মানুষের মূল্যবোধ ও বিশ্বাস, সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে এর পরিবর্তন এবং এর সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জানতে ১৯৮১ সাল থেকে নানা ধরনের গবেষণা, সমীক্ষা ও জরিপ চালিয়ে যাচ্ছে ওয়ার্ল্ড ভ্যালু সারভে
(ডবলিউভিএস) নামের একটি সংগঠন। জারমানি, সুইডেন, স্পেন ও যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক এ সংগঠনটি প্রায় ১০০টি দেশে (অর্থাৎ বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় ৯০ শতাংশ অধ্যুষিত অঞ্চলে) নিবিড়ভাবে তথ্য সংগ্রহ করে সমাজবিজ্ঞানীদের মাধ্যমে। অর্থনৈতিক মুক্তি মানুষকে কম বা বেশি সাম্প্রদায়িক করে তোলে কিনা- এ নিয়ে গবেষণায় নেমে সম্প্রতি দু’জন সুইডিশ অর্থনীতিবিদ বুঝতে পারেন, আগে তাঁদের প্রয়োজন বিভিন্ন দেশের সাম্প্রদায়িক সহিষ্ণুতার মাত্রা নির্ণয়ের একটা উপায় খুঁজে পাওয়া। তখন তাঁরা সহায়তা চান ডবলিউভিএস-এর কাছে। কারণ এ সংগঠনটিই গত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে চলেছে বৈশ্বিক প্রবণতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামত নিয়ে। আর তাদের গবেষণার ফল গুরুত্বের সঙ্গে গৃহীত ও ব্যবহৃত হয় যাবতীয় আন্তর্জাতিক সংস্থায়, বহু দেশে ও সংগঠনে। ওই সূত্রেই ডবলিউভিএস বিশ্বের ৮০টিরও বেশি দেশে জরিপ চালিয়েছে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি সম্পর্কে। এতে দেখা যায় সবচেয়ে বেশি সাম্প্রদায়িক সহিষ্ণু দেশ (মাত্রা অনুসারে ক্রমনিম্ন)- যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ব্রাজিল, আরজেনটিনা, কলম্বিয়া, গুয়াতেমালা, বৃটেন, সুইডেন, নরওয়ে, লাটভিয়া, অসট্রেলিয়া, নিউ জিল্যান্ড (০-৪.৯%); চিলি, পেরু, স্পেন, মেকসিকো, জারমানি, বেলজিয়াম, বেলারুশ, ক্রোয়েশিয়া, জাপান, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা (৫-৯.৯%); ফিনল্যান্ড, পোলান্ড, ইউক্রেন, ইতালি, গ্রিস, চেক প্রজাতন্ত্র, স্লোভাকিয়া (১০-১৪.৯%); ভেনেজুয়েলা, হাঙ্গারি, সারবিয়া, রোমানিয়া, মেসেডোনিয়া, ইথিওপিয়া, উগান্ডা, তানজানিয়া, জিমবাবুয়ে, রাশিয়া, চীন (১৫-১৯.৯%)। আর সবচেয়ে বেশি অসহিষ্ণু দেশ (মাত্রা অনুসারে ক্রমোচ্চ) - ফ্রান্স, তুরস্ক, বালগেরিয়া, আলজেরিয়া, মরক্কো, মালি, জামবিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, বাংলাদেশ, হংকং (২০-৩৯.৯%); মিশর, সউদি আরব, ইরান, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া (৩০-৩৯.৯%); ভারত, জর্দান (৪০%+)।
এ জরিপের ফল কয়েকটি ক্ষেত্রে বিস্মিত করতে পারে অনেককে, কিন্তু সেদিকে না গিয়ে আমাদের নিজেদের দিকে তাকানোই ভাল। এই তাকাতে গিয়েই ঘা লাগতে পারে আমাদের স্থায়ী কতকগুলো বিশ্বাসে, ধারণায়। সে বিশ্বাসগুলোর মধ্যে রয়েছে- আমাদের এখানে সাম্প্রদায়িকতার মাত্রা তুলনামূলক ভাবে অনেক কম; সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে স্বার্থবুদ্ধির অপরাজনীতি; এ দেশ শান্তি, সৌভ্রাতৃত্ব, প্রেম ও সাম্য ধর্মে উজ্জীবিত- তাই এখানে সবাই ধর্মপ্রাণ, নগণ্যসংখ্যক ধর্মান্ধ; বাঙালিত্বের মহিমা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমাদের নির্দেশক শক্তি। তবে সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে পালটে গেছে পরিস্থিতি। সব কিছু আর আগের মতো নেই। তাই আমাদের বিশ্বাস ও অঙ্গীকারগুলোর পাশাপাশি নগ্ন নিষ্ঠুর সত্যগুলোকেও মেনে নেয়ার সময় এসেছে। এসব বাস্তবতাকে অস্বীকার করার যো নেই আর। কয়েকটি মাত্র উদাহরণ দেই এখানে। নির্বাচনের আগে-পরে বিভিন্ন অঞ্চলে হিন্দুরা শিকার হন হামলার, মারমুখো আচরণ দেখি আহমদিয়া সম্প্রদায়ের প্রতি, হেনস্থা হতে দেখি বাউলদের, মাঝেমধ্যে হঠাৎ সহিংসতার লক্ষ্য হয়ে পড়ে বৌদ্ধ, খৃস্টান, উপজাতি-অদিবাসী মানুষ। বিহারি ও রোহিঙ্গাদের প্রতি অনেকের বিদ্বেষ খুব স্পষ্ট। আঞ্চলিকতার বিষবাষ্প-ও ছড়ায় হঠাৎ কখনও। সাম্প্রতিককালে রাজনীতির উথলে পড়া বমনে সৃষ্ট নাস্তিক-আস্তিক দ্বন্দ্ব ঘনিয়ে তুলছে ধর্মভিত্তিক সন্ত্রস্ততা। ইসলাম-বিদ্বেষের ধুয়া ছড়িয়ে পড়ছে ক্রোধের আগুনে। তারপর রাজনীতির বিকার যে জাতীয় বিভাজন সৃষ্টি করেছে তা তীব্র হয়ে উঠছে ক্রমে। ফলে একটির পর একটি পরিকল্পিত অথবা অসতর্ক ঘটনা-দুর্ঘটনার সূত্রে বেড়েই চলেছে অসহিষ্ণুতার মাত্রা। তাই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চেয়ে রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতা এখন আমাদের সামনে বড় বিপদ হয়ে ঝুলছে ডেমোক্লিস-এর তরবারির মতো। এ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রেখে বা একে উপেক্ষা করে ক্ষমতা, সম্পদ, আপাত সুখ উপভোগের মতো বিপজ্জনক প্রবণতা আর কিছু হতে পারে না। আমাদের বুঝতে হবে সমাজ-জীবনে এখন যে অস্থিরতা তার মূলে রয়েছে ওই ঝুলন্ত তরবারির হুমকি। আমাদের রাজনীতিতে, সমাজে, জীবনে যাবতীয় অসহিষ্ণুতার সৃষ্টি অমন এক উদ্যত হুমকি থেকেই।
0 comments:
Post a Comment