Home » , , , , » তথ্যবিভ্রাটও চালের দাম বাড়ায় by আশরাফুল হক রাজীব

তথ্যবিভ্রাটও চালের দাম বাড়ায় by আশরাফুল হক রাজীব

Written By Unknown on Sunday, January 16, 2011 | 11:09 PM

চাল ও গম উৎপাদনের যে তথ্য কৃষি মন্ত্রণালয় ও পরিসংখ্যান ব্যুরো দেয়, তা আমলে নিলে দেশে কোনো খাদ্যঘাটতির কথা থাকে না; বরং ২৫ থেকে ৩৩ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকে। কাজেই অর্থনীতির চিরায়ত সূত্র অনুযায়ী, বাজারে খাদ্য তথা চালের দাম না বেড়ে কমার কথা।

কিন্তু বাস্তবতা উল্টো। দেশে যে খাদ্য উদ্বৃত্ত নেই, বরং ঘাটতি রয়েছে, তার জলজ্যান্ত প্রমাণ হলো বাজার। এই ভরা মৌসুমেও বেশ কিছুদিন ধরে বাজারে চালের দাম বাড়ছেই। গত এক বছরে দাম বাড়ার এ হার ৪৯ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিভিন্ন দপ্তরের ভুল তথ্যের কারণে বাজারের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেই সরকারের। কারণ খাদ্য মন্ত্রণালয় যেসব তথ্যের ওপর ভিত্তি করে পরিকল্পনা করছে, তা সঠিক নয়। এ কারণে খাদ্যশস্য, বিশেষ করে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোনো পরিকল্পনাই কাজে আসছে না।
অর্থনীতির সূত্র অনুযায়ী, বাজারে খাদ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকলে দাম বাড়ার কথা নয়। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, খাদ্য উৎপাদনের যে বাম্পার ফলনের তথ্য সরকারের তরফ থেকে বলা হয়, তা আদৌ ঠিক কি না? অথবা চাহিদার যে হিসাব দেওয়া হচ্ছে, তা সঠিক কি না? কিংবা আরো যেসব জরুরি তথ্য রয়েছে, যেমনÑজনসংখ্যা, মাথাপিছু খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ ইত্যাদি, এগুলো সঠিক কি না, সে প্রশ্নও আছে। খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করলে এ চিত্রই ফুটে ওঠে।
খাদ্যমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক গত শনিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘খাদ্য পরিকল্পনার বিভিন্ন উপাদান, যেমনÑজনসংখ্যা, মাথাপিছু খাদ্য গ্রহণের চাহিদা অথবা খাদ্য উৎপাদনের পরিসংখ্যানে গোলমাল রয়েছে। এ কারণে পরিকল্পনার সঙ্গে বাস্তবতার কিছুটা অমিল রয়েছে। সমস্যাটি সমাধানের চেষ্টা করছি। আশা করি, চলতি বছরের আদমশুমারিতে এর সমাধান বের হয়ে আসবে।’
তবে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী গতকাল রবিবার কালের কণ্ঠকে জোর দিয়ে বলেন, ‘কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যে কোনো গলদ নেই। মাঠপর্যায় থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। আবার তথ্য সংগ্রহে স্পারসোর সহায়তাও নেওয়া হয়। সমস্যা যদি জনসংখ্যায় হয়, তাহলে আমার কিছু বলার নেই। মাথাপিছু খাদ্য গ্রহণের হারেও সমস্যা থাকতে পারে। তার পরও অস্বীকার করি না, খাদ্য উৎপাদনের পরিসংখ্যানে কিছু সমস্যা আছে। তবে সেটা দিন দিন কমে আসছে। সামনের দিনগুলোতে আরো কমে যাবে।’
কৃষিমন্ত্রী আরো বলেন, পরিসংখ্যানের জটিলতা থাকুক বা না থাকুক, বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে। এই তথ্য সরকারের নয়, এটা জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার। তারা বলেছে, গত দুই বছরে যে চার-পাঁচটি দেশের খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। সরকার কৃষিতে ভর্তুকি দিচ্ছে। ভরা মৌসুমে কৃষক ধানের দাম পাচ্ছে, যা আগে কখনো পায়নি। ঘূর্ণিঝড় আইলা এবং হওরে প্লাবন না হলে কৃষি উৎপাদন গত দুই বছরে কোথায় গিয়ে দাঁড়াত, তা মূল্যায়নের দায়িত্ব সাধারণ মানুষের ওপর ছেড়ে দিলাম।’
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর দেশে বোরো চালের উৎপাদন হয়েছে এক কোটি ৮৭ লাখ টন। আমন হয়েছে এক কোটি ৩৫ লাখ টন আর আউশ ২৫ লাখ টন। মোট উৎপাদন হয়েছে তিন কোটি ৪৭ লাখ টন চাল। এর মধ্যে ১২ ভাগ খাদ্যশস্য বীজ হিসেবে সংরক্ষণ এবং মাঠ থেকে আনা ও মাড়াই প্রক্রিয়ায় নষ্ট হয় বলে ধরা হয়। ফলে এ পরিমাণ খাদ্যশস্য বাজারে আসে না। এ অংশটুকু বাদ দিলে দেশে মোট খাদ্যশস্যের উৎপাদন তিন কোটি পাঁচ লাখ ৩৬ হাজার টন। এর সঙ্গে দেশে উৎপাদিত ১০ লাখ টন গম ও আমদানি করা ৩০ লাখ টন খাদ্যশস্য যোগ করলে মোট খাদ্যশস্যের পরিমাণ দাঁড়ায় তিন কোটি ৪৫ লাখ ৩৬ হাজার টন।
আর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, গত অর্থবছরে (২০০৯-১০) বোরো চাল এক কোটি ৮৩ লাখ টন, আমন এক কোটি ২২ লাখ টন, আউশ ১৭ লাখ টন এবং গমের উৎপাদন ছিল ৯ লাখ ৬৯ হাজার টন। মোট খাদ্যশস্যের উৎপাদন ছিল তিন কোটি ৩১ লাখ ৬৯ হাজার টন।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী দেশের জনসংখ্যা ১২ কোটি ৪৪ লাখ। তাদের গতকালের জনসংখ্যা-ঘড়ি অনুযায়ী দেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৪ কোটি ৯৮ লাখ ৭২ হাজার ৪৪৮ জন। অনেকের ধারণা, আসলে জনসংখ্যা হবে ১৬ কোটি। খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিটের হিসাব মতে প্রতিদিন মাথাপিছু খাদ্যশস্যের চাহিদা ৪৮৯ গ্রাম। অর্থনীতিবিদদের মতে, একজন মানুষের প্রতিদিনের খাদ্য চাহিদা ৫০০ গ্রাম। সেই হিসাবে ১৬ কোটি লোকের জন্য বছরে খাদ্য চাহিদার পরিমাণ দাঁড়ায় দুই কোটি ৯২ লাখ টন। এর মধ্যে প্রায় ২০ লাখ জনসংখ্যা রয়েছে, যাদের বয়স ছয় মাসের নিচে এবং যারা দানাদার খাদ্যশস্য গ্রহণ করে না। জনসংখ্যার এ অংশটুকু বাদ দিলে খাদ্য চাহিদার পরিমাণ দাঁড়ায় দুই কোটি ৮২ লাখ ৬৩০ টন।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের দেওয়া খাদ্যশস্যের উৎপাদনের হিসাব সঠিক হলে দেশে ৩৩ লাখ ৩৫ হাজার ৩৭০ টন খাদ্যশস্য উদ্বৃত্ত থাকার কথা। কাজেই আমদানি তো নয়ই বরং বাংলাদেশ খাদ্য রপ্তানি করতে পারে। আর বাজারে দাম বাড়ারও কারণ নেই।
ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক ও কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুব হোসেন বলেন, ‘চাহিদার চেয়ে জোগান বেশি হলে চালের দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। জোগান কম হলেই দাম বাড়ে। তাই বলা যায়, সঠিক তথ্যের অভাবে সরকারের পরিকল্পনা যথাযথ হয় না। খাদ্যের মতো একটি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তথ্যবিভ্রাট কারোই কাম্য নয়। বিষয়টি সরকারকে আমিও জানিয়েছি। কৃষি মন্ত্রণালয় মাঠকর্মী ও স্পারসোর মাধ্যমে যে পরিসংখ্যান সংগ্রহ করে তা প্রশ্নাতীত নয়। পরিসংখ্যান ব্যুরো জনসংখ্যার যে হিসাব দিচ্ছে তা নিয়ে অনেকের সন্দেহ থাকে। আর খাদ্য মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিট মাথাপিছু খাদ্য চাহিদার যে তথ্য দিচ্ছে তাও শতভাগ ঠিক নয়। এ অবস্থা চলতে দেওয়া উচিত নয়।’
খাদ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশে উৎপাদিত খাদ্য ও আমদানি করা চালের বাইরেও বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা বাংলাদেশকে খাদ্য সহায়তা দেয়, যা তারা বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে বিতরণ করছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, কৃৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের গ্রাম পর্যায়ের অফিসগুলোর উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার (ব্লক সুপারভাইজার) মাধ্যমে সরকার খাদ্যশস্যের তথ্য সংগ্রহ করে। কৃষক কতটুকু জমিতে কী ফসল চাষ করছে, উৎপাদন কেমন হতে পারে এবং ফসল কাটার সময় প্রকৃত উৎপাদন কেমন হলোÑসে হিসাব দিয়ে থাকেন তাঁরা। অভিযোগ রয়েছে, এসব কর্মকর্তা কৃষকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করেন না। জরিপের জন্য সর্বজনস্বীকৃত কোনো পন্থাও তাঁরা ব্যবহার করেন না। বড় একটি আবাদি মাঠের পাশে গিয়ে সেখানে কতটুকু জমি আছে লোকজনের কাছে শুনে এর ওপর ভিত্তি করে একটি আনুমানিক উৎপাদনের হিসাব দেন। অথবা আগে থেকে সংগ্রহ করা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে অফিসে বসেই একটি কাল্পনিক তথ্য সরকারকে দেন, যার ওপর ভিত্তি করে খাদ্য পরিকল্পনা করা হয়।
সাধারণত কৃষি মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যানের সঙ্গে পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যের মিল থাকে না। এ নিয়ে সব সরকারের সময়ই প্রশ্ন উঠেছে। গত চারদলীয় জোট সরকারের সময় অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান পরিসংখ্যানের অমিল দূর করার জন্য অনেক বৈঠক করেন। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে পরিসংখ্যানগত অমিল দূর করার জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটিও তাদের রিপোর্টে বিভিন্ন পরিসংখ্যানগত অমিলের জন্য খাদ্যমূল্য সংকটসহ নানা সংকট সৃষ্টির কথা তুলে ধরে। মহাজোট সরকারের কৃষিমন্ত্রীও গত বছর পরিসংখ্যান ব্যুরোর কর্মকর্তাদের ভর্ৎসনা করেন।
একজন কৃষি অর্থনীতিবিদ জানান, কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে যদি বোরো মৌসুমে বাম্পার ফলনই হবে তাহলে চালের দাম চড়া থাকার কোনো কারণ নাই। কৃষক, ব্যবসায়ী বা মজুদদাররা যদি মজুদও করে থাকেন তা সাধারণত আমন মৌসুম পর্যন্ত ধরে রাখেন। অথচ এবার আমন মৌসুমে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে উৎপাদন ভালো হওয়ার কথা জানানোর পরই চালের বাজার ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। এমন নজির খুব কম রয়েছে। অপরদিকে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের চালের বাজারের তেমন পার্থক্য নেই। তাই ভারত থেকে বৈধ বা অবৈধ কোনোভাবেই তেমন একটা চাল আসছে বা যাচ্ছে না। তাহলে বিপুল পরিমাণ উৎপাদিত খাদ্যশস্য কোথায় যাচ্ছে?

0 comments:

Post a Comment

 
Support : Dhumketo ধূমকেতু | NewsCtg.Com | KUTUBDIA @ কুতুবদিয়া | eBlog
Copyright © 2013. Edu2News - All Rights Reserved
Template Created by Nejam Kutubi Published by Darianagar Publications
Proudly powered by Dhumketo ধূমকেতু