তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি বাতিলের কথা ওঠার সময় থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবারই গণতন্ত্রের যে মডেলটির কথা বলে এসেছেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ওয়েস্টমিনস্টারেই তিনি তাঁর ‘সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার নির্বাচন’ নিয়ে সবচেয়ে কঠোরভাবে সমালোচিত হয়েছেন।
তা-ও একবার নয়, দুই সপ্তাহের ব্যবধানে দুবার। ওয়েস্টমিনস্টারের বার্তা পরিষ্কার যে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন না ছিল অবাধ, না ছিল সুষ্ঠু এবং সে কারণে তার কোনো নৈতিক গ্রহণযোগ্যতা নেই। ওয়েস্টমিনস্টারে এ ক্ষেত্রে মতৈক্যটা দলমত-নির্বিশেষে। ব্রিটিশ সরকারের অবস্থানও এ ক্ষেত্রে অভিন্ন। যথাযথভাবে সচল গণতন্ত্র বলতে যা বোঝায়, বাংলাদেশে তার অনুপস্থিতি তাঁদের ভাবিয়ে তুলেছে। কেননা, যে পাঁচ লাখ বাংলাদেশি ব্রিটেনে বসতি গেড়েছেন, তাঁদের ছায়া অনুসরণ করে ওই সংকটের অস্থিরতার আঁচ ব্রিটেনেও পড়তে পারে। তাই রাজনৈতিক সংলাপ এবং সমঝোতার মধ্য দিয়ে আরেকটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের জন্যই তাঁদের আকুতি।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দল যতটা সময় সংসদের ভেতরে কাটিয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি সময় কাটিয়েছে রাজপথে। সংসদের বিরোধী আসনে যাঁরা বসেন (বিএনপি অথবা আওয়ামী লীগ উভয়েই এই ঐতিহ্যের অধিকারী) তাঁদের যেহেতু সেখানে বসাটা খুবই অপছন্দের, সে কারণে তাঁদের স্থায়ীভাবে রাজপথে পাঠিয়ে দেওয়ার ধারণাটিতে যে সৃজনশীলতার প্রকাশ ঘটেছে তা রাজনীতিবিজ্ঞানের পাঠ্যসূচিতে নতুন অধ্যায় সংযোজন করবে কোনো সন্দেহ নেই। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) পার্লামেন্ট ওয়াচের হিসাব অনুযায়ী নব্বইয়ে সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের পর থেকে নবম সংসদ পর্যন্ত চারটি সংসদে বিরোধী দলের সংসদ বর্জনের গড় দাঁড়ায় প্রায় ৫৫ শতাংশ। আর প্রতি সংসদেই এ বর্জনের মাত্রা বাড়তে বাড়তে নবমে তা সর্বোচ্চ ৮৩ শতাংশে পৌঁছেছিল। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের রেকর্ডটি হচ্ছে প্রায় ৬০ শতাংশ।
সমর্থকদের ভাষায় ‘সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা’ এবং সমালোচকদের ভাষায় একতরফা ও প্রতিনিধিত্বহীন এবং কারও কারও ভাষায় ‘কেরামতির’ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত দশম সংসদে বিরোধী দলের সরকার এবং বিরোধী দল উভয় আসন অলংকৃত করার বিষয়টিকে ‘কিম্ভূতকিমাকার’ ছাড়া আর কী বিশেষণে অভিহিত করা যায়, তা কিছুতেই ভেবে পাচ্ছি না। সাংবাদিকতার প্রথম শিক্ষাই হচ্ছে সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো বলে বর্ণনা করা। কিন্তু জাতীয় পার্টিকে না বলা যাচ্ছে বিরোধী দল, না সরকারি দল। জাতীয় পার্টির একজন প্রয়াত নেতা সিরাজুল হোসেন খান এরশাদবিরোধী গণ-আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির স্বৈরাচারবিরোধী জোট গঠনকে বিদ্রূপ করতে গিয়ে পল্টনের জনসভায় বলেছিলেন ‘ঘোড়া আর গাধার মিলনে ঘোড়াও হয় না, গাধাও হয় না, হয় খচ্চর।’ জাতীয় পার্টির জন্য বোধ হয় এ রকম একটি চমকপ্রদ ব্যাখ্যার ঐতিহাসিক রেফারেন্স এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
জাতীয় পার্টিকে প্রধানমন্ত্রী বা তাঁর সহযোগী মন্ত্রীরাও যে বিরোধী দল ভাবতে পারছেন না, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ তাঁদের বক্তৃতা-বিবৃতি। এসব বক্তৃতার যতটুকু সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে তার প্রায় সবটা জুড়েই থাকছে রাজপথের বিরোধী দলের সমালোচনা। তাঁদের বক্তব্যে জাতীয় পার্টির উল্লেখ বিরল বললেও বোধ হয় কম বলা হবে।
এই অভূতপূর্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরির কৃতিত্ব যে সরকারের, সেই সরকারের কতিপয় কট্টর সমর্থক যুক্তি দিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রে ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট ওবামার প্রশাসনে যদি রিপাবলিকান চাক হেগেল প্রতিরক্ষামন্ত্রী হতে পারেন তাহলে শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভায় বাবলু- চুন্নুরা মন্ত্রী হলে সমস্যা কোথায়? জার্মানিতে ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাট এবং সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের গ্র্যান্ড কোয়ালিশনের কথা উল্লেখ করে তাঁরা বলছেন যে এর ফলে জার্মানিতে গণতন্ত্রের অবসান ঘটে না থাকলে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ঝুঁকির মুখে পড়বে কেন?
আপাতদৃশ্যে দৃষ্টান্তগুলো যতটা নিরীহ, বাস্তবে কিন্তু ততটাই শঠতাপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের মতো বাংলাদেশেও যদি অতীতের মতো রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারপদ্ধতি চালু থাকত তাহলে বিরোধী দলের কারও মন্ত্রী হওয়া নিয়ে আলোচনাটা হতো ভিন্ন। মিজান চৌধুরী, কোরবান আলীদের মন্ত্রী হওয়ার কথা আমাদের এত সহজেই ভুলে যাওয়া উচিত হবে না। তাঁরা কিন্তু মন্ত্রী হয়েছিলেন আগে এবং পরে আওয়ামী লীগ তাঁদের বহিষ্কার করেছিল। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র কিংবা জার্মানিতে বাংলাদেশের সংবিধানের মতো ৭০ ধারা নেই, যাতে দলীয় সাংসদদের স্বাধীনভাবে ভোট দেওয়ার ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। জার্মানিতে প্রধান দুই দলের যে মহাজোটের সরকার, সেটির পটভূমিও ভিন্ন। চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটরা নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও ছোট কোনো দলকে সঙ্গে নিয়েও সরকার গঠনে সক্ষম ছিলেন না। ফলে পুনর্নির্বাচন এড়াতে মহাজোটের সরকার এবং জোটটি গড়ে উঠেছে মন্ত্রিত্ব বা ক্ষমতা ভাগাভাগির সমঝোতার ওপর নয়, রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বিষয়গুলোতে ন্যূনতম কর্মসূচির ওপর। ডান এবং বামপন্থী দুটো দলের এ সমঝোতা তাই রাজনৈতিক আপসরফার এক নতুন দৃষ্টান্ত। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যে এই সমঝোতাটির সিদ্ধান্ত হয়েছে সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির তৃণমূলের সাধারণ সদস্যদের ভোটে। জাতীয় স্বার্থে দলের প্রায় আড়াই লাখের বেশি সদস্য প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছেন, আর বিপক্ষে ৪০ হাজার। বিপরীতে বাংলাদেশে সংবিধান সংশোধন থেকে শুরু করে জাতীয় পার্টিকে আধা সরকারি-আধা বিরোধী (যথার্থ বর্ণনায় সুবিধাবাদী) দলে রূপান্তরিত করা পর্যন্ত সবকিছুই হয়েছে একজনের ইচ্ছায়। আর কোনো ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সমঝোতার কথা কেউ দাবি করেছেন বলে আজ পর্যন্ত শুনিনি। অবশ্য বামপন্থী মেনন বা ইনু সাহেবদের বিভিন্ন ইসলামি মাহফিলে উপস্থিতি হেফাজতভক্ত জেনারেলের সঙ্গে সমঝোতার আলামত কি না, তা তাঁরাই ভালো বলতে পারবেন।
নতুন মেয়াদে সরকার গঠন করায় প্রধানমন্ত্রীকে বিশ্বসম্প্রদায়ের অভিনন্দনে খরার কারণে শেষ পর্যন্ত ‘ডি এইট’ নামক গোষ্ঠীর মহাসচিবের বিবৃতির কথাও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এখন বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানাতে হচ্ছে। ভারত, রাশিয়া ও চীন ছাড়া বৈশ্বিক পরিসরে ওজনদার আর কোনো দেশের নাম যুক্ত না হওয়ায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের ঘুম হারাম হয়েছে বলেই এমনটি ঘটছে কি না কে জানে। তাঁরা হয়তো এ ক্ষেত্রে টনি ব্লেয়ারের মতো অবসরপ্রাপ্ত সুপারস্টারের কথা ভুলে গেছেন। অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের চেয়েও জঙ্গি ইসলামপন্থীদের মোকাবিলাকে অগ্রাধিকার হিসেবে বিশ্বসম্প্রদায়ের কাছে তুলে ধরতে উৎসুক যাঁরা, তাঁদের একজন একনিষ্ঠ সমর্থক মি. ব্লেয়ার এ সপ্তাহে আবার সংবাদের শিরোনাম হয়েছেন। মিসরে ইসলামি ব্রাদারহুডকে নির্মূলে সামরিক বাহিনীর ভূমিকার প্রশংসা করে তিনি আবারও শিরোনামে উঠে এসেছেন। স্বৈরশাসন এবং দুর্নীতির জন্য বহুল আলোচিত কাজাখস্তান এবং মালাওয়ির হয়ে বেতনভোগী উপদেষ্টার কাজ করার ইতিহাস তাঁর রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য একপর্যায়ে ওয়েস্টমিনস্টার ছাড়াও মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের কথাও কখনো কখনো বলেছেন। নভেম্বর মাসে যখন ঢাকায় ছিলাম তখন একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীও আমাকে বলেছিলেন যে মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের মতো উন্নতি করতে হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং ধারাবাহিকতা প্রয়োজন। বিরোধীদের হয়রানি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ প্রসঙ্গেই তাঁর বক্তব্যে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার কথা উঠেছিল। তখনই আমার আশঙ্কা হয়েছিল যে আসলে আওয়ামী লীগ ওই সিঙ্গাপুর মালয়েশিয়ার পথটাই অনুসরণ করতে চাইছে কি না।
রাজনৈতিক ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন এবং গণমাধ্যমে ক্ষমতাসীন দলের নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব এতটাই বিস্তৃত যে সরকার পরিবর্তন কি জিনিস সেটাই সেখানকার নাগরিকেরা ভুলে গেছেন। মালয়েশীয় নাগরিক জীবনে ভূমিপুত্রদের অগ্রাধিকার আর অন্যদের দ্বিতীয় শ্রেণীর অবস্থানে যেমন বৈষম্য, সে ধরনের গণতন্ত্র বাংলাদেশে কারোরই (সুবিধাভোগীরা ছাড়া) পছন্দ হওয়ার কথা নয়। সরকারপ্রধানের অনুগত থাকলে উপপ্রধানমন্ত্রী আর বিরোধী দলে গেলে সমকামিতার অভিযোগে বন্দী রাখা এবং বিচারের নামে হয়রানির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত মালয়েশিয়ার আনোয়ার ইব্রাহিম। সিঙ্গাপুরের শাসকদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ না থাকলেও মালয়েশিয়া ওই দুর্নাম থেকে মুক্ত নয়। আর সংবাদপত্রের ওপর শাসকদের নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকায় সরকারের কোনো জবাবদিহির অবকাশ নেই।
কৌশল যা-ই হোক না কেন, আলামতগুলো সুবিধার নয়। আদালতকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখার প্রক্রিয়ার মৃত্যু ঘটেছে অনেক আগেই। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে রয়েছে ২০৪১ সালের রূপকল্প। সংসদকে বিরোধীমুক্ত করার পাশাপাশি সংবাদমাধ্যমের জন্য যেসব নীতিমালার কথা বলা হচ্ছে, তাতে করে সরকারের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার প্রয়োজনে ক্ষমতাসীনদের কর্তৃত্ববাদী বা স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠার আশঙ্কাই প্রবল।
কামাল আহমেদ: প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি, লন্ডন।
0 comments:
Post a Comment