পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্টরা ৩৫ বছর ধরে শাসন করেও সেখানকার জনজীবনের মান উন্নত করতে পারেননি। অর্থাৎ তাঁদের মার্ক্সবাদ প্রগতির একটা প্রলেপ মাত্র।
তাঁদের চামড়ায় আঁচড় কাটলেই দেখা যাবে তাঁরা বৃহত্তর প্রাতিষ্ঠানিকতার অংশ। কয়েক দশকেও তাঁঁরা যা করতে পারেননি, আম আদমি পার্টি সেটা ১২ মাসের মধ্যে করার প্রতিশ্রুতি নিয়ে এসেছে। কাজটি হলো গরিব মানুষকে জাগিয়ে তোলা, যাতে তারা নিজেদের বক্তব্য নিজেরাই তুলে ধরতে পারে।
ভারতের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল কংগ্রেস ও বিজেপি মন্দিরের মোহন্তদের মতো। তারা কিছুই শেখেনি, কিছুই ভোলেনি। নিজেদের নীতি-কৌশলগুলোর ভুলত্রুটি সংশোধন করার পরিবর্তে তারা আম আদমি পার্টিকে মনে করছে একটা অস্বাভাবিক ব্যতিক্রম, কিংবা বুদ্বুদ। তারা মনে করছে সামনের এপ্রিলে লোকসভা নির্বাচন আসতে আসতে এই বুদ্বুদ ফেটে মিলিয়ে যাবে। কিন্তু কংগ্রেস ও বিজেপির এ রকম ধারণা ভুল, কারণ, আম আদমি পার্টি জনগণের মনকে স্পর্শ করতে পেরেছে, তাই দলটির প্রভাব দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। লাখ লাখ মানুষের আম আদমি পার্টিতে যোগ দেওয়ার মধ্য দিয়েই তা দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে।
ভারতীয় রাজনৈতিক দৃশ্যপট খাপছাড়া, জোড়াতালিসর্বস্ব হলেও এখন তা একধরনের রূপ পরিগ্রহ করতে চলেছে। বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত আম আদমি পার্টির আবির্ভাবের ফলে রাজনৈতিক দৃশ্যপট বদলে গেছে। কংগ্রেস ও বিজেপির একটি বিকল্প হিসেবে তারা আবির্ভূত হয়েছে; এমন একটি বিকল্পের ভীষণ প্রয়োজন ছিল। কারণ, কংগ্রেস ও বিজেপি দুটি ভিন্ন বোতলে একই সুরা।
ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে যেসব আঞ্চলিক দলের ভিত্তি রয়েছে, এবারের নির্বাচনে তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। ভাষা, এলাকা বা অঞ্চলের নামে তাদের আবেদন ও জনপ্রিয়তা কার্যত অনেক হ্রাস পেয়েছে। দিল্লি বিধানসভার নির্বাচনে আম আদমি পার্টির সাফল্য বিভিন্ন ধরনের বিভক্তি ও মেরুকরণের রাজনীতিকে আঘাত করেছে। কারণ, এই দলটি জাত-পাত, শ্রেণী-ধর্ম-ভাষা ইত্যাদি ভেদাভেদ অতিক্রম করে গেছে। কংগ্রেস ও বিজেপি—উভয় দলই স্বীকার করেছে যে আম আদমি পার্টি যেভাবে সাফল্য অর্জন করেছে, সেখান থেকে তাদের অনেক কিছু শেখার আছে। যদি তারা এটা আন্তরিকভাবে উপলব্ধি করেই থাকে, তাহলে তাদের নিজেদের রূপান্তর ঘটাতে হবে। এখন পর্যন্ত তারা বিদ্যমান ব্যবস্থার কেন্দ্রই রয়ে গেছে। আম আদমি পার্টির নেতা-কর্মীদের মধ্যে মার্ক্সবাদী ও নকশালপন্থীরা রয়েছেন কি না, সেটা কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত দলটি জনসাধারণের আশা-আকাঙ্ক্ষার অনুকূলে কাজ করে যাবে। চূড়ান্ত বিচারে, স্বাধীনতার ৬৭ বছর পরও ভারতের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে দারিদ্র্য রয়ে গেছে, আম আদমি পার্টি কত দ্রুত তা দূর করতে পারে, সেটাই তাদের সামনে আসল পরীক্ষা।
এটা নিশ্চিত, বামপন্থীরা নির্মমভাবে ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। এতে যে ক্ষতি হয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এ জন্য কমিউনিস্ট ও সমাজতান্ত্রিক দলগুলো নিজেরাই দায়ী; কারণ, তারা তৃণমূলের জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে। প্রগতি ও সাম্যের পক্ষে শুধু স্লোগান উচ্চারণ আর সুন্দর সুন্দর কথা বলাই যথেষ্ট নয়। আম আদমি পার্টি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মান উন্নত করার এজেন্ডা নিয়ে এসেছে এবং তারা তাদের লক্ষ্য অর্জনের একটা সময়সীমা নির্ধারণ করেছে। বিজেপির পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেদ্র মোদির জনপ্রিয়তায় যেভাবে ভাটার টান লেগেছে, তাতে আভাস মিলছে যে জনগোষ্ঠীর ওপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ ছিল, তারা এখন আর সে রকম নেই। অবশ্য সংবাদমাধ্যম এখনো মোদিকে বড় করেই দেখিয়ে চলেছে। মোদির জনপ্রিয়তা দ্রুত কমে যাচ্ছে বলেই তো রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) ব্যতিব্যস্ত হয়ে বিজেপিকে বলছে, তোমরা এখন আম আদমি পার্টিকে থামাও, কংগ্রেসকে নয়। অথচ বছরের পর বছর ধরে কংগ্রেসই ছিল তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ।
দিল্লি শাসনের প্রতিটি পদক্ষেপে আম আদমি পার্টি যেভাবে বিভিন্ন নেতার আক্রমণের শিকার হচ্ছে, তাতে এই ধারণাই সঠিক প্রমাণিত হচ্ছে যে কংগ্রেস এখন পড়ে গেছে তৃতীয় অবস্থানে। খবর পাওয়া যাচ্ছে, কংগ্রেস এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, মোদিকে ঠেকাতে তাদের উচিত অনানুষ্ঠানিকভাবে আম আদমি পার্টিকে সমর্থন করা। এর আরও একটা অর্থ এই যে কংগ্রেস উপলব্ধি করতে পারছে, তারা ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারবে না। বস্তুত, কেন্দ্রে সরকার গঠনে আম আদমি পার্টিকে সহযোগিতা করতে কংগ্রেস নিজের সমর্থন তো বটেই, বিভিন্ন রাজ্যের আঞ্চলিক দলগুলোকেও এক কাতারে জড়ো করার চেষ্টা চালাতে পারে। কারণ, মোদিকে ক্ষমতার বাইরে রাখার চেষ্টায় কংগ্রেস হেন কিছু নেই, যা করা বাকি রাখবে।
রাজনৈতিক অঙ্গনের সবচেয়ে ন্যক্কারজনক দিকটি হলো দুর্নীতি। দুর্নীতিবাজ হিসেবে পরিচিত নেতাদের সমর্থন পেতে কংগ্রেস বা বিজেপি কোনো দলেরই কোনো দ্বিধা নেই, বিশেষত বিজেপির। কংগ্রেস হিমাচল প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী বীরভদ্র সিংয়ের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি এমন একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে অবৈধ সুবিধা দিয়েছেন, যে প্রতিষ্ঠানের বিরাট অংশের শেয়ারের মালিক তাঁর এক আত্মীয়। আর নরেদ্র মোদি জনসমক্ষে ন্যায়নীতির কথা বলেন বটে, কিন্তু তিনি তাঁর মন্ত্রিসভায় এমন এক মন্ত্রীকে রেখে দিয়েছেন, যিনি আদালতে দণ্ডিত হয়েছেন। বিহারের লালুপ্রসাদ যাদব ও রশিদ মাসুদ আদালতে দণ্ডিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সংসদ সদস্যপদ হারিয়েছেন। কিন্তু বিজেপি কেন গুজরাটে দণ্ডিত সদস্যদের মোদি সরকারের মধ্যে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে রেখেছে?
আরেকটি বিরক্তিকর বিষয় হচ্ছে ব্যক্তিপূজা। এই গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা বদলে গিয়ে যেন রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থার মতো হতে চাইছে। এর জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী নরেন্দ্র মোদি, কারণ, একজন শক্তিমান ব্যক্তি ও শক্তিশালী সরকারের স্লোগান তুলেছেন তিনিই। ১২ বছর আগে নিজের নাগরিকদের ওপর হত্যাযজ্ঞ পরিচালনায় যিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন, তিনি গোটা দেশের শাসক হয়ে উঠলে সংবিধানে ভিন্নমত প্রকাশের যে নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে, তা বিরাট ঝুঁকির মুখে পড়ে যাবে। আহমেদাবাদে পুলিশ মোদির বিরুদ্ধে একটি এফআইআর নিতেও যে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, এটা দুঃখজনক হলেও অবাক হওয়ার মতো কিছু নয়। গোপনে আড়ি পাতার যে কেলেঙ্কারিতে একটি মেয়ের ওপর নজরদারির সঙ্গে মোদির জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে, সেটি অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। আসলে কী ঘটেছে, তা জানার প্রক্রিয়া শুরু করতে একটি এফআইআর প্রয়োজন। কেন্দ্র সরকারের নিয়োগকৃত একটি কমিশন তদন্ত করে তা বের করতে পারত। কিন্তু মোদির রাজ্যের প্রশাসনযন্ত্র এ ব্যাপারে সহযোগিতা করতে আগ্রহী নয়। স্থানীয় পুলিশের আচরণে সেটা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে।
নরেন্দ্র মোদি যে ২০১৪ সালের নির্বাচনকে জাতীয় ইস্যুগুলোর পরিবর্তে ব্যক্তিত্বের সংঘাতভিত্তিক ভোটযুদ্ধে পরিণত করতে চাইছেন, কংগ্রেসের এটা বোঝা উচিত ছিল। কিন্তু কংগ্রেসও একই দোষে দুষ্ট, তারাও রাহুল গান্ধীকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছে, যেন বা লড়াইটা হবে এই দুই ব্যক্তির মধ্যে। রাহুল গান্ধীও খুব ঘন ঘন গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলছেন, সরকারের সিদ্ধান্ত পাল্টে দিচ্ছেন। একটি দৃষ্টান্ত হলো, কোনো আইনপ্রণেতা আদালত কর্তৃক দণ্ডিত হলে সংসদ সদস্যপদ হারাবেন—সুপ্রিম কোর্টের এই রায় থেকে রাজনীতিকদের রক্ষা করার উদ্দেশ্যে জারি করা অধ্যাদেশ। আরও একটি দৃষ্টান্ত মহারাষ্ট্রে গৃহায়ণ কেলেঙ্কারি। ওই রাজ্যের কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকার আদর্শ হাউজিং প্রতিবেদন খারিজ করে দিয়েছিল, রাহুল গান্ধী সেটি আংশিক পুনরুদ্ধার করেছেন। তার পরও রাজনীতিকেরা পার পেয়ে গেছেন; এখন দায়টা বইতে হবে শুধু আমলাদের।
দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের উপলব্ধি করা উচিত আম আদমি পার্টির পক্ষ থেকে তিনি যে সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, সেটি তাঁর সঙ্গে পুরোপুরি খাপ খাবে না। অবাক ব্যাপার যে তিনি ১৬টি বিভাগই রেখে দিয়েছেন। গান্ধীবাদী জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে পরিচালিত এক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে জনতা পার্টি গড়ে উঠেছিল, তা বেশি দিন টেকেনি। কিন্তু তারা চেয়েছিল যেন জরুরি অবস্থা না থাকে। সেটা ঘটেছে, গণতন্ত্রের শিকড় গভীরে প্রোথিত হয়েছে। আম আদমি যদি বিদ্যমান ব্যবস্থাটির জঞ্জাল পরিষ্কার করতে সক্ষম হয় এবং নিশ্চিত করতে পারে যে তা সঠিক পথে থাকবে, তাহলে সেটা হবে তার বিরাট অবদান, এমনকি দলটি যদি বেশি দিন না-ও টেকে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় সাংবাদিক।
0 comments:
Post a Comment