ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে গতকাল বুধবার লেনদেন শুরু হওয়ার দেড় ঘণ্টার মধ্যে সূচক সর্বনিম্ন সীমায় (সার্কিট ব্রেকার) পৌঁছে যায়। ফলে বন্ধ হয়ে যায় শেয়ার লেনদেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে বিনিয়োগকারীরা রাজধানীর মতিঝিল, দিলকুশা, দৈনিক বাংলার মোড়সহ আশপাশের এলাকায় বিক্ষোভ ও বেপরোয়া ভাঙচুর শুরু করে।
তাদের তাণ্ডবে অতিষ্ঠ হয়ে প্রতিরোধ করতে রাস্তায় নামেন ক্ষতিগ্রস্ত গাড়ির মালিক, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তাকর্মী ও কর্মচারীরা। এ সময় উভয় পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। বিক্ষোভকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করেও ইটপাটকেল ছোড়ে। পুলিশ একজনকে আটক করে।
পুঁজিবাজারে অস্বাভাবিক উত্থান-পতন ঠেকাতে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) এক দিনে সূচক হ্রাস-বৃদ্ধির সীমা (সার্কিট ব্রেকার) নির্ধারণ করে। এসইসি সিদ্ধান্ত নেয়, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) সাধারণ সূচকের হ্রাস বা বৃদ্ধি আগের দিনের তুলনায় ২৩৭ পয়েন্ট হলেই লেনদেন বন্ধ করে দেওয়া হবে। এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয়েছে গতকাল থেকে। এ দিন শেয়ারবাজারে লেনদেন শুরু হওয়ার দেড় ঘণ্টার মধ্যে দরপতন হয়ে এ সীমা ছুঁয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যায় দুই স্টক এক্সচেঞ্জের লেনদেন।
সাত কর্মদিবসের ব্যবধানে গতকাল তৃতীয়বারের মতো বন্ধ হয় লেনদেন। আগের দিন মঙ্গলবার ও গত ১০ জানুয়ারি (সোমবার) অস্বাভাবিক দরপতনের কারণে লেনদেন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
বিনিয়োগকারীরা জানায়, সকালে নির্ধারিত সময়ে লেনদেন শুরু না হলেও তারা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছিল। অর্থমন্ত্রীর বাসভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠক থেকে বাজারের জন্য ইতিবাচক কোনো সিদ্ধান্ত আসবে বলে প্রত্যাশা ছিল তাদের। পরে এসইসি ও বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন কোনো সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলে লেনদেন শুরু হবে বলে ধারণা করছিল তারা। কিন্তু শুধু সূচক হ্রাস-বৃদ্ধির সীমা আরোপ করে লেনদেন শুরু এবং এর পরই ব্যাপক দরপতনের কারণে বিনিয়োগকারীদের ক্ষোভ সহিংস রূপ ধারণ করে।
বিনিয়োগকারীরা রাস্তায় অবস্থান নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক, এসইসি ও ডিএসই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকে। তবে তারা পুঁজিবাজারের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য প্রধানত বাংলাদেশ ব্যাংককেই দায়ী করে। তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমানের পদত্যাগও দাবি করে।
দুপুরে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিনিয়োগকারীরা মতিঝিল, দিলকুশা, দৈনিক বাংলার মোড় ও ফকিরাপুলে রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে শুরু করে। দুপুর আড়াইটা থেকে বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত এক ঘণ্টা ওই সব এলাকায় ব্যাপক গাড়ি ভাঙচুর এবং আগুন লাগানো হয়। এ ঘটনায় চার পুলিশ সদস্য আহত হন। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে এক বিক্ষোভকারীকে আটক করে।
দুপুর আড়াইটার দিকে বিনিয়োগকারীরা ঢাকা স্টক এক্সেচেঞ্জের সামনে টায়ার, কাগজ ও কাঠে আগুন ধরিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে। এরপর বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে মতিঝিল শাপলা চত্বর, দৈনিক বাংলার মোড় ও ফকিরাপুল এলাকায়। বিনিয়োগকারীদের একটি দল লাঠিসোঁটা ও ইটপাটকেল নিয়ে ওই সব এলাকায় পার্কিং করা গাড়ি ভাঙতে শুরু করে। এরপর আরেকটি দল রাস্তায় চলাচলরত যানবাহন ভাঙচুর করতে থাকে। এ ঘটনায় মতিঝিল, দৈনিক বাংলার মোড়সহ আশপাশ এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। রাস্তায় গাড়ি, রিকশা ও মোটরসাইকেল রেখেই দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করতে থাকে লোকজন। এলাকার বিভিন্ন ব্যাংক, অফিস, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান মুহূর্তের মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়।
মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় অগ্রণী ব্যাংক প্রধান শাখা এবং শিল্প মন্ত্রণালয় ও পূবালী ব্যাংক লিমিটেডের প্রধান শাখার নিচে পার্কিং করা গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। বিনিয়োগকারীরা ইটপাটকেল ও লাঠিসোঁটা দিয়ে ভাঙচুর চালায়। একই সময়ে বিক্ষোভকারীরা ভাঙচুর শুরু করে দিলকুশা এলাকায়ও। ওই এলাকায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্টাফ বাস, প্রাইভেট কার ও বিআরটিসির দুটি বাসসহ শতাধিক গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। ফুটপাতের দোকানপাটও ভাঙচুর করে বিক্ষোভকারীরা। ফুটপাতের দোকানিরা এগিয়ে গেলে বিক্ষোভকারীরা তাঁদের মারধর করে। এ সময় ওই এলাকা ছিল পুলিশশূন্য। মতিঝিল থানার অদূরে এ ঘটনা ঘটলেও পুলিশ এগিয়ে যায়নি। এতে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ দেখা দেয় মানুষের মধ্যে। অসহায় হয়ে পড়ে সাধারণ মানুষ। একপর্যায়ে মতিঝিল এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত গাড়ির মালিক, বিভিন্ন অফিসের কর্মচারী, ভবনগুলোর নিরাপত্তাকর্মী ও সাধারণ মানুষ মিলে বিক্ষোভকারীদের পাল্টা ধাওয়া দেয়। শুরু হয় দ্বিতীয় দফায় ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ। একপর্যায়ে শ্রমিক-কর্মচারীরা বিক্ষোভকারীদের ধাওয়া করেন। এ সময় পুলিশ গিয়ে তাঁদের লাঠিপেটা করে।
সোনালী ব্যাংকের (মিরপুর শাখা) এজিএম এস এম গোলাম মোস্তফা জানান, তিনি অফিসের গাড়ি নিয়ে মতিঝিল শাখায় কাজের জন্য যান। বাইরে হৈচৈ শুনতে পেয়ে বের হন ব্যাংক থেকে। দেখতে পান বিক্ষোভকারীরা তাঁর গাড়িটিও ভাঙচুর করছে। বাধা দিতে গেলে তাঁকে গালমন্দ করে বিক্ষোভকারীরা। ব্র্যাক ব্যাংকের এক নারী কর্মকর্তা অফিস থেকে বেরিয়ে তাঁর গাড়িটি রক্ষা করার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। বিক্ষোভকারীরা তাঁর সামনেই প্রাইভেট কারটি ভেঙে ফেলে। এই দৃশ্য দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন ওই নারী।
এদিকে দুপুরেই শতাধিক বিনিয়োগকারী ধানমণ্ডিতে মীনাবাজারের সামনে রাস্তা অবরোধ করে ১০-১২টি গাড়ি ভাঙচুর করে। এ ঘটনায় ওই এলাকায়ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ধানমণ্ডি থানার ওসি শাহ আলম জানান, এ ঘটনায় তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। তবে কিছুক্ষণ রাস্তা অবরোধ করে রাখা হয়েছিল। পরে তা তুলে নেওয়া হয়।
এসইসির নির্বাহী পরিচালক আনোয়ারুল কবীর ভুঁইয়া সাংবাদিকদের বলেন, পুঁজিবাজারে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি এড়াতে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থেই সূচক হ্রাস-বৃদ্ধির সীমা আরোপ করা হয়েছে। বুধবার এসইসির বাজার পর্যালোচনা কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরপরই তা কার্যকর করা হয়েছে। তিনি বলেন, লেনদেন চলাকালে প্রতি পাঁচ মিনিট পরপর সূচক সমন্বয় করা হয়। এ কারণে কোনো একটি পয়েন্টে সূচকের সীমা নির্দিষ্ট করে দেওয়া যায়নি। একবার সমন্বয়ের পর পরের পাঁচ মিনিটের মধ্যে যাতে বড় ধরনের উত্থান বা পতন ঘটতে না পারে সে জন্য ২৩৭ পয়েন্টকে ভিত্তি ধরা হলেও হ্রাস-বৃদ্ধির পরিমাণ ২২৫ পয়েন্টের বেশি হলেই লেনদেন বন্ধ করে দেওয়া হবে।
আনোয়ারুল কবীর আরো বলেন, বাংলাদেশে সূচক হ্রাস-বৃদ্ধির সীমা আরোপের ধারণা নতুন হলেও বিশ্বের অনেক দেশে এ ধরনের ব্যবস্থা চালু রয়েছে। এর ফলে এক দিনের মধ্যে শেয়ারবাজারে অস্বাভাবিক দরপতন বা উত্থানের প্রবণতা অনেকটা রোধ করা সম্ভব হবে।
বড় ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কায় আগের দিন (মঙ্গলবার) শেয়ারবাজারে লেনদেন স্থগিত রাখার পর গতকাল নির্ধারিত সময়ে (সকাল ১১টা) যথারীতি লেনদেন শুরুর ঘোষণা দিয়েছিল এসইসি ও ডিএসই। কিন্তু সকাল থেকেই পুঁজিবাজারের বর্তমান পরিস্থিতিতে করণীয় নির্ধারণের লক্ষ্যে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে একের পর এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যেকোনো ধরনের বিভ্রান্তি এড়াতে শেয়ারবাজারে লেনদেন শুরুর সময় পিছিয়ে দেওয়া হয় দুই ঘণ্টা। শেষ পর্যন্ত সূচক হ্রাস-বৃদ্ধির সীমা আরোপের পর দুপুর ১টা থেকে দুই শেয়ারবাজারে লেনদেন শুরু হয়।
সূচক হ্রাস-বৃদ্ধির সীমা আরোপের প্রথম দিনে লেনদেন শুরুর পর দেড় ঘণ্টার মধ্যেই শেয়ারবাজারে সর্বোচ্চ দরপতনের ঘটনা ঘটেছে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে সূচক আগের দিনের তুলনায় ১৬০ পয়েন্ট বেড়ে ৭৩০০ পয়েন্টের ঘর ছুঁয়ে যায়। এরপর শুরু হয় দরপতন। একটানা দরপতনে ২০ মিনিটে সূচক কমে যায় ২৮০ পয়েন্ট। এটা আগের দিনের তুলনায় ১২০ পয়েন্ট কম। এ সময় লেনদেন হওয়া বেশির ভাগ কম্পানির দরপতন ঘটে। এর ২০ মিনিটে আবার সামান্য বৃদ্ধি পায় লেনদেন। এ সময় সূচক প্রায় ১২০ পয়েন্ট বেড়ে ৭১২৫-এর ঘরে পৌঁছায়। এরপর আবার শুরু হয় পতন। এ পতন শেষ হয় আড়াইটায়। এ সময় এ সূচক আগের দিনের চেয়ে ২৩১ পয়েন্ট কমে ৬৯০২.৪৮-এ দাঁড়ায়। ফলে ওই অবস্থায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে দিনের লেনদেন বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় পর্যন্ত লেনদেন হওয়া ২৪০টি কম্পানির মধ্যে ২৩০টিরই শেয়ারের দর ব্যাপক মাত্রায় কমে। এর বিপরীতে সাতটির দর বাড়ে এবং তিনটির অপরিবর্তিত থাকে।
অর্থমন্ত্রীর বাসায় বৈঠক : পুঁজিবাজার পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল সকালে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের বাসায় একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, ড. মশিউর রহমান, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান, অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শফিকুর রহমান পাটোয়ারী, এসইসি চেয়ারম্যান জিয়াউল হক খোন্দকার, সদস্য মো. ইয়াসিন আলী, মো. আনিসুজ্জামানসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে পুঁজিবাজারের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। এ ছাড়া পুঁজিবাজারে বিপর্যয়কর পরিস্থিতি তৈরির পেছনে কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর কারসাজি রয়েছে কি না তা খুঁজে বের করার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
ডিএসইর ব্রিফিং : বাজার পরিস্থিতি সম্পর্কে বিকেলে ডিএসইর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সতিপতি মৈত্র সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় তিনি সূচকের সার্কিট ব্রেকার আরোপের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বিনিয়োগকারীদের ধৈর্য ধরার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, যাদের হাতে ভালো কম্পানির শেয়ার আছে, কোনোভাবেই আতঙ্কে তা বিক্রি করা ঠিক হবে না।
পুঁজিবাজারে অস্বাভাবিক উত্থান-পতন ঠেকাতে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) এক দিনে সূচক হ্রাস-বৃদ্ধির সীমা (সার্কিট ব্রেকার) নির্ধারণ করে। এসইসি সিদ্ধান্ত নেয়, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) সাধারণ সূচকের হ্রাস বা বৃদ্ধি আগের দিনের তুলনায় ২৩৭ পয়েন্ট হলেই লেনদেন বন্ধ করে দেওয়া হবে। এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয়েছে গতকাল থেকে। এ দিন শেয়ারবাজারে লেনদেন শুরু হওয়ার দেড় ঘণ্টার মধ্যে দরপতন হয়ে এ সীমা ছুঁয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যায় দুই স্টক এক্সচেঞ্জের লেনদেন।
সাত কর্মদিবসের ব্যবধানে গতকাল তৃতীয়বারের মতো বন্ধ হয় লেনদেন। আগের দিন মঙ্গলবার ও গত ১০ জানুয়ারি (সোমবার) অস্বাভাবিক দরপতনের কারণে লেনদেন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
বিনিয়োগকারীরা জানায়, সকালে নির্ধারিত সময়ে লেনদেন শুরু না হলেও তারা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছিল। অর্থমন্ত্রীর বাসভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠক থেকে বাজারের জন্য ইতিবাচক কোনো সিদ্ধান্ত আসবে বলে প্রত্যাশা ছিল তাদের। পরে এসইসি ও বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন কোনো সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলে লেনদেন শুরু হবে বলে ধারণা করছিল তারা। কিন্তু শুধু সূচক হ্রাস-বৃদ্ধির সীমা আরোপ করে লেনদেন শুরু এবং এর পরই ব্যাপক দরপতনের কারণে বিনিয়োগকারীদের ক্ষোভ সহিংস রূপ ধারণ করে।
বিনিয়োগকারীরা রাস্তায় অবস্থান নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক, এসইসি ও ডিএসই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকে। তবে তারা পুঁজিবাজারের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য প্রধানত বাংলাদেশ ব্যাংককেই দায়ী করে। তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমানের পদত্যাগও দাবি করে।
দুপুরে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিনিয়োগকারীরা মতিঝিল, দিলকুশা, দৈনিক বাংলার মোড় ও ফকিরাপুলে রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে শুরু করে। দুপুর আড়াইটা থেকে বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত এক ঘণ্টা ওই সব এলাকায় ব্যাপক গাড়ি ভাঙচুর এবং আগুন লাগানো হয়। এ ঘটনায় চার পুলিশ সদস্য আহত হন। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে এক বিক্ষোভকারীকে আটক করে।
দুপুর আড়াইটার দিকে বিনিয়োগকারীরা ঢাকা স্টক এক্সেচেঞ্জের সামনে টায়ার, কাগজ ও কাঠে আগুন ধরিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে। এরপর বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে মতিঝিল শাপলা চত্বর, দৈনিক বাংলার মোড় ও ফকিরাপুল এলাকায়। বিনিয়োগকারীদের একটি দল লাঠিসোঁটা ও ইটপাটকেল নিয়ে ওই সব এলাকায় পার্কিং করা গাড়ি ভাঙতে শুরু করে। এরপর আরেকটি দল রাস্তায় চলাচলরত যানবাহন ভাঙচুর করতে থাকে। এ ঘটনায় মতিঝিল, দৈনিক বাংলার মোড়সহ আশপাশ এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। রাস্তায় গাড়ি, রিকশা ও মোটরসাইকেল রেখেই দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করতে থাকে লোকজন। এলাকার বিভিন্ন ব্যাংক, অফিস, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান মুহূর্তের মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়।
মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় অগ্রণী ব্যাংক প্রধান শাখা এবং শিল্প মন্ত্রণালয় ও পূবালী ব্যাংক লিমিটেডের প্রধান শাখার নিচে পার্কিং করা গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। বিনিয়োগকারীরা ইটপাটকেল ও লাঠিসোঁটা দিয়ে ভাঙচুর চালায়। একই সময়ে বিক্ষোভকারীরা ভাঙচুর শুরু করে দিলকুশা এলাকায়ও। ওই এলাকায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্টাফ বাস, প্রাইভেট কার ও বিআরটিসির দুটি বাসসহ শতাধিক গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। ফুটপাতের দোকানপাটও ভাঙচুর করে বিক্ষোভকারীরা। ফুটপাতের দোকানিরা এগিয়ে গেলে বিক্ষোভকারীরা তাঁদের মারধর করে। এ সময় ওই এলাকা ছিল পুলিশশূন্য। মতিঝিল থানার অদূরে এ ঘটনা ঘটলেও পুলিশ এগিয়ে যায়নি। এতে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ দেখা দেয় মানুষের মধ্যে। অসহায় হয়ে পড়ে সাধারণ মানুষ। একপর্যায়ে মতিঝিল এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত গাড়ির মালিক, বিভিন্ন অফিসের কর্মচারী, ভবনগুলোর নিরাপত্তাকর্মী ও সাধারণ মানুষ মিলে বিক্ষোভকারীদের পাল্টা ধাওয়া দেয়। শুরু হয় দ্বিতীয় দফায় ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ। একপর্যায়ে শ্রমিক-কর্মচারীরা বিক্ষোভকারীদের ধাওয়া করেন। এ সময় পুলিশ গিয়ে তাঁদের লাঠিপেটা করে।
সোনালী ব্যাংকের (মিরপুর শাখা) এজিএম এস এম গোলাম মোস্তফা জানান, তিনি অফিসের গাড়ি নিয়ে মতিঝিল শাখায় কাজের জন্য যান। বাইরে হৈচৈ শুনতে পেয়ে বের হন ব্যাংক থেকে। দেখতে পান বিক্ষোভকারীরা তাঁর গাড়িটিও ভাঙচুর করছে। বাধা দিতে গেলে তাঁকে গালমন্দ করে বিক্ষোভকারীরা। ব্র্যাক ব্যাংকের এক নারী কর্মকর্তা অফিস থেকে বেরিয়ে তাঁর গাড়িটি রক্ষা করার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। বিক্ষোভকারীরা তাঁর সামনেই প্রাইভেট কারটি ভেঙে ফেলে। এই দৃশ্য দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন ওই নারী।
এদিকে দুপুরেই শতাধিক বিনিয়োগকারী ধানমণ্ডিতে মীনাবাজারের সামনে রাস্তা অবরোধ করে ১০-১২টি গাড়ি ভাঙচুর করে। এ ঘটনায় ওই এলাকায়ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ধানমণ্ডি থানার ওসি শাহ আলম জানান, এ ঘটনায় তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। তবে কিছুক্ষণ রাস্তা অবরোধ করে রাখা হয়েছিল। পরে তা তুলে নেওয়া হয়।
এসইসির নির্বাহী পরিচালক আনোয়ারুল কবীর ভুঁইয়া সাংবাদিকদের বলেন, পুঁজিবাজারে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি এড়াতে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থেই সূচক হ্রাস-বৃদ্ধির সীমা আরোপ করা হয়েছে। বুধবার এসইসির বাজার পর্যালোচনা কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরপরই তা কার্যকর করা হয়েছে। তিনি বলেন, লেনদেন চলাকালে প্রতি পাঁচ মিনিট পরপর সূচক সমন্বয় করা হয়। এ কারণে কোনো একটি পয়েন্টে সূচকের সীমা নির্দিষ্ট করে দেওয়া যায়নি। একবার সমন্বয়ের পর পরের পাঁচ মিনিটের মধ্যে যাতে বড় ধরনের উত্থান বা পতন ঘটতে না পারে সে জন্য ২৩৭ পয়েন্টকে ভিত্তি ধরা হলেও হ্রাস-বৃদ্ধির পরিমাণ ২২৫ পয়েন্টের বেশি হলেই লেনদেন বন্ধ করে দেওয়া হবে।
আনোয়ারুল কবীর আরো বলেন, বাংলাদেশে সূচক হ্রাস-বৃদ্ধির সীমা আরোপের ধারণা নতুন হলেও বিশ্বের অনেক দেশে এ ধরনের ব্যবস্থা চালু রয়েছে। এর ফলে এক দিনের মধ্যে শেয়ারবাজারে অস্বাভাবিক দরপতন বা উত্থানের প্রবণতা অনেকটা রোধ করা সম্ভব হবে।
বড় ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কায় আগের দিন (মঙ্গলবার) শেয়ারবাজারে লেনদেন স্থগিত রাখার পর গতকাল নির্ধারিত সময়ে (সকাল ১১টা) যথারীতি লেনদেন শুরুর ঘোষণা দিয়েছিল এসইসি ও ডিএসই। কিন্তু সকাল থেকেই পুঁজিবাজারের বর্তমান পরিস্থিতিতে করণীয় নির্ধারণের লক্ষ্যে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে একের পর এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যেকোনো ধরনের বিভ্রান্তি এড়াতে শেয়ারবাজারে লেনদেন শুরুর সময় পিছিয়ে দেওয়া হয় দুই ঘণ্টা। শেষ পর্যন্ত সূচক হ্রাস-বৃদ্ধির সীমা আরোপের পর দুপুর ১টা থেকে দুই শেয়ারবাজারে লেনদেন শুরু হয়।
সূচক হ্রাস-বৃদ্ধির সীমা আরোপের প্রথম দিনে লেনদেন শুরুর পর দেড় ঘণ্টার মধ্যেই শেয়ারবাজারে সর্বোচ্চ দরপতনের ঘটনা ঘটেছে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে সূচক আগের দিনের তুলনায় ১৬০ পয়েন্ট বেড়ে ৭৩০০ পয়েন্টের ঘর ছুঁয়ে যায়। এরপর শুরু হয় দরপতন। একটানা দরপতনে ২০ মিনিটে সূচক কমে যায় ২৮০ পয়েন্ট। এটা আগের দিনের তুলনায় ১২০ পয়েন্ট কম। এ সময় লেনদেন হওয়া বেশির ভাগ কম্পানির দরপতন ঘটে। এর ২০ মিনিটে আবার সামান্য বৃদ্ধি পায় লেনদেন। এ সময় সূচক প্রায় ১২০ পয়েন্ট বেড়ে ৭১২৫-এর ঘরে পৌঁছায়। এরপর আবার শুরু হয় পতন। এ পতন শেষ হয় আড়াইটায়। এ সময় এ সূচক আগের দিনের চেয়ে ২৩১ পয়েন্ট কমে ৬৯০২.৪৮-এ দাঁড়ায়। ফলে ওই অবস্থায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে দিনের লেনদেন বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় পর্যন্ত লেনদেন হওয়া ২৪০টি কম্পানির মধ্যে ২৩০টিরই শেয়ারের দর ব্যাপক মাত্রায় কমে। এর বিপরীতে সাতটির দর বাড়ে এবং তিনটির অপরিবর্তিত থাকে।
অর্থমন্ত্রীর বাসায় বৈঠক : পুঁজিবাজার পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল সকালে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের বাসায় একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, ড. মশিউর রহমান, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান, অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শফিকুর রহমান পাটোয়ারী, এসইসি চেয়ারম্যান জিয়াউল হক খোন্দকার, সদস্য মো. ইয়াসিন আলী, মো. আনিসুজ্জামানসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে পুঁজিবাজারের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। এ ছাড়া পুঁজিবাজারে বিপর্যয়কর পরিস্থিতি তৈরির পেছনে কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর কারসাজি রয়েছে কি না তা খুঁজে বের করার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
ডিএসইর ব্রিফিং : বাজার পরিস্থিতি সম্পর্কে বিকেলে ডিএসইর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সতিপতি মৈত্র সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় তিনি সূচকের সার্কিট ব্রেকার আরোপের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বিনিয়োগকারীদের ধৈর্য ধরার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, যাদের হাতে ভালো কম্পানির শেয়ার আছে, কোনোভাবেই আতঙ্কে তা বিক্রি করা ঠিক হবে না।
0 comments:
Post a Comment