শেয়ারবাজারে লাগাতার দরপতন, বিশেষজ্ঞরাও ধোঁয়াশায় by টিটু দত্ত গুপ্ত

Saturday, September 24, 2011

রকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর নানামুখী পদক্ষেপের পরও শেয়ারবাজার কেন স্থির হচ্ছে না, তা বিশেষজ্ঞদেরও বোধগম্য নয়। 'স্বাভাবিক' অবস্থার সংজ্ঞা নিয়েও তাঁরা নিশ্চিত নন। সর্বশেষ ধ্বংসের আগের অবস্থা অর্থাৎ সূচকের ৮৯১৯ পয়েন্ট যদি 'স্বাভাবিক' অবস্থার মাপকাঠি হয়, তাহলে দেশের শেয়ারবাজার কবে নাগাদ সে অবস্থায় পেঁৗছাবে, এ ব্যাপারে কোনো ধারণা নেই তাঁদের। তবে তাঁদের পরামর্শ, বর্তমানে সূচক যেভাবে হিসাব করা হয়, তাতে শেয়ারবাজারের প্রকৃত চিত্র ফুটে ওঠে না। সূচক নিয়ে বিচলিত না হয়ে লগি্নকারীদের উচিত কম্পানির মৌল ভিত্তি বিবেচনায় নিয়ে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া ও অপেক্ষা করা। ঋণের টাকায় নয়, নিজের সঞ্চয়ের একটি নিরাপদ অংশ দিয়েই যেন তারা শেয়ার কেনে।

বিশ্লেষকদের মতে, বাজারে নতুন করে আস্থাহীনতা তৈরি হওয়ার মতো কোনো ঘটনা দেশের অর্থনীতিতে ঘটেনি। বিক্ষোভকারীদের নানা দাবি মেনে নেওয়ার পর সরকারেরও আর তেমন কিছু করার নেই। তবে অর্থমন্ত্রীর আগের ঘোষণা অনুযায়ী সরকারি শেয়ার জরুরি ভিত্তিতে বাজারে ছাড়ার তাগিদ দিয়েছেন তাঁরা। বাজারে যখন এমনিতেই শেয়ারের দাম পড়ছে, তখন কম্পানির উদ্যোক্তাদের শেয়ার বিক্রির হিড়িক শেয়ারের দামের নিম্নগতিকে ত্বরান্বিত করছে। তা ছাড়া বাজারে ওই কম্পানি সম্পর্কে সাধারণ লগি্নকারীদের মনে একটি নেতিবাচক ধারণাও তৈরি করছে বলে তাঁরা মনে করছেন।
শেয়ারবাজার হবে শিল্প স্থাপন ও অবকাঠামো নির্মাণের জন্য অর্থায়নের বিকল্প উৎস, যা ব্যাংকের ওপর চাপ কমাবে_এমনিটিই আশা দেশের ব্যক্তি খাতের উদ্যোক্তাদের। কিন্তু বাস্তবে শেয়ারবাজার নিজেই হয়ে পড়েছে ব্যাংকনির্ভর। 'তারল্য সংকটের' কথা বলে হাত গুটিয়ে নিয়েছেন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা। আর পড়তি দামেই নিজেদের শেয়ার বেচে বাজার থেকে বের হতে চাইছেন কম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকরা। তারল্য সংকট নিরসনের দাবিতে বিক্ষোভ-ভাঙচুরের প্রেক্ষাপটে গত সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকগুলোর একক ঋণ সমন্বয়ের সময়সীমা এক বছর বাড়িয়ে দিল। তার পরও শেয়ারের দামের পতন থামছে না। এ অবস্থায় মন্দাবস্থা হয়তো প্রলম্বিত হবে_এমন আশঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না বিশ্লেষকদের কেউ কেউ।
বাজারের এমন আচরণের কারণ বুঝে উঠতে পারছেন না তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, 'বাজারে কেন এ রকম অবস্থা চলছে তা বলা মুশকিল।'
শেয়ারবাজারের জন্য সরকারের আর কী করার আছে জিজ্ঞেস করা হলে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এঙ্চেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) সাবেক এ চেয়ারম্যান বলেন, সরকার এখন যা করতে পারে সেটি হলো, দ্রুতগতিতে সরকারি শেয়ার বাজারে ছাড়া। এতে সরবরাহের ঘাটতি কিছুটা কমবে। ড. মির্জ্জা আজিজ বলেন, 'আমি মনে করি, নতুন শেয়ার আসা দরকার। যেকোনো আইপিও এলেই ওভার-সাব্সক্রাইব্ড হয়। এতে বাজারে নতুন অর্থ আসবে।' ইনডেঙ্ (সূচক) দেখে বিনিয়োগ না করার পরামর্শও দিলেন তিনি।
অর্থনীতিবিদ ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, শেয়ারবাজারের বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র দৃশ্যমান উপায় হচ্ছে ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমিয়ে দেওয়া। তিন প্রশ্ন করেন, 'ব্যাংকে টাকা রেখে যদি ১৪ শতাংশ সুদ পাওয়া যায় তাহলে মানুষ কেন শেয়ারবাজারে আসবে?' তবে তাঁর ধারণা, আইএমএফের চাপে সরকার বা বাংলাদেশ ব্যাংক তা করতে পারবে না, ফলে শেয়ারবাজারে মন্দাবস্থারও দ্রুত অবসান হবে না।
শেয়ারবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক ড. ওসমান ইমাম বলেন, শেয়ারবাজারে ব্যাংকগুলো আগেই বিপুল অঙ্কের বিনিয়োগ করেছিল। এটি কমিয়ে আনার জন্য তাদের খুব কম সময় দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তিনি মনে করেন, চার থেকে পাঁচ বছর সময় পেলে ব্যাংকগুলো নিজেদের গুটিয়ে আনতে পারত, বাজারেও প্রভাব পড়ত না। শেয়ারবাজারকে শিল্পে অর্থায়নের বিকল্প উৎস হিসেবে গড়ে তোলার সত্যিকারের ইচ্ছা সরকার বা নিয়ন্ত্রক সংস্থার আছে বলে মনে করেন না ড. ওসমান। তিনি বলেন, বাজেটেও এ ব্যাপারে কোনো দিকনির্দেশনা নেই।
লন্ডন স্টক এঙ্চেঞ্জে সাম্প্রতিক মন্দাবস্থার সময় বড় বড় কম্পানি বাজার থেকে নিজেদের শেয়ার কিনে নিয়েছে। দাম পড়ে যাওয়ায় শেয়ারহোল্ডারদের ধারণকৃত শেয়ারের মূল্যমান সমান রাখা বা বাড়ানোর জন্যই এ শেয়ার কিনে নেওয়া হচ্ছে বলে কম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে জানানো হয়। অথচ বাংলাদেশে একদিকে যখন সরকার শেয়ার বাই-ব্যাক আইন কঠোর করার উদ্যোগ নিচ্ছে, অন্যদিকে তখন ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এঙ্চেঞ্জে কম্পানির পরিচালকরা মন্দার বাজারে শেয়ার বিক্রি করে চলেছেন। গত এক সপ্তাহে অন্তত ১৩টি কম্পানির পরিচালকরা তাঁদের হাতে থাকা ৭০ লাখেরও বেশি শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে প্রায় ১২১ কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন।
এ ব্যাপারে মির্জ্জা আজিজ বলেন, বাজারের এ অবস্থায় তাঁরা নিজেরাই যদি নিজেদের শেয়ার বিক্রি করে দেন তাহলে বাজারে ভুল সংকেত যাবে। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মনে সংশ্লিষ্ট কম্পানি সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হবে।
১৯৯০ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জের (ডিএসই) সাধারণ সূচক ছিল ৫০০ পয়েন্টের নিচে। '৯৬-এর জুলাই মাসে তা ১০০০-এর ঘর অতিক্রম করে চার মাসের মাথায় সূচক ৩০০০ পয়েন্ট ছাড়িয়ে যায়। চার মাসের মাথায় আবার নেমে আসে ৯৫০-এর কোটায়। এর মধ্যে ঘটে যায় বাংলাদেশের উঠতি শেয়ারবাজারের প্রথম ভয়াবহ ধস, অসংখ্য ব্যক্তি লগি্নকারীর সারা জীবনের সঞ্চয় চলে যায় গুটিকয়েক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে। তারপর আট বছর লেগেছে সূচকের ১০০০-এর ঘর পার হতে। ২০০৪-এর ডিসেম্বরে একবার ২০০০ ছুঁই ছুঁই করলেও ২০০৬ সালের জুলাই মাস নাগাদ সূচক পড়ে যায় ১৪০০ পয়েন্টে। অবশ্য পরের দেড় বছরে অর্থাৎ ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে ডিএসইর মূল্যসূচক আবার পেঁৗছায় ৩০০০-এ। ওঠা-নামার মধ্য দিয়ে ২০০৯-এর মার্চে সূচক ২৫০০-এর নিচে নেমে এলেও পরের ২০ মাস ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জের শুধুই উল্লম্ফন। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে দেশের শেয়ারবাজারের ইতিহাসের সর্বোচ্চ ৮৯১৯ পয়েন্ট ছোঁয় ডিএসই জেনারেল ইনডেঙ্ বা ডিজেন। এ উত্থান যেন ঘটেছিল পতনের জন্যই। মাত্র দুই মাসের মাথায়, অর্থাৎ চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে এটি নেমে আসে ৫২০০-এর ঘরে। এর মধ্যে রাস্তায় ব্যাপক বিক্ষোভ, তদন্ত কমিটি গঠন ও নির্ধারিত সময়ের আগেই তার প্রতিবেদন পেশ, দেরিতে হলেও সেই প্রতিবেদনের আলোর মুখ দেখা, প্রতিবেদন অনুযায়ী বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া, কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়াসহ বাজেটে ঘোষিত কিছু পদক্ষেপ, সবশেষে শেয়ারবাজারে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বাড়তি বিনিয়োগ কমিয়ে আনার সময় বাড়ানো। এক একটি উদ্যোগের পর সূচকের ঊর্ধ্বমুখী নড়াচড়া, পরের দিন আবার নিম্নমুখিতা, রাস্তায় বিক্ষোভ।
গত সপ্তাহে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জে (ডিএসই) বাজার মূলধন কমেছে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। সাধারণ মূল্যসূচক পাঁচ হাজার ৯৬৬.৫১ পয়েন্ট নিয়ে গত সপ্তাহের লেনদেন শুরু হয়েছিল ডিএসইতে। আর সপ্তাহের শেষে এসে মূল্যসূচক দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৬৫২.৩২ পয়েন্ট। ফলে এক সপ্তাহের ব্যবধানে সূচক কমেছে ৩১৪.১৯ পয়েন্ট। শেষ দিন হরতালে রাজধানীতে বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকলেও ডিএসইর সূচক অবশ্য ২.৮৮ পয়েন্ট বেড়ে ৫৬৫২.৩২ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।
গত সপ্তাহে ঢাকার স্টক মার্কেট এলাকায় যখন শেয়ারবাজারে ব্যাংকের অর্থ সরবরাহ বাড়ানোর দাবিতে বিক্ষোভ চলছিল, তখন বিক্ষোভকারীরা নিউ ইয়র্ক স্টক এঙ্চেঞ্জ ও ওয়ালস্ট্রিট দখলের ঘোষণা দিয়ে দাবি করেছে, দেশের এক শতাংশ লোভী ও দুর্নীতিবাজ মানুষের কাছে ৯৯ শতাংশ মানুষ জিম্মি হয়ে থাকতে পারে না। দেশের অর্থনীতির নীতি শুধু এক শতাংশ মানুষের সুখের জন্য রচিত হতে পারে না।
ব্যাংকের টাকা দিয়ে শেয়ারবাজার টিকিয়ে রাখার দাবির যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজ। তাঁর মতে, শেয়ার মার্কেট হবে শিল্পে অর্থায়নের একটি নির্ভরযোগ্য উৎস। এখন ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে এটি চলছে। ব্যাংকের টাকা আমানতকারীদের সম্পদ। এটি বিনিয়োগ করার কথা উৎপাদনমুখী খাতে, শেয়ারবাজারের মতো ঝুঁকিপূর্ণ খাতে ব্যাংকের অর্থ বিনিয়োগের একটি নিরাপদ সীমারেখা থাকতে হবে। অথচ তারল্য সংকটের কথা বলে ব্যাংকের আরো টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের দাবি তোলা হচ্ছে। এর যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ নেই।
বিশ্বজুড়েই শেয়ারবাজারে মন্দা চলছে। চলতি মাসে আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এ নিয়ে বিক্ষোভ হয়েছে। তারা অর্থনীতিতে মন্দার কারণে দেশগুলোতে নেওয়া নানা কৃচ্ছ্র কর্মসূচির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছে। তবে কোথাও রাস্তায় বিক্ষোভ করে শেয়ারবাজারের পতন ঠেকানোর জন্য ব্যাংক থেকে অর্থ সরবরাহ বাড়ানোর দাবি জানানো হয়নি। আমেরিকার নিউ ইয়র্কে গত সপ্তাহে বিক্ষোভ হয়েছিল দুর্নীতি আর লোভের হাত থেকে অর্থনীতিকে রক্ষা করার দাবিতে।

প্লেসমেন্ট শেয়ারের অবৈধ হাট, এমপি-সাবেক এমপিরাও গ্রীন বাংলার ফাঁদে by তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু

Sunday, July 31, 2011

রাজধানীর বনশ্রীতে প্লেসমেন্ট শেয়ার বিকিকিনির জন্য আলাদাভাবে গড়ে উঠেছে একটি 'স্টক মার্কেট'। গ্রীন বাংলা গ্রুপ পরিচালিত এ কার্ব মার্কেটে বছরে অন্তত এক হাজার কোটি টাকার প্লেসমেন্ট শেয়ার কেনাবেচা হয়। বিভিন্ন কম্পানির রাইট শেয়ার নিয়েও আগাম বাণিজ্য চলে এখানে। এই প্লেসমেন্ট বাণিজ্যের ফাঁদে পড়েছেন প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও। সংসদ সদস্য, পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ নির্বাহীসহ অনেকের মোটা অঙ্কের টাকা আটকে আছে গ্রীন বাংলা গ্রুপের কাছে। তাঁদের মধ্যে মাহী বি চৌধুরী আড়াই কোটি টাকারও বেশি বিনিয়োগ করে পরে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে টাকা উদ্ধার করেন। কুমিল্লার এমপি নাসিমুল আলম চৌধুরীও গ্রীন বাংলার মাধ্যমে আট কোটি টাকা বিনিয়োগ করেন বলে জানা যায়। তবে নাসিমুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেছেন, তিনি টাকা তুলে নিয়েছেন।

প্লেসমেন্ট শেয়ার নিয়ে প্রতারণার অভিযোগে এক বছর আগে এ প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার নবী উল্যাহ নবীকে গ্রেপ্তার করেছিল র‌্যাব। এসইসির তদন্ত কমিটি এসব অভিযোগের সত্যতাও পেয়েছিল। মামলা হয়েছিল। সে মামলা এখনো চলছে। তবে অবৈধ এ ব্যবসা চালিয়ে যেতে অসুবিধা হচ্ছে না গ্রীন বাংলার।
গ্রীন বাংলা গ্রুপের প্রধান কার্যালয় রাজধানীর রামপুরার বনশ্রীতে। নবী উল্যাহ নবী এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক। আটটি সহযোগী প্রতিষ্ঠানের নামে চালানো হচ্ছে অবৈধ প্লেসমেন্ট ব্যবসাসহ পুঁজিবাজারকেন্দ্রিক নানামুখী প্রতারণা। ২০১৪ সাল পর্যন্ত যেসব প্রতিষ্ঠান শেয়ারবাজারে আসতে পারে_এর প্রায় সব কটির শেয়ার এখনই নবী উল্যাহ নবীর কাছে রয়েছে বলে তাঁর সহযোগীরা প্রচার করছে। এই চক্র ইতিমধ্যে সহস্রাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করেছে। সর্বনিম্ন পাঁচ লাখ থেকে ৬০ কোটি টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করেছেন এমন দেড় শতাধিক ব্যক্তির তালিকা রয়েছে কালের কণ্ঠের কাছে।
ফাঁদে আটক যাঁরা : ১৫০ টাকার জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে করা 'বিনিয়োগ চুক্তি' দলিলের মাধ্যমে জহিরুল ইসলাম নামে একজন বিনিয়োগকারী নবী উল্যাহর কাছ থেকে দেশবন্ধু পলিমারের দুই লাখ প্লেসমেন্ট শেয়ার কিনেছেন। শেয়ারপ্রতি ৩৫ টাকা হিসাবে জহিরুল ইসলাম ৭০ লাখ টাকা দেন নবী উল্যাহকে। চুক্তিনামায় নবী উল্যাহর স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন মিনু এবং কে এম নাজমুল হাসান নামে এক ব্যক্তিকে সাক্ষী রাখা হয়েছে। জহিরুল ইসলামের বিনিয়োগকৃত অর্থের জামানত হিসেবে নবী উল্যাহর পক্ষ থেকে সমপরিমাণ অর্থের নিরাপত্তামূলক চেক দেওয়া হয়েছে বলেও চুক্তিতে উল্লেখ রয়েছে। চুক্তিপত্রে বলা হয়, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বিক্রির পর বিক্রয়মূল্যের ভিত্তিতে বিনিয়োগের লভ্যাংশ নির্ধারিত হবে। আর শেয়ার বিক্রি করে লোকসান হলে বিনিয়োগকারীর ৭০ লাখ টাকা ফেরত দেওয়ারও নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা সম্ভাব্য ক্রেতাদের বলছেন, বর্তমান জাতীয় সংসদের ১১ জন সদস্য, বেশ কয়েকজন সাবেক সংসদ সদস্য, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তা, উচ্চপদস্থ আমলা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, উঠতি শিল্পপতিসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ এখানে বিনিয়োগ করেছেন। বিনিয়োগকৃত টাকা উত্তোলনের জন্য গত ১৩ জুলাই বনশ্রীর গ্রীন বাংলা কার্যালয়ে গিয়েছিলেন কুমিল্লা-৮ আসনের সংসদ সদস্য নাসিমুল আলম চৌধুরী। এ সময় এই প্রতিবেদকও প্রতিষ্ঠানটিতে উপস্থিত ছিলেন। গ্রীন বাংলার এক কর্মকর্তার সঙ্গে সেদিন কথা বলে জানা যায়, নাসিমুল আলম গ্রীন বাংলায় আট কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। ওই দিন তাঁকে আরো সাত কোটি টাকা বিনিয়োগের জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়।
কয়েক দিন আগে যোগাযোগ করা হলে নাসিমুল আলম চৌধুরী এমপি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'নবীর কাছে আমার কিছু বিনিয়োগ ছিল। সেটা আমি কিছুদিন আগে উঠিয়ে নিয়ে এসেছি। তবে আমার এলাকার অনেকের টাকা আটকে গেছে বলে শুনেছি।' প্লেসমেন্ট শেয়ার এভাবে কেনা বৈধ কি না_এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'সেটা জানি না।' তিনি আরো বলেন, 'এখন শেয়ারবাজার ভালো, ফলে মূল মার্কেটের বাইরে গিয়ে বিনিয়োগের দরকার পড়ে না।'
ডিএসইর কয়েকজন সদস্যও গ্রীন বাংলায় বিনিয়োগ করেছেন বলে প্রতিষ্ঠানটির এক কর্মকর্তা দাবি করেন। ওই কর্মকর্তা বলেন, বনশ্রীর ওই অফিসে একাধিক এমপির যাতায়াত রয়েছে। তাঁরা সবাই প্লেসমেন্ট শেয়ার কিনেছেন।
বীকন ফার্মার প্লেসমেন্ট শেয়ার কিনে সম্প্রতি বড় ধরনের বিপাকে পড়েন সাবেক সংসদ সদস্য ও বিকল্পধারার নেতা মাহি বি চৌধুরী। তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নবী উল্যাহ সিন্ডিকেটের সদস্য আলাউদ্দীনের মাধ্যমে তিনি বীকন ফার্মার দুই কোটি ৬১ লাখ টাকার প্লেসমেন্ট শেয়ার কিনেছিলেন। গ্রীন বাংলার পক্ষ থেকে তাঁদের নামে চেক লিখে দেওয়ার প্রস্তাব করা হলেও তিনি রাজি হননি। কথা ছিল, মাহির নিজস্ব বিও অ্যাকাউন্টে টাকা জমা রাখা হবে এবং সেখানে নির্ধারিতসংখ্যক শেয়ার জমা হওয়ার পর মূল্য পরিশোধ করা হবে। সে অনুযায়ী মতিঝিলে সাদ সিকিউরিটিজের একটি শাখায় পরিচালিত বিও অ্যাকাউন্টে টাকা জমা দেওয়া হয়। কিন্তু নির্ধারিত সময় পার হলেও বিও অ্যাকাউন্টে শেয়ার জমা হয়নি। এ কারণে ব্রোকারেজ হাউস থেকে সব টাকা তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। কিন্তু সেখান থেকে জানানো হয়, বিও অ্যাকাউন্টে টাকা জমা হয়নি।
মাহি বি চৌধুরী জানান, তিনি তাঁর স্ত্রী, শ্যালক ও শাশুড়ির নামে নবী উল্যাহর কাছ থেকে বীকন ফার্মার প্লেসমেন্ট শেয়ার কেনেন। শেষ পর্যন্ত প্রশাসনের সহায়তায় তিনি ওই টাকা উদ্ধার করতে সক্ষম হন। বিষয়টি তিনি ডিএসই সভাপতি শাকিল রিজভী ও সহসভাপতি আহসানুল ইসলাম টিটুকে মৌখিকভাবে জানিয়ে রেখেছিলেন। গ্রীন বাংলার বনশ্রী অফিসে একাধিক বৈঠক এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় সম্পূর্ণ টাকা ফেরত পান মাহি।
মাহি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এটা বেআইনি, তা প্রথমে বুঝিনি। পরে যখন বুঝতে পারি, তখন টাকাটা তুলে আনার চেষ্টা করি।' তাঁর মতে, টাকার রসিদই প্রমাণ দেয়, সাদ সিকিউরিটিজ জড়িত।
এ ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে সাদ সিকিউরিটিজের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমার হাউসে মাহি বি চৌধুরীর বিও হিসাব থাকলেও সেখানে ওই টাকা জমা হয়নি। আলাউদ্দীনের মাধ্যমে গ্রীন বাংলার নবী উল্যাহ নবী ওই টাকা নিয়েছেন। ইতিমধ্যেই তা প্রমাণিত হয়েছে।' প্রতারক চক্র তাঁর হাউসের জাল রসিদ বই ছাপিয়ে নিয়েছে বলেও তিনি জানান।
গ্রীন বাংলার ব্যবস্থাপনা পরিচালক নবী উল্যাহ নবী এ প্রতিবেদককে বলেন, 'আমার এই ব্যবসা বৈধ। আইনগত কোনো বাধা নেই।' তিনি আরো বলেন, 'আমার বিরুদ্ধে এসইসি ৫৪ ধারায় একটা মামলা করেছে। আশা করি, শিগগিরই মামলাটির মীমাংসা হয়ে যাবে।' প্রতারণার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'সাত-আট বছর ধরে এ ব্যবসা করছি। কেউ বলতে পারবেন না, আমি কারো টাকা মেরে দিয়েছি।'
প্লেসমেন্ট শেয়ার নিয়ে গড়ে ওঠা আলাদা কার্ব মার্কেট প্রসঙ্গে ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জের সভাপতি শাকিল রিজভী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'একজন আইনজীবীসহ কিছুদিন আগে মাহি বি চৌধুরী ডিএসইর অফিসে আসেন। তাঁর অভিযোগের সূত্র ধরে জানতে পারি, মূল শেয়ার মার্কেটের বাইরে প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রির জন্য বনশ্রীর লেকের পাড়ে গড়ে উঠেছে আলাদা কার্ব মার্কেট। যেন শেয়ার মার্কেটের বাইরে আলাদা স্টক মার্কেট। এটা আইনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী এবং দণ্ডনীয় অপরাধ। এটা মূল শেয়ার মার্কেটের জন্য মারাত্মক হুমকি। এখনই তা বন্ধ করা উচিত।'
অবৈধ ব্রোকারেজ হাউস : ২০০০ সালের সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এঙ্চেঞ্জ কমিশন (স্টক ব্রোকার, স্টক ডিলার ও অনুমোদিত প্রতিনিধি) বিধিমালা অনুযায়ী কোনো প্রতিষ্ঠানকে এসইসির কাছ থেকে স্টক ব্রোকার বা স্টক ডিলারের নিবন্ধন সনদ পেতে হলে অবশ্যই কোনো স্টক এঙ্চেঞ্জের সদস্য হতে হবে। কিন্তু দেশের দুই স্টক এঙ্চেঞ্জের কোনোটির সদস্য না হয়েও ব্রোকারেজ হাউস প্রতিষ্ঠা করেছে গ্রীন বাংলা গ্রুপ_নাম গ্রীন বাংলা সিকিউরিটিজ। ডিএসইর আওতাধীন সাদ সিকিউরিটিজের সদস্যপদ কেনার বিষয়ে আলোচনা চলছে বলেও দাবি করেছেন গ্রীন বাংলার কর্মকর্তারা। তবে সাদ সিকিউরিটিজের চেয়ারম্যান মো. দেলোয়ার হোসেন জানিয়েছেন, এসব একেবারেই ভুয়া প্রচারণা, তবে তাঁর (দেলোয়ার) ছোট ভাইয়ের ব্রোকারেজ হাউস আরাফাত সিকিউরিটিজ কেনার বিষয়ে একবার কথা হয়েছিল।
অবৈধ প্লেসমেন্ট বাণিজ্যের বিষয়টি জানানো হলে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এম খায়রুল হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, কমিশনের অনুমোদন ছাড়া যেকোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের শেয়ার লেনদেন সম্পূর্ণ বেআইনি। আইনগত প্রক্রিয়ার বাইরে এ ধরনের কর্মকাণ্ড পুঁজিবাজারের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তিনি বলেন, 'এ ধরনের তৎপরতা অবশ্যই খতিয়ে দেখা হবে। যে বা যারাই অবৈধ পন্থায় শেয়ার লেনদেনে জড়িত থাকুক না কেন_প্রমাণ পেলে কমিশনের পক্ষ থেকে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।'
সরেজমিন প্লেসমেন্ট হাটে : পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কম্পানি দেশবন্ধু পলিমারের প্রতিটি শেয়ার গত বৃহস্পতিবার বিক্রি হয়েছে ৮১.৫০ টাকা দরে। অ্যাকটিভ ফাইন কেমিক্যালের শেয়ারের দাম ছিল ৮৮.৫০ টাকা। ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এঙ্চেঞ্জে এই দরে বিক্রি হলেও বনশ্রীর ওই স্টক মার্কেটে এ দুটি কম্পানির প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রি হয়েছে ৩৫ টাকা করে। আগামী অক্টোবরে দেশবন্ধু ও অ্যাকটিভ ফাইন কেমিক্যালের 'লক-ইন' উঠে যাবে বলে গ্রীন বাংলার পক্ষ থেকে ক্রেতাদের জানানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে, তখন যদি এসব শেয়ারের বাজারদর বর্তমান স্তরেও থাকে, তাহলেও প্লেসমেন্ট শেয়ারের ক্রেতারা লাভ পাবেন শেয়ারপ্রতি যথাক্রমে ৪৬ ও ৫৩ টাকারও বেশি।
একই কায়দায় বিক্রি হচ্ছে পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড ও রংপুর ডেইরি অ্যান্ড ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেডের প্লেসমেন্ট শেয়ার। পিপলস লিজিংয়ের ১২৫ টাকার শেয়ার ৫০ টাকায় আর শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির আগেই ২৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে রংপুর ডেইরির ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের প্রতিটি শেয়ার।
জানা যায়, এর আগে গ্রামীণফোন, আরএকে সিরামিকস, ফিনিঙ্ ফাইন্যান্স ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ড, আইএফআইসি ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ডসহ বেশ কয়েকটি কম্পানির প্লেসমেন্টে শেয়ার নিয়েও বাণিজ্য করেছে গ্রীন বাংলা গ্রুপ।
রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মসে নিবন্ধিত যেকোনো কম্পানি পুঁজি সংগ্রহের উদ্দেশ্যে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার আগে এর শেয়ারের একটা অংশ বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এঙ্চেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) পূর্বানুমতি প্রয়োজন। এ ধরনের শেয়ারই প্লেসমেন্ট শেয়ার, যা কম্পানিটি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার পরও নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত বা লক-ইন উঠে না যাওয়া পর্যন্ত বিক্রি করা যাবে না। কিন্তু ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে নেওয়া এসব প্লেসমেন্ট শেয়ারই অবাধে কেনাবেচা হচ্ছে গ্রীন বাংলা পরিচালিত 'কার্ব মার্কেটে'। এসইসি আইন ১৯৯৩ অনুযায়ী এসইসির নিবন্ধন ছাড়া স্টক ব্রোকার, সাব ব্রোকার, শেয়ার হস্তান্তরকারী প্রতিনিধিসহ পুঁজিবাজারসংশ্লিষ্ট যেকোনো কর্মকাণ্ড পরিচালনা বেআইনি। এ ছাড়া ২০০০ সালের এসইসি (স্টক ব্রোকার, স্টক ডিলার ও অনুমোদিত প্রতিনিধি) বিধিমালায়ও এসইসির নিবন্ধন সনদ ছাড়া কোনো সিকিউরিটি (শেয়ার, মিউচ্যুয়াল ফান্ড ইউনিট ইত্যাদি) ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই আইন লঙ্ঘনের দায়ে পাঁচ বছরের শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। অথচ এসইসির কোনো নিবন্ধন সনদ ছাড়াই গ্রীন বাংলা গ্রুপ চার বছর ধরে প্লেসমেন্ট শেয়ারের বাণিজ্য চালিয়ে আসছে।
রাইট শেয়ার নিয়েও আগাম বাণিজ্য : বিভিন্ন কম্পানির রাইট শেয়ার নিয়েও আগাম বাণিজ্যের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এসইসির অনুমোদনের বিষয়টি প্রাথমিক পর্যায়ে থাকলেও এরই মধ্যে পিপলস লিজিংয়ের রাইট শেয়ার বিক্রি শুরু করেছেন নবী উল্যাহ নবী ও তাঁর সহযোগীরা। গত বৃহস্পতিবার পিপলস লিজিংয়ের শেয়ার ১২৫.২০ টাকায় লেনদেন হয়েছে। গ্রীন বাংলা শেয়ারটি বিক্রি করছে ৫০ টাকায়।
২০০৫ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত এই কম্পানির প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রির বিষয়ে জানতে চাইলে গ্রীন বাংলার একজন কর্মকর্তা জানান, তাঁদের কাছে পিপলস লিজিংয়ের ৮০ লাখ শেয়ার আছে। এসইসিতে রাইট শেয়ার পাস হলে সেখান থেকে আরো ৪০ লাখ শেয়ার পাওয়া যাবে। এ কারণেই তাঁরা ছয় মাসের লক-ইন হিসাব করে পিপলস লিজিংয়ের শেয়ার বিক্রি করছেন। অথচ এই কম্পানির রাইট শেয়ার ইস্যুর আবেদন এসইসির অনুমোদন পাবে কি না, সে বিষয়টি এখন নিশ্চিত নয়।
কোনো একটি কম্পানি শেয়ারবাজারে আসার প্রক্রিয়া শুরু করা মাত্রই ওই কম্পানির শেয়ার বাগিয়ে নিতে তৎপর হয়ে ওঠেন নবী উল্যাহ নবী। কম্পানির উদ্যোক্তা, পরিচালক কিংবা কর্মকর্তাদের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে প্লেসমেন্ট শেয়ার প্রাপ্তি নিশ্চিত করেন তিনি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্লেসমেন্ট শেয়ার পাওয়া না গেলে উদ্যোক্তা শেয়ারের একাংশ কিনে নেন। এসইসির বিধি অনুযায়ী শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির পর নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত প্লেসমেন্ট ও উদ্যোক্তা শেয়ার হস্তান্তরে নিষেধাজ্ঞা (লক ইন) বলবৎ থাকে।
গ্রেপ্তার হয়েছিলেন নবী উল্যাহ : ২০১০ সালের ১৫ জুলাই গ্রীন বাংলা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নবী উল্যাহ নবী ওরফে শফিউল আলম নবী এবং তাঁর সহযোগী সাত্তারুজ্জামান শামীমকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। র‌্যাব-৩ কার্যালয়ে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে নবী উল্যাহ বিভিন্ন কম্পানির প্লেসমেন্টের শেয়ার নিয়ে বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণার কথা স্বীকার করেন। বিষয়টি নিয়ে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এঙ্চেঞ্জ কমিশন (এসইসি) একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্তের ভিত্তিতে কমিশনের পক্ষে উপপরিচালক (আইন) এ এস এম মাহমুদুল হাসান বাদী হয়ে নবী উল্যাহ নবী, সাত্তারুজ্জামান শামীম এবং গ্রীন বাংলা কমিউনিকেশনস লিমিটেডের নামে ঢাকা মহানগর মুখ্য হাকিমের আদালতে একটি মামলা করেন। ওই মামলার আরজিতে ১০টি কম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের আট কোটি টাকার প্লেসমেন্ট ব্যবসার হিসাব দেখিয়ে নবী উল্যাহ নবীর লিখিত বক্তব্য উল্লেখ করে বলা হয়, 'তার মোট ক্লায়েন্ট সংখ্যা ১০০ জন এবং ৩-৪ বছর যাবত তিনি অবৈধ শেয়ার প্লেসমেন্ট ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।'
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গ্রীন বাংলার নিয়োজিত এজেন্টদের নামে ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জ (ডিএসই) এবং চট্টগ্রাম স্টক এঙ্চেঞ্জের (সিএসই) বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউসে অনেক বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। এসব বিও অ্যাকাউন্টের পোর্টফোলিও স্টেটমেন্টকে প্লেসমেন্ট শেয়ার থাকার প্রমাণ হিসেবে হাজির করা হয় বিনিয়োগকারীদের সামনে। বিষয়টি আরো বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্রোকারেজ হাউসের কর্মকর্তাদের প্রত্যয়নপত্রও দেখানো হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিজেরাই ভুয়া পোর্টফোলিও তৈরি করে তাতে ব্রোকারেজ হাউস সংশ্লিষ্টদের স্বাক্ষর বসিয়ে দেওয়া বা একই পোর্টফোলিও স্টেটমেন্ট দেখিয়ে একই শেয়ার একাধিক ক্রেতার কাছে বিক্রির অভিযোগও রয়েছে। কখনোই আইপিও বা প্লেসমেন্টের মাধ্যমে কোনো শেয়ার ইস্যু করেনি_এমন কম্পানির শেয়ারও রয়েছে গ্রীন বাংলার পোর্টফোলিওতে।
নথিপত্রে দেখা যায়, গ্রীন বাংলা গ্রুপের নামে আইআইডিএফসি মার্চেন্ট ব্যাংকিং ইউনিটের একটি সিডিআই হিসাবের পোর্টফোলিওতে (হিসাব নম্বর ০৩১৩) ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের ৩০ লাখ এবং বাংলালিংকের ৫০ লাখ শেয়ার দেখানো হয়েছে। পোর্টফোলিওতে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গ্রীন বাংলা গ্রুপ ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের প্রতিটি শেয়ার ১০০ টাকা দরে মোট ৩০ কোটি টাকায় এবং বাংলালিংকের প্রতিটি শেয়ার ১০ টাকা দরে পাঁচ কোটি টাকায় কিনেছে। একই হিসাবে গ্রামীণফোনের ৫০ লাখ, গোল্ডেনসনের ১০ লাখ, ক্রাউন সিমেন্টের ১০ লাখ এবং আরএকে সিরামিকের ৭০ লাখ শেয়ার দেখানো হয়েছে। অথচ ইনসেপ্টা ফার্মা ও বাংলালিংক এখনো কোনো প্লেসমেন্ট শেয়ার ইস্যুই করেনি।
পোর্টফোলিওটির সত্যতা জানতে আইআইডিএফসিতে যোগাযোগ করা হলে গ্রীন বাংলা গ্রুপের প্রতারণার বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ওই পোর্টফোলিও স্টেটমেন্টে প্রত্যয়নকারী হিসেবে আইআইডিএফসির উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) রাসেল আহমেদের নাম ও স্বাক্ষর রয়েছে। কিন্তু ওই প্রতিষ্ঠানে এই নামে কোনো ডিএমডি নেই এবং কোনোকালে ছিলও না। রাসেল শাহরিয়ার নামে একজন সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট রয়েছেন। তিনি প্রতিষ্ঠানের এসএমই ফাইন্যান্স বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
রাসেল শাহরিয়ারের কাছে গ্রীন বাংলার ওই পোর্টফোলিও বিবরণী দেখানো হলে তিনি কালের কণ্ঠকে জানান, প্রদর্শিত স্বাক্ষরটি তাঁর নয়। রাসেল আহমেদ নামের কোনো কর্মকর্তা আইআইডিএফসিতে নেই। প্রকৃতপক্ষে আইআইডিএফসিতে ওই প্রতিষ্ঠানের নামে কোনো হিসাব চালু নেই। তা ছাড়া 'সিডিআই' কোডের কোনো হিসাব তাঁদের প্রতিষ্ঠানের নয়।

ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকায় ঝুঁকিতে অর্থনীতি

Monday, February 21, 2011

পুঁজিবাজারে ধস, আবাসন শিল্পে স্থবিরতা ও অনুৎপাদনশীল খাতে ঋণের উচ্চ প্রবৃদ্ধির কারণে ব্যাংক খাতের আর্থিক ভিত্তি নড়বড়ে। গুটিকয়েক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আগ্রাসী কার্যক্রম পুরো আর্থিক খাতকেই বিপর্যয়ের মুখে দাঁড় করিয়েছে। বাংলাদেশের আর্থিক খাতের বর্তমান পরিস্থিতিকে ১৯৯৭ সালের এশীয় আর্থিক সংকটের প্রারম্ভিক অবস্থার সঙ্গে তুলনা করেছেন কোনো কোনো বিশ্লেষক।
তাঁদের মতে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুঁজিবাজার, আবাসন খাত ও অনুৎপাদনশীল খাতে অতিমাত্রায় ঋণ সম্প্রসারণের কারণে এশিয়ার অনেক দেশই ওই সময় চরম সংকটে পড়েছিল। জিডিপির প্রয়োজনের তুলনায় বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বেশি : ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ ব্যাপক বেড়েছে, যা জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রয়োজনীয় ঋণ সরবরাহের তুলনায় অনেক বেশি। এ বিষয়ে খোদ মুদ্রানীতিতে বলা হয়েছে, 'অর্থবছরের প্রথমার্ধজুড়েই (২০১০ সালের জুন থেকে ডিসেম্বর) অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ব্যাপক। বিদায়ী ২০১০ সালের জুন থেকে নভেম্বর_এই পাঁচ মাসের ব্যবধানে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বেড়েছে ২৪ দশমিক ২ শতাংশ। বেসরকারি খাতের এই ঋণের প্রবাহ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের তুলনায় অনেক বেশিই ছিল।' অপরদিকে এ সময়ে ব্যাংকগুলোর আমানত সংগ্রহের প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ২১ শতাংশ এবং ঋণ বিতরণের প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ২৮ শতাংশ।
বেসরকারি খাতের এই বিপুল ঋণ প্রবৃদ্ধির জন্য
সরকারের সিদ্ধান্তকেই দায়ী করেছেন একাধিক ব্যাংক বিশ্লেষক। বেসরকারি একটি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কালের কণ্ঠকে জানান, বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধিতে সবচেয়ে সহায়ক ছিল কিছু খাতে ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ১৩ শতাংশ
নির্ধারণ করে দেওয়া। যেখানে সরকার গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ দিতে পারছে না, সেখানে শিল্প ও এসএমই খাতে ঋণের সর্বোচ্চ সুদ হার বেঁধে দেওয়ার কোনো যৌক্তিক কারণ ছিল না।
তিনি বলেন, এতে সমস্যা হয়েছে ত্রিমুখী। প্রথমত, ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার বেঁধে দেওয়ায় ব্যাংকগুলো বাধ্য হয়েছে আমানতের বিপরীতে ঋণের সুদহার কমাতে। দ্বিতীয়ত, ব্যাংকগুলো মুনাফা ধরে রাখতে কনজ্যুমার ক্রেডিটে বেশি অর্থায়ন করেছে। তৃতীয়ত, চড়া দ্রব্যমূল্যের বাজারে ৫ থেকে ৬ শতাংশ সুদহারে আমানতকারীরা নিরুৎসাহিত হয়ে অন্য লাভজনক খাতে বিনিয়োগের কথা ভাবতে বাধ্য হয়েছেন। লাভজনক খাত ছিল সঞ্চয়পত্র। সেখানেও সুদহার কমানো এবং এর আয়ের ওপর করারোপ করায় সঞ্চয়পত্র ভেঙে পুঁজিবাজারের দিকে ঝুঁকেছে অসংখ্য বিনিয়োগকারী।
সরকারি ব্যাংকের একজন প্রধান নির্বাহী কালের কণ্ঠকে বলেন, সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানো ও করারোপ সরকারের অন্যতম একটি ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। কারণ এতে বিনিয়োগকারীরা সঞ্চয়পত্র ভেঙে পুঁজিবাজারের দিকে ধাবিত হয়েছেন। যদি সঞ্চয়পত্রে সরকারের ভর্তুকি দিতেই হতো তাহলে এর পরিমাণ আর কত হতো! নিশ্চয়ই বর্তমানে পুঁজিবাজারে ধসের চেয়ে ভয়াবহ হতো না। গত সপ্তাহে অর্থমন্ত্রীর উপস্থিতিতে এক ঘরোয়া বৈঠকেও সিদ্ধান্তটির সমালোচনা করেন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী।
বিশ্লেষকদের মতে, প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ বা রেমিট্যান্স বিনিয়োগের কোনো দিকনির্দেশনা না থাকায় প্রান্তিক মানুষ তা ব্যয় করেছে জমি কেনাসহ নানা অনুৎপাদনশীল খাতে, যা মূল্যস্ফীতিকে ত্বরান্বিত করেছে। মূল্যস্ফীতির প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি এবং তা প্রবৃদ্ধিকে গিলে ফেলে। সুতরাং সরকারের উচিত ছিল, ব্যাংক আমানত ও সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানোর পরিবর্তে কিছুটা বাড়িয়ে দেওয়া। তাতে রেমিট্যান্সের বিপুল পরিমাণ অর্থ হয়তো ব্যাংক খাতেই থেকে যেত। পরবর্তী সময়ে কোনো উৎপাদনশীল খাতে তা বিনিয়োগ করা যেত বলে মনে করেন ব্যাংকের একজন প্রধান নির্বাহী।
পুঁজিবাজারে ধসের কারণে ঝুঁকিতে ব্যাংকিং খাত : বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ বর্তমানে প্রায় ১২ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা। এ ছাড়াও ২০১০ সালে ব্যাংকগুলো নতুন করে ঋণ বিতরণ করেছে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে অর্থায়নে ৩৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি, শিল্পায়নে প্রায় ২৮, এসএমই ও কৃষিতে প্রায় ১০ শতাংশ ঋণের প্রবৃদ্ধি বিবেচনায় এ খাতগুলোতে মোট নতুন ঋণের প্রায় ৬০ শতাংশ গেছে। বাকি প্রায় ৪০ শতাংশ (প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা) গেছে সরাসরি উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত নয় এমন খাতগুলোতে। এ ছাড়াও ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে ভোক্তাপণ্য কেনার জন্য দেওয়া ঋণের পরিমাণ সাড়ে ১২০০ কোটি টাকা। অর্থনীতিবিদদের ভাষায় যেসব খাত অনুৎপাদনশীল তার মধ্যে গত বছর পুঁজিবাজার ছিল শীর্ষে। অনুৎপাদনশীল খাতের ঋণের সিংহভাগই পুঁজিবাজারে গেছে বলে ধারণা করছেন তাঁরা। এরই মধ্যে কিছু ব্যাংকের আর্থিক সংকট বেশ প্রকট হয়ে উঠেছে। এ ব্যাংকগুলো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ব্যাপকভাবে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেছে। কেউ কেউ আন্তঃব্যাংক কলমানি মার্কেট থেকে টাকা ধার করেও তাদের মার্চেন্ট ব্যাংক শাখায় দিয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রমাণ পেয়েছে। পুঁজিবাজারে ধসের কারণে এসব ব্যাংকের বড় অঙ্কের বিনিয়োগ আটকে পড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নির্দিষ্ট সময়ে বিনিয়োগ উঠে না আসায় ব্যাংকগুলোর দায়-সম্পদ ব্যবস্থাপনায় অসঙ্গতি দেখা দিয়েছে। ফলে বর্তমানে কলমানি থেকে প্রতিদিন এসব ব্যাংক বেশ বড় অঙ্কের টাকা ধার করে চলেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'পুঁজিবাজারে ধস অব্যাহত থাকলে কয়েকটি ব্যাংকের বড় অঙ্কের খেলাপি ঋণ সৃষ্টি হতে পারে, যা সমগ্র ব্যাংকিং খাতের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি সৃষ্টি করবে। তাই আমরা ব্যাংকগুলোকে ঋণ আমানত অনুপাত কমিয়ে আনার নির্দেশ দিয়েছি।'
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক এস কে সুর চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা ব্যাংকগুলোকে সুরক্ষিত রাখতে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এখন ব্যাংকগুলোর পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ মোটামুটি গ্রহণযোগ্য মাত্রায় চলে এসেছে।'
অপরদিকে তুলনামূলক অরক্ষিত খাত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বেশ কয়েকটির মুনাফার অধিকাংশই আসে পুঁজিবাজার থেকে। এদের অনেকেরই পুঁজিবাজারে বড় ধরনের মূলধন আটকে গেছে। বাজারে মন্দাবস্থা এবং ক্রেতা না থাকার কারণে এসব প্রতিষ্ঠান ট্রিগার সেলেও যেতে পারছে না। এ ছাড়া এ বিষয়ে এসইসির কঠোর নির্দেশনা রয়েছে।
বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল কম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের চেয়াম্যান ও লঙ্কা বাংলা ফিন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মফিজউদ্দিন সরকার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বর্তমানে ছয়টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মার্চেন্ট ব্যাংকিং উইং রয়েছে। এদের পুঁজিবাজারে শেয়ার ক্রয়ের বিপরীতে দেওয়া ঋণের পরিমাণ প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। ২৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব বিনিয়োগ রয়েছে প্রায় সাড়ে ৭০০ কোটি টাকা। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পুঁজিবাজারে আনুমানিক বিনিয়োগ প্রায় তিন হাজার ৩০০ কোটি টাকার মতো। পুঁজিবাজারে ধসের কারণে গ্রাহকদের দেওয়া এই বিপুল পরিমাণ ঋণের একটি বড় অংশ আগামী প্রান্তিকে খেলাপি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে মার্কেটের এ অবস্থায় আমরা ট্রিগার সেলে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।'
সার্বিক পরিস্থিতিতে পুঁজিবাজারে ধসের কারণে ব্যাংকিং খাতের প্রায় বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আগামী দুই প্রান্তিক অর্থাৎ মার্চ ও জুন প্রান্তিকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক বিবরণীতে এর প্রতিফলন ঘটতে পারে।
আবাসন শিল্পে মন্দাবস্থা ও বিপুল অর্থ খেলাপি হওয়ার আশঙ্কা : গত কয়েক বছর ধরে জমির মূল্য বেড়েছে লাগামহীনভাবে। এজন্য ব্যাংকগুলোর সহজ শর্তে অর্থায়নই ছিল দায়ী। সহজে অর্থ পাওয়ার সুবাদে রাজধানীসহ সারা দেশে হাউজিং ব্যবসার প্রসার বেড়েছে। জমির দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। এ অবস্থায় তৈরি হয়েছে বিপুল উদ্যোক্তা। বিনিয়োগও হয়েছে প্রচুর। ফলে ব্যাংকের অর্থায়নও রয়েছে অনেক।
রিয়্যাল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব)_এর তথ্য অনুযায়ী, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগের অভাবে আবাসন শিল্পমালিকদের প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা এবং ফ্ল্যাট ক্রেতাদের প্রায় ১২০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ আটকে পড়েছে। রিহ্যাবের সদস্য নয় এমন উদ্যোক্তা ও ক্রেতাদের সমপরিমাণ অর্থ বিবেচনা করলে প্রায় আট হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আটকে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অনেক ডেভেলপার চরম আর্থিক সংকটে নিমজ্জিত হয়েছেন। প্রকল্প সম্পূর্ণ করতে পারছেন না অনেকে। আবার অনেকে সম্পূর্ণ করেও প্রকল্প হস্তান্তর করতে পারছেন না গ্যাস-বিদ্যুৎ না থাকার কারণে। এই অবস্থা চলতে থাকলে অনেক ডেভেলপারই দেউলিয়া হয়ে যাবেন বলে রিহ্যাব সূত্র আশঙ্কা প্রকাশ করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এশীয় মন্দার সময়ে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুঁজিবাজার এবং আবাসন খাতে অনেক বেশি বিনিয়োগ করেছিল। তবে আমরা এখনো সে পর্যায়ে যাইনি। কিছু ব্যাংক ১০ শতাংশের বেশি বিনিয়োগ করেছে। তারা অন্যান্য খাত থেকে ডিভিডেন্ট দিচ্ছে। পুঁজিবাজারে খেলাপি হলে তারা সেখান থেকে প্রভিশন করবে।'
তিনি আরো বলেন, 'বাংলাদেশের আর্থিক খাত মন্দাকবলিত হতে পারে বলে এখনো আমি মনে করি না। পুঁজিবাজারে ধস নেমেছে এটাও বলা ঠিক হবে না। কারণ এটাকে আবার কার্যকর করার প্রচেষ্টা চলছে।'
তবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে নজর বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন ড. সালেহউদ্দিন। তিনি বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগ করে থাকে। তারা পুঁজিবাজারে স্বল্প মেয়াদি বিনিয়োগের দিকে যেন অতিমাত্রায় ধাবিত না হয় সেদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নজর দেওয়া উচিত। এ ছাড়াও এ প্রতিষ্ঠানগুলোর মূলধন পর্যাপ্ততা বাড়ানো জরুরি বলে মনে করেন তিনি। তবে মন্দাবস্থা যাতে সৃষ্টি না হয় সেজন্য সরকারকে সতর্ক থাকতে পরামর্শ দিয়েছেন বিশিষ্ট এ অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, সরকারকে ম্যাক্রো-ইকোনমির দিকে আরো বেশি নজর দিতে হবে। জ্বালানিসহ অর্থনৈতিক বিষয়গুলোর প্রতি জোর দিতে হবে। উৎপাদনশীল খাতে ঋণের প্রবাহ নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
এশিয়ান মন্দার কারণ পর্যবেক্ষণ করে একটি প্রতিবেদন লেখেন ওয়েস্টার্ন সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ইউএন-ডেসার সিনিয়র ইকোনমিক অ্যাফেয়ার্স অফিসার ড. আনিছ চৌধুরী। তাঁর পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ১৯৯০-এর দিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বেড়ে যায়, যা তাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশিই ছিল। থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার ব্যাংকগুলো আবাসন খাতেও প্রচুর বিনিয়োগ করে। এক পর্যায়ে ব্যাংকের মুনাফা কমতে শুরু করে এবং কিছু কিছু ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে পড়ে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুঁজিবাজারেও অধিক হারে বিনিয়োগ করে। ফলে পুঁজিবাজারে অতিমূল্যায়নের ঘটনা ঘটে। একসময় পুঁজিবাজারে ধস নামে এবং ব্যাংকগুলো বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়ে। বাংলাদেশের আর্থিক খাতেও এসব লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে বলে মন্তব্য করেন এ বিশ্লেষক। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দীন আহমেদের কণ্ঠেও উদ্বেগের সুর। আর্থিক খাত ও পুঁজিবাজারে সাম্প্রতিক বাব্ল বা বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতিকে অর্থনৈতিক সংকটের পূর্বাভাস হিসেবে দেখছেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ মুদ্রানীতির পর্যালোচনায় ড. আনিছ চৌধুরী লিখেছেন, অতিমূল্যায়িত পুঁজিবাজারে ধস সবার জন্যই বেদনাদায়ক। প্রাইস কারেকশন আরো বিলম্বিত হওয়ার কারণে যে ধস নামবে তা আরো বেদনাদায়ক হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত, পুুঁজিবাজারের মতো অনুৎপাদনশীল খাতের ঋণ সম্প্রসারণ বন্ধ করা। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ বাজারের স্থায়িত্ব ও উচ্চ প্রবৃদ্ধির জন্য পুঁজিবাজার ও রিয়েল এস্টেট সেক্টর সঠিকভাবে মূল্যায়িত হওয়া উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সভাপতি কে মাহমুদ সাত্তার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আর্থিক খাতে মন্দা হতে পারে দুটি কারণে। এগুলো হচ্ছে_জ্বালানি সংকট এবং জমির অতিমূল্য। জমির দাম সাংঘাতিক বেড়েছে, এখানে কারেকশন হতে পারে।'
বাংলাদেশ ব্যাংক গত মে মাসে রিয়েল এস্টেটে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। এ অবস্থায় এ খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি আর বাড়বে না। এখন গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ হওয়ার ফলে চলতি ঋণগুলো খেলাপি হতে পারে। তবে বড় ধরনের করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেওয়া ঋণখেলাপি হওয়ার আশঙ্কা নেই। কারণ তাদের অন্যান্য খাতের লভ্যাংশ থেকে এ ঋণ ফেরত আসবে। সমস্যা হবে ছোট উদ্যোক্তাদের নিয়ে।
মন্দা ঠেকাতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি বাড়ানোর পক্ষে মত দেন মাহমুদ সাত্তার। অর্থনৈতিক গতি বাড়াতে সরকার বিদ্যুতের জোগান বাড়াতে সক্ষম হলেও গ্যাসের জোগান বাড়ানো নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে ব্যাংক পরিচালকদের বৈঠক

Friday, February 11, 2011

র্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোকে নিজস্ব মূলধন বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন। অন্যদিকে প্রথম আলোতে প্রকাশিত সংবাদ নিয়ে বিষোদ্গার করেছেন কোনো কোনো রাজনৈতিক ব্যাংক পরিচালক। অবশ্য আরও কয়েকজন পরিচালক বলেছেন, ব্যাংকের আর্থিক সূচক যদি খারাপ থাকে, উদ্বেগজনক হয়, সেদিকেই নজর দেওয়া উচিত।

রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় গতকাল শুক্রবার বিকেলে রাষ্ট্র মালিকানাধীন জনতা, রূপালী ও বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের সঙ্গে বৈঠককালে এসব পরামর্শ ও আলোচনা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়।
তিন ঘণ্টার বেশি সময় ধরে এ বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান, অর্থসচিব মুহাম্মদ তারেক, ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শফিকুল ইসলাম পাটোয়ারীসহ তিন ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের চেয়ারম্যান, পরিচালক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকেরা উপস্থিত ছিলেন।
সূত্র জানায়, অর্থমন্ত্রী বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণে আরও বেশি যত্নবান হওয়ার নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে তিনি ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের সদস্যদের সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ব্যাংক পরিচালনাকে গতিশীল করতে বলেন।
সূত্র জানায়, বৈঠকের শুরুতে জনতা ব্যাংকে নিয়োজিত একজন রাজনৈতিক পরিচালক প্রথম আলোর বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেন। তিনি বলেন, এসব ষড়যন্ত্র। প্রধানমন্ত্রীও এই পত্রিকার বিরুদ্ধে সংসদে বক্তব্য দিয়েছেন। বৈঠক ডাকা হলেই পত্রিকাটি এমন সব প্রতিবেদন ছাপে। তিনি বলেন, ‘আমি ব্যাংকের গাড়ি ব্যবহার করি না। অথচ বলা হচ্ছে গাড়ি ব্যবহার করি।’
এই পরিচালককে সমর্থন করেন আরও কয়েকজন রাজনৈতিক পরিচালক। তাঁরা সংবাদপত্রের সমালোচনা করেন। কিন্তু এ পর্যায়ে একজন পরিচালক বলেন, পত্রিকায় তথ্য কীভাবে গেল, সেটা খুঁজে দেখার চেয়ে আগে দেখা দরকার, তথ্য-উপাত্ত সঠিক কি না। যদি তথ্য-উপাত্ত, ব্যাংকের আর্থিক সূচকগুলো সঠিক হয়, যদি ব্যাংক থেকে অর্থ নিয়ে গিয়ে শেয়ারবাজারে খাটানো হয়, তবে তা লুকানো যাবে না। বর্তমান পরিচালকেরা যখন দায়িত্ব ছেড়ে দেবেন তখন কিন্তু সব তথ্য-উপাত্ত বেরিয়ে যাবে। ব্যাংকের অবস্থাও খারাপ হয়ে যাবে। ফলে এখন ব্যাংক যদি সঠিকভাবে না চলে, তাহলে ব্যাংকগুলোকে সঠিক পথে আনতে হবে।
এ বক্তব্যের পর বৈঠকের পরিবেশ বদলে যায়। অর্থমন্ত্রীসহ আরও কয়েকজন ব্যাংকের আর্থিক শৃঙ্খলা রক্ষা ও ভালোভাবে ব্যাংক চালানোর আহ্বান জানান। তাঁরা বলেন, ব্যাংকের আর্থিক সূচক ভালো থাকলে এসব প্রচারণা হবে না।
অর্থমন্ত্রী এ পর্যায়ে বলেন, রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকের অনেক সামাজিক কাজ করতে হয়। যে কারণে কিছু তদবির আসে। এগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া সব আমলেই ছিল। তবে বর্তমান আমলে ব্যাংকের অনেক উন্নতিও হয়েছে।
বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, বেসিক ব্যাংকের কর্মকাণ্ড নিয়ে একটি প্রচারমাধ্যমে নেতিবাচক সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে। সংবাদটি অত্যন্ত অপরিপক্ব ও অজ্ঞতাপ্রসূত। এর আগেও এ ধরনের সংবাদ পরিবেশন করা হয়েছে, যার কোনো ভিত্তি নেই।
এর আগে গত ২৭ জানুয়ারি অর্থমন্ত্রী সোনালী ও অগ্রণী ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের সঙ্গে বৈঠক করেন।

সংযমী হতে হবে

Thursday, February 10, 2011

শেয়ারবাজারে হঠাৎ করেই বড় ধরনের ধস নামে। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে তৈরি হয় আতঙ্ক। কিন্তু এ পরিস্থিতি সাধারণ বিনিয়োগকারীর জন্য দীর্ঘস্থায়ী কোনো সমস্যা নয়। পরদিন অর্থাৎ সোমবারই দেখা গেছে, সূচক আবারও কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
এখানে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের নেওয়া রবিবারের কিছু সিদ্ধান্ত সহায়ক হয়েছে_এটা মনে করা যায়। এর পরও বিনিয়োগকারীরা আশ্বস্ত হয়েছেন_এমনটা বলার কোনো কারণ নেই। কিন্তু সত্যি হচ্ছে, বিনিয়োগকারীদের বিকল্প ব্যবস্থা সামনে না থাকার কারণে তাঁদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা বেড়ে গেছে। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে এসইসি এবং ডিএসইর সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের বিষয়টিও। বিনিয়োগকারীরা স্পষ্টত দায়ী করেছে নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ঘন ঘন সিদ্ধান্ত পরিবর্তনকে। এর ফলে চক্রবিশেষ অতিরিক্ত টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে সাধারণ বিনিয়োগকারীর পকেট থেকে।
এর পরও অধৈর্য হয়ে কেউ যেন শেয়ার বিক্রি না করেন_এমন পরামর্শ দিয়েছেন কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ। এ মুহূর্তে রাজপথে বিক্ষোভকারী বিনিয়োগকারীদের ধৈর্য ধারণ করতে হবে। সরকারের নৈতিক সমর্থনও বাজারের অস্বাভাবিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় কিছুটা সহযোগিতা করতে পারে। সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এঙ্চেঞ্জ কমিশনের প্রতিটি পদক্ষেপ বিনিয়োগকারীদের শান্ত কিংবা অশান্ত করে তোলার জন্য যথেষ্ট। সেই বিবেচনা মাথায় রেখেই সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এঙ্চেঞ্জ কমিশনকে অধিকতর সতর্কতার সঙ্গে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে হবে।
শেয়ারবাজারে দরপতন কিংবা দাম বাড়ার ঘটনা নতুন কিছু নয়। তবে এ প্রবণতা যদি ক্রমহ্রাসমান কিংবা ক্রমবর্ধমান হয়, তাহলেই বিনিয়োগকারীদের মধ্যে হতাশা কিংবা আতঙ্ক তৈরি হতে পারে এবং এর পরিণতিতে অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো ঘটনারও জন্ম হতে পারে। বর্তমানে বাজারে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, এর অন্যতম কারণ এটি।
যদিও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে কিছু দিন আগেও এ বিষয়ে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এর পরও নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসি সম্পর্কে বাজারে নানা প্রশ্ন কিন্তু থেকেই গেছে। তাঁদের দক্ষতা, এমনকি সততা নিয়েও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে, যা প্রায়ই তাঁরা ব্যক্ত করে থাকেন। কিন্তু সরকার এসব জানার পরও এসইসির কর্মকাণ্ড সম্পর্কে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। একই কারণে বিনিয়োগকারীরা নিরাপত্তাহীনতার জন্য সরকারকেও দায়ী করছেন। যদিও বাজারের ওপর সরকারের হাত খুবই সীমিত। শেয়ারবাজারের স্বাভাবিক রীতি অনুযায়ী ঝুঁকি কিংবা লাভ-লোকসানের হিসাবটা বিনিয়োগকারীকেই নিতে হয়। সেখানে সরকারের সার্বক্ষণিক খবরদারির বিষয়টি কাঙ্ক্ষিতও নয়।
এই দরপতনের প্রক্রিয়ায় ষড়যন্ত্রকারীদের হাত রয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। বিনিয়োগকারীদের পক্ষ থেকে অদৃশ্য সিন্ডিকেটের কথাও কেউ কেউ বলছেন। সরকার স্বপ্রণোদিত হয়েও সেদিকে নজর দিতে পারে। কারণ, হালে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নির্ভর করে এমন প্রতিষ্ঠানগুলোতে নাশকতা চালানোর কথাও ব্যাপকভাবে শোনা যাচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, শেয়ারবাজারেও এমন কোনো ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠীর অস্তিত্ব আছে কি না তা-ও দেখার দায়িত্ব সরকারের। আর বিনিয়োগকারীদের মনে রাখতে হবে শেয়ারবাজার শুধু লাভেরই বাজার নয়, এখানে লোকসানও একটি স্বাভাবিক বিষয়। ব্যবসায়িক মানসিকতা পোষণ করলেই এই ক্ষোভ প্রশমিত হবে।

শেয়ার বাজারের লুটপাট কাহিনী by আবুল খায়ের

Monday, February 7, 2011

শেয়ার বাজার দরপতনের নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার নেপথ্যে নায়করা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রয়ে যাচ্ছে। তাদের স্পর্শ করার ক্ষমতা কারো নেই। নির্মম, নির্দয়ভাবে প্রায় ৪০ লাখ বিনিয়োগকারীদের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছেন তারা।

৪০ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী ও তার পরিবারসহ প্রায় ২ কোটি মানুষ নিদারুণ আর্থিক কষ্টের শিকার। এই নির্দয় লুণ্ঠনকারীদের আলস্নাহ বিচার করবেন। গতকাল রবিবার নবমবারের মত শেয়ার বাজারে দরপতনে নিঃস্ব হওয়া ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের বেশ কয়েকজন কান্নাজড়িত কণ্ঠে এই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। অপরদিকে বিভিন্ন সংস্থা শেয়ার বাজারে দরপতনের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎকারীদের সনাক্ত এবং কিভাবে আত্মসাৎ করেছে তার বিস্তারিত তথ্য উলেস্নখ করে ইতিমধ্যে সরকারের শীর্ষ প্রশাসন ও কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন দাখিল করেছে। তারপরও শেয়ার বাজারে দরপতনের নামে কোটি কোটি টাকা লুটপাট বন্ধ হয়নি। সর্বশেষ গতকাল শেয়ার বাজারে দরপতন হয়েছে। পাশাপাশি বিক্ষোভ ও ভাংচুরের ঘটনা ঘটে। একটি নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় শেয়ার বাজারে কোটি কোটি টাকা লুণ্ঠনকারী কিছুসংখ্যক অর্থলোভীকে নিয়ন্ত্রণ করা কিংবা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাচ্ছে না। এই নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা ও সমালোচনা চলছে। তাদের এত ক্ষমতার উৎস কি? অনুসন্ধান ও বিভিন্ন সংস্থা এবং বিনিয়োগকারীসহ ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, শেয়ার বাজারে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎকারীরা ক্ষমতাধর দুইটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সঙ্গে সরাসরি জড়িত এবং কেউ কেউ দলীয় নেতা। রাজনীতি নিয়ে উভয়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে রাজপথে ও জনগণের সামনে কথা বলছে। দৃশ্যপট এমন যে, উভয়ের মধ্যে দা-কুমড়া সম্পর্ক। আসলে তা নয়, একশ্রেণীর নেতা উভয় দলের মধ্যে কোটি কোটি টাকা ভাগাভাগিতে একে অপরের জানিদোস্ত। কি মজার ব্যাপার শেয়ার বাজারের কোটি কোটি টাকা কেলেংকারির জন্য উভয় দল থেকে একে অপরকে দায়ী করে এবং সরকারের চরম ব্যর্থতার কথা উলেস্নখ করা হয়।

অনুসন্ধানে জানা যায়, চারদলীয় জোট সরকারের আমলের এক ক্ষমতাধর মন্ত্রীর পুত্র, অসীম ক্ষমতাধর দুই এমপি ও তিন ব্যবসায়ী এবং বর্তমান আওয়ামী লীগসহ মহাজোট সরকারের দুই এমপি, দুই ক্ষমতাবান শিল্পপতি ব্যবসায়ীসহ উভয় দলের ১১ জন প্রত্যক্ষভাবে শেয়ার কেলেংকারিতে জড়িত। এছাড়া তাদের সঙ্গে আরো কয়েকজন জড়িত বলে জানা গেছে। গত ৮ ডিসেম্বর থেকে গতকাল পর্যন্ত নবম দফা শেয়ার বাজারের দরপতন ঘটিয়ে কোটি কোটি টাকা তারা হাতিয়ে নিয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, শেয়ার বাজার থেকে ৪৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়। একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা শেয়ার বাজারে বার বার দরপতন ঘটিয়ে কোটি কোটি টাকার কেলেংকারি ঘটনার দীর্ঘ তদন্ত করেছে। তদন্ত করে উভয় দলের ১১ জন রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী শেয়ার বাজার কেলেংকারির সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে। বিষয়টি সরকারের শীর্ষ প্রশাসনকে অভিহিত করেছে।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, শেয়ার বাজারে কোটি কোটি টাকা লুটপাটে সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের কতিপয় কর্তা জড়িত। বাংলাদেশ ব্যাংক শেয়ার বাজার নিয়ন্ত্রণে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। বিধি অনুযায়ী বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ তাদের মূলধনের ১০% এর বেশি শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করতে পারে না। কিন্তু অধিকাংশ বাণিজ্যিক ব্যাংক নীতিমালা লংঘন করে তাদের মূলধনের অধিকাংশই শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করার ফলে শেয়ারের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক এ নীতিমালা অনুসরণের জন্য আদেশ দেয়ায় এবং তদারকি করায় ব্যাংকসমূহ তাদের বিনিয়োগ প্রত্যাহার করায় শেয়ার বাজারে দরপতনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশ ব্যাংক ১০ ডিসেম্বর বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের অতিরিক্ত বিনিয়োগের দুই হাজার কোটি টাকা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এতে শেয়ার বাজারে দরপতন ঘটে যায় বলে সংস্থার তদন্তে উলেস্নখ করা হয়।

১৯৯৬ সালে উক্ত জড়িত ব্যবসায়ী ও নেতারা কৌশলে শেয়ার বাজারে বড় ধরনের পতন ঘটিয়ে কোটি কোটি টাকা লুটপাট করে নিয়ে যায়। সেই উভয় দলের নেতারা এবার শেয়ার বাজারে একই কেলেংকারি ঘটিয়েছেন। এছাড়া ১৯৯৬ সালে সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন শেয়ার বাজারে দরপতনের সঙ্গে ১৫টি কোম্পানি জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়ে মামলা দায়ের করে। সেই মামলা এখন হিমাগারে। এসব লুণ্ঠনকারী কোম্পানি শেয়ার বাজারে এখন তৎপর রয়েছে বলেও তদন্ত প্রতিবেদনে উলেস্নখ করা হয়।

শেয়ারবাজার ধসের সংকেত দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক

Saturday, January 29, 2011

দেশের শেয়ারবাজারে বড় বিপর্যয়ের সংকেত দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রায় এক বছর আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের কাছে তাদের একটি প্রতিবেদন তুলে ধরে পরিষ্কার করে যে, বাজার কতটা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

স্পর্শকাতর বিষয় হওয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্ট এসইসি, ডিএসই ও গবেষকদের কয়েকজনকে ডেকে এনে একটি নির্বাহী সেমিনারে গবেষণা সমীক্ষাপত্রের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে। এ সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বাজার বিপর্যয় পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশের বাজার বিশ্লেষণ করা হয়। এর পরপরই ব্যাংক খাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি, মুদ্রানীতি ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আসে।
গবেষণায় বিশ্বের উন্নত কয়েকটি দেশের শেয়ারবাজার, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর বাজার এবং বাংলাদেশে ’৯৬ সালে বাজার বিপর্যয়ের সঙ্গে ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তথ্য-উপাত্ত ও পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়। সেখানে দেখানো হয়, পুঁজিবাজার থেকে বিনিয়োগকারীর লভ্যাংশ আয় ও মূল্য পরিস্থিতির মধ্যে যে ব্যবধান তা কতটা বেড়েছে এবং ব্যবধানের কোন পর্যায়ে বিভিন্ন দেশে ও বাংলাদেশে ’৯৬ সালে বাজার পতন হয়েছে।
সেমিনারে এসইসি ও ডিএসইর দিক থেকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, কেন্দ্রীয় ব্যাংক কি বলতে চাইছে যে, দেশের শেয়ারবাজার বিপর্যয়ের পর্যায়ে (বাবলস) উপনীত হয়েছে। জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর (ডিজি) জিয়াউল হাসান সিদ্দিকী বলেন, ‘আমরা বাবলস আছে কি না সেটা বলছি না, এটা বলবেন বাজার-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। আমরা শুধু বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শেয়ারবাজার যে পর্যায়ে বাবলস তৈরি হয়েছে, তার সঙ্গে ডিএসইর পরিস্থিতি লেখচিত্রে উপস্থাপন করেছি।’
গবেষকদের কাছে প্রশ্ন তোলা হয়, ’৯৬ আর আজকের বাজার তো এক নয়। জবাবে গবেষকদের তত্ত্বাবধায়ক আহসান হাবীব মনসুর বলেন, ‘বাজারের কতগুলো মৌলিক দিক (মার্কেট ফান্ডামেন্টাল) বিশ্বের সব দেশে এবং সব সময়ের জন্য একই।’
গবেষণা অনুযায়ী, প্রদর্শিত সব কটি দেশ ও ’৯৬ সালে বাংলাদেশে বাজার ধসের পরিস্থিতির তুলনায় ২০০৯ সালের নভেম্বরে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) মূল্য পরিস্থিতি অনেক বেশি তীক্ষভাবে বাড়তে শুরু করে এবং এ সময় শেয়ারের বিপরীতে লভ্যাংশ আয় ও মূল্য আয় অনুপাত (পিই) এবং মূল্যসূচকের ব্যবধান ছিল সর্বোচ্চ পর্যায়ে।
সূত্র জানায়, ২০১০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি গভর্নর আতিউর রহমানের সভাপতিত্বে সেমিনারে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি), ডিএসই, সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি অংশ নেয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব নাসিরউদ্দিন আহমেদ, এসইসির তৎকালীন সদস্য মনসুর আলম, নির্বাহী পরিচালক ফরহাদ আহমেদ, পরিচালক হাসান মাহমুদ, ডিএসইর তৎকালীন সহসভাপতি ও বর্তমান সভাপতি শাকিল রিজভী, নির্বাহী আফজালুর রহমান, সিপিডির তারিকুল ইসলাম ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণাসহ নীতিনির্ধারণী কয়েকটি বিভাগের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
আইএমএফের সাবেক অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান হাবীব মনসুরের তত্ত্বাবধানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গবেষণা বিভাগের যুগ্ম পরিচালক আবদুল ওয়াহাব ও সহকারী পরিচালক ওমর ফারুক এই গবেষণা সমীক্ষাটি তৈরি করেন।
এ বিষয়ে গত বৃহস্পতিবার জিয়াউল হাসান সিদ্দিকী বলেন, ‘আমি শুধু বলব গবেষণাপত্রে পরিষ্কার একটা দিকনির্দেশনা ছিল। আর বাংলাদেশ ব্যাংক সেই বার্তাটি এসইসি ও ডিএসইর কাছে পৌঁছে দিয়েছে।’ কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই গবেষণার দিকনির্দেশনাটি পরবর্তী সময়ে অনুসরণ করেছে কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপগুলো দেখলেই তার মধ্যে পরিষ্কার জবাব পাওয়া যাবে।’
এ বিষয়ে এসইসি চেয়ারম্যান জিয়াউল হক খোন্দকারের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের এই গবেষণা ধরে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপও নিয়েছি।’ তবে তিনি বলেন, এর আগ থেকেই বাজার সামাল দিতে কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়। জানুয়ারি মাসে এসে এসইসি বিনিয়োগকারীদের সচেতন বা সতর্ক করতে সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপনও ছাপে বলে জানান চেয়ারম্যান।
গবেষণার কিছু দিক: গবেষণায় দেখানো হয়েছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাজার বিপর্যয়ের আগে একটা বড় উত্থান হয়। যেমনটি হয়েছে ’৯৬ সালে বাংলাদেশের বাজারে। একই পরিস্থিতি পাওয়া যায় জাপানের নিক্কি, চীনের সাংহাই, আমেরিকার ন্যাসডাক, ভারতের বোম্বে-সেনসেক্স, হংকংয়ের হ্যাংসেং, শ্রীলঙ্কার কলম্বো ও সৌদি আরবের তাসি মূল্যসূচকে। বাংলাদেশে ডিএসইর ২০১০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সূচক উত্থানকে গবেষণায় বিবেচনা করা হয়। তার আগের দুই বছরের সূচক পর্যালোচনাও ছিল এতে।
২০১০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ডিএসইর সাধারণ মূল্যসূচক ছিল ৫৭৪৫ দশমিক ৭৮, ডিএসআই সূচক ছিল ৪৭০০ দশমিক ৮৭ আর ডিএসই-২০ সূচক ছিল ৩১৩৪ দশমিক ৩৫। এ সময় বাজারের মূল্য আয় অনুপাত ছিল ৩০ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। অন্যদিকে লভ্যাংশ আয় ছিল ১ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাজার ধসে পড়ার সময় লভ্যাংশ আয় ও বাজারের মূল্যস্তরের মধ্যে বড় ধরনের ব্যবধান তৈরি হওয়ার উপাত্ত মেলে। এসব দেশের তুলনায় বাংলাদেশের উত্থানের হার বেশি থাকায় বড় ঝুঁকির সংকেত পায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
২০০৯ সালের আগস্ট থেকে একটা বড় ধরনের উত্থান ছিল বাজারে। এ সময় বাজারের উত্থান সামলে নেওয়া হয় গ্রামীণফোনের বড় একটা আইপিও দিয়ে। ওই সময় বাজার থেকে বড় অঙ্কের অর্থ বের হয়ে পড়ে। আবার নতুন শেয়ার যুক্ত হলে সামলে ওঠে বাজার। কিন্তু ডিএসই ভুলভাবে সূচক হিসাব করায় প্রকৃত বাজারের চিত্র এতে প্রকাশ পায়নি।
গ্রামীণফোনের শেয়ার লেনদেন শুরু হওয়ার পর বাজারে আবারও একটা দ্রুত বৃদ্ধি দেখা যায়। গবেষণায় দেখানো হয়, এমনকি ডিএসই সঠিকভাবে সূচক হিসাব করলেও উত্থান ছিল দ্রুত ও তীক্ষ। এই বৃদ্ধি অব্যাহত থাকে ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত। এ সময় বাজারের মৌলশক্তি ক্রমশই দুর্বল হয়ে পড়ে এবং লভ্যাংশ আয়ের সঙ্গে মূল্য পরিস্থিতির মধ্যে বড় ধরনের ব্যবধান তৈরি হয়।
বিভিন্ন দেশে বাজার বিপর্যয়ের সময় সেখানে বাজার পিইর সঙ্গে লভ্যাংশ আয়ের তুলনা করা হয় গবেষণায়। এতে দেখা যায়, ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ডিএসইর পিই সর্বাধিক ৩০ দশমিক ৬-তে ওঠে। তখন লভ্যাংশ আয়ের হার হয় ১ দশমিক ৬ শতাংশ। অন্যদিকে বাজার বিপর্যয়ের সময় বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জের পিই ছিল ২০ দশমিক ৩ (জানুযারি ’০৮) ও লভ্যাংশ আয়ের হার ছিল ১ দশমিক ৩ শতাংশ। শ্রীলঙ্কায় (সেপ্টেম্বর ’০৭) পিই ছিল ১৪ দশমিক ৪৪ ও লভ্যাংশ আয়ের হার ছিল ২ দশমিক ২ শতাংশ। জাপানে বাজার (ডিসেম্বর ’৮৯) বিপর্যয়ের সময় পিই ছিল ৩৯ দশমিক ৮ ও লভ্যাংশ আয়ের হার ছিল শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ। চীনে (অক্টোবর ’০৭) পিই ছিল ১৮ দশমিক ৩ ও লভ্যাংশ আয় ছিল ২ দশমিক ৭ শতাংশ, সৌদি আরবের (ফেব্রুয়ারি ’০৬) পিই ৪৭ দশমিক ৩ ও আয় ছিল ১ দশমিক ৪ শতাংশ এবং ইউএসএর ন্যাসডাক (মার্চ ২০০০) স্টক এক্সচেঞ্জের পিই ছিল ৩৫ দশমিক ৪ ও লভ্যাংশ আয়ের হার ছিল মাত্র শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ।
পরবর্তী পরিস্থিতি: ডিএসইর বাজারে ফেব্রুয়ারির শেষে এসে লভ্যাংশ আয় কমে ও পিই বাড়ে। তবে জুনে গ্রামীণফোন লভ্যাংশ দিলে পিই কিছুটা কমে আসে। মার্চ-এপ্রিল মাসে মূল্যসূচক কিছুটা সংশোধনের মধ্যে ছিল। মধ্য মে পর্যন্ত ৫৫০০ সূচকের মধ্যে ওঠানামা করে বাজার। তারপর থেকে ওঠানামার মধ্য দিয়ে দ্রুত বেড়ে চলে বাজার। অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে সূচক ৭৫০০ ছাড়িয়ে যায়। এ পর্যায়ে আবার তীক্ষ উত্থান শুরু হয়ে ৫ ডিসেম্বর ডিএসইর সাধারণ সূচক গিয়ে ঠেকে ৮৯১৮ দশমিক ৫১-তে। এরপরই ধসের কবলে পড়ে বাজার।
এ পরিস্থিতি সম্পর্কে গবেষক আবদুল ওয়াহাব বলেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বাজার বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে ডিএসইর সূচকে এই বৃদ্ধি বাজারে মৌলশক্তির সঙ্গে যায় না। ফলে বাজারের উত্থানপ্রবণতা জানুয়ারির প্রথমভাগে বা ডিসেম্বরের শেষ সময়ে আর টেকসই হয়নি।’
আহসান হাবীব মনসুর গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুঁজি ও মুদ্রাবাজারের সব দিক নিয়েই এ গবেষণা করা হয়। আমরা এর মাধ্যমে পরিষ্কার ইঙ্গিত দিয়েছি বাজারে। বলেছি, “বাজার অতি মূল্যয়িত।” ধারণা করি কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরবর্তী সময়ে তাদের দিক থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে।’
গবেষণা ধরে বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে মতামত চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘গবেষণার ভিত্তিতে আমি তো মনে করি এখনো বাজার অতি মূল্যায়িত। কৃত্রিমভাবে বাজারকে সহায়তা দেওয়া কারও জন্যই শুভ হবে না।’

সূচক আশাজাগানিয়া তবু অর্থনীতি মন্থর

Friday, January 28, 2011

র্থনীতির ক্ষেত্রে চাপের মধ্যে রয়েছে সরকার। পণ্যবাজারের অস্থিরতার মধ্যে দুই বছর আগে দায়িত্ব নিয়েছিল সরকার। কিছুদিন নিয়ন্ত্রণে থাকার পর সেই অস্থিরতা আরো বেড়েছে। ঘনীভূত হয়েছে গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট। চলতি বছরটা শুরু হয়েছে শেয়ারবাজারের ভয়াবহ ধস দিয়ে।
এসব চাপ সামলে দেশের অর্থনীতির গতিধারা বজায় রাখা, বিনিয়োগ বাড়ানো ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির কোনো সহজ পথ বাতলাতে পারেননি অর্থনীতিবিদরা। অর্থনীতির মূল সূচকগুলো বেশির ভাগই ইতিবাচক থাকলেও মূল অর্থনীতিতে তেমন গতি নেই। বিনিয়োগের প্রস্তাব বাড়লেও বাস্তবায়ন কম। বিশ্বখ্যাত ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি গোল্ডম্যান স্যাক্স ও মুডিস বাংলাদেশকে ভারতের পরেই এ অঞ্চলে বিনিয়োগের সম্ভাবনাময় দেশ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। জাপান ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশনের (জেবিআইসি) পরিচালিত এক জরিপে ২৮তম অবস্থান থেকে ২০১০ সালে ১৫তম অবস্থানে এসেছে বাংলাদেশ। বিশ্বের বড় বড় কম্পানি বাংলাদেশকে বিনিয়োগের বিকল্প স্থান হিসেবে মনে করছে। কিন্তু কাক্সিক্ষত বিনিয়োগ আসেনি। এর মূল কারণ গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট। এর সঙ্গে নতুন সমস্যা হিসেবে জমির অভাব। সমস্যাটি ভবিষ্যতে শিল্পায়ন, আধুনিকায়ন ও অবকাঠামো উন্নয়নের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ বিশ্বের ৩০তম শক্তিশালী অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে বলে দাবি করছেন মন্ত্রীরা। কিন্তু এর জন্য যে উদ্যোগ প্রয়োজন, তা নেই। মন্ত্রীদের এমন দাবির ভিত্তি হচ্ছে গত ছয় মাসে রপ্তানি আয়ে ৪১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি, লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি রাজস্ব আদায় ও বিনিয়োগ নিবন্ধন বেশি হওয়া। কিন্তু এ কয়েকটি সূচক বাদে বাকি দিকগুলোতে দুর্বলতা রয়েই গেছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা খারাপ হচ্ছে।
জনশক্তি রপ্তানি কমে যাওয়া, বিদেশ থেকে লোক ফেরত আসা বেড়ে যাওয়া ও কর্মসংস্থানের সুযোগ না বাড়ায় সামাজিক অস্থিরতা বাড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় ভবিষ্যতে মানুষকে সস্তায় খাদ্য দেওয়া যাবে এমন নিশ্চয়তা নেই। আগামী গরমে লোডশেডিং নিয়ে মানুষের ধৈর্যচ্যুতি ঘটবে-এমন আশঙ্কা রয়েছে। শেয়ারবাজার ও ভূমি অধিগ্রহণ নিয়ে ইতিমধ্যেই মানুষের বিক্ষোভের মুখে পড়েছে সরকার।
এসব বিষয়ে আগামী দিনে সরকারকে আরো সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান কালের কণ্ঠকে বলেন, অর্থনীতিতে যে সমস্যাগুলো তৈরি হচ্ছে, তা সরকারকে শক্তভাবে মোকাবিলা করতে হবে। শেয়ারবাজারের দরপতন যেমন একটি সমস্যা, তেমনি বিদ্যুৎ সংকটও একটি সমস্যা। কাজেই সমস্যাগুলো সঠিকভাবে মোকাবিলা করার ওপরই আগামী দিনে সরকারের ভাবমূর্তি নির্ভর করবে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, শেয়ারবাজারে স্থিতিশীলতা আনয়ন ও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের বিষয়ে নিঃসন্দেহে সরকার বেশ চাপেই আছে। শেয়ারবাজারে যা ঘটেছে, তা থেকে সরকারকে অবশ্যই সতর্ক হয়ে শিক্ষা নিতে হবে। পাশাপাশি এসইসি, বিনিয়োগকারী সবাইকে আরো সচেতন হতে হবে। ড. মোস্তাফিজ বলেন, বিশ্ববাজারের পাশাপাশি পণ্যের দাম স্থানীয় বাজারেও বাড়ছে। তবে সব কিছুর পরও নিত্যপণ্য স্বল্প আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী বাড়াতে হবে। রেশনিং অব্যাহত রাখার পাশাপাশি সরকারি খাতে খাদ্যপণ্য আমদানি করতে হবে। প্রয়োজনে ভর্তুকির মতো বিষয়কেও মেনে নিতে হবে।
দ্রব্যমূল্যে নাকাল : ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচনী ইশতেহারে অঙ্গীকার ছিল দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ। সরকারের মেয়াদ দুই বছর পার হওয়ার পর এখনো এক নম্বর সমস্যা হিসেবেই তা রয়েছে। সম্প্রতি পৌরসভা নির্বাচন ও কয়েকটি আসনে উপনির্বাচনে বিরোধী দল প্রচারণার ক্ষেত্রে দ্রব্যমূল্য ইস্যুকে সামনে নিয়ে আসে। ২০১০ সালে দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্যের দাম বেড়েছে বলে ৩ জানুয়ারি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দাবি করেছে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। সরকারি বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তালিকায়ও দেখা যায়, আগের বছরের তুলনায় পণ্যের দাম অনেক বেশি। টিসিবির সর্বশেষ হিসাবে দেখা যায়, গত এক বছরে চারটি প্রধান পণ্য-মোটা চালের দাম ৩৩.৩৩ শতাংশ, আটার দাম ৪৩.৭৫ শতাংশ, সয়াবিন তেলের দাম ৩৬.৪৯ শতাংশ ও পেঁয়াজের দাম ২৪.৫৬ শতাংশ বেড়েছে। সরকারের মন্ত্রীরাও স্বীকার করছেন, দ্রব্যমূল্য বেড়েছে। তবে তাঁদের ভাষ্য, প্রতিবেশী অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্য কম।
আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি, উৎপাদন কমে যাওয়া ও চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ধারণা করা হচ্ছে এ অস্থিরতার হাওয়া লাগবে বাংলাদেশেও। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) ‘খাদ্য পূর্বাভাস’ নামের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, গত বছরের তুলনায় এবার ৬ শতাংশ কম খাদ্যপণ্য বিশ্ববাজারে আসবে। আর সরবরাহ কমায় এরই মধ্যে খাদ্যের দাম ৪.২ শতাংশ বেড়েছে। এফএওর প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, খাদ্যমূল্য বাড়ায় বাংলাদেশসহ ৭৭টি খাদ্য ভর্তুকির দেশকে অতিরিক্ত ১২ শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হবে।
বাড়ছে মূল্যস্ফীতিও। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, বার্ষিক গড় হিসাবে নভেম্বরে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮.১৪ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির ভয়ের দিক হলো, খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতির হার বেশি এবং শহরের চেয়ে গ্রামে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে বেশি হারে। এরই মধ্যে সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজারে টাকার সরবরাহ কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে।
গ্যাস-বিদ্যুতে আলো জ্বলছে না : বিগত দুই বছরে ১০২১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ও ২০৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ করেছে দাবি করছে সরকার। তবে ১০২১ মেগাওয়াটের মধ্যে মাত্র ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ বর্তমান সরকারের আমলে নেওয়া হয়েছে। বাকি বিদ্যুৎ উৎপাদনের সব কাজ করেছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
মহাজোট সরকারের নীতিনির্ধারকরা প্রথম বছর পরিকল্পনা এবং দ্বিতীয় বছর সিদ্ধান্ত ও চুক্তি করতেই পার করে দিয়েছেন। এ পর্যন্ত ২৯০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে ১৬টি কুইক রেন্টালসহ ৩৩টি চুক্তি করা হয়েছে। এর অধিকাংশ হয়েছে ২০১০ সালে। এ ছাড়া ভারত থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আনতে চুক্তি, ২৬০০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ভারতীয় এনটিপিসির সঙ্গে চুক্তি এবং বৃহৎ ও মাঝারি আকারের বেশ কয়েকটি গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগও নিয়েছে সরকার। কিন্তু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজের অগ্রগতি হতাশাজনক। এখন পর্যন্ত তিনটি ছাড়া বেশির ভাগ কেন্দ্র নির্দিষ্ট সময়ে উৎপাদনে আসতে পারেনি।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০০ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো গ্যাস উৎপাদন বাড়লেও বর্তমানে মোট উৎপাদনের পরিমাণ আগের চেয়ে কমেছে। গত বছর এ সময়ে দৈনিক ১৯৭ থেকে ১৯৮ কোটি ঘনফুট গ্যাস উৎপাদিত হলেও তা এখন নেমে এসেছে ১৯৪ থেকে ১৯৬ কোটি ঘনফুটে। নতুন গ্যাস অনুসন্ধান কূপ খনন, ক্ষেত্র উন্নয়ন ও সংস্কারে আশানুরূপ অগ্রগতি না হওয়ায় গ্যাস ঘাটতি আগের চেয়ে বেড়েছে। প্রথম বছরে সরকার ফার্স্ট ট্র্যাক কর্মসূচি নিলেও তা যথাসময়ে বাস্তবায়নে হাত দিতে পারেনি। এতে চলতি বছরেও চটজলদি পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে হলে প্রায় ২৮ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ শিল্প খাতে বিনিয়োগ হতে হবে। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা এ পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করতে সক্ষম। এ জন্য গ্যাস ও বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নয়নে সরকারকে কাজ করতে হবে।
এডিপি বিশাল, বাস্তবায়ন কম : চলতি অর্থবছরে এডিপির আকার ৩৮ হাজার কোটি টাকা। আকারে বিশাল হলেও বাস্তবায়ন হার গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় কম। ডিসেম্বর পর্যন্ত গত ছয় মাসে এডিপি বাস্তবায়িত হয়েছে ২৭ শতাংশ, যা গত অর্থবছরে একই সময়ে ছিল ২৯ শতাংশ। এ সময়ে ৯১৬টি প্রকল্পের বিপরীতে ১১ হাজার ২০৭ কোটি টাকা ছাড় করা হলেও ব্যয় হয়েছে ১০ হাজার ২৮৪ কোটি টাকা। অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে মাত্র এক-চতুর্থাংশ এডিপির বাস্তবায়ন হওয়ায় বাকি সময়ে অবশিষ্ট ৭৫ শতাংশ কাজ সম্পন্ন করা হলে কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠার আশঙ্কা রয়েছে। এমনকি কাজ না হওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। এর ফলে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগও থমকে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজ এডিপির বাস্তবায়ন হার নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, এডিপি বাস্তবায়ন যথাসময়ে না হলে তা মানসম্পন্ন হবে না। অনেক প্রকল্প বাধাগ্রস্ত হতে পারে। আর তা হলে সরকারি উন্নয়নের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গতি নেই : গ্যাস-বিদ্যুতের অভাবে বিনিয়োগ পরিস্থিতির আশানুরূপ উন্নতি না হওয়ায় কর্মসংস্থান বাড়ছে না। এর সঙ্গে বিভিন্ন শিল্পে অস্তিরতার কারণে শ্রমিকরাও কর্মহীন হয়ে পড়ছে। বিভিন্ন গবেষণার তথ্য মতে, দেশে প্রতিবছর ২০ লাখ লোক শ্রমবাজারে প্রবেশ করে। এর বিপরীতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে ১০ লাখ। ফলে ১০ লাখ লোক নতুন করে বেকারত্বের তালিকায় নাম লেখাচ্ছে।
আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহারে দারিদ্র্য কমাতে বেশকিছু অঙ্গীকার করেছিল। এর মধ্যে ছিল প্রতি পরিবারে একজনকে কাজ দেওয়া। এটি বাস্তবায়নের জন্য সরকার ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচি হাতে নেয়। এখনো এটি কুড়িগ্রাম ও গোপালগঞ্জে পরীক্ষামূলকভাবে চলছে। আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারাবাহিকতায় অতি দরিদ্রদের জন্য কর্মসৃজন কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে। বিলুপ্ত হওয়া একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছে। বিএনপি সরকারের সময় বন্ধ থাকা সরকারি প্রতিষ্ঠানে জনবল নিয়োগ বর্তমান সরকারের সময় চালু করেছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কৃষিতে নতুন করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা কঠিন। মানুষকে কাজ দিতে শিল্পায়ন বাড়াতে হবে। কিন্তু বিনিয়োগ নিবন্ধন বাড়লেও গ্যাস-বিদ্যুতের অভাবে কারখানা চালু হচ্ছে না।
বিনিয়োগ বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালের জানুয়ারি-নভেম্বর এই ১১ মাসে মোট এক হাজার ৬২৭টি প্রকল্পে ৬২ হাজার ৫৬৬ কোটি ১৩ লাখ টাকা বিনিয়োগ প্রস্তাব নিবন্ধন করেছেন উদ্যোক্তারা। এতে মোট চার লাখ ১২ হাজার কর্মসংস্থান হবে। কিন্তু এসব বিনিয়োগ প্রস্তাব বাস্তবায়নে গ্যাস-বিদ্যুতের নিশ্চয়তা নেই এখনো।
এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, প্রতিবছর দেশে সর্বোচ্চ ১০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব হচ্ছে। দেশে বর্তমান দুই কোটি ৭০ লাখ বেকার ছাড়াও কর্মবাজারে প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ মানুষ যুক্ত হচ্ছে। ফলে বেকারের সংখ্যা বেড়েই চলছে।
রেমিট্যান্স-প্রবাহ ধীরগতি, জনশক্তি রপ্তানি কমেছে : জনবল রপ্তানি কমে যাওয়ায় প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধিও গতি হারিয়েছে। ২০১০ সালের (জানুয়ারি-ডিসেম্বর) সময়জুড়ে দেশে মোট প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) এসেছে এক হাজার ১০০ কোটি ডলার। এটি আগের বছরের তুলনায় মাত্র ২ শতাংশ বেশি। রেমিট্যান্সের দিক দিয়ে গেল বছরটি সরকার স্বস্তিতে কাটিয়ে দিলেও চলতি বছর বড় ধরনের ধাক্কা আসতে পারে বলে মনে করছেন জনশক্তি রপ্তানিকারকরা। কারণ বাংলাদেশের বৃহৎ শ্রমবাজার সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে জনশক্তি রপ্তানি দু-তিন বছর ধরে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধিতে নেমে এসেছে। এসব দেশ থেকে বিপুলসংখ্যক শ্রমিক ফেরতও এসেছে।
অবকাঠামোর বাধা ভূমি : অবকাঠামোর জন্য জমি অধিগ্রহণ করতে গিয়ে বিপাকে পড়ছে সরকার। জমি হারিয়ে বিক্ষুব্ধ মানুষ রাস্তায় নেমে আসছে। আর সরকারের জন্য তৈরি হচ্ছে রাজনৈতিক সমস্যা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভবিষ্যতে এ সমস্যা আরো প্রকট হতে পারে।
মুন্সীগঞ্জের আড়িয়াল বিলে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও বঙ্গবন্ধু সিটি নির্মাণের জন্য ২৫ হাজার একর জমি প্রয়োজন সরকারের। কিন্তু ওই এলাকার জনগণ এরই মধ্যে বিক্ষোভ শুরু করেছে। ঢাকার অদূরে রূপগঞ্জে সেনা আবাসন প্রকল্পের জমি নিয়ে এলাকাবাসীর সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভয়াবহ সংঘর্ষ হয়েছে। বিনিয়োগ বোর্ড ও বাংলাদেশ এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন্স অথরিটির (বেপজা) কর্মকর্তারা জানান, শিল্প স্থাপনের জায়গা দিতে পারলে গত বছর ঢাকা ও চট্টগ্রাম ইপিজেডে কমপক্ষে সাত হাজার কোটি টাকার বিদেশি বিনিয়োগ আসত। জমি না পেয়ে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ফিরে গেছেন।
ভূমি অধিগ্রহণ সরকারের জন্য বড় সমস্যা হতে পারে বলে মনে করেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ড. বিনায়ক সেন। টাটার গাড়ি তৈরির কারখানার জন্য পশ্চিমবঙ্গের সিঙ্গুরে ভূমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে জনগণের বিক্ষোভের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, বাংলাদেশেও এমন অবস্থা তৈরি হতে পারে। তিনি ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ প্যাকেজ নিয়ে নতুনভাবে চিন্তার পরামর্শ দেন।

মূল্যস্ফীতির চাপে শেয়ারবাজারে টানাপোড়েন

দুনিয়াজুড়ে বাংলাদেশের নাম আরেকবার ছড়িয়ে পড়ল। তা সম্ভব হলো দেশের পুঁজিবাজারে বিরাট বিপর্যয়ের কারণে। এতে হয়তো খুশি হওয়ার কিছু নেই। তবে যেটা বাংলাদেশের নীতিনির্ধারক ও বিনিয়োগকারীদের সচেতন করতে পারে সেটি হলো, বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের এই উত্থান-পতন কিছু কিছু দেশে গভীর মনোযোগ কেড়েছে।

মনোযোগ কেড়েছে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারী ও ক্রেতাদের। তারা বাংলাদেশকে ও বাংলাদেশের অর্থনীতিকে এবার একটু ভিন্নভাবে পর্যালোচনা শুরু করেছে। আবার কেউ কেউ বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা ও প্রবণতার সঙ্গে নিজেদের শেয়ারবাজারকে মিলিয়ে দেখতে চাইছে। ফিলিপাইনের কথাই ধরা যাক। সেখানকার কোনো কোনো বিশ্লেষক বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে ধস নামা থেকে সে দেশের কারবারি ও বিনিয়োগকারীদের শিক্ষা নিতে বলছে, সতর্ক হতে বলছে। দেশটির প্রধান শেয়ারবাজার ফিলিপাইন স্টক এক্সচেঞ্জের মূল সূচক হলো পিএসই সূচক। জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে এই সূচক চার হাজার পয়েন্টের নিচে নেমে গেছে। দেশটিতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে চলায় তা ইতিমধ্যে শেয়ারবাজারের ওপর চাপ তৈরি করেছে।
অবশ্য বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনা করতে গিয়ে তারা একটা দিক থেকে স্বস্তিতে রয়েছে। গত পাঁচ বছরের (২০০৬-১০) দুই বাজারের গতি-প্রবণতা পর্যালোচনা করে তারা দেখতে পায়, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) মূল্যসূচক যত দ্রুত হারে ও যতটা বেড়েছে, পিএসই সূচক সেই হারে ও সেভাবে বাড়েনি।
ফিলিপাইনের বাজারের বিষয়টি যখন চলে এল, তখন আসলে এশিয়ার শেয়ারবাজারগুলোর সর্বশেষ প্রবণতাটার দিকে আলোকপাত করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে এখানে চলে আসছে মূল্যস্ফীতির বিষয়টি, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বস্তুত এই বছরের প্রথম তিন সপ্তাহে এশিয়ার প্রধান শেয়ারবাজারগুলোয় দুটি বিপরীতধর্মী প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। ইন্দোনেশিয়া, ভারত ও চীনের শেয়ারবাজার যথাক্রমে ৮ দশমিক ৭০ শতাংশ, ৭ দশমিক ৩০ শতাংশ ও ৩ দশমিক ৩০ শতাংশ হারে পড়ে গেছে। বিশ্লেষকদের মতে, এই পতনের মূলে রয়েছে মূল্যস্ফীতিজনিত আতঙ্ক।
এখানকার বিনিয়োগকারীরা এখন শেয়ার ও বন্ড বিক্রি করে দিয়ে দ্রুত মুনাফা তুলে নেওয়ার দিকেই মনোযোগী। তাঁরা এও মনে করছেন, এসব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক যথাসময়ে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করেনি বা করলেও তা খানিকটা ধীরে ধীরে।
যেমন—ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (আরবিআই) গত মঙ্গলবার রেপো (কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে হারে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে অর্থ ধার দেয়) ও রিভার্স রেপোর (কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অর্থ জমা রাখলে যে সুদ দেওয়া হয়) হার বাড়িয়েছে। তবে সেখানকার অর্থনীতিবিদদের অনেকেই মনে করছেন, এই হার যতটা বাড়ানো হয়েছে, তার চেয়ে বেশি বাড়ানো উচিত ছিল।
ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটের অর্থনীতিবিদ অভিরূপ সরকার ইকোনমিক টাইমসকে বলেছেন, ‘উচ্চ মূল্যস্ফীতির মূলে রয়েছে দুই অঙ্কের খাদ্যের মূল্যস্ফীতির হার ও তেল-পণ্যের উচ্চমূল্য। একদিকে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো, অন্যদিকে মুদ্রার সরবরাহ কমানো—এ দুইয়ের মাধ্যমে এই মূল্যস্ফীতিকে প্রশমিত করতে হবে। রেপো ও রিভার্স রেপোর হার বাড়িয়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না।’
আরেক ধাপ বাড়িয়ে মন্তব্য করেছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক বিপুল মালাকার। তাঁর মতে, এই নীতিনির্ধারণী সুদের হার বাড়ানোর কোনো প্রভাব বেড়ে চলা পণ্যমূল্যের ওপর পড়বে না। কেননা, মুদ্রাবাজারে উচ্চমাত্রায় ফাটকা চাহিদাই মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিচ্ছে। তাই এই ফাটকা চাহিদার প্রশমন ঘটিয়ে এবং উৎপাদন খাতের প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতিকে বাগে আনতে হবে।
অথচ আরবিআইকে বলা হচ্ছে এশিয়ার সবচেয়ে আগ্রাসী কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যে কিনা গত বছরে ছয়বার বিভিন্ন নীতিনির্ধারণী সুদের হার বাড়িয়েছে। আর জানুয়ারি মাসে রেপো ও রিভার্স হার যথাক্রমে সোয়া ছয় ও সোয়া পাঁচ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ছয় ও সাড়ে পাঁচ শতাংশে উন্নীত করেছে।
বিপরীতে মালয়েশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেকটা দ্রুত মুদ্রানীতি সংকোচনমূলক করেছে সুদের হার বাড়িয়ে দিয়ে। এটি আবার সে দেশের শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের কাছে ইতিবাচক বার্তা দিয়েছে। তাই এ দুটি দেশের প্রধান শেয়ারবাজার আলোচ্য সময়ে ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। সিউল স্টক এক্সচেঞ্জে তো একপর্যায়ে রেকর্ড উল্লম্ফন ঘটেছে। রয়টার্সের বিশ্লেষণে এমনটিই বলা হয়েছে।
সুতরাং, মূল্যস্ফীতির চাপে এশিয়ার শেয়ারবাজারগুলোয় এক ধরনের টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে। শুধু শেয়ারবাজারই নয়, মুদ্রাবাজারে বিশেষত বৈদেশিক মুদ্রাবিনিময় হারের ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতির চাপ আরেকটি অস্থিরতা তৈরি করেছে।
থাইল্যান্ডের বিহিত মুদ্রা বাথ ও ভারতের রুপির দরের বড় ধরনের পতন ঘটেছে। আর এটা ঘটছে যেহেতু এসব দেশের বিদেশি বিনিয়োগকারী ও কারবারিরা শেয়ার ও বন্ড বিক্রি করে দিচ্ছে এবং মার্কিন ডলার কিনছে। এমনকি থাইল্যান্ডে কিছু স্থানীয় স্বর্ণ আমদানিকারকও ডলার কিনতে শুরু করেছে। এই চাহিদা বৃদ্ধি ডলারের দর বাড়িয়ে স্থানীয় মুদ্রাকে স্বাভাবিকভাবেই চাপের মুখে ফেলছে। সিঙ্গাপুরের স্ট্রেট টাইমস-এর এক প্রতিবেদনে (২৩ জানুয়ারি) এসব তথ্য দিয়ে আরও বলা হয়েছে, সম্ভবত এশিয়ার মধ্যে এখন একমাত্র তাইওয়ানেই বিদেশিরা শেয়ার ও বন্ড কিনছে।
প্রেক্ষিত বাংলাদেশ: বাংলাদেশে শেয়ারবাজারের বিরাট দরপতন বা ধস যা-ই বলা হোক না কেন, এর সঙ্গে মূল্যস্ফীতির একটা যোগসূত্র দাঁড় করানো যেতে পারে। যদিও বাজার অতিমূল্যায়িত হয়ে যে অবস্থায় গিয়েছিল, তা থেকে বিরাট পতনটা ছিল অনিবার্য। আর মূল্যস্ফীতি প্রশমনের জন্য নিয়ন্ত্রণমূলক মুদ্রানীতি এই পতনে দৃশ্যতই একটা ভূমিকা রেখেছে।
সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির মূল কথাই হলো মুদ্রার সরবরাহ কমিয়ে আনা। আর এটা কমিয়ে আনতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাধারণত সুদের হার বাড়ানোর দিকে যায়। এতে একদিকে ঋণ প্রবাহ কমে, অন্যদিকে মানুষজন আগের তুলনায় বেশি পরিমাণ অর্থ ব্যাংকে জমা করে একটু বাড়তি সুদ পাওয়ার জন্য। এতে শেয়ার ও বন্ড বাজার থেকে অর্থ প্রত্যাহার করার একটা প্রবণতা দেখা দেয়।
বাংলাদেশে এই মুহূর্তে (অক্টোবর, ২০১০ হিসাবে) বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতির হার ৮ দশমিক ১৪ শতাংশ। আর সরকারি লক্ষ্যমাত্রা হলো চলতি ২০১০-১১ অর্থবছর শেষে বার্ষিক মূল্যস্ফীতির হার সাড়ে ছয় শতাংশের মধ্যে বেঁধে রাখা। কাজেই মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি রুখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দিক থেকে করণীয় হলো সুদের হার বাড়ানো। সেই পদক্ষেপ হিসেবেই ডিসেম্বর মাসে ব্যাংক খাতের বিধিবদ্ধ জমার হার (এসএলআর) ও নগদ জমার হার (সিআরআর) বাড়িয়ে দেওয়া হয়। আর এতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপ ছিল। কেননা, সরকার আইএমএফের কাছ থেকে ১০০ কোটি ডলার ঋণ নিতে যাচ্ছে।
এ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে মুদ্রাবাজার থেকে বাড়তি তারল্য তুলে নেওয়ার দিকে অগ্রসর হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০০৯ সালের নভেম্বর মাসের তুলনায় ২০১০ সালের নভেম্বরে দেশে মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ২২ শতাংশের বেশি। এতে বোঝা যায়, বাজারে যথেষ্ট অর্থ প্রবাহ ঘটেছে।
তবে আরেকটি বিষয় এখানে লক্ষণীয়। মুদ্রা সরবরাহ এতটা বাড়লে মূল্যস্ফীতির ওপর যতখানি প্রভাব পড়ার কথা, ততখানি পড়েনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আলী তসলিম এ বিষয়টি উল্লেখ করে প্রশ্ন রাখেন, তাহলে এত টাকা গেল কোথায়? উত্তরটা অবশ্য তিনিই দিয়েছেন, যা এখানে তুলে ধরা হলো।
হতে পারে, মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধির প্রভাবটি মূল্যস্ফীতিতে প্রতিফলিত হয় দীর্ঘ সময় পরে। সে ক্ষেত্রে আরও কিছুদিন পর গিয়ে হয়তো মূল্যস্ফীতির হার আরও উচ্চ হবে। তবে এর চেয়ে অধিক গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা আছে।
সরবরাহকৃত মুদ্রার একটা উল্লেখযোগ্য অংশ খাটানো হয়েছে শেয়ারবাজারে। ফলে অর্থগুলো ধাবিত হয়েছে শেয়ারের পেছনে, যা ক্রমান্বয়ে শেয়ারের দাম বাড়াতে ভূমিকা রেখেছে। আর যেহেতু এই অর্থ বাজারে নিত্যপণ্যের পেছনে ধাবিত হয়নি, তাই তা মূল্যস্তরেও সেভাবে প্রভাব ফেলেনি। তাছাড়া বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতির নির্ণায়ক যে ভোক্তা মূল্যসূচক, তাতে শেয়ারের দাম অন্তর্ভুক্ত হয় না। ফলে, শেয়ারের দাম অনেক বাড়লেও তা এই সূচকে প্রতিফলিত হয়নি। তাই তা মূল্যস্ফীতির হার বৃদ্ধিতে সেভাবে কোনো ভূমিকা রাখেনি।
বলা যেতে পারে, শেয়ারবাজার বিপুল পরিমাণ অর্থ টেনে নিয়ে মূল্যস্ফীতিকে প্রশমিত রাখার ক্ষেত্রে নিজের অজান্তেই কাজ করেছে। তবে এই কাজটি যে টেকসই নয় বা হতে পারে না, তাও ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। কেননা, শেয়ারবাজার থেকে যখন অর্থ তুলে নেওয়া শুরু হয়েছে, তখন স্বাভাবিকভাবেই তা বাজারকে নিম্নমুখী করেছে। এটা আবার বাজারকে বড় ধরনের সংশোধনের দিকে ঠেলে দেওয়ায় ভূমিকা রেখেছে।
শেয়ারবাজারের এই বিপর্যস্ত অবস্থার পর স্বাভাবিকভাবেই দেশের আর্থিক খাতে একটি বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে। কেউ কেউ ভবিষ্যতে গোটা আর্থিক খাতেই বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন। সেটা হয়তো ঘটবে না। অন্তত শেয়ারবাজারের এই অবস্থার পর নীতিনির্ধারকদের যথেষ্ট সতর্ক ও দৃঢ় হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। তাঁরা তা কতটা হয়েছেন, তা বোঝা যাবে খুব অল্প সময়ের মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রাবিনিময় হারের ক্ষেত্রে অস্থিরতা তৈরি হওয়া বা না হওয়ার ওপর।

পুঁজিবাজারের মুনাফা থেকে লভ্যাংশ দিতে পারবে না ব্যাংকগুলো

Monday, January 24, 2011

পুঁজিবাজার থেকে অর্জিত মুনাফা শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ হিসাবে দিতে পারবে না ব্যাংকগুলো। বিদায়ী বছরে পুঁজিবাজার থেকে অর্জিত এ মুনাফা শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে বিতরণ না করে রিজার্ভে রেখে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

পরবর্তী সময়ে ব্যাংকগুলো এ অর্থের একটি নির্দিষ্ট অংশ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারবে। সম্প্রতি ছয়টি ব্যাংকের সঙ্গে অনুষ্ঠিত ভিন্ন ভিন্ন বৈঠকে এ নির্দেশনা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক এস কে সুর চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা ব্যাংকগুলোর সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে পুঁজিবাজার থেকে অর্জিত মুনাফা লভ্যাংশ হিসাবে বিতরণ না করে রিজার্ভে রেখে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছি। তাহলে ঘুরেফিরে এ মুনাফার একটি নির্দিষ্ট অংশ পুঁজিবাজারে আবার বিনিয়োগে আসবে।'
তিনি বলেন, 'পুঁজিবাজারে সাম্প্রতিক ধসের জন্য বিভিন্ন মহল থেকে ব্যাংক খাতের সীমাতিরিক্ত বিনিয়োগ ও উচ্চ মুনাফা নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে পুঁজিবাজারে এ খাতের বিনিয়োগ ও মুনাফা বাজার ধসের ক্ষেত্রে কোনো প্রভাবই ফেলেনি। সার্বিকভাবে পুঁজিবাজার থেকে ব্যাংকগুলোর মুনাফা এসেছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। শেয়ারবাজারে সূচক বৃদ্ধি বা হ্রাসে এ টাকার ভূমিকা খুবই নগণ্য।'
বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষস্থানীয় একটি সূত্র জানায়, এ পর্যন্ত পুঁজিবাজার থেকে উচ্চ মুনাফাকারী ছয়টি ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ব্যাংকগুলো হচ্ছে_ন্যাশনাল ব্যাংক, এবি ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, আল আরাফা ইসলামী ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া ও ঢাকা ব্যাংক লিমিটেড। বৈঠকে ব্যাংকগুলোর দেওয়া তথ্যানুযায়ী, এদের দুটি সর্বোচ্চ আড়াই শ কোটি টাকা পুঁজিবাজার থেকে মুনাফা করেছে। বাকি ব্যাংকগুলোর একটির এক শ কোটি টাকার কিছু বেশি এবং বাকিগুলোর মুনাফা ৫০ কোটি টাকার কাছাকাছি। সার্বিকভাবে ব্যাংকিং খাতে পুঁজিবাজার থেকে মুনাফা এসেছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। বৈঠকে তাদের পুঁজিবাজার থেকে অর্জিত মুনাফা শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে বিতরণ না করে তা রিজার্ভে রেখে দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে সংরক্ষিত ডিসেম্বরভিত্তিক তথ্য থেকে দেখা যায়, পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর সর্বমোট বিনিয়োগ ১২ হাজার ৫৪১ কোটি টাকা, যা পুঁজিবাজারে মোট শেয়ারমূল্য তিন লাখ ৫০ হাজার ৮০০ কোটি টাকার মাত্র ৩.৫৮ শতাংশ। অপরদিকে পুঁজিবাজারের মোট শেয়ারের পরিমাণ তিন লাখ তিন হাজার ৪৩২টির মধ্যে ব্যাংকগুলো মাত্র ৭.৪১ শতাংশ ধারণ করে আছে। অর্থাৎ ব্যাংকগুলোর হাতে বর্তমানে শেয়ার রয়েছে ২২ হাজার ৪৭৯টি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'পুঁজিবাজার থেকে অর্জিত মুনাফা রিজার্ভে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ ব্যাংকগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংক দিয়ে থাকলে এটা ভালো সিদ্ধান্ত বলেই আমি মনে করি। রিজার্ভে এ লভ্যাংশ নিয়ে গেলে ব্যাংকগুলোর মূলধন বাড়বে এবং ভিত্তি শক্ত হবে।' এ ছাড়া এ সিদ্ধান্তের ফলে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ সক্ষমতাও বাড়বে বলে তিনি মন্তব্য করেছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, সার্বিকভাবে ব্যাংকগুলো মোট দায়ের ৫-২৮ শতাংশ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেছে। এ বিনিয়োগ পুঁজিবাজারের মোট বিনিয়োগের মাত্র ৩.৫৮ শতাংশ। যদি ব্যাংকগুলো আইনি সীমার সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ বিনিয়োগ করে, তাহলে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ দাঁড়াবে পুঁজিবাজারের মোট বিনিয়োগের প্রায় ৭ শতাংশ। এই অবস্থায় সূচকের পতন ঠেকাতে ব্যাংকিং খাত নির্ভরতা কতটুকু যৌক্তিক_এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'এ পরিসংখ্যান অনুযায়ী ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ বাড়ানোয় সূচকের তেমন পরিবর্তন আসবে না। তাই আমি বরাবরই শুধু ব্যাংক কিংবা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নির্ভরশীল না হয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকেও বিনিয়োগে উৎসাহিত করার জন্য পরামর্শ দিয়েছি। তবে সরকার বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরানোর চেষ্টা করছে। তাই হয়তো বারবার আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিনিয়োগে ফেরানোর কথা বলে সাধারণ মানুষকে বিনিয়োগে ফেরানোর কথা বলছে।
সাবেক ডেপুটি গভর্নর ও কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলেন, 'বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সিদ্ধান্ত একদিকে যেমন ব্যাংকগুলোর জন্য উপকারী, অন্যদিকে তা পরিচালকদের জন্য শাস্তিস্বরূপ। ব্যাংকগুলোর এ মুনাফা রিজার্ভে রেখে দেওয়াই যুক্তিসংগত।'
ব্যাংকগুলোর মুনাফার একটি অংশ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের সরকারের যে সিদ্ধান্ত, সে সম্পর্কে তিনি বলেন, 'আমি মনে করি, সরকার এসইসিকে পুনর্গঠন ছাড়া যত সিদ্ধান্তই নিক না কেন, তাতে জনগণের আস্থা ফিরবে না। কারণ সূচকের ধস ঠেকাতে এই এসইসি বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, যখন সূচক অতি দ্রুত বাড়ছিল তখন তারা উদ্যোগ নেয়নি কেন। তাই আমি বলব, সরকার কোনো উদ্যোগ নেওয়ার আগে এসইসির পুনর্গঠন জরুরি।'
তিনি বলেন, '৩০ লাখ লোক পুঁজিবাজারে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। এদের অনেকেই শিক্ষিত বেকার। সরকার যদি বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর পুঁজিবাজার থেকে অর্জিত মুনাফার একটি অংশ আবার বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে নিয়ে আসার অনুরোধ করে তখন বাংলাদেশ ব্যাংক তার মনিটরিং পলিসি ও ব্যাংকিং আইন ঠিক রেখে এ ক্ষেত্রে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কারণ আমি আগেই বলেছি, এখানে অনেক শিক্ষিত বেকারের কর্মসংস্থান রয়েছে।'
বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ বলেন, 'পুঁজিবাজার থেকে ব্যাংকগুলোর মুনাফা যদি আমি দুই হাজার কোটি টাকাও ধরি, তাহলে এ মুনাফার জন্য এদের যেভাবে অভিযুক্ত করা হচ্ছে, সেভাবে কিন্তু ব্যক্তি বা সিন্ডিকেটকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে না। সরকারের উচিত ১৫ দিনের আগেই কমিটি গঠন করা, কমিটির রিপোর্টের জন্য সময় বেঁধে দেওয়া। এর ফলে ব্যক্তি অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সরকার দ্রুত চিহ্নিত ও ব্যবস্থা নিতে পারবে। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থা আরো বাড়বে।'

ব্যাংকের মুনাফার হিসাব প্রকাশ ও তা বাজারে আনার সুপারিশ

পুঁজিবাজার থেকে গত কয়েক বছরে ব্যাংক, বিমা ও অব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কী পরিমাণ মুনাফা করেছে, তার হিসাব প্রকাশের দাবি উঠেছে। একই সঙ্গে বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে ওই মুনাফার টাকা পুনরায় শেয়ারবাজারে ফিরিয়ে আনারও সুপারিশ করা হয়েছে।

গতকাল রোববার সকালে রাজধানীর ইস্কাটনে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় অনুষ্ঠিত সরকারের সঙ্গে বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের উচ্চপর্যায়ের এক বৈঠকে এসব দাবি জানানো হয়। বৈঠকে শেয়ারবাজারের ধসের জন্য কারা দায়ী, তা নিয়েও অনেক কথাবার্তা হয়েছে। বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নানা উপায়ে শেয়ারের দাম বাড়িয়ে অর্থ তুলে নিয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। এ নিয়ে এক দফা উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয় বলেও জানা গেছে।
শেয়ারবাজারের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের উপস্থিতিতে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সকাল সাড়ে আটটায় শুরু হওয়া এ বৈঠক চলে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত।
অর্থমন্ত্রী ছাড়াও বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান, সংস্থাপনবিষয়ক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) চেয়ারম্যান জিয়াউল হক খোন্দকার, বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি এ কে আজাদ, এসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ চৌধুরী, সাবেক উপদেষ্টা ও শিল্পপতি সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাবেক সভাপতি রকিবুর রহমান, বর্তমান সভাপতি শাকিল রিজভী, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সহসভাপতি আল মারুফ খান, বাংলাদেশ পাবলিকলি লিস্টেড কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএলসিএ) সভাপতি ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর বেসরকারি খাত উন্নয়নবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক এস কে সুর চৌধুরী, ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বিএবির সভাপতি নজরুল ইসলাম মজুমদার, ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন এবিবির সভাপতি কে মাহমুদ সাত্তার, এবি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী কাইজার এ চৌধুরী, বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সভাপতি শেখ মর্তুজা আহমেদসহ শেয়ারবাজারসংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
সভায় দুই স্টক এক্সচেঞ্জের নেতারা বলেন, গত কয়েক বছরে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো শেয়ারবাজার থেকে বিপুল পরিমাণ মুনাফা করেছে। বাজারের স্থিতিশীলতার স্বার্থে এসব টাকা বাজারে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। কোন ব্যাংক কত টাকা মুনাফা করেছে তাও জনসমক্ষে প্রকাশ করার দাবি জানিয়ে তাঁরা বলেন, ব্যাংকের আমানতের কোনো টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের প্রয়োজন নেই। কেউ তা চায়ও না।
ডিএসইর সাবেক সভাপতি রকিবুর রহমান সভায় বলেন, যেসব কোম্পানির শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্তির পর নির্দেশক দামের নিচে নেমে এসেছে, ওই সব কোম্পানির বেলায় আইন করে নিজ কোম্পানির শেয়ার পুনঃক্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ছাড়া শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে তুলে নেওয়া টাকা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের আওতায় আনতে হবে। এ জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেওয়া যেতে পারে। তিনি বলেন, যদি কোনো কোম্পানির শেয়ারের দাম তালিকাভুক্তির ছয় মাসের মধ্যে নির্দেশক দামের নিচে নেমে আসে তাহলে কোম্পানিটির শেয়ারের যে পরিমাণ দাম কমবে সমপরিমাণ অর্থ কোম্পানিটিকে বাজারে বিনিয়োগ করতে হবে বা ওই সমপরিমাণ টাকায় তাকে নিজ কোম্পানির শেয়ার কিনতে হবে।
রকিবুর রহমানের এই প্রস্তাবের সঙ্গে একমত পোষণ করেন সালমান এফ রহমান। তিনিও শেয়ার পুনঃক্রয় (বাই-ব্যাক) ব্যবস্থা চালুর কথা বলেন।
সালমান এফ রহমান বৈঠকের একটি আলোচনাকে কেন্দ্র করে বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েন। জানা গেছে, বৈঠকে উপস্থিত একজন তাঁর স্বার্থসংশ্লিষ্ট একটি উড়োজাহাজ কোম্পানির হিসাব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। ওই বক্তা বলেন, কোম্পানিটি বছরের পর বছর লোকসান দেখিয়ে এসেছে। কিন্তু হঠাৎ করে আইপিওতে আসার প্রস্তুতি নেওয়ার আগের বছর কোম্পানিটি মুনাফা দেখিয়েছে। যখন কোম্পানিটি লোকসান করেছে, তখন খরচ বেশি দেখানো হয়েছে। কিন্তু যে বছর মুনাফা করেছে, সে বছর খরচ দেখানো হলো কম। এটা কীভাবে সম্ভব, তা বোধগম্য নয়। কোম্পানিটি যে টেলিফোন খরচ দেখিয়েছে, তা তাঁর ব্রোকারেজ হাউসের টেলিফোন খরচের চেয়েও কম।
এ বক্তব্যের পরপরই সালমান এফ রহমান বলেন, তিনি বহু ব্যবসায়িক সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও তাঁকে এভাবে ব্যক্তিগত আক্রমণের মুখোমুখি হতে হয়নি। এসব আলোচনা এ ফোরামের বিষয় নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাঁর উড়োজাহাজ বহরে নতুন নতুন জাহাজ যুক্ত হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রুট চালু করা হয়েছে। এসব কারণে মুনাফা হয়েছে। টেলিফোন খরচ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তাঁদের প্রতিষ্ঠানে ‘সিটা’ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। এ কারণে টেলিফোন খরচ কম হয়েছে। এসব বিষয়ে না জেনে ঢালাও মন্তব্য করা ঠিক হয়নি।
সিএসইর সহসভাপতি আল মারুফ খান প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে একসঙ্গে পুরো টাকা বাজার থেকে তোলার সুযোগ না দিয়ে ধাপে ধাপে টাকা তোলার পরামর্শ দেন। একই সঙ্গে তিনি আইপিও-প্রক্রিয়ার সঙ্গে ব্রোকারেজ হাউসগুলোকে যুক্ত করার দাবি জানিয়ে বলেন, এতে পুরো প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা কমবে। দীর্ঘদিন টাকা আটকে থাকবে না। পাশাপাশি কোম্পানির দামভেদে আরোপিত সার্কিট ব্রেকার (দাম বাড়া-কমার নির্ধারিত সীমা) সীমা কমিয়ে আনার কথা বলেন, যাতে খুব বেশি লাভ-লোকসানের সুযোগ না থাকে। পাশাপাশি প্রাইভেট প্লেসমেন্টকে দ্রুত আইনের আওতায় আনার দাবি জানান সিএসইর প্রতিনিধিরা।
দুই এক্সচেঞ্জের নেতারা বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে বাজারে তালিকাভুক্ত ও তালিকাভুক্তির অপেক্ষায় থাকা কোম্পানিগুলোর হিসাব বিবরণী নিরীক্ষার দাবি জানান।
সভায় উপস্থিত ব্যাংকাররা বলেন, ব্যাংকগুলো শেয়ারবাজার থেকে যে মুনাফা করেছে তার একটি অংশ ওই ব্যাংকেরই সহযোগী মার্চেন্ট ব্যাংকে রিজার্ভ হিসেবে রাখতে হবে। তার পরই ওই ব্যাংক মুনাফার ভিত্তিতে লভ্যাংশ ঘোষণা করবে।
জানা গেছে, সভায় তিনটি কোম্পানি বাজার থেকে বড় অঙ্কের টাকা তুলে নিয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়। বলা হয়, ওই সব কোম্পানি তালিকাভুক্তির শুরুতে বিনিয়োগকারীদের কাছে যে দামে শেয়ার বিক্রি করেছে, ধীরে ধীরে তার দাম কমেছে। এতে বিনিয়োগকারীদের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। কীভাবে কোম্পানিগুলোকে উচ্চ দামে শেয়ার বিক্রির সুযোগ দেওয়া হলো, এ নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়।
সভায় উপস্থিত বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধি একপর্যায়ে বক্তব্য দিতে চাইলে অর্থমন্ত্রী তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, ‘আলাদা বৈঠকে তোমাদের কথা শোনা হবে। এখানে আমি অন্যদের কথা শুনতে চাই।’
অনুষ্ঠানে উপস্থিত প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম শেয়ারবাজারের গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, মাঝেমধ্যে পার্টি অফিসে গেলে সেখানে দলের লোকজন বাজার সম্পর্কে জানতে চান। শেয়ারবাজারের অস্থিরতার কারণে দলের অনেক কর্মীও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এতে তাঁদের মধ্যেও ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। এ বাজারের সঙ্গে এখন সারা দেশের বিভিন্ন শ্রেণীপেশার লোক জড়িত। এখানে অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এটিকে কোনোভাবেই অবহেলার দৃষ্টিতে দেখার সুযোগ নেই।
সম্প্রতি পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আশানুরূপ ফল অর্জন না করার পেছনে শেয়ারবাজারের অস্থিরতার একটা প্রভাব রয়েছে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ ঘটনা যাতে ভবিষ্যতে না ঘটে, সে ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
সভায় সব শেয়ারের অভিন্ন অভিহিত মূল্য (ফেস ভ্যালু) নির্ধারণের পরামর্শ দিয়ে বলা হয়, অভিহিত মূল্য পরিবর্তনে কোম্পানির আর্থিক অবস্থার কোনো পরিবর্তন না হলেও এটিকে কেন্দ্র করে বাজারে কারসাজি হয়েছে। এটিও বাজারে অস্থিরতা তৈরিতে সহায়তা করেছে। ভবিষ্যতে কেউ যাতে এভাবে আর দামে কারসাজি করতে না পারে, সে জন্য সব কোম্পানির অভিন্ন অভিহিত মূল্য নির্ধারণ করা উচিত।
পুঁজিবাজারের স্বচ্ছতার স্বার্থে এসইসির জনবল বাড়ানো এবং একে আরও বেশি শক্তিশালী করার পরামর্শ তুলে ধরা হয়। এ ছাড়া বাজার নিয়ে যেকোনো মন্তব্য করার ক্ষেত্রে সবাইকে সতর্ক থাকারও পরামর্শ দেন উপস্থিত অনেকে। তাঁরা বলেন, সরকারের লোকজনই বাজার নিয়ে যেসব মন্তব্য করছেন, সেগুলো বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট আরও বাড়াচ্ছে।
সভায় উপস্থিত অনেকে সরাসরি নাম উল্লেখ না করে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজনের সাম্প্রতিক বক্তব্যের সমালোচনা করে বলেন, এ মুহূর্তে কারোরই দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য দেওয়া উচিত নয়।
শেয়ারবাজার সম্পর্কে না জেনে, না বুঝে কেউ যাতে কোনো ধরনের মন্তব্য করতে না পারেন, সে জন্য আর্থিক বিশ্লেষক লাইসেন্স পদ্ধতি চালুর পরামর্শ দেওয়া হয়। এ ছাড়া বাজারের গভীরতা বাড়াতে তহবিল ও পত্রকোষ (পোর্টফোলিও) ছাড়পত্র চালুরও কথা বলেন কেউ কেউ।
সকালের এই সভাতেই মূল্যসূচকের ওপর আরোপিত সার্কিট ব্রেকার তুলে নেওয়ার পরামর্শ দেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। গতকালের সভায় শেয়ারবাজারের সাম্প্রতিক অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য অনেকাংশে বাংলাদেশ ব্যাংককে দায়ী করা হয়। বাজারের এই অস্থিরতার কারণ উদ্ঘাটনে তদন্ত কমিটি গঠনেরও পরামর্শ দেন অনেকে।

পুঁজিবাজারে অস্থিরতার দায় এসইসির

Sunday, January 23, 2011

'পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এঙ্চেঞ্জ কমিশন (এসইসি) শেয়ারবাজার নিয়ে অনভিজ্ঞ ডাক্তারের মতো আচরণ করেছে। অনভিজ্ঞ ডাক্তার যেমন রোগীকে সকালে হাড় ভাঙার ওষুধ দেওয়ার পর বিকেলে তা বাতিল করে ঠাণ্ডা লাগার ওষুধ দেয়_পুঁজিবাজার নিয়ে তেমনটিই করেছে এসইসি।

তারা সকালে এক সিদ্ধান্ত, বিকেলে অন্য সিদ্ধান্ত দিয়েছে!' গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবে অর্থনীতি ও বাণিজ্যবিষয়ক রিপোর্টারদের সংগঠন ইকোনোমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত এক সেমিনারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এসব কথা বলেন। 'মুদ্রানীতি ব্যবস্থাপনা ও বাংলাদেশ ব্যাংক' শিরোনামে সেমিনারটি আয়োজন করা হলেও তা মূলত শেয়ারবাজারের আলোচনায় রূপ নেয়। সেমিনারে পিকেএসএফের চেয়ারম্যান ড. কাজী খলিকুজ্জমান আহমদ, কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. ইব্রাহীম খালেদ প্রমুখ বক্তব্য দেন।
পুঁজিবাজারের অস্থিরতার পেছনে অর্থমন্ত্রীর তেমন ভূমিকা নেই উল্লেখ করে সাবেক গভর্নর বলেন, 'সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এঙ্চেঞ্জ কমিশন (এসইসি) একটি স্বাধীন নিয়ন্ত্রক সংস্থা। অর্থমন্ত্রী সংস্থাটিকে হয়তো পরামর্শ দিয়ে থাকতে পারেন। বাজার অস্থিরতার পেছনে এসইসির দোষ রয়েছে।' কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেওয়া বিভিন্ন সিদ্ধান্ত যৌক্তিক হলেও ডিসেম্বরে সিআরআর, এসএলআরের হার বাড়ানো ঠিক হয়নি উল্লেখ করে সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, 'কিছু দিন আগে অথবা আগামী মার্চ-এপ্রিল মাসে এসব পদক্ষেপ নিতে পারত কেন্দ্রীয় ব্যাংক।'
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, 'আগে দোষীদের শাস্তি দিতে হবে। অনলাইন পদ্ধতি দোষীদের খুঁজে বের করা খুবই সহজ। ১৯৯৬ সালে শেয়ার কেলেঙ্কারীদের তখনই শাস্তি দেওয়া উচিত ছিল। বিদেশে এ ধরনের অপরাধের জন্য কঠিন শাস্তির বিধান রয়েছে।'
তিনি বলেন, 'পুঁজিবাজারের এ অস্থিরতার কারণে আর্থিক খাতও ঝুঁকিতে রয়েছে। আর আর্থিক খাতে মড়ক দেখা দিলে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে বিপর্যয় নেমে আসবে। এ অবস্থা হলে তা থেকে রক্ষা পাওয়ার তেমন কোনো উপায় থাকবে না।' সালেহউদ্দিন আহমেদ আরো বলেন, 'ব্যাংকগুলো আমানতকারীর টাকা নিয়ে শেয়ারবাজারে অতিরিক্ত বিনিয়োগ করছে। আমানতকারীর টাকা নিয়ে এ ধরনের ঝুঁঁকিপূর্ণ বিনিয়োগে যাওয়া ব্যাংকগুলোর উচিত হয়নি। আর মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক সিআরআর, এসএলআর বাড়িয়ে মুদ্রাবাজার সংকোচন করবে_এটা ঠিক নয়। এতে উৎপাদনশীল খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটের কারণে এসব খাত এমনতিইে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও এসইসি নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রেখে সিদ্ধান্ত নিলে পুঁজিবাজারে এ অবস্থার সৃষ্টি হতো না।' সাবেক এই গভর্নর আরো বলেন, 'পৃথিবীর কোনো দেশে ১০০ টাকা ফেসভ্যালুর শেয়ার ১১০ বা ১১৫ টাকার বেশি বিক্রি হতে দেখা যায় না। আর বাংলাদেশে ১০ টাকার ফেসভ্যালুর শেয়ার ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায়ও বিক্রি হয়!' কেবল আইপিও-নির্ভর না হয়ে বাজারে করপোরেট বন্ড ছাড়ার উদ্যোগ নিতে পরামর্শ দেন তিনি।
এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও এসইসির নেওয়া বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ও সার্কুলার পরস্পরকে প্রভাবিত করে উল্লেখ করে সংস্থা দুটির মধ্যে গভীর সমন্বয় সাধনের ওপর গুরুত্ব দেন তিনি।
মুদ্রানীতি প্রসঙ্গে ড. সালেহউদ্দিন বলেন, 'প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা ছাড়াও মুদ্রানীতিতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। শুধু চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করে মূল্যস্ফীতি দমানো সম্ভব নয়। এজন্য মুদ্রানীতির সঙ্গে আর্থিক নীতির সমন্বয় ঘটাতে হবে। প্রবৃদ্ধির সঙ্গে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। এখনো ব্যাংকগুলোর আমানত ও ঋণের সুদের হারের পার্থক্য ৫ শতাংশেরও বেশি উল্লেখ করে তিনি তা কমিয়ে আনার পরামর্শ দেন।'
পিকেএসএফের চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, 'শেয়ারবাজারের বর্তমান অবস্থার পেছনে কারা দায়ী, তা সকলেরই জানা। এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া না হলে ভবিষ্যতেও পুঁজিবাজার নিয়ে_এমন খেলা খেলবে তারা।'
মুদ্রানীতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'অর্থনীতির বড় অংশ কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতিতে আয় ও কাজ বাড়াতে না পারলে প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হবে না। বাংলাদেশে বর্তমানে যোগসাজশের অর্থনীতি চলছে। এখানে যিনি সংসদ সদস্য, তিনিই রাজনীতিবিদ, তিনিই ব্যবসায়ী, তিনিই ব্যাংকার। তিনিই নীতি নিয়ন্ত্রণ করেন। এ ধরনের অবস্থা থেকে অর্থনীতিতে মুক্তি দিতে হবে।' মূল্যস্ফীতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি মূলত প্রতিবেশী দেশ ভারতের মূল্যস্ফীতি ও বহির্বিশ্বে পণ্যমূল্যের ওপর নির্ভরশীল। কারণ এসব দেশ থেকেই বাংলাদেশকে পণ্য আমদানি করতে হয়। ভারতে মূল্যস্ফীতি বাড়লে বাংলাদেশেও বাড়ে।' তিনি বলেন, 'চলমান অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি থাকবেই। তবে তা ৪-৫ শতাংশ পর্যন্ত সহনীয়। মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশ হলে তা চিন্তার বিষয়। আর তারও বেশি হলে ব্যবস্থা নিতেই হবে। বর্তমানে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির হার ৭ শতাংশের বেশি, আর খাদ্যমূল্যস্ফীতির হার ১০ শতাংশ। এ অবস্থায় ব্যবস্থা না নিয়ে উপায় নেই।'
সরকারের নিয়ন্ত্রণে রেখে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) কে কার্যকর করা সম্ভব হবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'কোনো পণ্য আমদানি করতে হলে ৪০ থেকে ৫০ জনের স্বাক্ষর নিতে হবে। তত দিনে বাজার সয়লাব হয়ে যাবে।' তাই টিসিবিকে পাবলিক লিমিটেড কম্পানিতে রূপান্তরের পরামর্শ দেন তিনি।
কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. ইব্রাহীম খালেদ বলেন, 'শেয়ারবাজার নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে দোষারোপ করা যৌক্তিক নয়। কারণ বাজারে শেয়ারের দাম যে অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছিল, তা আগেই বাংলাদেশ ব্যাংক সতর্ক করে দিয়েছিল। আর পাঁচটি ব্যাংক নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত অর্থ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছিল। এর মধ্যে দুই-তিনটি ব্যাংক শেয়ারবাজার নিয়ে অতি বাজে খেলায় মেতেছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক সময়মতো উদ্যোগ না নিলে শেয়ারবাজারের সঙ্গে এখন ব্যাংকগুলোও বিপর্যস্ত হতো। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত ছিল, আরো আগে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া।'
বাংলাদেশের মুদ্রায়ন খুবই নিম্নমানের উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'মুদ্রানীতি মুদ্রাবাজারকে খুব বেশি প্রভাবিত করতে পারে না।' মোটামুটিভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার কৌশলসহ মুদ্রানীতি প্রণয়ন করা হলে সবাই সন্তুষ্ট হবেন বলে মত দেন তিনি। সেমিনারে ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আবদুর রশীদ লালী বলেন, 'বাজারে তারল্য সংকট চলছে। ব্যাংকে গিয়ে ১০ লাখ টাকাও পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ কয়েক মাস আগেও ৩০ থেকে ৩৫ হাজার কোটি অলস টাকা পড়ে ছিল। এই টাকা গেল কোথায়?' সেমিনারে ইআরএফ সভাপতি মনোয়ার হোসেন, সাধারণ সম্পাদক আবু কায়সার প্রমুখ বক্তব্য দেন।

অর্থনীতি ধ্বংসে পরিকল্পিত চেষ্টা

সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা, সুস্পষ্ট নীতিমালার অভাব ও শিল্পবিরোধী নানা রকমের নির্দেশনায় প্রায় এক লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ হুমকির মুখে পড়েছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে দেড় গুণের বেশি অর্থ বিনিয়োগকারী আবাসন, জাহাজ ভাঙা ও স্টিল, রি-রোলিং, অটো রি-রোলিংসহ ২০ হাজার শিল্পপ্রতিষ্ঠান ক্রমেই অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে যাচ্ছে।

এরই মধ্যে বেকার হয়ে গেছে এসব খাতের লক্ষাধিক শ্রমিক। কয়েকটি এনজিও পরিবেশ রক্ষার অজুহাতে পরিকল্পিতভাবে দেশের অর্থনীতি ধ্বংসের মাধ্যমে সরকারকে বিপাকে ফেলার ষড়যন্ত্রে নামায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। মহাজোটের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতি পরিবার থেকে কমপক্ষে একজন বেকারকে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি রয়েছে। তবে বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, নতুন চাকরির সুযোগ সৃষ্টির বদলে বেসরকারি শিল্প খাতে নিয়োজিত শ্রমিকরা বেকার হয়ে যাচ্ছে। বিনিয়োগকারীরা সর্বস্বান্ত হওয়ার আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। শঙ্কিত বিনিয়োগকারী এবং জীবিকা হারানো শ্রমিক শ্রেণীর ক্ষোভ গিয়ে পড়ছে বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে ক্ষমতায় আসা মহাজোট সরকারের ওপর।
লাখো কোটি টাকার বিনিয়োগ স্থবির হয়ে পড়ায় দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড দুর্বল হয়ে পড়ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সরকারের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াবে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
তাঁদের মতে, বেসরকারি খাতের এই বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগকে গতিশীল করতে না পারলে ব্যর্থতার দায় সরকারকেই নিতে হবে। আর এর বিরূপ প্রভাব পড়বে আগামী জাতীয় নির্বাচনে।
আবাসন খাতের বিনিয়োগ ৭০ হাজার কোটি টাকা। জাহাজ ভাঙা, স্টিল, রি-রোলিং, অটো রি-রোলিং খাতের মোট বিনিয়োগ এক লাখ কোটি টাকা। এসব খাতের শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা ৫০ লাখের বেশি। তাদের সঙ্গে জড়িত একটি করে পরিবার। সব মিলিয়ে প্রায় আড়াই কোটি মানুষের অন্ন-বস্ত্রের জোগান আসে এসব খাত থেকেই। গুরুত্বপূর্ণ এ খাতগুলোকে অস্থিতিশীল করে তোলার গভীর ষড়যন্ত্র চলছে বর্তমানে। পরিবেশবাদী কয়েকটি এনজিওকে সামনে নিয়ে অদৃশ্য মহল সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য পরিকল্পিতভাবে বিনিয়োগকারী এবং এসব খাতে কর্মরত বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষকে খেপিয়ে তোলার পাঁয়তারা চালাচ্ছে।
বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগের সবচেয়ে বড় অংশীদার হচ্ছে আবাসন খাত। ৭০ হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করে আবাসন খাত অন্যান্য খাতের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। আবাসন খাতের সঙ্গে নির্মাণ শিল্পের অধিকাংশ শিল্পপ্রতিষ্ঠান জড়িত। যেমনÑরড, সিমেন্ট, ইট, রং, কাঠ, গ্লাস, অ্যালুমিনিয়াম, বৈদ্যুতিক সামগ্রী, আসবাবপত্রসহ হাজার হাজার শিল্পপ্রতিষ্ঠান। মূলত আবাসন খাত ধ্বংসের উদ্দেশ্যে সংশ্লিষ্ট মূল এবং উপশিল্প খাতকে অস্থিতিশীল করে তোলার চক্রান্ত করছে ওই বিশেষ মহল। আবাসন খাত ধ্বংস হলে বাকিগুলো এমনিতেই বসে যাবে। বিদেশি অর্থায়নে পরিচালিত চক্রটি দেশের শিল্প-কারখানা বন্ধ করে বিদেশ থেকে প্রয়োজনীয় সামগ্রী আমদানির সুযোগ তৈরির জন্যই এসব করছে বলে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন। তাঁদের মতে, চক্রটি পরিবেশবাদী কয়েকটি এনজিওকে সামনে রেখে নিজেদের শক্তিশালী করে তোলার প্রক্রিয়া শুরু করে বিগত সরকারগুলোর সময় থেকেই। বর্তমানে তারা এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে খোদ প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের বিষয়েও তারা অসন্তোষ প্রকাশ করছে। গণতান্ত্রিক পন্থায় ড্যাপ (ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান) বাস্তবায়নের বিষয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠক এবং জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতেও নাখোশ হয়েছে চক্রটি। বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিবেশবাদী কিছু এনজিও পরিবেশ রক্ষার অজুহাত দেখিয়ে শিল্প-কারখানা বন্ধ করে দিচ্ছে, মানুষকে বেকারত্বের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কিন্তু এসব পরিবেশবাদী এনজিও হুন্ডি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করে না। হুন্ডি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে এসব সংগঠন সোচ্চার হলে বছরে বৈধভাবে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আসার হার বর্তমানের চেয়ে দুই থেকে তিন গুণ বৃদ্ধি পেত। উল্লেখ্য, বর্তমানে বছরে ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমানের অর্থ দেশে আসছে। অর্থপ্রবাহ বাড়লে দেশের অর্থনীতি আরো শক্তিশালী হতো। সরকারের রাজস্ব আয়ও বৃদ্ধি পেত। অথচ তাদের বিরুদ্ধে কোনো সংগঠন কথা বলে না। বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেশে গ্যাস, বিদ্যুতের সংকট তীব্র। এর ফলে লাখো কোটি টাকার বিনিয়োগ আটকে আছে। যানজটের কারণে প্রতিদিন মানুষের হাজার হাজার শ্রমঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। বিশুদ্ধ পানির অভাব প্রকট। এসব সমস্যা নিয়ে কোনো সংগঠনের মাথাব্যথা নেই। জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য সোচ্চার না হয়ে অর্থ উপার্জনকারী খাতগুলো নিয়ে টানাহেঁচড়া শুরু করেছে চক্রটি। তারা আইনের মারপ্যাঁচে এসব খাতের উন্নয়ন স্থবির করে দেওয়ার চক্রান্তে নেমেছে। তারা দেশ, জাতি ও সরকারের বিরুদ্ধে কোন মাত্রার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, তা এখনই নিরূপণ করা জরুরি বলে তাঁরা মন্তব্য করেন।
বেসরকারি আবাসিক প্রকল্পের ভূমি উন্নয়ন বিধিমালা ২০০৪ প্রণয়ন করে বিগত বিএনপি তথা জোট সরকার। এ বিধিমালায় স্ববিরোধী কিছু বিষয় থাকায় এটি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বর্তমান সরকার বিপাকে পড়ে। ফলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বিধিমালাটি যুগোপযোগী করার। এর অংশ হিসেবে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি একাধিক বৈঠক করে নতুন নতুন প্রস্তাবও দেয়। কিন্তু অদৃশ্য কারণে সেই প্রস্তাব সংযোজন করে এখন পর্যন্ত বিধিমালাটি চূড়ান্ত করা হচ্ছে না। এর পেছনেও সেই চক্রের অদৃশ্য হাত থাকতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
রাজউকের হিসাব অনুযায়ী আবাসিক উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় দুই শতাধিক উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে রাজউক ২৬টি প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে। বাকি ১৭৪টি প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। এগুলোর অনুমোদনও দেওয়া হচ্ছে না, আবার স্পষ্ট করে কিছু বলাও হচ্ছে না। ফলে প্রকল্পগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন। জাতীয় অর্থনীতিতে আবাসন খাতের অবদান শতকরা ২১ ভাগ। এ খাতে বিনিয়োগ করা টাকার ৩০ শতাংশ এসেছে প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছ থেকে। তাঁরা ২১ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। এসব খাতে সরাসরি প্রায় ৫০ লাখ শ্রমিক কাজ করছে। এই ৫০ লাখ শ্রমিকের সঙ্গে জড়িত প্রায় আড়াই কোটি মানুষ। এসব মানুষের অন্নসংস্থান হচ্ছে উল্লিখিত উন্নয়ন প্রকল্পগুলো থেকেই। আবাসন ও ভূমি উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত ৩০০টি শিল্প উপখাত। এসব খাতেও বিনিয়োগ করা হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা। এ শিল্পগুলোতে প্রত্যক্ষভাবে কাজ করছে দেড় কোটি এবং পরোক্ষভাবে এর ওপর নির্ভরশীল তিন কোটি মানুষ। তাদের সঙ্গে জড়িত প্রত্যেকের পরিবার। আবাসিক এবং ভূমি উন্নয়নকাজ কোনোভাবে ব্যাহত হলে কোটি কোটি লোক বেকার হয়ে যাবে। চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়বে এই শ্রমিকদের পরিবার।
ঢাকা মহানগরের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান পর্যালোচনার জন্য সরকারের গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি ১৬টি আবাসন প্রকল্প ও স্থাপনা এবং দুই হাজার ৭২৪টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে ড্যাপের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ (নন-কনফর্মিং) হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কমিটি প্রকল্পগুলোর অনুমোদন না দিতে এবং শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো সরিয়ে নেওয়ার সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে ছয়টি সরকারি ও ১০টি বেসরকারি প্রকল্প রয়েছে। ড্যাপ নিয়ে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা বিস্তারিত প্রতিবেদন দিয়েছে। ওই প্রতিবেদনে ড্যাপ বাস্তবায়িত হলে সরকার রাজনৈতিকভাবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হবেÑএ আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ড্যাপ বাস্তবায়িত হলে আগামী ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিসিসি) ও সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ কারণে ঢাকা ও এর আশপাশের ২৯টি সংসদীয় আসনের সংসদ সদস্যরা ড্যাপ মেনে নিতে পারছেন না। সরকারদলীয় সদস্যরাও ড্যাপের প্রচণ্ড বিরোধিতা করছেন। এই ড্যাপ বাস্তবায়ন করতে হলে পাঁচ লাখেরও বেশি স্থাপনা ভাঙতে হবে। এতে জাতীয় অর্থনীতির ওপরও ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ড্যাপের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত বিপুলসংখ্যক মানুষ সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠবে। এই সুযোগে বিরোধী দলও একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মধ্যে সরকারকে ঠেলে দেওয়ার সুযোগ পাবে। ফলে ঢাকার বর্তমান অবকাঠামোগত অবস্থাকে আমলে নিয়ে ভবিষ্যতের জন্য করণীয় নির্ধারণ করা প্রয়োজন।
চার পৃষ্ঠার ওই গোপন প্রতিবেদনের শিরোনাম ‘রাজধানী ঢাকার ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) বাস্তবায়নে প্রতিকূলতা প্রসঙ্গে’। সরকার যাতে বিপাকে না পড়ে এ জন্য গোয়েন্দা সংস্থার তরফ থেকে কিছু সুপারিশও তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনের ৫ নম্বর অনুচ্ছেদে ‘মন্তব্য ও সুপারিশ’ শীর্ষক উপশিরোনামের ‘ক’ থেকে ‘চ’ পর্যন্ত রয়েছে ছয়টি সুপারিশ। একটিতে বলা হয়েছে, ড্যাপ বাস্তবায়িত হলে আর্মি হাউজিং সোসাইটি প্রকল্প বাধাগ্রস্ত হবে। এতে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের মনোবলে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা আছে, যা বর্তমান সরকারের প্রতি তাঁদের আস্থা অর্জনের ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। কিছু এনজিও পরিবেশ রক্ষার নামে সরকারকে দিয়ে এসব কাজ করিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। তারা সফল হলে দেশের অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ব্যবসায়ীরা সরকারের বিরুদ্ধে চলে যাবেন। এনজিওগুলো মূলত পরিকল্পিতভাবে সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবসায়ীদের খেপিয়ে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। শুধু ব্যবসায়ী নয়, সাধারণ মানুষকেও নানাভাবে উত্তেজিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে তারা। ইতিমধ্যে গাজীপুরসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষ রাস্তায় নেমে এসে এর প্রমাণ দিয়েছে। কাজেই এসব এনজিও কাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য কাজ করছে, তারা কাদের নীলনকশা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে মাঠে নেমেছে, তা এখনই খুঁজে বের করা প্রয়োজন এবং একই সঙ্গে এমন পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, যাতে এ ধরনের এনজিওগুলো আর সরকার ও জনগণকে বিভ্রান্ত করতে না পারে।
নতুন করে বিদ্যুৎ এবং গ্যাস সংযোগ না দেওয়ায় চরম সংকটে পড়েছে দেশের গৃহায়ণ শিল্প। এ কারণে প্রায় পাঁচ হাজার ফ্ল্যাট খালি পড়ে আছে, যার অর্থমূল্য হচ্ছে তিন হাজার কোটি টাকা। এসব ফ্ল্যাট কেনার জন্য চার হাজারের বেশি ক্রেতা বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। ফলে ক্রেতাদের একদিকে বাড়ি ভাড়া, অন্যদিকে ব্যাংকের ঋণের কিস্তি একসঙ্গে পরিশোধ করতে হচ্ছে। বিদ্যুৎ সংযোগের অভাবে তিন শতাধিক নতুন প্রকল্পের অধীন তিন হাজার ৬০০ অ্যাপার্টমেন্টের কাজ সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। ফলে প্রত্যক্ষভাবে প্রায় অর্ধলক্ষ শ্রমিক বেকার হয়ে গেছে। ক্ষতির শিকার হয়েছে দুই লাখের বেশি মানুষ। গৃহায়ণ শিল্প খাতের বর্তমান অবস্থা দেখে নতুন ক্রেতারা এগিয়ে আসতে ভয় পাচ্ছেন। এ কারণে ফ্ল্যাট বিক্রি আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। কমেছে গৃহায়ণ শিল্পে প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিনিয়োগ। গৃহায়ণ শিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা চরম সংকটের মধ্যে পড়েছেন। তাঁরা বিনিয়োগ তুলেও আনতে পারছেন না। অথচ এসব বিষয় নিয়ে কোনো সংগঠন প্রতিবাদ করছে না।
বিএলডিএর মহাসচিব মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন এ প্রসঙ্গে কালের কণ্ঠকে বলেন, পরিবেশ রক্ষা যেকোনো সুনাগরিকের দায়িত্ব। সচেতন নাগরিক মাত্রই পরিবেশ রক্ষার বিরোধিতা করতে পারেন না। তবে পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের বিষয়টি অবশ্যই বিবেচনায় আনতে হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন, বিশ্বব্যাপী পরিবেশদূষণের জন্য দায়ী শিল্পোন্নত অনেক দেশ পরিবেশবিষয়ক বিশ্ব সনদে স্বাক্ষর করেনি। যুক্তরাষ্ট্র কিয়োটো প্রটোকলে স্বাক্ষর করেনি। এশিয়ার বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীন এবং উন্নয়নশীল দেশের কাতারে প্রথম দিকে থাকা ভারতও পরিবেশ রক্ষার নামে উন্নত দেশগুলোর চাপিয়ে দেওয়া শিল্পবিরোধী শর্ত মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। কেননা রাষ্ট্রীয়ভাবে তারা মনে করেছে, পরিবেশ রক্ষা যেমন জরুরি, এর চেয়ে অনেক বেশি জরুরি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। এই সমৃদ্ধি নিশ্চিত করেই পরিবেশ রক্ষা করা উচিত। তিনি বলেন, মিল-কারখানা বন্ধ করে দিয়ে দেশের অর্থনীতি ধ্বংস করে, বেকারত্ব বৃদ্ধির মাধ্যমে মানুষকে অসহায়ত্বের দিকে ঠেলে দিয়ে, তাদের বুভুক্ষু রেখে পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন মানবতার সঙ্গে পরিহাস ছাড়া কিছুই নয়। মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ হলেই কেবল পরিবেশ রক্ষার জন্য আন্দোলন করা যৌক্তিক হবে বলে মনে করেন বিএলডিএর মহাসচিব। তিনি বলেন, বিশুদ্ধ পানির অভাবে পানিবাহিত রোগের প্রকোপ বাড়ছে। এতে শিশুমৃত্যুসহ নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য কারো তেমন জোরালো উদ্যোগ নেই। এসব সংগঠন আছে শুধু উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করার কাজে।
বাংলাদেশ স্টিল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শেখ ফজলুর রহমান বকুল কালের কণ্ঠকে জানান, স্টিল মিলগুলোর কাঁচামালের বড় অংশই আসে জাহাজ ভাঙা শিল্প থেকে। জাহাজ আমদানি বন্ধ থাকায় কাঁচামালের অভাবে প্রায় ২০০ কারখানা ইতিমধ্যে বন্ধ হয়েছে। চালু থাকা ২০০ কারখানাও কাঁচামালের সংকটে ভুগছে। তিনি বলেন, ‘৩০-৪০ বছর ধরে জাহাজ ভাঙা হচ্ছে। পরিবেশ রক্ষার নামে হঠাৎ করে জাহাজ আমদানি বন্ধ করে দেওয়া মোটেই সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। আমরাও চাই পরিবেশসম্মতভাবে এ শিল্প গড়ে উঠুক। এ জন্য হঠাৎ সিদ্ধান্ত না নিয়ে কয়েক বছর ধরে এ শিল্পকে পরিবেশবান্ধব করে গড়ে তুলতে সরকারের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল।’
বাংলাদেশ রি-রোলিং মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. আলী হোসাইন কালের কণ্ঠকে জানান, বেলা নামের একটি এনজিও এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে জাহাজ আমদানি বন্ধ থাকায় রি-রোলিং মিলগুলো কাঁচামাল সংকটে ভুগছে। কাঁচামালের অভাবে এ খাতের ৩০০ কারখানার মধ্যে ১৮০টিই এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি বলেন, সরকারের এদিকে নজর দেওয়া উচিত। বছরে মাত্র দু-একটি বর্জ্যবাহী জাহাজ সমুদ্রে বর্জ্য ফেলে। কিন্তু ইয়ার্ডে কখনো ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্যবাহী জাহাজ আসে না। উন্নত দেশগুলো এত দিন পরিবেশ দূষণ করে শিল্পোন্নত হয়েছে। এখন তারা পরিবেশ রক্ষায় মনোযোগ দিচ্ছে। আর বাংলাদেশের মতো একটি দেশ পরিবেশ রক্ষার নামে শিল্প খাত ধ্বংস করছে। তিনি আরো বলেন, ডাইং ও ফিনিশিং কারখানাগুলো থেকে যে পরিমাণ ক্ষতিকর রাসায়নিক নদীতে পড়ছে, জাহাজ ভাঙা শিল্প থেকে এর চার ভাগের এক ভাগ দূষণ ঘটছে না।

শেয়ারবাজারে- বিশেষ গোষ্ঠীর কারসাজি!

Friday, January 21, 2011

দেশের শেয়ারবাজার চরম এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। অব্যাহত দরপতনের ফলে লাখ লাখ সাধারণ বিনিয়োগকারী এখন সর্বস্বান্ত হওয়ার পথে। এরই মধ্যে গত বৃহস্পতিবার ধরা পড়েছে অভিনব কারসাজির ঘটনা। বেরিয়ে আসছে আরো অনেক তথ্য। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত সেপ্টেম্বর মাসে ‘একটি গোষ্ঠী’ শেয়ারবাজারে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে শুরু করে।

নামে-বেনামে বিপুলসংখ্যক বিও অ্যাকাউন্ট খুলে তারা বিপুল পরিমাণ শেয়ার কিনে মূল্যবৃদ্ধি ঘটায় এবং একপর্যায়ে মুনাফা নিয়ে সটকে পড়ে। এ ছাড়া কর্তৃপক্ষের কিছু সিদ্ধান্তও শেয়ারবাজারকে অস্থিতিশীল করে বলে বিভিন্ন সূত্র জানায়। গতকাল শুক্রবার অর্থমন্ত্রীও স্বীকার করেছেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ তাঁরও এ ক্ষেত্রে কিছু ভুল ছিল।
১৯৯৬ ও ২০১১ সালÑদুই বারই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। তাই ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের কেউ কেউ এ দুই কেলেঙ্কারির দায় আওয়ামী লীগের কাঁধে চাপাচ্ছে। বিষয়টিকে পুঁজি করতে চাইছে প্রধান বিরোধী দলও। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই শেয়ারবাজারে কেলেঙ্কারি হয়। নিজেদের দলের লোকদের টাকা বানানোর সুযোগ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে অতিমুনাফার ফাঁদ পেতে সাধারণ মানুষকে শেয়ারবাজারে ডেকে আনে। আর সুযোগ মতো টাকা উঠিয়ে বাজার থেকে সরে পড়ে। পথে বসে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।
আবার অনেক বিনিয়োগকারী বলছে, বিএনপিপন্থী একটি গোষ্ঠী অব্যাহতভাবে এ কারসাজি করে যাচ্ছে, যাতে ১৯৯৬ সালের মতো আরেকটি কেলেঙ্কারির ঘটনা আওয়ামী লীগ সরকারের ঘাড়ে চাপানো যায়। বিশ্লেষক থেকে শুরু করে বহু বিনিয়োগকারী বলছে, এসব কেলেঙ্কারির ঘটনায় কারা জড়িত একটু সক্রিয় হলেই নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা খুঁজে বের করতে পারে। শেয়ারের লেনদেনের হিসাব পর্যালোচনা করলেই অস্বাভাবিক লেনদেনকারী ব্যক্তি, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও ব্রোকারেজ হাউস শনাক্ত করা সম্ভব। কেউ কেউ এমনও বলছেন, ২০-২৫ জনের সংঘবদ্ধ একটি দল শেয়ারবাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা উঠিয়ে দেশের বাইরে পাচার করেছে। খোদ ডিএসই সভাপতি গত বৃহস্পতিবার এ ঘটনার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি করেছেন। অনেক দেরিতে হলেও এসইসি সন্দেহভাজন ব্রোকারেজ হাউসগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে।
‘একটি গোষ্ঠীর কাজ’ : এ বছরের সেপ্টেম্বর মাসের শুরুর দিকে একটি গোষ্ঠী শেয়ারবাজারে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে শুরু করে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র দাবি করেছে। ডিএসইর সাধারণ মূল্যসূচক সাড়ে ছয় হাজারের কাছাকাছি থাকা অবস্থায় চক্রটি কয়েকটি মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউসের মাধ্যমে ওই টাকা বিনিয়োগ শুরু করে। এর আগে এসব প্রতিষ্ঠানে নামে-বেনামে বিপুলসংখ্যক বিও অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত এসব অ্যাকাউন্ট খোলা ও বিনিয়োগ করা হয়। এসব বিও অ্যাকাউন্টে প্রতিদিন ২০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার শেয়ার কেনা হয়। এর মাধ্যমে প্রতিদিনই তালিকাভুক্ত বেশির ভাগ কম্পানির শেয়ারের দর বাড়ানো হয়। এর প্রভাবে তিন মাসের ব্যবধানে ডিএসইর সাধারণ সূচক প্রায় আড়াই হাজার পয়েন্ট বেড়ে প্রায় ৯ হাজারের ঘরে পৌঁছে।
পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো এ চক্রটি সম্পর্কে দিয়েছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। তাদের দাবি, বৃহস্পতিবার শাস্তি পাওয়া ছয়টি প্রতিষ্ঠানের কেউ কেউসহ আরো অনেক ব্রোকারেজ হাউসের মালিক বিএনপিপন্থী হিসেবে পরিচিত। তবে তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হয় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক একজন সভাপতিসহ আওয়ামী লীগপন্থী হিসেবে পরিচিত ব্রোকারেজ হাউসের কয়েকজন মালিক। তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন অতি মুনাফার লোভে শেয়ারবাজারকে অস্বাভাবিক ফুলিয়ে-ফাপিয়ে তুলতে ভূমিকা রাখেন। তাঁদের মধ্যে একজন সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ঘনিষ্ঠতা কাজে লাগিয়ে ডিএসইর নেতৃত্বে নিজের প্রভাব বজায় রেখেছেন। আওয়ামীপন্থী হিসেবে পরিচিত ডিএসইর সামনের সারির অধিকাংশ নেতার বিরুদ্ধে ১৯৯৬ সালের কেলেঙ্কারির মামলা রয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর একাধিক কম্পানির শেয়ারের দর বৃদ্ধির পেছনেও তাঁদের কারসাজি রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তাঁরা পুঁজিবাজারে প্রবেশমুখে সরাসরি তালিকাভুক্ত ও বুকবিল্ডিং পদ্ধতিতে তালিকাভুক্ত কয়েকটি কম্পানির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
গত ডিসেম্বরের কিছু ঘটনাকেও আজকের পরিস্থিতির জন্য দায়ী করছেন অনেক বিনিয়োগকারী। গত ৬ ও ৭ ডিসেম্বর এসইসির চেয়ারম্যান জিয়াউল হক খোন্দকারের অনুমোদন ছাড়াই কমিশন সদস্য মনসুর আলম চেক ও নেটিং সুবিধা-সংক্রান্ত দুটি নির্দেশনা জারির ব্যবস্থা করেন। চেয়ারম্যানের বিদেশ সফরের কারণে ওই সময় মনসুর আলম ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে কাজ করছিলেন। এসইসির এ নির্দেশনাটি ৭ ডিসেম্বর নজিরবিহীনভাবে ডিএসইর ওয়েবসাইটে মোট আটবার প্রদর্শন করা হয়। ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বড় রকমের বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে চেকের মাধ্যমে অর্থ জমা দেওয়া যাবে নাÑএ ধরনের গুজবে বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। পরদিন লেনদেন শুরুর পর বাজারে বড় ধরনের ধস নামে। সোয়া এক ঘণ্টার মধ্যে ডিএসই সাধারণ সূচক আগের দিনের চেয়ে ৫৪৬ পয়েন্ট কমে যায়। এ ঘটনায় এসইসি চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে। ঘটনার জের ধরে গত ১২ জানুয়ারি মনসুর আলম পদত্যাগ করেন।
অনেক বিনিয়োগকারী মনসুর আলমকে বলে থাকে বিএনপিপন্থী। প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচয় প্রদানকারী ডিএসইর সাবেক ওই সভাপতির সঙ্গে মনসুর আলমের বিশেষ ঘনিষ্ঠতার কথা তখন ডিএসই ও এসইসিতে আলোচনার খোরাক ছিল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এসইসির এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, মনসুর আলমকে দিয়ে ওই নির্দেশনা জারি করাতে ডিএসইর ওই সাবেক সভাপতি বিশেষ ভূমিকা রাখেন। এই নির্দেশনা জারির আগেই তিনি নিজের পোর্টফোলিও থেকে সব শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন বলেও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। ৮ ডিসেম্বরের পর থেকে যে দরপতন ও অস্থিরতা তৈরি হয়, এরই পরিণতিতে ২০ জানুয়ারির সর্বশেষ দরপতন ও লেনদেন বন্ধের ঘটনা ঘটে।
গত বৃহস্পতিবারের দরপতনের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ছয়টি ব্রোকারেজ হাউসের লেনদেন কার্যক্রম এক মাসের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাদের এক মাসের জন্য দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। চার দিন বন্ধ হয়ে গেছে শেয়ারবাজারের লেনদেন। রবিবারও বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে লেনদেন। হয়তো এ বন্ধের মেয়াদ আরো বাড়ানো হবে।
ব্যাংকের দায় : বাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুঁজিবাজারের মুনাফার বেশির ভাগ টাকা আসলে চলে গেছে মুদ্রাবাজারে। গত বছর ব্যাংকগুলোর মুনাফার সিংহভাগই আসে পুঁজিবাজার থেকে। আলাদা কম্পানি হওয়ার আগ পর্যন্ত মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো বেশ কিছু সুবিধা ভোগ করে। ফলে নিজেদের চ্যানেল থেকে তারা নিজেদের ডিলার অ্যাকাউন্টে ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পোর্টফোলিওতে মার্জিন ঋণের মাধ্যমে ব্যাপক হারে বিনিয়োগ করে। সেখান থেকেই মুনাফা আসে ব্যাপক। কোনো কোনো মার্চেন্ট ব্যাংক ২০০ থেকে ৪০০ কোটি টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করে। কিন্তু ডিসেম্বরের পরে আলাদা সাবসিডিয়ারি কম্পানি করার পর এসব ব্যাংকের ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগের সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। একই সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কয়েকটি সার্কুলার জারি করে। ফলে কমে যায় ব্যাংকের বিনিয়োগ। এর প্রভাব পড়ে পুঁজিবাজারে। বিভিন্ন সূত্র মতে, শেয়ারবাজারের কিছু সংঘবদ্ধ চক্রও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি নিজেদের অর্থ তুলে নেয়। ফলে বাজার হয়ে পড়ে অর্থশূন্য।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সভাপতি শাকিল রিজভী গত বৃহস্পতিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, পুঁজিবাজারের বেশির ভাগ টাকা চলে গেছে মুদ্রাবাজারে। আর একটি অংশ তুলে নিয়েছে কারসাজি চক্র। ২০ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলন থেকে তিনি এ চক্রের বিরুদ্ধে তদন্তের দাবি করেন।
কারণ আরো আছে : নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসির কয়েকটি সিদ্ধান্তের প্রভাবেও এ পতন ত্বরান্বিত হয় বলে মনে করা হচ্ছে। এ ছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বার্ষিক হিসাব সমাপনী (ইয়ার ক্লোজিং), আইনসীমার অতিরিক্ত অর্থ প্রত্যাহারে বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোরতা আরোপ, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা শিল্পঋণের টাকা ফেরতের সময় বেঁধে দেওয়া, ব্যাংকের নগদ জমা সংরক্ষণের (সিআরআর) হার বৃদ্ধি এবং মার্জিন ঋণ সংকোচন করার প্রভাবও পড়ে বাজারে। এদিকে ডিসেম্বরের মধ্যে ব্যাংকগুলোর মার্চেন্ট ইউনিটকে আলাদা সাবসিডিয়ারি কম্পানি করা হয়েছে। ব্যাংকিং নিয়ম অনুযায়ী পরিশোধিত মূলধনের ১৫ শতাংশের বেশি কোনো কম্পানিকে ঋণ দেওয়ার নিয়ম নেই। ফলে তারাও বিনিয়োগ আর বাড়াতে পারছে না।
ডিএসইর সভাপতি এ প্রসঙ্গে কালের কণ্ঠকে বলেন, একসঙ্গে এতগুলো সিদ্ধান্ত আরোপের কারণেও বাজার অস্থিতিশীল হয়েছে।
কাগুজে বনাম ইলেকট্রনিকস : ১৯৯৬ সালে অল্প কয়েক দিনের মধ্যে কৃত্রিমভাবে কয়েকটি কম্পানির শেয়ারের দাম বাড়িয়ে তা বিক্রি করে বাজার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছিল। ১৯৯৬ সালে ছিল কাগুজে শেয়ার, এবার ইলেকট্রনিক শেয়ার। এবার এক বছর ধরে শেয়ারের দাম বাড়ার ঘটনা ঘটে। বাজার থেকে সরে পড়তে সময় নিয়েছে প্রায় এক মাস। তবে এবারের ভয়াবহ ঘটনা হচ্ছে, স্বেচ্ছায় লোকসান দিয়ে বাজারদরের চেয়ে অনেক কম দামে শেয়ার বিক্রির করে দেওয়া, যা গত বৃহস্পতিবার ধরা পড়েছে কর্তৃপক্ষের নজরদারিতেও।
১৯৯৬ সালে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ছিল ১০ হাজার। আর দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাধারণ মূল্যসূচক ছিল ২০০০ পয়েন্ট। গড়ে প্রতিদিনের লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৩০০ কোটি টাকা। কম্পানির সংখ্যাও ছিল কম। এবার বিও অ্যাকাউন্টধারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৩ লাখ। মূল্যসূচক ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে সর্বোচ্চ ৮৯০০ পয়েন্টে ওঠে। ডিএসইতে প্রতিদিনের লেনদেনের গড় দাঁড়ায় প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। বাজার মূলধনের পরিমাণ তিন লাখ পাঁচ হাজার কোটির ওপরে ওঠে। তবে বাজারে ধারাবাহিক পতনের ফলে গড় লেনদেন ও বাজার মূলধন দুই-ই অনেক কমে গেছে।
১৯৯৬ সালের শেয়ার কেলেঙ্কারির ঘটনায় মামলা হলেও এর বিচার হয়নি আজও। আদালতের স্থগিতাদেশের পর বিচার কার্যক্রম থেমে আছে। এ মামলার বিচার কার্যক্রম নিষ্পত্তি করার উদ্দেশ্যে বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে একটি সংসদীয় কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ওই কমিটি এখন পর্যন্ত কোনো কার্যক্রম শুরু করেনি বলে জানা গেছে। তদন্ত কার্যক্রমের দুর্বলতার কারণে এ মামলার পরিণতি নিয়েও দেখা দিয়েছে সংশয়।
 
Support : Dhumketo ধূমকেতু | NewsCtg.Com | KUTUBDIA @ কুতুবদিয়া | eBlog
Copyright © 2013. Edu2News - All Rights Reserved
Template Created by Nejam Kutubi Published by Darianagar Publications
Proudly powered by Dhumketo ধূমকেতু