কর্মী-সমর্থকদের উৎসাহ ছিল একেবারে তুঙ্গে। ছিল সব রকম প্রস্তুতিও। গণজোয়ার সৃষ্টি হবে ঢাকার রাজপথে। সেই জোয়ারের তোড়ে ভেসে যাবে একতরফা নির্বাচনের সব আয়োজন। সরকার বাধ্য হবে সমঝোতা করতে।
সকলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হবে। অবসান ঘটবে অনিশ্চয়তার। দূর হবে সব রকম শঙ্কা আর আতঙ্ক। বন্ধ হবে খুনোখুনি আর পেট্রল বোমার সন্ত্রাস। নিরাপদ ও স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে আসবে দেশজুড়ে। এমন স্বপ্ন বুকে নিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন বিরোধীরা। ভয়-বিপত্তি তুচ্ছ করে নানা কৌশলে মফস্বল থেকে ঢাকায় পৌঁছে যান বহু মানুষ। কিন্তু নেতাদের গা বাঁচানো কৌশল আর চালাকিতে ধুলিসাৎ হয়ে যায় সব পরিকল্পনা।
একদিকে ঘটনার দু’দিন আগেই বিরোধী দলের পুরো পরিকল্পনা পৌঁছে যায় সরকারের হাতে। অন্যদিকে মহানগর বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের ভয় দেখানো হয়, রাস্তায় নামলেই সরাসরি গুলি করা হবে। চুল পরিমাণ ছাড়ও দেয়া হবে না। আর তাতেই আঁতকে ওঠেন নেতারা। শীর্ষমহলকে কিছু না জানিয়েই যে যার মতো পালিয়ে বাঁচার কৌশল নেন। এমনকি মোবাইল ফোন বন্ধ করে দিয়ে চলে যান যোগাযোগের একেবারে বাইরে। এ কারণে ঘটনার দিন কাউকেই আর খুঁজে পাওয়া যায়নি কোথাও। কর্মসূচি সফল করার দায়িত্বে থাকা নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি একবারের জন্যও। এছাড়া সরকারের পক্ষে কিছু নেতার ‘ম্যানেজ’ হয়ে যাওয়ার অভিযোগও রয়েছে। অপরদিকে জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ের নির্দেশ ছিল, বিএনপি রাস্তায় না নামলে জামায়াত-শিবিরও নামবে না। শেষ পর্যন্ত তা-ই হলো। বিএনপিকে রাস্তায় দেখা যায়নি। সে কারণে নামেনি জামায়াত-শিবির। স্বাভাবিকভাবেই নামেনি নগরবাসীও। আর এসব কারণেই কার্যত ব্যর্থ হয় ব্যাপক উত্তাপ ছড়ানো ২৯শে ডিসেম্বরের ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচি।
নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিরোধী দলগুলোর আন্দোলন চলে আসছিল প্রায় তিন বছর ধরে। এ ব্যবস্থা সংবিধান থেকে মুছে দেয়া হয় ২০১১ সালের ৩০শে জুন। এরপর থেকেই ব্যবস্থাটি সংবিধানে পুনর্বহালের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে বিরোধী দল। দাবি আদায়ে দফায় দফায় প্রায় ৭৫ দিন হরতাল পালন করা হয়। হরতালের পর শুরু হয় অবরোধ। নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে শুরুর পর নতুন বছরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত একাধিক দফায় প্রায় ৩৫ দিনের অবরোধ কর্মসূচি পালন করে বিরোধী দল। এতে অচল হয়ে পড়ে গোটা দেশ। স্থবির হয়ে যায় জনজীবন। পুরোপুরি ভেঙে পড়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা। ব্যাপক নাশকতার কারণে প্রথমবারের মতো মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে ট্রেন চলাচল। ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে যায় শিল্প-কারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্য। অভিজ্ঞজনেরা বলেছেন, স্বাধীন বাংলাদেশে এতটা কড়া আন্দোলন আর কখনও দেখা যায়নি। কিন্তু তাতেও কাজ হলো না। সরকার পাত্তা দেয়নি কোন কিছুকে। নিজেরা যা ভেবেছে, তা করে গেছে নিঃসংকোচে। মহাজোটের সরকারই খুশিমতো প্রথমে সর্বদলীয় সরকার ঘোষণা করেছে। পরক্ষণেই আবার বলেছে, না এটি সর্বদলীয় নয়, নির্বাচনকালীন সরকার। সরকারের ইচ্ছার সঙ্গে তালমিলিয়ে চলে নির্বাচন কমিশনও। বিরোধী দলগুলোর দাবি-দাওয়ার প্রতি ফিরেও তাকায়নি কাজী রকিবউদ্দিনের কমিশন।
এমন পরিস্থিতিতে হরতাল-অবরোধের বাইরে ভিন্নতর আন্দোলনের পথে হাঁটেন খালেদা জিয়া। ২৪ ডিসেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা দেন নতুন কর্মসূচি ‘রোড ফর ডেমোক্রেসি’। একতরফা নির্বাচন প্রতিহত করতে ২৯শে ডিসেম্বর দলে দলে ঢাকার রাজপথে নেমে আসার আহবান জানান দেশবাসীর প্রতি। এই কর্মসূচিকে ঘিরে উত্তাপ-উত্তেজনা তুঙ্গে ওঠে। ঢাকাসহ সারাদেশে বিরোধী দলের নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা ব্যাপক প্রস্তুতি নেন। অন্যদেকি কর্মসূচি ঠেকাতে সরকারও হয়ে ওঠে মরিয়া। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বলে বসলেন, একটি পিঁপড়াও যেন ঢাকায় ঢুকতে না পারে। পুলিশ, বিজিবি ও র্যাবসহ প্রশাসনের সর্বশক্তি লাগানো হয় কাজে। রাজধানীতে জড়ো করা হয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ৪০ হাজারেরও বেশি সদস্যকে। বিরোধী দলের অবরোধ ভাঙার চেষ্টা বাদ দিয়ে সরকার নিজেই অবতীর্ণ হয় অবরোধকারীর ভূমিকায়। সব ধরনের পরিবহন-যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া হয় ২৭শে ডিসেম্বর থেকে। শুরু হয় অঘোষিত সরকারি অবরোধ। কাউকে সন্দেহ হওয়া মাত্রই গ্রেফতার। রাজধানীতে বিভিন্ন থানা ও গোয়েন্দা পুলিশের হাজতখানায় তিল ধরণের ঠাঁই ছিল না। নিদারুণ মানবেতর পরিস্থিতি তৈরি হয় প্রতিটি হাজতে। সর্বত্র দেখা দেয় সীমাহীন আতঙ্ক।
অন্যদিকে বিরোধী দলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার গুলশানের বাড়ির সামনে চলে আরেক নাটকীয়তা। শ’ শ’ পুলিশ দিয়ে ঘিরে ফেলা হয় বাড়িটি। সেই সঙ্গে বাড়ির প্রবেশমুখে ফেলে রাখা হয় বালুভর্তি দু’টি ট্রাক। অদ্ভুত এই কাণ্ড নিয়ে ভীতি-আতঙ্কের মধ্যেও সর্বত্র সৃষ্টি হয় হাস্যরস। এই ঘটনায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানান বিশিষ্টজনরাও। কিন্তু কোন কিছুই বিচলিত কিংবা বিব্রত করেনি সরকারকে।
এমন উত্তাপ-আতঙ্কের মধ্যেই চলে আসে ২৯শে ডিসেম্বর। সর্বত্র টান টান উত্তেজনা। সকাল গড়িয়ে দুপুর। এরপর দুপুর গড়িয়ে বিকেল। দিনের শেষে এক সময় নেমে আসে রাতের আঁধার। কিন্তু সুপ্রিমকোর্ট আঙিনায় বিএনপি-জামায়াত সমর্থক আইনজীবী, জাতীয় প্রেস ক্লাবে সাংবাদিক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নেতৃবৃন্দের বিক্ষোভ ছাড়া রাজধানীর আর কোথাও উল্লেখ করার মতো কোন জনস্রোতের খবর পাওয়া যায়নি। অবশ্য মালিবাগ বাজার এলাকায় জামায়াত-শিবিরের একটি মিছিল বের হওয়া মাত্রই পুলিশ গুলি শুরু করে। তাতে ঘটনাস্থলেই মারা যায় এক শিবির কর্মী। তারপর আর কেউ রাস্তায় নামার সাহস পায়নি।
ওয়াকিবহাল সূত্রগুলো জানিয়েছে, ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ সফল করার লক্ষ্যে বিরোধী পক্ষ যে কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেছিল, সেটি সরকারের হাতে পৌঁছে যায় ২৭ তারিখেই। নগর বিএনপির নেতাদের মধ্যে কে কোন এলাকায় নেতৃত্ব দেবেন, কোন্ দিক থেকে মিছিল আসবে, পল্টনে যেতে না দেয়া হলে বিকল্প জমায়েত কোথায় হবে - সবকিছুই জেনে যায় সরকার। সেভাবেই নেয়া হয় মোকাবেলার সব রকম ব্যবস্থা। কর্মসূচি সফল করার দায়িত্বে থাকা নেতাদেরকে পরিষ্কার জানিয়ে দেয়া হয়, ২৯ তারিখে রাস্তায় নামলেই সরাসরি গুলি করা হবে। এক চুলও ছাড় দেয়া হবে না। আর তাতেই ভয় পেয়ে যান বিএনপির এসব নেতা। শীর্ষ নেতৃত্বকে কিছু না জানিয়ে আগের রাতেই যে যার মতো সটকে পড়েন। বন্ধ করে দেন মোবাইল ফোন। এ কারণে কর্মসূচির দিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তাদের কারও সঙ্গেই আর যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া কোন কোন নেতাকে বিশেষ ব্যবস্থায় ‘ম্যানেজ’ করার খবরও রয়েছে।
নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানায়, ২৯ তারিখে বেগম খালেদা জিয়াকে যে বাড়ি থেকে বের হতে দেয়া হবে না- তা আগেই বুঝতে পেরেছিলেন তিনি। এ কারণে আগের দিনের ভিডিও বার্তায় তিনি সেটার ইঙ্গিতও দেন। কিন্তু তাঁর অনুপস্থিতিতে ময়দানে কর্মসূচি সফল করার মূল নেতৃত্ব কে দেবেন তা ঠিক করা ছিল না। এছাড়া গোটা কর্মসূচির কার্যকর কোন সমন্বয়ও ছিল না। এ কারণে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বহু মানুষ মিছিল নিয়ে বের হওয়ার জন্য নির্দ্দিষ্ট স্থানে জড়ো হলেও তাদের দিক-নির্দেশনা দেবার কেউ ছিল না। একই ভাবে মফস্বলের যে হাজার হাজার মানুষ ২-৩ দিন আগেই রাজধানীতে চলে আসেন, তারা রাস্তায় ঘুরেছেন এতিমের মতো। এলোমেলো ঘুরতে থাকায় সন্দেহবশত তাদের অনেককে পুলিশ গ্রেফতার করে হাজতে নিয়ে যায়। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলামের বিপুল সংখ্যক নেতা-কর্মীও রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় তাদের পূর্বনির্ধারিত স্থানগুলোতে জড়ো হন। কিন্তু তাদের অপেক্ষা করাই সার। বিএনপি নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারায় শেষ পর্যন্ত তারা রাস্তায় নামেননি। কেবলমাত্র মালিবাগ বাজার এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে জামায়াত-শিবিরের একটি মিছিল হঠাৎ রাস্তায় নেমে আসে। সঙ্গে সঙ্গেই গুলি শুরু করে দেয় পুলিশ। তাতে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারায় এক শিবির কর্মী। আহত হয় অনেকে। এই খবর চাউর হওয়ার পর অন্য কোথাও আর রাস্তায় নামেনি জামায়াত-শিবির। সূত্র জানিয়েছে, জামায়াতের কেন্দ্র থেকে নির্দেশ ছিল, বিএনপি যদি আগে রাস্তায় না নামে, তাহলে জামায়াত-শিবিরও নামবে না। এমন পরিস্থিতিতে বিকল্প কোন কর্মকৌশল বা পরিকল্পনা ছাড়াই বেগম খালেদা জিয়া ঘোষণা দেন, ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ চলবে পরদিনও। কিন্তু দেখা গেল একই দৃশ্যপট। অন্ধকারে মুখ থুবড়ে পড়ে গণতন্ত্রের আন্দোলন, সংগ্রাম।
0 comments:
Post a Comment