বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নির্বাচন আজ। বিরোধী কোন দলই অংশ নিচ্ছে না এ নির্বাচনে। এরই মধ্যে বেসরকারিভাবে ১৫৩ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।
ফলে দেশের শতকরা ৫২ ভাগ ভোটার ভোট দেয়ার কোন অধিকারই পাচ্ছেন না। আমরা এটাকে জাতীয় নির্বাচন বলতে পারবো না। প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনের আগে আমরা যেমনটা লিখে থাকি ‘জাতি নির্বাচনমুখী’, সে রকম কোন শিরোনামও আমরা দিতে পারছি না। আমাদের দৃষ্টিতে এটা জাতীয় নির্বাচন নয়। তাই এটাকে বিতর্কিত নির্বাচন কমিশনার দ্বারা সিলেকশন বলতে পারি আমরা।
আমরা যে কারণে এটাকে নির্বাচন বলতে পারি না তা হলো, আমাদের সংবিধানের অধীনে জনগণ তাদের প্রতিনিধি বেছে নিতে ভোটাধিকার প্রয়োগ করে থাকেন। এভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সরকার গঠন করে দেশ পরিচালনা করে। তথাকথিত এই নির্বাচনে এ রকম কোনটাই ঘটেনি। সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন করতে ব্যর্থ হয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এ নির্বাচন তাদের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো, তাদের ক্ষমতার লালসা দেশকে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন থেকে বঞ্চিত করেছে। বাংলাদেশকে এখন দেখা হয় এমন একটি দেশ হিসেবে যেখানে কোন গণতন্ত্র নেই। বিশ্বে অস্থিরতার শীর্ষ দশটি দেশের মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ।
কিন্তু সামপ্রতিক সময়ে বাংলাদেশকে দেখা হতো উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে। পূর্বাভাস দেয়া হচ্ছিল যে, ২০২১ সালের মধ্যে এ দেশটি হবে মধ্য আয়ের। সুস্থ গণতন্ত্রের একটি দেশ হিসেবে এ দেশের ভাবমূর্তি ছিল উজ্জ্বল। রাজনৈতিক সহিংসতার জন্য নাজুক মানবাধিকারের কারণে বাংলাদেশ এখন তলাবিহীন ঝুড়ির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। দেশে শান্তি নিশ্চিত করার মাধ্যমে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য দায়বদ্ধ সরকার ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। কিন্তু এখন এদেশের মানুষ সবচেয়ে বেশি অনিরাপদ। তাদের জীবন ও সম্পদ হয়ে পড়েছে পুরোপুরি অনিরাপদ। ব্যবসায় লোকসান হচ্ছে। যদি পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি না হয় তাহলে এ দেশের গার্মেন্ট খাত সবচেয়ে খারাপ সময়ের দিকে এগিয়ে যাবে।
এখন প্রশ্ন হলো কিভাবে এই পরিস্থিতি পাল্টানো যাবে এবং উন্নত করা যাবে? জবাব হলো- জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী সরকার পরিবর্তনের মাধ্যমে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসতে পারে। সাধারণভাবে বলা যায়, বাংলাদেশকে সঠিক পথে রাখতে যত দ্রুত সম্ভব দেশে সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি নির্বাচন অবশ্যই করতে হবে। যদি আজকের প্রহসনের নির্বাচনকে বন্ধ করলে এবং ক্ষমতাসীন দল ও নির্বাচন কমিশন যদি ২৪শে জানুয়ারি পার্লামেন্ট বিলুপ্তির ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য দ্বিতীয় সুযোগটি বেছে নিতেন তাহলে তা হতো অপেক্ষাকৃত ভাল। কিন্তু সেই সুযোগ এখন আর নেই। এখন ফলপ্রসূ একটি আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক এ সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলকে। এর মাধ্যমেই সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথ বেরিয়ে আসবে।
বড় দু’দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে অবশ্যই জনমানুষের মেজাজ মর্জির বিষয়টিতে নজর দিতে হবে। জনগণ বিভক্ত। তারা এ দু’দলকে সমর্থন করে। কিন্তু শতকরা প্রায় ৩০ ভাগ মানুষ আছেন, তারা নিরপেক্ষ। তাদের ভোট হলো ভাসমান ভোট। এই ভাসমান ভোটের ভিত্তিতেই দু’দলের মধ্য থেকে কোন এক দল সরকার গঠন করে থাকে। নিরপেক্ষ যেসব মানুষ তারা রাজনীতিবিদদের ওপর ক্ষুব্ধ। তাদের এই ধারণাটি প্রধান দু’দলের শীর্ষ নেতাদের মূল্যায়ন করা উচিত। তারা মনে করে, ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল দেশের স্বার্থ, জনগণের নিরাপত্তার বিষয়টি উপেক্ষা করে ক্ষমতার জন্য লড়াই করছে।
রাজনীতি হলো একটি পরিসমাপ্তির অর্থ। এই পরিসমাপ্তি হতে হবে জনগণের কল্যাণে। দুর্ভাগ্যজনক হলো, বর্তমান পরিস্থিতি দেখে মনে হয় আমাদের রাজনীতিবিদরা জনগণের কল্যাণের বিষয়টি মোটেও পরোয়া করেন না। রাজপথে যখন মানুষ মারা যাচ্ছে তখন তারা তাদের লক্ষ্যে অটল। তারা সংবিধানের বিষয়ে বেশ সচেতন। তবে মানুষের কল্যাণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে কম মনোযোগী। এ অবস্থা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের ওপর থেকে আগ্রহ হারাবে জনগণ। যাদের কারণে দেশের আজ এই অবস্থা তাদের জন্য এবং দেশের জন্য কি তা শুভকর হবে?
রাজনৈতিক সঙ্কট শিগগিরই সমাধান করা না হলে বাংলাদেশ আরও বড় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সঙ্কটের মুখে পড়বে। বর্তমান পরিস্থিতিতে পশ্চিমা দেশগুলো এ অবস্থায় হতাশ হয়ে পড়েছে। এর ফলে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে রাখার জোর আভাস মিলছে। তারা বাংলাদেশে গণতন্ত্র দেখতে চায়। তারা এমন এক বাংলাদেশ দেখতে চায় যা বৈশ্বিক উন্নয়নে অবদান রাখবে। তারা ঝগড়া, ফ্যাসাদে লিপ্ত বাংলাদেশ দেখতে চায় না। যদি ক্ষমতাসীন দলের নেতারা সামনে বিপদ দেখতে না পান তাহলে বাংলাদেশ উচ্চ প্রবৃদ্ধি ও জীবনমানের উন্নতির জন্য যে লড়াই করছে সেক্ষেত্রে হেরে যাবে। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ একটি বিকশিত দেশের ভাবমূর্তি হারাবে। এই সঙ্কট বাংলাদেশকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র করে দিতে পারে। স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ যা অর্জন করেছে, সেটা হবে সেই বাংলাদেশের পরাজয়। বাংলাদেশের মানুষের এখন সবচেয়ে বড় প্রত্যাশা নির্বাচন বা রাজনীতি নয়। তাদের প্রত্যাশা শুধু শান্তি নিয়ে। তারা নিজেদের নিরাপত্তা ও ভবিষ্যতের জন্য শান্তি চায়। বিভক্তির দু’পক্ষে আমাদের যেসব রাজনীতিবিদ আছেন এবং তাদেরকে যারা রাজা বা রানী বানান তাদের কথা কি এই রাজনীতিবিদরা শুনতে পান? তাদের কথা যদি তারা শুনতে না পান, তাহলে সেই একই মানুষ তাদেরকে ইতিহাসের ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করবে।
0 comments:
Post a Comment