বাংলাদেশ একদা ডায়রিয়া, ঘূর্ণিঝড় ও হরতালের দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক ফোকাসে ছিল। দীর্ঘকাল পরে বাংলাদেশ আবার আন্তর্জাতিক ফোকাসে। আর সেটা কেবল ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের কারণে।
১৯৮৮ ও ১৯৯৬ সালের ভোটারবিহীন নির্বাচনের পরও যা ঘটেনি বাংলাদেশ প্রশ্নে বিশ্ব এবার তাই করে দেখিয়েছে। তবে এর বিপরীতে এটা দেখার মতো যে, বিতর্কিত নির্বাচন প্রশ্নে বিশ্বের শক্তিশালী পার্লামেন্ট যখন একযোগে অনাস্থা প্রকাশ করেছে তখন বাংলাদেশের জাতীয় গণমাধ্যম তা ফোকাসে আনতে অপারগতার পরিচয় দিচ্ছে। এর একটি জ্বলন্ত উদাহরণ, গত ১৬ই জানুয়ারি ইউরোপীয় পার্লামেন্টে গৃহীত প্রস্তাবের সংবাদ পরিবেশন করা। অনেক সংস্থা এমনভাবে খবর দিয়েছে যে, মনে হতে পারে সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে বিএনপিকে দূরত্ব বজায় রাখতে বলা কিংবা জামায়াত নিষিদ্ধ করার ব্যাপারেই ইইউ তার মাথাব্যথার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। এটা অর্ধসত্য। প্রকৃত ঘটনা হলো ১৬ই জানুয়ারির ইইউ রেজুলেশনের শিরোনামই হলো বাংলাদেশের নির্বাচন। এর বেশির ভাগ জায়গা জুড়ে জনপ্রতিনিধিত্বশীল সংসদ নির্বাচন করতে ‘আগাম নির্বাচন’ অনুষ্ঠানের পক্ষে মত ব্যক্ত করা হয়েছে। কিন্তু অনেক মিডিয়া তা বেমালুম চেপে যায়। গৃহীত প্রস্তাবে ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের ‘ঐতিহ্যবাহী তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাতিল করেছেন’ বলা আছে। আরও বলা আছে, নির্বাচন কমিশন ৪০ ভাগ ভোটের দাবি করলেও ঢাকাভিত্তিক কূটনীতিকরা ২০ ভাগ ভোটের কথা বলেছেন। সরকারকে নির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে, নির্বাচনের আগে ও পরে সংঘটিত সহিংসতায় নিহতদের বিষয়ে স্বাধীন তদন্ত করতে। আর এটা বলতে গিয়ে ওই প্রস্তাবে ‘নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যসহ সকল দুষ্কৃত অপরাধের বিষয়ে’ তদন্ত করার কথাটিও ব্যবহার করেছে। ক্ষমতাসীন সরকারের জন্য এসব অস্বস্তিকর অংশ একেবারেই ঝেড়ে ফেলে সরকারি মহলে কেবল জামায়াত বিরোধী অংশটির প্রচার-প্রচারণা নিয়ে উৎসাহ দেখাচ্ছে।
উল্লেখ্য, গত ১৪ই জানুয়ারি ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টের ১২ জন সংসদ সদস্য ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন বিষয়ে কঠোরতম মনোভাব ব্যক্ত করেছিলেন। তারা নির্দিষ্টভাবে যত শিগগির সম্ভব নিরপেক্ষ ও পক্ষপাতহীন ক্রান্তিকালীন সরকার গঠন করে নির্বাচন অনুষ্ঠান অন্যথায় বাংলাদেশকে দেয়া শুল্কমুক্ত সুবিধা বাতিল করার বিষয়ে ইঙ্গিত দেয়া হয়। বছরে এর ফলে ইইউর ২৮টি দেশে ১০ বিলিয়নেরও বেশি ডলারের পণ্য রপ্তানি করা সম্ভব হয়, তা কাটছাঁট করার ব্যাপারেও ইঙ্গিত দেয়া হয়। গত ১৬ই জানুয়ারি গৃহীত সিদ্ধান্তে যদিও ওই প্রস্তাব সরাসরি গৃহীত হয়নি।
তবে এটাও দেখার বিষয় যে, ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের পরে সংসদীয় গণতন্ত্রের সূতিকাগার হাউস অব কমন্স এবং গণতন্ত্রের আদি নিবাস ইউরোপের পার্লামেন্ট থেকেই বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনের জন্য সরাসরি একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওয়াজ উঠলো।
কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকে যদিও বিষয়টিকে কাকতালীয় মনে করেন কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, সাড়ে ছয় শ’ সদস্যের হাউস অব কমন্স এবং সাড়ে সাত শ’ সদস্যের ইইউ’র পার্লামেন্ট একই দিনে অত্যন্ত প্রাণবন্ত বিতর্ক করেছে। টেমস নদীর তীর থেকে ফ্রান্সের স্ট্রামবুর্গ পর্যন্ত প্রতিধ্বনিত হয়েছে যে, বাংলাদেশে নির্বাচন বিতর্কিত। এতে বাঙালি জনগোষ্ঠীর মতামত প্রতিফলিত হয়নি।
আলোচনার অভিন্ন বিষয়: বাংলাদেশের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন
একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন এবং উন্নত বিশ্ব হিসেবে স্বীকৃত ২৮টি দেশের নির্বাচিত রাজনীতিকরা একযোগে বলেছেন ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন তাদের মনঃপূত হয়নি। এর নেতৃত্বে মার্কিন আইনসভা নির্বাচন প্রশ্নে শুনানি তারা আগেই করে রেখেছিল। তাই মার্কিন সিনেটর দ্রুত দুই নেত্রীর কাছে চিঠি লেখেন। প্রধানমন্ত্রীকে সাফ জানিয়ে দেন এই নির্বাচনে তাদের আস্থা নেই। নতুন নির্বাচন লাগবে।
এটা অত্যন্ত লক্ষণীয় যে, নির্বাচিতের বড়াই করে ভোটারবিহীন নির্বাচন হয়েছে। অথচ ১৯৯৬ ও ১৯৮৮ নির্বাচনের পরে বিভিন্ন ক্ষমতাসীন বিদেশী সরকার প্রতিক্রিয়া দিয়েছিল। কিন্তু ইতিহাসে এই প্রথম গোটা উন্নত বিশ্বের নির্বাচিত জ্ঞানীগুণী রাজনীতিকরা সমস্বরে বাংলাদেশের বর্তমান নির্বাচিতদের মুখের ওপর না বলে দিয়েছে। এত বড় কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক ভূমিধস পরাজয়ের গ্লানি বাংলাদেশ এই প্রথম আস্বাদন করলো।
সর্বত্র প্রশ্ন, এই সরকার বৈধ কিনা। বিবিসি ও সিএনএনসহ সকল প্রভাবশালী মিডিয়া একযোগে নির্বাচনকে বিতর্কিত বলেছে। প্রতিবেশী ভারতের মিডিয়াও উন্নত বিশ্বের পার্লামেন্টগুলোর কণ্ঠস্বরের সঙ্গে গলা মিলিয়েছে। ভারতে নতুন সাধারণ নির্বাচনের সানাই বাজছে। তাই বলা যায়, এই নির্বাচনকে সামনে রেখে ভারতের বিদায়ী ক্ষমতাসীন দল যারা পরাস্ত হতে পারে তারাই কেবল স্বাগত জানিয়েছে। সেখানেও দিল্লি কিন্তু অসতর্ক নয়। তারা কোনমতে বলেছে, সাংবিধানিক প্রয়োজনের কারণে, এর অর্থ তারাও মনে করে নির্বাচন বিতর্কিত। চীনের অবস্থানও কৌশলগত। কিন্তু নতুন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী দাবি করেছেন যে, চীন তার আগের মনোভাব পাল্টে সরকারকে সমর্থন দিয়েছে। অথচ চীনের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া বাংলাদেশ নির্বাচনকে বিতর্কিতই বলছে। মধ্যপ্রাচ্য থেকেও কোন ঐতিহ্যবাহী বন্ধু রাষ্ট্র নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নে অন্তত প্রকাশ্যে বাংলাদেশ সরকারের পাশে দাঁড়ায়নি। উল্লেখ্য, ইইউ’র গৃহীত সিদ্ধান্তে বাংলাদেশ সরকারকে অবিলম্বে নিরাপত্তাবাহিনীর নিপীড়নমূলক পদ্ধতি বন্ধ করতে হবে বলে উল্লেখ আছে। তারা বলেছে, নির্বিচারে গুলিবর্ষণ বন্ধ এবং নিরাপত্তা হেফাজতে নির্যাতন বন্ধ করা বিরোধীদলীয় রাজনীতিকদের মুক্তি দেয়া দরকার। কারণ, তারা নিয়মবহির্ভূত গ্রেপ্তারের স্বীকার হয়েছেন। নির্বাচন আগে ও পরের সহিংস মৃত্যুর কারণ খতিয়ে দেখতে স্বাধীন তদন্তের দাবি জানানো হয়। এর সঙ্গে নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যসহ জড়িত দুর্বৃত্তদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাতেও আহ্বান জানানো হয়।
পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, বাণিজ্য সুবিধা পর্যালোচনার মধ্যে এলে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার ইঙ্গিত আছে। তাই এই ধরনের প্রস্তাব পাস হওয়ার মতো পরিস্থিতি যাতে যা না হয় সেজন্য উভয় পক্ষকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। সমঝোতার পথে আসতে হবে। কারণ, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার মতো বিষয় গৃহীত সিদ্ধান্তে না থাকলেও সেখানে প্রচ্ছন্নভাবে তাদের কঠোর মনোভাবের প্রতিফলন ঘটেছে। তাই কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নেতিবাচক প্রভাব ফেলার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এক অর্থে বিদেশী সংসদগুলোয় বাংলাদেশ জনগণের মতামতের প্রতিফলন ঘটেছে, সরকারও বলেছিল নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলন ঘটেনি। এ ধরনের ফোকাস বিব্রতকর এজন্য যে নিজেদের যা করণীয় এবং যা নিজেদেরও জানা সেটার জন্য আজ বিদেশীদের পরামর্শে শুনতে হচ্ছে। সন্ত্রাসী দলকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে জামায়াতের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। ইইউ’র পার্লামেন্টে এ ঘটনা এই প্রথম।
0 comments:
Post a Comment