বালিয়ে দেয়। এ সময় দেশটির প্রধান জাদুঘর কায়রো মিউজিয়ামেও অগ্নিসংযোগের আশঙ্কা দেখা দেয়। রাতেই মিসরের প্রেসিডেন্ট জাতির উদ্দেশে ভাষণে মন্ত্রিসভা ভেঙে দেওয়ার ঘোষণা দেন। তবে বিক্ষোভকারীরা বলছে, তাদের একটিই দাবি, মুবারকের পদত্যাগ।
শেষরাতের দিকে অনেক বিক্ষোভকারী ঘরে ফিরে গেলেও গতকাল সকাল হতেই তারা আবারও রাজপথে নেমে আসে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে গতকাল স্থানীয় সময় বিকেল ৪টা থেকে দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে নতুন করে কারফিউ জারি করা হয়েছে। সেনাবাহিনী বলেছে, রাতে কারফিউ লঙ্ঘন করা হলে পরিণতি হবে ভয়াবহ। মিসরের তথা বিশ্বের গৌরব পিরামিডগুলো রক্ষায় গাজা উপত্যকায় সাঁজোয়া যান নিয়ে সেনাবাহিনী সুরক্ষা দেয়াল গড়ে তুলেছে।
এদিকে গতকাল বিকেলে কারফিউ উপেক্ষা করে কয়েক হাজার বিক্ষোভকারী কায়রোর প্রাণকেন্দ্রে ঢুকে পড়ে পার্লামেন্ট ভবনের দিকে এগোতে থাকলে সেনাবাহিনী তাদের বাধা দেয়। এ সময় লুটপাট ও সহিংসতার ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে পরিস্থিতি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। পরে সেনাবাহিনী বিক্ষোভকারীদের ওপর রাবার বুলেট, গুলি ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এ সময় সংঘর্ষে তিনজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এ ছাড়া বিক্ষোভকারীরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের দিকে এগুতে থাকলে পুলিশ গুলি চালায়। এতে অন্তত পাঁচ জন নিহত হয়েছে বলে জানা গেছে।
গতকাল ক্ষমতাসীন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির পক্ষ থেকে সিনিয়র এক নেতা টিভি সাক্ষাৎকারে বর্তমান পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে জানিয়ে দেশের জনগণকে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের কথা চিন্তা করে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানান। এ সময় সেনাবাহিনীকে যেকোনো মূল্যে সহিংসতা মোকাবিলা করে মিসর রক্ষায় সতর্ক দৃষ্টি রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়। দলের পক্ষ থেকে শিগগিরই নতুন মন্ত্রিসভা ঘোষণার কথা জানান তিনি।
অন্যদিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনীর একাংশ জনগণের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মিসরে সহিংসতা কমাতে দেশবাসীকে নিজেদের এবং দেশকে রক্ষার আহ্বান জানায়।
এ বিক্ষোভে যোগ দিতে বৃহস্পতিবার অস্ট্রিয়া থেকে দেশে ফেরেন আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার সাবেক প্রধান মোহামেদ এল বারাদি। আগের তিন দিন নিষ্ক্রিয় থাকা মুসলিম ব্রাদারহুডও শুক্রবারের বিক্ষোভে যোগ দেওয়ার ঘোষণা দেয়।
বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকেই বেশির ভাগ স্থানে মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দিলেও গতকাল তা খুলে দেওয়া হয়েছে। তবে ফেইসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক নেটওয়ার্কিং সাইট বন্ধ রয়েছে। সূত্র : বিবিসি, আল জাজিরা, এএফপি।

ফুঁসে উঠেছে মিসরীয়রা

Wednesday, January 26, 2011

প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের পতনের দাবিতে বড় ধরনের বিক্ষোভ হয়েছে মিসরে। গতকাল মঙ্গলবার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের দাবিতে দেশটিতে বিক্ষোভ দিবস পালন করে সরকারবিরোধীরা। সরকারের নিষেধাজ্ঞা ও পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে হাজার হাজার মানুষ এ কর্মসূচিতে অংশ নেয়।

শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত সব বড় শহরেই মোবারকের পতনের দাবিতে বিক্ষোভ চলছিল। দেশটির ইতিহাসে এমন আন্দোলনের ঘটনা বিরল। বিশ্লেষকরা বলছেন, সম্প্রতি তিউনিসিয়ায় সফল গণ-আন্দোলনের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই মিসরের এ বিক্ষোভ হয়েছে।
এ বছর ক্ষমতা গ্রহণের ৩০ বছর পূর্ণ করছেন মোবারক। এ দীর্ঘ শাসনামলে বিরোধীদের কঠোর হস্তে দমন করেছেন তিনি। দেশটির সবচেয়ে বড় বিরোধী দল মুসলিম ব্রাদারহুডকে দীর্ঘদিন ধরে নিষিদ্ধ করে রাখা হয়েছে। সেখানে সরকারের অনুমতি ছাড়া কোনো মিছিল-সমাবেশ করা নিষিদ্ধ। স্বল্প পরিসরেও সরকারবিরোধী কোনো বিক্ষোভ শুরু হলে পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এমন পরিস্থিতিতেই ইন্টারনেটে প্রচারের মাধ্যমে মঙ্গলবারের বিক্ষোভ আয়োজন করে তরুণরা। এ দিনটিকে 'নির্যাতন, দারিদ্র্য, দুর্নীতি ও বেকারত্বের বিরুদ্ধে বিপ্লব দিবস' হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। তিউনিসিয়ার ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে মোবারকের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামার জন্য তারা দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানায়। বিষয়টি টের পেয়ে বিক্ষোভের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দেয় সরকার। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হাবিব আল আদলি স্পষ্ট বলে দেন, নির্দেশ অমান্য করে রাস্তায় নামলে গ্রেপ্তারের মুখোমুখি হতে হবে বিক্ষোভকারীদের। গতকাল সকাল থেকে দেশটির সব বড় শহরে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়। একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, কেবল রাজধানী কায়রোতেই মোতায়েন রয়েছে ৩০ হাজার পুলিশ।
তবে সব বাধা উপেক্ষা করে গতকাল দুপুরে মিসরের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভকারীরা সমবেত হয়। রাজধানী কায়রো ছাড়াও আলেকজান্দ্রিয়া, মানসুরা, ইসমাইলিয়া ও আল মাহদিয়া শহরে বড় ধরনের বিক্ষোভ হয়েছে। বার্তা সংস্থাগুলো জানিয়েছে, কায়রোতে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙেই বিক্ষোভকারীরা এগিয়ে যায়। পরে সুপ্রিম কোর্টের সামনে জড়ো হয়ে তারা 'তিউনিসিয়াই সমাধান', 'মোবারকের পতন চাই' ইত্যাদি স্লোগান দেয়।
সূত্র : এএফপি, রয়টার্স।
 
Support : Dhumketo ধূমকেতু | NewsCtg.Com | KUTUBDIA @ কুতুবদিয়া | eBlog
Copyright © 2013. Edu2News - All Rights Reserved
Template Created by Nejam Kutubi Published by Darianagar Publications
Proudly powered by Dhumketo ধূমকেতু