অবশেষে ফিলিপাইনের সরকার ও দেশটির সবচেয়ে বড় মুসলিম বিদ্রোহী গোষ্ঠী মরো ইসলামিক লিবারেশন ফ্রন্টের মধ্যে (এমআইএলএফ) একটি শান্তিচুক্তি হতে যাচ্ছে।
গত শনিবার মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে এ ব্যাপারে দুই পক্ষের মধ্যে একটি সমঝোতা হয়। অনেকে আশা করছেন, এর মধ্য দিয়ে অবসান হতে যাচ্ছে ফিলিপাইনের দক্ষিণাঞ্চলে ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা সহিংসতার।
এমআইএলএফ ছাড়াও বেশ কয়েকটি মুসলিম বিদ্রোহী গোষ্ঠী দক্ষিণাঞ্চলের মিন্দানাও দ্বীপসহ দক্ষিণাঞ্চলের বেশ কয়েকটি এলাকায় ম্যানিলার শাসনের বিরুদ্ধে এবং স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে লড়াই চালিয়ে আসছে। গত কয়েক দশকের লড়াইয়ে প্রায় দেড় লাখ মানুষ নিহত হয়েছে, ঘরছাড়া হয়েছে ২০ লাখ মানুষ এবং চরম দারিদ্র্যের কবলে পড়ে দেশটির দক্ষিণাঞ্চল। পাশাপাশি এই সহিংসতা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়তে সহায়তা করেছে ইসলামি চরমপন্থা।
এই সমঝোতাকে ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট বেনিগনো নয়নয় অ্যাকুইনোর বড় অর্জন হিসেবে দেখা হচ্ছে। ২০১২ সালের অক্টোবর মাস থেকে ফিলিপাইন সরকার ও এমআইএলএফের মধ্যে এই শান্তিচুক্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়। চুক্তিতে কী কী থাকবে, সে ব্যাপারে তারা এত দিন আলোচনা করেছে। গত শনিবার চূড়ান্ত পর্বের আলোচনা শেষে সমঝোতাপত্র সই হয়। আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে চূড়ান্ত চুক্তি সই হবে বলে ফিলিপাইন সরকার সূত্র জানিয়েছে।
চুক্তি অনুযায়ী, ফিলিপাইন সরকার মিন্দানাওসহ দক্ষিণের বেশ কয়েকটি এলাকায় স্বায়ত্তশাসন দেবে। বিনিময়ে এমআইএলএফের ১১ হাজার যোদ্ধার একটি বড় অংশ সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীতে যোগ দেবে এবং অন্যরা পর্যায়ক্রমে তাদের অস্ত্র সমর্পণ করবে। এই সমর্পণের কাজ পর্যবেক্ষণ করবে তৃতীয় একটি পক্ষ। এ ছাড়া স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলগুলোর বিভিন্ন খনি থেকে প্রাপ্ত রাজস্বের ৭৫ শতাংশ মিন্দানাওতে থাকবে। জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে পাওয়া করের অর্ধেক সেখানকার স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
এমন একটি শান্তিচুক্তির সম্ভাবনায় ফিলিপাইনের অনেকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। অ্যাটেনিও ডি ম্যানিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক রিচার্ড জাভাদ হেদারিয়ান বলেন, মিন্দানাও দ্বীপের সহিংসতার অবসানে কয়েক দশক ধরে কূটনীতিকেরা যে কষ্টকর চেষ্টা চালিয়ে আসছিলেন, এই চুক্তির মাধ্যমে এর অবসান ঘটবে। এই চুক্তি বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলা লড়াইয়ের অবসানের এক অপূর্ব সুযোগ এনে দেবে।
তবে এই শান্তিচুক্তির সফলতা নির্ভর করবে এমআইএলএফের সক্ষমতার ওপর। স্বায়ত্তশাসিত এলাকার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার রক্ষার দায়িত্ব তাদের হাতে থাকবে। অন্যান্য জঙ্গি গোষ্ঠীর সহিংসতা দমন করাই হবে তাদের প্রধান কাজ। এটা করতে না পারলে শান্তি আসবে না।
১৯৯৬ সালে আরেকটি বড় জঙ্গি গোষ্ঠী মরো ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের সঙ্গে ফিলিপাইন সরকারের শান্তিচুক্তি হয়েছিল। তবে ওই চুক্তিতে বিদ্রোহীদের হাতে অস্ত্র রাখার অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। এ কারণে শান্তিচুক্তির বাস্তবায়ন হয়নি।
এমআইএলএফ সরকারের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করতে রাজি হলেও আল-কায়েদা-সংশ্লিষ্ট জঙ্গি গোষ্ঠী আবু সায়াফ, এমআইএলএফসহ বাকি লড়াইরত জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো জানিয়ে দিয়েছে, তারা এই চুক্তিতে যোগ দেবে না। আর এ কারণে অনেকে শান্তিচুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। তাঁদের মধ্যে একজন হলেন দ্য ফিলিপাইন স্টার পত্রিকার কলামিস্ট ববিট আভিলা। তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট অ্যাকুইনোর প্রশাসন চুক্তিটি করার জন্য খুব ব্যতিব্যস্ত। তারাই শান্তিচুক্তি করতে পেরেছে—এমন একটি কৃতিত্ব নিতে চাইছে। কিন্তু এই শান্তিচুক্তি শান্তি আনবে না, যতক্ষণ না পর্যন্ত দক্ষিণাঞ্চলের সব সশস্ত্র গোষ্ঠী এই চুক্তিতে না যোগ দেবে।
আভিলা বলেন, ‘বিশ্বের যেকোনো মুসলিম দেশে আমি ভয় ছাড়াই ঘুরতে পারি। কিন্তু মিন্দানাওয়ে আমি সেটা পারব না। হয় আমি খুন হব, নয়তো অপহূত হব। শান্তিচুক্তি এই অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটাতে পারবে না।’
সরকার ও বিদ্রোহী—উভয় পক্ষই স্বীকার করেছে যে, দেশের দক্ষিণাঞ্চলে রাতারাতি সহিংসতার অবসান ঘটবে না। কেননা, সেখানে এখনো গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব অব্যাহত রয়েছে, রয়েছে বিপুলসংখ্যক অবৈধ অস্ত্র ও দুর্বল আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা।
নওয়াজ ফারহিন
সূত্র: দ্য টেলিগ্রাফ, এএফপি ও বিবিসি
0 comments:
Post a Comment