রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি এই মুহূর্তে যে বড় সংকটে পড়েছে, ১৯৮২ সালের পর কখনোই তাকে সে পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়নি।
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ এরশাদ বন্দুকের জোরে ক্ষমতায় আসার আগেই শামসুল হুদা চৌধুরী ও আবদুল মতিনের নেতৃত্বে দলের একটি অংশ তাঁর সঙ্গে আঁতাত করেছিল। পরবর্তী সময়ে মওদুদ আহমদসহ অনেক অভিজ্ঞ নেতা সামরিক সরকারে যোগ দিলেও বিএনপি তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।
বরং সামরিক স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়ার আপসহীন ভাবমূর্তি ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জয়ী হতে সহায়ক হয়েছিল। কিন্তু এবার দলের উপজেলা পর্যায়ের একজন নেতাকেও আওয়ামী লীগ সরকার ভাগিয়ে নিতে না পারলেও বিএনপি দল হিসেবে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে।
অনেকেই মনে করেন, বিএনপির আন্দোলনই কেবল ভুল পথে পরিচালিত হয়নি, রাজনীতির মূলধারা থেকেও দলটি ছিটকে পড়ার উপক্রম হয়েছে। কেন এমনটি হলো?
ডান দিকে ঝুঁকে পড়া মধ্যপন্থী হিসেবে বিএনপির যে অবস্থান ছিল, তা অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছে। এখন বিএনপিকে মানুষ জামায়াত-হেফাজতের সহযোগী হিসেবে মনে করে। গত পাঁচ বছরে জনগণের সমস্যা নিয়ে তারা যেমন রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তুলতে পারেনি, তেমনি সরকারের ভুলত্রুটিগুলো জাতীয় সংসদে তুলে ধরে দায়িত্বশীল বিরোধী দল হিসেবে নিজেকে প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হয়েছে। সংসদ নিয়ে কথা বলার চেয়ে সংসদ বর্জন করাকেই দলটি রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে নিয়েছিল, যা সংসদীয় ব্যবস্থায় সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য।
আর রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগের বাইরে থাকা মধ্যপন্থী ও গণতান্ত্রিক জনগোষ্ঠীর সমর্থন আদায়ের চেষ্টা না করে বিএনপির নেতৃত্ব উগ্রবাদী জামায়াতে ইসলামী ও গোঁড়াপন্থী হেফাজতে ইসলামের ওপর ভরসা রেখেই আন্দোলনকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যেতে চেষ্টা করেছে, যা শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। নিজস্ব শক্তি-সামর্থ্য নয়, দুই চরম প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির কাঁধে ভর করে বিএনপির গণ-অভ্যুত্থানের এই প্রয়াস ছিল মারাত্মক ভুল।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ গড়ে উঠলে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব তাদের ‘নাস্তিক’ বলে দূরে ঠেলে দেয়, যদিও দলের অনেক নেতা-কর্মী তা পছন্দ করেননি। দ্বিতীয়ত, তারা হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা কর্মসূচির সঙ্গে সংহতি ঘোষণার পাশাপাশি ৫ মে ঢাকায় সংগঠনটির সহিংস তাণ্ডবের প্রতি সমর্থন জানালে বিএনপির অনেক শুভানুধ্যায়ীই বিস্মিত হন। ফলে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির প্রতি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থন থাকা সত্ত্বেও তারা রাজপথে বিএনপির সহযাত্রী হননি। যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধে জামায়াতের সহিংস কর্মকাণ্ড মানুষকে আরও বেশি আন্দোলনবিমুখ করে। জামায়াতের প্রতি বিএনপির অতিশয় নির্ভরতায় দলের অনেক জ্যেষ্ঠ নেতা অস্বস্তি বোধ করলেও প্রকাশ্যে মুখ খুলতে সাহস পাননি। এখনো পাচ্ছেন না।
জনসমর্থন বিএনপির পক্ষে থাকায় ক্ষমতাসীনেরা শুরু থেকেই বিরোধী দলকে বাইরে রেখে নির্বাচন করার যে প্রয়াস চালাচ্ছিল, বিএনপি নেতৃত্ব শেষ পর্যন্ত সেই ফাঁদে পা দেয় জামায়াত ও হেফাজতের ভরসায়। ৪ মে মতিঝিলে খালেদা জিয়ার সমাবেশে আলটিমেটামের পর দুই দলের মধ্যে সমঝোতার পথ ক্রমশ সংকুচিত হতে থাকে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধী দলের লাগাতার অবরোধ-হরতালের কর্মসূচি এবং সরকারের দমন-পীড়নের মুখে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের আত্মগোপনে চলে যাওয়ার নীতিও ছিল আত্মঘাতী। সারা দেশে তো বটেই, খোদ রাজধানীতে বিএনপির নেতা-কর্মীদের অনুপস্থিতির সুযোগে আন্দোলনের নিয়ন্ত্রণ পুরোটাই জামায়াত-শিবিরের হাতে চলে যায় এবং বোমা ও আগুনে মানুষ খুন আর সরকারি সম্পদ ধ্বংসই হয়ে ওঠে তাদের প্রধান হাতিয়ার।
এর পাশাপাশি ঢাকা ও লন্ডনে বিএনপির নেতৃত্বের দুটি আলাদা ভরকেন্দ্রও দলের নেতা-কর্মীদের বিভ্রান্তিতে ফেলে। দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে বসে দলের নেতৃত্ব ও আন্দোলনের কর্মসূচি ঠিক করে দেওয়ায় সামনে থাকা দলের অনেক নেতাই পেছনে চলে যান; আবার পেছনের কেউ কেউ সামনে চলে আসেন। নানা কারণে খালেদা জিয়ার সঙ্গে দলের বেশির ভাগ কেন্দ্রীয় নেতার দূরত্ব সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে তিনি লন্ডনপ্রবাসী পুত্র তারেক রহমান ছাড়া কারও ওপরই ভরসা রাখতে পারেননি।
সম্প্রতি বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরীর সঙ্গে তারেক রহমানের যে কথোপকথন প্রকাশিত হয়েছে, তাতে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের প্রতি তাঁর (তারেক) অবিশ্বাস ও অনাস্থা—দুটোই প্রকাশিত হয়েছে। অথচ বর্তমান সরকারের আমলে এই নেতাই সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত হয়েছেন।
৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে ও পরে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বক্তৃতা-বিবৃতির মধ্যেও বেশ পার্থক্য লক্ষ করা যায়। তারেক রহমান লন্ডনে বসে শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করেই ক্ষান্ত হননি, বায়াত্তর সালে প্রণীত সংবিধানকেই জন-আকাঙ্ক্ষার বিরোধী বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর এই মূল্যায়ন যদি প্রধানমন্ত্রীর একক ক্ষমতার (যা তাঁর মা খালেদা জিয়া দুবার ভোগ করেছেন) বিরুদ্ধে হতো, জনগণের সমর্থন পেত। কিন্তু তিনি এই বিবৃতির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম মূল লক্ষ্য রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকেই চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন এবং ৫ জানুয়ারি নির্বাচনকে অবৈধ ঘোষণা করে সরকারের প্রতি প্রকাশ্যে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন।
বিএনপির চেয়ারপারসন এখনো ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে আলোচনার দরজাটি খোলা রাখতে চান বলে আমাদের ধারণা। সম্প্রতি বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎ কারে তিনি বলেছেন, ‘আমরা আলোচনার জন্য প্রস্তুত আছি। কিন্তু প্রথমে তাদের (সরকার) আলোচনার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। সব জ্যেষ্ঠ নেতা কারাগারে আছেন। আমার বহু কর্মী জেলখানায়। অন্যরা আত্মগোপনে আছেন। তাদেরই আলোচনার পরিবেশ তৈরি করতে হবে।’
এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছেন, তাঁকে (খালেদা জিয়া) সহিংসতা ও জামায়াতে ইসলামীকে ছেড়ে আসতে হবে। সোমবার নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎ কারে খালেদা জিয়া প্রথমবারের মতো স্বীকার করেছেন, ‘তাঁর দল জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে স্থায়ী জোট করেনি।’ জামায়াতকে ছাড়বেন কি না, জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমি পারি না, কিন্তু যখন সময় আসবে, তখন দেখা যাবে।’
সরকারের সঙ্গে আলোচনার শর্ত হিসেবেই নয়, পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যেও জামায়াত সম্পর্কে সংশয়ের কথা বিএনপির নেতাদের অজানা নয়। কিন্তু তারা এই যুুক্তিতে দলটি নিষিদ্ধ করার বিরুদ্ধে যে তাতে তারা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাবে এবং আরও সহিংস হয়ে উঠবে।
বিএনপির নেতৃত্বের প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস ছিল যে নানা কারণে মানুষ যেহেতু সরকারের প্রতি ক্ষুব্ধ, সেহেতু তারা ডাক দিলেই লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে এসে উনসত্তর বা নব্বইয়ের মতো গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়ে দেবে। কিন্তু এখানে তারা যে ভুলটি করেছে তা হলো, জোটের প্রধান সহযোগী জামায়াতে ইসলামীর আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল ভিন্ন। হাইকোর্টের আদেশে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল এবং শীর্ষ নেতারা যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ও দণ্ডিত হওয়ার পর দলটি নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ করছে। বিএনপির নেতৃত্ব জামায়াতের সন্ত্রাসী ও সহিংস আন্দোলনের ওপর ভরসা না করে যদি আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচনে যেত, তাহলে জয়ের সম্ভাবনা ছিল। সরকার সে রকম একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে কারচুপি করার সাহস পেত না। এর পরও সরকার জবরদস্তি করে নির্বাচনী ফল উল্টে দিতে চাইলে সাধারণ মানুষ তখন বিএনপির পক্ষেই রাস্তায় নেমে আসত।
রণাঙ্গনের যুদ্ধে অস্ত্রশক্তি প্রধান হাতিয়ার হলেও রাজনৈতিক যুদ্ধে কৌশল ও মিত্রের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেই কৌশলে বিএনপির নেতৃত্ব এ যাত্রায় জয়ী হতে পারেনি। যার সুফল তাঁর প্রতিপক্ষ শেখ হাসিনা পেয়েছেন। এর আরেকটি কারণ, ১৯৯৫-৯৬ সালে শেখ হাসিনা বিএনপি ছাড়া সবাইকে এবং ২০০৬ সালে তাদের সঙ্গে জামায়াত থাকলেও বিএনপির একসময়ের মিত্র বি. চৌধুরী, অলি আহমদকে কাছে নিতে পেরেছিলেন। কিন্তু এবার খালেদা জিয়া শেখ হাসিনাবিরোধী সবাইকে কাছে টানতে পারেননি। এমনকি জামায়াতের কারণে বি. চৌধুরী, আ স ম আবদুর রব, কাদের সিদ্দিকী জোটভুক্ত হননি। এর পাশাপাশি দলটির ভারতনীতিও পরস্পরবিরোধী উপাদানে আকীর্ণ। দলের একাংশ ভারতের আস্থা অর্জনে আন্তরিক চেষ্টা করলেও অন্য অংশ যুদ্ধ জারি রাখাকেই শ্রেয় মনে করছে। বাসার সামনে খালেদা জিয়ার ক্ষুব্ধ বক্তব্য কিংবা তারেক রহমানের দ্বিতীয় বিবৃতিতে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার আহ্বান তারই প্রমাণ।
আপাতত বিএনপি আন্দোলন ও নির্বাচনবিরোধী রণকৌশলে হেরে গেছে, এটা স্বীকার করেই তাকে নতুন পথচলার কথা ভাবতে হবে। অবরোধ-হরতালের নামে গাড়ি পোড়ানো কিংবা মানুষ মারার আন্দোলন করে যে জনসমর্থন পাওয়া যায় না, সে কথা বিএনপির নেতৃত্ব যত দ্রুত অনুধাবন করবে, ততই দেশের মঙ্গল। এমনকি বিএনপিরও।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
বরং সামরিক স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়ার আপসহীন ভাবমূর্তি ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জয়ী হতে সহায়ক হয়েছিল। কিন্তু এবার দলের উপজেলা পর্যায়ের একজন নেতাকেও আওয়ামী লীগ সরকার ভাগিয়ে নিতে না পারলেও বিএনপি দল হিসেবে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে।
অনেকেই মনে করেন, বিএনপির আন্দোলনই কেবল ভুল পথে পরিচালিত হয়নি, রাজনীতির মূলধারা থেকেও দলটি ছিটকে পড়ার উপক্রম হয়েছে। কেন এমনটি হলো?
ডান দিকে ঝুঁকে পড়া মধ্যপন্থী হিসেবে বিএনপির যে অবস্থান ছিল, তা অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছে। এখন বিএনপিকে মানুষ জামায়াত-হেফাজতের সহযোগী হিসেবে মনে করে। গত পাঁচ বছরে জনগণের সমস্যা নিয়ে তারা যেমন রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তুলতে পারেনি, তেমনি সরকারের ভুলত্রুটিগুলো জাতীয় সংসদে তুলে ধরে দায়িত্বশীল বিরোধী দল হিসেবে নিজেকে প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হয়েছে। সংসদ নিয়ে কথা বলার চেয়ে সংসদ বর্জন করাকেই দলটি রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে নিয়েছিল, যা সংসদীয় ব্যবস্থায় সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য।
আর রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগের বাইরে থাকা মধ্যপন্থী ও গণতান্ত্রিক জনগোষ্ঠীর সমর্থন আদায়ের চেষ্টা না করে বিএনপির নেতৃত্ব উগ্রবাদী জামায়াতে ইসলামী ও গোঁড়াপন্থী হেফাজতে ইসলামের ওপর ভরসা রেখেই আন্দোলনকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যেতে চেষ্টা করেছে, যা শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। নিজস্ব শক্তি-সামর্থ্য নয়, দুই চরম প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির কাঁধে ভর করে বিএনপির গণ-অভ্যুত্থানের এই প্রয়াস ছিল মারাত্মক ভুল।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ গড়ে উঠলে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব তাদের ‘নাস্তিক’ বলে দূরে ঠেলে দেয়, যদিও দলের অনেক নেতা-কর্মী তা পছন্দ করেননি। দ্বিতীয়ত, তারা হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা কর্মসূচির সঙ্গে সংহতি ঘোষণার পাশাপাশি ৫ মে ঢাকায় সংগঠনটির সহিংস তাণ্ডবের প্রতি সমর্থন জানালে বিএনপির অনেক শুভানুধ্যায়ীই বিস্মিত হন। ফলে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির প্রতি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থন থাকা সত্ত্বেও তারা রাজপথে বিএনপির সহযাত্রী হননি। যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধে জামায়াতের সহিংস কর্মকাণ্ড মানুষকে আরও বেশি আন্দোলনবিমুখ করে। জামায়াতের প্রতি বিএনপির অতিশয় নির্ভরতায় দলের অনেক জ্যেষ্ঠ নেতা অস্বস্তি বোধ করলেও প্রকাশ্যে মুখ খুলতে সাহস পাননি। এখনো পাচ্ছেন না।
জনসমর্থন বিএনপির পক্ষে থাকায় ক্ষমতাসীনেরা শুরু থেকেই বিরোধী দলকে বাইরে রেখে নির্বাচন করার যে প্রয়াস চালাচ্ছিল, বিএনপি নেতৃত্ব শেষ পর্যন্ত সেই ফাঁদে পা দেয় জামায়াত ও হেফাজতের ভরসায়। ৪ মে মতিঝিলে খালেদা জিয়ার সমাবেশে আলটিমেটামের পর দুই দলের মধ্যে সমঝোতার পথ ক্রমশ সংকুচিত হতে থাকে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধী দলের লাগাতার অবরোধ-হরতালের কর্মসূচি এবং সরকারের দমন-পীড়নের মুখে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের আত্মগোপনে চলে যাওয়ার নীতিও ছিল আত্মঘাতী। সারা দেশে তো বটেই, খোদ রাজধানীতে বিএনপির নেতা-কর্মীদের অনুপস্থিতির সুযোগে আন্দোলনের নিয়ন্ত্রণ পুরোটাই জামায়াত-শিবিরের হাতে চলে যায় এবং বোমা ও আগুনে মানুষ খুন আর সরকারি সম্পদ ধ্বংসই হয়ে ওঠে তাদের প্রধান হাতিয়ার।
এর পাশাপাশি ঢাকা ও লন্ডনে বিএনপির নেতৃত্বের দুটি আলাদা ভরকেন্দ্রও দলের নেতা-কর্মীদের বিভ্রান্তিতে ফেলে। দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে বসে দলের নেতৃত্ব ও আন্দোলনের কর্মসূচি ঠিক করে দেওয়ায় সামনে থাকা দলের অনেক নেতাই পেছনে চলে যান; আবার পেছনের কেউ কেউ সামনে চলে আসেন। নানা কারণে খালেদা জিয়ার সঙ্গে দলের বেশির ভাগ কেন্দ্রীয় নেতার দূরত্ব সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে তিনি লন্ডনপ্রবাসী পুত্র তারেক রহমান ছাড়া কারও ওপরই ভরসা রাখতে পারেননি।
সম্প্রতি বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরীর সঙ্গে তারেক রহমানের যে কথোপকথন প্রকাশিত হয়েছে, তাতে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের প্রতি তাঁর (তারেক) অবিশ্বাস ও অনাস্থা—দুটোই প্রকাশিত হয়েছে। অথচ বর্তমান সরকারের আমলে এই নেতাই সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত হয়েছেন।
৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে ও পরে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বক্তৃতা-বিবৃতির মধ্যেও বেশ পার্থক্য লক্ষ করা যায়। তারেক রহমান লন্ডনে বসে শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করেই ক্ষান্ত হননি, বায়াত্তর সালে প্রণীত সংবিধানকেই জন-আকাঙ্ক্ষার বিরোধী বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর এই মূল্যায়ন যদি প্রধানমন্ত্রীর একক ক্ষমতার (যা তাঁর মা খালেদা জিয়া দুবার ভোগ করেছেন) বিরুদ্ধে হতো, জনগণের সমর্থন পেত। কিন্তু তিনি এই বিবৃতির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম মূল লক্ষ্য রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকেই চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন এবং ৫ জানুয়ারি নির্বাচনকে অবৈধ ঘোষণা করে সরকারের প্রতি প্রকাশ্যে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন।
বিএনপির চেয়ারপারসন এখনো ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে আলোচনার দরজাটি খোলা রাখতে চান বলে আমাদের ধারণা। সম্প্রতি বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎ কারে তিনি বলেছেন, ‘আমরা আলোচনার জন্য প্রস্তুত আছি। কিন্তু প্রথমে তাদের (সরকার) আলোচনার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। সব জ্যেষ্ঠ নেতা কারাগারে আছেন। আমার বহু কর্মী জেলখানায়। অন্যরা আত্মগোপনে আছেন। তাদেরই আলোচনার পরিবেশ তৈরি করতে হবে।’
এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছেন, তাঁকে (খালেদা জিয়া) সহিংসতা ও জামায়াতে ইসলামীকে ছেড়ে আসতে হবে। সোমবার নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎ কারে খালেদা জিয়া প্রথমবারের মতো স্বীকার করেছেন, ‘তাঁর দল জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে স্থায়ী জোট করেনি।’ জামায়াতকে ছাড়বেন কি না, জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমি পারি না, কিন্তু যখন সময় আসবে, তখন দেখা যাবে।’
সরকারের সঙ্গে আলোচনার শর্ত হিসেবেই নয়, পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যেও জামায়াত সম্পর্কে সংশয়ের কথা বিএনপির নেতাদের অজানা নয়। কিন্তু তারা এই যুুক্তিতে দলটি নিষিদ্ধ করার বিরুদ্ধে যে তাতে তারা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাবে এবং আরও সহিংস হয়ে উঠবে।
বিএনপির নেতৃত্বের প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস ছিল যে নানা কারণে মানুষ যেহেতু সরকারের প্রতি ক্ষুব্ধ, সেহেতু তারা ডাক দিলেই লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে এসে উনসত্তর বা নব্বইয়ের মতো গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়ে দেবে। কিন্তু এখানে তারা যে ভুলটি করেছে তা হলো, জোটের প্রধান সহযোগী জামায়াতে ইসলামীর আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল ভিন্ন। হাইকোর্টের আদেশে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল এবং শীর্ষ নেতারা যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ও দণ্ডিত হওয়ার পর দলটি নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ করছে। বিএনপির নেতৃত্ব জামায়াতের সন্ত্রাসী ও সহিংস আন্দোলনের ওপর ভরসা না করে যদি আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচনে যেত, তাহলে জয়ের সম্ভাবনা ছিল। সরকার সে রকম একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে কারচুপি করার সাহস পেত না। এর পরও সরকার জবরদস্তি করে নির্বাচনী ফল উল্টে দিতে চাইলে সাধারণ মানুষ তখন বিএনপির পক্ষেই রাস্তায় নেমে আসত।
রণাঙ্গনের যুদ্ধে অস্ত্রশক্তি প্রধান হাতিয়ার হলেও রাজনৈতিক যুদ্ধে কৌশল ও মিত্রের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেই কৌশলে বিএনপির নেতৃত্ব এ যাত্রায় জয়ী হতে পারেনি। যার সুফল তাঁর প্রতিপক্ষ শেখ হাসিনা পেয়েছেন। এর আরেকটি কারণ, ১৯৯৫-৯৬ সালে শেখ হাসিনা বিএনপি ছাড়া সবাইকে এবং ২০০৬ সালে তাদের সঙ্গে জামায়াত থাকলেও বিএনপির একসময়ের মিত্র বি. চৌধুরী, অলি আহমদকে কাছে নিতে পেরেছিলেন। কিন্তু এবার খালেদা জিয়া শেখ হাসিনাবিরোধী সবাইকে কাছে টানতে পারেননি। এমনকি জামায়াতের কারণে বি. চৌধুরী, আ স ম আবদুর রব, কাদের সিদ্দিকী জোটভুক্ত হননি। এর পাশাপাশি দলটির ভারতনীতিও পরস্পরবিরোধী উপাদানে আকীর্ণ। দলের একাংশ ভারতের আস্থা অর্জনে আন্তরিক চেষ্টা করলেও অন্য অংশ যুদ্ধ জারি রাখাকেই শ্রেয় মনে করছে। বাসার সামনে খালেদা জিয়ার ক্ষুব্ধ বক্তব্য কিংবা তারেক রহমানের দ্বিতীয় বিবৃতিতে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার আহ্বান তারই প্রমাণ।
আপাতত বিএনপি আন্দোলন ও নির্বাচনবিরোধী রণকৌশলে হেরে গেছে, এটা স্বীকার করেই তাকে নতুন পথচলার কথা ভাবতে হবে। অবরোধ-হরতালের নামে গাড়ি পোড়ানো কিংবা মানুষ মারার আন্দোলন করে যে জনসমর্থন পাওয়া যায় না, সে কথা বিএনপির নেতৃত্ব যত দ্রুত অনুধাবন করবে, ততই দেশের মঙ্গল। এমনকি বিএনপিরও।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
0 comments:
Post a Comment