বৈশ্বিক অর্থনীতি- অধিকাংশ মানুষের স্থায়ী দুর্দশা by জোসেফ স্টিগলিৎস

Wednesday, February 12, 2014

২০০৮ সালে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেওয়ার পরপরই আমি সতর্ক করে বলেছিলাম, সঠিক নীতি গ্রহণ করা না হলে জাপানের মতো বছরের পর বছর ধরে ধীর প্রবৃদ্ধি ও আয়-উপার্জনের ক্ষেত্রে প্রায়-স্থবিরতা সৃষ্টি হতে পারে।
তখন আটলান্টিকের উভয় তীরের নেতারা দাবি করেছিলেন যে তাঁরা জাপানের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়েছেন, কিন্তু কার্যত দ্রুতই তাঁরা একই ধরনের ভুলভ্রান্তির পুনরাবৃত্তির দিকে অগ্রসর হন। এখন যুক্তরাষ্ট্রের একজন গুরুত্বপূর্ণ সাবেক কর্মকর্তা অর্থনীতিবিদ ল্যারি সামার্স পর্যন্ত এমন সতর্কতা উচ্চারণ করছেন যে একটা দীর্ঘমেয়াদি স্থবিরতা দেখা দিতে পারে।

আধা দশক আগে আমি যে বিষয়টি উত্থাপন করেছিলাম, তার মূল কথাটি ছিল মৌলিক অর্থে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি রুগ্ণ হয়ে পড়েছিল, এমনকি সংকট শুরু হওয়ার আগেই। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি হয়ে উঠেছিল একটা সম্পদ-মূল্যের বুদ্বুদ, যা সৃষ্টি হয়েছিল শিথিল ব্যবস্থাপনা/নিয়ন্ত্রণ ও সুদের নিম্ন হারের কারণে। এ দুয়ের ফলে অর্থনীতিটাকে বেশ হূষ্টপুষ্ট দেখাচ্ছিল। কিন্তু উপরিতলের নিচে, ভেতরে ভেতরে অসংখ্যা সমস্যা ঘনিয়ে উঠছিল। যেমন, ধনী-দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য আরও বেড়ে চলেছিল, কাঠামোগত সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার দিকে দৃষ্টি দেওয়া হচ্ছিল না (কলকারখানায় উৎপাদনভিত্তিক অর্থনীতি থেকে সেবামুখী অর্থনীতির দিকে যাওয়া, বৈশ্বিক পরিসরে তুলনামূলক সুযোগ-সুবিধাগুলোর পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা); দীর্ঘস্থায়ী বৈশ্বিক ভারসাম্যহীনতা; এমন এক আর্থিক ব্যবস্থা, যেখানে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি, উৎপাদনশীলতা বাড়ানো এবং সামাজিক কল্যাণ বাড়ানোর লক্ষ্যে উদ্বৃত্ত সম্পদের পুনর্ব্যবহার করার পরিবর্তে ফাটকা বাজারি অধিকতর সুবিধাজনক।
সেসব সংকটের ব্যাপারে নীতিনির্ধারকেরা যা করেছেন, তাতে সংকট মেটেনি। আরও খারাপ কথা হলো, তাঁদের কৃতকর্মের ফলে কিছু সংকট তীব্রতর হয়েছে, নতুন আরও কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে এবং তা শুধু যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। ফলে, অনেক দেশের জিডিপিতে ধস নেমে সরকারের রাজস্ব আয় কমে গিয়েছে এবং তাদের ঋণ গ্রহণ বেড়েছে। উপরন্তু, সরকারি ও বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমে যাওয়ার ফলে এমন এক তরুণ প্রজন্ম সৃষ্টি হয়েছে, যারা বছরের পর বছর কর্মহীন অলস দিন পার করেছে এবং জীবনের একটা পর্যায়ে উৎপাদনক্ষেত্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে; অথচ তাদের তখন দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা কাজে লাগানোর সময়।
আটলান্টিকের উভয় পারে ২০১৩ সালের তুলনায় সামনের দিনগুলোতে জিডিপি উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যেসব নেতা কৃচ্ছ্রসাধনের নীতিকে আলিঙ্গন করেছিলেন, তাঁরা এবার উল্লাসে শ্যাম্পেনের বোতল খুলতে পারেন। কিন্তু সেটা করতে যাওয়ার আগে তাঁদের ভালো করে খতিয়ে দেখা উচিত এখন আমাদের অবস্থা কী; তাঁদের গৃহীত সেসব নীতির ফলে যে প্রায়-অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়েছে, সেটাও বিবেচনায় নেওয়া উচিত।
প্রত্যেক নিম্নমুখী প্রবণতাই একটা পর্যায়ে গিয়ে থেমে যায়। এ রকম ক্ষেত্রে একটা ভালো নীতি হয় সেটাই, যা গ্রহণের ফলে সেই নিম্নমুখী প্রবণতা বেশি গভীরে যেতে পারে না এবং বেশি সময় স্থায়ী হতে পারে না। যেসব দেশের সরকার কৃচ্ছ্রসাধনের নীতি গ্রহণ করেছিল, সেসব দেশে অর্থনীতির নিম্নমুখী প্রবণতা অনেক গভীর পর্যন্ত গেছে এবং বেশি দীর্ঘ হয়েছে, যার পরিণতিগুলো হবে দীর্ঘমেয়াদি। কিন্তু এ রকম হওয়া অনিবার্য ছিল না।
উত্তর আটলান্টিকের অধিকাংশ দেশে ২০০৭ সালে মাথাপিছু প্রকৃত (মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয়কৃত) জিডিপি ছিল বেশ কম; গ্রিসে অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছে প্রায় ২৩ শতাংশ। ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে সফল অর্থনীতির দেশ জার্মানিতে ছয় বছর ধরে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে গড়ে মাত্র শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে সংকটের আগে যে সামান্য হারে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হচ্ছিল, তা অব্যাহত থাকলে আজ এ অর্থনীতির যে আকার দাঁড়াতে পারত, এখন তার থেকে প্রায় ১৫ শতাংশ ছোট এ অর্থনীতি।
কিন্তু পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে এসব পরিসংখ্যানে প্রকৃত চিত্রটা ফুটে ওঠে না; কারণ সাফল্য পরিমাপের ভালো সূচক জিডিপি নয়। গৃহস্থালির আয়-উপার্জনের ক্ষেত্রে কী ঘটছে, সেটা বরং অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। সিকি শতক আগে, ১৯৮৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রকৃত গৃহস্থালি আয় (মিডিয়ান রিয়্যাল ইনকাম) যা ছিল, এখন তার থেকে কম; আর আজ থেকে ৪০ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রে একজন সার্বক্ষণিক পুরুষ শ্রমিকের আয় (মিডিয়ান ইনকাম) যা ছিল, এখন তার থেকে কম।
অর্থনীতিবিদ রবার্ট গর্ডনের মতো কেউ কেউ বলেছেন, বিগত শতাব্দীজুড়ে দীর্ঘমেয়াদি উৎপাদন প্রবৃদ্ধির যে হার ছিল, তার থেকে যথেষ্ট কম প্রবৃদ্ধি হবে—এমন এক নতুন বাস্তবতার সঙ্গে আমাদের খাপ খাইয়ে নিতে হবে। অর্থনীতিবিদদের কর্মকাণ্ডের শোচনীয় রেকর্ড—যা কিনা ২০০৮ সালের সংকটের প্রাক্কালে ফুটে উঠেছিল—তিন বছরের পূর্বাভাস সত্ত্বেও এমন আস্থা বোধ করা উচিত হবে না যে, কেউ বলতে পারেন ভবিষ্যতের দশকগুলোতে কী ঘটবে। কিন্তু এটা পরিষ্কার বলেই মনে হয়: সরকারের নীতিগুলো পরিবর্তন করা না হলে আমরা সুদীর্ঘ সময় ধরে নৈরাশ্যব্যঞ্জক পরিস্থিতির মধ্যেই থেকে যাব।
বাজারের এমন শক্তি আছে যে তা নিজেই নিজেকে শুধরে নিতে পারে। কিন্তু আমি ওপরে যে অন্তর্নিহিত মৌলিক সমস্যাগুলোর কথা বললাম, সেগুলো খারাপ থেকে আরও খারাপের দিকে যেতে পারে। অনেক সমস্যার ইতিমধ্যে আরও অবনতি ঘটে গেছে। অসমতার ফলে চাহিদা দুর্বল হয়ে যায়; অসমতার বিস্তার ঘটলে চাহিদা আরও বেশি দুর্বল হয়। যুক্তরাষ্ট্রসহ অধিকাংশ দেশে অর্থনৈতিক সংকটের ফলে অসমতা শুধুই বেড়েছে।
উত্তর ইউরোপে বাণিজ্যিক উদ্বৃত্ত বৃদ্ধি পেয়েছে, এমনকি চীনেরও কিছুটা বেড়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বাজারগুলোর অবস্থা কখনোই এত ভালো হয়নি যে সেগুলো আপনা থেকেই কাঠামোগত রূপান্তর দ্রুত অর্জন করতে পারে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, কৃষি থেকে ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের দিকে যাত্রা কখনোই মসৃণ হয়নি। উল্টো বরং এই রূপান্তরের সঙ্গে সঙ্গে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় সামাজিক স্থানচ্যুতি ও মহা মন্দা ঘটেছে।
এবারও ভিন্ন কিছু ঘটছে না; বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটা আরও খারাপ হতে পারে। যেসব খাতে প্রবৃদ্ধি ঘটা উচিত, যেগুলোতে নাগরিকদের চাহিদা ও আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে, সেগুলো হচ্ছে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো সেবা খাত। এই সেবা খাতগুলো ঐতিহ্যগতভাবে অর্থ বরাদ্দ পেয়ে এসেছে রাষ্ট্রের কাছ থেকে এবং তা যুক্তিসংগত কারণেই। কিন্তু সরকার এসব খাতে রূপান্তরকে সহযোগিতা করার পরিবর্তে কৃচ্ছ্রসাধনের মাধ্যমে বাধাগ্রস্ত করছে।
অর্থনীতিতে পশ্চাদপসরণ বা মন্দনের থেকে রুগ্ণতা বা ব্যাধি বরং ভালো। কিন্তু আমরা এখন যেসব সমস্যার মুখোমুখি, সেগুলো অর্থনীতির অনিবার্য, অমোঘ নিয়মকানুনের ফল নয়। ভূমিকম্প বা সুনামির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর সঙ্গে আমরা যেভাবে খাপ খাইয়ে চলি, এই সমস্যাগুলোর ক্ষেত্রেও আমাদের তা-ই করা উচিত। এগুলো মোকাবিলা করা অতীতের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার মতোও নয়; যদিও নিশ্চিত করে বলতে গেলে, গত তিন দশকজুড়ে যে নয়া-উদারপন্থী নীতিগুলো প্রাধান্য চলে এসেছে, আজকের অবস্থার জন্য সেগুলোর দায় বিরাট।
আমাদের চলমান সমস্যাগুলো ভুল নীতিমালার ফল। বিকল্প আছে। কিন্তু যেসব অভিজাত লোকের আয় বেড়ে চলেছে, যারা আবার শেয়ারমার্কেটে ফুলেফেঁপে উঠছে, তাদের আত্মতুষ্টির মধ্যে আমরা সেই বিকল্পগুলো খুঁজে পাব না। শুধু যা ঘটবে তা হলো, জীবনযাত্রার আরও নিম্নমানের সঙ্গে স্থায়ীভাবে খাপ খাইয়ে নিতে হবে কিছু মানুষকে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, এই কিছু মানুষই হলো অধিকাংশ মানুষ।
ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
জোসেফ স্টিগলিৎস: নোবেল পুরস্কারে ভূষিত মার্কিন অর্থনীতিবিদ; যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক।

রাজনীতি ও অর্থনীতি- ব্যাংকঋণ পুনর্বিন্যাসের প্রণোদনা by ফারুক মঈনউদ্দীন

Tuesday, February 4, 2014

বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি এবং নীতি বিভাগ (বিআরপিডি) অতিসম্প্রতি দুটো সার্কুলারের মাধ্যমে মেয়াদোত্তীর্ণ এবং খেলাপি ঋণ পুনর্গঠন,
পুনঃ তফসিলীকরণ এবং ডাউন পেমেন্ট আদায়ের ব্যাপারে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে কিছুটা নমনীয় হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। উভয় সার্কুলারে স্বীকার করা হয়েছে দেশের অস্থিতিশীল (রাজনৈতিক) পরিস্থিতির কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি ও শিল্প খাতের উপকরণ ও পণ্যের স্বাভাবিক পরিবহন বিঘ্নিত হয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিরূপ প্রভাব পড়ছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ঋণ পরিশোধে সক্ষমতা হারাচ্ছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প।

এমন পরিস্থিতিতে অর্থনীতির সব খাতের ঋণখেলাপি হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এই বিবেচনায় ঋণগ্রহীতা এবং ঋণদানকারী ব্যাংক—উভয় পক্ষের নাজুক অবস্থার কথা বিবেচনা করে এই দুই সার্কুলারের মাধ্যমে ডাউন পেমেন্ট আদায়, সুদের হার নির্ধারণ এবং ঋণ পুনর্গঠন কিংবা পুনঃ তফসিলীকরণের বিষয়টি যৌক্তিক পর্যায়ে রাখার শর্ত সাপেক্ষে ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তবে এসএমই কিংবা কৃষিঋণ ছাড়া অন্যান্য ঋণের মেয়াদকাল পুনর্গঠন করার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদন নিতে হবে। উল্লেখ্য, এই শিথিলতার সুযোগ গ্রহণের মেয়াদ ৩০ জুন ২০১৪ সাল পর্যন্ত বলবৎ থাকবে।
স্মরণে থাকার কথা, ২০০৯ এবং ২০১০ সালে ভোগ্যপণ্য, ইস্পাত—এসব খাতে বিশ্বমন্দার কবলে পড়ে বহু আমদানিকারক ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হলেও শেয়ারবাজারের উল্লম্ফনের সময় এবং পতনের আগে পর্যন্ত ব্যাংকগুলো এই বাজার থেকে প্রচুর মুনাফা তুলে নিতে পেরেছিল। ২০১০ সালের শেষ প্রান্তে এসে শেয়ারবাজারের সেই মাতাল বুদ্বুদ বিস্ফোরিত হলে বহু অসতর্ক ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী প্রায় পথে বসে যান, তার সঙ্গে আটকা পড়ে যায় বিভিন্ন ব্যাংকের বিপুল ঋণ। বিশ্বের পণ্য বাজারের পতনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের আটকে পড়া ঋণের সঙ্গে যুক্ত হয় শেয়ারবাজারে লগ্নি করা ঘোষিত এবং অঘোষিত বিপুল ঋণ। এই ঋণের মধ্যে সাধারণ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের ভোক্তা ঋণ যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে ভিন্ন দিকে সরিয়ে নেওয়া ব্যবসায়িক ঋণ।
এমন পরিস্থিতির ধারাবাহিকতায় ব্যাংকগুলো যখন খেলাপি ঋণ ব্যবস্থাপনায় কঠিন সময় পার করছিল, তখন ২০১২ সালের শেষে খেলাপি ঋণ পুনঃ তফসিলীকরণ, মেয়াদ নির্ধারণ এবং ডাউন পেমেন্ট আদায়ের নিয়মগুলো আরও কঠোর করা হয়। সেই নতুন নীতিমালায় মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ ৯০ দিনের সীমা অতিক্রম করলেই ‘নিম্নমান’ শ্রেণীকৃত হয়ে পড়ে, যার সীমা আগে ছিল ১৮০ দিন। একইভাবে আগের ২৭০ দিনের মেয়াদোত্তীর্ণ ‘সন্দেহজনক’ ঋণের সময়সীমা কমিয়ে করা হয় ১৮০ দিন এবং ৩৬০ দিনের মেয়াদোত্তীর্ণ ‘মন্দ’ শ্রেণীর মেয়াদ কমিয়ে করা হয় ২৭০ দিন।
ঋণ শ্রেণীকরণের এই কঠোরতর নীতিমালার কারণে বহু মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ দ্রুত শ্রেণীকৃত হয়ে পড়ে এবং প্রাথমিক ধাপের শ্রেণীকৃত ঋণগুলো আচমকা পরবর্তী বিরূপ ধাপে নেমে যায়। শ্রেণীকরণের আইন পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব প্রতিফলিত হয়েছিল ব্যাংকগুলোর ২০১২ সালের হ্রাসকৃত মুনাফায়। অথচ সে সময় ব্যবসায়ী মহল এবং ব্যাংকগুলোর অধিকাংশই ২০০৮-পরবর্তী বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য হ্রাসের ধকল সামলাতে ব্যস্ত। তবু একটি আন্তর্জাতিক মানের শ্রেণীকরণ নীতিমালা প্রবর্তনের স্বার্থে স্থিতিপত্রে বিরূপ ফলাফল সত্ত্বেও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিবর্তিত নীতিমালা বাস্তবায়ন করতে তৎপর হয়েছিল। তবে তার জন্য ২০১৩ সালে নতুন মাত্রায় উন্নীত হয়েছিল ব্যাংকিং খাতের মোট শ্রেণীকৃত ঋণ।
উল্লেখ্য, ২০১২ সালের ডিসেম্বরে সমাপ্ত বছরে ব্যাংকিং খাতের নিট মুনাফা কমেছিল ১০৪ শতাংশ, যার প্রধান কারণ ছিল খেলাপি ঋণের উল্লম্ফন। মুনাফা হ্রাসের এই হার বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতে ছিল ২৮ শতাংশ, অর্থাৎ সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতেই মূলত মুনাফা হ্রাস পেয়েছিল সবচেয়ে বেশি হারে। এখানে একটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য যে ২০১১ এবং ২০১২ উভয় বছরেই ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফা ছিল ১৯,৭০০ কোটি টাকা, অথচ নিট মুনাফা ছিল যথাক্রমে ৯,১০০ এবং ৪,৪০০ কোটি টাকা। দুই বছরে একই পরিমাণ পরিচালন মুনাফা থাকা সত্ত্বেও নিট মুনাফার এই বিশাল পার্থক্য থেকে সহজেই বোঝা যায়, ২০১২ সালের পরিচালন মুনাফার একটা বিশাল অংশ চলে গিয়েছিল শ্রেণীকৃত ঋণের বিপরীতে সংস্থান বাবদ। কারণ, কেবল বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বেড়ে গিয়েছিল প্রায় ৮১ শতাংশ। (সাধারণ পাঠকদের জন্য জানানো প্রয়োজন, খেলাপি বা মন্দ ঋণের বিপরীতে পরিচালন মুনাফা থেকে নির্দিষ্ট হারে কুঋণ সংস্থান রাখতে হয়, যার ফলে কমে যায় নিট মুনাফা)।
এ ছাড়া বিরূপ বিনিয়োগ পরিবেশ, তারল্যসংকট, আমানতের উচ্চ সুদ ব্যয়, আমদানি বাণিজ্যে ভাটা—এসব কারণে ২০১২ সাল ব্যাংকগুলোর জন্য খুব সুখকর বছর ছিল না। তার সঙ্গে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো যুক্ত হয় হল-মার্ক কেলেঙ্কারি, যা ব্যাংকগুলোকে আরও নাজুক পরিস্থিতিতে ঠেলে দেয়। এ রকম বিরূপ পরিস্থিতিতেও বিভিন্ন মহলের চাপ উপেক্ষা করে ঋণ শ্রেণীকরণ এবং পুনঃ তফসিলীকরণ নীতিমালা কঠোরতর করার উদ্যোগ বাস্তবায়ন করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
২০১২ সালের ডিসেম্বরে বাড়তি শ্রেণীকরণের চাপ হজম করে ব্যাংকগুলো নতুন বছর শুরু করার পরপরই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়কে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে শুরু হয় রাজনৈতিক অস্থিরতা। এই অস্থিরতা পর্যবসিত হয় তাণ্ডবে, যার বৈশিষ্ট্য ছিল পরিকল্পিত নাশকতা। লক্ষণীয়, এই নাশকতা পরিচালিত হয়েছে অবকাঠামো—যেমন রেললাইন, সড়ক, ট্রেন ও যানবাহন, বিদ্যুৎকেন্দ্র, সরকারি দপ্তর ইত্যাদির বিরুদ্ধে। সবচেয়ে অপূরণীয় ক্ষতি করা হয়েছে দেশের বৃক্ষ সম্পদের।
নজিরবিহীন এই সহিংসতা, জাতীয় ও ব্যক্তিগত সম্পদের ধ্বংসযজ্ঞ ইত্যাকার তৎপরতায় দেশের পরিস্থিতি যেমন ছিল উত্তাল, তেমনি স্থবির ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য। ফলে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগবিমুখ হয়ে পড়েন, বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা কমে যায় উদ্বেগজনক হারে। তার বিরূপ প্রভাব পড়ে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের ওপর। আগের বছরের বাড়তি শ্রেণীকৃত ঋণের বোঝা বাড়লেও নতুন ঋণ বিতরণ প্রায় স্থবির হয়ে পড়ে। ২০১৩ সালের নভেম্বরে ব্যাংকগুলোর বাড়তি তারল্যের পরিমাণ দাঁড়ায় ৮৬ হাজার কোটি টাকা, জানুয়ারিতে যা ছিল ৬০ হাজার কোটি টাকা, এ রকম অলস তহবিল ব্যাংক বা অর্থনীতির জন্য কোনোভাবেই মঙ্গলকর নয়।
রাজনীতি কখনোই অর্থনীতিকে বাদ দিয়ে চলতে পারে না। একসময় বাণিজ্য, উৎপাদন ও বণ্টন, জাতীয় আয় ও সম্পদ ইত্যাদির সঙ্গে সরকার ও কানুনের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করার শাস্ত্রটিরই নাম ছিল রাজনৈতিক অর্থনীতি। সুতরাং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে রাষ্ট্র ও সরকার তথা রাজনীতি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। আবার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডও পরিচালিত হয় দেশ ও মানুষের কল্যাণের জন্য। কিন্তু ২০১৩ সালের প্রায় পুরোটাজুড়েই একযোগে ও বিচ্ছিন্নভাবে চলেছে বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড, যার কুফল জাতি ভোগ করবে আগামী বছরগুলোতে।
গত বছরের এই অস্থিরতা ও ধ্বংসলীলায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের উৎপাদন ও সুস্থির কর্মকাণ্ডের ধারায় ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে ঋণ পুনর্বিন্যাস ও শ্রেণীকরণের নিয়মাচারে ছাড় দেওয়ার গৃহীত উদ্যোগ থেকে সহজেই অনুমান করা যায়, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং শিল্প ও অর্থনীতির কতখানি ক্ষতি হয়েছে। পুনঃ তফসিলীকরণ, ডাউন পেমেন্ট এবং পুনর্গঠিত মেয়াদ নির্ধারণের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত শিথিল নিয়মাবলি ক্ষতিগ্রস্ত ঋণগ্রহীতাদের কিছুটা অবকাশ দিতে পারে।
এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ করা হবে, নির্যাতিত সংখ্যালঘুরাও বিভিন্নভাবে সহায়তা ও অনুদান পেতে পারেন। তবে ঋণগ্রহীতা নন, কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত বা সর্বস্বান্ত হয়েছেন দেশজুড়ে এমন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর সংখ্যা নগণ্য নয়। এঁদেরও উৎপাদন ও বাণিজ্যের ধারায় নিয়ে আসার জন্য দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। কারণ, অর্থনীতিতে এই অপ্রাতিষ্ঠানিক প্রণোদনাহীন খাতের অদৃশ্য সমধিক গুরুত্ববহ। এ ব্যাপারে এনজিও বা মাইক্রোক্রেডিট প্রতিষ্ঠানগুলো সামাজিক দায়িত্বের আওতায় স্বল্প সুদে সহায়তা প্রদান করতে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এই বিষয়ে দিতে পারে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা।
বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি বা মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ পুনঃ তফসিলীকরণ বিষয়ে যে শিথিলতার অবকাশ দিয়েছে, তার সুফল ঋণগ্রহীতাদের পাশাপাশি ব্যাংকগুলোও ভোগ করতে পারবে। কারণ, এতে শ্রেণীবিন্যাসিত ঋণের হার কমে আসার ফলে মন্দ ঋণ সংস্থানের পরিমাণও হ্রাস পাবে। তবে এই সুযোগের অপব্যবহার করে স্বেচ্ছাখেলাপি এবং ২০১৩-পূর্ব খেলাপি ঋণগুলো যাতে পুনর্গঠিত না করা হয়, সেদিকেও নজর রাখতে হবে। অনেক কিছুর বিনিময়ে আমাদের ব্যাংকিং খাতে আন্তর্জাতিক মানের ঋণ শ্রেণীকরণ এবং প্রকৃত মুনাফা প্রদর্শনের যে স্বচ্ছ নিয়ম চালু হয়েছিল, তা এই শিথিলতার সুযোগে যাতে বিনষ্ট না হয়।

ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার।
fmainuddin@hotmail.com

সিপিডির পর্যালোচনা- অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন না হলে অনিশ্চয়তা থেকেই যাবে

Sunday, January 26, 2014

একটি সুষ্ঠু, আস্থাভাজন, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত দেশের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা থেকেই যাবে বলে মন্তব্য করেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
তার মতে, সঙ্কট দূর করতে হলে রাজনৈতিক বিরোধীদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। আর গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হলে বিনিয়োগেও আস্থার সঙ্কট কাটবে না। গতকাল রাজধানীর ধানমন্ডিতে সিপিডি কার্যালয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি ২০১৩-১৪ দ্বিতীয় অন্তর্বর্তীকালীন পর্যালোচনা বিষয়ক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি। এতে উপস্থিত ছিলেন সংস্থাটির গবেষণা পরিচালক ড. ফাহমিদা হক ও খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন। গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, অস্থিরতা না কাটলে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদের দ্বিধা থেকে যাবে। সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান না হলে আস্থার সঙ্কট কাটবে না। আর এটা যদি না হয় তবে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ হবে না। তিনি আরও বলেন, জনসমর্থনের অভাব ও আস্থার অভাব থাকলে দীর্ঘমেয়াদে সুফল পাওয়া যায় না। তিনি বলেন, আপাতত শান্ত পরিস্থিতি বিরাজ করছে। অনেক বন্ধ ছোটখাটো প্রতিষ্ঠান সচল হচ্ছে। কিন্তু এতে নতুন বিনিয়োগ বাড়বে বলে মনে হয় না। বিনিয়োগ বাড়াতে হলে নীতি সঙ্কট দূর করতে হবে, অচলাবস্থার নিরসন করতে হবে। তিনি বলেন, জনপ্রত্যাশার কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জনে সমঝোতার মাধ্যমে একটি নির্বাচনের প্রত্যাশা সিপিডি’র। ড. দেবপ্রিয় বলেন, গত ছয় মাসে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে গ্রামীণ অর্থনীতি ও দেশীয় শিল্পখাত ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এ জন্য শুধু রপ্তানিমুখী শিল্পকে নয় বরং সব ধরনের শিল্পকে সমান গুরুত্ব দিয়ে বিশেষ প্রণোদনা দিতে হবে। দেশের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গ্রামীণ অর্থনীতি। এর মধ্যে পোল্ট্রি ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের বিশেষ প্রণোদনার আওতায় নিয়ে এসে কৃষি ঋণ বৃদ্ধি ও ভাতার ব্যবস্থা করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। এক প্রশ্নের জবাবে অর্থবছরের প্রথমার্ধে ৪ খাতের আর্থিক ক্ষতির হিসাব তুলে ধরে তিনি বলেন, রেল ও সড়ক যোগাযোগ খাতে ১৬ হাজার ৬৮৯ কোটি, কৃষি ও কৃষিজাত শিল্পখাতে ১৫ হাজার ৮২৯ কোটি, রপ্তানিমুখী বস্ত্রশিল্পে ১৩ হাজার ৭৫০ কোটি ও পর্যটন খাতে ২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার ক্ষতির চিত্র উঠে এসেছে। সিপিডি’র পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে ক্ষতির এই আর্থিক মূল্যায়ন তৈরি করা হয়েছে। মোস্তাফিজুর রহমান গবেষণাপত্র উপস্থাপনের শুরুতেই বলেন, জনপ্রত্যাশা ও অর্থনীতির শক্তির ভিত্তিতে উচ্চ প্রবৃদ্ধির যে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল, সেটি হারিয়ে গেছে। উচ্চ প্রবৃদ্ধির সেই সম্ভাবনা ফিরিয়ে আনা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। তিনি বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দেশের অর্থনীতিকে মাশুল দিতে হচ্ছে। বর্তমানে অর্থনীতির গতি একেবারে শ্লথ হয়ে পড়েছে। ঘোষিত বাজেটের আয় ও ব্যয় উভয় অনেক কমে গেছে। নানা সঙ্কটের কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্যের সহজলভ্য থাকলেও বাংলাদেশের খাদ্য মজুত কমেছে। অপরদিকে খাদ্য মূল্যস্ফীতি অনেক বেড়ে গেছে। এছাড়া, নানা অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে ব্যাংকিং খাত নাজুক অবস্থা পার করছে। এদিকে অস্থিরতার কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হওয়ায় সরকারের রাজস্ব আয়েও বড় ধরনের ধসের মধ্যে পড়েছে।
গবেষণাপত্রে বলা হয়, অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে সরকারের রাজস্ব আদায়, বিদেশী বিনিয়োগ, বৈদেশিক অনুদানসহ বিভিন্ন খাতে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আয় অনেক কম হলেও ব্যয়ের মাত্রা কম থাকায় ঘাটতি নেই। এটি দেশের সার্বিক উন্নয়নের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। তাই আয় এবং ব্যয়ের কাঠামোকে পুনর্গঠন করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাজেটবহির্ভূত ব্যয় বাড়ানো দরকার।
গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশে বর্তমানে খাদ্য মজুত সাড়ে ৯ লাখ টন, যা গত বছরের তুলনায় ৩৮ শতাংশ কম। কৃষি ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি হলেও তা শুধু ধান উৎপাদনে। বাকি শস্যের ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি অনেক কমেছে। শাকসবজির ক্ষেত্রে উৎপাদনকারীরা ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আবার ভোক্তা বাজার থেকে বেশি মূল্যে তা কিনেছে। পোল্ট্রি ও দুগ্ধ খামারিরা ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।
সিপিডি’র দাবি, বিশ্বব্যাপী চালের দাম অনেক কম হলেও বাংলাদেশে তা বেশি। এ জন্য মজুত কমেছে। যাতে ভবিষ্যতে খাদ্য ঘাটতি না হয়, সেজন্য কম দামে বিদেশে বাজার থেকে চাল আমদানির ওপর গুরুত্ব দেয় সিপিডি।
গবেষণায় বলা হয়েছে, গত কয়েক মাসে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অর্থনীতির গতি শ্লথ হয়ে পড়ায় রাজস্ব আহরণে ঘাটতি হয়েছে। সার্বিকভাবে রাজস্ব খাতে প্রবৃদ্ধি ২৫.৩ শতাংশ ধরা হলেও গত ৫ মাসে এখাতে মাত্র ১৪.৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে।
এনবিআরের হিসাব মতে, ৫ মাসে সরকারের রাজস্ব ঘাটতি হয়েছে ৮৫০০ কোটি টাকা। ব্যক্তি করমুক্ত আয়সীমা বৃদ্ধি করা, বিভিন্ন খাতকে করসুবিধা ও করহার হ্রাসের কারণে ঘাটতি বেড়েছে। সার্বিকভাবে রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলেও রাজস্ব আদায়ে ৩০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে। যেটি খুবই দুরুহ কাজ। বছর শেষে রাজস্ব আদায়ে ১৮ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি হবে বলে মনে করছে সিপিডি।
ব্যাংকিং খাতের বিষয়ে সিপিডি বলছে, বেশ কিছু সমস্যার মধ্য দিয়ে চলছে ব্যাংকিং খাত। উচ্চ মাত্রার ঋণ নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঋণ জালিয়াতির পরিমাণ আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। নতুন ব্যাংক এলেও চাহিদা অনুযায়ী প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পায়নি। সার্বিকভাবে অর্থনৈতিক স্থবিরতা থাকায় ঋণের চাহিদা বাড়েনি। কেউ বিনিয়োগ করছে না। ফলে ঋণ নেয়ার মতো কেউ নেই। এ কারণে ব্যাংকগুলোতে তারল্য বাড়ছে, যা ব্যাংকিং খাতকে বেকায়দায়, এমনকি লোকসানের মুখে ফেলতে পারে। গত ৬ মাসে ব্যাংকগুলোতে তারল্য বেড়েছে ৭৩.৮ শতাংশ। এছাড়া, ১৬ শতাংশের বেশি ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও ব্যাংকগুলো মাত্র ১১ শতাংশ বিতরণে সক্ষম হয়েছে।
এদিকে অর্থনৈতিক দুরবস্থার মধ্যে বিদেশী এবং স্থানীয় উভয় বিনিয়োগই অনেক কমে গেছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর প্রান্তিকে এফডিআই হয়েছে ৫৩৮ মিলিয়ন ডলার, যা গত অর্থবছরের তুলনায় মাত্র ১.৩ শতাংশ বেশি। কিন্তু বিনিয়োগ বোর্ডে নিবন্ধিত হওয়ার হার হ্রাস পেয়েছে। স্থানীয় কোম্পানির বিনিয়োগ ২৭ শতাংশ এবং বিদেশী মালিকানা কোম্পানির বিনিয়োগ ১০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। তবে রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে উল্লেখ করে বলা হয়, অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি ১৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেলেও তা শুধু তৈরী পোশাক শিল্পেই বেশি। তৈরী পোশাক শিল্প ছাড়া বাকি সবখাতে মাত্র ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। মার্কিন ও ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশের তুলনায় ভারত, ভিয়েতনাম ও কম্ব্বোডিয়া তাদের পণ্যের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি তিন গুণ বৃদ্ধি করেছে। আর বাংলাদেশ প্রবৃদ্ধি কিছুটা বৃদ্ধি করতে সক্ষম হলেও লভ্যাংশ পাওয়ার ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে।
পুঁজিবাজারের ক্ষেত্রে বলা হয়, এ সময় পুঁজিবাজারে আইপিও’র সংখ্যা বাড়লেও নতুন উদ্যোক্তা কমেছে ১০ শতাংশ। এছাড়া, গবেষণাপত্রে বলা হয়, চলতি অর্থবছরের জুলাই মাস থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পরিবহন, কৃষি, তৈরী পোশাক ও পর্যটন খাতে ৪৯ হাজার ১৭ কোটি ৯২ লাখ টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। যা মোট দেশজ উৎপাদনের ৪.৭ শতাংশ। এর মধ্যে পরিবহনে ১৬ হাজার ৬৮৮ কোটি ৬৫ লাখ, কৃষিতে ১৫ হাজার ৮২৯ কোটি, পোশাক খাতে ১৩ হাজার ৭৫০ কোটি এবং পর্যটন খাতে ২৭৫০ কোটি টাকার লোকসান হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। অর্থনৈতিক বর্তমান অগ্রগতি অব্যাহত থাকলে বছরে শেষে ৫.৮ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে পারে বলে মনে করছে সিপিডি।

অস্থির রাজনীতি, স্থবির অর্থনীতি by আলী ইদ্‌রিস

Saturday, January 25, 2014

সাম্প্রতিককালের হরতাল-অবরোধ ও সহিংসতায় দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি ও শিল্পোৎপাদনের যেমন অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, তেমনি বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি ম্লান হয়েছে।
আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় সাম্প্রতিক সহিংসতার ঘটনাবলী দেশকে হানাহানি, মারামারির দেশ হিসেবে তুলে ধরেছে। তদুপরি একতরফা নির্বাচন দেশের গণতন্ত্র চর্চাকে কলঙ্কিত করেছে বিশ্বের দরবারে বিজিএমই-এর এক প্রতিবেদন মতে দেশের সর্ববৃহৎ শিল্প তৈরী পোশাক খাতে উৎপাদন ও রপ্তানি ব্যাহত হওয়ায় ৯,২৫০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে, রপ্তানি আদেশ কমেছে ৩০-৩৫%, অনেক কারখানার হাতে রপ্তানি আদেশ না থাকায় শ্রমিক ছাঁটাই চলছে অথবা বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে, কোন কোন কারখানা শ্রমিকদের বসিয়ে না রেখে আগামী জুন-জুলাই মাসের কাজ এখনই শেষ করে ফেলছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি হলেও তিন মাসের একটি শূন্যতা সৃষ্টি হবে যদি রপ্তানি আদেশ ৭০% কমে যায়। এফবিসিসিআই-এর প্রতিবেদন মতে চামড়া শিল্পে ৭০০ কোটি টাকা, পোল্ট্রিতে ৩৮২ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। হিমায়িত খাদ্যে ৩৩% রপ্তানি কমেছে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে প্রতি হরতালে ৭৫০ কোটি টাকা, পরিবহন খাতে প্রতিদিন প্রায় ৩০০ কোটি হিসাবে ২০,০০০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে, আবাসন খাতে ৫০% ছাড় দিয়েও ক্রেতা মিলছে না, প্রায় ২০,০০০ ফ্ল্যাট অবিক্রীত পড়ে আছে। এ খাতের ব্যাংক লোন ১৮,০০০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণে পরিণত হতে পারে। সব কিছু বিবেচনায় ব্যবসায়ীদের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিদিন হরতাল-অবরোধে ১৬০০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়। আমার মতে, লাগাতার হরতাল-অবরোধে প্রতিদিন প্রায় ২০০০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়। একটানা হরতাল না হলে একদিনের ক্ষতি পরের ৩ দিনে পুষিয়ে নেয়া যায়, কিন্তু লাগাতার হলে সেটা সম্ভব নয়। কারণ সময়সীমা, পচনশীলতা, উৎপাদন ক্ষমতা, পরিবহন ইত্যাদি বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সব কিছু বিবেচনা করে এফবিসিসিআই বলেছে ২০১৩ সালে ক্ষতি হয়েছে ১০০,০০০ কোটি টাকা। অঙ্কটির কলেবর দেখলে আতঙ্কিত হতে হয়। এই বিরাট ক্ষতি দায়ী রাজনৈতিক দলগুলো বা ক্ষমতাসীন সরকার পুষিয়ে দিতে পারবে কি? না। তাহলে দেশের ও জনগণের ক্ষতি করার অধিকার তাদেরকে কে দিলো? জনগণ ভোটের মাধ্যমে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করেছে দেশের ও জনগণের মঙ্গল সাধনের জন্য, ক্ষতি করার জন্য নয়। বিনিয়োগের পরিস্থিতিও হতাশাব্যঞ্জক। বিদেশী বিনিয়োগ তো নেই-ই, ব্যাংকগুলোতে প্রায় ১,০০,০০০ কোটি টাকা অলস পড়ে আছে, বিনিয়োগের উদ্যোক্তা পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে কু-ঋণ, খেলাপি ঋণ ও অর্থ কেলেঙ্কারির প্রভাবে ব্যাংকগুলো সুদের হার কমাতে পারছে না, সুদের হার কমালে ব্যাংকগুলোকে লোকসান গুনতে হবে। এর মধ্যে নতুন আরও ৮টি ব্যাংক বাজারে এসে অসম প্রতিযোগিতার আবহ সৃষ্টি করেছে। সুতরাং অর্র্থনীতির প্রাণকেন্দ্র এবং পুঁজি ও ঋণ সরবরাহকারী ব্যাংকিং সেক্টর ঝুঁকির মধ্যে আছে। অত্যন্ত দুর্ভাগ্য ও হতাশার বিষয় যে, দেশটি অর্থনৈতিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে নিচ্ছিল, প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়, দারিদ্র্য বিমোচন, জন্ম হার, মিলেনিয়াম লক্ষ্য অর্জন ইত্যাদিতে দ্রুতবেগে অগ্রসর হচ্ছিল, রাজনৈতিক অস্থিরতায় সব কিছু এখন স্থবির হয়ে আছে। এই স্থবিরতা কাটিয়ে উন্নতির পথে গতি পেতে অনেক দিন লেগে যেতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের পরেই বাংলাদেশের অর্থনীতি অগ্রসরমান ছিল, বিরাট আয়তন ও বিশাল জনসংখ্যার দেশ ভারতের প্রবৃদ্ধিও বাংলাদেশের চেয়ে কম ছিল। এবার প্রবৃদ্ধি ৬.৫ থেকে ৬-এ নেমে যেতে পারে। ক্ষমতাসীন সরকারি ও প্রধান বিরোধী দল উভয়ের এখন বিবেক জাগ্রত করা উচিত, যা ক্ষতি হওয়ার হয়েছে, অর্থনীতির ক্ষতি আর নয়। এখন উভয় দলকে সহনশীল হয়ে, ত্যাগ স্বীকার করে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে হবে।

রাষ্ট্র ও অর্থনীতি- নাগরিকের অর্থনৈতিক মুক্তি by সালেহউদ্দিন আহমেদ

Tuesday, December 31, 2013

জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি একটি দেশের মূল লক্ষ্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে দুটি কারণ কাজ করেছিল।
এক. পশ্চিম পাকিস্তান থেকে রাজনৈতিক মুক্তি, আরেকটি হলো অর্থনৈতিক মুক্তি। পাকিস্তান আমলে উন্নয়ন থেকে আমরা ছিলাম বঞ্চিত। ফলে রাজনৈতিক স্বাধিকার ও অর্থনৈতিক মুক্তি দুটিই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মূল উদ্দেশ্য।

নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজ আমরা একটি পর্যায়ে উপনীত হয়েছি। এর মধ্যে বিভিন্ন সরকার ক্ষমতায় এসেছে। ১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে গণতন্ত্র। এরপর সরকার পরিবর্তন হচ্ছে; বিভিন্ন কার্যক্রমও গ্রহণ করা হচ্ছে। উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলেছে রাজনৈতিক দলগুলো। তবে আরও দ্রুত অগ্রগতি অর্জন করা যেত কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সন্দেহ নেই, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর মানুষের মধ্যে উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা আরও বেড়েছে। আমরা এখন অর্থনৈতিক উন্নয়নের যুগসন্ধিক্ষণে এসে পৌঁছেছি।
সময় এসেছে অর্থনৈতিকভাবে মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের কাজ দ্রুত সম্পন্ন করার এবং দেশকে আর্থসামাজিক দিক থেকে আরও এগিয়ে নেওয়ার। বর্তমান সরকার মেয়াদের শেষ দিকে চলে এসেছে। এমন সময়ে সরকার পরিবর্তন এবং আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিবার নির্বাচনের সময় অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ায় অর্থনৈতিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অথচ প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে সামান্য সময় নষ্ট করার সুযোগ নেই। এতে আমরা পিছিয়ে পড়ব। উন্নয়নের পূর্বশর্তই হলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়।
এ নিবন্ধে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, ভবিষ্যতে আমাদের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জগুলোর ওপর দৃষ্টিপাত করব।
হিসাব মিলিয়ে দেখতে হবে, আমরা কতটুকু অর্জন করেছি, কতটুকু ব্যর্থ হয়েছি, কেন ব্যর্থ হয়েছি এবং ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জগুলো কীভাবে মোকাবিলা করব। সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে আত্মপর্যালোচনা করলে সঠিক পথনির্দেশনা আমরা পাব। পরবর্তী সময়ে যে সরকার আসবে, তাদের জন্য একটি দিকনির্দেশনা তৈরি হবে এতে, যাতে তারা ঠিকমতো দেশ পরিচালনা করতে পারে। পথ ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু সবার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এক হওয়া উচিত। আর সেটি হলো, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে বিশ্বদরবারে দ্রুত মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো। মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্যও ছিল এটি।
সামষ্টিক অর্থনীতি পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, আমাদের প্রবৃদ্ধি, অর্থনৈতিক সূচক সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। আমরা যে অবস্থায় উপনীত হয়েছি, তাতে ১৯৯১ থেকে ২০১৩ সালে দেশ পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিটি সরকারের ধারাবাহিক অবদান রয়েছে। তাদের কারও অবদান খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। অন্যান্য দেশের তুলনায় সামষ্টিক অর্থনীতিতে আমাদের স্থিতিশীলতা সন্তোষজনক। বিখ্যাত সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান স্যাকস ২০০৬ সালে ১১টি ‘নিউ ইমার্জিং’ বা উদীয়মান দেশের তালিকায় বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশ রয়েছে এ তালিকায়। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশ আরও এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের প্রবৃদ্ধি মোটামুটি ভালো। চীন-ভারত ৭, সাড়ে ৭, ৮ শতাংশের অধিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আমাদের প্রবৃদ্ধি এ পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারিনি। তবে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। কিছুটা কমেছে, তবে একে সহনীয় করে তুলতে হবে। ইদানীং খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। মনে রাখতে হবে, উভয় মূল্যস্ফীতি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবন যাপনে প্রভাব ফেলে। সামগ্রিক সূচকে যেমনটা উন্নয়ন করা দরকার ছিল, সেটা আমরা করতে পারিনি। যতটুকু করতে পেরেছি, অর্থাৎ ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধিও খারাপ নয়। এর ফল অবশ্য সুষমভাবে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছায়নি। তাই প্রবৃদ্ধির সুফল সবাই পায়নি। সমস্যা এখানেই। ফলে দিনে দিনে ব্যক্তিগত আয়বৈষম্য বাড়ছে; আঞ্চলিক আয়বৈষম্যও বাড়ছে। অনেকে যুক্তি দেখান, আমাদের মাথাপিছু জিডিপি এক হাজার ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এটি সত্য, তবে সেখানেও শুভংকরের ফাঁকি রয়েছে। কেউ মাসে পাঁচ লাখ টাকা আয় করছে, কেউবা পাঁচ হাজার। গড় করলে বেশি তো দেখাবেই। পোশাকশিল্পের শ্রমিকের কথাই ধরুন। তাঁরা কি এক হাজার ডলার আয় করেন? এ ধরনের গড় মাথাপিছু আয় সুষম উন্নয়ন নির্দেশ করে না।
মানতে হবে, এদিক দিয়ে আমরা অনেক পিছিয়ে রয়েছি। সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচকে আরও উন্নতি করতে হবে আমাদের। উন্নয়নের বিকেন্দ্রীকরণ করে বিভিন্ন অঞ্চলে তা বণ্টন করতে হবে। এটি করা না গেলে সামাজিক অস্থিরতা বাড়বে। এখন পোশাকশিল্পে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে। তারা নানাভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করছে। এটি গণতন্ত্রের জন্য ইতিবাচক নয়।
তৃণমূল মানুষের কথায় আসি। ব্যাংক, ইনস্যুরেন্স প্রভৃতি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এ পর্যায়ের মানুষের কাছে অর্থ পৌঁছায়। এখন দারিদ্র্যের হার কমেছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের অর্জন প্রশংসিত হবে। এগুলো হঠাৎ হয়নি। ধারাবাহিকভাবে অর্জিত হয়েছে। স্বাস্থ্য খাতেও আমাদের অগ্রগতি ভালো। গড় আয়ু বেড়েছে। এটি ভারতের তুলনায় ভালো। সহাস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনেও আমরা এগিয়ে। তবে কিছু লক্ষ্য অর্জনে আমাদের বেগ পেতে হবে। প্রথমেই আয় বৃদ্ধি করতে হবে। স্বাস্থ্য খাতেও কয়েকটি লক্ষ্য, বিশেষ করে পুষ্টির ঘাটতি পূরণে চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এখনো দেশের অধিকাংশ শিশু অপুষ্টির শিকার। চরাঞ্চল ও দুর্গম অঞ্চলে এখনো পুষ্টির ঘাটতি রয়ে গেছে।
শিক্ষার হার বেড়েছে, কিন্তু এর মান বাড়েনি। শিক্ষা উপকরণের মান বাড়েনি, বাড়েনি শিক্ষকের মান। শিক্ষকদের বেতনকাঠামোর উন্নয়ন হয়নি। বাংলাদেশের মতো দেশে বাজেটের বিরাট অংশ ব্যয় হওয়া উচিত শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন খাতে দুর্নীতি ও অদক্ষতার কারণে বরাদ্দকৃত অর্থেরও সদ্ব্যবহার হচ্ছে না। ফলে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তা ও মানবসম্পদ উন্নয়নে বাড়তি বরাদ্দের পাশাপাশি ব্যয়ের মানোন্নয়ন ও দুর্নীতি দূর করতে হবে। সে জন্যই গুণগত স্বাস্থ্যসেবার পরিধি (বিশেষ করে দরিদ্রদের জন্য), শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে তেমন বরাদ্দ নেই। এ কারণে জনসম্পদ উন্নয়নে আমরা অনেকটা পিছিয়ে রয়েছি।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান যেমন ব্যাংক, বিমা খাতে নানা অব্যবস্থাপনা, তদারকির অভাব ও কিছু প্রতিষ্ঠানের একচ্ছত্র আধিপত্যের কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সেভাবে উন্নয়ন ঘটছে না এবং সাধারণ জনগোষ্ঠীর কল্যাণের জন্য আশানুরূপ অবদান রাখতে পারছে না তারা। মোটা দাগে, এগুলোই আমাদের বড় সমস্যা। যতই বিনিয়োগের কথা বলা হোক, মনোপলি হলে, গুটিকতক ব্যবসায়ীর নিয়ন্ত্রণ থাকলে, বাজার ব্যবস্থাপনা ঠিকমতো না হলে, উৎপাদনকারীকে ঠিকমতো সেবা দিতে না পারলে টেকসই ও সুষম অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হবে না। রেগুলেটরি প্রতিষ্ঠান যেমন বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন প্রভৃতির তদারকির অভাবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে নজিরবিহীন কেলেঙ্কারি, অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা, শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে। রেগুলেটরি প্রতিষ্ঠানগুলো যথাযথ সততা ও দক্ষতার পরিচয় দিলে উন্নয়ন টেকসই ও সুষম হতো।
আমাদের মূল সমস্যা দুর্নীতি। নজিরবিহীন দুর্নীতির খবর বেরিয়ে আসছে। সক্ষমতা, প্রযুক্তি, অর্থ থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নানা কারণে বিতর্কিত হয়ে পড়ছে। এ চ্যালেঞ্জগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করলে উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যেকোনো ব্যবসার মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হয়। যদিও আমাদের বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতিকে ‘ভালো’ বলা হচ্ছে সংখ্যা বা উপাত্ত দিয়ে। কিন্তু এর আড়ালে অনেক কিছু লুকিয়ে রয়েছে। সংখ্যা ও উপাত্ত দিয়ে অনেক কিছু বোঝানো যেমন যায়, তেমনি প্রকৃত সত্যও আড়াল করা যায়। মূল্যস্ফীতি কমেছে। কিন্তু বাজারে গিয়ে ক্রেতা তার প্রতিফলন দেখছে না, মূল্যস্ফীতি কমে যাওয়ার প্রমাণ মানুষ পাচ্ছে না।
ব্যাংকগুলোয় অস্বাভাবিকভাবে কুঋণ বেড়ে গেছে। কুঋণের বেশির ভাগ বড় মুষ্টিমেয় কিছু প্রতিষ্ঠানের। বিতর্কটা হচ্ছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিয়ে। কোটি কোটি টাকা পাচ্ছেন মুষ্টিমেয় ব্যবসায়ী-শিল্পপতি। আয়ের মতো ঋণ বিতরণেও বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে। স্বল্পসংখ্যক ব্যক্তির কাছে ব্যাংকের ঋণ আটকে থাকার সঙ্গে সঙ্গে দেশের একাংশে অর্থ চলে যাচ্ছে। ব্যক্তিগত আয়বৈষম্যের সঙ্গে আঞ্চলিক বৈষম্যও কমিয়ে আনা যাচ্ছে না।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল নয়। নব্বইয়ের পর থেকে ব্যাংকিং খাতে সংস্কার শুরু হয়েছিল এবং এটি অন্যান্য খাতের চেয়ে অধিকতর সুশৃঙ্খল হয়ে ওঠে। ইদানীং ব্যাংকিং খাতে বেশ কিছু সমস্যা ও দুর্বলতা দেখা দিয়েছে। পরিচালনা পর্ষদের অদক্ষতা ও ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এ ক্ষেত্রে যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারছে না। এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান রাজনৈতিক প্রভাব এবং আমলাতান্ত্রিক অদক্ষতা দূর করতে হবে। সর্বোপরি ব্যাংক ও আর্থিক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে।
প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ সরকারের লক্ষ্য বা নীতি কী? সরকারের কৌশলগুলোয় মারাত্মক কিছু সমস্যা রয়েছে। সরকার অনেক বিষয় আড়াল করার চেষ্টা করে। হল-মার্ক বা বিসমিল্লাহ কেলেঙ্কারি আড়ালের চেষ্টা হয়েছে। এতে সমস্যা বেড়েছে বৈ কমেনি।
বিশ্বমন্দা চলাকালীন ২০০৭-০৮ অর্থবছরেও আমাদের অর্থনৈতিক সূচকগুলো ভালো ছিল। ওই সময় বিশ্বের বড় অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সূচক নেমে গিয়েছিল। দেশের সভরিন রেটিংয়ের সূচক ও সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচকগুলো ভালো থাকলেই সরকারের কর্তাব্যক্তিদের আত্মতুষ্টিতে নিমগ্ন থাকা ঠিক নয়। দেখতে হবে বৃহৎ জনগোষ্ঠী অর্থনৈতিক মুক্তির স্বাদ পাচ্ছে কি না, স্বস্তিতে ও স্বাচ্ছন্দ্যে আছে কি না।
বারবার ভালো প্রবৃদ্ধির কথা বলা হচ্ছে। এটি কোন কোন খাতে অর্জিত হচ্ছে—উৎপাদনশীল নাকি অনুৎপাদনশীল খাতে, তা-ও দেখতে হবে। কারণ, অনুৎপাদনশীল খাতে অর্জিত প্রবৃদ্ধি টেকসই হয় না। দেশে ক্ষুদ্র-মাঝারি-বৃহৎ শিল্পে বিনিয়োগ হচ্ছে কি না, তা-ও বিবেচনায় নিতে হবে। কর্মসংস্থান, সাধারণ মানুষের আয় বাড়ছে কি না, তা-ও বিবেচনায় নিতে হবে। সময় এসেছে সংখ্যাভিত্তিক সূচক, পরিসংখ্যান এবং এসব পর্যালোচনার সঙ্গে গুণগত সূচক, জনগণের ধারণা ও উপলব্ধিকে বিবেচনায় নেওয়ার। এটাকে বলে সার্বিক সূচক, যেটি আরও বৃদ্ধি করতে আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর, অধ্যাপক, নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটি।

খাতুনগঞ্জ- ব্যবসায়িক ঐতিহ্যের সুরক্ষা জরুরি by ফারুক মঈনউদ্দীন

Thursday, December 26, 2013

চট্টগ্রামবাসীকে প্রবোধ দেওয়ার জন্য নামকাওয়াস্তে ঘোষিত ‘বাণিজ্যিক রাজধানী’ চট্টগ্রাম কি অবশেষে তার জৌলুশ এবং ব্যবসায়িক সততার মুকুটটি হারাতে বসেছে? চট্টগ্রামের কেউ কেউ একসময় আহ্লাদের আতিশয্যে যে খাতুনগঞ্জকে বাংলাদেশের
তথা চট্টগ্রামের ‘ওয়াল স্ট্রিট’ বলেও অভিহিত করতেন, যে খাতুনগঞ্জ বা চাক্তাই ছিল মৌখিক অঙ্গীকার রক্ষা এবং ব্যবসায়িক বিশ্বাসের এক উজ্জ্বল উদাহরণ—সেই খাতুনগঞ্জ থেকে হয়তো শিগগির মুখ ফিরিয়ে নেবে ব্যাংকগুলো, অবশিষ্ট থাকবে না পারস্পরিক ব্যবসায়িক বিশ্বাস। কারণ, প্রায় দেড় দশক ধরে খাতুনগঞ্জে একের পর এক ঘটতে থাকা বিভিন্ন প্রতারণামূলক ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ব্যাংকগুলো এবং ব্যবসায়ী সম্প্রদায়।

সম্প্রতি মোজাহের হোসেন নামের প্রতিষ্ঠিত ও বিশ্বস্ত ব্যবসায়ীর বিপুল অঙ্কের ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক ঋণ অপরিশোধিত রেখে গা-ঢাকা দেওয়ার পর নড়েচড়ে বসেছে ব্যাংকগুলো। জানা গেছে, দেশি-বিদেশি মিলিয়ে প্রায় পাঁচটি ব্যাংকের কাছে এই ব্যবসায়ীর প্রতিষ্ঠানের নামে ৪৫০ কোটি টাকার মতো অনাদায়ি মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ রয়ে গেছে। এ ছাড়া চট্টগ্রামের বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে নেওয়া অনাদায়ি ব্যক্তিগত ঋণের পরিমাণও ১৫০ কোটি টাকার মতো। ব্যাংকগুলোর কাছে যৎসামান্য বন্ধকি জমি জামানত হিসেবে থাকলেও অন্যান্য ব্যবসায়ীর কাছ থেকে নেওয়া ঋণের বিপরীতে চেক ছাড়া কিছুই নেই।

বলা বাহুল্য, দেশের আইন সঠিক পথে চললে এবং ঋণগ্রহীতার সততা ও নৈতিক মূল্যবোধ সমুন্নত থাকলে এই চেকই হতে পারত যথেষ্ট শক্ত জামানত। কারণ, চেকে লিখিত অঙ্কের টাকা ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে না থাকার কারণে সেই চেক প্রত্যাখ্যাত হলে দেশের প্রচলিত আইনে (নেগোশিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট অ্যাক্ট) চেকদাতার বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা করা যায়। কিন্তু আমাদের দেশে এ আইনটি বলবৎ থাকলেও এর অধীনে উল্লেখযোগ্য প্রতিবিধান বা শাস্তি হয়েছে, এমন প্রমাণ খুব বেশি নেই। অথচ একসময় খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা কোনো চেকের জামানত ছাড়াই কেবল মুখের কথার ভিত্তিতে কোটি টাকার পণ্য বাকিতে দিয়েছেন।

এখনকার জটিল এবং বিশ্বাসহীনতার যুগে নতুন প্রজন্মের কাছে এসব হয়তো অবাস্তব মনে হবে। ব্যবসায়িক বিশ্বাসের কারণে বিভিন্ন ব্যাংকের খাতুনগঞ্জকেন্দ্রিক শাখাগুলো প্রায় বিনা জামানতে সেখানকার ব্যবসায়ীদের ঋণ দিতে দ্বিধা করত না। এক দশক আগেও ঢাকার তুলনায় প্রায় সবগুলো ব্যাংকের চট্টগ্রামভিত্তিক খেলাপি ঋণ ছিল কম এবং এমনকি কোনো কোনো ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখায় খেলাপি বা শ্রেণীবিন্যাসিত ঋণের পরিমাণ থাকত শূন্য। কোনো ঋণগ্রহীতা অনিবার্য কারণে খেলাপি হয়ে পড়লেও অতি দ্রুত তার নিষ্পত্তি করে ফেলার একটা দায়বদ্ধতা ছিল।

কিন্তু খাতুনগঞ্জের সেই স্বর্ণযুগ আর অবশিষ্ট নেই। খাতুনগঞ্জের ক্ষীয়মাণ জৌলুশ, পরিকল্পনাহীন নাগরিক ও ব্যবসায়িক পরিবেশ এবং ক্রমবর্ধমান অবকাঠামোগত সমস্যার কারণে এখানকার অনেক প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী এ এলাকা ছেড়ে অন্যত্র স্থানান্তরিত হয়েছেন আধুনিক সুসজ্জিত ভবনে। এককালের সওদাগরি সংস্কৃতির পরিবর্তে গড়ে উঠেছে করপোরেট সংস্কৃতি। ঋণখেলাপি হওয়ায় অনেক ব্যবসায়ীকে একাধিক ব্যাংকের সঙ্গে  নামতে হচ্ছে আইনি লড়াইয়ে।      

প্রায় ১৩৮ বছর আগে শেখ মোহাম্মদ হামিদুল্লা খানের পত্নী খাতুন বিবির দান করা জায়গার ওপর যে খাতুনগঞ্জের গোড়াপত্তন হয়েছিল, সেই খাতুনগঞ্জ এবং তার সন্নিহিত এলাকা পরবর্তী সময়ে পরিণত হয়েছিল সমগ্র বাংলাদেশের আমদানি করা পণ্যের প্রায় ৮০ শতাংশের মূল সরবরাহের কেন্দ্র।

প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে হাজার দুয়েক দোকান, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের অফিস এবং বিভিন্ন পণ্যের আড়ত ও গুদাম নিয়ে একদা জমজমাট আমদানিনির্ভর ব্যবসায়িক কার্যক্রমের প্রাণকেন্দ্র ছিল খাতুনগঞ্জ। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কর্ণফুলী নদী হয়ে চাক্তাই খাল দিয়ে পণ্য পরিবহনের সুবিধার কারণে একচেটিয়া উৎকর্ষ লাভ করে খাতুনগঞ্জ প্রসারিত হয় কোরবানীগঞ্জ ও চাক্তাই পর্যন্ত।

প্রাচীন এ বাণিজ্যকেন্দ্রটির মূল কার্যক্রম ছিল আমদানি এবং ইনডেন্টিং (বিদেশি রপ্তানিকারকের দেশীয় প্রতিনিধিত্ব) ব্যবসানির্ভর। অথচ খাতুনগঞ্জ তথা চট্টগ্রামকেন্দ্রিক যে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালিত হতো, তার উদ্যোক্তারা যে খুব উচ্চশিক্ষিত ছিলেন তা নয়; প্রখর ব্যবসায়িক জ্ঞান ও দূরদর্শিতার পাশাপাশি মৌখিক অঙ্গীকার রক্ষা এবং ব্যবসায়িক সততার কারণে তাঁরা গড়ে তুলেছিলেন বিশ্বস্ততার একটি নিরবচ্ছিন্ন ধারা। সাদামাটা বহিরঙ্গের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের একটা অতি সাধারণ গদিঘর বা অফিস নিয়ে খুব সাদাসিধা জীবন যাপন করলেও অতীত প্রজন্মের এঁদের অনেকেই হয়তো নিয়ন্ত্রণ করতেন সারা বাংলাদেশের নির্দিষ্ট কোনো পণ্যের আমদানি, মজুত ও সরবরাহ। এঁদের প্রায় সবাই ছিলেন আর্থিকভাবে সচ্ছল এবং প্রভূত ব্যবসায়িক সুনামের অধিকারী, ফলে তাঁদের সঙ্গে ব্যবসায়িক লেনদেন ঘটত মূলত মৌখিক অঙ্গীকারের ভিত্তিতে।

খাতুনগঞ্জভিত্তিক ব্যবসায়ীরা পণ্য আমদানি করলেও তার বিপণনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। পণ্য বন্দরে পৌঁছার পর কখনো ব্রোকাররা, কখনো বা পাইকারি ব্যবসায়ীরা পণ্যের চাহিদা বুঝে আগাম দিয়ে কিংবা আংশিক বাকিতে ডেলিভারি অর্ডার (ডিও) কিনে নিতেন। যদিও সেই পণ্য হয়তো তখনো বন্দরের শেডে কিংবা অমুক মাঝির গুদামে (উল্লেখ্য, চট্টগ্রামের গুদামগুলোর পরিচিতি হয় কুলিসর্দার বা মাঝিদের নামে)। পরবর্তী সময়ে প্রকৃত পণ্যের কোনো স্থানান্তর ছাড়াই এই ডিও হাতবদলের মাধ্যমে মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীরা পণ্যবিশেষে লাখ থেকে কোটি টাকা মুনাফা অর্জন করতে পারতেন।

উল্লেখ্য, এসব কেনাবেচা কখনো কেবল মুখের কথা বা টেলিফোন কিংবা নিদেনপক্ষে একটা ছোট স্লিপের মাধ্যমে চলত। এভাবে কয়েকবার হাতবদলের কারণে পণ্যের দামও বেড়ে যেত কয়েক দফা। সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় এই ডিও ব্যবসা একসময় লাগাম ছাড়া হয়ে ওঠে, সেই সঙ্গে যুক্ত হয় ডিও জালিয়াতির মতো তৎপরতা। ভুয়া ডিও তৈরি করে অন্যায়ভাবে বিপুল অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে যেমন উধাও অনেক ব্যবসায়ী, তেমনি ক্ষতিগ্রস্তও হয়েছে অপর পক্ষ।

২০০৬ সালেও ডিও জালিয়াতি করে কিছু ব্যবসায়ী কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে গা ঢাকা দিয়েছিলেন। এ রকম ডিও জালিয়াতির বেশ বড় কিছু ঘটনার পর অবশেষে ‘কন্ট্রোল অব অ্যাসেনশিয়াল কমোডিটিজ অ্যাক্ট ১৯৫৬’-এর আওতায় চিনি ও ভোজ্যতেল ব্যবসায় ডিও প্রথা বাতিল করে জারি করা হয় ‘অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিপণন ও পরিবেশক নিয়োগ আদেশ ২০১১’। এ ব্যবস্থায় ডিওর পরিবর্তে দিতে হবে সেলস অর্ডার (এসও); যার মেয়াদ হবে ১৫ দিন। কিন্তু এ আইনটি মান্য করা হচ্ছে কি না, কিংবা বরখেলাপিদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না, তার কোনো তথ্য-প্রমাণ আমাদের হাতে নেই।

ডিও জালিয়াতির মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নেওয়া ছাড়াও মাঝেমধ্যে পাওনাদার এবং ব্যাংকের ঋণ অপরিশোধিত রেখে গা ঢাকা দেওয়ার ঘটনার পর খাতুনগঞ্জকে এখন আর নিরাপদ বলে মনে করছে না ব্যাংকগুলো, বিশেষ করে সর্বশেষ মোজাহের হোসেন আমদানিকারকের পাওনাদার এবং ব্যাংকের বিপুল দেনা ফেলে দেশান্তরি হওয়ার ঘটনা সব মহলের বিশ্বাসের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে।

এখানে প্রণিধানযোগ্য যে, জামানতবিহীন বা স্বল্প জামানতের বিপরীতে ব্যাংকের পক্ষ থেকে ঋণদান-পরবর্তী যে কঠোর তদারকি প্রয়োজন হয়, এ ক্ষেত্রে তার ব্যত্যয় ঘটেছে। কারণ, ব্যাংকগুলো দালিলিক তথ্য-উপাত্তের ওপর যতখানি ভরসা করে, বাস্তব পরিস্থিতির ওপর ততখানি করেনি। ফলে এই পলাতক আমদানিকারকের গুদামে কী পরিমাণ মজুত আছে কিংবা আদৌ আছে কি না, ব্যাংক ছাড়াও বাজারে এই ব্যক্তির বিশাল অঙ্কের হ্যান্ড লোনের কারণ, ক্রমাগত মূল্যহ্রাসের কারণে সৃষ্ট লোকসানজনিত গহ্বর কতখানি গভীর—এসব বাস্তব তথ্যানুসন্ধান করে কঠোর তদারকির মধ্যে রাখলে এই ব্যবসায়ী হয়তো এতখানি ক্ষতি করতে পারতেন না।

ব্যাংক এবং অন্যান্য পাওনাদার ব্যবসায়ীর আর্থিক ক্ষতি ছাড়াও তিনি ভূলুণ্ঠিত করেছেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের সততা ও অঙ্গীকার রক্ষার ভাবমূর্তি। ফলে ব্যাংক বা অন্য ব্যবসায়ীরা অতীতের মতো চোখ বন্ধ করে তাঁদের আর বিশ্বাস করবেন না। অথচ এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে দেশের শিল্প-বাণিজ্যে চট্টগ্রামের যে ভূমিকা ও অবদান, টোলখাওয়া ভাবমূর্তির কারণে তা ক্ষুণ্ন হলে তার বিরূপ প্রভাব পড়বে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর ।

তাই চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী নেতাদের সচেষ্ট ও সক্রিয় হতে হবে, যাতে বাণিজ্যনগরের ব্যবসায়িক বিশ্বাস ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ, জালিয়াতি, ঋণখেলাপ ইত্যাদি কারণে তাঁদের ক্ষতিগ্রস্ত ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করা যায়। চট্টগ্রাম তথা খাতুনগঞ্জ আবারও যাতে পরিণত হয় ব্যবসা-বাণিজ্যের সততা এবং অঙ্গীকার রক্ষার অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত ও কেন্দ্রবিন্দুতে। চট্টগ্রাম তথা খাতুনগঞ্জের এমনকি ঢাকার মৌলভীবাজার বা ইমামগঞ্জের ব্যবসার যা ধরন, তাতে একটি কমোডিটি এক্সচেঞ্জ স্থাপন করা যায় কি না (যদিও বিষয়টি যথেষ্ট বিতর্ক এবং যথার্থ নিরীক্ষাসাপেক্ষ) তা ভেবে দেখতে পারেন ব্যবসায়ী নেতারা। চট্টগ্রাম এ ক্ষেত্রে নিতে পারে অগ্রণী ভূমিকা।  

ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার।

fmainuddin@hotmail.com 

সহিংস রাজনীতি সমর্থনযোগ্য নয়- অর্থনীতিতে অপূরণীয় ক্ষতি

Wednesday, December 18, 2013

বিজয় দিবসের আগের দিন দেশজুড়ে ব্যবসায়ী সমাজ সাদা পতাকার প্রতিবাদবন্ধন কর্মসূচি পালন করল। চলমান রাজনৈতিক সহিংসতায় ব্যবসা-বাণিজ্য তথা অর্থনীতি যেভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে,
তা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি জোরালো আহ্বান জানাতে এবং ধ্বংসাত্মক রাজনৈতিক কর্মসূচির প্রতি প্রবল অনীহা জানাতেই এই প্রতিবাদবন্ধন কর্মসূচি। কিন্তু তাদের এই বার্তা যে রাজনৈতিক নেতৃত্বের কর্ণকুহরে সেভাবে প্রবেশ করেনি, তা এখন পরিষ্কার। সব অনুরোধ-আহ্বান উপেক্ষা করে বিরোধী দল নবোদ্যমে ৭২ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করল। এর ফলে কয়েক মাস ধরে হরতাল-অবরোধসহ রাজনৈতিক সহিংসতার যে নেতিবাচক প্রভাব অর্থনীতির ওপর পড়েছে, তা আরও প্রলম্বিত হবে।

অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যে ইতিমধ্যে কতখানি সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে, তা বোঝা যায় প্রথম আলোয় প্রকাশিত একগুচ্ছ প্রতিবেদনে। এসব প্রতিবেদনে সব ধরনের ব্যবসায়ী-শিল্পপতির অসহায় অবস্থা ফুটে উঠেছে। ফুটে উঠেছে তৈরি পোশাক কারখানাগুলো সময়মতো রপ্তানিপণ্য জাহাজে তুলতে না পেরে চড়া মাশুল গুনছে, ২০ হাজার টাকার ট্রাক ভাড়া লাখ টাকা হয়ে পরিবহন ব্যয় কয়েক গুণ বাড়িয়েছে, স্থলবন্দরগুলোতে পণ্য জমে গেছে, যা বাজারে ও কারখানায় আনা যাচ্ছে না, বিভিন্ন কারখানা উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে, হাজার হাজার শ্রমিক কর্মহীন অনিশ্চিত সময় কাটাচ্ছেন। দাবি আদায়ের নামে হরতাল-অবরোধে এখন পুড়ছে পণ্যবাহী ট্রাক, থেমে যাচ্ছে কারখানার চাকা, আহত হচ্ছেন রাস্তার ধারের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, নাশকতার শিকার হচ্ছে রেলপথ।

এ রকম অবস্থা আরও কত দিন চলবে, তা কেউ বলতে পারছে না। ইতিমধ্যে এই ধ্বংসযজ্ঞ যে গোটা অর্থনীতিকে অনেকখানি পিছিয়ে দিয়েছে, তা কোনো রকম অঙ্ক কষা ছাড়াই বলে দেওয়া যায়। অথচ বাংলাদেশের অর্থনীতি গত দুই দশকে নানা প্রতিকূলতা অতিক্রম করে একটি গতিময় ও স্পন্দবান অর্থনীতিতে রূপ নিচ্ছিল। বিশ্ব অর্থনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ৫৯তম, তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বিশ্ববাজারে তৃতীয় স্থানটি বাংলাদেশের, সহজে ব্যবসা করার বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩০তম, দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সর্বোপরি ২০২১ সাল নাগাদ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) কাতার থেকে উত্তরণের পথে অভিযাত্রায় ছিল বাংলাদেশ। চলমান অসুস্থ রাজনীতির সহিংস ছোবলে সেই অভিযাত্রার পদযুগলে বিরাট ক্ষতের সৃষ্টি হলো। সামনে এগোনোর চেয়ে এই ক্ষত সারানোর দাওয়াই প্রয়োগই এখন জরুরি হয়ে উঠেছে।

এ রকম একটা অবস্থায় দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছ থেকে বিচক্ষণ ও দূরদর্শী আচরণই কাম্য। দেশে রাজনৈতিক সংকট তৈরির ক্ষেত্রে সরকারি দলের দায় যেমন বেশি, তেমনি এই ধ্বংসযজ্ঞ বিস্তারের বড় দায় প্রধান বিরোধী দলকেই নিতে হবে। তবে যুদ্ধাপরাধের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়ানো জামায়াত-শিবির এই ধ্বংসযজ্ঞের দাবানল ছড়িয়ে দিতে যে হিংস্র ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে, তা কঠোরভাবে দমন করার জন্য সরকারের কুশলী পদক্ষেপ প্রয়োজন। অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিলে তার মূল্য কমবেশি সবাইকে দিতে হবে, আর এই ক্ষতি আসলে অপূরণীয়।

শেয়ারবাজারে লাগাতার দরপতন, বিশেষজ্ঞরাও ধোঁয়াশায় by টিটু দত্ত গুপ্ত

Saturday, September 24, 2011

রকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর নানামুখী পদক্ষেপের পরও শেয়ারবাজার কেন স্থির হচ্ছে না, তা বিশেষজ্ঞদেরও বোধগম্য নয়। 'স্বাভাবিক' অবস্থার সংজ্ঞা নিয়েও তাঁরা নিশ্চিত নন। সর্বশেষ ধ্বংসের আগের অবস্থা অর্থাৎ সূচকের ৮৯১৯ পয়েন্ট যদি 'স্বাভাবিক' অবস্থার মাপকাঠি হয়, তাহলে দেশের শেয়ারবাজার কবে নাগাদ সে অবস্থায় পেঁৗছাবে, এ ব্যাপারে কোনো ধারণা নেই তাঁদের। তবে তাঁদের পরামর্শ, বর্তমানে সূচক যেভাবে হিসাব করা হয়, তাতে শেয়ারবাজারের প্রকৃত চিত্র ফুটে ওঠে না। সূচক নিয়ে বিচলিত না হয়ে লগি্নকারীদের উচিত কম্পানির মৌল ভিত্তি বিবেচনায় নিয়ে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া ও অপেক্ষা করা। ঋণের টাকায় নয়, নিজের সঞ্চয়ের একটি নিরাপদ অংশ দিয়েই যেন তারা শেয়ার কেনে।

বিশ্লেষকদের মতে, বাজারে নতুন করে আস্থাহীনতা তৈরি হওয়ার মতো কোনো ঘটনা দেশের অর্থনীতিতে ঘটেনি। বিক্ষোভকারীদের নানা দাবি মেনে নেওয়ার পর সরকারেরও আর তেমন কিছু করার নেই। তবে অর্থমন্ত্রীর আগের ঘোষণা অনুযায়ী সরকারি শেয়ার জরুরি ভিত্তিতে বাজারে ছাড়ার তাগিদ দিয়েছেন তাঁরা। বাজারে যখন এমনিতেই শেয়ারের দাম পড়ছে, তখন কম্পানির উদ্যোক্তাদের শেয়ার বিক্রির হিড়িক শেয়ারের দামের নিম্নগতিকে ত্বরান্বিত করছে। তা ছাড়া বাজারে ওই কম্পানি সম্পর্কে সাধারণ লগি্নকারীদের মনে একটি নেতিবাচক ধারণাও তৈরি করছে বলে তাঁরা মনে করছেন।
শেয়ারবাজার হবে শিল্প স্থাপন ও অবকাঠামো নির্মাণের জন্য অর্থায়নের বিকল্প উৎস, যা ব্যাংকের ওপর চাপ কমাবে_এমনিটিই আশা দেশের ব্যক্তি খাতের উদ্যোক্তাদের। কিন্তু বাস্তবে শেয়ারবাজার নিজেই হয়ে পড়েছে ব্যাংকনির্ভর। 'তারল্য সংকটের' কথা বলে হাত গুটিয়ে নিয়েছেন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা। আর পড়তি দামেই নিজেদের শেয়ার বেচে বাজার থেকে বের হতে চাইছেন কম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকরা। তারল্য সংকট নিরসনের দাবিতে বিক্ষোভ-ভাঙচুরের প্রেক্ষাপটে গত সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকগুলোর একক ঋণ সমন্বয়ের সময়সীমা এক বছর বাড়িয়ে দিল। তার পরও শেয়ারের দামের পতন থামছে না। এ অবস্থায় মন্দাবস্থা হয়তো প্রলম্বিত হবে_এমন আশঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না বিশ্লেষকদের কেউ কেউ।
বাজারের এমন আচরণের কারণ বুঝে উঠতে পারছেন না তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, 'বাজারে কেন এ রকম অবস্থা চলছে তা বলা মুশকিল।'
শেয়ারবাজারের জন্য সরকারের আর কী করার আছে জিজ্ঞেস করা হলে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এঙ্চেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) সাবেক এ চেয়ারম্যান বলেন, সরকার এখন যা করতে পারে সেটি হলো, দ্রুতগতিতে সরকারি শেয়ার বাজারে ছাড়া। এতে সরবরাহের ঘাটতি কিছুটা কমবে। ড. মির্জ্জা আজিজ বলেন, 'আমি মনে করি, নতুন শেয়ার আসা দরকার। যেকোনো আইপিও এলেই ওভার-সাব্সক্রাইব্ড হয়। এতে বাজারে নতুন অর্থ আসবে।' ইনডেঙ্ (সূচক) দেখে বিনিয়োগ না করার পরামর্শও দিলেন তিনি।
অর্থনীতিবিদ ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, শেয়ারবাজারের বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র দৃশ্যমান উপায় হচ্ছে ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমিয়ে দেওয়া। তিন প্রশ্ন করেন, 'ব্যাংকে টাকা রেখে যদি ১৪ শতাংশ সুদ পাওয়া যায় তাহলে মানুষ কেন শেয়ারবাজারে আসবে?' তবে তাঁর ধারণা, আইএমএফের চাপে সরকার বা বাংলাদেশ ব্যাংক তা করতে পারবে না, ফলে শেয়ারবাজারে মন্দাবস্থারও দ্রুত অবসান হবে না।
শেয়ারবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক ড. ওসমান ইমাম বলেন, শেয়ারবাজারে ব্যাংকগুলো আগেই বিপুল অঙ্কের বিনিয়োগ করেছিল। এটি কমিয়ে আনার জন্য তাদের খুব কম সময় দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তিনি মনে করেন, চার থেকে পাঁচ বছর সময় পেলে ব্যাংকগুলো নিজেদের গুটিয়ে আনতে পারত, বাজারেও প্রভাব পড়ত না। শেয়ারবাজারকে শিল্পে অর্থায়নের বিকল্প উৎস হিসেবে গড়ে তোলার সত্যিকারের ইচ্ছা সরকার বা নিয়ন্ত্রক সংস্থার আছে বলে মনে করেন না ড. ওসমান। তিনি বলেন, বাজেটেও এ ব্যাপারে কোনো দিকনির্দেশনা নেই।
লন্ডন স্টক এঙ্চেঞ্জে সাম্প্রতিক মন্দাবস্থার সময় বড় বড় কম্পানি বাজার থেকে নিজেদের শেয়ার কিনে নিয়েছে। দাম পড়ে যাওয়ায় শেয়ারহোল্ডারদের ধারণকৃত শেয়ারের মূল্যমান সমান রাখা বা বাড়ানোর জন্যই এ শেয়ার কিনে নেওয়া হচ্ছে বলে কম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে জানানো হয়। অথচ বাংলাদেশে একদিকে যখন সরকার শেয়ার বাই-ব্যাক আইন কঠোর করার উদ্যোগ নিচ্ছে, অন্যদিকে তখন ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এঙ্চেঞ্জে কম্পানির পরিচালকরা মন্দার বাজারে শেয়ার বিক্রি করে চলেছেন। গত এক সপ্তাহে অন্তত ১৩টি কম্পানির পরিচালকরা তাঁদের হাতে থাকা ৭০ লাখেরও বেশি শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে প্রায় ১২১ কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন।
এ ব্যাপারে মির্জ্জা আজিজ বলেন, বাজারের এ অবস্থায় তাঁরা নিজেরাই যদি নিজেদের শেয়ার বিক্রি করে দেন তাহলে বাজারে ভুল সংকেত যাবে। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মনে সংশ্লিষ্ট কম্পানি সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হবে।
১৯৯০ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জের (ডিএসই) সাধারণ সূচক ছিল ৫০০ পয়েন্টের নিচে। '৯৬-এর জুলাই মাসে তা ১০০০-এর ঘর অতিক্রম করে চার মাসের মাথায় সূচক ৩০০০ পয়েন্ট ছাড়িয়ে যায়। চার মাসের মাথায় আবার নেমে আসে ৯৫০-এর কোটায়। এর মধ্যে ঘটে যায় বাংলাদেশের উঠতি শেয়ারবাজারের প্রথম ভয়াবহ ধস, অসংখ্য ব্যক্তি লগি্নকারীর সারা জীবনের সঞ্চয় চলে যায় গুটিকয়েক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে। তারপর আট বছর লেগেছে সূচকের ১০০০-এর ঘর পার হতে। ২০০৪-এর ডিসেম্বরে একবার ২০০০ ছুঁই ছুঁই করলেও ২০০৬ সালের জুলাই মাস নাগাদ সূচক পড়ে যায় ১৪০০ পয়েন্টে। অবশ্য পরের দেড় বছরে অর্থাৎ ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে ডিএসইর মূল্যসূচক আবার পেঁৗছায় ৩০০০-এ। ওঠা-নামার মধ্য দিয়ে ২০০৯-এর মার্চে সূচক ২৫০০-এর নিচে নেমে এলেও পরের ২০ মাস ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জের শুধুই উল্লম্ফন। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে দেশের শেয়ারবাজারের ইতিহাসের সর্বোচ্চ ৮৯১৯ পয়েন্ট ছোঁয় ডিএসই জেনারেল ইনডেঙ্ বা ডিজেন। এ উত্থান যেন ঘটেছিল পতনের জন্যই। মাত্র দুই মাসের মাথায়, অর্থাৎ চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে এটি নেমে আসে ৫২০০-এর ঘরে। এর মধ্যে রাস্তায় ব্যাপক বিক্ষোভ, তদন্ত কমিটি গঠন ও নির্ধারিত সময়ের আগেই তার প্রতিবেদন পেশ, দেরিতে হলেও সেই প্রতিবেদনের আলোর মুখ দেখা, প্রতিবেদন অনুযায়ী বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া, কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়াসহ বাজেটে ঘোষিত কিছু পদক্ষেপ, সবশেষে শেয়ারবাজারে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বাড়তি বিনিয়োগ কমিয়ে আনার সময় বাড়ানো। এক একটি উদ্যোগের পর সূচকের ঊর্ধ্বমুখী নড়াচড়া, পরের দিন আবার নিম্নমুখিতা, রাস্তায় বিক্ষোভ।
গত সপ্তাহে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জে (ডিএসই) বাজার মূলধন কমেছে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। সাধারণ মূল্যসূচক পাঁচ হাজার ৯৬৬.৫১ পয়েন্ট নিয়ে গত সপ্তাহের লেনদেন শুরু হয়েছিল ডিএসইতে। আর সপ্তাহের শেষে এসে মূল্যসূচক দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৬৫২.৩২ পয়েন্ট। ফলে এক সপ্তাহের ব্যবধানে সূচক কমেছে ৩১৪.১৯ পয়েন্ট। শেষ দিন হরতালে রাজধানীতে বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকলেও ডিএসইর সূচক অবশ্য ২.৮৮ পয়েন্ট বেড়ে ৫৬৫২.৩২ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।
গত সপ্তাহে ঢাকার স্টক মার্কেট এলাকায় যখন শেয়ারবাজারে ব্যাংকের অর্থ সরবরাহ বাড়ানোর দাবিতে বিক্ষোভ চলছিল, তখন বিক্ষোভকারীরা নিউ ইয়র্ক স্টক এঙ্চেঞ্জ ও ওয়ালস্ট্রিট দখলের ঘোষণা দিয়ে দাবি করেছে, দেশের এক শতাংশ লোভী ও দুর্নীতিবাজ মানুষের কাছে ৯৯ শতাংশ মানুষ জিম্মি হয়ে থাকতে পারে না। দেশের অর্থনীতির নীতি শুধু এক শতাংশ মানুষের সুখের জন্য রচিত হতে পারে না।
ব্যাংকের টাকা দিয়ে শেয়ারবাজার টিকিয়ে রাখার দাবির যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজ। তাঁর মতে, শেয়ার মার্কেট হবে শিল্পে অর্থায়নের একটি নির্ভরযোগ্য উৎস। এখন ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে এটি চলছে। ব্যাংকের টাকা আমানতকারীদের সম্পদ। এটি বিনিয়োগ করার কথা উৎপাদনমুখী খাতে, শেয়ারবাজারের মতো ঝুঁকিপূর্ণ খাতে ব্যাংকের অর্থ বিনিয়োগের একটি নিরাপদ সীমারেখা থাকতে হবে। অথচ তারল্য সংকটের কথা বলে ব্যাংকের আরো টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের দাবি তোলা হচ্ছে। এর যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ নেই।
বিশ্বজুড়েই শেয়ারবাজারে মন্দা চলছে। চলতি মাসে আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এ নিয়ে বিক্ষোভ হয়েছে। তারা অর্থনীতিতে মন্দার কারণে দেশগুলোতে নেওয়া নানা কৃচ্ছ্র কর্মসূচির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছে। তবে কোথাও রাস্তায় বিক্ষোভ করে শেয়ারবাজারের পতন ঠেকানোর জন্য ব্যাংক থেকে অর্থ সরবরাহ বাড়ানোর দাবি জানানো হয়নি। আমেরিকার নিউ ইয়র্কে গত সপ্তাহে বিক্ষোভ হয়েছিল দুর্নীতি আর লোভের হাত থেকে অর্থনীতিকে রক্ষা করার দাবিতে।

অর্থনীতি সামাল দিতে পারছে না সরকার by শওকত হোসেন ও মনজুর আহমেদ

Wednesday, September 21, 2011

হা দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে মূল্যস্ফীতি। পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না সরকার। বরং দাতাদের শর্ত মেনে সাড়ে তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতির হার নিয়ে সরকার সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।
এতে সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা নিয়ে তৈরি চাপ কিছু কমলেও সংকট বাড়বে সীমিত আয়ের সাধারণ মানুষের। কারণ, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোয় মূল্যস্ফীতির চাপ আরেক দফা বাড়বে বলেই মনে করা হচ্ছে।

অর্থনীতিবিদেরা মনে করছেন, ইতিমধ্যেই মূল্যস্ফীতির একটি দুষ্টচক্রে ঢুকে পড়েছে বাংলাদেশ। শিগগির এখান থেকে বের হওয়া সম্ভব হবে না। এ পরিস্থিতিতে আগামী দিনে সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় সমস্যা থেকেই যাবে।
সম্পদ কোথা থেকে আসবে, তা বিবেচনা না করেই বিভিন্ন ধরনের প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় সংকট তৈরি হয়েছে। দ্রুত বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান, কম দামে সেচসুবিধা ও সার প্রদান, মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে বাঁচাতে কম মূল্যে চাল বিতরণ এবং বর্তমান মেয়াদেই পদ্মা সেতুর কাজ শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সরকার। এতে ব্যয় বেড়েছে অনেক। কিন্তু এখন ব্যয় ব্যবস্থাপনা করতে পারছে না সরকার।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত পূরণ করতেই মূলত সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে সরকার। মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত দিয়েই ওই রাতেই অর্থমন্ত্রী বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের বার্ষিক সভায় যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন। আইএমএফের একটি প্রতিনিধিদল ১৪ সেপ্টেম্বর জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোসহ কয়েক দফা সুপারিশসংবলিত একটি প্রতিবেদন সরকারকে দিয়েছে। আর সরকার জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে ১৮ সেপ্টেম্বর।
এই পরিস্থিতিতে আইএমএফ আবারও মুদ্রা সরবরাহ কমিয়ে আনার পরামর্শ দিয়েছে। আইএমএফ মনে করে, এতে মূল্যস্ফীতির চাপ কমবে। তবে অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি এখন যে পর্যায়ে চলে গেছে তাতে ব্যয় বৃদ্ধির কারণে না চাহিদা বাড়ার কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে, তা আর এভাবে পৃথক করা যাবে না। কেননা, একটা পর্যায়ে উঠে গেলে এটা আর আলাদা করা যায় না। ফলে আমরা একটা দুষ্টচক্রের মধ্যে ঢুকে পড়েছি বলা যায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘অর্থমন্ত্রী অর্ধবার্ষিক ভিত্তিতে বাজেট পর্যালোচনার কথা বলেছেন। কিন্তু আমার মনে হয় পর্যালোচনার সময়টা আরও একটু এগিয়ে এনে ব্যয় সাশ্রয়ের সময় এসেছে।’
অর্থবছরের শুরুতেই সংকট: নতুন অর্থবছরের মাত্র তিন মাসের মধ্যেই সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সংকট দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন খাতে দেওয়া ভর্তুকির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় আয়-ব্যয়ে তৈরি হচ্ছিল ভারসাম্যহীনতা। রাজস্ব আদায় এবং রপ্তানি আয় বাড়লেও সে তুলনায় সরকারের ব্যয়ের পরিমাণ বেশি। এতে এক দিকে সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ কমছে, ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ নেওয়াও বেড়েছে। সব মিলিয়ে চাপের মধ্যে আছে সরকার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এম এ তসলিম বলেন, ‘আমরা অনেক দিন ধরেই বলে আসছিলাম যে, সরকারের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় ঝামেলা আছে। কিন্তু সরকার এটা আমলে নেয়নি। উপরন্তু অনেকগুলো কাজ একসঙ্গে নিয়েছে। এতে একটা লেজেগোবরে অবস্থা হয়েছে।’
রাজস্ব আয়ের চেষ্টায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) অনেকখানি অগ্রসর হয়েছে। কিন্তু ঘাটতি মেটাতে তা পর্যাপ্ত নয়। ফলে সম্পদের জোগান পেতে ঋণ করার বিকল্প নেই। এর মধ্যে বৈদেশিক ঋণ আগের অর্থবছরেই ৩০ শতাংশ কম হয়েছে। পদ্মা সেতুর কাজ করার আগেই দুর্নীতির অভিযোগসহ টানাপোড়েনের কারণে এবারও পর্যাপ্ত বৈদেশিক সাহায্য পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে রয়েছে। ফলে ভরসা এখন অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ। এর মধ্যে সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে সরকারের ঋণ ততটা সফল হয়নি। ফলে সরকার ব্যাংক থেকে টাকা ধার নিচ্ছে। এতে বেসরকারি খাতের সঙ্গে সরকারের প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে। সরকার বেশি ঋণ করায় বেসরকারি খাতের ঋণের জোগান কমে সুদের হার বেড়ে যাচ্ছে।
অধ্যাপক এম এ তসলিম বলেন, ‘অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কথা উঠলেই সরকার খালি বলে প্রবৃদ্ধি তো ভালো হচ্ছে। কিন্তু জিডিপির প্রবৃদ্ধি একটা উপাদান মাত্র। আর এই প্রবৃদ্ধিকে টেকসই করতে হবে। এ জন্য পরিকল্পনা করে বছর ভিত্তিতে অর্জন ধরে রাখতে হবে। ঋণের টাকায় এই প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা কতটা সম্ভব, তা সামনের দিনগুলোতে বোঝা যাবে।’
শুরুতেই ব্যাংকঋণ: বড় অঙ্কের ধার দিয়েই বছরটি শুরু হয়েছে সরকারের। সূত্র জানায়, গত ২১ আগস্ট পর্যন্ত সরকার ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ করেছে পাঁচ হাজার ২২৪ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকার নিয়েছে দুই হাজার ৮৬৬ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। আর তফসিলি ব্যাংকগুলো থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারের ট্রেজারি বিল ও বন্ড বিক্রি করে তুলে দিয়েছে দুই হাজার ৩৫৮ কোটি ২৩ লাখ টাকা।
বলা হয়, তফসিলি ব্যাংক থেকে সরকার বেশি ঋণ করলে বেসরকারি খাতের ঋণ পাওয়ার সুযোগ কমে আসে। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ করলে, যদি বাংলাদেশ ব্যাংক পরবর্তী সময়ে তফসিলি ব্যাংকের কাছ থেকে তা তুলে নিতে না পারে তবে বাজারে নতুন টাকার সরবরাহ বেড়ে যায়। আর এতে বাড়ে দ্রব্যমূল্য, চাপ বাড়ে মূল্যস্ফীতিতে।
২০১০-১১ অর্থবছরে ব্যাংক খাত থেকে সরকার ঋণ করেছিল প্রায় ২০ হাজার ৪০০ কোটি টাকা, যা একটি নতুন রেকর্ড। এই ঋণের প্রায় অর্ধেকটা নেওয়া হয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে। জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন টাকা ছেপে সরকারের এই চাহিদা মিটিয়েছে।
সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি: নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ছিল দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ। অথচ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবমতে, গত আগস্ট মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১১ দশমিক ২৯ শতাংশ। গত ৪৩ মাসের মধ্যে এটাই সর্বোচ্চ। এর আগে ২০০৮ সালের জানুয়ারি মাসে মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ ১১ দশমিক ৪৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল। অর্থাৎ বর্তমান সরকারের সময়ে এটাই সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি।
দুই বছর ধরেই মূল্যস্ফীতির চাপ রয়ে গেছে। সরকারও মূল্যস্ফীতির হার কমাতে ব্যর্থ হয়ে মূল্যস্ফীতিকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। অধ্যাপক এম এ তসলিম বলেন, এর ক্ষতিকারক দিকও আছে। ব্যবসায়ীরা যখন বুঝে নেবেন যে বছর বছর এটা চলবে, তখন তাঁরা তাঁদের পণ্যমূল্যের মধ্যে আগেভাগেই নতুন মূল্যস্ফীতিকে হিসাব করে নেবেন। এতে মূল্য পরিস্থিতিতে নতুন মাত্রা যোগ হবে।
এদিকে, ভর্তুকি সমন্বয়ে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর প্রভাবে আরেক দফা বাড়বে মূল্যস্ফীতি। মূল্যবৃদ্ধি ইতিমধ্যেই ভোক্তা মূল্যসূচকে গিয়ে যুক্ত হচ্ছে। আবার এর প্রভাব পড়বে উৎপাদনে। পরিবহন ব্যয় বেড়ে চাপ আরও বাড়াবে।
এম এ তসলিম বলেন, ‘এই অবস্থা কারও জন্যই ভালো হবে না। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের যে অবস্থা তাতে রাজনৈতিক বিবেচনা উপেক্ষা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক শক্ত হাতে মুদ্রা ব্যবস্থাপনা করে মূল্যস্তরকে সামাল দিতে পারবে, আমি তা মনে করি না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আগামী এক-দুই বছরের মধ্যে এ পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসার কোনো পথ আমি দেখছি না। ফলে আগামী দিনে সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় সমস্যা থেকেই যাবে।’
লেনদেনের ভারসাম্যেও চাপ: চলতি অর্থবছরে এরই মধ্যে ৯০ কোটি ডলারের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এটা আরও বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ কমা শুরু হয়েছে। বর্তমান মজুদ দিয়ে মাত্র দুই মাসের কিছুদিন বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। এবার রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ৩০ থেকে ৩২ শতাংশ এবং আমদানি ব্যয়ে প্রবৃদ্ধি ২০ শতাংশের কাছাকাছি হলে বাণিজ্য ঘাটতি থাকবেই। এর মধ্যে বৈদেশিক সাহায্য ও প্রবাসী-আয়ে ভালো প্রবৃদ্ধি হবে বলে অর্থনীতিবিদেরা মনে করছেন না। এ রকম বাস্তবতায় বিনিময় হারও বাড়বে। এক বছর আগে, অর্থাৎ ২০১০ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর টাকা-ডলারের গড় বিনিময়মূল্য ছিল ৬৯ টাকা ৫৮ পয়সা। আর এখন তা ৭৪ টাকা ৫৫ পয়সা। অর্থাৎ এবারও বেশি দাম দিয়েই পণ্য আমদানি করতে হবে। আর এর চাপ পড়বে আবারও মূল্যস্ফীতিতে।

বেগম খালেদা জিয়ার বিকল্প বাজেট প্রস্তাবনা

Wednesday, June 8, 2011

পস্থিত সহকর্মী, সুধী, এক্সেলিন্সিস, সাংবাদিকবৃন্দ,
আস্‌সালামু আলাইকুম।
৭ জুন ২০১০ সালে চলতি অর্থবছরের বাজেট সম্পর্কে আমাদের কিছু চিন্তা-ভাবনা ও বাজেট প্রস্তাবনা আপনাদের সামনে উপস্থাপন করেছিলাম। আমাদের এই বাজেট প্রস্তাবনা উত্থাপনের পেছনে উদ্দেশ্য ছিল জাতির ভবিষ্যত সম্পর্কে আমাদের ধ্যান-ধারণা তুলে ধরা। একটি দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল হিসেবে জাতির সামনে একটি দিক-দর্শন তুলে ধরা আমরা দায়িত্ব মনে করি। সেই চিন্তা থেকেই আমরা গত বছর বাজেট প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেছিলাম।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সরকার আমাদের ধারণাগুলোকে কোনো গুরুত্বই দেয় নি। যার ফলে আজ সামষ্টিক অর্থনীতির সকল সূচক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। এক কথায় দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙ্গে পড়েছে। বিগত দুই দশকেও একই অর্থবছরে সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকসমূহ এমন বিপর্যয়ে পড়েনি। যাইহোক, বিদায়ী অর্থছরের মতো আমরা এবারও একই আঙ্গিকে দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে আগামী অর্থবছরের উপর বাজেট প্রস্তাবনা উত্থাপন করছি। কিন্তু পরিতাপের বিষয় আমরা এমন এক প্রেক্ষাপটে এই প্রস্তাবনা উত্থাপন করছি যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আদালতের রায়ের অজুহাতে বাতিলের ঘোষণা দিয়ে সুষ্ঠু বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথ রূদ্ধ করে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে স্তব্ধ করে দেয়ার পাঁয়তারা চলছে। আমরা একদিকে যেমন রাজপথের সংগ্রামে রয়েছি, তেমনি তার পাশাপাশি আমাদের জাতি গঠনমুলক কর্মকাণ্ড সকল প্রতিকূলতার মধ্যেও অব্যাহত রাখতে চাই।


সুধী মন্ডলী,
আমরা বিশ্বাস করি, বাজেট হবে মানুষের জন্য, উন্নয়নের জন্য, উৎপাদনের জন্য। আর বাজেট বরাদ্দের নীতি হবে সামাজিক উৎপাদনশীলতার নিরিখে সীমিত সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা। বর্তমান বাস্তব অবস্থার নিরিখে বরাদ্দের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার নির্ণয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত, শিক্ষা খাত, স্বাস্থ্যখাত এবং ভৌত-অবকাঠামো খাত বিশেষ গুরুত্বের দাবিদার।

বিদায়ী অর্থবছরের বাজেটের ওপর আমরা বেশ কিছু প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেছিলাম। আমাদের দিক-দর্শন এবং প্রস্তাভাবনা এ বছরেও পুরোনো হয়ে যায় নি। এ কারণে বিদায়ী অর্থবছরের প্রস্তাবনাগুলোও সংক্ষিপ্তরূপে আপনাদের নজরে আনা হলো।

বিএনপির অর্থনৈতিক দর্শন
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরবর্তী প্রায় চল্লিশ বছরের মধ্যে আওয়ামী শাসনাধীন প্রথম সাড়ে তিন বছরকে বাংলাদেশের একজন অর্থনীতিবিদ আখ্যায়িত করেছিলেন “দি লস্ট মোমেন্টস” বা “হারানো মুহূর্ত” রূপে। সেই সময় বাংলাদেশ একটি “তলাবিহীন ঝুড়ি” বলেও পরিচিতি অর্জন করেছিল। সমাজতন্ত্রের নামে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের নীতি রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুন্ঠনের অবাধ সুযোগ করে দেয়। গড়ে উঠে একটি উৎপাদনবিমুখ লুটেরা শ্রেণী। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়া উন্নয়ন ও উৎপাদনের অর্থনীতি প্রবর্তন করে এই ধারা রোধ করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করেন। কিন্তু জেনারেল এরশাদের আমলে স্বৈরশাসনের সমর্থনের ভিত তৈরি করার প্রয়াস একটি ঈৎড়হু ঈধঢ়রঃধষরংস এর জন্ম দেয়, যার নেতিবাচক প্রভাব আজও অব্যাহত। বর্তমান সরকারের শাসনামলে ক্ষমতাবানদের আত্মীয়-স্বজন এবং অনুগত ব্যক্তিদের মধ্যে খাজনা বিতরণের (উরংঃৎরনঁঃরড়হ ড়ভ জবহঃ) প্রবণতা দুঃখজনকভাবে প্রকট আকার ধারণ করেছে। এর ফলে অদক্ষ হাতে সমপদ কুক্ষিগত হচ্ছে। নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, আয় বণ্টন এবং কর্মসংস্থানের উপর।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি ব্যক্তি উদ্যোগ এবং গণসৃজনশীলতা-নির্ভর অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বিশ্বাস করে। ব্যক্তি উদ্যোগ ও গণসৃজনশীলতাকে গতিশীল করার জন্য বিএনপি রাষ্ট্রের সহায়ক ভূমিকায় বিশ্বাস করে। বিএনপি আরও বিশ্বাস করে যে, একটি সুঠাম এবং প্রতিযোগিতার শক্তিতে বলিয়ান ব্যক্তি-উদ্যোক্তা শ্রেণী ছাড়া একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণ সম্ভব নয়। সম্ভব নয় এর জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দর্শনের বাস্তবায়ন।
বাংলাদেশে ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও একটি ব্যক্তি-উদ্যোক্তাগোষ্ঠী গড়ে উঠেছে। এই গোষ্ঠীটির মধ্যে সবচাইতে সৃজনশীল ও প্রাণবন- গোষ্ঠীটি বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মূলতঃ নিজস্ব সঞ্চয়ের উপর ভিত্তি করে এবং কোনো প্রকার ব্যাংক ঋণের প্রত্যাশা না করে এরা নতুন নতুন উদ্যোগ সৃষ্টি করছে। এদের মধ্যেই নিহিত আছে আগামী দিনের অর্থনীতির গতিশীল ও প্রাণবন- ধারা। নীচ থেকে গড়ে উঠা এই উদ্যোগ (ঊহঃবৎঢ়ৎরংব ভৎড়স নবষড়) ক্রমান্বয়ে শক্তি অর্জন করে জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারাকে বেগবান করবে। বিএনপির লক্ষ্য হলো, এদেরকে কার্যকর নীতি সহায়তা দিয়ে স্বাবলম্বী ও আত্ম-মর্যাদাবোধে বিশ্বাসী করে গড়ে তোলা। যথোপযুক্ত প্রণোদনার মাধ্যমে উৎপাদন ও উন্নয়নের পথে উত্তরণ ঘটাতে চায় বিএনপি। বিএনপি পরনির্ভরশীলতার অর্থনীতি থেকে দ্রুততম সময়ে বেরিয়ে আসতে চায়। উল্লেখ্য যে, ১৯৯১ সালে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থায়নে ৪৯ শতাংশ পর্যন- সংস্থান দেশীয় সম্পদের মাধ্যমে করতে সক্ষম হয়। পূর্ববর্তী স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের সময় জাতীয় উন্নয়নে দেশীয় সমপদ যোগানোর প্রয়াস শূণ্যের কোঠায় নেমে আসে। সেই সময় সরকারের প্রশাসনিক ব্যয় মেটানোর জন্য বৈদেশিক সম্পদের উপর নির্ভরশীলতার সৃষ্টি হয়। একটি স্বাধীন স্বার্বভৌম দেশের জন্য এর চাইতে লজ্জ্বাকর অবস্থা আর কি হতে পারে?

বিএনপি একটি কল্যাণমুখী দরিদ্রবান্ধব কর্মসংস্থান সৃজনকারী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বিশ্বাস করে। আয় বণ্টনে বৈষম্য হ্রাস করে দেশীয় বাজার সম্প্রসারণের নীতিতে বিশ্বাসী বিএনপি। বিএনপি কৃষি, শিল্প এবং সেবাখাতে সমৃদ্ধ জাতীয় অর্থনীতি গড়ে তুলতে চায়। এই লক্ষ্য দ্রুততম সময়ে পুরণের জন্য একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলতে চায় বিএনপি। বিএনপি তাই শিক্ষা, গবেষণা, কৃৎ-কৌশল, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং গবেষণা ও উন্নয়নের প্রতি যথাসাধ্য রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা প্রদানের নীতিতে বিশ্বাস করে। আমরা মনে করি, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির অব্যাহত সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে খাদ্যে স্বয়ম্ভর হওয়ার কোনো বিকল্প জনবহুল বাংলাদেশের নেই।

বিএনপি বাজার প্রক্রিয়া ও রাষ্ট্রের ভূমিকার সর্বোত্তম সমন্বয়ে বিশ্বাসী। জাতীয় অর্থনীতিকে সর্বোত্তমভাবে সংগঠিত করতে ব্যক্তি মালিকানা, সমবায়ভিত্তিক মালিকানা এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানার পারস্পরিক পরিপূরকতায় বিশ্বাসী বিএনপি। সামাজিকভাবে অনগ্রসরগোষ্ঠীসমূহকে রাষ্ট্রীয়ভাবে বিশেষ সহায়তা প্রদানের নীতিতে বিশ্বাসী বিএনপি। শিক্ষার বিস-ার, স্বাস্থ্যসেবা, আয়বর্ধন, সামাজিক বৈষম্য নিরসন প্রভৃতি নানামুখী কর্মসূচির বাস্তবায়ন করে সামাজিকভাবে অনগ্রসর গোষ্ঠীগুলোকে সমাজের মূলধারায় নিয়ে আসার নীতিতে বিশ্বাস করে বিএনপি। নারীর ক্ষমতায়ন ও অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নারী পুরুষকে সমভাবে দেশ গড়ার সৈনিকে পরিণত করতে চায় বিএনপি।

বিএনপি সবসময় নন-গভ:সংস্থাসমূহকে জাতীয় উন্নয়নমূলক কাজে সম্পৃক্ত হতে সুযোগ করে দিয়েছে এবং ভবিষ্যতেও এ ধারা অব্যাহত থাকবে।
বিএনপি চায় এমন একটি আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা, যে ব্যবস্থা কোনো গোষ্ঠীকে এড়িয়ে যাবেনা, প্রতিটি মানুষ মানুষের মর্যাদা পাবে। প্রতিটি মানুষের স্বাধীনতা এবং বাছাই ও পছন্দের অধিকার (ঈযড়রপব)  নিশ্চিত হবে। সম্পূর্ণ অবসান ঘটবে ধর্মীয় ও জাতিগত ভেদ বৈষম্যের। বাংলাদেশের মাটিতে এবং এর উন্মুক্ত আকাশের নীচে প্রতিটি মানুষ হবে একে অপরের স্বজন। উন্নত জীবনবোধের নৈতিকতায় প্রত্যেক নাগরিক হবে মানুষের মতো মানুষ। সকল প্রকার বৈষম্য, শোষন বঞ্চণা এবং অবহেলার বিরুদ্ধেই বিএনপির রাষ্ট্রীয় নীতি পরিচালিত হবে।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতা
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এখন অত্যন্ত নাজুক। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে জমি ইজারা নেওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক যে মন-ব্য করেছে তাতে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তারা বলেছে “বৈদেশিক মুদ্রার মজুত মূলতঃ কয়েকটি পণ্য রপ্তানি এবং প্রবাসী বাংলাদেশীদের পাঠানো আয়ের উপর নির্ভরশীল। এর মধ্যে রয়েছে খুবই স্বল্প পরিমানে বৈদেশিক সাহায্য ও ঋণ। সম্প্রতি রপ্তানি বাড়লেও এর চেয়ে বেশি বেড়েছে আমদানী (রপ্তানি বেড়েছে ৪১%, কিন্তু আমদানি বেড়েছে ৫১%)। প্রবাসী আয়ে নামমাত্র প্রবৃদ্ধি থাকলেও মূলধন হিসাবে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বিদেশী বিনিয়োগ পরিস্থিতি দুর্বল অবস্থায় রয়েছে। ফলে বৈদেশিক দায় পরিশোধে দেশে বিদেশী মুদ্রার মজুত (রিজার্ভ) চাপের মধ্যে ও তা নিম্মমুখী। এই পরিস্থিতিতে টাকার মূল্যমান ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে।

গত মার্চ ২০১১ পর্যন্ত (বাংলাদেশ ব্যাংক তথ্য) সামগ্রিক বৈদেশিক লেনদেনের ঘাটতি ৫২ কোটি ৯০ লাখ ডলার। চলতি হিসেবে ৬৮ কোটি ৯০ লাখ ডলার উদ্বৃত্ত থাকলেও তা চলতি জুন মাসের হিসাব সমন্বয়ের পর ঘাটতিতে পরিণত হবে। সূত্রমতে, বুধবার (১.৬.১১) দেশে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের পরিমান ছিল এক হাজার তেতাল্লিশ কোটি ১২ লাখ ৩০ হাজার মার্কিন ডলারের সমপরিমান বৈদেশিক মুদ্রা।
সারের দাম বৃদ্ধি
যেখানে উৎপাদনের উপকরণ সাশ্রয়ী মূল্যে সরবরাহ করে কৃষককে উৎপাদন বৃদ্ধি করার জন্য প্রণোদনা দেয়ার কথা, সেখানে ইউরিয়া সারের দাম কেজিপ্রতি ১২ টাকা থেকে ২০ টাকায় বৃদ্ধি করা হয়েছে, অর্থাৎ দাম বাড়ানো হয়েছে ৬৭ শতাংশ। এর ফলে গত বছরের তুলনায় একই পরিমান সার ব্যবহার করলে শুধু এই উপকরণের জন্য উৎপাদন খরচ বাড়বে প্রায় ৪০ শতাংশ। কেননা কৃষকরা ইউরিয়া ব্যাপক হারে ব্যবহার করে। এর ফলে কৃষি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

একদিকে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি এবং অন্যদিকে উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ারও ব্যাপক অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।

‘ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না কৃষক। লাভ ফড়িয়া মজুদদারদের’ - প্রথম আলো, ২রা জুন, ২০১১। খবরে প্রকাশ সরকারিভাবে বোরো ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান শুরু না হওয়ায় ঠাকুরগাঁয়ের মজুদদারেরা ফড়িয়াদের মাধ্যমে কমদামে ধান কিনে পরবর্তী সময়ে সরকার ঘোষিত দরে বিক্রির আশায় গুদামজাত করছেন। মজুদদারেরা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ফড়িয়াদের সঙ্গে আলোচনা করে ধানের দর নিয়ন্ত্রণ করছেন। এতে শ্রম ও পুঁজি খাটিয়ে কৃষকেরা ফসলের ন্যায্য দাম না পেলেও ফড়িয়া মজুদদাররা শস্য সংগ্রহ নিয়ে সরকারের সময় উপযোগী সিদ্ধান্তের অভাবে ফায়দা তুলে নিচ্ছে। সরকারই ফড়িয়া মজুদদারদের স্বার্থে কাজ করছে।
মূল্যস্ফীতির হার বৃদ্ধি
চলতি অর্থবছরে বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে স্থিতিশীল রেখে তা ক্রমান্বয়ে কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সেই প্রতিশ্রুতির ধারে কাছে নেই মূল্যস্ফীতির বর্তমান হার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী সর্বশেষ এপ্রিল মাসে ভোক্তা মূল্যস্ফীতির হার ১০.৬৭, মার্চ ২০১১ এ হার ছিল ১০.৪৫ শতাংশ। অন্যদিকে চলমান গড় হিসাবে ২০১১ এর এপ্রিল মাসে মূল্যস্ফীতির হার ৮.৫৪ শতাংশ। দরিদ্র দেশগুলোর জনগণের আয়ের বড় অংশই ব্যয় হয় খাদ্য ক্রয়ে। ফলে বাংলাদেশের মত দেশগুলোতে খাদ্যপণ্যের দামের উপরই নির্ভর করে মূল্যস্ফীতির উঠানামা। খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার এখন আতঙ্কজনক পর্যায়ে চলে গেছে। গত এপ্রিলে (২০১১) খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১৪.৩৬ শতাংশ। আগে মার্চে ছিল ১৩.৮৭ শতাংশ। অন্যদিকে খাদ্য বহির্ভূত মূল্যস্ফীতির হার ৩.৯৭ শতাংশ, যা মার্চে ছিল ৪.৩২ শতাংশ।

ব্যবধান বেড়েছে শহর আর গ্রামের মানুষের মধ্যেও। গ্রামে দারিদ্র্যের হার বেশি। মূল্যস্ফীতির চাপও বেশি। গত এপ্রিলে পল্লী অঞ্চলে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১১.৪৯ শতাংশ। এর মধ্যে খাদ্যসূচকে ১৫.৩৮ শতাংশ ও খাদ্য বহির্ভূত সূচকে ৩.৯২ শতাংশ। অন্যদিকে এপ্রিলে শহর এলাকায় মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮.৬২ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে খাদ্যসূচকে ১২.০৪ শতাংশ এবং খাদ্য বহির্ভূত সূচকে ৪.১৮ শতাংশ। অর্থাৎ গরীব মানুষের উপর বাজেটের আগেই কর বসেছে ১০.৬৭ শতাংশ।
অথচ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রথম অগ্রাধিকার ছিল দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ। বলা হয়েছিল, “দ্রব্যমূল্যের দুঃসহ চাপ প্রশমনের লক্ষ্যে চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে জনগণের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে স্থিতিশীল রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।”

অথচ টিসিবির মূল্য তালিকা (মার্চ ২০১১) অনুযায়ী বিগত বছরের একই সময়ের তুলনায় মোটা চালের দাম বেড়েছে ৩২ শতাংশ, আটার দাম বেড়েছে ৫০ শতাংশ এবং ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে ৫০ শতাংশ।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০০৫ সালের খানা আয় ও ব্যয় জরিপ অনুযায়ী দরিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী বেশির ভাগ মানুষের দৈনিক আয়ের ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ ব্যয় হয় খাদ্য ক্রয়ে। এর মধ্যে কেবল চালই কিনতে হয় ৩৩ শতাংশ আয় দিয়ে। সুতরাং চালের দাম বাড়লে জনগোষ্ঠী খাদ্য-নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পড়ে যায়। দারিদ্র্য বাড়ে। উচ্চ-মূল্যস্ফীতি আয় বৈষম্য বৃদ্ধি করে। আন-র্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আই,এম,এফ) মনে করে মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়াই বিপদজনক। সন্দেহাতীতভাবে বাংলাদেশ সেই বিপদজনক পরিস্থিতিতে পড়েছে।

দ্রব্যমূল্যের প্রভাব নিয়ে পরিচালিত বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে ২০১০-১১ স্ট্যাডি থেকে ২০১০ এর জুলাই থেকে ২০১০ এর ডিসেম্বর পর্যন- খাদ্যমূল্যের বিশ্লেষণে জানা যায়, খাদ্য পণ্যের দাম বাড়ায় নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে ২ দশমিক ০৮ শতাংশ এবং কিছু মানুষ এ সীমা অতিক্রম করায় (০.৪৯%), সার্বিকভাবে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে ১ দশমিক ৫৯ শতাংশ মানুষ। এ পরিসংখ্যান ২০১০-১১ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের। অবস্থার দ্রুত অবনতির পরিপ্রেক্ষিতে আরও ৩ শতাংশ মানুষ যে দারিদ্রসীমার নিচে নেমে গেছে তা সহজেই অনুমান করা যায়। উল্লেখ্য যে, ২০০০ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন- বিএনপির শাসনামলে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৪৯ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশে নেমে এসেছিল।

বৈদেশিক সাহায্য প্রবাহ
বর্তমান অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি মেটানোর জন্য বিশ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা বৈদেশিক সাহায্য প্রাপ্তি আশা করা হয়েছিল। কিন্তু, অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে এই খাতে পাওয়া গেছে মাত্র ৪,৬২৭ কোটি টাকা। বিগত অর্থবছরে প্রাপ্ত সাহায্যের পরিমান ছিল ৯,১৪৪ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমান আর্থিক বছরের প্রথম নয় মাসে বিদেশী ঋণ পাওয়া গেছে ১২৯ কোটি ৩৩ লাখ ডলার, কিন্তু বিগত অর্থবছরে একই সময়ে পাওয়া গিয়েছিল ১৭৭ কোটি ডলার যার মধ্যে ৫০ কোটি ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। বর্তমান অর্থবছরে তুলনামূলকভাবে বেশ কম সাহায্য পাওয়া গেলেও পরিশোধ করতে হয়েছে বেশি। দুর্নীতি, মানবাধিকার, সুশাসন প্রভৃতি ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে দাতাগোষ্ঠীর দূরত্ব বৃদ্ধি পাওয়ায় দাতাগোষ্ঠী পূর্বের ন্যায় অর্থ ছাড় করছে না। বৈদেশিক ঋণের প্রবাহের পরিমান কমেছে ৩৮%।
স্পেশাল ইকনমিক জোন
ভারতীয় বাণিজ্য সংস্থার পক্ষ থেকে সিলেটের ছাতকে শুধু মাত্র ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি ‘স্পেশাল ইকনমিক জোন’ স্থাপনের প্রস্তাব করা হয়েছে। বর্তমান সরকার বিষয়টি বিবেচনা করে দেখছেন। এই স্পেশাল ইকনমিক জোনের জন্য ৪০০ একর ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। যেসব ভারতীয় ব্যবসায়ীগোষ্ঠী এই স্পেশাল ইকনমিক জোনে বিনিয়োগের জন্য উৎসাহ দেখাচ্ছে তাদের মধ্যে রয়েছে টাটা, বিরলা, টিভিএস গোষ্ঠীসহ অন্যান্য বড় বড় ভারতীয় শিল্পগোষ্ঠী। এদের লক্ষ্য হল উত্তর পূর্ব ভারতের শিল্প পণ্যের চাহিদা পুরণ করা। বাংলাদেশের শিল্পপতিরা ধারণা করেছিলেন ট্রানজিট ব্যবস্থা চালু হলে তারাই সীমান-বর্তি অঞ্চলে কলকারখানা স্থাপন করে উত্তর-পূর্ব ভারতের বাজারে তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করবে। ভারতীয় ব্যবসায়ী মহলের প্রস্তাব গ্রহণ করা হলে বাংলাদেশী শিল্পপতিদের আশাআকাঙ্খা ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। আমার মনে করি এ ধরণের প্রস্তাব অনুমোদনের পূর্বে বাংলাদেশী শিল্পপতিদের স্বার্থ সরকারকে অবশ্যই বিশেষ বিবেচনায় নিতে হবে।
ভারতের সংগে ১ বিলিয়ন ডলারের কঠিন শর্তযুক্ত ঋণচুক্তি
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় ভারত থেকে ১ বিলিয়ন ডলারের ঋণ নেওয়ার একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়। এই ঋণচুক্তির অধীনে যে সব প্রকল্প বাস-বায়িত হবে তার লক্ষ্য হল বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারতের করিডোর সুবিধা ব্যবহার সহজতর করা। এই ঋণের জন্য ১.৭৫% হারে সুদ দিতে হবে। অথচ বিশ্ব ব্যাংক এ ধরণের ঋণ দেয় ০.৭৫% সুদে। ৫ বছরের গ্রেস পিরিয়ড সহ ১৫ বছরে এই ঋণ শোধ করতে হবে। বিশ্ব ব্যাংকের ক্ষেত্রে শর্তটি হলো ১০ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ৪০ বছরে পরিশোধ। কমিটমেন্ট ফি দিতে হবে ০.৫ শতাংশ হারে। এই শর্তটিও বিশ্ব ব্যাংকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয় না। ভারতই প্রকল্পের পরামর্শক সেবা দেবে। ৮৫ শতাংশ উপকরণ ও যন্ত্রপাতি ভারত থেকেই কিনতে হবে, বাকী ১৫ শতাংশ উপকরণ অন্য সূত্র থেকে সংগ্রহ করা গেলেও ভারতের এক্সিম ব্যাংকই তা সংগ্রহ করবে। প্রকল্পে অংশগ্রহণকারী পার্টিগুলোর পাওনা ভারতের এক্সিম ব্যাংক সরাসরি পরিশোধ করবে। প্রকল্পের কোনো অর্থ বাংলাদেশের হাতে আসবে না। প্রকল্পের কন্ট্রাক্টরগণও হবেন ভারতীয়। জয়েন্ট ভেনচারের ক্ষেত্রে ৫১ শতাংশ মালিকানা থাকবে ভারতীয় কোম্পানীর। সকল পাওনা ডলারে পরিশোধ করতে হবে। বাংলাদেশ নিজ উদ্যোগে ভারতীয় অনুমোদন ছাড়া এই ঋণের অধিনে কোনো প্রকল্প গ্রহণ করতে পারবে না। এই ঋণ চুক্তি শতকরা ১০০ ভাগ বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থবিরোধী। কারণ কঠিন শর্তের ভারতীয় ঋণ বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারতের করিডোর সুবিধা ব্যবহারের জন্যই ব্যয়িত হবে। ইতোমধ্যে সরকারের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ভারতের কাছ থেকে ট্রানজিট ব্যবহারের জন্য ফি দাবি করাকে ‘অসভ্যতা’ বলে মিডিয়ার কাছে উল্লেখ করেছেন। অথচ বর্তমান সরকারের সমর্থক অর্থনীতিবিদরা ইতিপূর্বে দাবি করেছিলেন ভারতকে ট্রানজিট দিলে বাংলাদেশ সিংগাপুর হয়ে যাবে। বাস-বে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস- হয়ে আরো নিঃস্ব হয়ে পড়বে।
এ, ডি, পি বাস্তবায়ন
রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে এখন চলছে নৈরাজ্যকর অবস্থা। মন্ত্রী পরিষদ ও উপদেষ্টা মন্ডলীর দ্বৈত শাসনের ফলে সিদ্ধান্তহীনতা, স্থবিরতা এবং সরকারের অভ্যন্তরে চিন্তার ঐক্যের অভাব প্রশাসনকে এমন স্তরে নিয়ে গেছে যে এর দ্বারা জনগণের কোন মঙ্গল আশা করা যায় না। জানা যায়, বর্তমান সরকারের কর্মকর্তারা ভয়ভীতি ও ত্রাসের মধ্যে থাকার ফলে এবং তাঁদের উপর অবাঞ্ছিত রাজনৈতিক খবরদারি ও হস্তক্ষেপের ফলে এ,ডি,পি বাস্তবায়নে আশানুরূপ উদ্যোগ গ্রহনে তাঁরা সাহস পাচ্ছে না। বর্তমানে এডিপি বাস্তবায়নে অদক্ষতা সরকারের ব্যর্থতারই একটি নজির।

পরবর্তী এডিপিতে প্রকল্পের সংখ্যা ১০৩৯ এর মধ্যে ৯৬২টি প্রকল্প বর্তমান অর্থবছর থেকে স্থানান্তরিত। ৭৭টি প্রকল্পের জন্য নতুন অর্থায়ন করা হয়েছে। এর মধ্যে ৮৩৪টি বিনিয়োগ প্রকল্প, ১৪৩টি কারিগরি সহায়তা প্রকল্প এবং ৬২টি জেডিসিএফ দ্বারা অর্থায়নকৃত।

চলতি অর্থবছরে প্রথম ১০ (দশ) মাস শেষে সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি মাত্র ৬০ শতাংশ বাস-বায়ন হয়েছে। ৮৭টি প্রকল্পে কোন অর্থই ব্যয় করা হয়নি। অর্থাৎ জুলাই থেকে এপ্রিল ২০১১ পযনর্- ২০ হাজার ৯০৯ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এর অর্থ দাঁড়ায়, শেষ দুই মাসে ১৪ হাজার ২২১ কোটি টাকা খরচ করতে হবে। প্রতি বছরেই সরকার যে আকারের এ, ডি, পি, করে, তা বাস-বায়ন না করতে পেরে সংশোধন করা হয়। সংশোধিত এ,ডি, পিও শেষ পযনর্- বাস-বায়ন হয় না।

এ দিকে গত দুই অর্থবছর ধরে বাজেটে সরকারী বেসরকারী অংশীদারির (পিপিপি) আওতায় বিনিয়োগের ব্যাপক আশাবাদ প্রকাশ করা হলেও এখন পর্যন- কোন অগ্রগতি নেই। গত বছরে আড়াই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও নীতিনির্ধারণী কাঠামো প্রণয়নে ব্যর্থতার কারণে একটি টাকাও খরচ করা সম্ভব হযনি। আগামী অর্থবছরেও শুনছি তিন হাজার কোটি টাকা এই খাতে বরাদ্দ দেয়া হবে। এমনকি পিপিপির দপ্তর গঠনের ঘোষনা দেওয়া হলেও তা’ও করতে পারেনি সরকার। জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোতে খরচ না করে অন্যান্য প্রকল্পে খরচ করার ফলে উন্নয়ন ব্যয়ের মান ব্যাহত হয়েছে। উল্লেখ্য যে, আমাদের সময়ে গৃহীত ঢাকা-চট্টগ্রাম হাই-ওয়ে চার লেন প্রকল্প, যাত্রাবাড়ী ফ্লাই-ওভার ও রেলওয়ের ডাবল লাইন প্রকল্পগুলো যথাসময়ে শুরু না করে বর্তমানে নতুন করে কার্যাদেশ দিয়ে এগুলোর ব্যয় বাড়ানো হয়েছে প্রায় কয়েকগুণ। উল্লেখ্য যে, আমাদের সময় প্রাইভেট ইনভেস্টমেন্ট কমিটির (চওঈঙগ) নীতি কাঠামোর আওতায় ১৬টি বিনিয়োগ প্রস-াব প্রক্রিয়াকরণ করে অনেক দূর এগিয়ে যাওয়া হয়েছিল, কিন্তু এগুলো বন্ধ করে দেওয়ার ফলে প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকগুণ।


আমরা মনে করি, সরকারী কর্মকান্ডের উপর রাজনৈতিক হস-ক্ষেপ বন্ধ করে আস্থার মনোভাব ফিরিয়ে আনতে হবে। সময়মত অর্থছাড় করে প্রকল্পের বাস-বায়ন ত্বরান্বিত করতে হবে। বছর ব্যাপী সুষম হারে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে বছরের প্রথম থেকেই রাজস্ব সংগ্রহের গতি বাড়াতে হবে। রাজস্ব প্রশাসনের ভিন্নতা বিবেচনায় রাজস্ব প্রশাসন পরিচলনায় নীতি পরিবর্তন ও সংস্কার করতে হবে।

উন্নয়ন প্রকল্পগুলো সময়ের মধ্যে সম্পন্ন না হওয়ায় একদিকে যেমন ব্যয়, অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির চাপও বৃদ্ধি এই দ্বি-মুখী নেতিবাচক চাপ প্রতিহত করার লক্ষ্যে উন্নয়ন প্রশাসনকে তৎপর করে তোলা প্রয়োজন। রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রকল্পের বাহুল্য কাঙ্খিত উন্নয়ন অর্জনের পরিপন্থি।

আগামী অর্থবছরের জন্য ৪৬ হাজার কোটি টাকার নতুন এ,ডি,পি অনুমোদন করেছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (এন,ই,সি)। এই অর্থ আপাতঃদৃষ্টিতে বিগত বছরের এডিপির তুলনায় বড় দেখালেও বর্তমান মূল্যস্ফীতির কথা বিবেচনা করলে এই অর্থ তেমন বেশি নয়। এর মধ্যে সরকার যোগান দেবে ২৭ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা এবং বিদেশী সহায়তার প্রত্যাশা ১৮ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা। এই সরকারের আমলে চলতি অর্থ বছরের সময়মত বৈদেশিক সাহায্য না আসার ফলে এডিপি বাস্তবায়ন মন্থর হয়ে গেছে। ভবিষ্যতে কি হবে বলা যায় না। স্থানীয় মুদ্রায় অর্থ যোগান দিতে ব্যাংক ব্যবস্থার উপর অতি নির্ভরশীলতায় একদিকে বেসরকারী খাতে ঋণের সরবরাহ সংকুচিত হবে, অন্যদিকে বেসরকারী খাতে উৎপাদন ব্যাহত হবার ফলে মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিতে পারে।
কী রকম বাংলাদেশ দেখতে চাই

সাধারণ মানুষের মধ্য থেকে উঠে আসা তরুণ গণযোদ্ধা ও সৈনিকেরা দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাঁধে কাধ মিলিয়ে যুদ্ধ করে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পরপর তাদের স্বপ্ন ভেঙ্গে গিয়েছিল। অগণিত মানুষের রক্ত, অশ্রু, শ্রমের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে রচিত হয়েছিল ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়। গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে একদলীয় বাকশালী স্বৈরশাসন জাতির কাঁধে চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। সেই স্বৈরব্যবস্থার ভস্মস্তূপ থেকে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এ দেশকে বহুদলীয় গণতন্ত্রে উত্তরণ করেছিলেন। তবে ১৯৮২ এবং ২০০৭ সালে এই গণতন্ত্র ব্যাহত করে স্বৈরশাসন প্রবর্তিত হয়েছিল। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আমাদেরকে সংগ্রামের পথে স্বৈরশাসনের অবসান ঘটাতে হয়েছে।

শহীদ জিয়ার লক্ষ্যই ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল নির্যাস-সঞ্জাত। সেটা হচ্ছে গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, মর্যাদা এবং উন্নয়ন ও উৎপাদনের পথে সমৃদ্ধি অর্জন।

আমাদের ভবিষ্যত স্বপ্ন ও লক্ষ্য হচ্ছে, পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং পরিবেশ বিপর্যয় মোকাবিলায় সক্ষম এমন একটি বাংলাদেশ, যেখানে ক্ষুধা, অপুষ্টি, অশিক্ষা, সামাজিক অবিচার, মানবাধিকার লঙঘন এবং শোষণ, বঞ্চনা ও কোনো ধরণের বৈষম্য থাকবে না। আমরা আগামী দশকের মধ্যে বাংলাদেশকে বিশ্ব সভায় সম্মান ও মর্যাদার আসনে আসীন দেখতে চাই। সেই লক্ষ্য ও স্বপ্ন বাস-বায়নকল্পেঃ

ক    বিশ্বাসযোগ্য এবং পক্ষপাতহীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের নিশ্চয়তা
খ    কার্যকর এবং জবাবদিহিতামূলক সংসদের নিশ্চয়তা
গ    একটি স্বাধীন, দক্ষ, রাজনৈতিক হস-ক্ষেপ বিবর্জিত এবং দুর্নীতিমুক্ত বিচার ব্যবস্থা
ঘ    মানবাধিকার সংরক্ষণ এবং আইনের শাসনের নিশ্চয়তা
ঙ    দক্ষ, দুর্নীতিমুক্ত এবং দল-নিরপেক্ষ গণ এবং পুলিশ প্রশাসন গড়ে তোলা
প্রশাসনিক
আমরা একটি দক্ষ, গতিশীল, যুগ-উপযোগী ও গণমুখি প্রশাসন গড়ে তুলতে চাই।

সেই লক্ষ্যে
ক    স্বচ্ছ এবং জবাবদিহিতামূলক নীতিনির্ধারনী প্রক্রিয়া চালু করা
খ    স্বচ্ছ এবং দলীয় প্রভাবমুক্ত সরকারি ক্রয় ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা
গ    সকল পর্যায়ে ব-মড়াবৎহধহপব চালু।
ঘ    স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশনকে সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা
অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা
আমরা এমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও নীতি কাঠামো গড়ে তুলতে চাই যার মাধ্যমে ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশ দ্রুত দারিদ্র্যমুক্ত একটি মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হবার পথে এগিয়ে যাবে।

সেই লক্ষ্যে
ক    কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, বাণিজ্যিকীকরণ এবং বহুমুখীকরণ
খ    শিল্পখাতে অধিকতর প্রবৃদ্ধি অর্জন
গ    সেবা খাতকে দরিদ্র মানুষের নিছক টিকে থাকার আশ্রয়স্থল থেকে সর্বাত্মক সমৃদ্ধির বাহনে রূপান্তরিত করা
ঘ    রপ্তানী খাতের বহুমুখীকরণ
ঙ    বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের চাহিদার নিরিখে বিশ্বায়নের বাস-বতার সংগে সঙ্গতি রেখে দেশীয় বাজারমুখী শিল্পায়ন
বৈদেশিক শ্রমবাজার
আমরা এমন একটি মানব সম্পদ উন্নয়ন নীতি চাই যার মাধ্যমে সম্ভব হবে
ক    বিদেশে রপ্তানিযোগ্য শ্রমিকদের দক্ষ শ্রমিকরূপে গড়ে তোলা।
খ    বিদেশের শ্রমবাজারে দক্ষ নার্সদের বিরাট চাহিদার সুযোগ গ্রহণের জন্য দেশে প্রতিটি বিভাগীয় শহরে উচ্চ মানের নার্সিং ইনস্টিটিটিউট গড়ে তোলা।
ঘ    এক কথায় বিদেশে প্রেরণযোগ্য শ্রমশক্তির কারিগরি ও প্রযুক্তিগত মান উন্নয়ন।
স্বাস্থ্যবান জাতি
আমরা একটি স্বাস্থ্যবান জাতি গঠনকল্পে জনগণের স্বাস্থ্যসেবা ও সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে একটি বাস্তবসম্মত স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ নীতি প্রণয়ন করতে চাই।

যার লক্ষ্যে হবে
ক    আগামী দশকের মধ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার আরো উল্লেখযোগ্য পর্যায়ে নামিয়ে আনার জন্য প্রণোদনা ও বস্তুগত সহায়তা প্রদান।
খ    গরিব ও বঞ্চিত শ্রেণীর মানুষদের অগ্রাধিকার দিয়ে নাগরিকদের জন্য নিবারণ ও নিরাময়মূলক স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ, আওতা ও পরিধি এবং মান উন্নত করা।
গ    শিশু ও মাতৃ মৃত্যুর হার আরও নামিয়ে আনতে এবং তাদেরকে অপুষ্টি থেকে বাঁচাতে শিশু ও মাতৃসেবার উন্নয়ন।

আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ।

ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকায় ঝুঁকিতে অর্থনীতি

Monday, February 21, 2011

পুঁজিবাজারে ধস, আবাসন শিল্পে স্থবিরতা ও অনুৎপাদনশীল খাতে ঋণের উচ্চ প্রবৃদ্ধির কারণে ব্যাংক খাতের আর্থিক ভিত্তি নড়বড়ে। গুটিকয়েক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আগ্রাসী কার্যক্রম পুরো আর্থিক খাতকেই বিপর্যয়ের মুখে দাঁড় করিয়েছে। বাংলাদেশের আর্থিক খাতের বর্তমান পরিস্থিতিকে ১৯৯৭ সালের এশীয় আর্থিক সংকটের প্রারম্ভিক অবস্থার সঙ্গে তুলনা করেছেন কোনো কোনো বিশ্লেষক।
তাঁদের মতে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুঁজিবাজার, আবাসন খাত ও অনুৎপাদনশীল খাতে অতিমাত্রায় ঋণ সম্প্রসারণের কারণে এশিয়ার অনেক দেশই ওই সময় চরম সংকটে পড়েছিল। জিডিপির প্রয়োজনের তুলনায় বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বেশি : ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ ব্যাপক বেড়েছে, যা জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রয়োজনীয় ঋণ সরবরাহের তুলনায় অনেক বেশি। এ বিষয়ে খোদ মুদ্রানীতিতে বলা হয়েছে, 'অর্থবছরের প্রথমার্ধজুড়েই (২০১০ সালের জুন থেকে ডিসেম্বর) অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ব্যাপক। বিদায়ী ২০১০ সালের জুন থেকে নভেম্বর_এই পাঁচ মাসের ব্যবধানে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বেড়েছে ২৪ দশমিক ২ শতাংশ। বেসরকারি খাতের এই ঋণের প্রবাহ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের তুলনায় অনেক বেশিই ছিল।' অপরদিকে এ সময়ে ব্যাংকগুলোর আমানত সংগ্রহের প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ২১ শতাংশ এবং ঋণ বিতরণের প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ২৮ শতাংশ।
বেসরকারি খাতের এই বিপুল ঋণ প্রবৃদ্ধির জন্য
সরকারের সিদ্ধান্তকেই দায়ী করেছেন একাধিক ব্যাংক বিশ্লেষক। বেসরকারি একটি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কালের কণ্ঠকে জানান, বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধিতে সবচেয়ে সহায়ক ছিল কিছু খাতে ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ১৩ শতাংশ
নির্ধারণ করে দেওয়া। যেখানে সরকার গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ দিতে পারছে না, সেখানে শিল্প ও এসএমই খাতে ঋণের সর্বোচ্চ সুদ হার বেঁধে দেওয়ার কোনো যৌক্তিক কারণ ছিল না।
তিনি বলেন, এতে সমস্যা হয়েছে ত্রিমুখী। প্রথমত, ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার বেঁধে দেওয়ায় ব্যাংকগুলো বাধ্য হয়েছে আমানতের বিপরীতে ঋণের সুদহার কমাতে। দ্বিতীয়ত, ব্যাংকগুলো মুনাফা ধরে রাখতে কনজ্যুমার ক্রেডিটে বেশি অর্থায়ন করেছে। তৃতীয়ত, চড়া দ্রব্যমূল্যের বাজারে ৫ থেকে ৬ শতাংশ সুদহারে আমানতকারীরা নিরুৎসাহিত হয়ে অন্য লাভজনক খাতে বিনিয়োগের কথা ভাবতে বাধ্য হয়েছেন। লাভজনক খাত ছিল সঞ্চয়পত্র। সেখানেও সুদহার কমানো এবং এর আয়ের ওপর করারোপ করায় সঞ্চয়পত্র ভেঙে পুঁজিবাজারের দিকে ঝুঁকেছে অসংখ্য বিনিয়োগকারী।
সরকারি ব্যাংকের একজন প্রধান নির্বাহী কালের কণ্ঠকে বলেন, সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানো ও করারোপ সরকারের অন্যতম একটি ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। কারণ এতে বিনিয়োগকারীরা সঞ্চয়পত্র ভেঙে পুঁজিবাজারের দিকে ধাবিত হয়েছেন। যদি সঞ্চয়পত্রে সরকারের ভর্তুকি দিতেই হতো তাহলে এর পরিমাণ আর কত হতো! নিশ্চয়ই বর্তমানে পুঁজিবাজারে ধসের চেয়ে ভয়াবহ হতো না। গত সপ্তাহে অর্থমন্ত্রীর উপস্থিতিতে এক ঘরোয়া বৈঠকেও সিদ্ধান্তটির সমালোচনা করেন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী।
বিশ্লেষকদের মতে, প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ বা রেমিট্যান্স বিনিয়োগের কোনো দিকনির্দেশনা না থাকায় প্রান্তিক মানুষ তা ব্যয় করেছে জমি কেনাসহ নানা অনুৎপাদনশীল খাতে, যা মূল্যস্ফীতিকে ত্বরান্বিত করেছে। মূল্যস্ফীতির প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি এবং তা প্রবৃদ্ধিকে গিলে ফেলে। সুতরাং সরকারের উচিত ছিল, ব্যাংক আমানত ও সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানোর পরিবর্তে কিছুটা বাড়িয়ে দেওয়া। তাতে রেমিট্যান্সের বিপুল পরিমাণ অর্থ হয়তো ব্যাংক খাতেই থেকে যেত। পরবর্তী সময়ে কোনো উৎপাদনশীল খাতে তা বিনিয়োগ করা যেত বলে মনে করেন ব্যাংকের একজন প্রধান নির্বাহী।
পুঁজিবাজারে ধসের কারণে ঝুঁকিতে ব্যাংকিং খাত : বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ বর্তমানে প্রায় ১২ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা। এ ছাড়াও ২০১০ সালে ব্যাংকগুলো নতুন করে ঋণ বিতরণ করেছে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে অর্থায়নে ৩৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি, শিল্পায়নে প্রায় ২৮, এসএমই ও কৃষিতে প্রায় ১০ শতাংশ ঋণের প্রবৃদ্ধি বিবেচনায় এ খাতগুলোতে মোট নতুন ঋণের প্রায় ৬০ শতাংশ গেছে। বাকি প্রায় ৪০ শতাংশ (প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা) গেছে সরাসরি উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত নয় এমন খাতগুলোতে। এ ছাড়াও ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে ভোক্তাপণ্য কেনার জন্য দেওয়া ঋণের পরিমাণ সাড়ে ১২০০ কোটি টাকা। অর্থনীতিবিদদের ভাষায় যেসব খাত অনুৎপাদনশীল তার মধ্যে গত বছর পুঁজিবাজার ছিল শীর্ষে। অনুৎপাদনশীল খাতের ঋণের সিংহভাগই পুঁজিবাজারে গেছে বলে ধারণা করছেন তাঁরা। এরই মধ্যে কিছু ব্যাংকের আর্থিক সংকট বেশ প্রকট হয়ে উঠেছে। এ ব্যাংকগুলো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ব্যাপকভাবে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেছে। কেউ কেউ আন্তঃব্যাংক কলমানি মার্কেট থেকে টাকা ধার করেও তাদের মার্চেন্ট ব্যাংক শাখায় দিয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রমাণ পেয়েছে। পুঁজিবাজারে ধসের কারণে এসব ব্যাংকের বড় অঙ্কের বিনিয়োগ আটকে পড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নির্দিষ্ট সময়ে বিনিয়োগ উঠে না আসায় ব্যাংকগুলোর দায়-সম্পদ ব্যবস্থাপনায় অসঙ্গতি দেখা দিয়েছে। ফলে বর্তমানে কলমানি থেকে প্রতিদিন এসব ব্যাংক বেশ বড় অঙ্কের টাকা ধার করে চলেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'পুঁজিবাজারে ধস অব্যাহত থাকলে কয়েকটি ব্যাংকের বড় অঙ্কের খেলাপি ঋণ সৃষ্টি হতে পারে, যা সমগ্র ব্যাংকিং খাতের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি সৃষ্টি করবে। তাই আমরা ব্যাংকগুলোকে ঋণ আমানত অনুপাত কমিয়ে আনার নির্দেশ দিয়েছি।'
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক এস কে সুর চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা ব্যাংকগুলোকে সুরক্ষিত রাখতে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এখন ব্যাংকগুলোর পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ মোটামুটি গ্রহণযোগ্য মাত্রায় চলে এসেছে।'
অপরদিকে তুলনামূলক অরক্ষিত খাত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বেশ কয়েকটির মুনাফার অধিকাংশই আসে পুঁজিবাজার থেকে। এদের অনেকেরই পুঁজিবাজারে বড় ধরনের মূলধন আটকে গেছে। বাজারে মন্দাবস্থা এবং ক্রেতা না থাকার কারণে এসব প্রতিষ্ঠান ট্রিগার সেলেও যেতে পারছে না। এ ছাড়া এ বিষয়ে এসইসির কঠোর নির্দেশনা রয়েছে।
বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল কম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের চেয়াম্যান ও লঙ্কা বাংলা ফিন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মফিজউদ্দিন সরকার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বর্তমানে ছয়টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মার্চেন্ট ব্যাংকিং উইং রয়েছে। এদের পুঁজিবাজারে শেয়ার ক্রয়ের বিপরীতে দেওয়া ঋণের পরিমাণ প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। ২৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব বিনিয়োগ রয়েছে প্রায় সাড়ে ৭০০ কোটি টাকা। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পুঁজিবাজারে আনুমানিক বিনিয়োগ প্রায় তিন হাজার ৩০০ কোটি টাকার মতো। পুঁজিবাজারে ধসের কারণে গ্রাহকদের দেওয়া এই বিপুল পরিমাণ ঋণের একটি বড় অংশ আগামী প্রান্তিকে খেলাপি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে মার্কেটের এ অবস্থায় আমরা ট্রিগার সেলে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।'
সার্বিক পরিস্থিতিতে পুঁজিবাজারে ধসের কারণে ব্যাংকিং খাতের প্রায় বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আগামী দুই প্রান্তিক অর্থাৎ মার্চ ও জুন প্রান্তিকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক বিবরণীতে এর প্রতিফলন ঘটতে পারে।
আবাসন শিল্পে মন্দাবস্থা ও বিপুল অর্থ খেলাপি হওয়ার আশঙ্কা : গত কয়েক বছর ধরে জমির মূল্য বেড়েছে লাগামহীনভাবে। এজন্য ব্যাংকগুলোর সহজ শর্তে অর্থায়নই ছিল দায়ী। সহজে অর্থ পাওয়ার সুবাদে রাজধানীসহ সারা দেশে হাউজিং ব্যবসার প্রসার বেড়েছে। জমির দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। এ অবস্থায় তৈরি হয়েছে বিপুল উদ্যোক্তা। বিনিয়োগও হয়েছে প্রচুর। ফলে ব্যাংকের অর্থায়নও রয়েছে অনেক।
রিয়্যাল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব)_এর তথ্য অনুযায়ী, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগের অভাবে আবাসন শিল্পমালিকদের প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা এবং ফ্ল্যাট ক্রেতাদের প্রায় ১২০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ আটকে পড়েছে। রিহ্যাবের সদস্য নয় এমন উদ্যোক্তা ও ক্রেতাদের সমপরিমাণ অর্থ বিবেচনা করলে প্রায় আট হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আটকে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অনেক ডেভেলপার চরম আর্থিক সংকটে নিমজ্জিত হয়েছেন। প্রকল্প সম্পূর্ণ করতে পারছেন না অনেকে। আবার অনেকে সম্পূর্ণ করেও প্রকল্প হস্তান্তর করতে পারছেন না গ্যাস-বিদ্যুৎ না থাকার কারণে। এই অবস্থা চলতে থাকলে অনেক ডেভেলপারই দেউলিয়া হয়ে যাবেন বলে রিহ্যাব সূত্র আশঙ্কা প্রকাশ করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এশীয় মন্দার সময়ে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুঁজিবাজার এবং আবাসন খাতে অনেক বেশি বিনিয়োগ করেছিল। তবে আমরা এখনো সে পর্যায়ে যাইনি। কিছু ব্যাংক ১০ শতাংশের বেশি বিনিয়োগ করেছে। তারা অন্যান্য খাত থেকে ডিভিডেন্ট দিচ্ছে। পুঁজিবাজারে খেলাপি হলে তারা সেখান থেকে প্রভিশন করবে।'
তিনি আরো বলেন, 'বাংলাদেশের আর্থিক খাত মন্দাকবলিত হতে পারে বলে এখনো আমি মনে করি না। পুঁজিবাজারে ধস নেমেছে এটাও বলা ঠিক হবে না। কারণ এটাকে আবার কার্যকর করার প্রচেষ্টা চলছে।'
তবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে নজর বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন ড. সালেহউদ্দিন। তিনি বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগ করে থাকে। তারা পুঁজিবাজারে স্বল্প মেয়াদি বিনিয়োগের দিকে যেন অতিমাত্রায় ধাবিত না হয় সেদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নজর দেওয়া উচিত। এ ছাড়াও এ প্রতিষ্ঠানগুলোর মূলধন পর্যাপ্ততা বাড়ানো জরুরি বলে মনে করেন তিনি। তবে মন্দাবস্থা যাতে সৃষ্টি না হয় সেজন্য সরকারকে সতর্ক থাকতে পরামর্শ দিয়েছেন বিশিষ্ট এ অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, সরকারকে ম্যাক্রো-ইকোনমির দিকে আরো বেশি নজর দিতে হবে। জ্বালানিসহ অর্থনৈতিক বিষয়গুলোর প্রতি জোর দিতে হবে। উৎপাদনশীল খাতে ঋণের প্রবাহ নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
এশিয়ান মন্দার কারণ পর্যবেক্ষণ করে একটি প্রতিবেদন লেখেন ওয়েস্টার্ন সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ইউএন-ডেসার সিনিয়র ইকোনমিক অ্যাফেয়ার্স অফিসার ড. আনিছ চৌধুরী। তাঁর পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ১৯৯০-এর দিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বেড়ে যায়, যা তাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশিই ছিল। থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার ব্যাংকগুলো আবাসন খাতেও প্রচুর বিনিয়োগ করে। এক পর্যায়ে ব্যাংকের মুনাফা কমতে শুরু করে এবং কিছু কিছু ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে পড়ে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুঁজিবাজারেও অধিক হারে বিনিয়োগ করে। ফলে পুঁজিবাজারে অতিমূল্যায়নের ঘটনা ঘটে। একসময় পুঁজিবাজারে ধস নামে এবং ব্যাংকগুলো বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়ে। বাংলাদেশের আর্থিক খাতেও এসব লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে বলে মন্তব্য করেন এ বিশ্লেষক। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দীন আহমেদের কণ্ঠেও উদ্বেগের সুর। আর্থিক খাত ও পুঁজিবাজারে সাম্প্রতিক বাব্ল বা বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতিকে অর্থনৈতিক সংকটের পূর্বাভাস হিসেবে দেখছেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ মুদ্রানীতির পর্যালোচনায় ড. আনিছ চৌধুরী লিখেছেন, অতিমূল্যায়িত পুঁজিবাজারে ধস সবার জন্যই বেদনাদায়ক। প্রাইস কারেকশন আরো বিলম্বিত হওয়ার কারণে যে ধস নামবে তা আরো বেদনাদায়ক হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত, পুুঁজিবাজারের মতো অনুৎপাদনশীল খাতের ঋণ সম্প্রসারণ বন্ধ করা। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ বাজারের স্থায়িত্ব ও উচ্চ প্রবৃদ্ধির জন্য পুঁজিবাজার ও রিয়েল এস্টেট সেক্টর সঠিকভাবে মূল্যায়িত হওয়া উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সভাপতি কে মাহমুদ সাত্তার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আর্থিক খাতে মন্দা হতে পারে দুটি কারণে। এগুলো হচ্ছে_জ্বালানি সংকট এবং জমির অতিমূল্য। জমির দাম সাংঘাতিক বেড়েছে, এখানে কারেকশন হতে পারে।'
বাংলাদেশ ব্যাংক গত মে মাসে রিয়েল এস্টেটে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। এ অবস্থায় এ খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি আর বাড়বে না। এখন গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ হওয়ার ফলে চলতি ঋণগুলো খেলাপি হতে পারে। তবে বড় ধরনের করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেওয়া ঋণখেলাপি হওয়ার আশঙ্কা নেই। কারণ তাদের অন্যান্য খাতের লভ্যাংশ থেকে এ ঋণ ফেরত আসবে। সমস্যা হবে ছোট উদ্যোক্তাদের নিয়ে।
মন্দা ঠেকাতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি বাড়ানোর পক্ষে মত দেন মাহমুদ সাত্তার। অর্থনৈতিক গতি বাড়াতে সরকার বিদ্যুতের জোগান বাড়াতে সক্ষম হলেও গ্যাসের জোগান বাড়ানো নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে ব্যাংক পরিচালকদের বৈঠক

Friday, February 11, 2011

র্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোকে নিজস্ব মূলধন বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন। অন্যদিকে প্রথম আলোতে প্রকাশিত সংবাদ নিয়ে বিষোদ্গার করেছেন কোনো কোনো রাজনৈতিক ব্যাংক পরিচালক। অবশ্য আরও কয়েকজন পরিচালক বলেছেন, ব্যাংকের আর্থিক সূচক যদি খারাপ থাকে, উদ্বেগজনক হয়, সেদিকেই নজর দেওয়া উচিত।

রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় গতকাল শুক্রবার বিকেলে রাষ্ট্র মালিকানাধীন জনতা, রূপালী ও বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের সঙ্গে বৈঠককালে এসব পরামর্শ ও আলোচনা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়।
তিন ঘণ্টার বেশি সময় ধরে এ বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান, অর্থসচিব মুহাম্মদ তারেক, ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শফিকুল ইসলাম পাটোয়ারীসহ তিন ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের চেয়ারম্যান, পরিচালক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকেরা উপস্থিত ছিলেন।
সূত্র জানায়, অর্থমন্ত্রী বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণে আরও বেশি যত্নবান হওয়ার নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে তিনি ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের সদস্যদের সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ব্যাংক পরিচালনাকে গতিশীল করতে বলেন।
সূত্র জানায়, বৈঠকের শুরুতে জনতা ব্যাংকে নিয়োজিত একজন রাজনৈতিক পরিচালক প্রথম আলোর বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেন। তিনি বলেন, এসব ষড়যন্ত্র। প্রধানমন্ত্রীও এই পত্রিকার বিরুদ্ধে সংসদে বক্তব্য দিয়েছেন। বৈঠক ডাকা হলেই পত্রিকাটি এমন সব প্রতিবেদন ছাপে। তিনি বলেন, ‘আমি ব্যাংকের গাড়ি ব্যবহার করি না। অথচ বলা হচ্ছে গাড়ি ব্যবহার করি।’
এই পরিচালককে সমর্থন করেন আরও কয়েকজন রাজনৈতিক পরিচালক। তাঁরা সংবাদপত্রের সমালোচনা করেন। কিন্তু এ পর্যায়ে একজন পরিচালক বলেন, পত্রিকায় তথ্য কীভাবে গেল, সেটা খুঁজে দেখার চেয়ে আগে দেখা দরকার, তথ্য-উপাত্ত সঠিক কি না। যদি তথ্য-উপাত্ত, ব্যাংকের আর্থিক সূচকগুলো সঠিক হয়, যদি ব্যাংক থেকে অর্থ নিয়ে গিয়ে শেয়ারবাজারে খাটানো হয়, তবে তা লুকানো যাবে না। বর্তমান পরিচালকেরা যখন দায়িত্ব ছেড়ে দেবেন তখন কিন্তু সব তথ্য-উপাত্ত বেরিয়ে যাবে। ব্যাংকের অবস্থাও খারাপ হয়ে যাবে। ফলে এখন ব্যাংক যদি সঠিকভাবে না চলে, তাহলে ব্যাংকগুলোকে সঠিক পথে আনতে হবে।
এ বক্তব্যের পর বৈঠকের পরিবেশ বদলে যায়। অর্থমন্ত্রীসহ আরও কয়েকজন ব্যাংকের আর্থিক শৃঙ্খলা রক্ষা ও ভালোভাবে ব্যাংক চালানোর আহ্বান জানান। তাঁরা বলেন, ব্যাংকের আর্থিক সূচক ভালো থাকলে এসব প্রচারণা হবে না।
অর্থমন্ত্রী এ পর্যায়ে বলেন, রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকের অনেক সামাজিক কাজ করতে হয়। যে কারণে কিছু তদবির আসে। এগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া সব আমলেই ছিল। তবে বর্তমান আমলে ব্যাংকের অনেক উন্নতিও হয়েছে।
বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, বেসিক ব্যাংকের কর্মকাণ্ড নিয়ে একটি প্রচারমাধ্যমে নেতিবাচক সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে। সংবাদটি অত্যন্ত অপরিপক্ব ও অজ্ঞতাপ্রসূত। এর আগেও এ ধরনের সংবাদ পরিবেশন করা হয়েছে, যার কোনো ভিত্তি নেই।
এর আগে গত ২৭ জানুয়ারি অর্থমন্ত্রী সোনালী ও অগ্রণী ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের সঙ্গে বৈঠক করেন।

শেয়ারবাজার ধসের সংকেত দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক

Saturday, January 29, 2011

দেশের শেয়ারবাজারে বড় বিপর্যয়ের সংকেত দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রায় এক বছর আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের কাছে তাদের একটি প্রতিবেদন তুলে ধরে পরিষ্কার করে যে, বাজার কতটা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

স্পর্শকাতর বিষয় হওয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্ট এসইসি, ডিএসই ও গবেষকদের কয়েকজনকে ডেকে এনে একটি নির্বাহী সেমিনারে গবেষণা সমীক্ষাপত্রের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে। এ সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বাজার বিপর্যয় পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশের বাজার বিশ্লেষণ করা হয়। এর পরপরই ব্যাংক খাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি, মুদ্রানীতি ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আসে।
গবেষণায় বিশ্বের উন্নত কয়েকটি দেশের শেয়ারবাজার, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর বাজার এবং বাংলাদেশে ’৯৬ সালে বাজার বিপর্যয়ের সঙ্গে ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তথ্য-উপাত্ত ও পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়। সেখানে দেখানো হয়, পুঁজিবাজার থেকে বিনিয়োগকারীর লভ্যাংশ আয় ও মূল্য পরিস্থিতির মধ্যে যে ব্যবধান তা কতটা বেড়েছে এবং ব্যবধানের কোন পর্যায়ে বিভিন্ন দেশে ও বাংলাদেশে ’৯৬ সালে বাজার পতন হয়েছে।
সেমিনারে এসইসি ও ডিএসইর দিক থেকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, কেন্দ্রীয় ব্যাংক কি বলতে চাইছে যে, দেশের শেয়ারবাজার বিপর্যয়ের পর্যায়ে (বাবলস) উপনীত হয়েছে। জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর (ডিজি) জিয়াউল হাসান সিদ্দিকী বলেন, ‘আমরা বাবলস আছে কি না সেটা বলছি না, এটা বলবেন বাজার-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। আমরা শুধু বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শেয়ারবাজার যে পর্যায়ে বাবলস তৈরি হয়েছে, তার সঙ্গে ডিএসইর পরিস্থিতি লেখচিত্রে উপস্থাপন করেছি।’
গবেষকদের কাছে প্রশ্ন তোলা হয়, ’৯৬ আর আজকের বাজার তো এক নয়। জবাবে গবেষকদের তত্ত্বাবধায়ক আহসান হাবীব মনসুর বলেন, ‘বাজারের কতগুলো মৌলিক দিক (মার্কেট ফান্ডামেন্টাল) বিশ্বের সব দেশে এবং সব সময়ের জন্য একই।’
গবেষণা অনুযায়ী, প্রদর্শিত সব কটি দেশ ও ’৯৬ সালে বাংলাদেশে বাজার ধসের পরিস্থিতির তুলনায় ২০০৯ সালের নভেম্বরে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) মূল্য পরিস্থিতি অনেক বেশি তীক্ষভাবে বাড়তে শুরু করে এবং এ সময় শেয়ারের বিপরীতে লভ্যাংশ আয় ও মূল্য আয় অনুপাত (পিই) এবং মূল্যসূচকের ব্যবধান ছিল সর্বোচ্চ পর্যায়ে।
সূত্র জানায়, ২০১০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি গভর্নর আতিউর রহমানের সভাপতিত্বে সেমিনারে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি), ডিএসই, সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি অংশ নেয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব নাসিরউদ্দিন আহমেদ, এসইসির তৎকালীন সদস্য মনসুর আলম, নির্বাহী পরিচালক ফরহাদ আহমেদ, পরিচালক হাসান মাহমুদ, ডিএসইর তৎকালীন সহসভাপতি ও বর্তমান সভাপতি শাকিল রিজভী, নির্বাহী আফজালুর রহমান, সিপিডির তারিকুল ইসলাম ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণাসহ নীতিনির্ধারণী কয়েকটি বিভাগের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
আইএমএফের সাবেক অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান হাবীব মনসুরের তত্ত্বাবধানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গবেষণা বিভাগের যুগ্ম পরিচালক আবদুল ওয়াহাব ও সহকারী পরিচালক ওমর ফারুক এই গবেষণা সমীক্ষাটি তৈরি করেন।
এ বিষয়ে গত বৃহস্পতিবার জিয়াউল হাসান সিদ্দিকী বলেন, ‘আমি শুধু বলব গবেষণাপত্রে পরিষ্কার একটা দিকনির্দেশনা ছিল। আর বাংলাদেশ ব্যাংক সেই বার্তাটি এসইসি ও ডিএসইর কাছে পৌঁছে দিয়েছে।’ কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই গবেষণার দিকনির্দেশনাটি পরবর্তী সময়ে অনুসরণ করেছে কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপগুলো দেখলেই তার মধ্যে পরিষ্কার জবাব পাওয়া যাবে।’
এ বিষয়ে এসইসি চেয়ারম্যান জিয়াউল হক খোন্দকারের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের এই গবেষণা ধরে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপও নিয়েছি।’ তবে তিনি বলেন, এর আগ থেকেই বাজার সামাল দিতে কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়। জানুয়ারি মাসে এসে এসইসি বিনিয়োগকারীদের সচেতন বা সতর্ক করতে সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপনও ছাপে বলে জানান চেয়ারম্যান।
গবেষণার কিছু দিক: গবেষণায় দেখানো হয়েছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাজার বিপর্যয়ের আগে একটা বড় উত্থান হয়। যেমনটি হয়েছে ’৯৬ সালে বাংলাদেশের বাজারে। একই পরিস্থিতি পাওয়া যায় জাপানের নিক্কি, চীনের সাংহাই, আমেরিকার ন্যাসডাক, ভারতের বোম্বে-সেনসেক্স, হংকংয়ের হ্যাংসেং, শ্রীলঙ্কার কলম্বো ও সৌদি আরবের তাসি মূল্যসূচকে। বাংলাদেশে ডিএসইর ২০১০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সূচক উত্থানকে গবেষণায় বিবেচনা করা হয়। তার আগের দুই বছরের সূচক পর্যালোচনাও ছিল এতে।
২০১০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ডিএসইর সাধারণ মূল্যসূচক ছিল ৫৭৪৫ দশমিক ৭৮, ডিএসআই সূচক ছিল ৪৭০০ দশমিক ৮৭ আর ডিএসই-২০ সূচক ছিল ৩১৩৪ দশমিক ৩৫। এ সময় বাজারের মূল্য আয় অনুপাত ছিল ৩০ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। অন্যদিকে লভ্যাংশ আয় ছিল ১ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাজার ধসে পড়ার সময় লভ্যাংশ আয় ও বাজারের মূল্যস্তরের মধ্যে বড় ধরনের ব্যবধান তৈরি হওয়ার উপাত্ত মেলে। এসব দেশের তুলনায় বাংলাদেশের উত্থানের হার বেশি থাকায় বড় ঝুঁকির সংকেত পায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
২০০৯ সালের আগস্ট থেকে একটা বড় ধরনের উত্থান ছিল বাজারে। এ সময় বাজারের উত্থান সামলে নেওয়া হয় গ্রামীণফোনের বড় একটা আইপিও দিয়ে। ওই সময় বাজার থেকে বড় অঙ্কের অর্থ বের হয়ে পড়ে। আবার নতুন শেয়ার যুক্ত হলে সামলে ওঠে বাজার। কিন্তু ডিএসই ভুলভাবে সূচক হিসাব করায় প্রকৃত বাজারের চিত্র এতে প্রকাশ পায়নি।
গ্রামীণফোনের শেয়ার লেনদেন শুরু হওয়ার পর বাজারে আবারও একটা দ্রুত বৃদ্ধি দেখা যায়। গবেষণায় দেখানো হয়, এমনকি ডিএসই সঠিকভাবে সূচক হিসাব করলেও উত্থান ছিল দ্রুত ও তীক্ষ। এই বৃদ্ধি অব্যাহত থাকে ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত। এ সময় বাজারের মৌলশক্তি ক্রমশই দুর্বল হয়ে পড়ে এবং লভ্যাংশ আয়ের সঙ্গে মূল্য পরিস্থিতির মধ্যে বড় ধরনের ব্যবধান তৈরি হয়।
বিভিন্ন দেশে বাজার বিপর্যয়ের সময় সেখানে বাজার পিইর সঙ্গে লভ্যাংশ আয়ের তুলনা করা হয় গবেষণায়। এতে দেখা যায়, ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ডিএসইর পিই সর্বাধিক ৩০ দশমিক ৬-তে ওঠে। তখন লভ্যাংশ আয়ের হার হয় ১ দশমিক ৬ শতাংশ। অন্যদিকে বাজার বিপর্যয়ের সময় বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জের পিই ছিল ২০ দশমিক ৩ (জানুযারি ’০৮) ও লভ্যাংশ আয়ের হার ছিল ১ দশমিক ৩ শতাংশ। শ্রীলঙ্কায় (সেপ্টেম্বর ’০৭) পিই ছিল ১৪ দশমিক ৪৪ ও লভ্যাংশ আয়ের হার ছিল ২ দশমিক ২ শতাংশ। জাপানে বাজার (ডিসেম্বর ’৮৯) বিপর্যয়ের সময় পিই ছিল ৩৯ দশমিক ৮ ও লভ্যাংশ আয়ের হার ছিল শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ। চীনে (অক্টোবর ’০৭) পিই ছিল ১৮ দশমিক ৩ ও লভ্যাংশ আয় ছিল ২ দশমিক ৭ শতাংশ, সৌদি আরবের (ফেব্রুয়ারি ’০৬) পিই ৪৭ দশমিক ৩ ও আয় ছিল ১ দশমিক ৪ শতাংশ এবং ইউএসএর ন্যাসডাক (মার্চ ২০০০) স্টক এক্সচেঞ্জের পিই ছিল ৩৫ দশমিক ৪ ও লভ্যাংশ আয়ের হার ছিল মাত্র শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ।
পরবর্তী পরিস্থিতি: ডিএসইর বাজারে ফেব্রুয়ারির শেষে এসে লভ্যাংশ আয় কমে ও পিই বাড়ে। তবে জুনে গ্রামীণফোন লভ্যাংশ দিলে পিই কিছুটা কমে আসে। মার্চ-এপ্রিল মাসে মূল্যসূচক কিছুটা সংশোধনের মধ্যে ছিল। মধ্য মে পর্যন্ত ৫৫০০ সূচকের মধ্যে ওঠানামা করে বাজার। তারপর থেকে ওঠানামার মধ্য দিয়ে দ্রুত বেড়ে চলে বাজার। অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে সূচক ৭৫০০ ছাড়িয়ে যায়। এ পর্যায়ে আবার তীক্ষ উত্থান শুরু হয়ে ৫ ডিসেম্বর ডিএসইর সাধারণ সূচক গিয়ে ঠেকে ৮৯১৮ দশমিক ৫১-তে। এরপরই ধসের কবলে পড়ে বাজার।
এ পরিস্থিতি সম্পর্কে গবেষক আবদুল ওয়াহাব বলেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বাজার বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে ডিএসইর সূচকে এই বৃদ্ধি বাজারে মৌলশক্তির সঙ্গে যায় না। ফলে বাজারের উত্থানপ্রবণতা জানুয়ারির প্রথমভাগে বা ডিসেম্বরের শেষ সময়ে আর টেকসই হয়নি।’
আহসান হাবীব মনসুর গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুঁজি ও মুদ্রাবাজারের সব দিক নিয়েই এ গবেষণা করা হয়। আমরা এর মাধ্যমে পরিষ্কার ইঙ্গিত দিয়েছি বাজারে। বলেছি, “বাজার অতি মূল্যয়িত।” ধারণা করি কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরবর্তী সময়ে তাদের দিক থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে।’
গবেষণা ধরে বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে মতামত চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘গবেষণার ভিত্তিতে আমি তো মনে করি এখনো বাজার অতি মূল্যায়িত। কৃত্রিমভাবে বাজারকে সহায়তা দেওয়া কারও জন্যই শুভ হবে না।’
 
Support : Dhumketo ধূমকেতু | NewsCtg.Com | KUTUBDIA @ কুতুবদিয়া | eBlog
Copyright © 2013. Edu2News - All Rights Reserved
Template Created by Nejam Kutubi Published by Darianagar Publications
Proudly powered by Dhumketo ধূমকেতু