Home » , » তত্ত্বাবধায়কের ওপর দায় চাপালেন মইন by নিখিল ভদ্র

তত্ত্বাবধায়কের ওপর দায় চাপালেন মইন by নিখিল ভদ্র

Written By Unknown on Tuesday, September 13, 2011 | 11:27 PM

০০৭ সালের ২০ আগস্ট। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সেই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে সেনা সদস্যদের সঙ্গে ছাত্রদের কথা কাটাকাটি ও বচসা হয়। আপাত এই সামান্য ঘটনা এরপর বিরাট আকার নেয়। ক্যাম্পাসজুড়ে ছাত্র বিক্ষোভ বাড়তে থাকলে শুরু হয় পুলিশি অ্যাকশন। পরের দুই দিন ধরে থেমে থেমে চলতে থাকে ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ। রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তা ছড়িয়ে পড়ে। জারি করা হয় কারফিউ। গ্রেপ্তার করে নির্যাতন করা হয় ছাত্রদের পাশাপাশি কয়েকজন শিক্ষককেও।

ওই ঘটনার তদন্তে তৎকালীন সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদ গতকাল মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেওয়া সাক্ষ্যে তাঁর বা সেনাবাহিনীর দায় অস্বীকার করেছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির উপকমিটির কাছে টেলিকনফারেন্সের মাধ্যমে দেওয়া সাক্ষ্যে তিনি বলেন, 'তখন যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, তা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টারাই নিয়েছিলেন। সেনাবাহিনী সরকারকে সহযোগিতা করেছে মাত্র।' তবে মাঠপর্যায়ের নিম্নপদস্থ সেনা কর্মকর্তারা নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত থাকলেও থাকতে পারেন বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। উপকমিটি জানায়, মইনের অনেক বক্তব্যে তারা সন্তুষ্ট নয় এবং তিনি সুকৌশলে অনেক প্রশ্ন এড়িয়েও গেছেন।
গতকাল সকাল ১০টা থেকে সংসদ ভবনের একটি কক্ষে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে চলে বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে টেলিকনফারেন্সের মাধ্যমে প্রথম এই সাক্ষ্যগ্রহণ। এতে অংশ নেন স্থায়ী কমিটির প্রধান ও উপকমিটির আহ্বায়ক রাশেদ খান মেনন, সদস্য মির্জা আজম, বীরেণ শিকদার ও মো. শাহ আলম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক এবং ওই সময়ে নির্যাতিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দুজন অধ্যাপক হারুনুর রশীদ ও অধ্যাপক সদরুল আমিন।
কনফারেন্স সূত্র জানায়, সাক্ষ্যে অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল মইন ২০০৭ সালের ২০ থেকে ২২ আগস্টে সংঘটিত সংঘর্ষ ও পরবর্তী সময়ে নির্যাতনের বিষয়ে সেনাবাহিনী জড়িত ছিল না বলে দাবি করেছেন। কিন্তু কমিটির সদস্যরা তাঁর বক্তব্যে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। কারণ উপকমিটির এ তদন্তে নির্যাতিত ছাত্র-শিক্ষকসহ অনেকেই ঘটনার জন্য সেনাবাহিনীকে দায়ী করে বক্তব্য দিয়েছেন।
কমিটির একাধিক সদস্য জানান, জেনারেল মইন কমিটির সদস্যদের ২০-২২টি প্রশ্নের উত্তর দেন। তবে স্পর্শকাতর কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর তিনি কৌশলে এড়িয়ে যান। শুরুতে তিনি ওই ঘটনায় তাঁর অবস্থান সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা দেন। কমিটির সদস্যদের প্রশ্নের জবাবে মইন বলেন, 'ওই ঘটনায় সেনাবাহিনীর ওপরের সারির কেউ জড়িত নন। তবে মাঠপর্যায়ের কোনো কোনো সদস্য জড়িত থাকলেও থাকতে পারেন। তবে সেটা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়।' তাঁর এ বক্তব্য শুনে কমিটির পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়, তাহলে কি ওই সময়ে সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড ছিল না? এ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তিনি অন্য প্রসঙ্গে চলে যান।
সেনাবাহিনী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে প্রতিপক্ষ মনে করে কি না জানতে চাইলে মইন বলেন, 'এটা ঠিক না। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে সেনাবাহিনীর আত্মীয়স্বজনও লেখাপড়া করে।' শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সেনাবাহিনীর মধ্যে সহমর্মিতা থাকা প্রয়োজন বলে মইন মন্তব্য করেন।
কনফারেন্স সূত্র জানায়, ছাত্র-শিক্ষক নির্যাতনের ঘটনায় মইন সেনাবাহিনীর সম্পৃক্ততা অস্বীকার করলে কমিটি তাঁকে বলে, বেশ কিছু সেনা ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য কমিটির কাছে দেওয়া সাক্ষ্যে বলেছেন, তাঁরা কেবল ওপরের নির্দেশ পালন করেছেন। এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী? উত্তরে মইন বলেন, তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় ছিল, সেনাবাহিনী তাদের সহায়তা করেছে মাত্র। যা কিছু হয়েছে উপদেষ্টা পরিষদের সিদ্ধান্তে হয়েছে। কমিটি টিএফআই (টাস্ক ফোর্স ইনটেলিজেন্স) সেলে শিক্ষকদের নির্যাতনের বিষয়ে জানতে চাইলে মইন এ বিষয়টিও এড়িয়ে যান।
জানা গেছে, এর আগে কমিটিকে দেওয়া ছাত্র-শিক্ষকদের সাক্ষ্য এবং গতকাল মইনের বক্তব্যে কমিটি নিশ্চিত যে, ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের ঘটনা ছিল পরিকল্পিত। এ জন্য সেনাবাহিনীর সদস্যরা ও সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়ী। গতকাল মইনের সাক্ষ্যগ্রহণের সময় উপস্থিত শিক্ষক প্রতিনিধিরা আবারও বলেন, সেই কালো অধ্যায়ের জন্য সেনা কর্মকর্তারা দায়ী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য হারুনুর রশীদ ও অধ্যাপক সদরুল আমিন কমিটিকে বলেন, ওই সময়ে মেজর কামরুল নামের এক সেনা কর্মকর্তা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেন। সেনা সদস্যরা প্রকাশ্যে নির্যাতন চালান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক তাঁদের বক্তব্য সমর্থন করেন। উপকমিটি তাঁদের এ অভিযোগ আমলে নিয়েছে।
কনফারেন্স শেষে প্রেস ব্রিফিংয়ে রাশেদ খান মেনন বলেন, জেনারেল মইন কমিটির সব প্রশ্নের জবাবেই তৎকালীন উপদেষ্টা পরিষদকে দায়ী করেছেন। ওই বক্তব্যে কমিটি সন্তুষ্ট নয়। তিনি বলেন, 'কমিটির কাছে মইন বলেছেন, সেনাবাহিনী তৎকালীন সরকারকে সহযোগিতা করেছে। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে তিনি থাকলেও বাস্তবায়ন পর্যায়ে ছিলেন না।'
মেনন বলেন, 'কমিটিতে এর আগে যেসব বক্তব্য এসেছে তাতে দেখা গেছে, ওই ঘটনার পর উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে চারটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। সেগুলো ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সেনাছাউনি প্রত্যাহার, আটককৃতদের মুক্তি দেওয়া, আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা ও ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করা।' উপদেষ্টাদের সেই বৈঠকে সেনা গোয়েন্দা সংস্থা_ ডিজিএফআইয়ের কর্মকর্তারা ছিলেন। তাঁরা বৈঠকের কার্যবিবরণী থেকে এ চারটি বিষয় বাদ দেওয়ার জন্য চাপ দিয়েছিলেন। এ বিষয়ে জেনারেল মইনকে জিজ্ঞাসা করা হলে এটাও তিনি এড়িয়ে গেছেন।
স্থায়ী কমিটির সভাপতি মেনন জানান, কমিটির কাছে নির্যাতিত যেসব শিক্ষক বক্তব্য দিয়েছেন তাতে দেখা গেছে, টিএফআই সেলে ভারত ও শেখ হাসিনার সঙ্গে শিক্ষকদের সম্পর্ক আছে কি না, তা জানতে চাওয়া হয়। একই সঙ্গে শিক্ষকরা আওয়ামীপন্থী কি না, তাও জানতে চাওয়া হয়েছিল। কমিটির এই প্রশ্নও মইন এড়িয়ে গেছেন বলে তিনি জানান।
মেনন আরো জানান, সাবেক চিফ অব জেনারেল স্টাফ সিনা ইবনে জামালি কমিটিতে বলেছিলেন, ওই সময় প্রধান উপদেষ্টা ও সেনাপ্রধানের নির্দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেনাছাউনি স্থাপন করা হয়েছিল। এ বিষয়েও মইনের কাছে জানতে চাওয়া হয়। জবাবে মইন বলেন, সেনাক্যাম্প স্থাপনের বিষয়ে যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করে জেলা প্রশাসকের অনুমতি নেওয়া হয়েছিল।
টেলিফোনে কমিটির সদস্যরা মইনকে বলেন, জরুরি অবস্থার সময় ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী দল গঠন করে মিছিল করলেও তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। অথচ জরুরি অবস্থা ভাঙার দায়ে শিক্ষক ও ছাত্রদের গ্রেপ্তার করা হয়। কেন এটা করা হয়? এ প্রশ্নের উত্তরও এড়িয়ে গেছেন মইন।
প্রেস ব্রিফিংয়ে রাশেদ খান মেনন বলেন, ওই সংঘর্ষের পরে নির্যাতনের ঘটনাটিকে অনভিপ্রেত ও দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন জেনারেল মইন। কমিটিতে বক্তব্য দেওয়ার জন্য মইনকে কমিটির পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানানো হয়েছে।
প্রসঙ্গত, মইন টেলিকনফারেন্সের মাধ্যমে সাক্ষ্য প্রদান করলেও সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দীন আহমদ সাক্ষ্য দেওয়ার বিষয়ে কমিটির আহ্বানে এখনো সাড়া দেননি। তিনি শুধু ই-মেইল বার্তায় কিছু ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে মেনন বলেন, 'গণতন্ত্র ও সংসদের প্রতি তাঁর যদি সম্মান থাকে তবে তিনি কমিটির সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। তিনি যোগাযোগ করলে তাঁর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হবে। তবে এ বিষয়ে কমিটি আর নিজে থেকে কোনো উদ্যোগ নেবে না। তিনি যোগাযোগ না করলে তাঁর বক্তব্য ছাড়াই তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত করা হবে।' সংসদের আগামী অধিবেশনেই মইনের বক্তব্যসংবলিত তদন্ত প্রতিবেদন সংসদে উত্থাপন করা হবে বলে কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
যেভাবে কনফারেন্সের আয়োজন : সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সংসদীয় কমিটিতে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য দুই দফা আমন্ত্রণ জানানো হলেও নির্ধারিত দিনে হাজির হননি জেনারেল মইন। এরপর তিনি গত আগস্টে টেলিকনফারেন্সের মাধ্যমে সাক্ষ্য দিতে আগ্রহ প্রকাশ করে সংসদীয় কমিটির কাছে চিঠি পাঠান। গত ২৩ আগস্ট উপকমিটির নবম বৈঠকে টেলিকনফারেন্সের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সংসদ সচিবালয়ে এর প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়। বৈঠকের জন্য জাতীয় সংসদ ভবনের চতুর্থ লেভেলের ২ নম্বর স্থায়ী কমিটির কক্ষে অতিরিক্ত চারটি ল্যান্ডফোনের সংযোগ দেওয়া হয়। টেলিকনফারেন্স শুরুর আগে সকাল ৯টা ৫০ মিনিটে মইনকে ফোন করে প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য বলা হয়। এর আগে এ বিষয়ে স্পিকারের অনুমতি গ্রহণ করে উপকমিটি।
উল্লেখ্য, চার বছর আগের ওই ঘটনার বিভিন্ন দিক খতিয়ে দেখতে গত বছরের ১৯ আগস্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে এ উপকমিটি গঠন করা হয়। ওই সহিংসতা ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে দেশের বিভাগীয় শহরগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার ২২ আগস্ট সন্ধ্যায় ছয় বিভাগীয় শহরে কারফিউ জারি করে। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় ৫৩টি মামলা করে। ওই ঘটনায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগে ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষককে গ্রেপ্তার করা হয়। নির্বিচারে আটক ও নির্যাতন করা হয় ছাত্রদের।
মেজর কামরুলকে ডাকবে তদন্ত কমিটি : ছাত্র-শিক্ষকদের নির্যাতনের সঙ্গে মেজর কামরুলের সম্পৃক্ততার কথা জানতে পারে তদন্ত কমিটি। শিগগিরই তাঁকে কমিটির বৈঠকে ডাকার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিয়ে তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হবে। রাশেদ খান মেনন বলেন, 'ওই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দায়িত্ব পালন করেন মেজর কামরুল। তাঁর ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ ও নির্যাতনের বিষয়টি আমরা জানতে পেরেছি।'
অসুস্থতার কথা জানালেন মইন : মইন টেলিকনফারেন্সের শুরুতেই নিজের অসুস্থতার কথা জানান। তিনি বলেন, 'আমি ভীষণ অসুস্থ। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, মাইলোমা নামের এক ধরনের ক্যান্সারে আক্রান্ত। এ জন্য সপ্তাহে দুই দিন কেমোথেরাপি নিতে হয়।' টেলিকনফারেন্সের মাধ্যমে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ দেওয়ায় তিনি কমিটির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। তাঁর এ কথায় কমিটির পক্ষ থেকে তাঁর সুস্থতা কামনা করা হয়।

0 comments:

Post a Comment

 
Support : Dhumketo ধূমকেতু | NewsCtg.Com | KUTUBDIA @ কুতুবদিয়া | eBlog
Copyright © 2013. Edu2News - All Rights Reserved
Template Created by Nejam Kutubi Published by Darianagar Publications
Proudly powered by Dhumketo ধূমকেতু