Home » , , » শেয়ারবাজারে লাগাতার দরপতন, বিশেষজ্ঞরাও ধোঁয়াশায় by টিটু দত্ত গুপ্ত

শেয়ারবাজারে লাগাতার দরপতন, বিশেষজ্ঞরাও ধোঁয়াশায় by টিটু দত্ত গুপ্ত

Written By Unknown on Saturday, September 24, 2011 | 9:32 PM

রকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর নানামুখী পদক্ষেপের পরও শেয়ারবাজার কেন স্থির হচ্ছে না, তা বিশেষজ্ঞদেরও বোধগম্য নয়। 'স্বাভাবিক' অবস্থার সংজ্ঞা নিয়েও তাঁরা নিশ্চিত নন। সর্বশেষ ধ্বংসের আগের অবস্থা অর্থাৎ সূচকের ৮৯১৯ পয়েন্ট যদি 'স্বাভাবিক' অবস্থার মাপকাঠি হয়, তাহলে দেশের শেয়ারবাজার কবে নাগাদ সে অবস্থায় পেঁৗছাবে, এ ব্যাপারে কোনো ধারণা নেই তাঁদের। তবে তাঁদের পরামর্শ, বর্তমানে সূচক যেভাবে হিসাব করা হয়, তাতে শেয়ারবাজারের প্রকৃত চিত্র ফুটে ওঠে না। সূচক নিয়ে বিচলিত না হয়ে লগি্নকারীদের উচিত কম্পানির মৌল ভিত্তি বিবেচনায় নিয়ে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া ও অপেক্ষা করা। ঋণের টাকায় নয়, নিজের সঞ্চয়ের একটি নিরাপদ অংশ দিয়েই যেন তারা শেয়ার কেনে।

বিশ্লেষকদের মতে, বাজারে নতুন করে আস্থাহীনতা তৈরি হওয়ার মতো কোনো ঘটনা দেশের অর্থনীতিতে ঘটেনি। বিক্ষোভকারীদের নানা দাবি মেনে নেওয়ার পর সরকারেরও আর তেমন কিছু করার নেই। তবে অর্থমন্ত্রীর আগের ঘোষণা অনুযায়ী সরকারি শেয়ার জরুরি ভিত্তিতে বাজারে ছাড়ার তাগিদ দিয়েছেন তাঁরা। বাজারে যখন এমনিতেই শেয়ারের দাম পড়ছে, তখন কম্পানির উদ্যোক্তাদের শেয়ার বিক্রির হিড়িক শেয়ারের দামের নিম্নগতিকে ত্বরান্বিত করছে। তা ছাড়া বাজারে ওই কম্পানি সম্পর্কে সাধারণ লগি্নকারীদের মনে একটি নেতিবাচক ধারণাও তৈরি করছে বলে তাঁরা মনে করছেন।
শেয়ারবাজার হবে শিল্প স্থাপন ও অবকাঠামো নির্মাণের জন্য অর্থায়নের বিকল্প উৎস, যা ব্যাংকের ওপর চাপ কমাবে_এমনিটিই আশা দেশের ব্যক্তি খাতের উদ্যোক্তাদের। কিন্তু বাস্তবে শেয়ারবাজার নিজেই হয়ে পড়েছে ব্যাংকনির্ভর। 'তারল্য সংকটের' কথা বলে হাত গুটিয়ে নিয়েছেন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা। আর পড়তি দামেই নিজেদের শেয়ার বেচে বাজার থেকে বের হতে চাইছেন কম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকরা। তারল্য সংকট নিরসনের দাবিতে বিক্ষোভ-ভাঙচুরের প্রেক্ষাপটে গত সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকগুলোর একক ঋণ সমন্বয়ের সময়সীমা এক বছর বাড়িয়ে দিল। তার পরও শেয়ারের দামের পতন থামছে না। এ অবস্থায় মন্দাবস্থা হয়তো প্রলম্বিত হবে_এমন আশঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না বিশ্লেষকদের কেউ কেউ।
বাজারের এমন আচরণের কারণ বুঝে উঠতে পারছেন না তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, 'বাজারে কেন এ রকম অবস্থা চলছে তা বলা মুশকিল।'
শেয়ারবাজারের জন্য সরকারের আর কী করার আছে জিজ্ঞেস করা হলে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এঙ্চেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) সাবেক এ চেয়ারম্যান বলেন, সরকার এখন যা করতে পারে সেটি হলো, দ্রুতগতিতে সরকারি শেয়ার বাজারে ছাড়া। এতে সরবরাহের ঘাটতি কিছুটা কমবে। ড. মির্জ্জা আজিজ বলেন, 'আমি মনে করি, নতুন শেয়ার আসা দরকার। যেকোনো আইপিও এলেই ওভার-সাব্সক্রাইব্ড হয়। এতে বাজারে নতুন অর্থ আসবে।' ইনডেঙ্ (সূচক) দেখে বিনিয়োগ না করার পরামর্শও দিলেন তিনি।
অর্থনীতিবিদ ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, শেয়ারবাজারের বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র দৃশ্যমান উপায় হচ্ছে ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমিয়ে দেওয়া। তিন প্রশ্ন করেন, 'ব্যাংকে টাকা রেখে যদি ১৪ শতাংশ সুদ পাওয়া যায় তাহলে মানুষ কেন শেয়ারবাজারে আসবে?' তবে তাঁর ধারণা, আইএমএফের চাপে সরকার বা বাংলাদেশ ব্যাংক তা করতে পারবে না, ফলে শেয়ারবাজারে মন্দাবস্থারও দ্রুত অবসান হবে না।
শেয়ারবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক ড. ওসমান ইমাম বলেন, শেয়ারবাজারে ব্যাংকগুলো আগেই বিপুল অঙ্কের বিনিয়োগ করেছিল। এটি কমিয়ে আনার জন্য তাদের খুব কম সময় দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তিনি মনে করেন, চার থেকে পাঁচ বছর সময় পেলে ব্যাংকগুলো নিজেদের গুটিয়ে আনতে পারত, বাজারেও প্রভাব পড়ত না। শেয়ারবাজারকে শিল্পে অর্থায়নের বিকল্প উৎস হিসেবে গড়ে তোলার সত্যিকারের ইচ্ছা সরকার বা নিয়ন্ত্রক সংস্থার আছে বলে মনে করেন না ড. ওসমান। তিনি বলেন, বাজেটেও এ ব্যাপারে কোনো দিকনির্দেশনা নেই।
লন্ডন স্টক এঙ্চেঞ্জে সাম্প্রতিক মন্দাবস্থার সময় বড় বড় কম্পানি বাজার থেকে নিজেদের শেয়ার কিনে নিয়েছে। দাম পড়ে যাওয়ায় শেয়ারহোল্ডারদের ধারণকৃত শেয়ারের মূল্যমান সমান রাখা বা বাড়ানোর জন্যই এ শেয়ার কিনে নেওয়া হচ্ছে বলে কম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে জানানো হয়। অথচ বাংলাদেশে একদিকে যখন সরকার শেয়ার বাই-ব্যাক আইন কঠোর করার উদ্যোগ নিচ্ছে, অন্যদিকে তখন ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এঙ্চেঞ্জে কম্পানির পরিচালকরা মন্দার বাজারে শেয়ার বিক্রি করে চলেছেন। গত এক সপ্তাহে অন্তত ১৩টি কম্পানির পরিচালকরা তাঁদের হাতে থাকা ৭০ লাখেরও বেশি শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে প্রায় ১২১ কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন।
এ ব্যাপারে মির্জ্জা আজিজ বলেন, বাজারের এ অবস্থায় তাঁরা নিজেরাই যদি নিজেদের শেয়ার বিক্রি করে দেন তাহলে বাজারে ভুল সংকেত যাবে। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মনে সংশ্লিষ্ট কম্পানি সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হবে।
১৯৯০ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জের (ডিএসই) সাধারণ সূচক ছিল ৫০০ পয়েন্টের নিচে। '৯৬-এর জুলাই মাসে তা ১০০০-এর ঘর অতিক্রম করে চার মাসের মাথায় সূচক ৩০০০ পয়েন্ট ছাড়িয়ে যায়। চার মাসের মাথায় আবার নেমে আসে ৯৫০-এর কোটায়। এর মধ্যে ঘটে যায় বাংলাদেশের উঠতি শেয়ারবাজারের প্রথম ভয়াবহ ধস, অসংখ্য ব্যক্তি লগি্নকারীর সারা জীবনের সঞ্চয় চলে যায় গুটিকয়েক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে। তারপর আট বছর লেগেছে সূচকের ১০০০-এর ঘর পার হতে। ২০০৪-এর ডিসেম্বরে একবার ২০০০ ছুঁই ছুঁই করলেও ২০০৬ সালের জুলাই মাস নাগাদ সূচক পড়ে যায় ১৪০০ পয়েন্টে। অবশ্য পরের দেড় বছরে অর্থাৎ ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে ডিএসইর মূল্যসূচক আবার পেঁৗছায় ৩০০০-এ। ওঠা-নামার মধ্য দিয়ে ২০০৯-এর মার্চে সূচক ২৫০০-এর নিচে নেমে এলেও পরের ২০ মাস ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জের শুধুই উল্লম্ফন। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে দেশের শেয়ারবাজারের ইতিহাসের সর্বোচ্চ ৮৯১৯ পয়েন্ট ছোঁয় ডিএসই জেনারেল ইনডেঙ্ বা ডিজেন। এ উত্থান যেন ঘটেছিল পতনের জন্যই। মাত্র দুই মাসের মাথায়, অর্থাৎ চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে এটি নেমে আসে ৫২০০-এর ঘরে। এর মধ্যে রাস্তায় ব্যাপক বিক্ষোভ, তদন্ত কমিটি গঠন ও নির্ধারিত সময়ের আগেই তার প্রতিবেদন পেশ, দেরিতে হলেও সেই প্রতিবেদনের আলোর মুখ দেখা, প্রতিবেদন অনুযায়ী বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া, কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়াসহ বাজেটে ঘোষিত কিছু পদক্ষেপ, সবশেষে শেয়ারবাজারে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বাড়তি বিনিয়োগ কমিয়ে আনার সময় বাড়ানো। এক একটি উদ্যোগের পর সূচকের ঊর্ধ্বমুখী নড়াচড়া, পরের দিন আবার নিম্নমুখিতা, রাস্তায় বিক্ষোভ।
গত সপ্তাহে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জে (ডিএসই) বাজার মূলধন কমেছে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। সাধারণ মূল্যসূচক পাঁচ হাজার ৯৬৬.৫১ পয়েন্ট নিয়ে গত সপ্তাহের লেনদেন শুরু হয়েছিল ডিএসইতে। আর সপ্তাহের শেষে এসে মূল্যসূচক দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৬৫২.৩২ পয়েন্ট। ফলে এক সপ্তাহের ব্যবধানে সূচক কমেছে ৩১৪.১৯ পয়েন্ট। শেষ দিন হরতালে রাজধানীতে বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকলেও ডিএসইর সূচক অবশ্য ২.৮৮ পয়েন্ট বেড়ে ৫৬৫২.৩২ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।
গত সপ্তাহে ঢাকার স্টক মার্কেট এলাকায় যখন শেয়ারবাজারে ব্যাংকের অর্থ সরবরাহ বাড়ানোর দাবিতে বিক্ষোভ চলছিল, তখন বিক্ষোভকারীরা নিউ ইয়র্ক স্টক এঙ্চেঞ্জ ও ওয়ালস্ট্রিট দখলের ঘোষণা দিয়ে দাবি করেছে, দেশের এক শতাংশ লোভী ও দুর্নীতিবাজ মানুষের কাছে ৯৯ শতাংশ মানুষ জিম্মি হয়ে থাকতে পারে না। দেশের অর্থনীতির নীতি শুধু এক শতাংশ মানুষের সুখের জন্য রচিত হতে পারে না।
ব্যাংকের টাকা দিয়ে শেয়ারবাজার টিকিয়ে রাখার দাবির যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজ। তাঁর মতে, শেয়ার মার্কেট হবে শিল্পে অর্থায়নের একটি নির্ভরযোগ্য উৎস। এখন ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে এটি চলছে। ব্যাংকের টাকা আমানতকারীদের সম্পদ। এটি বিনিয়োগ করার কথা উৎপাদনমুখী খাতে, শেয়ারবাজারের মতো ঝুঁকিপূর্ণ খাতে ব্যাংকের অর্থ বিনিয়োগের একটি নিরাপদ সীমারেখা থাকতে হবে। অথচ তারল্য সংকটের কথা বলে ব্যাংকের আরো টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের দাবি তোলা হচ্ছে। এর যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ নেই।
বিশ্বজুড়েই শেয়ারবাজারে মন্দা চলছে। চলতি মাসে আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এ নিয়ে বিক্ষোভ হয়েছে। তারা অর্থনীতিতে মন্দার কারণে দেশগুলোতে নেওয়া নানা কৃচ্ছ্র কর্মসূচির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছে। তবে কোথাও রাস্তায় বিক্ষোভ করে শেয়ারবাজারের পতন ঠেকানোর জন্য ব্যাংক থেকে অর্থ সরবরাহ বাড়ানোর দাবি জানানো হয়নি। আমেরিকার নিউ ইয়র্কে গত সপ্তাহে বিক্ষোভ হয়েছিল দুর্নীতি আর লোভের হাত থেকে অর্থনীতিকে রক্ষা করার দাবিতে।

0 comments:

Post a Comment

 
Support : Dhumketo ধূমকেতু | NewsCtg.Com | KUTUBDIA @ কুতুবদিয়া | eBlog
Copyright © 2013. Edu2News - All Rights Reserved
Template Created by Nejam Kutubi Published by Darianagar Publications
Proudly powered by Dhumketo ধূমকেতু