সামষ্টিক অর্থনীতিতে বর্তমান স্থিতিশীলতা বজায় থাকলে রেমিটেন্স প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়াসহ ছোটখাট কিছু ধাক্কা সহ্য করা অর্থনীতির জন্য খুব একটা কঠিন হবে না। প্রকৃতির বিরূপ আচরণ, বিশ্বমন্দা দীর্ঘস্থায়ী হওয়াসহ আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক চ্যালেঞ্জগুলোকে বিবেচনায় নিয়ে সেগুলো মোকাবেলার লাগসই কৌশল প্রণয়ন করলে ২০১৩ সালের মধ্যে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করা তেমন কঠিন হবে না।
বিশ্বব্যাপী বিশেষ করে উন্নত বিশ্বের অর্থনীতিগুলোতে মন্দা চলছে। এ অবস্থা থেকে বিশ্ব অর্থনীতি কবে মুক্তি পাবে - এ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক অর্থনীতিবিদদের পূর্বাভাসও এখন বাস্তবতা হারিয়ে ফেলতে বসেছে। বেকার সমস্যা প্রকটভাবে বিরাজ করায় গত নভেম্বরে বিশ্ব অর্থনীতির এক-চতুর্থাংশের মালিক যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট ওবামার ডেমোক্রেটিক পার্টির ভরাডুবি হয়েছে। ইউরোপে ইউরোজোনের পর্তুগাল, আয়ারল্যান্ড, ইতালী, ফিনল্যান্ডসহ ১৬টি দেশের অর্থনীতিতেই এখন টালমাটাল অবস্থা। জার্মানী একটু ভাল অবস্থায় থাকলেও অন্যদের মন্দা মোকাবেলায় ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাংককে চাঁদা দিতে দিতে তারাও ক্লান্ত। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ইউরোজোনের বাইরে থাকা ব্রিটেনসহ ১১টি দেশের অর্থনীতিও ভাল অবস্থায় নেই। সবাই ব্যয় সংকোচন করছে। ব্রিটেনে বেতন বৃদ্ধির প্রতিবাদে ছাত্রদের আন্দোলন তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ভাঙচুর, অগি্নসংযোগকেও হার মানিয়েছে। মন্দাকবলিত প্রায় সবগুলো দেশেই পেনশন ভাতা কমানো হয়েছে। জাপান শত চেষ্টা করেও তাদের অর্থনীতিতে গতি ফিরিয়ে আনতে পারছে না। এখন সরকার প্রায় শত কোটি ডলার বাজারে ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর ফলে মূল্যস্ফীতি আরো বেড়ে গেলে তা কীভাবে সামাল দেবে তা এখনো পরিষ্কার নয়। বড় অর্থনীতিগুলোর মধ্যে একমাত্র চীন একটু ভাল অবস্থায় আাছে। তবে ইতোমধ্যেই চীনের মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশ স্পর্শ করেছে। ধনী-গরিব বৈষম্য আরো বেড়েছে। উচ্চ বেতনের চাকরির আশায় লাখ লাখ কর্মক্ষম মানুষ শিল্পসমৃদ্ধ প্রদেশগুলোতে পাড়ি জমাচ্ছে। পক্ষান্তরে, বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশ্বমন্দার অভিঘাত সহ্য করেও সামস্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রেখেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য এটি একটি আশাপূর্ণ অগ্রগতি। আন্তর্জাতিক অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, বিশ্বে যে বিশটি দেশ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি। গত নভেম্বরে প্রকাশিত জাতিসংঘ মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন_২০১০ অনুযায়ী এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি অর্জন করেছে। উন্নয়ন ধারার দিক থেকে ৯৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। কয়েকদিন আগে অর্থনীতিবিষয়ক প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক সাময়িকী 'দ্যা ইকোনোমিস্ট'-এর মর্যাদাপূর্ণ 'ইকোনোমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিট ইনডেস্ক ২০১০' প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বিশ্বগণতান্ত্রিক সূচকে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি অর্জন করেছে। বিশ্বের ১৬৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ এখন ৮৩ তম। দুই বছর আগে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৯১তম।
বাংলাদেশের অর্থনীতির এ ভাল অবস্থায় বড় অবদান রেখেছে রফতানি আয় এবং প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স। গত বছর বিশ্বের আমদানি-রফতানি তার আগের বছরের তুলনায় ১২.২ শতাংশ কমেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটিই সবচেয়ে বড় পতন। বিশ্বের রফতানি কমেছে ২১ শতাংশ। মাত্র ১২টি দেশ রফতানিতে প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পেরেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ২০০৯-১০ অর্থবছরে বাংলাদেশ ১,৬২০ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য রফতানি করেছে। ২০০৮-০৯-এ হয়েছিল ১,৫৫৬ কোটি ডলার। ৪.১১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বর্তমান ২০১০-১১ অর্থবছরের নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে রফতানি আয় হয়েছে ৮২৮ কোটি ডলার। যা বিগত অর্থবছরের এ সময়ের তুলনায় প্রায় ৩৬ শতাংশ বেশি। আগামী জুন পর্যন্ত এভাবে এগিয়ে যেতে পারলে চলতি অর্থবছরে রফতানি আয় ২,২০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে। আমদানির ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ ভাল অবস্থায় আছে। মন্দার কারণে ২০০৯ সালে বিশ্ব আমদানি ব্যয় প্রায় ১১ শতাংশ কমেছে। পক্ষান্তরে, বাংলাদেশের আমদানি ৫.৫ শতাংশ বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে আমদানি ব্যয় হয়েছে ৯৫৫ কোটি ডলার। যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৩৪ শতাংশ বেশি। এ ব্যয়ের একটা বড় অংশই হয়েছে মূলধনী যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে। এটি আগামী দিনগুলোতে অর্থনীতি আরো চাঙ্গা হওয়ারই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
বাংলাদেশের রফতানিপণ্যের সংখ্যা বেশি নয়। প্রায় আড়াই দশক ধরে রফতানি ক্ষেত্রে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে তৈরি পোশাক খাত। প্রতি বছরই রফতানি আয়ে তৈরি পোশাক খাতের অবদান বাড়ছে। গত বছর ১,৬২১ কোটি ডলার রফতানি আয়ের মধ্যে ১,২৫০ কোটি ডলারই এসেছে তৈরি পোশাক খাত থেকে। অন্যান্য পণ্য থেকে এসেছে মাত্র ২৩ শতাংশ আয়। তৈরি পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম রফতানিকারক দেশ। চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও তুরস্কের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। আমদানিকারক দেশগুলোতে ব্যাপক মন্দা সত্ত্বেও সরকার ও তৈরি পোশাক উদ্যোক্তাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টার কারণে দেশ এ কৃতিত্ব অর্জন করেছে। সরকার বিশ্বমন্দার প্রভাব মোকাবেলা করে রফতানিমুখী খাতগুলো যাতে প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে পারে সে লক্ষ্যে প্রথম প্যাকেজে নীতি প্রণোদনাসহ ৩,৪২৪ কোটি টাকা দিয়েছে। দ্বিতীয় প্যাকেজের আওতায় ২,০০০ কোটি টাকা প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। তৈরি পোশাকের পাশাপাশি ঔষধ, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যসহ ম্যানুফেকচার্ড পণ্য, হিমায়িত খাদ্য, পাট ও পাটজাত দ্রব্য, কৃষিপণ্য, জাহাজ শিল্প প্রভৃতি ক্ষেত্রে রফতানি বৃদ্ধির লক্ষ্যে নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং নতুন বাজার সৃষ্টিতে সরকার তৎপর রয়েছে। বিদেশে বাংলাদেশের মিশনগুলোকে অর্থনৈতিক কূটনীতিমুখী করে গড়ে তোলা হচ্ছে। নতুন নতুন পণ্য রফতানি বাজারে নিয়ে আসার লক্ষ্যে বিনিয়োগবান্ধব শিল্পনীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। শিল্পনীতিতে ৩২টি খাতকে থার্স্ট সেক্টর হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এগুলোতে বিনিয়োগ করলে কর মওকুফসহ বিভিন্ন প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। তবে গার্মেন্টস খাতে প্রবৃদ্ধি অর্জনের প্রধান শক্তি এ খাতে নিয়োজিত প্রায় ৩৫ লাখ গার্মেন্টস শ্রমিক। যার অধিকাংশই নারী। সাম্প্রতিককালে নতুন বেতন-ভাতার দাবিতে ঢাকা ও চট্টগ্রামের বেশকিছু গার্মেন্টস ও রফতানিমুখী অন্যান্য শিল্পে শ্রমিক আন্দোলনের নামে কিছু অনভিপ্রেত উচ্ছৃঙ্খলতা দেখা গেছে। যদিও সরকার অনেকটা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে গার্মেন্টস খাতে নূ্যনতম মজুরি ২০০৬ সালের ১,৬৬২ টাকা থেকে বাড়িয়ে তিন হাজার টাকা করেছে। এসবের পিছনে কার কী দূরভীসন্ধি কাজ করছে তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। পাশাপাশি নতুন বেতন-স্কেল বাস্তবায়নের মনিটরিং জোরদার করা দরকার। শিল্পে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় থাকলে আগামী দিনগুলোতে উৎপাদন ও রফতানি প্রবৃদ্ধি আরো বাড়বে। নতুন বিনিয়োগও হবে। বেকারদের কর্মসংস্থান হবে। দেশের অর্থনীতি দৃঢ় হবে।
দেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি হচ্ছে। দেশীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধির পাশাপাশি বিশ্বমন্দা অবস্থায়ও বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের পরিমাণ বাড়ছে। শিল্প বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে শিল্পঋণ সহজলভ্য করা হয়েছে। ফলে ২০০৯-১০ অর্থবছরে শিল্পঋণ বিতরণে আগের বছরের তুলনায় ৩০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৮ শতাংশ। নতুন নতুন শিল্প স্থাপনের ফলে উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি কর্মসংস্থানও বাড়ছে। ২১ ডিসেম্বর, ২০১০ পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ১,০৯৫ কোটি ডলার। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের আরেকটি প্রধান খাত জনশক্তি রফতানি। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবাসীরা ৯৬৯ কোটি ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন। ২০০৯-১০ অর্থবছরে রেমিটেন্স আয়ে ১৩.৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে ১,০৯৯ কোটি ডলার অর্জিত হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শেষ বছর রেমিটেন্স এসেছিল মাত্র ৪৪৩ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে ৪৫৩ কোটি ডলার রেমিটেন্স এসেছে। প্রবাসীরা যাতে বৈধ পথে অর্থ প্রেরণে উদ্বুদ্ধ হয় সে লক্ষ্যে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন এবং সন্ত্রাসবিরোধী আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এখন প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থ তাদের আত্মীয়-স্বজনরা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পাচ্ছেন। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে রেমিটেন্স প্রেরণ পদ্ধতি সহজীকরণ করা হয়েছে। প্রবাসীদের দেশে বিনিয়োগের পথ এখন অনেক সুগম হয়েছে। তাদের এবং দেশে তাদের পরিবারের জন্য বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে। প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক স্থাপন করা হয়েছে। প্রবাসে গমনেচ্ছুরা এ ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারছেন। এতে তাদের পাসপোর্ট, ওয়ার্ক-পারমিট ইত্যাদি যথাযথ আছে কি না তাও নিশ্চিত হওয়া যাবে। প্রতারিত হওয়ার পথ বন্ধ হবে। এর ফলে প্রবাসীরা বৈধ চ্যানেলে রেমিটেন্স পাঠাতে আগ্রহী হয়েছেন। দুশ্চিন্তার বিষয় হচ্ছে, মন্দার কারণে কোনো কোনো দেশে জনশক্তির চাহিদা কমে গেছে। জনশক্তি রফতানি প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে সরকারকে সম্ভাবনাময় দেশগুলোর সরকারের সাথে নিরন্তর আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। পাশাপাশি দক্ষ শ্রমিক রফতানি সামর্থ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাকে আরো কার্যকর ও যুগোপযোগী করতে হবে।
রাজস্ব আদায় পরিস্থিতিও বেশ সন্তোষজনক। ২০০৯-১০ অর্থবছরে মোট ৭৮,০৮৬ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে। যা ২০০৮-০৯ অর্থবছরের তুলনায় ১৬.৭ শতাংশ বেশি। চলতি অর্থবছরে ৯২,৮৪৭ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম তিন মাসে আয় হয়েছে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা। এ আয় লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ২২.৬ শতাংশ বেশি। চলতি ২০১০-১১ অর্থবছরে মোট বাজেট বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১ লাখ ৩২ হাজার ১৭০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা এডিপি বরাদ্দ ৩৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। বাজেট বরাদ্দের শতভাগ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মনিটরিং জোরদার এবং জবাবদিহিমূলক ব্যব্স্থা নেয়া হয়েছে। ফলে এডিপি বাস্তবায়ন গত বছরের চেয়েও এ বছর দ্রুততর হচ্ছে। নতুন মজুরি কমিশন ঘোষণা করা হয়েছে।
নিত্যপণ্যের মূল্য পরিস্থিতি নিয়ে জনগণের মধ্যে কিছুটা উদ্বেগ আছে এবং এটা স্বাভাবিক। ২০০৯-১০ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ছিল ৭.৩ শতাংশ। এখন তা ৭.৮ শতাংশ এবংয় ঊধর্্বমুখী। এখন বিশ্বব্যাপীই মূল্যস্ফীতি চলছে। কোনো কোনো দেশে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি ২০ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে। এর প্রধান কারণ, বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি। বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী বিগত ছয় মাসে বিশ্ববাজারে গম ও ভুট্টার দাম ৫৭ শতাংশ বেড়েছে। চালের দাম বেড়েছে ৪৫ শতাংশ। চিনির দাম বেড়েছে ৫৫ শতাংশ। সয়াবিনের দাম গত ১৬ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে গত অক্টোবরে ভারতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৭ শতাংশ। ডিসেম্বরে এসে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১২.১৩ শতাংশে। পাকিস্তানে মূল্যস্ফীতি প্রায় ১৩ শতাংশ। নেপালে ১৩.২ শতাংশ। শ্রীলঙ্কায় প্রায় ১১ শতাংশ। সার্কভুক্ত দেশগুলোসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তুলনায় বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি বেশ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এর মূলে আছে কৃষি উৎপাদনে আমাদের ব্যাপক সাফল্য। ২০০৯-১০ অর্থবছরে ৩ কোটি ২৩ লাখ টন চাল উৎপাদিত হয়েছে। এর আগের বছর হয়েছিল ৩ কোটি ১৩ লাখ টন। গত মৌসুমে আমন ধানের ফলনও খুব ভাল হয়েছে। উৎপাদন এক কোটি ৩১ লাখ টনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যেতে পারে। শাক-সবজি, আলু, পিঁয়াজ, ডাল, ফল, পাট, রবিশস্য সব ফসলের উৎপাদনই গত দুই বছরে অনেক বেড়েছে। এর মূল কারণ সরকারের কৃষকবান্ধব নীতি। সরকার ৪০-৫০ টাকা কেজি দরে ইউরিয়া সার আমদানি করে কৃষককে দিচ্ছে কেজি ১২ টাকায়। অন্যান্য সারের দাম এ দুই বছরে তিনবার কমিয়েছে। ২০০৮ সালে যে টিএসপি ডিলারদের কাছে বিক্রি করা হতো কেজি ৬৫ টাকায় এখন ডিলাররা তা পাচ্ছে ২০ টাকায়। ডিএপি'র দাম ছিল ৮৫ টাকা কেজি। এখন ডিলাররা পাচ্ছে ২৫ টাকা কেজি। ভর্তুকি বাবদ চলতি অর্থবছরে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়া হয়েছে। কৃষি উপকরণ দেয়ার জন্য এক কোটি ৮২ লাখ কৃষক পরিবারকে কৃষি কার্ড দেয়া হয়েছে। এখন কৃষক ভর্তুকির টাকা সরাসরি ব্যাংক থেকে উত্তোলন করতে পারছে। সরকার কৃষকদেরকে ১০ টাকা দিয়ে ব্যাংক একাউন্ট খোলার সুযোগ করে দিয়েছে। গত অর্থবছরে সরকার কৃষকদের মধ্যে ১১,১১৭ কোটি টাকার কৃষিঋণ বিতরণ করেছে। চলতি অর্থবছরে ১২ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণের লক্ষ্য নিয়ে গত অক্টোবর পর্যন্ত চার মাসে ৩,৬০৮ কোটি টাকা বিতরণ করেছে। এক্ষেত্রে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে লবণাক্ত জমি, অতি খরা, হঠাৎ বন্যা , সহনীয় বীজ উদ্ভাবনে বেশকিছু সাফল্য অর্জিত হয়েছে। সেচ ব্যবস্থা সম্প্রসারিত হচ্ছে। এতে পতিত জমি আবাদী জমিতে রূপান্তরিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এসব উদ্যোগ কৃষকের মধ্যে উৎপাদন বাড়ানোর প্রেরণা হিসেবে কাজ করছে।
সামষ্টিক অর্থনীতিতে বর্তমান স্থিতিশীলতা বজায় থাকলে রেমিটেন্স প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়াসহ ছোটখাট কিছু ধাক্কা সহ্য করা অর্থনীতির জন্য খুব একটা কঠিন হবে না। প্রকৃতির বিরূপ আচরণ, বিশ্বমন্দা দীর্ঘস্থায়ী হওয়াসহ আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক চ্যালেঞ্জগুলোকে বিবেচনায় নিয়ে সেগুলো মোকাবেলার লাগসই কৌশল প্রণয়ন করলে ২০১৩ সালের মধ্যে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করা তেমন কঠিন হবে না। সে লক্ষ্যে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে
বাংলাদেশের অর্থনীতির এ ভাল অবস্থায় বড় অবদান রেখেছে রফতানি আয় এবং প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স। গত বছর বিশ্বের আমদানি-রফতানি তার আগের বছরের তুলনায় ১২.২ শতাংশ কমেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটিই সবচেয়ে বড় পতন। বিশ্বের রফতানি কমেছে ২১ শতাংশ। মাত্র ১২টি দেশ রফতানিতে প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পেরেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ২০০৯-১০ অর্থবছরে বাংলাদেশ ১,৬২০ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য রফতানি করেছে। ২০০৮-০৯-এ হয়েছিল ১,৫৫৬ কোটি ডলার। ৪.১১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বর্তমান ২০১০-১১ অর্থবছরের নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে রফতানি আয় হয়েছে ৮২৮ কোটি ডলার। যা বিগত অর্থবছরের এ সময়ের তুলনায় প্রায় ৩৬ শতাংশ বেশি। আগামী জুন পর্যন্ত এভাবে এগিয়ে যেতে পারলে চলতি অর্থবছরে রফতানি আয় ২,২০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে। আমদানির ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ ভাল অবস্থায় আছে। মন্দার কারণে ২০০৯ সালে বিশ্ব আমদানি ব্যয় প্রায় ১১ শতাংশ কমেছে। পক্ষান্তরে, বাংলাদেশের আমদানি ৫.৫ শতাংশ বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে আমদানি ব্যয় হয়েছে ৯৫৫ কোটি ডলার। যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৩৪ শতাংশ বেশি। এ ব্যয়ের একটা বড় অংশই হয়েছে মূলধনী যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে। এটি আগামী দিনগুলোতে অর্থনীতি আরো চাঙ্গা হওয়ারই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
বাংলাদেশের রফতানিপণ্যের সংখ্যা বেশি নয়। প্রায় আড়াই দশক ধরে রফতানি ক্ষেত্রে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে তৈরি পোশাক খাত। প্রতি বছরই রফতানি আয়ে তৈরি পোশাক খাতের অবদান বাড়ছে। গত বছর ১,৬২১ কোটি ডলার রফতানি আয়ের মধ্যে ১,২৫০ কোটি ডলারই এসেছে তৈরি পোশাক খাত থেকে। অন্যান্য পণ্য থেকে এসেছে মাত্র ২৩ শতাংশ আয়। তৈরি পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম রফতানিকারক দেশ। চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও তুরস্কের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। আমদানিকারক দেশগুলোতে ব্যাপক মন্দা সত্ত্বেও সরকার ও তৈরি পোশাক উদ্যোক্তাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টার কারণে দেশ এ কৃতিত্ব অর্জন করেছে। সরকার বিশ্বমন্দার প্রভাব মোকাবেলা করে রফতানিমুখী খাতগুলো যাতে প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে পারে সে লক্ষ্যে প্রথম প্যাকেজে নীতি প্রণোদনাসহ ৩,৪২৪ কোটি টাকা দিয়েছে। দ্বিতীয় প্যাকেজের আওতায় ২,০০০ কোটি টাকা প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। তৈরি পোশাকের পাশাপাশি ঔষধ, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যসহ ম্যানুফেকচার্ড পণ্য, হিমায়িত খাদ্য, পাট ও পাটজাত দ্রব্য, কৃষিপণ্য, জাহাজ শিল্প প্রভৃতি ক্ষেত্রে রফতানি বৃদ্ধির লক্ষ্যে নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং নতুন বাজার সৃষ্টিতে সরকার তৎপর রয়েছে। বিদেশে বাংলাদেশের মিশনগুলোকে অর্থনৈতিক কূটনীতিমুখী করে গড়ে তোলা হচ্ছে। নতুন নতুন পণ্য রফতানি বাজারে নিয়ে আসার লক্ষ্যে বিনিয়োগবান্ধব শিল্পনীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। শিল্পনীতিতে ৩২টি খাতকে থার্স্ট সেক্টর হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এগুলোতে বিনিয়োগ করলে কর মওকুফসহ বিভিন্ন প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। তবে গার্মেন্টস খাতে প্রবৃদ্ধি অর্জনের প্রধান শক্তি এ খাতে নিয়োজিত প্রায় ৩৫ লাখ গার্মেন্টস শ্রমিক। যার অধিকাংশই নারী। সাম্প্রতিককালে নতুন বেতন-ভাতার দাবিতে ঢাকা ও চট্টগ্রামের বেশকিছু গার্মেন্টস ও রফতানিমুখী অন্যান্য শিল্পে শ্রমিক আন্দোলনের নামে কিছু অনভিপ্রেত উচ্ছৃঙ্খলতা দেখা গেছে। যদিও সরকার অনেকটা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে গার্মেন্টস খাতে নূ্যনতম মজুরি ২০০৬ সালের ১,৬৬২ টাকা থেকে বাড়িয়ে তিন হাজার টাকা করেছে। এসবের পিছনে কার কী দূরভীসন্ধি কাজ করছে তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। পাশাপাশি নতুন বেতন-স্কেল বাস্তবায়নের মনিটরিং জোরদার করা দরকার। শিল্পে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় থাকলে আগামী দিনগুলোতে উৎপাদন ও রফতানি প্রবৃদ্ধি আরো বাড়বে। নতুন বিনিয়োগও হবে। বেকারদের কর্মসংস্থান হবে। দেশের অর্থনীতি দৃঢ় হবে।
দেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি হচ্ছে। দেশীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধির পাশাপাশি বিশ্বমন্দা অবস্থায়ও বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের পরিমাণ বাড়ছে। শিল্প বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে শিল্পঋণ সহজলভ্য করা হয়েছে। ফলে ২০০৯-১০ অর্থবছরে শিল্পঋণ বিতরণে আগের বছরের তুলনায় ৩০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৮ শতাংশ। নতুন নতুন শিল্প স্থাপনের ফলে উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি কর্মসংস্থানও বাড়ছে। ২১ ডিসেম্বর, ২০১০ পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ১,০৯৫ কোটি ডলার। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের আরেকটি প্রধান খাত জনশক্তি রফতানি। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবাসীরা ৯৬৯ কোটি ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন। ২০০৯-১০ অর্থবছরে রেমিটেন্স আয়ে ১৩.৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে ১,০৯৯ কোটি ডলার অর্জিত হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শেষ বছর রেমিটেন্স এসেছিল মাত্র ৪৪৩ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে ৪৫৩ কোটি ডলার রেমিটেন্স এসেছে। প্রবাসীরা যাতে বৈধ পথে অর্থ প্রেরণে উদ্বুদ্ধ হয় সে লক্ষ্যে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন এবং সন্ত্রাসবিরোধী আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এখন প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থ তাদের আত্মীয়-স্বজনরা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পাচ্ছেন। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে রেমিটেন্স প্রেরণ পদ্ধতি সহজীকরণ করা হয়েছে। প্রবাসীদের দেশে বিনিয়োগের পথ এখন অনেক সুগম হয়েছে। তাদের এবং দেশে তাদের পরিবারের জন্য বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে। প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক স্থাপন করা হয়েছে। প্রবাসে গমনেচ্ছুরা এ ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারছেন। এতে তাদের পাসপোর্ট, ওয়ার্ক-পারমিট ইত্যাদি যথাযথ আছে কি না তাও নিশ্চিত হওয়া যাবে। প্রতারিত হওয়ার পথ বন্ধ হবে। এর ফলে প্রবাসীরা বৈধ চ্যানেলে রেমিটেন্স পাঠাতে আগ্রহী হয়েছেন। দুশ্চিন্তার বিষয় হচ্ছে, মন্দার কারণে কোনো কোনো দেশে জনশক্তির চাহিদা কমে গেছে। জনশক্তি রফতানি প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে সরকারকে সম্ভাবনাময় দেশগুলোর সরকারের সাথে নিরন্তর আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। পাশাপাশি দক্ষ শ্রমিক রফতানি সামর্থ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাকে আরো কার্যকর ও যুগোপযোগী করতে হবে।
রাজস্ব আদায় পরিস্থিতিও বেশ সন্তোষজনক। ২০০৯-১০ অর্থবছরে মোট ৭৮,০৮৬ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে। যা ২০০৮-০৯ অর্থবছরের তুলনায় ১৬.৭ শতাংশ বেশি। চলতি অর্থবছরে ৯২,৮৪৭ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম তিন মাসে আয় হয়েছে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা। এ আয় লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ২২.৬ শতাংশ বেশি। চলতি ২০১০-১১ অর্থবছরে মোট বাজেট বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১ লাখ ৩২ হাজার ১৭০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা এডিপি বরাদ্দ ৩৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। বাজেট বরাদ্দের শতভাগ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মনিটরিং জোরদার এবং জবাবদিহিমূলক ব্যব্স্থা নেয়া হয়েছে। ফলে এডিপি বাস্তবায়ন গত বছরের চেয়েও এ বছর দ্রুততর হচ্ছে। নতুন মজুরি কমিশন ঘোষণা করা হয়েছে।
নিত্যপণ্যের মূল্য পরিস্থিতি নিয়ে জনগণের মধ্যে কিছুটা উদ্বেগ আছে এবং এটা স্বাভাবিক। ২০০৯-১০ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ছিল ৭.৩ শতাংশ। এখন তা ৭.৮ শতাংশ এবংয় ঊধর্্বমুখী। এখন বিশ্বব্যাপীই মূল্যস্ফীতি চলছে। কোনো কোনো দেশে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি ২০ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে। এর প্রধান কারণ, বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি। বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী বিগত ছয় মাসে বিশ্ববাজারে গম ও ভুট্টার দাম ৫৭ শতাংশ বেড়েছে। চালের দাম বেড়েছে ৪৫ শতাংশ। চিনির দাম বেড়েছে ৫৫ শতাংশ। সয়াবিনের দাম গত ১৬ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে গত অক্টোবরে ভারতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৭ শতাংশ। ডিসেম্বরে এসে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১২.১৩ শতাংশে। পাকিস্তানে মূল্যস্ফীতি প্রায় ১৩ শতাংশ। নেপালে ১৩.২ শতাংশ। শ্রীলঙ্কায় প্রায় ১১ শতাংশ। সার্কভুক্ত দেশগুলোসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তুলনায় বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি বেশ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এর মূলে আছে কৃষি উৎপাদনে আমাদের ব্যাপক সাফল্য। ২০০৯-১০ অর্থবছরে ৩ কোটি ২৩ লাখ টন চাল উৎপাদিত হয়েছে। এর আগের বছর হয়েছিল ৩ কোটি ১৩ লাখ টন। গত মৌসুমে আমন ধানের ফলনও খুব ভাল হয়েছে। উৎপাদন এক কোটি ৩১ লাখ টনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যেতে পারে। শাক-সবজি, আলু, পিঁয়াজ, ডাল, ফল, পাট, রবিশস্য সব ফসলের উৎপাদনই গত দুই বছরে অনেক বেড়েছে। এর মূল কারণ সরকারের কৃষকবান্ধব নীতি। সরকার ৪০-৫০ টাকা কেজি দরে ইউরিয়া সার আমদানি করে কৃষককে দিচ্ছে কেজি ১২ টাকায়। অন্যান্য সারের দাম এ দুই বছরে তিনবার কমিয়েছে। ২০০৮ সালে যে টিএসপি ডিলারদের কাছে বিক্রি করা হতো কেজি ৬৫ টাকায় এখন ডিলাররা তা পাচ্ছে ২০ টাকায়। ডিএপি'র দাম ছিল ৮৫ টাকা কেজি। এখন ডিলাররা পাচ্ছে ২৫ টাকা কেজি। ভর্তুকি বাবদ চলতি অর্থবছরে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়া হয়েছে। কৃষি উপকরণ দেয়ার জন্য এক কোটি ৮২ লাখ কৃষক পরিবারকে কৃষি কার্ড দেয়া হয়েছে। এখন কৃষক ভর্তুকির টাকা সরাসরি ব্যাংক থেকে উত্তোলন করতে পারছে। সরকার কৃষকদেরকে ১০ টাকা দিয়ে ব্যাংক একাউন্ট খোলার সুযোগ করে দিয়েছে। গত অর্থবছরে সরকার কৃষকদের মধ্যে ১১,১১৭ কোটি টাকার কৃষিঋণ বিতরণ করেছে। চলতি অর্থবছরে ১২ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণের লক্ষ্য নিয়ে গত অক্টোবর পর্যন্ত চার মাসে ৩,৬০৮ কোটি টাকা বিতরণ করেছে। এক্ষেত্রে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে লবণাক্ত জমি, অতি খরা, হঠাৎ বন্যা , সহনীয় বীজ উদ্ভাবনে বেশকিছু সাফল্য অর্জিত হয়েছে। সেচ ব্যবস্থা সম্প্রসারিত হচ্ছে। এতে পতিত জমি আবাদী জমিতে রূপান্তরিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এসব উদ্যোগ কৃষকের মধ্যে উৎপাদন বাড়ানোর প্রেরণা হিসেবে কাজ করছে।
সামষ্টিক অর্থনীতিতে বর্তমান স্থিতিশীলতা বজায় থাকলে রেমিটেন্স প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়াসহ ছোটখাট কিছু ধাক্কা সহ্য করা অর্থনীতির জন্য খুব একটা কঠিন হবে না। প্রকৃতির বিরূপ আচরণ, বিশ্বমন্দা দীর্ঘস্থায়ী হওয়াসহ আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক চ্যালেঞ্জগুলোকে বিবেচনায় নিয়ে সেগুলো মোকাবেলার লাগসই কৌশল প্রণয়ন করলে ২০১৩ সালের মধ্যে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করা তেমন কঠিন হবে না। সে লক্ষ্যে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে
0 comments:
Post a Comment