প্লেসমেন্ট শেয়ারের অবৈধ হাট, এমপি-সাবেক এমপিরাও গ্রীন বাংলার ফাঁদে by তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু

Sunday, July 31, 2011

রাজধানীর বনশ্রীতে প্লেসমেন্ট শেয়ার বিকিকিনির জন্য আলাদাভাবে গড়ে উঠেছে একটি 'স্টক মার্কেট'। গ্রীন বাংলা গ্রুপ পরিচালিত এ কার্ব মার্কেটে বছরে অন্তত এক হাজার কোটি টাকার প্লেসমেন্ট শেয়ার কেনাবেচা হয়। বিভিন্ন কম্পানির রাইট শেয়ার নিয়েও আগাম বাণিজ্য চলে এখানে। এই প্লেসমেন্ট বাণিজ্যের ফাঁদে পড়েছেন প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও। সংসদ সদস্য, পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ নির্বাহীসহ অনেকের মোটা অঙ্কের টাকা আটকে আছে গ্রীন বাংলা গ্রুপের কাছে। তাঁদের মধ্যে মাহী বি চৌধুরী আড়াই কোটি টাকারও বেশি বিনিয়োগ করে পরে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে টাকা উদ্ধার করেন। কুমিল্লার এমপি নাসিমুল আলম চৌধুরীও গ্রীন বাংলার মাধ্যমে আট কোটি টাকা বিনিয়োগ করেন বলে জানা যায়। তবে নাসিমুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেছেন, তিনি টাকা তুলে নিয়েছেন।

প্লেসমেন্ট শেয়ার নিয়ে প্রতারণার অভিযোগে এক বছর আগে এ প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার নবী উল্যাহ নবীকে গ্রেপ্তার করেছিল র‌্যাব। এসইসির তদন্ত কমিটি এসব অভিযোগের সত্যতাও পেয়েছিল। মামলা হয়েছিল। সে মামলা এখনো চলছে। তবে অবৈধ এ ব্যবসা চালিয়ে যেতে অসুবিধা হচ্ছে না গ্রীন বাংলার।
গ্রীন বাংলা গ্রুপের প্রধান কার্যালয় রাজধানীর রামপুরার বনশ্রীতে। নবী উল্যাহ নবী এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক। আটটি সহযোগী প্রতিষ্ঠানের নামে চালানো হচ্ছে অবৈধ প্লেসমেন্ট ব্যবসাসহ পুঁজিবাজারকেন্দ্রিক নানামুখী প্রতারণা। ২০১৪ সাল পর্যন্ত যেসব প্রতিষ্ঠান শেয়ারবাজারে আসতে পারে_এর প্রায় সব কটির শেয়ার এখনই নবী উল্যাহ নবীর কাছে রয়েছে বলে তাঁর সহযোগীরা প্রচার করছে। এই চক্র ইতিমধ্যে সহস্রাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করেছে। সর্বনিম্ন পাঁচ লাখ থেকে ৬০ কোটি টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করেছেন এমন দেড় শতাধিক ব্যক্তির তালিকা রয়েছে কালের কণ্ঠের কাছে।
ফাঁদে আটক যাঁরা : ১৫০ টাকার জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে করা 'বিনিয়োগ চুক্তি' দলিলের মাধ্যমে জহিরুল ইসলাম নামে একজন বিনিয়োগকারী নবী উল্যাহর কাছ থেকে দেশবন্ধু পলিমারের দুই লাখ প্লেসমেন্ট শেয়ার কিনেছেন। শেয়ারপ্রতি ৩৫ টাকা হিসাবে জহিরুল ইসলাম ৭০ লাখ টাকা দেন নবী উল্যাহকে। চুক্তিনামায় নবী উল্যাহর স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন মিনু এবং কে এম নাজমুল হাসান নামে এক ব্যক্তিকে সাক্ষী রাখা হয়েছে। জহিরুল ইসলামের বিনিয়োগকৃত অর্থের জামানত হিসেবে নবী উল্যাহর পক্ষ থেকে সমপরিমাণ অর্থের নিরাপত্তামূলক চেক দেওয়া হয়েছে বলেও চুক্তিতে উল্লেখ রয়েছে। চুক্তিপত্রে বলা হয়, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বিক্রির পর বিক্রয়মূল্যের ভিত্তিতে বিনিয়োগের লভ্যাংশ নির্ধারিত হবে। আর শেয়ার বিক্রি করে লোকসান হলে বিনিয়োগকারীর ৭০ লাখ টাকা ফেরত দেওয়ারও নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা সম্ভাব্য ক্রেতাদের বলছেন, বর্তমান জাতীয় সংসদের ১১ জন সদস্য, বেশ কয়েকজন সাবেক সংসদ সদস্য, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তা, উচ্চপদস্থ আমলা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, উঠতি শিল্পপতিসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ এখানে বিনিয়োগ করেছেন। বিনিয়োগকৃত টাকা উত্তোলনের জন্য গত ১৩ জুলাই বনশ্রীর গ্রীন বাংলা কার্যালয়ে গিয়েছিলেন কুমিল্লা-৮ আসনের সংসদ সদস্য নাসিমুল আলম চৌধুরী। এ সময় এই প্রতিবেদকও প্রতিষ্ঠানটিতে উপস্থিত ছিলেন। গ্রীন বাংলার এক কর্মকর্তার সঙ্গে সেদিন কথা বলে জানা যায়, নাসিমুল আলম গ্রীন বাংলায় আট কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। ওই দিন তাঁকে আরো সাত কোটি টাকা বিনিয়োগের জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়।
কয়েক দিন আগে যোগাযোগ করা হলে নাসিমুল আলম চৌধুরী এমপি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'নবীর কাছে আমার কিছু বিনিয়োগ ছিল। সেটা আমি কিছুদিন আগে উঠিয়ে নিয়ে এসেছি। তবে আমার এলাকার অনেকের টাকা আটকে গেছে বলে শুনেছি।' প্লেসমেন্ট শেয়ার এভাবে কেনা বৈধ কি না_এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'সেটা জানি না।' তিনি আরো বলেন, 'এখন শেয়ারবাজার ভালো, ফলে মূল মার্কেটের বাইরে গিয়ে বিনিয়োগের দরকার পড়ে না।'
ডিএসইর কয়েকজন সদস্যও গ্রীন বাংলায় বিনিয়োগ করেছেন বলে প্রতিষ্ঠানটির এক কর্মকর্তা দাবি করেন। ওই কর্মকর্তা বলেন, বনশ্রীর ওই অফিসে একাধিক এমপির যাতায়াত রয়েছে। তাঁরা সবাই প্লেসমেন্ট শেয়ার কিনেছেন।
বীকন ফার্মার প্লেসমেন্ট শেয়ার কিনে সম্প্রতি বড় ধরনের বিপাকে পড়েন সাবেক সংসদ সদস্য ও বিকল্পধারার নেতা মাহি বি চৌধুরী। তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নবী উল্যাহ সিন্ডিকেটের সদস্য আলাউদ্দীনের মাধ্যমে তিনি বীকন ফার্মার দুই কোটি ৬১ লাখ টাকার প্লেসমেন্ট শেয়ার কিনেছিলেন। গ্রীন বাংলার পক্ষ থেকে তাঁদের নামে চেক লিখে দেওয়ার প্রস্তাব করা হলেও তিনি রাজি হননি। কথা ছিল, মাহির নিজস্ব বিও অ্যাকাউন্টে টাকা জমা রাখা হবে এবং সেখানে নির্ধারিতসংখ্যক শেয়ার জমা হওয়ার পর মূল্য পরিশোধ করা হবে। সে অনুযায়ী মতিঝিলে সাদ সিকিউরিটিজের একটি শাখায় পরিচালিত বিও অ্যাকাউন্টে টাকা জমা দেওয়া হয়। কিন্তু নির্ধারিত সময় পার হলেও বিও অ্যাকাউন্টে শেয়ার জমা হয়নি। এ কারণে ব্রোকারেজ হাউস থেকে সব টাকা তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। কিন্তু সেখান থেকে জানানো হয়, বিও অ্যাকাউন্টে টাকা জমা হয়নি।
মাহি বি চৌধুরী জানান, তিনি তাঁর স্ত্রী, শ্যালক ও শাশুড়ির নামে নবী উল্যাহর কাছ থেকে বীকন ফার্মার প্লেসমেন্ট শেয়ার কেনেন। শেষ পর্যন্ত প্রশাসনের সহায়তায় তিনি ওই টাকা উদ্ধার করতে সক্ষম হন। বিষয়টি তিনি ডিএসই সভাপতি শাকিল রিজভী ও সহসভাপতি আহসানুল ইসলাম টিটুকে মৌখিকভাবে জানিয়ে রেখেছিলেন। গ্রীন বাংলার বনশ্রী অফিসে একাধিক বৈঠক এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় সম্পূর্ণ টাকা ফেরত পান মাহি।
মাহি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এটা বেআইনি, তা প্রথমে বুঝিনি। পরে যখন বুঝতে পারি, তখন টাকাটা তুলে আনার চেষ্টা করি।' তাঁর মতে, টাকার রসিদই প্রমাণ দেয়, সাদ সিকিউরিটিজ জড়িত।
এ ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে সাদ সিকিউরিটিজের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমার হাউসে মাহি বি চৌধুরীর বিও হিসাব থাকলেও সেখানে ওই টাকা জমা হয়নি। আলাউদ্দীনের মাধ্যমে গ্রীন বাংলার নবী উল্যাহ নবী ওই টাকা নিয়েছেন। ইতিমধ্যেই তা প্রমাণিত হয়েছে।' প্রতারক চক্র তাঁর হাউসের জাল রসিদ বই ছাপিয়ে নিয়েছে বলেও তিনি জানান।
গ্রীন বাংলার ব্যবস্থাপনা পরিচালক নবী উল্যাহ নবী এ প্রতিবেদককে বলেন, 'আমার এই ব্যবসা বৈধ। আইনগত কোনো বাধা নেই।' তিনি আরো বলেন, 'আমার বিরুদ্ধে এসইসি ৫৪ ধারায় একটা মামলা করেছে। আশা করি, শিগগিরই মামলাটির মীমাংসা হয়ে যাবে।' প্রতারণার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'সাত-আট বছর ধরে এ ব্যবসা করছি। কেউ বলতে পারবেন না, আমি কারো টাকা মেরে দিয়েছি।'
প্লেসমেন্ট শেয়ার নিয়ে গড়ে ওঠা আলাদা কার্ব মার্কেট প্রসঙ্গে ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জের সভাপতি শাকিল রিজভী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'একজন আইনজীবীসহ কিছুদিন আগে মাহি বি চৌধুরী ডিএসইর অফিসে আসেন। তাঁর অভিযোগের সূত্র ধরে জানতে পারি, মূল শেয়ার মার্কেটের বাইরে প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রির জন্য বনশ্রীর লেকের পাড়ে গড়ে উঠেছে আলাদা কার্ব মার্কেট। যেন শেয়ার মার্কেটের বাইরে আলাদা স্টক মার্কেট। এটা আইনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী এবং দণ্ডনীয় অপরাধ। এটা মূল শেয়ার মার্কেটের জন্য মারাত্মক হুমকি। এখনই তা বন্ধ করা উচিত।'
অবৈধ ব্রোকারেজ হাউস : ২০০০ সালের সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এঙ্চেঞ্জ কমিশন (স্টক ব্রোকার, স্টক ডিলার ও অনুমোদিত প্রতিনিধি) বিধিমালা অনুযায়ী কোনো প্রতিষ্ঠানকে এসইসির কাছ থেকে স্টক ব্রোকার বা স্টক ডিলারের নিবন্ধন সনদ পেতে হলে অবশ্যই কোনো স্টক এঙ্চেঞ্জের সদস্য হতে হবে। কিন্তু দেশের দুই স্টক এঙ্চেঞ্জের কোনোটির সদস্য না হয়েও ব্রোকারেজ হাউস প্রতিষ্ঠা করেছে গ্রীন বাংলা গ্রুপ_নাম গ্রীন বাংলা সিকিউরিটিজ। ডিএসইর আওতাধীন সাদ সিকিউরিটিজের সদস্যপদ কেনার বিষয়ে আলোচনা চলছে বলেও দাবি করেছেন গ্রীন বাংলার কর্মকর্তারা। তবে সাদ সিকিউরিটিজের চেয়ারম্যান মো. দেলোয়ার হোসেন জানিয়েছেন, এসব একেবারেই ভুয়া প্রচারণা, তবে তাঁর (দেলোয়ার) ছোট ভাইয়ের ব্রোকারেজ হাউস আরাফাত সিকিউরিটিজ কেনার বিষয়ে একবার কথা হয়েছিল।
অবৈধ প্লেসমেন্ট বাণিজ্যের বিষয়টি জানানো হলে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এম খায়রুল হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, কমিশনের অনুমোদন ছাড়া যেকোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের শেয়ার লেনদেন সম্পূর্ণ বেআইনি। আইনগত প্রক্রিয়ার বাইরে এ ধরনের কর্মকাণ্ড পুঁজিবাজারের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তিনি বলেন, 'এ ধরনের তৎপরতা অবশ্যই খতিয়ে দেখা হবে। যে বা যারাই অবৈধ পন্থায় শেয়ার লেনদেনে জড়িত থাকুক না কেন_প্রমাণ পেলে কমিশনের পক্ষ থেকে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।'
সরেজমিন প্লেসমেন্ট হাটে : পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কম্পানি দেশবন্ধু পলিমারের প্রতিটি শেয়ার গত বৃহস্পতিবার বিক্রি হয়েছে ৮১.৫০ টাকা দরে। অ্যাকটিভ ফাইন কেমিক্যালের শেয়ারের দাম ছিল ৮৮.৫০ টাকা। ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এঙ্চেঞ্জে এই দরে বিক্রি হলেও বনশ্রীর ওই স্টক মার্কেটে এ দুটি কম্পানির প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রি হয়েছে ৩৫ টাকা করে। আগামী অক্টোবরে দেশবন্ধু ও অ্যাকটিভ ফাইন কেমিক্যালের 'লক-ইন' উঠে যাবে বলে গ্রীন বাংলার পক্ষ থেকে ক্রেতাদের জানানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে, তখন যদি এসব শেয়ারের বাজারদর বর্তমান স্তরেও থাকে, তাহলেও প্লেসমেন্ট শেয়ারের ক্রেতারা লাভ পাবেন শেয়ারপ্রতি যথাক্রমে ৪৬ ও ৫৩ টাকারও বেশি।
একই কায়দায় বিক্রি হচ্ছে পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড ও রংপুর ডেইরি অ্যান্ড ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেডের প্লেসমেন্ট শেয়ার। পিপলস লিজিংয়ের ১২৫ টাকার শেয়ার ৫০ টাকায় আর শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির আগেই ২৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে রংপুর ডেইরির ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের প্রতিটি শেয়ার।
জানা যায়, এর আগে গ্রামীণফোন, আরএকে সিরামিকস, ফিনিঙ্ ফাইন্যান্স ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ড, আইএফআইসি ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ডসহ বেশ কয়েকটি কম্পানির প্লেসমেন্টে শেয়ার নিয়েও বাণিজ্য করেছে গ্রীন বাংলা গ্রুপ।
রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মসে নিবন্ধিত যেকোনো কম্পানি পুঁজি সংগ্রহের উদ্দেশ্যে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার আগে এর শেয়ারের একটা অংশ বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এঙ্চেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) পূর্বানুমতি প্রয়োজন। এ ধরনের শেয়ারই প্লেসমেন্ট শেয়ার, যা কম্পানিটি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার পরও নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত বা লক-ইন উঠে না যাওয়া পর্যন্ত বিক্রি করা যাবে না। কিন্তু ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে নেওয়া এসব প্লেসমেন্ট শেয়ারই অবাধে কেনাবেচা হচ্ছে গ্রীন বাংলা পরিচালিত 'কার্ব মার্কেটে'। এসইসি আইন ১৯৯৩ অনুযায়ী এসইসির নিবন্ধন ছাড়া স্টক ব্রোকার, সাব ব্রোকার, শেয়ার হস্তান্তরকারী প্রতিনিধিসহ পুঁজিবাজারসংশ্লিষ্ট যেকোনো কর্মকাণ্ড পরিচালনা বেআইনি। এ ছাড়া ২০০০ সালের এসইসি (স্টক ব্রোকার, স্টক ডিলার ও অনুমোদিত প্রতিনিধি) বিধিমালায়ও এসইসির নিবন্ধন সনদ ছাড়া কোনো সিকিউরিটি (শেয়ার, মিউচ্যুয়াল ফান্ড ইউনিট ইত্যাদি) ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই আইন লঙ্ঘনের দায়ে পাঁচ বছরের শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। অথচ এসইসির কোনো নিবন্ধন সনদ ছাড়াই গ্রীন বাংলা গ্রুপ চার বছর ধরে প্লেসমেন্ট শেয়ারের বাণিজ্য চালিয়ে আসছে।
রাইট শেয়ার নিয়েও আগাম বাণিজ্য : বিভিন্ন কম্পানির রাইট শেয়ার নিয়েও আগাম বাণিজ্যের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এসইসির অনুমোদনের বিষয়টি প্রাথমিক পর্যায়ে থাকলেও এরই মধ্যে পিপলস লিজিংয়ের রাইট শেয়ার বিক্রি শুরু করেছেন নবী উল্যাহ নবী ও তাঁর সহযোগীরা। গত বৃহস্পতিবার পিপলস লিজিংয়ের শেয়ার ১২৫.২০ টাকায় লেনদেন হয়েছে। গ্রীন বাংলা শেয়ারটি বিক্রি করছে ৫০ টাকায়।
২০০৫ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত এই কম্পানির প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রির বিষয়ে জানতে চাইলে গ্রীন বাংলার একজন কর্মকর্তা জানান, তাঁদের কাছে পিপলস লিজিংয়ের ৮০ লাখ শেয়ার আছে। এসইসিতে রাইট শেয়ার পাস হলে সেখান থেকে আরো ৪০ লাখ শেয়ার পাওয়া যাবে। এ কারণেই তাঁরা ছয় মাসের লক-ইন হিসাব করে পিপলস লিজিংয়ের শেয়ার বিক্রি করছেন। অথচ এই কম্পানির রাইট শেয়ার ইস্যুর আবেদন এসইসির অনুমোদন পাবে কি না, সে বিষয়টি এখন নিশ্চিত নয়।
কোনো একটি কম্পানি শেয়ারবাজারে আসার প্রক্রিয়া শুরু করা মাত্রই ওই কম্পানির শেয়ার বাগিয়ে নিতে তৎপর হয়ে ওঠেন নবী উল্যাহ নবী। কম্পানির উদ্যোক্তা, পরিচালক কিংবা কর্মকর্তাদের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে প্লেসমেন্ট শেয়ার প্রাপ্তি নিশ্চিত করেন তিনি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্লেসমেন্ট শেয়ার পাওয়া না গেলে উদ্যোক্তা শেয়ারের একাংশ কিনে নেন। এসইসির বিধি অনুযায়ী শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির পর নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত প্লেসমেন্ট ও উদ্যোক্তা শেয়ার হস্তান্তরে নিষেধাজ্ঞা (লক ইন) বলবৎ থাকে।
গ্রেপ্তার হয়েছিলেন নবী উল্যাহ : ২০১০ সালের ১৫ জুলাই গ্রীন বাংলা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নবী উল্যাহ নবী ওরফে শফিউল আলম নবী এবং তাঁর সহযোগী সাত্তারুজ্জামান শামীমকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। র‌্যাব-৩ কার্যালয়ে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে নবী উল্যাহ বিভিন্ন কম্পানির প্লেসমেন্টের শেয়ার নিয়ে বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণার কথা স্বীকার করেন। বিষয়টি নিয়ে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এঙ্চেঞ্জ কমিশন (এসইসি) একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্তের ভিত্তিতে কমিশনের পক্ষে উপপরিচালক (আইন) এ এস এম মাহমুদুল হাসান বাদী হয়ে নবী উল্যাহ নবী, সাত্তারুজ্জামান শামীম এবং গ্রীন বাংলা কমিউনিকেশনস লিমিটেডের নামে ঢাকা মহানগর মুখ্য হাকিমের আদালতে একটি মামলা করেন। ওই মামলার আরজিতে ১০টি কম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের আট কোটি টাকার প্লেসমেন্ট ব্যবসার হিসাব দেখিয়ে নবী উল্যাহ নবীর লিখিত বক্তব্য উল্লেখ করে বলা হয়, 'তার মোট ক্লায়েন্ট সংখ্যা ১০০ জন এবং ৩-৪ বছর যাবত তিনি অবৈধ শেয়ার প্লেসমেন্ট ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।'
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গ্রীন বাংলার নিয়োজিত এজেন্টদের নামে ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জ (ডিএসই) এবং চট্টগ্রাম স্টক এঙ্চেঞ্জের (সিএসই) বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউসে অনেক বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। এসব বিও অ্যাকাউন্টের পোর্টফোলিও স্টেটমেন্টকে প্লেসমেন্ট শেয়ার থাকার প্রমাণ হিসেবে হাজির করা হয় বিনিয়োগকারীদের সামনে। বিষয়টি আরো বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্রোকারেজ হাউসের কর্মকর্তাদের প্রত্যয়নপত্রও দেখানো হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিজেরাই ভুয়া পোর্টফোলিও তৈরি করে তাতে ব্রোকারেজ হাউস সংশ্লিষ্টদের স্বাক্ষর বসিয়ে দেওয়া বা একই পোর্টফোলিও স্টেটমেন্ট দেখিয়ে একই শেয়ার একাধিক ক্রেতার কাছে বিক্রির অভিযোগও রয়েছে। কখনোই আইপিও বা প্লেসমেন্টের মাধ্যমে কোনো শেয়ার ইস্যু করেনি_এমন কম্পানির শেয়ারও রয়েছে গ্রীন বাংলার পোর্টফোলিওতে।
নথিপত্রে দেখা যায়, গ্রীন বাংলা গ্রুপের নামে আইআইডিএফসি মার্চেন্ট ব্যাংকিং ইউনিটের একটি সিডিআই হিসাবের পোর্টফোলিওতে (হিসাব নম্বর ০৩১৩) ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের ৩০ লাখ এবং বাংলালিংকের ৫০ লাখ শেয়ার দেখানো হয়েছে। পোর্টফোলিওতে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গ্রীন বাংলা গ্রুপ ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের প্রতিটি শেয়ার ১০০ টাকা দরে মোট ৩০ কোটি টাকায় এবং বাংলালিংকের প্রতিটি শেয়ার ১০ টাকা দরে পাঁচ কোটি টাকায় কিনেছে। একই হিসাবে গ্রামীণফোনের ৫০ লাখ, গোল্ডেনসনের ১০ লাখ, ক্রাউন সিমেন্টের ১০ লাখ এবং আরএকে সিরামিকের ৭০ লাখ শেয়ার দেখানো হয়েছে। অথচ ইনসেপ্টা ফার্মা ও বাংলালিংক এখনো কোনো প্লেসমেন্ট শেয়ার ইস্যুই করেনি।
পোর্টফোলিওটির সত্যতা জানতে আইআইডিএফসিতে যোগাযোগ করা হলে গ্রীন বাংলা গ্রুপের প্রতারণার বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ওই পোর্টফোলিও স্টেটমেন্টে প্রত্যয়নকারী হিসেবে আইআইডিএফসির উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) রাসেল আহমেদের নাম ও স্বাক্ষর রয়েছে। কিন্তু ওই প্রতিষ্ঠানে এই নামে কোনো ডিএমডি নেই এবং কোনোকালে ছিলও না। রাসেল শাহরিয়ার নামে একজন সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট রয়েছেন। তিনি প্রতিষ্ঠানের এসএমই ফাইন্যান্স বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
রাসেল শাহরিয়ারের কাছে গ্রীন বাংলার ওই পোর্টফোলিও বিবরণী দেখানো হলে তিনি কালের কণ্ঠকে জানান, প্রদর্শিত স্বাক্ষরটি তাঁর নয়। রাসেল আহমেদ নামের কোনো কর্মকর্তা আইআইডিএফসিতে নেই। প্রকৃতপক্ষে আইআইডিএফসিতে ওই প্রতিষ্ঠানের নামে কোনো হিসাব চালু নেই। তা ছাড়া 'সিডিআই' কোডের কোনো হিসাব তাঁদের প্রতিষ্ঠানের নয়।

আবাসন শিল্প: ক্রেতা-বিক্রেতাকে কাঁদাবে সরকার!

Saturday, June 18, 2011

মানুষের পাঁচটি মৌলিক চাহিদার মধ্যে তৃতীয়টি হলো বাসস্থান। আধুনিক ও সভ্য মানুষের জন্য উন্নত আবাসন ব্যবস্থা জরুরি। এ জন্য পরিকল্পিত আবাসন ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই। দেশ ও মানুষের উন্নয়ন আর পরিকল্পিত আবাসন একসূত্রে গাঁথা। এই জরুরি কাজটি করার মূল দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এ দেশের কোনো সরকারই সে দায়িত্ব পালন করেনি। বরং এই গুরুদায়িত্ব যখন কাঁধে তুলে নিয়েছেন বেসরকারি আবাসন ব্যবসায়ীরা, তখনো বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে সরকার। নিরুপায় মানুষ মাথা গোঁজার একটু আশ্রয়ের জন্য শরণাপন্ন হয়েছে বেসরকারি আবাসন ব্যবসায়ীদের কাছে। সব সঞ্চয় দিয়ে তারা ক্রয় করছে এক টুকরো স্বপ্নের জমি; কিন্তু সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আইনের প্যাঁচে পড়ে তারা আজ অসহায়। অসহায় সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরাও। উভয় পক্ষের আজ চোখের পানিতে ভাসার দশা।

গতবারের আবাসন মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, মানুষের চোখের পানি ফেলতে হয় এমন কিছু করবেন না। কিন্তু বাস্তবে হচ্ছে কী? আবাসন ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তহীনতার কারণে মানুষের চোখের পানি ফেলতে হয়, এমন কিছুই হচ্ছে। ক্রেতা ও বিক্রেতাদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা বেসরকারি আবাসন খাতে ৭০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। লাখ লাখ মানুষ প্লট বা ফ্ল্যাট কেনার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। কিন্তু এ খাত এখন হুমকির মধ্যে পড়েছে।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সিদ্ধান্তের অভাবেই মূলত আবাসিক খাতের বিভিন্ন প্রকল্প দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে আছে। প্রকল্পগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হচ্ছে না। আবার রাজউক সুনির্দিষ্টভাবে কিছু না বলায় এগুলো বাতিলও করা হচ্ছে না। এ অবস্থায় সম্প্রতি হাইকোর্টের একটি সিদ্ধান্তে বিনিয়োগকারীরা আরো ভেঙে পড়েছেন। আবাসন শিল্পের এ সংকট কাটাতে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া না হলে অল্প সময়ের মধ্যে অন্তত ১৫ লাখ শ্রমিকসহ এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত প্রায় ২৫ লাখ লোক বেকার হয়ে পড়বে। পাশাপাশি আবাসন ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত ২৬৯টি উপখাতে বিনিয়োগ করা অর্থ জলে যাবে এবং এর সঙ্গে জড়িত সারা দেশের অন্তত তিন কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দেশের অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
আবাসন খাতের এ সংকটের জন্য রাজউক ও সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকেই দায়ী করছেন এ খাতের ক্রেতা-বিক্রেতারা। ক্রেতাদের ভাষ্য, 'সরকারি লোকজনের চোখের সামনে আবাসন ব্যবসায়ীরা
প্লট ও ফ্ল্যাটের বিজ্ঞাপন প্রচার করছে। সরকারি ও বেসরকারি গণমাধ্যমে সেই বিজ্ঞাপন প্রচারিতও হয়েছে। আমরা বিজ্ঞাপন দেখে প্লট বা ফ্ল্যাট কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বিজ্ঞাপন প্রচারের সময় সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা জনগণকে যদি সাবধান করত তবে আমরা অননুমোদিত প্রকল্প থেকে প্লট বা ফ্ল্যাট কিনতাম না। এখন মাথা গোঁজার জন্য এক টুকরো জমি কেনার পর বলা হচ্ছে এটা অননুমোদিত প্রকল্প। আমরা এখন কোথায় যাব, কার কাছে যাব? অনেক ব্যবসায়ী আছেন যাঁরা প্লট বা ফ্ল্যাট বিক্রি করার পর তা রেজিস্ট্রি করে দিয়ে অন্য ব্যবসায় চলে গেছেন, তাঁদের কোথায় খুঁজে পাওয়া যাবে?'
আর বিক্রেতাদের বক্তব্য, 'আমরা ভূমি উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার কাছে প্রকল্প অনুমোদনের জন্য আবেদন করেছি। এর মধ্যে তারা কিছু প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে, আবার বেশির ভাগ প্রকল্পই অনুমোদন না দিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছে। ঝুলিয়ে রাখা প্রকল্পের বিষয়ে তারা কোনো সিদ্ধান্তও দিচ্ছে না। আমরা ধরেই নিয়েছি, যেহেতু কিছু প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, বাকিগুলোর অনুমোদনও দেওয়া হবে।'
এ অবস্থায় বিক্রেতা হিসেবে আবাসন ব্যবসায়ীরা ও ক্রেতারা সম্মিলিতভাবে বিপর্যয়ের জন্য সরকারকেই দায়ী করছেন। তাঁদের মতে, বিধিমালা চূড়ান্ত করাসহ এ-সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয়ে রাজউকের সিদ্ধান্ত গ্রহণে ধীরগতির জন্যই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সর্বশেষ একটি বেসরকারি সংগঠনের জনস্বার্থে দায়ের করা একটি রিটের আদেশ যেন বিনিয়োগকারীদের মরার ওপর খাঁড়ার ঘা। এর দায় সরকারকেই বহন করতে হবে। তাঁরা বলেন, শেয়ার কেলেঙ্কারির ফলে বিনিয়োগকারীদের যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, আবাসন খাতের বিপর্যয় তার চেয়ে অনেক বড় ঘটনা হিসেবে দেখা দেবে।
প্রকল্প অনুমোদন না দেওয়া : রাজউকের হিসাব অনুযায়ী গত কয়েক বছরে আবাসিক উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় দুই শতাধিক উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে রাজউক মাত্র ২৬টি প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে। বাকি ১৭৪টি প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। এগুলোর অনুমোদনও দেওয়া হচ্ছে না, আবার অনুমোদন দেওয়া হবে না_এটাও স্পষ্ট করে বলা হচ্ছে না। এ কারণে এসব প্রকল্পের সংশ্লিষ্টরা কোনো বাস্তব সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।
রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সভাপতি ও বিশিষ্ট আবাসন ব্যবসায়ী নসরুল হামিদ বিপু কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা আবাসন খাতের বর্তমান অবস্থা নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন। আমরা বারবার সংসদীয় কমিটি ও মন্ত্রীকে বলেছি, যেসব প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে, সেগুলোর অনুমোদন দিয়ে দেওয়া হোক। আমারও একটি প্রকল্প আছে, যেটা বন্যাপ্রবণ এলাকা নয়, তার পরও অনুমতি পাচ্ছি না। এখন সরকার বলছে, তারা এগুলো রিভিউ করবে। কিন্তু রিভিউ করতে করতে তো এ ব্যবসার বারোটা বেজে গেছে। এ খাতে মানুষের হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ। সাধারণ মানুষ সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে একটি প্লট কিনেছে। কিন্তু সেখানে তারা কোনো বাড়ি বানাতে পারছে না। তারাও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। এভাবে চলতে থাকলে অর্থনীতিতেও এর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।'
রাজউক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী নুরুল হুদা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বিধিবিধান মেনে যেগুলোর আবেদন জমা পড়েছে, সেগুলোর অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আর কাগজপত্র ঠিক থাকলে সেটা আমরা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেই। অনুমোদনের জন্য একটি আন্তমন্ত্রণালয় কমিটি আছে। কমিটি সেটা দিয়ে থাকে। আবেদনকারীরা ৯০ শতাংশ শর্ত পূরণ করলেও আমরা সেগুলোকে পাসের ব্যাপারে সুপারিশ করি। আর যারা শর্ত অনুসরণ না করে অনুমোদনহীন প্রকল্পের প্লট বিক্রি করছে, তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নিতে যাচ্ছি আমরা। সাধারণ লোকজন যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে জন্য আমরা ওয়েবসাইটে অনুমোদিত প্রকল্পের নামগুলো উল্লেখ করে দিয়েছি। এমনকি রাজউকে এসেও তারা জেনে যেতে পারে, কোনটা অনুমোদিত আর কোনটা অননুমোদিত। কিন্তু লোকজন সেটা না দেখে কিনে ফেলছে। কেউ জেনেশুনে জ্বলন্ত আগুনে ঝাঁপ দিলে সেই দায় তো সরকার বা রাজউক নেবে না।'
বিধিমালা নেই : বেসরকারি আবাসিক প্রকল্পের ভূমি উন্নয়ন বিধিমালা ২০০৪ প্রণয়ন করে বিগত বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার। ওই বিধিমালা ছিল ত্রুটিপূর্ণ। ব্যবসায়ীসহ সব মহলে এ বিধিমালা সমালোচিত হয়। স্ববিরোধী বিধি থাকায় এটি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বর্তমান সরকারও বিপাকে পড়ে। ফলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, বিধিমালা যুগোপযোগী করার। এর অংশ হিসেবে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি বিধিমালাটি সময়োপযোগী করার জন্য একাধিক বৈঠক করে নতুন নতুন প্রস্তাবও দেয়। কিন্ত অদৃশ্য কারণে সেই প্রস্তাব সংযোজন করে এখন পর্যন্ত বিধিমালাটি চূড়ান্ত করা হচ্ছে না। এর পেছনেও আবাসন খাতকে ধ্বংস করতে একটি অদৃশ্য শক্তি কাজ করছে বলে ব্যবসায়ীরা আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
ওই বিধিমালা চূড়ান্ত না করে আবাসন প্রকল্পগুলো অনুমোদন দিতে গড়িমসি করছে রাজউক। অন্যদিকে সরকার নিজেই একের পর এক প্রকল্প হাতে নিচ্ছে প্লট বরাদ্দ দেওয়ার জন্য। ওই সব প্লটে লটারির মাধ্যমে খুব সামান্য সংখ্যক লোকই প্লট পেয়ে থাকে। বঞ্চিতের সংখ্যা হাজার হাজার। প্লট না পেয়ে টাকা ফেরত নিতেও তাদের ভুগতে হয়। যারা বরাদ্দ পায়, তাদেরও সময়মতো প্লট বুঝিয়ে দেওয়া হয় না। প্লট বরাদ্দ যারা পেয়েছে, তাদের অনেকের সঙ্গেই কথা বলে জানা গেছে, ১০ বছরের আগে রাজউক কোনো প্লট হস্তান্তর করতে পারে না।
এক দেশে দুই নীতি : সরকার ঘোষণা দিয়েছে, জলাশয় ভরাট করা যাবে না, কৃষিজমি অপরিবর্তিত রাখতে হবে ইত্যাদি। অথচ বেসরকারি আবাসন ব্যবসায়ীদের বেশির ভাগ সরকারের নির্দেশ মেনে চলেছেন। কিন্ত সরকারি সংস্থা রাজউক এ নির্দেশ মানছে না। তারা জলাশয় ভরাট করে প্লট বরাদ্দ দিয়ে যাচ্ছে। নতুন করে প্লট বরাদ্দ দেওয়ার জন্য সাধারণ মানুষের কৃষিজমি অধিগ্রহণ করে চলেছে একের পর এক। জনগণের সেবা দেওয়ার জন্যই সরকারের প্রশাসন যন্ত্র গড়ে ওঠে। কিন্তু এখানে সেই যন্ত্রকে ব্যবসার কাজে ব্যবহার করছে সরকার। সরকার নিজের ব্যবসায়িক স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য বেসরকারি আবাসন খাতের ব্যবসায়ীদের প্রতি নানাভাবে অবিচার করে চলেছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান প্লট ও ফ্ল্যাটের ব্যবসা করলেও তা দক্ষতার অভাবে খুব বেশি লোককে সুযোগ-সুবিধা দিতে পারে না।
সরকারি প্লট জনগণের চাহিদা মেটাতে না পারায়, প্লট বরাদ্দ পেয়ে বা না পেয়ে বিভিন্ন হয়রানির কথা শুনে আবাসনের প্রয়োজন মেটাতে মানুষ ঝুঁকছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্লট বা ফ্ল্যাট কেনার জন্য। কিন্তু এ খাতের বিরুদ্ধে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র অব্যাহত থাকায় প্লট কেনায় আগ্রহীরাও হতাশ হয়ে পড়েছে। আবার ঢাকা ও এর আশপাশের আবাসন প্রকল্পে যারা বিনিয়োগ করেছে, তারাও ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে হাতাশ হয়ে পড়েছে। অথচ প্রকল্পগুলো অনুমোদন দেওয়া হলে সংশ্লিষ্ট সবার আশঙ্কা দূর হতো বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মত।
হাইকোর্টের রায় : রাজউকের অননুমোদিত আবাসিক প্রকল্পগুলোর বিজ্ঞাপন ও সাইনবোর্ড ৩০ দিনের মধ্যে সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে এসব প্রকল্পের মাটি ভরাটের কাজ বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
গত ৭ জুন বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট এ নির্দেশ দেন।
আদালতের আদেশপ্রাপ্তির ৩০ দিনের মধ্যে রাজউককে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। রাজউকের অনুমোদনহীন আবাসন প্রকল্পগুলোর বিজ্ঞাপন প্রচার ও মাটি ভরাটসহ তাদের কার্যক্রমের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে জনস্বার্থে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) রিট আবেদনটি করেছিল। জানা গেছে, ৭০টি প্রকল্পের কার্যক্রম চ্যালেঞ্জ করে রিটটি দায়ের করে বেলা।
হাইকোর্টের এ রায়ের ফলে আবাসন প্রকল্পগুলোতে আরো স্থবিরতা চলে আসছে। আবাসন ব্যবসায়ীরা বলছেন, রাজউকে প্রকল্প অনুমোদনের জন্য আবেদন করা হয়েছে। আবেদনের নিষ্পত্তি হয় না। তা ছাড়া রাজউক থেকে জানানোও হয়নি যে, এগুলোর অনুমোদন দেওয়া হবে না। বিভিন্ন আবাসন মেলা হচ্ছে। সরকারের অনুমোদন নিয়েই ওই মেলার আয়োজন করা হচ্ছে। সেখানে প্লট বিক্রি হচ্ছে। লোকজন কিনছে। কোনো বাধা আসেনি।
রাজউক একের পর এক জলাশয় ভরাট করে আবাসন প্রকল্প করে তা বিক্রি করছে। এতে পরিবেশ নষ্ট হয় না। অথচ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মাটি ভরাট করলেই পরিবেশ নষ্ট হয়। এটা আবাসন খাতকে ধ্বংস করারই চক্রান্ত বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা।
ড্যাপ বাস্তবায়ন : গত বছর এ খাতের স্থবিরতার সঙ্গে নতুন মাত্রা যোগ করেছে ড্যাপ। অপরিকল্পিতভাবে তড়িঘড়ি করে ড্যাপের গেজেট প্রকাশ করায় আবাসন খাতের ক্রেতা ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে নতুন করে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। আবাসন ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ড্যাপ কিভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, সে বিষয়ে জনগণ ও আবাসন ব্যবসায়ীরা কিছুই অনুমান করতে পারছে না। ড্যাপে ঢাকা ও আশপাশের বিশাল এলাকাকে বন্যাপ্রবণ এলাকা হিসেবে দেখানো হয়েছে। ড্যাপ নিয়ে একাধিক নকশা প্রকাশ করেছে রাজউক। নকশায় অন্তর্ভুক্ত জমিতে বহুতল ভবন বা আবাসিক এলাকা করার বিপক্ষে মত দেওয়া হয়েছে। অথচ এ ধরনের অনেক এলাকায় সাধারণ মানুষ সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে এক টুকরো জমি কিনেছে। আবার এমনও আছে, এসব জমিতে বংশপরম্পরায় বসবাস করছে অনেকে। পারিবারিক কারণেই তাদের বসতবাড়ি বড় করতে হয়। সরকার কোনো দিক বিবেচনা না করে হঠাৎ ওই সব এলাকাকে ড্যাপের আওতাভুক্ত করে গেজেট প্রকাশ করেছে। এসব কারণে আগ্রহী সাধারণ মানুষ জমি কেনার বিষয়ে এগিয়ে আসতে ভয় পাচ্ছে। একইভাবে ব্যবসায়ীরা এ খাতে নতুন করে বিনিয়োগও করতে পারছেন না।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ব্যবসায়ীরা স্থানীয় জনগণের কাছ থেকে জমি কিনে প্রকল্প করে রাস্তা, খেলার মাঠ, মসজিদ বানিয়ে খোলা জায়গা রেখে অবশিষ্ট জমি আবাসিক এলাকা হিসেবে উন্নয়ন করেছেন, রাজউক সেই জমিকে ড্যাপের আওতাভুক্ত করে নিয়েছে। ফলে শহরমুখী মানুষ ওই এলাকার জমি আর কিনতে চাইছে না। এতে ব্যবসায়ীদের কোটি কোটি টাকা আটকে গেছে। বিনিয়োগ করা অর্থ তুলে আনার বিষয়েও সৃষ্টি হয়েছে অনিশ্চয়তা। যারা প্লট কিনেছে, তাদের ক্ষুদ্র বিনিয়োগ নিয়েও আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে প্রবাসীদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রার ১৩ শতাংশ এ খাতে বিনিয়োগ করা হয়েছে। ফলে তাদের মধ্যেও আতঙ্ক কাজ করছে।
যদিও এসব বিবেচনা করে সরকার পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য ড্যাপ পর্যালোচনার লক্ষ্যে মন্ত্রিসভা কমিটি গঠন করে দিয়েছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। জনকল্যাণের বিপক্ষে এমন একটি পরিকল্পনাও বেসরকারি আবাসন খাতকে পিছিয়ে দিচ্ছে।

শেয়ার বাজারের লুটপাট কাহিনী by আবুল খায়ের

Monday, February 7, 2011

শেয়ার বাজার দরপতনের নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার নেপথ্যে নায়করা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রয়ে যাচ্ছে। তাদের স্পর্শ করার ক্ষমতা কারো নেই। নির্মম, নির্দয়ভাবে প্রায় ৪০ লাখ বিনিয়োগকারীদের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছেন তারা।

৪০ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী ও তার পরিবারসহ প্রায় ২ কোটি মানুষ নিদারুণ আর্থিক কষ্টের শিকার। এই নির্দয় লুণ্ঠনকারীদের আলস্নাহ বিচার করবেন। গতকাল রবিবার নবমবারের মত শেয়ার বাজারে দরপতনে নিঃস্ব হওয়া ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের বেশ কয়েকজন কান্নাজড়িত কণ্ঠে এই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। অপরদিকে বিভিন্ন সংস্থা শেয়ার বাজারে দরপতনের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎকারীদের সনাক্ত এবং কিভাবে আত্মসাৎ করেছে তার বিস্তারিত তথ্য উলেস্নখ করে ইতিমধ্যে সরকারের শীর্ষ প্রশাসন ও কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন দাখিল করেছে। তারপরও শেয়ার বাজারে দরপতনের নামে কোটি কোটি টাকা লুটপাট বন্ধ হয়নি। সর্বশেষ গতকাল শেয়ার বাজারে দরপতন হয়েছে। পাশাপাশি বিক্ষোভ ও ভাংচুরের ঘটনা ঘটে। একটি নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় শেয়ার বাজারে কোটি কোটি টাকা লুণ্ঠনকারী কিছুসংখ্যক অর্থলোভীকে নিয়ন্ত্রণ করা কিংবা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাচ্ছে না। এই নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা ও সমালোচনা চলছে। তাদের এত ক্ষমতার উৎস কি? অনুসন্ধান ও বিভিন্ন সংস্থা এবং বিনিয়োগকারীসহ ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, শেয়ার বাজারে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎকারীরা ক্ষমতাধর দুইটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সঙ্গে সরাসরি জড়িত এবং কেউ কেউ দলীয় নেতা। রাজনীতি নিয়ে উভয়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে রাজপথে ও জনগণের সামনে কথা বলছে। দৃশ্যপট এমন যে, উভয়ের মধ্যে দা-কুমড়া সম্পর্ক। আসলে তা নয়, একশ্রেণীর নেতা উভয় দলের মধ্যে কোটি কোটি টাকা ভাগাভাগিতে একে অপরের জানিদোস্ত। কি মজার ব্যাপার শেয়ার বাজারের কোটি কোটি টাকা কেলেংকারির জন্য উভয় দল থেকে একে অপরকে দায়ী করে এবং সরকারের চরম ব্যর্থতার কথা উলেস্নখ করা হয়।

অনুসন্ধানে জানা যায়, চারদলীয় জোট সরকারের আমলের এক ক্ষমতাধর মন্ত্রীর পুত্র, অসীম ক্ষমতাধর দুই এমপি ও তিন ব্যবসায়ী এবং বর্তমান আওয়ামী লীগসহ মহাজোট সরকারের দুই এমপি, দুই ক্ষমতাবান শিল্পপতি ব্যবসায়ীসহ উভয় দলের ১১ জন প্রত্যক্ষভাবে শেয়ার কেলেংকারিতে জড়িত। এছাড়া তাদের সঙ্গে আরো কয়েকজন জড়িত বলে জানা গেছে। গত ৮ ডিসেম্বর থেকে গতকাল পর্যন্ত নবম দফা শেয়ার বাজারের দরপতন ঘটিয়ে কোটি কোটি টাকা তারা হাতিয়ে নিয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, শেয়ার বাজার থেকে ৪৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়। একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা শেয়ার বাজারে বার বার দরপতন ঘটিয়ে কোটি কোটি টাকার কেলেংকারি ঘটনার দীর্ঘ তদন্ত করেছে। তদন্ত করে উভয় দলের ১১ জন রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী শেয়ার বাজার কেলেংকারির সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে। বিষয়টি সরকারের শীর্ষ প্রশাসনকে অভিহিত করেছে।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, শেয়ার বাজারে কোটি কোটি টাকা লুটপাটে সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের কতিপয় কর্তা জড়িত। বাংলাদেশ ব্যাংক শেয়ার বাজার নিয়ন্ত্রণে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। বিধি অনুযায়ী বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ তাদের মূলধনের ১০% এর বেশি শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করতে পারে না। কিন্তু অধিকাংশ বাণিজ্যিক ব্যাংক নীতিমালা লংঘন করে তাদের মূলধনের অধিকাংশই শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করার ফলে শেয়ারের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক এ নীতিমালা অনুসরণের জন্য আদেশ দেয়ায় এবং তদারকি করায় ব্যাংকসমূহ তাদের বিনিয়োগ প্রত্যাহার করায় শেয়ার বাজারে দরপতনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশ ব্যাংক ১০ ডিসেম্বর বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের অতিরিক্ত বিনিয়োগের দুই হাজার কোটি টাকা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এতে শেয়ার বাজারে দরপতন ঘটে যায় বলে সংস্থার তদন্তে উলেস্নখ করা হয়।

১৯৯৬ সালে উক্ত জড়িত ব্যবসায়ী ও নেতারা কৌশলে শেয়ার বাজারে বড় ধরনের পতন ঘটিয়ে কোটি কোটি টাকা লুটপাট করে নিয়ে যায়। সেই উভয় দলের নেতারা এবার শেয়ার বাজারে একই কেলেংকারি ঘটিয়েছেন। এছাড়া ১৯৯৬ সালে সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন শেয়ার বাজারে দরপতনের সঙ্গে ১৫টি কোম্পানি জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়ে মামলা দায়ের করে। সেই মামলা এখন হিমাগারে। এসব লুণ্ঠনকারী কোম্পানি শেয়ার বাজারে এখন তৎপর রয়েছে বলেও তদন্ত প্রতিবেদনে উলেস্নখ করা হয়।

ইউনিপের থাবা এখন ঢাকায়

Tuesday, January 25, 2011

ন্দেহভাজন মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কম্পানি 'ইউনিপে টু ইউ বাংলাদেশ লিমিটেড' চট্টগ্রাম ও সিলেটের পর এখন ঢাকায়ও ব্যবসা ফেঁদে বসেছে।

'ইউনিপে-তে টাকা রাখুন, ১০ মাসে দ্বিগুণ লাভ করুন/স্বাবলম্বী হোন/দারিদ্র্য বিমোচন করুন'-এমনই চটকদার স্লোগানে গ্রাহক আকৃষ্ট করে তারা ধানমণ্ডিতে নতুন শাখা অফিস খুলেছে। অথচ এ ধরনের কম্পানির গ্রাহক প্রতারণা সম্পর্কে সতর্ক থাকার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক কিছুদিন আগে গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। সরকারি তথ্য বিবরণীতেও এমএলএমের গ্রাহক প্রতারণা থেকে সতর্ক থাকার অনুরোধ জানানো হয়েছে। ইউনিপে টু ইউ কর্তৃপক্ষের দাবি, এ ব্যবসায় বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন রয়েছে। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, প্রতিষ্ঠানটির কোনো বৈধ অনুমোদনই নেই। বরং বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুরোধে প্রতিষ্ঠানটির সন্দেহজনক কার্যক্রম দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) খতিয়ে দেখছে। ইউনিপেও এ ধরনের প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে ব্যবসা ফেঁদে বসেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। গত রবিবার হাইকোর্টে ইউনিপের কার্যক্রম চ্যালেঞ্জ করে রিট আবেদন দায়ের হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এরই মধ্যে ইউনিপে টু ইউ সারা দেশ থেকে অন্তত ছয় লাখ গ্রাহক সংগ্রহ করেছে। কম্পানিটির ব্যবসায় খাটছে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। ঢাকার ধানমণ্ডির পুরনো ২৭ নম্বর সড়কে তারা একটি চকচকে ছয় তলা অফিস ভবনও ভাড়া করেছে। সেখানে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে থেকে আসা তরুণ গ্রাহকদের ভিড় লেগেই আছে। ইউনিপের কর্মকর্তারা জানান, প্রতিজন গ্রাহককে তাঁরা অনলাইনে একটি আইডেন্টিফিকেশন নম্বর ও পাসওয়ার্ড দেন। এরপর তাঁদের নগদ লেনদেনের পুরোটিই হয় অনলাইনে। তাঁদের দাবি, এটি সম্পূর্ণ নিরাপদ ও বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদিত। একজন গ্রাহক মাত্র চার হাজার ২০০ টাকা থেকে শুরু করে আট হাজার ৪০০ টাকা দিয়ে অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন। এর ওপরে তাঁরা নির্দিষ্ট হারে লভ্যাংশ দিয়ে থাকেন। দুই লাখ ১২ হাজার টাকা বিনিয়োগ করলে গ্রাহকরা ১২ শতাংশ লভ্যাংশ পাবেন। এ বছর ফেব্রুয়ারি থেকে এ লভ্যাংশের হার ২০ শতাংশ হতে যাচ্ছে। এভাবে ১০ মাসে তাঁরা দ্বিগুণ পর্যন্ত লভ্যাংশ দিয়ে থাকেন। তবে লভ্যাংশের এই বিপুল পরিমাণ অর্থ কোথা থেকে আসছে, কর্মকর্তারা তা বলতে নারাজ।
ফরিদপুর জেলার বাসিন্দা আনিসুজ্জামান নামের একজন গ্রাহক অভিযোগ করে কালের কণ্ঠকে জানান, তিনি নিজে বিনিয়োগের পাশাপাশি পরিচিত অনেককে দিয়ে ইউনিপে-তে বিনিয়োগ করিয়েছেন। এখন ইউনিপে সম্পর্কে নানা খবর প্রকাশ হওয়ার পর বিনিয়োগকারীদের অনেকেই তাঁদের অর্থ ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি করছেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ১০ মাস শেষ হওয়ার আগে কোনোভাবেই বিনিয়োগের টাকা ফেরত পাওয়া যাবে না। অথচ এ নিয়ম কোথাও লিখিত আকারে নেই।
ইউনিপে টু ইউ বাংলাদেশ লিমিটেডের চেয়ারম্যান শহিদুজ্জামান শাহীন। ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুনতাসির মামুনও ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত। তবে তাঁরা কেউই গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে রাজি নন।
তবে নিজেকে ইউনিপের মুখপাত্র দাবি করে এ প্রতিষ্ঠানের আইন কর্মকর্তা অ্যাডভোকেট মোহাম্মাদ সারোয়ার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এটি সারা বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত এমএলএম ব্যবসা। সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, নেপালসহ বিভিন্ন দেশে ইউনিপে টু ইউ সাফল্যের সঙ্গে ব্যবসা করছে। ই-কমার্স মেথডে ইউনিপে টাকা ১০ মাসে দ্বিগুণ করে যে লাভ দিচ্ছে, তা মোটেই আজগুবি নয়। সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে অর্থ খাটিয়ে কম্পানিটি এ মুনাফা দিতে পারছে। এ নিয়ে গ্রাহকদের কোনো অভিযোগ নেই।’
চট্টগ্রাম ও সিলেটে গ্রাহক প্রতারণার অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে মোহাম্মদ সারোয়ার বলেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে কোথাও কোনো প্রতারণার অভিযোগ নেই। আমাদের সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে একটি মহল বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। আমরা গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আমাদের বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করার আহ্বান জানিয়েছি। প্রয়োজনে সরকার আমাদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করুক।’
অ্যাডভোকেট সারোয়ার আরো বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক ও ব্র্যাক ব্যাংকের সঙ্গে আমাদের লেনদেন আছে। আমরা সরকার অনুমোদিত বলেই বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন করতে পারছি। আমাদের বিরুদ্ধে সরকারেরও কোনো অভিযোগ নেই।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গ্রাহকদের বিনিয়োগের অর্থ কোনোভাবেই বিদেশে যাচ্ছে না, বরং মালয়েশিয়ার সঙ্গে নেট সার্ভার ব্যবহার করার কারণে বিদেশ থেকে এ দেশে টাকা আসছে।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের উপমহাব্যবস্থাপক দেবপ্রসাদ দেবনাথ কালের কণ্ঠকে বলেন, ইউনিপের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের লেনদেনের প্রশ্নই আসে না। বরং মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কম্পানিগুলোর এ ধরনের গ্রাহক প্রতারণা সম্পর্কে সতর্ক থাকার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক কিছুদিন আগে গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। সরকারি তথ্যবিবরণীও এমএলএমের গ্রাহক প্রতারণা থেকে সতর্ক থাকার অনুরোধ জানিয়ে সম্প্রতি বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। এ ছাড়া রাতারাতি অর্থশালী করে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে চট্টগ্রাম ও সিলেটে ইউনিপে টু ইউয়ের বিরুদ্ধে গ্রাহক প্রতারণার অভিযোগ ওঠায় সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শে দুর্নীতি দমন কমিশন তাদের কার্যক্রম খতিয়ে দেখছে।
দেবপ্রসাদ জানান, এমএলএম কম্পানিগুলো বিশ্বের নানা দেশে আইনের ফাঁক গলে চটকদার বিজ্ঞাপনের আড়ালে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। কানাডায়ও এ ধরনের একটি প্রতিষ্ঠান প্রতারণার ব্যবসা খুলে বসলে সে দেশের সরকার তাদের আইন আরো কঠোর করেছে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের মহাপরিচালক কর্নেল হানিফ ইকবাল কালের কণ্ঠকে জানান, কমিশন যাতে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে, সে জন্য আইনজীবীরা সংশ্লিষ্ট আইনি দিকগুলো খতিয়ে দেখছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ম. মাহফুজুর রহমান এর আগে সাংবাদিকদের জানান, ইউনিপে টু ইউ নামের প্রতিষ্ঠানটি রাতারাতি ভাগ্য পরিবর্তনের প্রচারণা চালিয়ে অর্থ সংগ্রহ করে প্রতারণা করছে। এসব প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সাধারণ মানুষের অর্থ নিয়ে একাধিক ব্যাংকে রাখা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, টাকা নিয়ে বিদেশে গ্রাহকদের নামে স্বর্ণ কিনে ভল্টে রাখা হচ্ছে। যাদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হচ্ছে, তাদের ২০ শতাংশ হারে সুদ দেওয়া হবে বলেও জানানো হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে প্রতিষ্ঠানটি টাকা নিয়ে লুটে খাচ্ছে, কোথাও কোনো স্বর্ণ ক্রয় করছে না, যা বাংলাদেশ ব্যাংক চিহ্নিত করেছে। তিনি আরো বলেন, জানা গেছে, এরই মধ্যে প্রায় ১০০ কোটি টাকা ব্যাংক থেকে ওঠানো হয়েছে। কিন্তু ওই টাকা কোথায় রাখা হয়েছে, কী করা হয়েছে, ইউনিপে টু ইউয়ের কাছ থেকে এর কোনো হদিস পাওয়া যায়নি।
এদিকে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত শেয়ারবাজারের ভয়াবহ পতনের জন্য অন্যান্য কারণের পাশাপাশি ইউনিপে টু ইউয়ের গ্রাহক প্রতারণাকেও দায়ী করেছেন। গত ৯ জানুয়ারি সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘আমরা শেয়ারবাজারের কারসাজির সঙ্গে দায়ী কাউকে ছেড়ে দেব না। ইউনিপে টু ইউ এক সপ্তাহে দ্বিগুণ লাভ দেওয়ার লোভ দেখিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে যাচ্ছে। আমরা তাদেরও ধরব।’
ইউনিপের বিরুদ্ধে হাইকোর্টের রুল
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম জানায়, ‘স্বর্ণ কেনার নামে বিনিয়োগ পুঁজি সংগ্রহ কেন বন্ধ করা হবে না’ মর্মে ইউনিপে টুইউ এবং সরকারের চার প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। অন্যরা হচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ও রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কম্পানিজ।
চট্টগ্রাম উত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার মোহাম্মদ আইয়ুব ও মুক্তিযোদ্ধা গোরী শংকরের জনস্বার্থে দায়ের করা রিট পিটিশনের (পিটিশন নম্বর ৭৮৩ তারিখ ২৩-০১-১১) পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ এ রুল জারি করেন।
গত রবিবার বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি শেখ মোহাম্মদ জাকির হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ রিটের শুনানি শেষে এই আদেশ দেন।
এ ছাড়া আদালত আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে কেন স্বর্ণ কেনার নামে অর্থ আদায় কার্যক্রম বন্ধ করা হবে না মর্মেও কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন। বেঞ্চ একই সঙ্গে ইউনিপের সব ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করার জন্য সংশ্লিষ্ট আইনজীবীকে আবেদন জানানোর জন্যও পরামর্শ দেন।
রিটকারীদের পক্ষে মামলাটি পরিচালনা করেন অ্যাডভোকেট বেলাল হোসেন জয়, অ্যাডভোকেট জসিম উদ্দিন ও অ্যাডভোকেট কে এম জাবির।

রপ্তানি বাণিজ্যে সুবাতাস

Sunday, January 23, 2011

বাংলাদেশ মানেই নেতিবাচক সংবাদ নয়। বাংলাদেশ এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে। নিশ্চয়ই এখন তেমন ভাবনা বদলে যেতে শুরু করবে। কারণ দেশের অর্থনীতিতে সুবাতাস লাগতে শুরু করেছে। রপ্তানি বাণিজ্যে বাংলাদেশের অর্জন সেই অনুভূতির মূল কারণ।
বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের ইতিবাচক বাণিজ্য দৃশ্যমান। চলতি পঞ্জিকাবর্ষের জানুয়ারি-অক্টোবর সময়ে বাংলাদেশ যে পরিমাণ মার্কিন দ্রব্য আমদানি করেছে তার চেয়ে অনেক বেশি রপ্তানি করেছে সে দেশে। এর তুলনামূলক বিশ্লেষণ করতে গেলে দেখা যাবে, আগের বছর একই সময় বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়েছে ৩১৮ কোটি ৮৬ লাখ মার্কিন ডলারের পণ্য। আর এবার তা বেড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে_৩৫১ কোটি ৮১ লাখ ডলারে। তবে এই অর্জনের পেছনে তৈরি পোশাক শিল্পের অবদানই বেশি। তাই বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের বড় খাত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত তৈরি পোশাক শিল্পের পাশাপাশি অন্যান্য দ্রব্যও যদি সেখানে রপ্তানি করা যেত তাহলে এই প্রবৃদ্ধি অনেক বেড়ে যেত। কিন্তু বাংলাদেশের পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের সময় যেভাবে উচ্চহারে শুল্ক পরিশোধ করতে হয় তাও বাংলাদেশের বাণিজ্য কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় পেঁৗছাতে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ডেমোক্রেটিক লিডারশিপ কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৫ দশমিক ৩০ শতাংশ পর্যন্ত আমদানি শুল্ক আদায় করেছে। এই শুল্ক হারকে শূন্য মাত্রায় নামিয়ে আনার ব্যাপারে বাংলাদেশের তদবির এখনো সফল হয়নি। শুল্কমুক্ত পণ্য রপ্তানিতে যদি বাংলাদেশ সুবিধা পেয়ে যায়, তাহলে অন্য কিছু উন্নত দেশেও বাংলাদেশ সেই সুবিধাপ্রাপ্তিকে উদাহরণ হিসেবে দেখাতে পারবে। অন্যদিকে বাংলাদেশের অর্জনও হবে আশানুরূপ।
যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি বৃদ্ধির পাশাপাশি সামগ্রিক রপ্তানি চিত্রও আশাব্যঞ্জক। একটি হিসাবে দেখা যায়, গত জুলাই-অক্টোবর মাসে বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয় বেড়েছে ৩৭ শতাংশ। আর শুধু অক্টোবর মাসে এ খাতে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬৪ শতাংশ। সংগত কারণেই রপ্তানি বাণিজ্য আমাদের অদূর ভবিষ্যতের দৃঢ় অর্থনীতির মাত্রাকে চিহ্নিত করবে। কিন্তু ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশ হওয়ার যে স্বপ্ন দেখছে, তা বাস্তবায়ন করতে হলে বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নয়ন অপরিহার্য। কিন্তু বাংলাদেশের সে দিকটি এখনো ঋণাত্মক চিত্রকেই ফুটিয়ে তোলে। বিনিয়োগ পরিস্থিতিকে অনুকূলে আনার জন্য যেসব আনুষঙ্গিক ব্যবস্থা গ্রহণ আবশ্যক সেগুলো পরিপূর্ণ না হলে বিনিয়োগে আকৃষ্ট হওয়া সম্ভব হবে না। বিশেষ করে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির নিশ্চয়তা দিতে না পারলে বিনিয়োগ বাড়ার সম্ভাবনা ক্ষীণই থেকে যাবে। আবার রপ্তানি বৃদ্ধির সূত্রেও বিনিয়োগ বৃদ্ধির সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে। শুধু যুক্তরাষ্ট্রই নয়, ইউরোপ-আমেরিকাসহ যেসব দেশে আমাদের বাণিজ্য সুবিধা বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে সেসব দেশে আমাদের ব্যবসায়িক যোগাযোগ বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের কূটনৈতিক মিশনগুলোর ভূমিকা হতে পারে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। অর্থনৈতিক কূটনীতির মাধ্যমে আমাদের রপ্তানি-বাণিজ্যকে আরো বাড়ানোর সুযোগ তৈরি হতে পারে। একই সঙ্গে বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধির প্রয়োজনে বহির্বিশ্বে আমাদের কূটনৈতিক মিশনগুলো যদি যথার্থ ভূমিকা পালন করে, তাহলে আমাদের অর্থনীতিতে নতুন যুগের সূচনা হতে পারে।

শেয়ারবাজারে- বিশেষ গোষ্ঠীর কারসাজি!

Friday, January 21, 2011

দেশের শেয়ারবাজার চরম এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। অব্যাহত দরপতনের ফলে লাখ লাখ সাধারণ বিনিয়োগকারী এখন সর্বস্বান্ত হওয়ার পথে। এরই মধ্যে গত বৃহস্পতিবার ধরা পড়েছে অভিনব কারসাজির ঘটনা। বেরিয়ে আসছে আরো অনেক তথ্য। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত সেপ্টেম্বর মাসে ‘একটি গোষ্ঠী’ শেয়ারবাজারে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে শুরু করে।

নামে-বেনামে বিপুলসংখ্যক বিও অ্যাকাউন্ট খুলে তারা বিপুল পরিমাণ শেয়ার কিনে মূল্যবৃদ্ধি ঘটায় এবং একপর্যায়ে মুনাফা নিয়ে সটকে পড়ে। এ ছাড়া কর্তৃপক্ষের কিছু সিদ্ধান্তও শেয়ারবাজারকে অস্থিতিশীল করে বলে বিভিন্ন সূত্র জানায়। গতকাল শুক্রবার অর্থমন্ত্রীও স্বীকার করেছেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ তাঁরও এ ক্ষেত্রে কিছু ভুল ছিল।
১৯৯৬ ও ২০১১ সালÑদুই বারই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। তাই ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের কেউ কেউ এ দুই কেলেঙ্কারির দায় আওয়ামী লীগের কাঁধে চাপাচ্ছে। বিষয়টিকে পুঁজি করতে চাইছে প্রধান বিরোধী দলও। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই শেয়ারবাজারে কেলেঙ্কারি হয়। নিজেদের দলের লোকদের টাকা বানানোর সুযোগ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে অতিমুনাফার ফাঁদ পেতে সাধারণ মানুষকে শেয়ারবাজারে ডেকে আনে। আর সুযোগ মতো টাকা উঠিয়ে বাজার থেকে সরে পড়ে। পথে বসে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।
আবার অনেক বিনিয়োগকারী বলছে, বিএনপিপন্থী একটি গোষ্ঠী অব্যাহতভাবে এ কারসাজি করে যাচ্ছে, যাতে ১৯৯৬ সালের মতো আরেকটি কেলেঙ্কারির ঘটনা আওয়ামী লীগ সরকারের ঘাড়ে চাপানো যায়। বিশ্লেষক থেকে শুরু করে বহু বিনিয়োগকারী বলছে, এসব কেলেঙ্কারির ঘটনায় কারা জড়িত একটু সক্রিয় হলেই নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা খুঁজে বের করতে পারে। শেয়ারের লেনদেনের হিসাব পর্যালোচনা করলেই অস্বাভাবিক লেনদেনকারী ব্যক্তি, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও ব্রোকারেজ হাউস শনাক্ত করা সম্ভব। কেউ কেউ এমনও বলছেন, ২০-২৫ জনের সংঘবদ্ধ একটি দল শেয়ারবাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা উঠিয়ে দেশের বাইরে পাচার করেছে। খোদ ডিএসই সভাপতি গত বৃহস্পতিবার এ ঘটনার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি করেছেন। অনেক দেরিতে হলেও এসইসি সন্দেহভাজন ব্রোকারেজ হাউসগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে।
‘একটি গোষ্ঠীর কাজ’ : এ বছরের সেপ্টেম্বর মাসের শুরুর দিকে একটি গোষ্ঠী শেয়ারবাজারে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে শুরু করে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র দাবি করেছে। ডিএসইর সাধারণ মূল্যসূচক সাড়ে ছয় হাজারের কাছাকাছি থাকা অবস্থায় চক্রটি কয়েকটি মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউসের মাধ্যমে ওই টাকা বিনিয়োগ শুরু করে। এর আগে এসব প্রতিষ্ঠানে নামে-বেনামে বিপুলসংখ্যক বিও অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত এসব অ্যাকাউন্ট খোলা ও বিনিয়োগ করা হয়। এসব বিও অ্যাকাউন্টে প্রতিদিন ২০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার শেয়ার কেনা হয়। এর মাধ্যমে প্রতিদিনই তালিকাভুক্ত বেশির ভাগ কম্পানির শেয়ারের দর বাড়ানো হয়। এর প্রভাবে তিন মাসের ব্যবধানে ডিএসইর সাধারণ সূচক প্রায় আড়াই হাজার পয়েন্ট বেড়ে প্রায় ৯ হাজারের ঘরে পৌঁছে।
পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো এ চক্রটি সম্পর্কে দিয়েছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। তাদের দাবি, বৃহস্পতিবার শাস্তি পাওয়া ছয়টি প্রতিষ্ঠানের কেউ কেউসহ আরো অনেক ব্রোকারেজ হাউসের মালিক বিএনপিপন্থী হিসেবে পরিচিত। তবে তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হয় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক একজন সভাপতিসহ আওয়ামী লীগপন্থী হিসেবে পরিচিত ব্রোকারেজ হাউসের কয়েকজন মালিক। তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন অতি মুনাফার লোভে শেয়ারবাজারকে অস্বাভাবিক ফুলিয়ে-ফাপিয়ে তুলতে ভূমিকা রাখেন। তাঁদের মধ্যে একজন সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ঘনিষ্ঠতা কাজে লাগিয়ে ডিএসইর নেতৃত্বে নিজের প্রভাব বজায় রেখেছেন। আওয়ামীপন্থী হিসেবে পরিচিত ডিএসইর সামনের সারির অধিকাংশ নেতার বিরুদ্ধে ১৯৯৬ সালের কেলেঙ্কারির মামলা রয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর একাধিক কম্পানির শেয়ারের দর বৃদ্ধির পেছনেও তাঁদের কারসাজি রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তাঁরা পুঁজিবাজারে প্রবেশমুখে সরাসরি তালিকাভুক্ত ও বুকবিল্ডিং পদ্ধতিতে তালিকাভুক্ত কয়েকটি কম্পানির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
গত ডিসেম্বরের কিছু ঘটনাকেও আজকের পরিস্থিতির জন্য দায়ী করছেন অনেক বিনিয়োগকারী। গত ৬ ও ৭ ডিসেম্বর এসইসির চেয়ারম্যান জিয়াউল হক খোন্দকারের অনুমোদন ছাড়াই কমিশন সদস্য মনসুর আলম চেক ও নেটিং সুবিধা-সংক্রান্ত দুটি নির্দেশনা জারির ব্যবস্থা করেন। চেয়ারম্যানের বিদেশ সফরের কারণে ওই সময় মনসুর আলম ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে কাজ করছিলেন। এসইসির এ নির্দেশনাটি ৭ ডিসেম্বর নজিরবিহীনভাবে ডিএসইর ওয়েবসাইটে মোট আটবার প্রদর্শন করা হয়। ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বড় রকমের বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে চেকের মাধ্যমে অর্থ জমা দেওয়া যাবে নাÑএ ধরনের গুজবে বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। পরদিন লেনদেন শুরুর পর বাজারে বড় ধরনের ধস নামে। সোয়া এক ঘণ্টার মধ্যে ডিএসই সাধারণ সূচক আগের দিনের চেয়ে ৫৪৬ পয়েন্ট কমে যায়। এ ঘটনায় এসইসি চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে। ঘটনার জের ধরে গত ১২ জানুয়ারি মনসুর আলম পদত্যাগ করেন।
অনেক বিনিয়োগকারী মনসুর আলমকে বলে থাকে বিএনপিপন্থী। প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচয় প্রদানকারী ডিএসইর সাবেক ওই সভাপতির সঙ্গে মনসুর আলমের বিশেষ ঘনিষ্ঠতার কথা তখন ডিএসই ও এসইসিতে আলোচনার খোরাক ছিল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এসইসির এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, মনসুর আলমকে দিয়ে ওই নির্দেশনা জারি করাতে ডিএসইর ওই সাবেক সভাপতি বিশেষ ভূমিকা রাখেন। এই নির্দেশনা জারির আগেই তিনি নিজের পোর্টফোলিও থেকে সব শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন বলেও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। ৮ ডিসেম্বরের পর থেকে যে দরপতন ও অস্থিরতা তৈরি হয়, এরই পরিণতিতে ২০ জানুয়ারির সর্বশেষ দরপতন ও লেনদেন বন্ধের ঘটনা ঘটে।
গত বৃহস্পতিবারের দরপতনের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ছয়টি ব্রোকারেজ হাউসের লেনদেন কার্যক্রম এক মাসের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাদের এক মাসের জন্য দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। চার দিন বন্ধ হয়ে গেছে শেয়ারবাজারের লেনদেন। রবিবারও বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে লেনদেন। হয়তো এ বন্ধের মেয়াদ আরো বাড়ানো হবে।
ব্যাংকের দায় : বাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুঁজিবাজারের মুনাফার বেশির ভাগ টাকা আসলে চলে গেছে মুদ্রাবাজারে। গত বছর ব্যাংকগুলোর মুনাফার সিংহভাগই আসে পুঁজিবাজার থেকে। আলাদা কম্পানি হওয়ার আগ পর্যন্ত মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো বেশ কিছু সুবিধা ভোগ করে। ফলে নিজেদের চ্যানেল থেকে তারা নিজেদের ডিলার অ্যাকাউন্টে ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পোর্টফোলিওতে মার্জিন ঋণের মাধ্যমে ব্যাপক হারে বিনিয়োগ করে। সেখান থেকেই মুনাফা আসে ব্যাপক। কোনো কোনো মার্চেন্ট ব্যাংক ২০০ থেকে ৪০০ কোটি টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করে। কিন্তু ডিসেম্বরের পরে আলাদা সাবসিডিয়ারি কম্পানি করার পর এসব ব্যাংকের ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগের সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। একই সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কয়েকটি সার্কুলার জারি করে। ফলে কমে যায় ব্যাংকের বিনিয়োগ। এর প্রভাব পড়ে পুঁজিবাজারে। বিভিন্ন সূত্র মতে, শেয়ারবাজারের কিছু সংঘবদ্ধ চক্রও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি নিজেদের অর্থ তুলে নেয়। ফলে বাজার হয়ে পড়ে অর্থশূন্য।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সভাপতি শাকিল রিজভী গত বৃহস্পতিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, পুঁজিবাজারের বেশির ভাগ টাকা চলে গেছে মুদ্রাবাজারে। আর একটি অংশ তুলে নিয়েছে কারসাজি চক্র। ২০ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলন থেকে তিনি এ চক্রের বিরুদ্ধে তদন্তের দাবি করেন।
কারণ আরো আছে : নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসির কয়েকটি সিদ্ধান্তের প্রভাবেও এ পতন ত্বরান্বিত হয় বলে মনে করা হচ্ছে। এ ছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বার্ষিক হিসাব সমাপনী (ইয়ার ক্লোজিং), আইনসীমার অতিরিক্ত অর্থ প্রত্যাহারে বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোরতা আরোপ, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা শিল্পঋণের টাকা ফেরতের সময় বেঁধে দেওয়া, ব্যাংকের নগদ জমা সংরক্ষণের (সিআরআর) হার বৃদ্ধি এবং মার্জিন ঋণ সংকোচন করার প্রভাবও পড়ে বাজারে। এদিকে ডিসেম্বরের মধ্যে ব্যাংকগুলোর মার্চেন্ট ইউনিটকে আলাদা সাবসিডিয়ারি কম্পানি করা হয়েছে। ব্যাংকিং নিয়ম অনুযায়ী পরিশোধিত মূলধনের ১৫ শতাংশের বেশি কোনো কম্পানিকে ঋণ দেওয়ার নিয়ম নেই। ফলে তারাও বিনিয়োগ আর বাড়াতে পারছে না।
ডিএসইর সভাপতি এ প্রসঙ্গে কালের কণ্ঠকে বলেন, একসঙ্গে এতগুলো সিদ্ধান্ত আরোপের কারণেও বাজার অস্থিতিশীল হয়েছে।
কাগুজে বনাম ইলেকট্রনিকস : ১৯৯৬ সালে অল্প কয়েক দিনের মধ্যে কৃত্রিমভাবে কয়েকটি কম্পানির শেয়ারের দাম বাড়িয়ে তা বিক্রি করে বাজার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছিল। ১৯৯৬ সালে ছিল কাগুজে শেয়ার, এবার ইলেকট্রনিক শেয়ার। এবার এক বছর ধরে শেয়ারের দাম বাড়ার ঘটনা ঘটে। বাজার থেকে সরে পড়তে সময় নিয়েছে প্রায় এক মাস। তবে এবারের ভয়াবহ ঘটনা হচ্ছে, স্বেচ্ছায় লোকসান দিয়ে বাজারদরের চেয়ে অনেক কম দামে শেয়ার বিক্রির করে দেওয়া, যা গত বৃহস্পতিবার ধরা পড়েছে কর্তৃপক্ষের নজরদারিতেও।
১৯৯৬ সালে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ছিল ১০ হাজার। আর দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাধারণ মূল্যসূচক ছিল ২০০০ পয়েন্ট। গড়ে প্রতিদিনের লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৩০০ কোটি টাকা। কম্পানির সংখ্যাও ছিল কম। এবার বিও অ্যাকাউন্টধারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৩ লাখ। মূল্যসূচক ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে সর্বোচ্চ ৮৯০০ পয়েন্টে ওঠে। ডিএসইতে প্রতিদিনের লেনদেনের গড় দাঁড়ায় প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। বাজার মূলধনের পরিমাণ তিন লাখ পাঁচ হাজার কোটির ওপরে ওঠে। তবে বাজারে ধারাবাহিক পতনের ফলে গড় লেনদেন ও বাজার মূলধন দুই-ই অনেক কমে গেছে।
১৯৯৬ সালের শেয়ার কেলেঙ্কারির ঘটনায় মামলা হলেও এর বিচার হয়নি আজও। আদালতের স্থগিতাদেশের পর বিচার কার্যক্রম থেমে আছে। এ মামলার বিচার কার্যক্রম নিষ্পত্তি করার উদ্দেশ্যে বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে একটি সংসদীয় কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ওই কমিটি এখন পর্যন্ত কোনো কার্যক্রম শুরু করেনি বলে জানা গেছে। তদন্ত কার্যক্রমের দুর্বলতার কারণে এ মামলার পরিণতি নিয়েও দেখা দিয়েছে সংশয়।

২০১০ সালের অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা by অর্কপ্রভ দেব

Thursday, January 20, 2011

সামষ্টিক অর্থনীতিতে বর্তমান স্থিতিশীলতা বজায় থাকলে রেমিটেন্স প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়াসহ ছোটখাট কিছু ধাক্কা সহ্য করা অর্থনীতির জন্য খুব একটা কঠিন হবে না। প্রকৃতির বিরূপ আচরণ, বিশ্বমন্দা দীর্ঘস্থায়ী হওয়াসহ আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক চ্যালেঞ্জগুলোকে বিবেচনায় নিয়ে সেগুলো মোকাবেলার লাগসই কৌশল প্রণয়ন করলে ২০১৩ সালের মধ্যে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করা তেমন কঠিন হবে না।

বিশ্বব্যাপী বিশেষ করে উন্নত বিশ্বের অর্থনীতিগুলোতে মন্দা চলছে। এ অবস্থা থেকে বিশ্ব অর্থনীতি কবে মুক্তি পাবে - এ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক অর্থনীতিবিদদের পূর্বাভাসও এখন বাস্তবতা হারিয়ে ফেলতে বসেছে। বেকার সমস্যা প্রকটভাবে বিরাজ করায় গত নভেম্বরে বিশ্ব অর্থনীতির এক-চতুর্থাংশের মালিক যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট ওবামার ডেমোক্রেটিক পার্টির ভরাডুবি হয়েছে। ইউরোপে ইউরোজোনের পর্তুগাল, আয়ারল্যান্ড, ইতালী, ফিনল্যান্ডসহ ১৬টি দেশের অর্থনীতিতেই এখন টালমাটাল অবস্থা। জার্মানী একটু ভাল অবস্থায় থাকলেও অন্যদের মন্দা মোকাবেলায় ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাংককে চাঁদা দিতে দিতে তারাও ক্লান্ত। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ইউরোজোনের বাইরে থাকা ব্রিটেনসহ ১১টি দেশের অর্থনীতিও ভাল অবস্থায় নেই। সবাই ব্যয় সংকোচন করছে। ব্রিটেনে বেতন বৃদ্ধির প্রতিবাদে ছাত্রদের আন্দোলন তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ভাঙচুর, অগি্নসংযোগকেও হার মানিয়েছে। মন্দাকবলিত প্রায় সবগুলো দেশেই পেনশন ভাতা কমানো হয়েছে। জাপান শত চেষ্টা করেও তাদের অর্থনীতিতে গতি ফিরিয়ে আনতে পারছে না। এখন সরকার প্রায় শত কোটি ডলার বাজারে ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর ফলে মূল্যস্ফীতি আরো বেড়ে গেলে তা কীভাবে সামাল দেবে তা এখনো পরিষ্কার নয়। বড় অর্থনীতিগুলোর মধ্যে একমাত্র চীন একটু ভাল অবস্থায় আাছে। তবে ইতোমধ্যেই চীনের মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশ স্পর্শ করেছে। ধনী-গরিব বৈষম্য আরো বেড়েছে। উচ্চ বেতনের চাকরির আশায় লাখ লাখ কর্মক্ষম মানুষ শিল্পসমৃদ্ধ প্রদেশগুলোতে পাড়ি জমাচ্ছে। পক্ষান্তরে, বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশ্বমন্দার অভিঘাত সহ্য করেও সামস্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রেখেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য এটি একটি আশাপূর্ণ অগ্রগতি। আন্তর্জাতিক অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, বিশ্বে যে বিশটি দেশ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি। গত নভেম্বরে প্রকাশিত জাতিসংঘ মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন_২০১০ অনুযায়ী এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি অর্জন করেছে। উন্নয়ন ধারার দিক থেকে ৯৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। কয়েকদিন আগে অর্থনীতিবিষয়ক প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক সাময়িকী 'দ্যা ইকোনোমিস্ট'-এর মর্যাদাপূর্ণ 'ইকোনোমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিট ইনডেস্ক ২০১০' প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বিশ্বগণতান্ত্রিক সূচকে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি অর্জন করেছে। বিশ্বের ১৬৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ এখন ৮৩ তম। দুই বছর আগে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৯১তম।

বাংলাদেশের অর্থনীতির এ ভাল অবস্থায় বড় অবদান রেখেছে রফতানি আয় এবং প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স। গত বছর বিশ্বের আমদানি-রফতানি তার আগের বছরের তুলনায় ১২.২ শতাংশ কমেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটিই সবচেয়ে বড় পতন। বিশ্বের রফতানি কমেছে ২১ শতাংশ। মাত্র ১২টি দেশ রফতানিতে প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পেরেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ২০০৯-১০ অর্থবছরে বাংলাদেশ ১,৬২০ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য রফতানি করেছে। ২০০৮-০৯-এ হয়েছিল ১,৫৫৬ কোটি ডলার। ৪.১১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বর্তমান ২০১০-১১ অর্থবছরের নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে রফতানি আয় হয়েছে ৮২৮ কোটি ডলার। যা বিগত অর্থবছরের এ সময়ের তুলনায় প্রায় ৩৬ শতাংশ বেশি। আগামী জুন পর্যন্ত এভাবে এগিয়ে যেতে পারলে চলতি অর্থবছরে রফতানি আয় ২,২০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে। আমদানির ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ ভাল অবস্থায় আছে। মন্দার কারণে ২০০৯ সালে বিশ্ব আমদানি ব্যয় প্রায় ১১ শতাংশ কমেছে। পক্ষান্তরে, বাংলাদেশের আমদানি ৫.৫ শতাংশ বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে আমদানি ব্যয় হয়েছে ৯৫৫ কোটি ডলার। যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৩৪ শতাংশ বেশি। এ ব্যয়ের একটা বড় অংশই হয়েছে মূলধনী যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে। এটি আগামী দিনগুলোতে অর্থনীতি আরো চাঙ্গা হওয়ারই ইঙ্গিত দিচ্ছে।

বাংলাদেশের রফতানিপণ্যের সংখ্যা বেশি নয়। প্রায় আড়াই দশক ধরে রফতানি ক্ষেত্রে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে তৈরি পোশাক খাত। প্রতি বছরই রফতানি আয়ে তৈরি পোশাক খাতের অবদান বাড়ছে। গত বছর ১,৬২১ কোটি ডলার রফতানি আয়ের মধ্যে ১,২৫০ কোটি ডলারই এসেছে তৈরি পোশাক খাত থেকে। অন্যান্য পণ্য থেকে এসেছে মাত্র ২৩ শতাংশ আয়। তৈরি পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম রফতানিকারক দেশ। চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও তুরস্কের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। আমদানিকারক দেশগুলোতে ব্যাপক মন্দা সত্ত্বেও সরকার ও তৈরি পোশাক উদ্যোক্তাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টার কারণে দেশ এ কৃতিত্ব অর্জন করেছে। সরকার বিশ্বমন্দার প্রভাব মোকাবেলা করে রফতানিমুখী খাতগুলো যাতে প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে পারে সে লক্ষ্যে প্রথম প্যাকেজে নীতি প্রণোদনাসহ ৩,৪২৪ কোটি টাকা দিয়েছে। দ্বিতীয় প্যাকেজের আওতায় ২,০০০ কোটি টাকা প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। তৈরি পোশাকের পাশাপাশি ঔষধ, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যসহ ম্যানুফেকচার্ড পণ্য, হিমায়িত খাদ্য, পাট ও পাটজাত দ্রব্য, কৃষিপণ্য, জাহাজ শিল্প প্রভৃতি ক্ষেত্রে রফতানি বৃদ্ধির লক্ষ্যে নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং নতুন বাজার সৃষ্টিতে সরকার তৎপর রয়েছে। বিদেশে বাংলাদেশের মিশনগুলোকে অর্থনৈতিক কূটনীতিমুখী করে গড়ে তোলা হচ্ছে। নতুন নতুন পণ্য রফতানি বাজারে নিয়ে আসার লক্ষ্যে বিনিয়োগবান্ধব শিল্পনীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। শিল্পনীতিতে ৩২টি খাতকে থার্স্ট সেক্টর হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এগুলোতে বিনিয়োগ করলে কর মওকুফসহ বিভিন্ন প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। তবে গার্মেন্টস খাতে প্রবৃদ্ধি অর্জনের প্রধান শক্তি এ খাতে নিয়োজিত প্রায় ৩৫ লাখ গার্মেন্টস শ্রমিক। যার অধিকাংশই নারী। সাম্প্রতিককালে নতুন বেতন-ভাতার দাবিতে ঢাকা ও চট্টগ্রামের বেশকিছু গার্মেন্টস ও রফতানিমুখী অন্যান্য শিল্পে শ্রমিক আন্দোলনের নামে কিছু অনভিপ্রেত উচ্ছৃঙ্খলতা দেখা গেছে। যদিও সরকার অনেকটা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে গার্মেন্টস খাতে নূ্যনতম মজুরি ২০০৬ সালের ১,৬৬২ টাকা থেকে বাড়িয়ে তিন হাজার টাকা করেছে। এসবের পিছনে কার কী দূরভীসন্ধি কাজ করছে তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। পাশাপাশি নতুন বেতন-স্কেল বাস্তবায়নের মনিটরিং জোরদার করা দরকার। শিল্পে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় থাকলে আগামী দিনগুলোতে উৎপাদন ও রফতানি প্রবৃদ্ধি আরো বাড়বে। নতুন বিনিয়োগও হবে। বেকারদের কর্মসংস্থান হবে। দেশের অর্থনীতি দৃঢ় হবে।

দেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি হচ্ছে। দেশীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধির পাশাপাশি বিশ্বমন্দা অবস্থায়ও বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের পরিমাণ বাড়ছে। শিল্প বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে শিল্পঋণ সহজলভ্য করা হয়েছে। ফলে ২০০৯-১০ অর্থবছরে শিল্পঋণ বিতরণে আগের বছরের তুলনায় ৩০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৮ শতাংশ। নতুন নতুন শিল্প স্থাপনের ফলে উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি কর্মসংস্থানও বাড়ছে। ২১ ডিসেম্বর, ২০১০ পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ১,০৯৫ কোটি ডলার। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের আরেকটি প্রধান খাত জনশক্তি রফতানি। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবাসীরা ৯৬৯ কোটি ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন। ২০০৯-১০ অর্থবছরে রেমিটেন্স আয়ে ১৩.৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে ১,০৯৯ কোটি ডলার অর্জিত হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শেষ বছর রেমিটেন্স এসেছিল মাত্র ৪৪৩ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে ৪৫৩ কোটি ডলার রেমিটেন্স এসেছে। প্রবাসীরা যাতে বৈধ পথে অর্থ প্রেরণে উদ্বুদ্ধ হয় সে লক্ষ্যে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন এবং সন্ত্রাসবিরোধী আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এখন প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থ তাদের আত্মীয়-স্বজনরা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পাচ্ছেন। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে রেমিটেন্স প্রেরণ পদ্ধতি সহজীকরণ করা হয়েছে। প্রবাসীদের দেশে বিনিয়োগের পথ এখন অনেক সুগম হয়েছে। তাদের এবং দেশে তাদের পরিবারের জন্য বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে। প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক স্থাপন করা হয়েছে। প্রবাসে গমনেচ্ছুরা এ ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারছেন। এতে তাদের পাসপোর্ট, ওয়ার্ক-পারমিট ইত্যাদি যথাযথ আছে কি না তাও নিশ্চিত হওয়া যাবে। প্রতারিত হওয়ার পথ বন্ধ হবে। এর ফলে প্রবাসীরা বৈধ চ্যানেলে রেমিটেন্স পাঠাতে আগ্রহী হয়েছেন। দুশ্চিন্তার বিষয় হচ্ছে, মন্দার কারণে কোনো কোনো দেশে জনশক্তির চাহিদা কমে গেছে। জনশক্তি রফতানি প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে সরকারকে সম্ভাবনাময় দেশগুলোর সরকারের সাথে নিরন্তর আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। পাশাপাশি দক্ষ শ্রমিক রফতানি সামর্থ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাকে আরো কার্যকর ও যুগোপযোগী করতে হবে।

রাজস্ব আদায় পরিস্থিতিও বেশ সন্তোষজনক। ২০০৯-১০ অর্থবছরে মোট ৭৮,০৮৬ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে। যা ২০০৮-০৯ অর্থবছরের তুলনায় ১৬.৭ শতাংশ বেশি। চলতি অর্থবছরে ৯২,৮৪৭ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম তিন মাসে আয় হয়েছে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা। এ আয় লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ২২.৬ শতাংশ বেশি। চলতি ২০১০-১১ অর্থবছরে মোট বাজেট বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১ লাখ ৩২ হাজার ১৭০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা এডিপি বরাদ্দ ৩৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। বাজেট বরাদ্দের শতভাগ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মনিটরিং জোরদার এবং জবাবদিহিমূলক ব্যব্স্থা নেয়া হয়েছে। ফলে এডিপি বাস্তবায়ন গত বছরের চেয়েও এ বছর দ্রুততর হচ্ছে। নতুন মজুরি কমিশন ঘোষণা করা হয়েছে।

নিত্যপণ্যের মূল্য পরিস্থিতি নিয়ে জনগণের মধ্যে কিছুটা উদ্বেগ আছে এবং এটা স্বাভাবিক। ২০০৯-১০ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ছিল ৭.৩ শতাংশ। এখন তা ৭.৮ শতাংশ এবংয় ঊধর্্বমুখী। এখন বিশ্বব্যাপীই মূল্যস্ফীতি চলছে। কোনো কোনো দেশে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি ২০ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে। এর প্রধান কারণ, বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি। বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী বিগত ছয় মাসে বিশ্ববাজারে গম ও ভুট্টার দাম ৫৭ শতাংশ বেড়েছে। চালের দাম বেড়েছে ৪৫ শতাংশ। চিনির দাম বেড়েছে ৫৫ শতাংশ। সয়াবিনের দাম গত ১৬ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে গত অক্টোবরে ভারতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৭ শতাংশ। ডিসেম্বরে এসে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১২.১৩ শতাংশে। পাকিস্তানে মূল্যস্ফীতি প্রায় ১৩ শতাংশ। নেপালে ১৩.২ শতাংশ। শ্রীলঙ্কায় প্রায় ১১ শতাংশ। সার্কভুক্ত দেশগুলোসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তুলনায় বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি বেশ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এর মূলে আছে কৃষি উৎপাদনে আমাদের ব্যাপক সাফল্য। ২০০৯-১০ অর্থবছরে ৩ কোটি ২৩ লাখ টন চাল উৎপাদিত হয়েছে। এর আগের বছর হয়েছিল ৩ কোটি ১৩ লাখ টন। গত মৌসুমে আমন ধানের ফলনও খুব ভাল হয়েছে। উৎপাদন এক কোটি ৩১ লাখ টনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যেতে পারে। শাক-সবজি, আলু, পিঁয়াজ, ডাল, ফল, পাট, রবিশস্য সব ফসলের উৎপাদনই গত দুই বছরে অনেক বেড়েছে। এর মূল কারণ সরকারের কৃষকবান্ধব নীতি। সরকার ৪০-৫০ টাকা কেজি দরে ইউরিয়া সার আমদানি করে কৃষককে দিচ্ছে কেজি ১২ টাকায়। অন্যান্য সারের দাম এ দুই বছরে তিনবার কমিয়েছে। ২০০৮ সালে যে টিএসপি ডিলারদের কাছে বিক্রি করা হতো কেজি ৬৫ টাকায় এখন ডিলাররা তা পাচ্ছে ২০ টাকায়। ডিএপি'র দাম ছিল ৮৫ টাকা কেজি। এখন ডিলাররা পাচ্ছে ২৫ টাকা কেজি। ভর্তুকি বাবদ চলতি অর্থবছরে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়া হয়েছে। কৃষি উপকরণ দেয়ার জন্য এক কোটি ৮২ লাখ কৃষক পরিবারকে কৃষি কার্ড দেয়া হয়েছে। এখন কৃষক ভর্তুকির টাকা সরাসরি ব্যাংক থেকে উত্তোলন করতে পারছে। সরকার কৃষকদেরকে ১০ টাকা দিয়ে ব্যাংক একাউন্ট খোলার সুযোগ করে দিয়েছে। গত অর্থবছরে সরকার কৃষকদের মধ্যে ১১,১১৭ কোটি টাকার কৃষিঋণ বিতরণ করেছে। চলতি অর্থবছরে ১২ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণের লক্ষ্য নিয়ে গত অক্টোবর পর্যন্ত চার মাসে ৩,৬০৮ কোটি টাকা বিতরণ করেছে। এক্ষেত্রে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে লবণাক্ত জমি, অতি খরা, হঠাৎ বন্যা , সহনীয় বীজ উদ্ভাবনে বেশকিছু সাফল্য অর্জিত হয়েছে। সেচ ব্যবস্থা সম্প্রসারিত হচ্ছে। এতে পতিত জমি আবাদী জমিতে রূপান্তরিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এসব উদ্যোগ কৃষকের মধ্যে উৎপাদন বাড়ানোর প্রেরণা হিসেবে কাজ করছে।

সামষ্টিক অর্থনীতিতে বর্তমান স্থিতিশীলতা বজায় থাকলে রেমিটেন্স প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়াসহ ছোটখাট কিছু ধাক্কা সহ্য করা অর্থনীতির জন্য খুব একটা কঠিন হবে না। প্রকৃতির বিরূপ আচরণ, বিশ্বমন্দা দীর্ঘস্থায়ী হওয়াসহ আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক চ্যালেঞ্জগুলোকে বিবেচনায় নিয়ে সেগুলো মোকাবেলার লাগসই কৌশল প্রণয়ন করলে ২০১৩ সালের মধ্যে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করা তেমন কঠিন হবে না। সে লক্ষ্যে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে

শেয়ারবাজারে দরপতন নির্বিচারে গাড়ি ভাঙচুর

ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে গতকাল বুধবার লেনদেন শুরু হওয়ার দেড় ঘণ্টার মধ্যে সূচক সর্বনিম্ন সীমায় (সার্কিট ব্রেকার) পৌঁছে যায়। ফলে বন্ধ হয়ে যায় শেয়ার লেনদেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে বিনিয়োগকারীরা রাজধানীর মতিঝিল, দিলকুশা, দৈনিক বাংলার মোড়সহ আশপাশের এলাকায় বিক্ষোভ ও বেপরোয়া ভাঙচুর শুরু করে।

তাদের তাণ্ডবে অতিষ্ঠ হয়ে প্রতিরোধ করতে রাস্তায় নামেন ক্ষতিগ্রস্ত গাড়ির মালিক, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তাকর্মী ও কর্মচারীরা। এ সময় উভয় পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। বিক্ষোভকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করেও ইটপাটকেল ছোড়ে। পুলিশ একজনকে আটক করে।
পুঁজিবাজারে অস্বাভাবিক উত্থান-পতন ঠেকাতে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) এক দিনে সূচক হ্রাস-বৃদ্ধির সীমা (সার্কিট ব্রেকার) নির্ধারণ করে। এসইসি সিদ্ধান্ত নেয়, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) সাধারণ সূচকের হ্রাস বা বৃদ্ধি আগের দিনের তুলনায় ২৩৭ পয়েন্ট হলেই লেনদেন বন্ধ করে দেওয়া হবে। এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয়েছে গতকাল থেকে। এ দিন শেয়ারবাজারে লেনদেন শুরু হওয়ার দেড় ঘণ্টার মধ্যে দরপতন হয়ে এ সীমা ছুঁয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যায় দুই স্টক এক্সচেঞ্জের লেনদেন।
সাত কর্মদিবসের ব্যবধানে গতকাল তৃতীয়বারের মতো বন্ধ হয় লেনদেন। আগের দিন মঙ্গলবার ও গত ১০ জানুয়ারি (সোমবার) অস্বাভাবিক দরপতনের কারণে লেনদেন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
বিনিয়োগকারীরা জানায়, সকালে নির্ধারিত সময়ে লেনদেন শুরু না হলেও তারা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছিল। অর্থমন্ত্রীর বাসভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠক থেকে বাজারের জন্য ইতিবাচক কোনো সিদ্ধান্ত আসবে বলে প্রত্যাশা ছিল তাদের। পরে এসইসি ও বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন কোনো সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলে লেনদেন শুরু হবে বলে ধারণা করছিল তারা। কিন্তু শুধু সূচক হ্রাস-বৃদ্ধির সীমা আরোপ করে লেনদেন শুরু এবং এর পরই ব্যাপক দরপতনের কারণে বিনিয়োগকারীদের ক্ষোভ সহিংস রূপ ধারণ করে।
বিনিয়োগকারীরা রাস্তায় অবস্থান নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক, এসইসি ও ডিএসই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকে। তবে তারা পুঁজিবাজারের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য প্রধানত বাংলাদেশ ব্যাংককেই দায়ী করে। তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমানের পদত্যাগও দাবি করে।
দুপুরে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিনিয়োগকারীরা মতিঝিল, দিলকুশা, দৈনিক বাংলার মোড় ও ফকিরাপুলে রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে শুরু করে। দুপুর আড়াইটা থেকে বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত এক ঘণ্টা ওই সব এলাকায় ব্যাপক গাড়ি ভাঙচুর এবং আগুন লাগানো হয়। এ ঘটনায় চার পুলিশ সদস্য আহত হন। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে এক বিক্ষোভকারীকে আটক করে।
দুপুর আড়াইটার দিকে বিনিয়োগকারীরা ঢাকা স্টক এক্সেচেঞ্জের সামনে টায়ার, কাগজ ও কাঠে আগুন ধরিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে। এরপর বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে মতিঝিল শাপলা চত্বর, দৈনিক বাংলার মোড় ও ফকিরাপুল এলাকায়। বিনিয়োগকারীদের একটি দল লাঠিসোঁটা ও ইটপাটকেল নিয়ে ওই সব এলাকায় পার্কিং করা গাড়ি ভাঙতে শুরু করে। এরপর আরেকটি দল রাস্তায় চলাচলরত যানবাহন ভাঙচুর করতে থাকে। এ ঘটনায় মতিঝিল, দৈনিক বাংলার মোড়সহ আশপাশ এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। রাস্তায় গাড়ি, রিকশা ও মোটরসাইকেল রেখেই দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করতে থাকে লোকজন। এলাকার বিভিন্ন ব্যাংক, অফিস, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান মুহূর্তের মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়।
মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় অগ্রণী ব্যাংক প্রধান শাখা এবং শিল্প মন্ত্রণালয় ও পূবালী ব্যাংক লিমিটেডের প্রধান শাখার নিচে পার্কিং করা গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। বিনিয়োগকারীরা ইটপাটকেল ও লাঠিসোঁটা দিয়ে ভাঙচুর চালায়। একই সময়ে বিক্ষোভকারীরা ভাঙচুর শুরু করে দিলকুশা এলাকায়ও। ওই এলাকায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্টাফ বাস, প্রাইভেট কার ও বিআরটিসির দুটি বাসসহ শতাধিক গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। ফুটপাতের দোকানপাটও ভাঙচুর করে বিক্ষোভকারীরা। ফুটপাতের দোকানিরা এগিয়ে গেলে বিক্ষোভকারীরা তাঁদের মারধর করে। এ সময় ওই এলাকা ছিল পুলিশশূন্য। মতিঝিল থানার অদূরে এ ঘটনা ঘটলেও পুলিশ এগিয়ে যায়নি। এতে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ দেখা দেয় মানুষের মধ্যে। অসহায় হয়ে পড়ে সাধারণ মানুষ। একপর্যায়ে মতিঝিল এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত গাড়ির মালিক, বিভিন্ন অফিসের কর্মচারী, ভবনগুলোর নিরাপত্তাকর্মী ও সাধারণ মানুষ মিলে বিক্ষোভকারীদের পাল্টা ধাওয়া দেয়। শুরু হয় দ্বিতীয় দফায় ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ। একপর্যায়ে শ্রমিক-কর্মচারীরা বিক্ষোভকারীদের ধাওয়া করেন। এ সময় পুলিশ গিয়ে তাঁদের লাঠিপেটা করে।
সোনালী ব্যাংকের (মিরপুর শাখা) এজিএম এস এম গোলাম মোস্তফা জানান, তিনি অফিসের গাড়ি নিয়ে মতিঝিল শাখায় কাজের জন্য যান। বাইরে হৈচৈ শুনতে পেয়ে বের হন ব্যাংক থেকে। দেখতে পান বিক্ষোভকারীরা তাঁর গাড়িটিও ভাঙচুর করছে। বাধা দিতে গেলে তাঁকে গালমন্দ করে বিক্ষোভকারীরা। ব্র্যাক ব্যাংকের এক নারী কর্মকর্তা অফিস থেকে বেরিয়ে তাঁর গাড়িটি রক্ষা করার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। বিক্ষোভকারীরা তাঁর সামনেই প্রাইভেট কারটি ভেঙে ফেলে। এই দৃশ্য দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন ওই নারী।
এদিকে দুপুরেই শতাধিক বিনিয়োগকারী ধানমণ্ডিতে মীনাবাজারের সামনে রাস্তা অবরোধ করে ১০-১২টি গাড়ি ভাঙচুর করে। এ ঘটনায় ওই এলাকায়ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ধানমণ্ডি থানার ওসি শাহ আলম জানান, এ ঘটনায় তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। তবে কিছুক্ষণ রাস্তা অবরোধ করে রাখা হয়েছিল। পরে তা তুলে নেওয়া হয়।
এসইসির নির্বাহী পরিচালক আনোয়ারুল কবীর ভুঁইয়া সাংবাদিকদের বলেন, পুঁজিবাজারে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি এড়াতে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থেই সূচক হ্রাস-বৃদ্ধির সীমা আরোপ করা হয়েছে। বুধবার এসইসির বাজার পর্যালোচনা কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরপরই তা কার্যকর করা হয়েছে। তিনি বলেন, লেনদেন চলাকালে প্রতি পাঁচ মিনিট পরপর সূচক সমন্বয় করা হয়। এ কারণে কোনো একটি পয়েন্টে সূচকের সীমা নির্দিষ্ট করে দেওয়া যায়নি। একবার সমন্বয়ের পর পরের পাঁচ মিনিটের মধ্যে যাতে বড় ধরনের উত্থান বা পতন ঘটতে না পারে সে জন্য ২৩৭ পয়েন্টকে ভিত্তি ধরা হলেও হ্রাস-বৃদ্ধির পরিমাণ ২২৫ পয়েন্টের বেশি হলেই লেনদেন বন্ধ করে দেওয়া হবে।
আনোয়ারুল কবীর আরো বলেন, বাংলাদেশে সূচক হ্রাস-বৃদ্ধির সীমা আরোপের ধারণা নতুন হলেও বিশ্বের অনেক দেশে এ ধরনের ব্যবস্থা চালু রয়েছে। এর ফলে এক দিনের মধ্যে শেয়ারবাজারে অস্বাভাবিক দরপতন বা উত্থানের প্রবণতা অনেকটা রোধ করা সম্ভব হবে।
বড় ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কায় আগের দিন (মঙ্গলবার) শেয়ারবাজারে লেনদেন স্থগিত রাখার পর গতকাল নির্ধারিত সময়ে (সকাল ১১টা) যথারীতি লেনদেন শুরুর ঘোষণা দিয়েছিল এসইসি ও ডিএসই। কিন্তু সকাল থেকেই পুঁজিবাজারের বর্তমান পরিস্থিতিতে করণীয় নির্ধারণের লক্ষ্যে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে একের পর এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যেকোনো ধরনের বিভ্রান্তি এড়াতে শেয়ারবাজারে লেনদেন শুরুর সময় পিছিয়ে দেওয়া হয় দুই ঘণ্টা। শেষ পর্যন্ত সূচক হ্রাস-বৃদ্ধির সীমা আরোপের পর দুপুর ১টা থেকে দুই শেয়ারবাজারে লেনদেন শুরু হয়।
সূচক হ্রাস-বৃদ্ধির সীমা আরোপের প্রথম দিনে লেনদেন শুরুর পর দেড় ঘণ্টার মধ্যেই শেয়ারবাজারে সর্বোচ্চ দরপতনের ঘটনা ঘটেছে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে সূচক আগের দিনের তুলনায় ১৬০ পয়েন্ট বেড়ে ৭৩০০ পয়েন্টের ঘর ছুঁয়ে যায়। এরপর শুরু হয় দরপতন। একটানা দরপতনে ২০ মিনিটে সূচক কমে যায় ২৮০ পয়েন্ট। এটা আগের দিনের তুলনায় ১২০ পয়েন্ট কম। এ সময় লেনদেন হওয়া বেশির ভাগ কম্পানির দরপতন ঘটে। এর ২০ মিনিটে আবার সামান্য বৃদ্ধি পায় লেনদেন। এ সময় সূচক প্রায় ১২০ পয়েন্ট বেড়ে ৭১২৫-এর ঘরে পৌঁছায়। এরপর আবার শুরু হয় পতন। এ পতন শেষ হয় আড়াইটায়। এ সময় এ সূচক আগের দিনের চেয়ে ২৩১ পয়েন্ট কমে ৬৯০২.৪৮-এ দাঁড়ায়। ফলে ওই অবস্থায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে দিনের লেনদেন বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় পর্যন্ত লেনদেন হওয়া ২৪০টি কম্পানির মধ্যে ২৩০টিরই শেয়ারের দর ব্যাপক মাত্রায় কমে। এর বিপরীতে সাতটির দর বাড়ে এবং তিনটির অপরিবর্তিত থাকে।
অর্থমন্ত্রীর বাসায় বৈঠক : পুঁজিবাজার পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল সকালে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের বাসায় একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, ড. মশিউর রহমান, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান, অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শফিকুর রহমান পাটোয়ারী, এসইসি চেয়ারম্যান জিয়াউল হক খোন্দকার, সদস্য মো. ইয়াসিন আলী, মো. আনিসুজ্জামানসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে পুঁজিবাজারের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। এ ছাড়া পুঁজিবাজারে বিপর্যয়কর পরিস্থিতি তৈরির পেছনে কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর কারসাজি রয়েছে কি না তা খুঁজে বের করার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
ডিএসইর ব্রিফিং : বাজার পরিস্থিতি সম্পর্কে বিকেলে ডিএসইর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সতিপতি মৈত্র সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় তিনি সূচকের সার্কিট ব্রেকার আরোপের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বিনিয়োগকারীদের ধৈর্য ধরার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, যাদের হাতে ভালো কম্পানির শেয়ার আছে, কোনোভাবেই আতঙ্কে তা বিক্রি করা ঠিক হবে না।

ইউনিপে টুইউর ওপর নজরদারি বাড়ানোর অনুরোধ

'অতি লাভের আশায় আমরা অবুঝের মতো বিনিয়োগ করেছি। আমাদের অর্থ আত্মসাৎ করে কেউ যাতে পালিয়ে যেতে না পারে সেজন্য ইউনিপে টুইউর ওপর ২৪ ঘণ্টা নজরদারি রাখতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংককে অনুরোধ জানাচ্ছি।' গতকাল বুধবার রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে ইউনিপে টুইউর সাধারণ সদস্য ও ট্রেডার্স ফোরামের ব্যানারে সংবাদ সম্মেলনে কয়েকজন গ্রাহক এসব কথা বলেন।

উচ্চ মুনাফার প্রলোভনে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া ইউনিপে টুইউ নিজেদের স্বচ্ছতা তুলে ধরার জন্য কৌশলে কিছু গ্রাহককে দিয়ে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত থাকার অনুরোধ জানিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে পাঠানো দাওয়াতপত্রে কম্পানিটির ম্যানেজার (অপারেশন) মালিক হাসান নোমান স্বাক্ষর করলেও তিনি এবং কর্তৃপক্ষের কেউই উপস্থিত ছিলেন না। বরং তাঁদের পছন্দের কিছু গ্রাহক সংবাদ সম্মেলনে ইউনিপে টুইউর প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন!
পরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে তাঁরা স্বীকার করেছেন, বিনিয়োগ করা অর্থ নিয়ে ইউনিপে টুইউ প্রতারণা করতে পারে। এটা ভেবে তাঁরা আতঙ্কিত। অনলাইনে স্বর্ণ কেনার জন্য ইউনিপে টুইউ টাকা নিলেও ওই স্বর্ণ কোনো দিন কোনো গ্রাহক দেখতে পাবেন না। সকাল ১১টায় এ সংবাদ সম্মেলন শুরুর আগে ইউনিপে টুইউর প্রায় দুই হাজার সদস্য প্রেসক্লাবের সীমানার ভেতরে ঢুকে নিজেদের মধ্যে মারামারি এবং ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু করেন। প্রেসক্লাবের নিরাপত্তারক্ষীরা তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হওয়ার পর পুলিশ ও র‌্যাব এসে তাঁদের প্রেসক্লাব থেকে বের করে দেয়। সংবাদ সম্মেলনের পরও গ্রাহকরা বিভিন্ন গ্রুপে জোট বেঁধে পরস্পরের সঙ্গে তর্কাতর্কি ও ধাক্কাধাক্কি শুরু করেন।
সংবাদ সম্মেলন শেষে একজন গ্রাহক অভিযোগ করে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ইউনিপে টুইউ কর্তৃপক্ষ নিজেদের অবৈধ বাণিজ্য টিকিয়ে রাখার স্বার্থে এসব গ্রাহককে ব্যবহার করছে। কিছু লোককে ইউনিপে টুইউর পক্ষে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেওয়ার জন্য টাকা দেওয়া হয়েছে।'
আসাদুজ্জামান নামের এক গ্রাহক (আইডি নম্বর-বি-৮৪৬৫১১এফ) বলেন, 'মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম)-এর কথা বলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সময় গ্রাহকদের টাকা নিয়ে পালিয়েছে। আমরা প্রতারণার শিকার হতে চাই না। আমরা সরল বিশ্বাসে টাকা দিয়েছি, আমাদের বাঁচান।'
তিনি বলেন, 'ইতিমধ্যে ইউনিপে টুইউ প্রায় চার লাখ গ্রাহকের কাছ থেকে ৪৫০ কোটি টাকা নিয়েছে। এই টাকায় কঙ্বাজারের রামুতে রাবার বাগান, কঙ্বাজার সমুদ্রসৈকতে হোটেল নির্মাণের জন্য জায়গা, ঢাকার ধানমণ্ডিতে নিজস্ব ভবন ক্রয়, নরসিংদী ও ফরিদপুরে জমি কিনেছে কম্পানিটি। আমাদের বলা হয়েছে, অনলাইনে স্বর্ণ কিনতে টাকা দিলেই ১০ মাসে দ্বিগুণ অর্থ দেওয়া হবে; কিন্তু ওই স্বর্ণ কোনো দিন পাওয়া বা দেখা যাবে না।'
সংবাদ সম্মেলনে অংশ নিতে যশোর থেকে আসা আরেক সদস্য জাবেদ বলেন, 'গত ১৪ মাসে কম্পানিটি তাঁদের সঙ্গে কোনো প্রতারণা করেনি। ভবিষ্যতে যাতে প্রতারণা করতে না পারে_সেজন্য সরকারের নজরদারি চান দরকার।'
তাহের নামে এক সদস্য সংবাদ সম্মেলনে মূল বক্তব্যে ইউনিপে টুইউর প্রশংসা করে বলেন, 'কম্পানিটির উন্নতিতে ঈর্ষান্বিত হয়ে কিছু ব্যক্তি সরকারি সংস্থাকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা করছে। কোনো গ্রাহকই ক্ষতিগ্রস্ত বা প্রতারিত হননি।' ১০ মাসে দ্বিগুণ অর্থ কিভাবে কম্পানিটি তার গ্রাহকদের দিচ্ছে, তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'কম্পানি কিভাবে ব্যবসা করে তার গ্রাহকদের মুনাফা দেবে, তা কম্পানির নিজস্ব বিষয়। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে মুনাফা অর্জন ও বণ্টনে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার ক্ষমতা কোনো সংস্থার নেই। দুঃখজনক হলো, কিছু সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া ইউনিপে টুইউর বিরুদ্ধে বিভ্রান্তিকর সংবাদ প্রচার করছে।'

তথ্যবিভ্রাটও চালের দাম বাড়ায় by আশরাফুল হক রাজীব

Sunday, January 16, 2011

চাল ও গম উৎপাদনের যে তথ্য কৃষি মন্ত্রণালয় ও পরিসংখ্যান ব্যুরো দেয়, তা আমলে নিলে দেশে কোনো খাদ্যঘাটতির কথা থাকে না; বরং ২৫ থেকে ৩৩ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকে। কাজেই অর্থনীতির চিরায়ত সূত্র অনুযায়ী, বাজারে খাদ্য তথা চালের দাম না বেড়ে কমার কথা।

কিন্তু বাস্তবতা উল্টো। দেশে যে খাদ্য উদ্বৃত্ত নেই, বরং ঘাটতি রয়েছে, তার জলজ্যান্ত প্রমাণ হলো বাজার। এই ভরা মৌসুমেও বেশ কিছুদিন ধরে বাজারে চালের দাম বাড়ছেই। গত এক বছরে দাম বাড়ার এ হার ৪৯ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিভিন্ন দপ্তরের ভুল তথ্যের কারণে বাজারের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেই সরকারের। কারণ খাদ্য মন্ত্রণালয় যেসব তথ্যের ওপর ভিত্তি করে পরিকল্পনা করছে, তা সঠিক নয়। এ কারণে খাদ্যশস্য, বিশেষ করে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোনো পরিকল্পনাই কাজে আসছে না।
অর্থনীতির সূত্র অনুযায়ী, বাজারে খাদ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকলে দাম বাড়ার কথা নয়। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, খাদ্য উৎপাদনের যে বাম্পার ফলনের তথ্য সরকারের তরফ থেকে বলা হয়, তা আদৌ ঠিক কি না? অথবা চাহিদার যে হিসাব দেওয়া হচ্ছে, তা সঠিক কি না? কিংবা আরো যেসব জরুরি তথ্য রয়েছে, যেমনÑজনসংখ্যা, মাথাপিছু খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ ইত্যাদি, এগুলো সঠিক কি না, সে প্রশ্নও আছে। খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করলে এ চিত্রই ফুটে ওঠে।
খাদ্যমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক গত শনিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘খাদ্য পরিকল্পনার বিভিন্ন উপাদান, যেমনÑজনসংখ্যা, মাথাপিছু খাদ্য গ্রহণের চাহিদা অথবা খাদ্য উৎপাদনের পরিসংখ্যানে গোলমাল রয়েছে। এ কারণে পরিকল্পনার সঙ্গে বাস্তবতার কিছুটা অমিল রয়েছে। সমস্যাটি সমাধানের চেষ্টা করছি। আশা করি, চলতি বছরের আদমশুমারিতে এর সমাধান বের হয়ে আসবে।’
তবে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী গতকাল রবিবার কালের কণ্ঠকে জোর দিয়ে বলেন, ‘কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যে কোনো গলদ নেই। মাঠপর্যায় থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। আবার তথ্য সংগ্রহে স্পারসোর সহায়তাও নেওয়া হয়। সমস্যা যদি জনসংখ্যায় হয়, তাহলে আমার কিছু বলার নেই। মাথাপিছু খাদ্য গ্রহণের হারেও সমস্যা থাকতে পারে। তার পরও অস্বীকার করি না, খাদ্য উৎপাদনের পরিসংখ্যানে কিছু সমস্যা আছে। তবে সেটা দিন দিন কমে আসছে। সামনের দিনগুলোতে আরো কমে যাবে।’
কৃষিমন্ত্রী আরো বলেন, পরিসংখ্যানের জটিলতা থাকুক বা না থাকুক, বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে। এই তথ্য সরকারের নয়, এটা জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার। তারা বলেছে, গত দুই বছরে যে চার-পাঁচটি দেশের খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। সরকার কৃষিতে ভর্তুকি দিচ্ছে। ভরা মৌসুমে কৃষক ধানের দাম পাচ্ছে, যা আগে কখনো পায়নি। ঘূর্ণিঝড় আইলা এবং হওরে প্লাবন না হলে কৃষি উৎপাদন গত দুই বছরে কোথায় গিয়ে দাঁড়াত, তা মূল্যায়নের দায়িত্ব সাধারণ মানুষের ওপর ছেড়ে দিলাম।’
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর দেশে বোরো চালের উৎপাদন হয়েছে এক কোটি ৮৭ লাখ টন। আমন হয়েছে এক কোটি ৩৫ লাখ টন আর আউশ ২৫ লাখ টন। মোট উৎপাদন হয়েছে তিন কোটি ৪৭ লাখ টন চাল। এর মধ্যে ১২ ভাগ খাদ্যশস্য বীজ হিসেবে সংরক্ষণ এবং মাঠ থেকে আনা ও মাড়াই প্রক্রিয়ায় নষ্ট হয় বলে ধরা হয়। ফলে এ পরিমাণ খাদ্যশস্য বাজারে আসে না। এ অংশটুকু বাদ দিলে দেশে মোট খাদ্যশস্যের উৎপাদন তিন কোটি পাঁচ লাখ ৩৬ হাজার টন। এর সঙ্গে দেশে উৎপাদিত ১০ লাখ টন গম ও আমদানি করা ৩০ লাখ টন খাদ্যশস্য যোগ করলে মোট খাদ্যশস্যের পরিমাণ দাঁড়ায় তিন কোটি ৪৫ লাখ ৩৬ হাজার টন।
আর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, গত অর্থবছরে (২০০৯-১০) বোরো চাল এক কোটি ৮৩ লাখ টন, আমন এক কোটি ২২ লাখ টন, আউশ ১৭ লাখ টন এবং গমের উৎপাদন ছিল ৯ লাখ ৬৯ হাজার টন। মোট খাদ্যশস্যের উৎপাদন ছিল তিন কোটি ৩১ লাখ ৬৯ হাজার টন।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী দেশের জনসংখ্যা ১২ কোটি ৪৪ লাখ। তাদের গতকালের জনসংখ্যা-ঘড়ি অনুযায়ী দেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৪ কোটি ৯৮ লাখ ৭২ হাজার ৪৪৮ জন। অনেকের ধারণা, আসলে জনসংখ্যা হবে ১৬ কোটি। খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিটের হিসাব মতে প্রতিদিন মাথাপিছু খাদ্যশস্যের চাহিদা ৪৮৯ গ্রাম। অর্থনীতিবিদদের মতে, একজন মানুষের প্রতিদিনের খাদ্য চাহিদা ৫০০ গ্রাম। সেই হিসাবে ১৬ কোটি লোকের জন্য বছরে খাদ্য চাহিদার পরিমাণ দাঁড়ায় দুই কোটি ৯২ লাখ টন। এর মধ্যে প্রায় ২০ লাখ জনসংখ্যা রয়েছে, যাদের বয়স ছয় মাসের নিচে এবং যারা দানাদার খাদ্যশস্য গ্রহণ করে না। জনসংখ্যার এ অংশটুকু বাদ দিলে খাদ্য চাহিদার পরিমাণ দাঁড়ায় দুই কোটি ৮২ লাখ ৬৩০ টন।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের দেওয়া খাদ্যশস্যের উৎপাদনের হিসাব সঠিক হলে দেশে ৩৩ লাখ ৩৫ হাজার ৩৭০ টন খাদ্যশস্য উদ্বৃত্ত থাকার কথা। কাজেই আমদানি তো নয়ই বরং বাংলাদেশ খাদ্য রপ্তানি করতে পারে। আর বাজারে দাম বাড়ারও কারণ নেই।
ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক ও কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুব হোসেন বলেন, ‘চাহিদার চেয়ে জোগান বেশি হলে চালের দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। জোগান কম হলেই দাম বাড়ে। তাই বলা যায়, সঠিক তথ্যের অভাবে সরকারের পরিকল্পনা যথাযথ হয় না। খাদ্যের মতো একটি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তথ্যবিভ্রাট কারোই কাম্য নয়। বিষয়টি সরকারকে আমিও জানিয়েছি। কৃষি মন্ত্রণালয় মাঠকর্মী ও স্পারসোর মাধ্যমে যে পরিসংখ্যান সংগ্রহ করে তা প্রশ্নাতীত নয়। পরিসংখ্যান ব্যুরো জনসংখ্যার যে হিসাব দিচ্ছে তা নিয়ে অনেকের সন্দেহ থাকে। আর খাদ্য মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিট মাথাপিছু খাদ্য চাহিদার যে তথ্য দিচ্ছে তাও শতভাগ ঠিক নয়। এ অবস্থা চলতে দেওয়া উচিত নয়।’
খাদ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশে উৎপাদিত খাদ্য ও আমদানি করা চালের বাইরেও বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা বাংলাদেশকে খাদ্য সহায়তা দেয়, যা তারা বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে বিতরণ করছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, কৃৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের গ্রাম পর্যায়ের অফিসগুলোর উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার (ব্লক সুপারভাইজার) মাধ্যমে সরকার খাদ্যশস্যের তথ্য সংগ্রহ করে। কৃষক কতটুকু জমিতে কী ফসল চাষ করছে, উৎপাদন কেমন হতে পারে এবং ফসল কাটার সময় প্রকৃত উৎপাদন কেমন হলোÑসে হিসাব দিয়ে থাকেন তাঁরা। অভিযোগ রয়েছে, এসব কর্মকর্তা কৃষকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করেন না। জরিপের জন্য সর্বজনস্বীকৃত কোনো পন্থাও তাঁরা ব্যবহার করেন না। বড় একটি আবাদি মাঠের পাশে গিয়ে সেখানে কতটুকু জমি আছে লোকজনের কাছে শুনে এর ওপর ভিত্তি করে একটি আনুমানিক উৎপাদনের হিসাব দেন। অথবা আগে থেকে সংগ্রহ করা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে অফিসে বসেই একটি কাল্পনিক তথ্য সরকারকে দেন, যার ওপর ভিত্তি করে খাদ্য পরিকল্পনা করা হয়।
সাধারণত কৃষি মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যানের সঙ্গে পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যের মিল থাকে না। এ নিয়ে সব সরকারের সময়ই প্রশ্ন উঠেছে। গত চারদলীয় জোট সরকারের সময় অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান পরিসংখ্যানের অমিল দূর করার জন্য অনেক বৈঠক করেন। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে পরিসংখ্যানগত অমিল দূর করার জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটিও তাদের রিপোর্টে বিভিন্ন পরিসংখ্যানগত অমিলের জন্য খাদ্যমূল্য সংকটসহ নানা সংকট সৃষ্টির কথা তুলে ধরে। মহাজোট সরকারের কৃষিমন্ত্রীও গত বছর পরিসংখ্যান ব্যুরোর কর্মকর্তাদের ভর্ৎসনা করেন।
একজন কৃষি অর্থনীতিবিদ জানান, কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে যদি বোরো মৌসুমে বাম্পার ফলনই হবে তাহলে চালের দাম চড়া থাকার কোনো কারণ নাই। কৃষক, ব্যবসায়ী বা মজুদদাররা যদি মজুদও করে থাকেন তা সাধারণত আমন মৌসুম পর্যন্ত ধরে রাখেন। অথচ এবার আমন মৌসুমে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে উৎপাদন ভালো হওয়ার কথা জানানোর পরই চালের বাজার ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। এমন নজির খুব কম রয়েছে। অপরদিকে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের চালের বাজারের তেমন পার্থক্য নেই। তাই ভারত থেকে বৈধ বা অবৈধ কোনোভাবেই তেমন একটা চাল আসছে বা যাচ্ছে না। তাহলে বিপুল পরিমাণ উৎপাদিত খাদ্যশস্য কোথায় যাচ্ছে?

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা by আকবর আলি খান

Saturday, January 15, 2011

৯৬০-এর দশকে যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ডাক দেয়া হয় তখন পাকিস্তানের অর্থনীতিবিদদের পক্ষ থেকে প্রচার করা হয়, বাংলাদেশের জন্য স্বাধীনতা অর্থনীতির দিক থেকে আত্মঘাতী হবে। তারা এমন একটি ধারণা দিয়েছিলেন যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হলে সেই অর্থনীতি টিকে থাকতে পারবে না।

তার সাথে সাথে আরো দুটি ধারণার সৃষ্টি করা হয়েছিল যে, বাংলাদেশের পক্ষে দ্রুত বর্ধমান জনসংখ্যা হ্রাস করা সম্ভব হবে না। ফলে জনসংখ্যার চাপে ক্ষুদ্র ভূ-খণ্ডে বাংলাদেশের অর্থনীতির মুখ থুবড়ে পড়বে। সবশেষে পাকিস্তানি অর্থনীতিবিদরা ও তাদের পশ্চিমা দোসররা প্রচার করেন, বাংলাদেশের পক্ষে বৈদেশিক সাহায্য ছাড়া আদৌ টিকে থাকা সম্ভব হবে না।

দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রায় চলিস্নশ বছর পূর্ণ হতে চলছে। এই চার দশকের অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে আমরা তখনকার পাকিস্তানি অর্থনীতিবিদ ও তাদের দোসরদের বক্তব্যের যথার্থতা বিচার করতে পারি। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত সে সময়কার পূর্ব-পাকিস্তান পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত ছিল, এই সময়ে ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত সময়কালে সাবেক পূর্ব-পাকিস্তানে মাথাপিছু স্থূল জাতীয় উৎপাদের হিসাব রয়েছে। প্রায়ত স্বদেশ বোসের হিসাব অনুসারে ১৯৮৯-৫০ সালে পূর্ব-পাকিস্তানে মাথাপিছু স্থূল জাতীয় উৎপাদ ছিল ৩১০ রুপি। ১৯৫৪-৫৫ সালে এই মাথাপিছু আয় কমে ৩০০ রুপিতে দাঁড়ায়। ১৯৫৪-৫৫ সময়কাল হতে ১৯৫৯-৬০ সময়কালে মাথাপিছু উৎপাদ আরো কমে ২৬৯ রুপিতে দাঁড়ায়। ১৯৬০ সাল থেকে অর্থাৎ আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের পর মাথাপিছু স্থূল জাতীয় উৎপাদ পরিমাণ বাড়তে থাকে। এ সংখ্যা ১৯৬৪-৬৫ সালে ২৮৩ রুপিতে উন্নীত হয়। ১৯৬৯-৭০ সালে এই সংখ্যা ৩১৪ রুপিতে দাঁড়ায়। অর্থাৎ ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ২০ বছর সময়কালে বাংলাদেশে মাথাপিছু উৎপাদ ৩২০ রুপি হতে ৩১৪ রুপিতে উন্নীত হয়। অর্থাৎ সংখ্যাতত্ত্বের ভাষায় এই ২০ বছর বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় প্রায় স্থির ছিল। পক্ষান্তরে বর্তমান পাকিস্তানে (যা তখন পশ্চিম পাকিস্তান নামে পরিচিত ছিল) ১৯৪৯-৫০ সালে মাথাপিছু আয় ছিল ৩২৪ রুপি। ২০ বছর পর অর্থাৎ ১৯৬৯-৭০ সালে পাকিস্তানের মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ ছিল ৫০৪ রুপি। অর্থাৎ পাকিস্তানে গড়ে তিন শতাংশ হারে মাথাপিছু আয় বেড়েছিল। অথচ বাংলাদেশে মাথাপিছু আয়ের অগ্রগতি ঘটে এবং পরবর্তী সময়ে কোনোক্রমে ১৯৪৯-৫০-এ মাথাপিছু আয় সমান হওয়া সম্ভব হয়।

স্বাধীনতা পূর্ববতর্ী ২০ বছরের সাথে যদি আমরা বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা তুলনা করি তাহলে নিম্নলিখিত প্রবণতাগুলো দেখতে পাই :

ক) অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি : ১৯৭৫ সাল থেকে ২০০৫ সময়কালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। হিসাব করলে দেখা যাবে, স্বাধীনতা পূর্বকালে সাবেক পূর্ব-পাকিস্তানে ২০ বছরে যে পরিমাণ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে তার চেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে প্রতি বছরেই হয়েছে। ত্রিশ বছরে মাথাপিছু আয় দ্বিগুণ হওয়া নেহাৎ অকিঞ্চিতকর নয়। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে, শিল্প-বিপস্নবের সময় যুক্তরাজ্যে প্রথমবার মাথাপিছু আয় দ্বিগুণ হতে ৫৭ বছর সময় লেগেছিল।

খ) গড় আয়ুর প্রত্যাশা বৃদ্ধি : বিশ্ব উন্নয়ন প্রতিবেদন অনুসারে ১৯৬০ সালে বাংলাদেশের গড় আয়ুর প্রত্যাশা ছিল ৪২ বছর। সেই সময়ে পাকিস্তানে গড় আয়ু ছিল ৪৪ বছর। সর্বশেষ হিসাব অনুসারে পাকিস্তানের গড় আয়ু ৬৫ বছর। আর বাংলাদেশের গড় আয়ুর প্রত্যাশা ৬৪ বছর। (২০০৯ সালে বিশ্বব্যাংকের দেয়া হিসাব অনুযায়ী)।

গ) জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধি : গড় আয়ুর প্রত্যাশা বেড়ে যাওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধির হার কমে এসেছে। অথচ সত্তরের দশকে অনুমান করা হয়েছিল যে, বাংলাদেশের মতো কৃষিপ্রধান অনুন্নত দেশে জনসংখ্যার বৃদ্ধি কমানো সম্ভব হবে না। ১৯৬৯-৭০ সালে পূর্ব-পাকিস্তানে মোট জনসংখ্যা ছিল ছয় কোটি ছিয়ানব্বই লক্ষ আর পশ্চিম পাকিস্তানে জনসংখ্যা ছিল পাঁচ কোটি আটাশি লক্ষ। ২০০৭ সালে পাকিস্তানের জনসংখ্যা ষোল কোটি বিশ লক্ষ। অন্যদিকে বাংলাদেশে জনসংখ্যা ছিল পনের কোটি নব্বই লক্ষ। অর্থাৎ যদি বাংলাদেশ স্বাধীন না হতো তাহলে সাবেক পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানের একটি সংখ্যালঘু প্রদেশে পরিণত হতো। শুধু জনসংখ্যার দিক দিয়েই নয়, খাদ্য উৎপাদনেও বাংলাদেশের সাফল্য ঈর্ষণীয়। ১৯৬৪-৬৫ সালে সাবেক পূর্ব-পাকিস্তানে মোট খাদ্য উৎপাদন ছিল এক কোটি চার লক্ষ টন। ২০০১ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত এই সময়ের পরে খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ হলো ২.৬৫ কোটি টন। একই সময়ে পাকিস্তানে খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ ২.৬৪ কোটি টন।

বাংলাদেশ সম্বন্ধে সবচেয়ে অপপ্রচার করা হয়েছে বাংলাদেশের বৈদেশিক সাহায্যের নির্ভরশীলতা প্রসঙ্গে। এ কথা সত্য, স্বাধীনতার ঊষালগ্নে যখন পাকিস্তান সকল বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কুক্ষিগত করে নেয় তখন বাধ্য হয়ে বাংলাদেশকে বিদেশি সাহায্যের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। আজকে এই পরিস্থিতি নেই। ২০০৭ সালে বাংলাদেশে মাথাপিছু বৈদেশিক সাহায্য ছিল নয় ডলার। এই সময়ে পাকিস্তানে মাথাপিছু বৈদেশিক সাহায্য প্রাপ্তি ছিল চৌদ্দ ডলার। একই সময়ে উন্নয়নশীল দেশসমূহে মাথাপিছু বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ ছিল একত্রিশ ডলার।

পৃথিবীর উন্নয়নশীল দেশগুলোর শতকরা আশিভাগ দেশ বাংলাদেশের চেয়ে বেশি বৈদেশিক সাহায্য পেয়ে থাকে।

উপরের আলোচনা হতে এ কথা সুস্পষ্ট যে, স্বাধীনতার পূর্বকারে সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অনেক ব্যাপক ও আশাব্যঞ্জক। পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক কাঠামোতে এ ধরনের প্রবৃদ্ধি আদৌ সম্ভব হতো না। যদিও সম্পদের সুষম বণ্টনের সমস্যা বাংলাদেশে রয়েছে তবুও এ কথা অস্বীকারের উপায় নেই যে, প্রবৃদ্ধির সোনার ফসল সাধারণ মানুষের কাছেও পেঁৗছেছে। ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করতো। এখন এই হার ৪০ শতাংশে নেমে এসেেছ। পৃথিবীর অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় এসব অর্জন অবশ্যই ঈর্ষণীয়।

গত চার দশকের এসব লক্ষণীয় অর্জন সত্ত্বেও এখনো অনেকগুলো সমস্যা রয়ে গিয়েছে। বিশ্বের মাথাপিছু আয়ের তুলনায় বাংলাদেশের মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ এখনো অনেক কম। বাংলাদেশে ভূমিসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের পরিমাণ অত্যন্ত অপ্রতুল। এখানে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামোর প্রচণ্ড ঘাটতি রয়েছে। উন্নত দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের বৈষম্য ক্রমেই বাড়ছে। এই প্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠতে পারে, বাংলাদেশ আদৌ উন্নত দেশের কাতারে উঠে আসতে পারবে কি না? আমি অবশ্য এ বিষয়ে আশাবাদী। আমার আশাবাদের কারণ দুটি_একটি হলো, তাত্তি্বক, আরেকটি হলো ঐতিহাসিক।

তাত্তি্বক ব্যাখ্যাটি উপস্থাপন করেছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত অধ্যাপক আলেকজান্ডার গ্রাসচেনক্রনে, তার বক্তব্য হলো যে, শিল্প-বিপস্নবের প্রথম পর্যায়ে যেসব রাষ্ট্র অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছেন তাদের প্রবৃদ্ধি ছিল শস্নথ। উন্নয়নের অগ্রপথিক হিসাবে তাদেরকে ভুল-ভ্রান্তি সংশোধন করে অগ্রগতির পথে এগোতে হয়েছে। কিন্তু যেসব দেশ পরবর্তী পর্যায়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেন তাদের পক্ষে নতুন করে নিজেদের ভুল থেকে শিখতে হবে না। তারা অন্যদের ভুলের ইতিহাস মনে রেখে এবং সর্বশেষ কারিগরি জ্ঞান প্রয়োগ করে উন্নতি করতে পারবেন।

ষাটের দশকে যখন এই তথ্য উপস্থাপন করা হয় তখন অনেকেই এর যথার্থতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু বিগত পাঁচ দশকের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে এই অনুমানই সঠিক। অন্যথায় ভারত ও চীনের পক্ষে এত বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হতো না। আমরা ইতিহাসে যাকে প্রথম শিল্প-বিপস্নব বলি সেটি ঘটেছিল যুক্তরাজ্যে। সেই সময়ে যুক্তরাজ্যের জনসংখ্যা ছিল প্রায় এক কোটি। এই জনসংখ্যার মাথাপিছু আয় ৫৭ বছর সময়ের মধ্যে দ্বিগুণ করা হয়। এতেই সারা বিশ্বে হৈ চৈ পড়ে যায়। অথচ আমাদের চোখের সামনে প্রায় ১৩০ কোটি জনসংখ্যা নিয়ে দশ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ দ্বিগুণ করেছে প্রায় ১২০ কোটি জনসংখ্যা নিয়ে ভারতেও আমরা একই ধরনের পরিস্থিতি দেখেছি। ভারত ও চীন যা করতে পারে বাংলাদেশের পক্ষেও সেটা করতে পারা উচিত। তবে তার জন্য প্রয়োজন সঠিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সুষ্ঠু অর্থনৈতিক নীতিমালা। এই দুটির সমন্বয় করতে পারলে বাংলাদেশের সৃজনশীল মানুষ একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে পারবে।

শেয়ারবাজারে বিকিকিনির নানা কৌশল by সুজয় মহাজন

তুন বছরের শুরুতেই দরপতন আর মূল্যবৃদ্ধির সর্বোচ্চ রেকর্ড দেখেছেন দেশের শেয়ারবাজারের লাখ লাখ বিনিয়োগকারী। তালিকাভুক্ত কোম্পানির অনেকগুলো কখনো দাম কমার নিম্নতম স্তর ছুঁয়েছে। পরের দিনই দাম বাড়ার সর্বোচ্চ মূল্যস্তর ছুঁয়েছে অনেক কোম্পানি। (মূলত সার্কিট ব্রেকার বা মূল্যহার সীমার মাধ্যমে প্রতি শেয়ারের দাম বাড়া-কমার সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন স্তর নির্ধারণ করে দেওয়া হয়)।

এতে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত অনেক কোম্পানির ক্রেতা-বিক্রেতা শূন্য হয়ে পড়ার দৃশ্যও দেখেছেন বিনিয়োগকারীরা। বিনিয়োগকারীদের আত্মবিশ্বাসকে ঘিরেই বাজারে এমনটি ঘটেছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান।
গত সোমবার দেশের শেয়ারবাজারে ভয়াবহ দরপতন ঘটে। মাত্র ৫০ মিনিটে প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে ৬৩৫ পয়েন্ট সূচক কমে যায়। ওই দিন লেনদেন হওয়া ২২৩ কোম্পানির মধ্যে ৫০টিরও বেশি কোম্পানির শেয়ারের ক্রেতা ছিল না। আর মঙ্গলবার ঘটে ঠিক উল্টো ঘটনা। ২৪৮ কোম্পানির মধ্যে ১৯৫টি কোম্পানি বিক্রেতাশূন্য হয়ে পড়ে।
সোমবার ডিএসইতে দাম কমার সর্বনিম্ন স্তর স্পর্শ করেছিল সায়হাম টেক্সটাইল। কোম্পানিটির বাজারদর প্রায় ২০ শতাংশ কমে যায়। কোম্পানিটির ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের শেয়ারের দাম ১২৮ থেকে কমে ১০১ টাকায় নেমে আসে। এতে কোম্পানির শেয়ার ক্রেতাশূন্য হয়ে যায়। কেননা, ক্রেতারা এই ভেবে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল যে, এভাবে পরের দিনগুলোয় দাম আরও কমবে।
পরের দিন মঙ্গলবার সায়হাম টেক্সটাইলের শেয়ার লেনদেনে উল্টো ঘটনা ঘটে। ওই দিন লেনদেন শুরুর কয়েক মিনিটের মধ্যে বিক্রেতাশূন্য হয়ে পড়ে। অল্প কিছু শেয়ার লেনদেনের পরই ওই শেয়ারের আর কোনো বিক্রেতা ছিল না। ততক্ষণে অবশ্য কোম্পানির প্রতিটি শেয়ারের দাম ওই দিনের সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ মূল্যস্তর স্পর্শ করে। কিন্তু বিক্রেতাদের মধ্যে প্রত্যাশা জন্মে যায় যে, পরের দিনগুলোয় আরও বাড়বে। তাই ওই দিনের সর্বোচ্চ সীমার দরেও কেউ বিক্রি করতে রাজি হননি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক ও ডিএসইর সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) অধ্যাপক সালাহউদ্দিন আহমেদ খান বলেন, ‘আমাদের বাজার এখনো অতিমাত্রায় ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীনির্ভর। এ কারণে বাজারে অস্বাভাবিক দরপতন ও মূল্যবৃদ্ধির ঘটনা ঘটে। বাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর অংশগ্রহণ যত বেশি শক্তিশালী হবে, এই প্রবণতা ততই কমে আসবে।’
ক্রেতা-বিক্রেতার দরকষাকষি: নিত্যপণ্যের বাজারের মতো শেয়ারবাজারেও প্রতিদিন ক্রেতা-বিক্রেতার দরকষাকষির ঘটনা ঘটে। তবে এটি হয় প্রযুক্তির সহায়তায়, যেখানে ক্রেতা-বিক্রেতা একে অপরকে চেনেন না।
ডিএসইতে ক্রেতা-বিক্রেতার দরকষাকষিতে ব্যবহার করা হয় ‘টেসা’ নামের একটি সফটওয়্যার। কম্পিউটারের পর্দায় যখন এই সফটওয়্যারভিত্তিক লেনদেন চলতে থাকে, তখন এর বাম পাশে থাকে ক্রেতা, আর ডান পাশে বিক্রেতা। ক্রেতা-বিক্রেতার ডান-বাম এই অবস্থানকে ঘিরে শেয়ারবাজারে প্রচলিত আছে ‘ডানে মারেন, বামে মারেন’ প্রবাদ। যাঁরা শেয়ারবাজারে নিত্যদিনের লেনদেনের সঙ্গে জড়িত, তাঁরাই শুধু এর অর্থ বোঝেন। বামে মারেন মানে, কোনো দরাদরি ছাড়াই বিক্রি করে দেওয়া। আর ডানে মারেন মানে, বিক্রেতা দরকষাকষি করতে চান।
স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতির এই দরকষাকষিতে কখনো বিক্রেতা আবার কখনো ক্রেতা লাভবান হন। সাধারণ বাজারের মতো এখানেও ক্রেতা-বিক্রেতার বনিবনা হলেই কেনাবেচা হয়। পণ্যবাজারের মতোই শেয়ারবাজারের সরবরাহ তথা বিক্রেতা বেড়ে গেলে দাম কমতে থাকে। একইভাবে ক্রেতা বাড়লে দাম বাড়তে থাকে। স্বাভাবিক এই প্রক্রিয়ার বাইরে কখনো কখনো কৃত্রিমভাবেও দাম বাড়ানোর ঘটনা ঘটে শেয়ারবাজারে। তবে শেয়ারবাজারের দাম নিয়ে দেনদরবারের স্বাভাবিক ধারার সঙ্গে বিনিয়োগকারীর ‘আত্মবিশ্বাসের’ রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি দেখা দিলে বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে আর আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে থাকলে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়ে বাজারে।
গত সোম ও মঙ্গলবার পরপর দুই দিনে দেশের শেয়ারবাজারে এরই প্রতিফলন ঘটেছে। বিনিয়োগকারীদের আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলায় সোমবার বাজারে রেকর্ড পরিমাণ দরপতন হয়েছিল। ওই দিন মাত্র ৫০ মিনিটের লেনদেনে ডিএসইতে সূচক ৬৩৫ পয়েন্ট কমে যায়। পতনের এই ভয়াবহতা ঠেকাতে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) প্রথমবারের মতো লেনদেন বন্ধ করে দেয়। আর মঙ্গলবার হারানো আত্মবিশ্বাস ফিরে পান বিনিয়োগকারীরা। ফলে এই দুই দিনে বাজারে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শেয়ার ক্রেতা-বিক্রেতা শূন্য হয়ে পড়ে।
বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, যখন বিনিয়োগকারীদের বেশির ভাগ অংশ ভীত হয়ে শেয়ার বিক্রি করতে শুরু করেন, তখন ক্রেতা কমতে থাকে। ভীতির মাত্রা বেড়ে গেলে একপর্যায়ে ট্রেড সার্ভারের বাঁয়ে থাকা ক্রেতা আর খুঁজে পাওয়া যায় না। একই ঘটনা ঘটে আত্মবিশ্বাসের মাত্রা অনেক বেড়ে গেলে। তখন সার্ভারের ডানে থাকা বিক্রেতাদের মধ্যে শেয়ার ধরে রাখা বা মজুদের প্রবণতা বেড়ে যায়। এখানেও বড় বড় বিনিয়োগকারী অনেকটা সাধারণ বাজারের মজুদদারের মতো আচরণ করেন। মঙ্গলবার লেনদেনের শুরুতেই বেশির ভাগ শেয়ার দাম বাড়ার সর্বোচ্চ সীমা স্পর্শ করার পর বেশির ভাগ বিনিয়োগকারীর মধ্যে আরও দাম বাড়বে—এমন প্রবণতা তৈরি হয়।
ডিএসইর সভাপতি শাকিল রিজভীর মতে, ‘বাজারের কয়েক দিনের ভয়াবহ দরপতনের পর মঙ্গলবার বেশির ভাগ শেয়ারের বিক্রেতাশূন্য হয়ে পড়ার ঘটনাটি খুবই স্বাভাবিক। কারণ, এর আগেই নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। যাতে বিনিয়োগকারীরা আস্থা ফিরে পেয়েছেন।’
শেয়ারের দাম বাড়া-কমার ব্যবধান নিয়ন্ত্রণে তালিকাভুক্ত প্রতিটি শেয়ারের ওপরই সার্কিট ব্রেকার বা মূল্যস্তর নির্ধারণ করে দেওয়া থাকে। কোম্পানিভেদে এই সীমা ভিন্ন।
দাম বাড়া-কমার মূল্যস্তর: ডিএসইর হিসাব অনুযায়ী, যেসব শেয়ারের বাজারমূল্য ১০০ থেকে ২০০ টাকার মধ্যে, সেসব শেয়ারের সার্কিট ব্রেকার (মূল্যস্তর) থাকে ২০ শতাংশ বা ৩৫ টাকা। অর্থাৎ উল্লিখিত দামের মধ্যে থাকা কোনো কোম্পানির শেয়ার এক দিনে ২০ শতাংশ বা ৩৫ টাকার বেশি কমতে বা বাড়তে পারবে না। এভাবে যেসব কোম্পানির শেয়ারের দাম ২০১ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে, সেসব শেয়ারের মূল্যস্তর নির্ধারিত সাড়ে ৭৫ টাকা বা ১৭ শতাংশ; ৫০১ থেকে এক হাজার টাকার মধ্যকার কোম্পানির শেয়ারের মূল্যস্তর ১২৫ টাকা বা ১৫ শতাংশ; এক হাজার থেকে দুই হাজার টাকার মধ্যকার কোম্পানির শেয়ারের মূল্যস্তর ২০০ টাকা বা সাড়ে ১২ শতাংশ; দুই হাজার এক টাকা থেকে পাঁচ হাজার টাকার মধ্যকার কোম্পানির শেয়ারের মূল্যস্তর ৩৭৫ টাকা বা ১০ শতাংশ এবং পাঁচ হাজার টাকার ওপরে বাজারদর এমন কোম্পানির শেয়ারের মূল্যস্তর ৬০০ টাকা বা সাড়ে ৭ শতাংশ।
বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, যখন বাজারে ধারাবাহিকভাবে দরপতন ঘটতে থাকে, তখন বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ভীতিও বাড়তে থাকে। তখন বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শেয়ার বিক্রির প্রবণতা বেড়ে যায়। কার আগে কে শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে বের হবেন, সেই প্রতিযোগিতা চলতে থাকে।
বাজারের এই বিপরীত চিত্র সম্পর্কে জানতে চাইলে ডিএসইর সভাপতি শাকিল রিজভী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিনিয়োগকারীরা যখন চরম ভীত হয়ে পড়েন, তখন বাজারে বিক্রেতা বেড়ে যায়। তখন বেশির ভাগ বিনিয়োগকারী নিজের হাতে থাকা শেয়ার অন্যদের আগে বিক্রি করতে চান। এ সময় শেয়ার ধরে রাখার ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন তাঁরা। আবার দাম যখন বাড়তে থাকে, তখন বিনিয়োগকারীদের আত্মবিশ্বাসও অনেক বেড়ে যায়। এতে বেশির ভাগ বিনিয়োগকারীর মধ্যে শেয়ার ধরে রাখার প্রবণতা তৈরি হয়। এই দুই প্রবণতার অসামঞ্জস্যতায় বাজার অস্বাভাবিক আচরণ করে।’
কেনা-বেচার বিশেষ পন্থা: শেয়ারবাজারে যারা বড় বিনিয়োগকারী, তাঁরা সাধারণ বা ছোট বিনিয়োগকারীদের চোখ ফাঁকি দিতে সময়ে সময়ে বিশেষ পন্থা অবলম্বন করেন। তেমনি দুটি পন্থা হলো ফিল অ্যান্ড কিল এবং ড্রিপ। শেয়ার কেনা-বেচা উভয় ক্ষেত্রেই এই দুটি পন্থা ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বড় অঙ্কের শেয়ার কেনা-বেচার ক্ষেত্রেই এই পন্থা অবলম্বন করা হয়।
ট্রেড সার্ভারের সামনে বসে থাকা সাধারণ বিনিয়োগকারীরা যাতে বড় বিনিয়োগকারীদের কেনা-বেচার খেলা সহজে বুঝতে না পারেন, সে জন্য এই দুটি পন্থার ব্যবহার হয়ে থাকে। ফিল অ্যান্ড কিলে একসঙ্গে অনেক শেয়ার কেনা-বেচার সুযোগ থাকে। আর ড্রিপ পন্থায় ধাপে ধাপে শেয়ার কেনা-বেচা হয়। সফটওয়্যারেই এসব পন্থা স্থাপন করে দেওয়া আছে। তবে বড় ধরনের কেনা-বেচার ক্ষেত্রেই এসব পন্থা ব্যবহারের সুযোগ মেলে। এতে করে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বুঝতে পারেন না আরেকজন বড় বিনিয়োগকারী এক আদেশে কী পরিমাণ শেয়ার কিনলেন বা বিক্রি করলেন।
একসঙ্গে অধিক পরিমাণ শেয়ারের ক্রয় বা বিক্রয় আদেশ দেখে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ওই শেয়ার নিয়ে কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়েন। বেশি শেয়ারের ক্রয় আদেশ দেখলে বিক্রেতা সাবধান হয়ে যান। তাঁরা তখন দরকষাকষি করতে থাকেন দাম বাড়ানোর জন্য। আর বড় বিক্রয় আদেশ দেখলে ক্রেতারা দাম কমানোর জন্য দরকষাকষি করেন। এভাবে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা যাতে শেয়ার কেনা-বেচায় খুব বেশি দরকষাকষির সুযোগ না নিতে পারেন, সে জন্য ‘ফিল অ্যান্ড কিল’ ও ‘ড্রিপ’ পন্থা অবলম্বন করেন বড় বিনিয়োগকারীরা।
ধরা যাক, একজন বিক্রেতা একটি নির্দিষ্ট দামে (এক হাজার টাকা) কোনো কোম্পানির এক লাখ শেয়ার বিক্রি করতে চান। তখন তিনি ড্রিপ অনুসরণ করবেন। এটা করতে গিয়ে তিনি এক লাখ শেয়ারেরই বিক্রয় আদেশ দেবেন, কিন্তু ড্রিপ দেবেন এক হাজার শেয়ার। অর্থাৎ ক্রেতারা পর্দায় দেখতে পাবেন যে এক হাজার টাকা দরে এক হাজার শেয়ার বিক্রি হবে। এভাবে যতক্ষণ না এক লাখ শেয়ার বিক্রি শেষ হচ্ছে, ততক্ষণ পর্দায় ওই দর ও পরিমাণ ভাসতে থাকবে। তারপর তা অদৃশ্য হয়ে যাবে। ক্রেতারা বুঝতেই পারবেন না যে আসলে এক লাখ শেয়ার বিক্রির আদেশ দেওয়া ছিল। একইভাবে বড় ক্রেতা ড্রিপ দিয়ে বিপুল পরিমাণ শেয়ার কিনতে পারেন।
আবার একজন ক্রেতা এক লাখ শেয়ার কিনতে চান। তখন বাজারে ওই শেয়ারের বিভিন্ন দামে বিভিন্ন পরিমাণ বিক্রির আদেশ রয়েছে। যেমন: ৯০০ টাকায় এক হাজার শেয়ার, ৯২৫ টাকায় দেড় হাজার শেয়ার ইত্যাদি। দেখা গেল, এভাবে ৯০০ থেকে এক হাজার ১০০ টাকায় মোট এক লাখ শেয়ার বিক্রির আদেশ রয়েছে। ফিল অ্যান্ড কিল অনুসরণ করে ক্রেতা এক হাজার ১০০ টাকা দরে ক্রয় আদেশ দিয়ে দেবেন। এতে করে ওই কোম্পানির সব শেয়ার (যেগুলো বিক্রয় আদেশ দেওয়া আছে) ক্রেতার কাছে চলে যাবে। যদি এক লাখ শেয়ারের কম পরিমাণ (যেমন ৭০ হাজার) বিক্রয় আদেশ থাকে, তাহলে ওই ৭০ হাজারই ক্রেতা পাবেন। বাকি ৩০ হাজার ক্রয় আদেশ বাতিল হবে; যাকে বলা হচ্ছে কিল। আর যা পেলেন, তা হলো তার ফিল।

শেয়ারবাজারে ধস বিক্ষোভে উত্তাল বিনিয়োগকারীরা

Sunday, January 9, 2011

শেয়ারবাজারে স্মরণকালের দরপতন দেখলেন লাখ লাখ বিনিয়োগকারী। গতকাল রবিবার দুই স্টক এক্সচেঞ্জে চোখের সামনে মিনিটে মিনিটে শেয়ারের দাম কমার দৃশ্য দেখে তাঁরা হয়ে পড়েন হতবিহ্বল, ক্ষুব্ধ। ফলে ঢাকার বাইরে বড় শহরগুলোতে রাস্তায় নেমে আসেন বহু বিনিয়োগকারী।

কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে রাজশাহীতে ১০টি ব্রোকারেজ হাউসের শাখায় তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। সিলেটে অসংখ্য বিনিয়োগকারী লেনদেন বন্ধ রাখেন। তাঁরা সমাবেশে ঘোষণা দিয়েছেন, এমনটি আজ সোমবারও চলতে থাকলে তাঁরা লেনদেন একেবারেই বর্জন করবেন।
গতকাল প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) এক দিনেই শেয়ারের সাধারণ মূল্যসূচক কমেছে প্রায় ৬০০ পয়েন্ট বা পৌনে ৮ শতাংশ। এটি এখন পর্যন্ত শেয়ারবাজারের ইতিহাসে এক দিনে সূচকের সর্বোচ্চ পতন। এর আগে গত ১৯ ডিসেম্বর এক দিনে ডিএসইর সাধারণ সূচক ৫৫২ পয়েন্ট বা ৭ শতাংশ কমেছিল।
শেয়ারবাজারের গত কয়েক দিনের দরপতনের ঘটনাকে ’৯৬ সালের শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির সময়কার পতনের চেয়ে ভয়াবহ উল্লেখ করেছেন অনেকে। ওই সময় সাত-আট মাসে ডিএসইর সূচক ৩ হাজার ৬০০ পয়েন্ট থেকে কমতে কমতে একপর্যায়ে ৪৬২ পয়েন্টে নেমে আসে। অবশ্য ১৯৯৬ সালের তুলনায় এখন বাজার অনেক বেশি বিস্তৃত। তালিকাভুক্ত কম্পানি ও বিনিয়োগকারীর সংখ্যাও এখন বাজারে ’৯৬-এর তুলনায় অনেক বেশি। সূচকের গণনাও ’৯৬ সালের মতো না।
এদিকে, গত ৩ জানুয়ারি থেকে ধারাবাহিক দরপতনের শুরু। সেই থেকে গতকাল পর্যন্ত পাঁচ কার্যদিবসে ডিএসইর সাধারণ সূচক কমেছে ১১৬৯ পয়েন্ট। ৩ জানুয়ারি লেনদেনের শুরুতে ডিএসইর সূচক ছিল প্রায় ৮৩০৪ পয়েন্টে। গতকাল লেনদেন শেষে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৭১৩৫ পয়েন্টে।
গতকালের দরপতনের ভয়াবহতা এতটাই ব্যাপক ছিল যে ঢাকার বাজারে লেনদেন হওয়া কম্পানিগুলোর মধ্যে তিনটি বাদে সবকটিরই দাম কমেছে। সকালের পর অনেক শেয়ারের কোনো ক্রেতাই ছিল না। বিক্রেতা থাকলেও ক্রেতাশূন্যতায় ওই সব কম্পানির শেয়ার লেনদেন বন্ধ হয়ে যায়।
এদিকে ধারাবাহিক দরপতনকে ঘিরে গত সপ্তাহের শেষ দুই দিন রাজধানীর মতিঝিলে বিনিয়োগকারীরা ব্যাপক বিক্ষোভ করলেও গতকাল তেমন হয়নি। সকাল থেকেই ডিএসই ভবনের সামনের সড়কে পুলিশ, র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুল সদস্য অবস্থান নেয়। বেশ কয়েকদফা বিনিয়োগকারীরা দরপতনের প্রতিবাদে ডিএসইর ভবনের সামনে জড়ো হওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। একপর্যায়ে কিছু বিনিয়োগকারী ডিএসই ভবনের সামনের সড়কে শুয়ে পড়েন। কিন্তু পাঁচ মিনিটের মধ্যে পুলিশ তাঁদের রাস্তা থেকে সরিয়ে দেন। এ সময় পুলিশ মামুন নামের এক বিনিয়োগকারীকে আটক করে। বিক্ষোভ না হলেও মতিঝিল পাড়ার অবস্থা ছিল কিছুটা থমথমে।
পুঁজিবাজারসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের মধ্যেই ছিল দরপতনের আশঙ্কা। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) মধ্যেও ছিল উদ্বেগ। এ কারণে গতকাল লেনদেন শুরুর আগেই সংশ্লিষ্টদের নিয়ে সকাল সাড়ে ৯টায় জরুরি বৈঠকে বসে এসইসি। সেই বৈঠকে পতন ঠেকাতে তিনটি সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়। বৈঠক শেষে এসইসির চেয়ারম্যান জিয়াউল হক খোন্দকার নিজেই সংবাদ মাধ্যমে বক্তব্য দেন। বিনিয়োগকারীদের ধৈর্য ধরার আহ্বান জানান তিনি। কিন্তু সেই আহ্বানও বেশ কিছুদিন ধরে আস্থার সংকটে ভুগতে থাকা বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করতে পারেনি। ফলে এর প্রভাব পড়তে থাকে বাজারে। কমতে থাকে শেয়ারের দাম। সেই সঙ্গে মূল্যসূচকও। চার ঘণ্টার লেনদেনকালীন মাঝেমধ্যে সূচকের পতনের ব্যবধান কমানোর দৃশ্য দেখা গেলেও সেটি ছিল সাময়িক। দিনের শেষভাগে সূচকের ভয়াবহ পতন ঘটতে থাকে।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ : শেয়ারবাজারের ধারাবাহিক এই পতন সরকারের মধ্যেও তোলপাড় সৃষ্টি করে। এ কারণে গতকাল মন্ত্রিসভা বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। ওই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নিজেই পতন রোধে প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অর্থমন্ত্রীকে নির্দেশ দেন। বৈঠক সূত্র প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশনার খবরের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
মন্ত্রিসভা বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী ব্যাংক ঋণের টাকা অবাধে যাতে পুঁজিবাজারের মতো ঝুঁকিপূর্ণ খাতে চলে যেতে না পারে সেজন্য ব্যাংক ঋণের খাত নির্দিষ্ট করে দেওয়ার কথা বলেছেন। তিনি এও বলেছেন, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে এক শ্রেণীর মানুষ অধিক লাভের আশায় তা পুঁজিবাজারের মতো ঝুঁকিপূর্ণ খাতে বিনিয়োগ করে লোকসানের মুখে পড়ছেন। তাই ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই এর খাত নির্দিষ্ট করে দেওয়া উচিত। বৈঠক সূত্রে এসব খবর জানা গেছে।
মুদ্রাবাজারে সৃষ্ট তারল্য সংকটের কারণে শেয়ারবাজারে দরপতন দেখা দিয়েছে-এমন বক্তব্য খণ্ডনের জন্য গতকাল বিকেলেই তারল্য পরিস্থিতি তুলে ধরে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাজারচিত্র : গতকাল লেনদেন শুরুর আগে ডিএসইর সাধারণ মূল্যসূচক ছিল ৭৭৩৫ পয়েন্টে। ওখান থেকেই শুরু হয় গতকালের লেনদেন। লেনদেন শুরুর প্রথম ১০ মিনিটে সূচক আগের দিনের চেয়ে প্রায় ৬৮ পয়েন্ট বেড়ে ৭৩০৮ পয়েন্টে ওঠে। এরপর শুরু হয় দরপতন। শেয়ারের দামের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মিনিটে মিনিটে কমতে থাকে ডিএসইর সাধারণ সূচকও। দিনের একপর্যায়ে সূচক আগের দিনের চেয়ে ৬৭৬ পয়েন্ট কমে সর্বনিু ৭৫৯ পয়েন্টে নেমে আসে। তবে দিনশেষে সূচক কিছুটা পুনরুদ্ধার হয়ে ৭১৩৫ পয়েন্টে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। ডিএসইতে গতকাল মোট ২৪৪ কম্পানির শেয়ার লেনদেন হয়। তার মধ্যে মাত্র তিনটি বাদে সবটির দাম কমেছে।
ইতিহাসের এই ভয়াবহ দরপতনের দিনে কিছুটা শুভ ইঙ্গিত ছিল লেনদেনে। গতকাল ডিএসইতে লেনদেনের পরিমাণ আগের দিনের চেয়ে বেড়েছে। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে মাত্র ৯৭০ কোটি টাকা। এটি ছিল গত আট মাসের মধ্যে সর্বনিু লেনদেন। গতকাল সেটি বেশ খানিকটা বেড়েছে। রবিবার দিনশেষে ঢাকার বাজারে এক হাজার ৩৩১ কোটি টাকার শেয়ার লেনদেন হয়। আগের দিনের চেয়ে যা ৩৬১ কোটি টাকা বেশি। বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, শঙ্কিত বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শেয়ার বিক্রির প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় লেনদেনও কিছুটা বেড়েছে। একদল ভয়ে শেয়ার বিক্রি করেছেন আর একদল কিনেছেন। লেনদেন বাড়াকে বাজারসংশ্লিষ্টরা ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন।
এসইসির তিন সিদ্ধান্ত : সকাল সাড়ে ৯টায় দুই স্টক এক্সচেঞ্জের সভাপতি ও মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে এসইসি। বৈঠক থেকে নেতাদের কয়েকটি সুপারিশ গ্রহণ করে এসইসি। এই সুপারিশ অনুযায়ী ১০ কোটি টাকার ওপরের বিও হিসাবধারীদের বিনিয়োগে মার্জিন ঋণসুবিধা বন্ধের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হয়েছে। এর ফলে ১০ কোটি টাকার ওপরের বিনিয়োগকারীরা শেয়ার ক্রয়ে ঋণসুুবিধা পাবেন। একই সঙ্গে নতুন বিও হিসাবধারীদের জন্য হিসাব খোলার প্রথম ৩০ কার্যদিবস পর্যন্ত ঋণসুবিধা বন্ধের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ১৫ দিন করা হয়েছে। ফলে এখন থেকে নতুন বিনিয়োগকারীরা ১৫ দিনের মধ্যে ঋণসুবিধা পাবেন। এ ছাড়া গ্রামীণফোনের শেয়ার ক্রয়ে আর্থিক সমন্বয় সুবিধা (নেটিং সুবিধা) দেওয়া হয়েছে। ফলে এখন থেকে যেকোনো শেয়ার বিক্রি করে গ্রামীণফোনের শেয়ার কিনতে পারবেন বিনিয়োগকারীরা। আগে গ্রামীণফোনের শেয়ার বিক্রি করে অন্য শেয়ার কেনার সুযোগ ছিল। কিন্তু অন্য কম্পানির শেয়ার বিক্রি করে গ্রামীণফোনের শেয়ার কেনার সুযোগ ছিল না।
সাংবাদিক আটক : বেলা সোয়া ২টার দিকে দায়িত্ব পালনরত র‌্যাবের একটি টিম ডিএসই ভবনের দ্বিতীয়তলায় সাবেক সভাপতি আবদুল হকের রুম থেকে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিবেদক মঞ্জুর আহমেদকে আটক করে। এ ঘটনায় উপস্থিত বিক্ষুব্ধ সাংবাদিকরা রাস্তায় বসে পড়েন। এর আধা ঘণ্টা পর র‌্যাব তাঁকে ছেড়ে দেয়। মঞ্জুর আহমেদ সাংবাদিকদের জানান, তিনি ওই সময় বাথরুম থেকে বেরিয়ে শোরগোল দেখার জন্য নিচে উঁকি মারেন। এর অল্প সময় পর নিচ থেকে র‌্যাব এসে তাঁকে জোরপূর্বক ধরে নিয়ে গাড়িতে আটকে রাখে।
চট্টগ্রাম : গত বছরের ১৯ ডিসেম্বরকে ধরা হতো ’৯৬ পরবর্তী শেয়ারবাজারের সবচেয়ে বড় বিপর্যয়কর দিন। কিন্তু গতকালের চট্টগ্রাম পুঁজিবাজারে লেনদেন সে বিপর্যয়কেও ছাড়িয়ে গেছে। গতকাল চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) এক দিনেই সার্বিক সূচকের পতন ঘটেছে ১৩৯৫ পয়েন্ট। আর দরপতনের তালিকায় ছিল লেনদেন হওয়া শেয়ারের প্রায় ৯৯ শতাংশ। কিন্তু এর মধ্যেও বেড়েছে শেয়ার লেনদেনের পরিমাণ। আতঙ্কের কারণে বিক্রির চাপ বাড়ায় এমনটি হয়েছে বলে মনে করছেন শেয়ারবিশেষজ্ঞরা।
সিএসইতে গতকাল ১৯০টি কম্পানির শেয়ার লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে দাম বেড়েছে মাত্র তিনটি কম্পানির। চট্টগ্রাম পুঁজিবাজারে গতকাল প্রায় ১৫৫ কোটি টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে। যা আগের দিনের লেনদেনের চেয়ে ৬০ কোটি টাকা বেশি। এদিন শেয়ার লেনদেন হয়েছে এক কোটি সাড়ে ২৬ লাখ। বৃহস্পতিবারের চেয়েও প্রায় ৪৪ লাখ বেশি শেয়ার লেনদেন হয়েছে গতকাল। শেয়ারবিপর্যয়ের দিনে লেনদেনের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়াকে অশনি সংকেত হিসেবে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।
গত ১৯ ডিসেম্বর সিএসইতে সার্বিক সূচক ১৩৮৩ পয়েন্ট কমেছিল। গতকাল সেটাকে ছাড়িয়ে সূচক পড়েছে ১৩৯৫ পয়েন্ট। বিশ্লেষকদের মতে ১৯৯৬ সালের মহাবিপর্যয়েও এক দিনে সূচকের এত পতন হয়নি।
আর পতনের তালিকায় ছিল বাকি ১৮৭টি শেয়ার। সাধারণ সূচক ১৪৫৪ পয়েন্ট কমে গতকাল ১৩২৯৬ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। বাজার মূলধনও এক দিনে ১৮ হাজার কোটি টাকা কমে গতকাল দুই লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
সিএসইতে গতকাল দাম বাড়ার তালিকায় থাকা ভাগ্যবান শেয়ার তিনটি হলো-বার্জার পেইন্ট, গ্রামীণফোন ও এসিআই জিরো কুপন বন্ড।
রাজশাহী : দরপতনের প্রতিবাদে বিনিয়োগকারীরা নগরীতে বিক্ষোভ-সমাবেশ করে। নগরীর সাহেববাজার আইসিবির (ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ) কার্যালয়ের সামনে থেকে তারা বিক্ষোভ মিছিল বের করে। অব্যাহত দরপতনের জন্য এসইসি চেয়ারম্যানকে দায়ী করে তাঁর পদত্যাগ চাওয়া হয় বিক্ষোভ-সমাবেশে। পরে বিনিয়োগকারীরা আইসিবিসহ শহরের ১০টি ব্রোকারেজ হাউসে তালা ঝুলিয়ে দেন। ফলে লেনদেন বন্ধ হয়ে যায়।
সিলেট : দরপতনের প্রতিবাদে গতকাল দুপুরে সিলেটের অসংখ্য বিনিয়োগকারী রাজপথে নেমে আসেন। করেন প্রতিবাদ সভা। সভায় ঘোষণা দেওয়া হয় বাজার স্থিতিশীল না হলে আজ সোমবার থেকে সিলেটের ব্রোকার হাউসগুলোতে কেউ লেনদেন করবেন না। এর আগে বিভিন্ন ব্রোকার হাউসগুলোতে গিয়ে অনেক বিনিয়োগকারী লেনদেন বন্ধ করার আহ্বান জানালে অন্যরা সম্মত হন। এরপর দুপুর ১টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত দুই ঘণ্টা সব ব্রোকার হাউসে লেনদেন বন্ধ থাকে।
বগুড়া : শেয়ারবাজারে অব্যাহত দরপতনের প্রতিবাদে বগুড়ার বিনিয়োগকারীরা বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ ও সড়ক অবেরোধ করেন। বিনিয়োগকারীরা অর্থমন্ত্রী, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এবং এসইসি ও ডিএসই প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ দাবি করেছেন।
খুলনা : দরপতনে বিক্ষুব্ধ হয়ে বিনিয়োগকারীরা নগরীর শিল্প ব্যাংকের সামনে জমায়েত হয়ে সব রকম যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেন।
 
Support : Dhumketo ধূমকেতু | NewsCtg.Com | KUTUBDIA @ কুতুবদিয়া | eBlog
Copyright © 2013. Edu2News - All Rights Reserved
Template Created by Nejam Kutubi Published by Darianagar Publications
Proudly powered by Dhumketo ধূমকেতু