একটি সুষ্ঠু, আস্থাভাজন, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত দেশের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা থেকেই যাবে বলে মন্তব্য করেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
তার মতে, সঙ্কট দূর করতে হলে রাজনৈতিক বিরোধীদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। আর গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হলে বিনিয়োগেও আস্থার সঙ্কট কাটবে না। গতকাল রাজধানীর ধানমন্ডিতে সিপিডি কার্যালয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি ২০১৩-১৪ দ্বিতীয় অন্তর্বর্তীকালীন পর্যালোচনা বিষয়ক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি। এতে উপস্থিত ছিলেন সংস্থাটির গবেষণা পরিচালক ড. ফাহমিদা হক ও খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন। গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, অস্থিরতা না কাটলে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদের দ্বিধা থেকে যাবে। সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান না হলে আস্থার সঙ্কট কাটবে না। আর এটা যদি না হয় তবে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ হবে না। তিনি আরও বলেন, জনসমর্থনের অভাব ও আস্থার অভাব থাকলে দীর্ঘমেয়াদে সুফল পাওয়া যায় না। তিনি বলেন, আপাতত শান্ত পরিস্থিতি বিরাজ করছে। অনেক বন্ধ ছোটখাটো প্রতিষ্ঠান সচল হচ্ছে। কিন্তু এতে নতুন বিনিয়োগ বাড়বে বলে মনে হয় না। বিনিয়োগ বাড়াতে হলে নীতি সঙ্কট দূর করতে হবে, অচলাবস্থার নিরসন করতে হবে। তিনি বলেন, জনপ্রত্যাশার কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জনে সমঝোতার মাধ্যমে একটি নির্বাচনের প্রত্যাশা সিপিডি’র। ড. দেবপ্রিয় বলেন, গত ছয় মাসে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে গ্রামীণ অর্থনীতি ও দেশীয় শিল্পখাত ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এ জন্য শুধু রপ্তানিমুখী শিল্পকে নয় বরং সব ধরনের শিল্পকে সমান গুরুত্ব দিয়ে বিশেষ প্রণোদনা দিতে হবে। দেশের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গ্রামীণ অর্থনীতি। এর মধ্যে পোল্ট্রি ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের বিশেষ প্রণোদনার আওতায় নিয়ে এসে কৃষি ঋণ বৃদ্ধি ও ভাতার ব্যবস্থা করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। এক প্রশ্নের জবাবে অর্থবছরের প্রথমার্ধে ৪ খাতের আর্থিক ক্ষতির হিসাব তুলে ধরে তিনি বলেন, রেল ও সড়ক যোগাযোগ খাতে ১৬ হাজার ৬৮৯ কোটি, কৃষি ও কৃষিজাত শিল্পখাতে ১৫ হাজার ৮২৯ কোটি, রপ্তানিমুখী বস্ত্রশিল্পে ১৩ হাজার ৭৫০ কোটি ও পর্যটন খাতে ২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার ক্ষতির চিত্র উঠে এসেছে। সিপিডি’র পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে ক্ষতির এই আর্থিক মূল্যায়ন তৈরি করা হয়েছে। মোস্তাফিজুর রহমান গবেষণাপত্র উপস্থাপনের শুরুতেই বলেন, জনপ্রত্যাশা ও অর্থনীতির শক্তির ভিত্তিতে উচ্চ প্রবৃদ্ধির যে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল, সেটি হারিয়ে গেছে। উচ্চ প্রবৃদ্ধির সেই সম্ভাবনা ফিরিয়ে আনা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। তিনি বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দেশের অর্থনীতিকে মাশুল দিতে হচ্ছে। বর্তমানে অর্থনীতির গতি একেবারে শ্লথ হয়ে পড়েছে। ঘোষিত বাজেটের আয় ও ব্যয় উভয় অনেক কমে গেছে। নানা সঙ্কটের কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্যের সহজলভ্য থাকলেও বাংলাদেশের খাদ্য মজুত কমেছে। অপরদিকে খাদ্য মূল্যস্ফীতি অনেক বেড়ে গেছে। এছাড়া, নানা অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে ব্যাংকিং খাত নাজুক অবস্থা পার করছে। এদিকে অস্থিরতার কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হওয়ায় সরকারের রাজস্ব আয়েও বড় ধরনের ধসের মধ্যে পড়েছে।
গবেষণাপত্রে বলা হয়, অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে সরকারের রাজস্ব আদায়, বিদেশী বিনিয়োগ, বৈদেশিক অনুদানসহ বিভিন্ন খাতে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আয় অনেক কম হলেও ব্যয়ের মাত্রা কম থাকায় ঘাটতি নেই। এটি দেশের সার্বিক উন্নয়নের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। তাই আয় এবং ব্যয়ের কাঠামোকে পুনর্গঠন করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাজেটবহির্ভূত ব্যয় বাড়ানো দরকার।
গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশে বর্তমানে খাদ্য মজুত সাড়ে ৯ লাখ টন, যা গত বছরের তুলনায় ৩৮ শতাংশ কম। কৃষি ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি হলেও তা শুধু ধান উৎপাদনে। বাকি শস্যের ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি অনেক কমেছে। শাকসবজির ক্ষেত্রে উৎপাদনকারীরা ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আবার ভোক্তা বাজার থেকে বেশি মূল্যে তা কিনেছে। পোল্ট্রি ও দুগ্ধ খামারিরা ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।
সিপিডি’র দাবি, বিশ্বব্যাপী চালের দাম অনেক কম হলেও বাংলাদেশে তা বেশি। এ জন্য মজুত কমেছে। যাতে ভবিষ্যতে খাদ্য ঘাটতি না হয়, সেজন্য কম দামে বিদেশে বাজার থেকে চাল আমদানির ওপর গুরুত্ব দেয় সিপিডি।
গবেষণায় বলা হয়েছে, গত কয়েক মাসে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অর্থনীতির গতি শ্লথ হয়ে পড়ায় রাজস্ব আহরণে ঘাটতি হয়েছে। সার্বিকভাবে রাজস্ব খাতে প্রবৃদ্ধি ২৫.৩ শতাংশ ধরা হলেও গত ৫ মাসে এখাতে মাত্র ১৪.৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে।
এনবিআরের হিসাব মতে, ৫ মাসে সরকারের রাজস্ব ঘাটতি হয়েছে ৮৫০০ কোটি টাকা। ব্যক্তি করমুক্ত আয়সীমা বৃদ্ধি করা, বিভিন্ন খাতকে করসুবিধা ও করহার হ্রাসের কারণে ঘাটতি বেড়েছে। সার্বিকভাবে রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলেও রাজস্ব আদায়ে ৩০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে। যেটি খুবই দুরুহ কাজ। বছর শেষে রাজস্ব আদায়ে ১৮ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি হবে বলে মনে করছে সিপিডি।
ব্যাংকিং খাতের বিষয়ে সিপিডি বলছে, বেশ কিছু সমস্যার মধ্য দিয়ে চলছে ব্যাংকিং খাত। উচ্চ মাত্রার ঋণ নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঋণ জালিয়াতির পরিমাণ আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। নতুন ব্যাংক এলেও চাহিদা অনুযায়ী প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পায়নি। সার্বিকভাবে অর্থনৈতিক স্থবিরতা থাকায় ঋণের চাহিদা বাড়েনি। কেউ বিনিয়োগ করছে না। ফলে ঋণ নেয়ার মতো কেউ নেই। এ কারণে ব্যাংকগুলোতে তারল্য বাড়ছে, যা ব্যাংকিং খাতকে বেকায়দায়, এমনকি লোকসানের মুখে ফেলতে পারে। গত ৬ মাসে ব্যাংকগুলোতে তারল্য বেড়েছে ৭৩.৮ শতাংশ। এছাড়া, ১৬ শতাংশের বেশি ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও ব্যাংকগুলো মাত্র ১১ শতাংশ বিতরণে সক্ষম হয়েছে।
এদিকে অর্থনৈতিক দুরবস্থার মধ্যে বিদেশী এবং স্থানীয় উভয় বিনিয়োগই অনেক কমে গেছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর প্রান্তিকে এফডিআই হয়েছে ৫৩৮ মিলিয়ন ডলার, যা গত অর্থবছরের তুলনায় মাত্র ১.৩ শতাংশ বেশি। কিন্তু বিনিয়োগ বোর্ডে নিবন্ধিত হওয়ার হার হ্রাস পেয়েছে। স্থানীয় কোম্পানির বিনিয়োগ ২৭ শতাংশ এবং বিদেশী মালিকানা কোম্পানির বিনিয়োগ ১০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। তবে রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে উল্লেখ করে বলা হয়, অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি ১৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেলেও তা শুধু তৈরী পোশাক শিল্পেই বেশি। তৈরী পোশাক শিল্প ছাড়া বাকি সবখাতে মাত্র ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। মার্কিন ও ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশের তুলনায় ভারত, ভিয়েতনাম ও কম্ব্বোডিয়া তাদের পণ্যের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি তিন গুণ বৃদ্ধি করেছে। আর বাংলাদেশ প্রবৃদ্ধি কিছুটা বৃদ্ধি করতে সক্ষম হলেও লভ্যাংশ পাওয়ার ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে।
পুঁজিবাজারের ক্ষেত্রে বলা হয়, এ সময় পুঁজিবাজারে আইপিও’র সংখ্যা বাড়লেও নতুন উদ্যোক্তা কমেছে ১০ শতাংশ। এছাড়া, গবেষণাপত্রে বলা হয়, চলতি অর্থবছরের জুলাই মাস থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পরিবহন, কৃষি, তৈরী পোশাক ও পর্যটন খাতে ৪৯ হাজার ১৭ কোটি ৯২ লাখ টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। যা মোট দেশজ উৎপাদনের ৪.৭ শতাংশ। এর মধ্যে পরিবহনে ১৬ হাজার ৬৮৮ কোটি ৬৫ লাখ, কৃষিতে ১৫ হাজার ৮২৯ কোটি, পোশাক খাতে ১৩ হাজার ৭৫০ কোটি এবং পর্যটন খাতে ২৭৫০ কোটি টাকার লোকসান হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। অর্থনৈতিক বর্তমান অগ্রগতি অব্যাহত থাকলে বছরে শেষে ৫.৮ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে পারে বলে মনে করছে সিপিডি।
0 comments:
Post a Comment