মিসর ও তিউনিসিয়া—আরব বিশ্বের দুটি দেশ। তাদের মধ্যে যোজন যোজন দূরত্ব তৈরি করেছে লিবিয়া। এই দূরত্ব সত্ত্বেও দেশ দুটির মধ্যে কত-না মিল ছিল।
দেশ দুটি দীর্ঘদিন স্বৈরশাসকদের শাসনে ছিল। ধর্মীয় কট্টরপন্থা যাতে সে দেশের শাসনব্যবস্থায় গেড়ে না বসতে পারে, এ জন্য মিসর ও তিউনিসিয়ার শাসকেরা ছিলেন নির্দয়। কিন্তু তলে তলে দেশ দুটিতে কট্টর ইসলামপন্থীদের সক্রিয় হয়ে ওঠা ও ক্ষমতা দখল—দুটোই কঠিন বাস্তব।
কিন্তু এই বাস্তবতা মোকাবিলায় দেশ দুটি আবার ভিন্ন পথে হেঁটেছে। একজন বেছে নিয়েছে আলোচনার পথ, অন্যজন বলপ্রয়োগের। অথচ ‘কথিত’ আরব বসন্তের সূত্রপাত করেছিল এই মিসর ও তিউনিসিয়া। এখন দুই বিপরীতমুখী ধারার সম্মিলন গোটা আরব বিশ্বকে বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দিয়েছে বলা যায়।
১৯৫৬ সালে ফ্রান্সের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পর থেকে তিউনিসিয়া সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবেই পরিচিত ছিল। নামে গণতন্ত্র হলেও ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বৈরাচার ও অনাচার দেশটিকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। শেষমেশ ২০১১ সালের জানুয়ারিতে এক গণ-অভ্যুত্থানে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বেন আলী। এরপর অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে সংবিধান পরিষদ নির্বাচিত হয়। ১৫ জানুয়ারি এই সংবিধান পরিষদ ঐকমত্যের ভিত্তিতে নতুন সংবিধান গ্রহণ করেছে, যা আরব বিশ্বে এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে উদার সংবিধানই বলা যায়। তিউনিসিয়ার পার্লামেন্ট গত রোববার দেশটির নতুন সংবিধান অনুমোদন দিয়েছে। সংবিধানে অনুমোদনের পক্ষে ২১৬ ভোটের মধ্যে ২০০টি ভোট পড়ে। গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয়ে এই সংবিধানে শব্দ চয়ন করা হয়েছে এমনভাবে, যাতে শাসক ইসলামপন্থী দল ও এর বিরোধী ধর্মনিরপেক্ষ দলের কাছে তা গ্রহণযোগ্য বলেই মনে হয়েছে। সামাজিক জীবনে ইসলামের ভূমিকা ঠিক কী হবে, এই কঠিন প্রশ্নে দল দুটি মতৈক্যে আসতে পেরেছে, যা আপস বা সমন্বয়ের এক বিরল নিদর্শন।
তিউনিসিয়ার নতুন সংবিধানে বলা হয়েছে, ‘তিউনিসিয়া হবে মুক্ত, স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ; ইসলাম এর ধর্মীয় পরিচয়; আরবি এর ভাষা এবং এর শাসনব্যবস্থা প্রজাতান্ত্রিক।’ এতে আরও বলা হয়েছে, ‘তিউনিসিয়া হবে নাগরিক রাষ্ট্র, যা জনমতের ইচ্ছায় গড়ে উঠবে এবং এখানে আইনই সর্বোচ্চ।’ ভবিষ্যতে কোনো দল যত গরিষ্ঠতা নিয়েই ক্ষমতায় আসুক না কেন, সংবিধানের এই দুই মৌলিক বিষয়কে তারা কখনো সংশোধন করতে পারবে না।
তিউনিসিয়ার পার্লামেন্ট গত বুধবার একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের বিষয়টি অনুমোদন করে। নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত এই সরকার দেশ পরিচালনা করবে।
অন্যদিকে, পিরামিডখ্যাত মিসরকে দেখুন। উত্তাল তাহরির স্কয়ারের কথা এ দেশের পাঠকের কে না জানে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে সংগঠিত আন্দোলন ও হাজারো তরুণের আত্মত্যাগ স্বৈরশাসকবিরোধী এ আন্দোলনকে স্মরণীয় করে রেখেছে। ২০১১ সালের জানুয়ারির সেই হোসনি মোবারকবিরোধী আন্দোলন ও ফেব্রুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট মোবারকের পতন মিসরবাসীকে নতুন স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছিল।
কিন্তু তারুণ্যের এই আত্মত্যাগের ফসল তুলল মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুড। ২০১১ সালের ২৮ নভেম্বর দেশের প্রথম সংসদ নির্বাচনে জয় ছিনিয়ে নিয়ে প্রেসিডেন্ট হলেন ব্রাদারহুডের নেতা মোহাম্মদ মুরসি। চলতে শুরু করলেন নিজের পথে, নিজের মতো করে। এক বছরের মধ্যে নতুন সংবিধান অনুমোদনের জন্য গণভোটের ব্যবস্থা করলেন। বিরোধী রাজনীতিকেরা শুরু থেকে ব্রাদারহুডের বিপক্ষে অবস্থান নেন। বুদ্ধিমান মুরসি তাঁদের কাছে আলোচনার প্রস্তাব দিলেও নিজের উদ্দেশ্য পূরণে অটল থাকলেন; যার ফলে গত বছরের মাঝামাঝি মিসরজুড়ে শুরু হয় মুরসিবিরোধী আন্দোলন।
জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবের আইনকানুনের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ নাথান ব্রাউন বলছেন, প্রথমত, বিরোধীরা এটা জানত যে পরের নির্বাচনেও তারা কোনোভাবেই জিততে পারবে না। দ্বিতীয়ত, সেনাবাহিনী সেখানে ছিল। কার্যক্ষেত্রে হলোও তা-ই।
ঘরে-বাইরে মুরসিবিরোধী তীব্র মনোভাবের সুযোগ নিল সে দেশের সেনাবাহিনী, যারা ১৯৫২ সাল থেকে একটানা ৬০ বছর মিসরের শাসন পরিচালনা করেছে। ক্ষমতা হারালেন মুরসি। সেনাশাসনকে পাকাপোক্ত করতে কোনো ধরনের মতৈক্য ছাড়াই আয়োজিত গণভোটে রায় এল ‘হ্যাঁ’-এর পক্ষে এবং বিপুলভাবে। আসলে ‘না’ যে বলা যাবে, এটাই বহু ভোটার জানতেন না। মিসরের নতুন শাসকেরা ব্রাদারহুডকে ‘সন্ত্রাসী’ তকমা দিয়ে নিষিদ্ধ করেছেন, কারাগারে পাঠিয়েছেন এ দলের নেতাদের, জব্দ করেছেন সম্পদ। ইজিপশিয়ান ইনিশিয়েটিভ ফর পার্সোনাল রাইটসের প্রতিষ্ঠাতা হোসাম বাঘাতের ভাষায়, এই শাসকেরা মোবারকের জামানাকেও হার মানিয়েছে। উল্লেখ্য, হোসনি মোবারক নিজেও সেনাবাহিনী থেকে এসে প্রায় ৪০ বছর মিসর শাসন করে গেছেন।
সামরিক বাহিনী ক্ষমতায় আসার মিসরের উদারপন্থীরা খুশি। তাদের সেই খুশি ঝরে পড়ছে সেনাশাসক সিসির প্রতি আপ্লুত ভাবাবেগে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সেনাবাহিনী কি শেষ পর্যন্ত দেশটিতে শান্তি আনতে পারবে? নাকি এখানেও দুই পক্ষের মধ্যে একটা সমঝোতার দরকার ছিল, যে পথ ইতিমধ্যে তিউনিসিয়া দেখিয়ে দিয়েছে। কায়রোর আইনজ্ঞ জায়েদ আল-আলীর কথায়, ‘তিউনিসিয়ায় পুরো পাতাটাই উল্টানো হয়েছে এবং তাই তুমি বুঝতে পারবে যে সেখানে বিপ্লব এসেছিল। কিন্তু মিসরের ক্ষেত্রে তা (বিপ্লব/আরব বসন্ত) তা বিতর্কিতই থেকে গেল।’
২০১১ সালের একই সময়ে একই পথে যাত্রা করে আরব বিশ্বের দুটি দেশের যাত্রা কেন বিপরীতমুখী হয়ে গেল, তা হয়তো ভবিষ্যতের গবেষকদের জন্য তোলা থাকবে। তত দিনে নীল নদের তীরের এই দেশে আর কত রক্তপাত হবে কে জানে!
ইন্টারন্যাশনাল নিউইয়র্ক টাইমস অবলম্বনে
0 comments:
Post a Comment