বন্দি পাখি ও মানুষের মন by তৌফিক মারুফ

Monday, September 12, 2011

কিশোরী তানিয়া তাকিয়ে আছে পাখিগুলোর দিকে। চোখে পলক নেই, আছে পানি_গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে। যেন অশ্রুর বর্ষণ। তার মা মেয়ের হাত শক্ত করে ধরে আছেন। তিনিও দেখছেন পাখিগুলো। অনেক ঘুঘু। হঠাৎ করেই তানিয়া মায়ের হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য জোরাজুরি শুরু করল। কামড় দিয়ে ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করে। মা জাপটে ধরে মেয়েকে মেঝেতে বসিয়ে দিলেন।

তানিয়ার কান্না আরো বেড়ে যায়। এরপর পা ছড়িয়ে মাথা ঠুকে চলে অঝোরে কান্না। 'ওই যে খাঁচার মইধ্যে পাখিগুলান আটকায়া থাকতাছে, এইডা অয় দেখতে পারতাছে না। আমার মাইয়াডার মাথায় গণ্ডগোল লাগতাছে, সেই জন্যে এইখানতে লইয়া আইছিলাম, এহনতে তো আরো খারাপ অইতাছে দেখলাম।' কী হয়েছে জানতে চাইলে তানিয়ার মা শেফালী বেগম বলেন এই প্রতিবেদককে। রাজধানীর সরকারি মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট হাসপাতালের দোতলার করিডরের দৃশ্য এটি।

কেবল তানিয়া একা নয়, ওই হাসপাতালে আসা আরো অনেকেই কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে থাকে ওই পাখির খাঁচার দিকে। এই দৃশ্য কাউকে কাউকে করে তোলে আরো আবেগপ্রবণ। কেউ কেউ আনমনে তাকিয়ে থাকে পাখির দিকে। পাখির ওড়াউড়ির মধ্যে নিজেকে হয়তো আরো বেশি করে হারিয়ে ফেলে। হাসপাতাল ভবন ঘুরে দেখা যায়, চতুর্ভুজ আকৃতির ভবনের মাঝখানের ফাঁকা এক চিলতে জমির ওপর গাছগাছালির বাগান। আছে ছোট চৌবাচ্চায় মাছের খামার। নিচ থেকে ভবনের চারতলার ছাদ পর্যন্ত পুরো ফাঁকা জায়গাটি ঘিরে দেওয়া হয়েছে লোহার জাল দিয়ে। ভেতরে অনেক প্রজাতির পাখির ওড়াউড়ি। বেশির ভাগই দেশি ঘুঘু। এ ছাড়া চড়ুই, বাবুই, টিয়া, শালিকসহ অন্য পাখিও রয়েছে। এসব পাখি উড়ে উড়ে বারবার জালের সঙ্গে ধাক্কা খায়। সে দৃশ্য কোনো কোনো রোগীকে হয়তো মুগ্ধও করে।

অবশ্য হাসপাতালের ভেতর এমন পাখির খামার নিয়ে এ হাসপাতালের চিকিৎসক-কর্মচারীদের ভেতর অনেক দিন ধরেই মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। জালবন্দি পাখি দেখে মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন রোগী কান্নাকাটি করে। কেউ কেউ পাখিগুলো ছেড়ে দেওয়ার জন্যও চেঁচামেচি করে থাকে। খামারের কারণে হাসপাতালজুড়েই পাখির বিষ্ঠার দুর্গন্ধ ছড়িয়ে আছে। রোগী-দর্শনার্থী অনেকেই নাকে কাপড় চেপে থাকেন এ হাসপাতালে। হাসপাতালের বিভিন্ন পর্যায়ের চিকিৎসক ও কর্মচারীরা বলেন, একটি হাসপাতালের মধ্যে এই নজিরবিহীন পাখির খামারটির কোনো বৈধতা নেই। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কোনো রকম অনুমোদনও নেই। সরকারি এ হাসপাতালে এ খামারটি কোনো গবেষণা বা চিকিৎসা কার্যক্রমভুক্ত নয়। সাবেক এক পরিচালক তাঁর শখ পূরণে ব্যক্তিগত উদ্যোগে এ খামার বানিয়েছিলেন। তিনি অবসরে যাওয়ার পর এ খামারটি এখানে থেকে যায়। এখন এ হাসপাতালের অ্যানেসথেশিয়া বিভাগের একজন চিকিৎসক এই পাখির খামারের তদারকি করেন।

হাসপাতাল সূত্র জানায়, ১৯৬৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠিত ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড হসপিটাল নামের এ প্রতিষ্ঠানটি এখন অনেকটাই লোকোচক্ষুর আড়ালে রয়ে গেছে। রাজধানীর শেরে বাংলানগর এলাকায় এ হাসপাতালটিতে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি প্রদানের কোর্স রয়েছে। যেখানে চিকিৎসক থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ডিগ্রি অর্জনের জন্য পড়াশোনা ও গবেষণা করে থাকেন। পাশাপাশি চলে আবাসিক-অনাবাসিক চিকিৎসা কার্যক্রম। এখন রোগী রয়েছে প্রায় ২০০ জন। এর মধ্যে ১৫০ জন মানসিক রোগী এবং বাকি ৫০ জন্য মাদকাসক্ত। মোট রোগীর মধ্যে ৩০ জনের মতো শিশু। এখানে শিশু ও বড় রোগীদের আলাদা রাখার কোনো ব্যবস্থা নেই। জায়গার অভাবে সব রোগীকে একসঙ্গে রাখা হয়। মোট বিভাগ রয়েছে ১০টি। এর মধ্যে সাতটি সরাসরি চিকিৎসার জন্য এবং বাকি তিনটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার কারিগরি বিভাগ।

হাসপাতালের ভেতর পাখির খামার করা সম্পর্কে জানতে চাইলে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. গোলাম রাব্বানী বলেন, 'এটি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কোনো কিছু নয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কোনোরূপ সিদ্ধান্তে ও পরিচালনায় এটি স্থাপিত বা পরিচালিত হয় না। জীববৈচিত্র্যপ্রেমী সাবেক এক পরিচালক এ হাসপাতালের দায়িত্বে থাকার সময় তাঁর ব্যক্তিগত শখ থেকে এটি তৈরি করেছিলেন। এখনো সেটি রয়ে গেছে। এখন এখানকার অন্য একজন চিকিৎসক এটি ব্যক্তিগতভাবে দেখভাল করেন।' রোগীদের মাঝে এ খামারে বন্দি পাখিদের নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে পরিচালক বলেন, এটি অস্বাভাবিক নয়। বন্দি পাখি দেখে যে কারো যে কোনো সময় বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতেই পারে। এতে অনেক সময় রোগীদের মনের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়াটাও অস্বাভাবিক নয়। তবে পরিচালক এর সঙ্গে আরো যোগ করে বলেন, বিষয়টি একেকজনের মনের তাৎক্ষণিক অবস্থা ও অবস্থানের ওপর নির্ভর করে। অনেক সময় এ পাখির খামার দেখে অনেকের মনে প্রশান্তি আসতে পারে বা ভালোও লাগে। পরিচালক বলেন, এ খামারের বিষয়ে এর আগে খুব একটা ভাবা হয়নি। এখন বিষয়টি নিয়ে ভেবে দেখার অবকাশ রয়েছে। এটি ক্ষতিকর হলে সে ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

এ খামার পরিচালনায় অর্থ ও জনবল জোগানের ব্যাপারে পরিচালক জানান, হাসপাতালের কোনো তহবিল থেকে এর জোগান হয় না। যে চিকিৎসক এটি দেখভাল করেন, তিনিই তাঁর ব্যক্তিগত অর্থে সব করে থাকেন। হাসপাতালের একাধিক কর্মচারী এ খামার পরিচর্যায় নিয়োজিত থাকেন।

এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক চিকিৎসক বলেন, একটি সরকারি হাসপাতালের মধ্যে এমন একটি ব্যক্তিগত খামার থাকার ঘটনা নজিরবিহীন। তাও একটি মানসিক হাসপাতালে! এখানকার রোগীও যেমন এক ধরনের বন্দি জীবনযাপন করে, পাখিগুলোও তেমনি বন্দি থাকে_এটা হতে পারে না। এক রোগীর অভিভাবক আলতাফ হোসেন বলেন, 'দেখেন এখানে চিকিৎসার স্বার্থে যেমন রোগীদেরও বন্দি করে রাখা হয়, তেমনি পাখিগুলোকেও বন্দি করে রাখা হয়েছে। পুরো পরিবেশটাই কেমন অমানবিক মনে হয়।' আরেক চিকিৎসক বলেন, এর আগে এ খামারটি অপসারণে একবার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রভাবশালী একটি মহলের চাপে তা সম্ভব হয়নি। আগের পরিচালক নিজের বাড়িতে পাখির খামার না করে কেন এ সরকারি হাসপাতালের জায়গায় করলেন, তা নিয়ে এখনো অনেকের মনেই প্রশ্ন রয়েছে।

সাধারণের ভালোবাসায় সিক্ত দুই অনন্য প্রতিভা

Tuesday, August 16, 2011

মেঘ কেটে যাওয়া সকালের রোদে প্রকৃতি ছিল উষ্ণ। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাদদেশে গগনশিরীষ গাছগুলোর নিচে কালো ব্যানার টানানো মঞ্চের সামনে কফিনে শায়িত দুই বন্ধুর জোড়া লাশ। তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর। কফিন বন্ধ। নিমেষের আকস্মিকতায় প্রাণবন্ত মানুষ থেকে তাঁরা ক্ষতবিক্ষত শবদেহে পরিণত। সেই বেদনা ক্ষোভ হয়ে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আসা অগণিত জনের কথায়। রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী, কবি, ছাত্র—সবাই বলেছেন, এ তো দুর্ঘটনায় মৃত্যু নয়, বলতে হয় রাজপথে প্রকাশ্যে হত্যাকাণ্ড। রাষ্ট্র এর দায় এড়াতে পারে না।
সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ যখন তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের শববাহী গাড়ি শহীদ মিনারে আসে, এর আগে থেকেই মানুষে ভরে উঠেছিল চত্বর। নেপথ্যের করুণ সুর বিমর্ষতা ছড়িয়ে দিচ্ছিল পরিবেশে। দল-মত, বয়স-ধর্মনির্বিশেষে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ এসেছিলেন অকালপ্রয়াত এই দুই বন্ধু, দেশের দুই প্রতিভাবান কৃতী সন্তানের প্রতি সশ্রদ্ধ ভালোবাসা নিবেদন করতে। প্রিয়জন হারানোর বেদনার সঙ্গে সমবেত মানুষের মনে তীব্র হয়ে উঠেছিল ‘সড়ক দুর্ঘটনা’ নামের প্রতিকারহীন মৃত্যুর ক্ষোভ ও যন্ত্রণা।
আক্ষেপ করছিলেন সবাই, মাটির ময়না আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনেছিল। তারেক-মিশুক জুটির নতুন উদ্যোগ ছিল কাগজের ফুল। আগামী দিনে আরও নতুন নতুন কাজ হয়তো আরও বড় অর্জনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেত দেশের চলচ্চিত্রশিল্পকে। কিন্তু হায়, না ফুটতেই ঝরে গেল সেই ফুল!
শোকের মিছিল: ব্যানার নিয়ে, পুষ্পস্তবক সঙ্গে করে বা একাকী ফুলের গুচ্ছ নিয়ে মিছিলের মতো জনস্রোত নেমেছিল শহীদ মিনারে। উত্তর দিকের প্রবেশপথ থেকে যাত্রা করে পায়ে পায়ে তাঁরা শহীদ মিনারের মূল বেদির পাশ দিয়ে ঘুরে এগিয়ে আসছিলেন পুব পাশের প্রবেশপথের ধারে শোকমঞ্চের কাছে।
এর আগে সকালে তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের শবদেহ আনা হয়েছিল এটিএন নিউজের কার্যালয়ে। সেখানে জানাজার পর পূর্বনির্ধারিত সময়সূচি অনুসারে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য মরদেহ শহীদ মিনারে আনা হয়।
এখানে রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে শোক জ্ঞাপন করে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি, তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ, স্থানীয় সরকার ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির, আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, ঢাকার মেয়র সাদেক হোসেন খোকা, সাংসদ হাসানুল হক ইনু, আসাদুজ্জামান নূর, সারাহ বেগম কবরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, শ্রমজীবী-পেশাজীবী, সাংস্কৃতিক ও ছাত্রসংগঠন এবং ব্যক্তিগতভাবে অগণিত মানুষ হূদয়ের নিখাদ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নিবেদন করেন।
সংগঠন-প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ছিল: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, গণতন্ত্রী পার্টি, গণফোরাম, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, বাংলা একাডেমী, শিল্পকলা একাডেমী, ছায়ানট, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন, বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ, গণসংগীত শিল্পী সমন্বয় পরিষদ, ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠী, ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী, বাউল একাডেমি, জাতীয় কবিতা পরিষদ, সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্র, পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদ, ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ, বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার, এফডিসি, বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ, বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল, প্রথম আলো, দ্য ডেইলি স্টার, সমকাল, ভোরের কাগজ, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল, টিএসসি, বঙ্গবন্ধু একাডেমি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শহীদ পরিবার কল্যাণ সমিতি, ’৭১-এর পরিবার, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, জাতীয় জাদুঘর, লোকশিল্প জাদুঘর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, মুক্তির গানের শিল্পীবৃন্দ, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, নারী প্রগতি সংঘ, নিজেরা করি, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, প্রশিকা, নায়েম, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ, খেলাঘর আসর, প্রামাণ্যচিত্র পর্ষদ, যুব ইউনিয়ন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ, বেঙ্গল ফাউন্ডেশন, স্বভূমি লেখক পরিষদ প্রভৃতি।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের পক্ষ থেকে এই শ্রদ্ধা নিবেদনের আয়োজন করা হয়েছিল। জোটের সহসভাপতি গোলাম কুদ্দুছ সংগঠনগুলোর পরিচিতি এবং প্রয়াত জনের নানা তথ্য ও তাৎপর্য তুলে ধরেন। জোহরের নামাজের পর হয় জানাজা। কিন্তু এত লোকসমাগম হয়েছিল যে নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে এলেও অনেকেই দীর্ঘ সারিতে অপেক্ষা করছিলেন ফুল নিয়ে।
শহীদ মিনার থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের দিকে শবযাত্রার আগে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসির উদ্দীন ইউসুফ সমবেত জনতার উদ্দেশে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অবিচল আস্থা রেখে তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর তাঁদের শিল্পপ্রয়াস চালিয়ে গেছেন। বহির্বিশ্বে আমাদের গুপ্তহত্যা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগের যে নেতিবাচক পরিচিতি রয়েছে, তার বিপরীতে আমাদের সৃজনশীলতার পরিচয় তুলে ধরেছিলেন তারেক মাসুদ। জাতি তাঁদের কখনো ভুলবে না।’ এরপর সবাই এক মিনিট নীরবতা পালন করেন প্রয়াত দুই কৃতীর স্মরণে। শহীদ মিনার চত্বরে নেমে আসে এক প্রগাঢ় স্তব্ধতা।
শোক থেকে ক্ষোভ: সাংসদ হাসানুল হক ইনু বললেন, ‘সড়ক-মহাসড়কে যে বিশৃঙ্খলা চলছে, তাতে সরকার ও প্রশাসন যে আছে জনগণ তা টের পাচ্ছে না। ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়ক বন্ধ হয়ে আছে। এক দিনে মহাসড়কে এমন ভয়াবহ অবনতি ঘটেনি। বোঝাই যায়, কোনো তদারকি নেই। গাড়ির চালকদের কীভাবে লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে, কেন এত দুর্ঘটনা ঘটছে—কোনো বিষয়ে কোনো সুষ্ঠু নিয়ম-শৃঙ্খলা নেই। এসব মৃত্যু হত্যাকাণ্ডেরই শামিল। দেশবাসী আর কোনো অজুহাত শুনতে চায় না। শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে আজ, এই মুহূর্ত থেকেই কাজ দেখতে চায় জনগণ। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ নিতে হবে। ব্যর্থ হলে এর দায়িত্ব কেউ এড়াতে পারবেন না।’
একই রকম প্রতিক্রিয়া ছিল প্রবীণ সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানীর। বললেন, ‘যোগাযোগমন্ত্রীর পদত্যাগ করা উচিত। যাঁদের উদাসীনতায় রোজ অসংখ্য সাধারণ মানুষ ও প্রতিভাবান প্রাণ অকালে ঝরে যাচ্ছে, তাঁরা কী করে পদ আঁকড়ে থাকেন? কী দায়িত্ব পালন করেন তাঁরা?’
প্রাবন্ধিক সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘এ ধরনের অপমৃত্যুকে আমি হত্যাকাণ্ড হিসেবেই গণ্য করি। এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী আমাদের রাষ্ট্র। রাস্তাঘাট নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। সেই দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্র সম্পূর্ণ ব্যর্থ। কাজেই এমন দুর্ঘটনায় আরও কত প্রাণ ঝরে যাবে, তার নিশ্চয়তা নেই।’ তিনি বলেন, সরকার যদি এই মৃত্যু থেকে শিক্ষা না নেয়, তবে জাতিকে আরও চরম মূল্য দিতে হতে পারে।
কবি নির্মলেন্দু গুণ বলেন, ‘দুর্ঘটনা তো ঘটছেই। রাস্তা বন্ধ হয়ে গেলেও সরকারের টনক নড়ে না। সড়ক অচল মানে দেশ অচল। কর্মকর্তারা নিষ্ক্রিয়। যোগাযোগমন্ত্রীর পদত্যাগ করা উচিত তাঁর অকর্মণ্য কর্মকর্তাদের সচেতন করার লক্ষ্যে। আমার মনে হয়, যোগাযোগমন্ত্রী স্বেচ্ছায় পদত্যাগ না করলে প্রধানমন্ত্রীর উচিত তাঁকে পদত্যাগে বাধ্য করা।’
প্রাবন্ধিক মফিদুল হক বলেন, ‘জাতীয় সংকটের সবচেয়ে বড় প্রতিফলন সড়কপথের বিশৃঙ্খলা। এই দুই তরুণ প্রতিভার কাছে আমাদের আরও অনেক কিছু পাওয়ার ছিল। কিন্তু তাঁরা অকালে চলে গেলেন এই বিশৃঙ্খলার শিকার হয়ে।’
বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বললেন, ‘মানুষকে তো চলাচল করতে হবে। কাজেই পথের নিয়ম-শৃঙ্খলা রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি। তারেক ও মিশুক বাংলা একাডেমীর হয়ে ভাষা আন্দোলনের ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করছিলেন। এ বছরই কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেই কাজ আর আমরা দেখতে পারব না। জাতির জন্য এটি অত্যন্ত দুঃখের ঘটনা।’
এভাবেই দুঃখ ও ক্ষোভ, শোক আর আক্ষেপ মিলে মানুষের মনে এক অসহ্য যন্ত্রণার কারণ হয়ে উঠছিল এই দুই প্রতিভার অকালপ্রয়াণ।
জানাজা: শহীদ মিনার থেকে শববাহী গাড়ি প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে নেওয়া হয়। সেখান থেকে বাদ জোহর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে জানাজা হয়।
তারপর আবার শবযাত্রা। শবানুগামী নানা বয়সী মানুষের ঢলের দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছিল, মানুষের প্রতি যাঁরা আস্থা রাখেন, মানুষকে ভালোবেসে যাঁরা কাজ করে যান, তাঁদের প্রতিও ভালোবাসা জানানোর মানুষের অভাব হয় না কখনো।
দাফন: জানাজার পর মিশুক মুনীরের মরদেহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) হিমাগারে রাখা হয়। তারেক মাসুদের মরদেহ নেওয়া হয় এফডিসিতে। সেখানে তাঁর জানাজা শেষে মরদেহ বিএসএমএমইউর হিমাগারে রাখা হয়।
মিশুক মুনীরের ছোট ভাই আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার কর্মকর্তা আসিফ মুনীর প্রথম আলোকে জানান, সিয়েরালিয়নে কর্মরত জাতিসংঘের কর্মকর্তা তাঁদের বড় ভাই আহমেদ মুনীর (ভাষণ মুনীর) মঙ্গলবার দেশে ফিরবেন। সেদিনই বাদ জোহর বনানী গোরস্থানে মিশুক মুনীরকে দাফন করা হবে।
তারেক মাসুদকে কোথায় দাফন করা হবে তা রোববার রাতেও চূড়ান্ত হয়নি বলে জানিয়েছেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসির উদ্দীন ইউসুফ। ফরিদপুর থেকে তারেকের মা এসেছেন। দাফনের বিষয়ে পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে তিনি জানান।
দোয়া মাহফিল: তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীরসহ দুর্ঘটনায় নিহত পাঁচজনের রুহের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া মাহফিল হবে মিশুক মুনীরের পরিবারের উদ্যোগে। কাল মঙ্গলবার বাদ আসর ১৩৯ রামকৃষ্ণ মিশন রোডের চিওরা হাউসে এই দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের শোক: বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ এবং সাংবাদিক মিশুক মুনীরের অকালমৃত্যুতে গভীর শোক জানিয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল এক শোকবার্তায় তিনি বলেন, এই দুজন তাঁদের সৃজনশীলতা ও কর্মদক্ষতা দিয়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ও সাংবাদিকতার অঙ্গনে যে অনবদ্য অবদান রেখে গেছেন, তা জাতি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। এই মৃত্যুতে দেশ দুই অমূল্য প্রতিভা হারালো।

এ কোন পুলিশ, এ কেমন পৈশাচিকতা!

Monday, August 8, 2011

‘মারি হালা। মারি হালা। পুলিশ কইছে মারি হালাইবার লাই। তোরা মারছ্ না কা? (মেরে ফেল। মেরে ফেল। পুলিশ বলেছে মেরে ফেলার জন্য। মারিস না কেন?)’

লোকজনের জটলা থেকে কেউ একজন এভাবে বলছেন, আর কিছু লোক কিশোর মিলনকে রাস্তার ওপর ফেলে এলোপাতাড়ি কিল-ঘুষি ও লাথি মারছে। একজন লাঠি দিয়ে এলোপাথাড়ি পেটাচ্ছে। একপর্যায়ে এক যুবক ইট দিয়ে তার মাথায় আঘাত করে। মিলনের মৃত্যু নিশ্চিত হলে পুলিশ তার লাশ গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়।
গত ২৭ জুলাই সকালে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে ঘটে এই অকল্পনীয় ঘটনা। ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, ১৬ বছরের কিশোরটিকে পুলিশের গাড়ি থেকে একজন নামিয়ে জনতার হাতে ছেড়ে দিচ্ছে। তারপর শুরু হয় কথিত গণপিটুনি। অবিশ্বাস্য এই হত্যাকাণ্ড ঘটে পুলিশের উপস্থিতিতে।
কোম্পানীগঞ্জে ওই দিন ডাকাত সন্দেহে পৃথক স্থানে ছয়জনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয় বলে পুলিশ দাবি করেছিল। এর মধ্যে টেকেরবাজার মোড়ে মারা হয় তিনজনকে। তাঁদেরই একজন এই কিশোর শামছুদ্দিন মিলন। মিলনকে মারা হয় সকাল সাড়ে ১০টার দিকে। আর বাকি দুজনকে মারা হয়েছিল ভোরবেলায়।
মিলনকে হত্যার অভিযোগ এনে তার মা বাদী হয়ে আদালতে মামলা করেছেন। এ ঘটনায় ‘দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে’ গত শনিবার রাতে কোম্পানীগঞ্জ থানার তিনজন পুলিশ সদস্যকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। তাঁরা হলেন: উপপরিদর্শক (এসআই) মো. আকরাম শেখ, কনস্টেবল আবদুর রহিম ও হেমারঞ্জন চাকমা।
মিলন কোম্পানীগঞ্জের চরফকিরা গ্রামের গিয়াস উদ্দিনের ছেলে। সে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে, তবে এসএসসি দেয়নি। সে চট্টগ্রামে একটি কোম্পানিতে কাজ করে। কয়েক দিন আগে সে বাড়ি এসেছিল। চার ভাইয়ের মধ্যে মিলন সবার বড়। তার বাবা বিদেশে থাকেন।
মিলনকে পুলিশের গাড়ি থেকে নামানো, পিটিয়ে হত্যা এবং লাশ পুলিশের গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত পুরো ঘটনার ভিডিও চিত্র এখন কোম্পানীগঞ্জের বিভিন্নজনের মুঠোফোনে পাওয়া যায়। বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল সময় গতকাল এর ভিডিও চিত্রের উল্লেখযোগ্য অংশ সম্পচারও করেছে।
ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, মারধরের একপর্যায়ে মিলন উঠে দৌড়ে পাশের একটি দোকানে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু উপস্থিত কেউ তাকে বাঁচাতে ন্যূনতম চেষ্টাও করেনি। এ পর্যায়ে সাদা শার্ট ও কালো প্যান্ট পরা একজন ইট নিয়ে সজোরে আঘাত করেন মিলনের মাথায়। সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে মিলন। একই লোক ইট দিয়ে এর পরও মিলনের মাথায় একাধিকবার আঘাত করেন। সঙ্গে আরও কয়েকজন এলোপাতাড়ি লাথি মারতে থাকে। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর মিলনের লাশ পুলিশ গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। পুরো ঘটনার সময় পুলিশের সদস্যরা গাড়ি নিয়ে উপস্থিত ছিলেন।
মিলনের মা কোহিনুর বেগম তাঁর ছেলেকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ এনে গত বুধবার আদালতে মামলা করেছেন। মামলার আরজিতে মিলনকে আটক করে মারধর এবং পুলিশের হাতে সোপর্দ করা পর্যন্ত স্থানীয় বাসিন্দা মিজানুর রহমান ওরফে মানিক ও চরকাঁকড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য জামাল উদ্দিন সম্পৃক্ত ছিলেন বলে অভিযোগ করা হয়।
কোহিনুর বেগম উল্লেখ করেন, গত ২৭ জুলাই সকালে মিলন জমি নিবন্ধনের কাজের জন্য বাড়ি থেকে ১৪ হাজার টাকা নিয়ে উপজেলা সদরের দিকে যায়। পথে সে চরকাঁকড়া বেপারী উচ্চবিদ্যালয়ে পড়ুয়া দূর-সম্পর্কের এক খালাতো বোনের সঙ্গে কথা বলতে বিদ্যালয়ের মসজিদের পুকুরঘাটে বসে অপেক্ষা করছিল। এ সময় মানিক নামের স্থানীয় একজন মিলনকে সেখানে বসে থাকার কারণ জানতে চান।
একপর্যায়ে সেখানে আসেন স্থানীয় ইউপি সদস্য জামাল উদ্দিন। তিনিও মিলনকে সেখানে বসে থাকার কারণ জানতে চান। কারণ জানালে জামাল উদ্দিন ওই মেয়েটিকে বিদ্যালয় থেকে ডেকে এনে মিলনের পরিচয় নিশ্চিত হন। কিন্তু এরপর মানিক ও জামালসহ উপস্থিত লোকজন মিলনকে চড়-থাপড় দিয়ে তার সঙ্গে থাকা নগদ টাকা ও মুঠোফোন ছিনিয়ে নেয় এবং মিলনকে পুলিশে সোপর্দ করে।
কোহিনুর বেগমের অভিযোগ, পুলিশ আহতাবস্থায় মিলনকে হাসপাতাল বা থানায় না নিয়ে টেকেরবাজার এলাকার তিন রাস্তার মোড়ে নিয়ে যায়। সেখানে স্থানীয় লোকজন মিলনকে পিটিয়ে হত্যা করে। পরে পুলিশ সেখান থেকে মিলনের লাশ থানায় নিয়ে যায়।
যোগাযোগ করা হলে ইউপি সদস্য জামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘লোকজন ডাকাত সন্দেহে ছেলেটিকে মারধর শুরু করে। আমি তাকে উদ্ধার করে সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছি। ওই ছেলে নিজেই হেঁটে পুলিশের গাড়িতে উঠেছে। এরপর শুনেছি, তিন রাস্তার মোড়ে লোকজন পুলিশের কাছ থেকে ছেলেটিকে নিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে জামাল বলেন, ‘আমরা তার কাছে যা কিছু পেয়েছি, তা দারোগা আকরামকে দিয়েছি। আমরা তো তাকে (মিলন) মেরে ফেলার জন্য পুলিশের হাতে তুলে দেইনি। পুলিশের কাজ তো কাউকে মেরে ফেলা না। কিন্তু তারা যদি কাউকে মৃত্যুর মুখে ফেলে দেয়, তাহলে কার কী করার আছে।’
পারিবারিক সূত্র জানায়, ওই সময় মিলন কিছু লোক তাকে আটক করেছে বলে মোবাইল ফোনে মাকে জানায়। তার মা মিলনের এক চাচাকে নিয়ে ঘটনাস্থলে এসে জানতে পারেন তাকে পুলিশে দেওয়া হয়েছে।
কোম্পানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিক উল্লাহ গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে জানান, মিলনকে ডাকাত সন্দেহেই লোকজন পিটিয়ে মেরেছে। তিনি বলেন, আদালতে করা তার মায়ের মামলার কপি এখনো থানায় আসেনি।
নোয়াখালীর পুলিশ সুপার (এসপি) হারুন-উর-রশিদ হাযারী গতকাল রোববার দুপুরে জানান, এ ঘটনায় দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগে তিন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ঘটনা তদন্তে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাহবুব রশীদকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে আগামীকাল মঙ্গলবারের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এসপি হারুন-উর-রশিদ হাযারী গতকাল মিলনকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। চরফকিরায় মিলনের বাড়িতে গিয়ে তার পরিবারের সদস্য এবং ওই স্কুলছাত্রীর সঙ্গেও কথা বলেন। পরে এসপি হারুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মিলন অপরাধী কি না, তা এই মুহূর্তে বলা যাবে না। আমরা সব বিষয় খতিয়ে দেখছি।’
স্থানীয় লোকজন জানান, গতকাল পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শনের সময় স্থানীয়ভাবে অপরিচিত কয়েকজন ব্যক্তি মিলনকে নানাভাবে ডাকাত হিসেবে চিহ্নিত করতে তৎপর ছিল।

পোশাক কম্পানিগুলোর নিরাপত্তা প্রসঙ্গ

Thursday, February 17, 2011

কটি ফ্যাক্টরিতে আগুন ধরে ২৬ জন শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনার পর পশ্চিমের ব্র্যান্ড কম্পানিগুলো বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পের নিরাপত্তাবিষয়ক অনিশ্চয়তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে। হা-মীম গ্রুপের একটি কারখানার নবম তলায় আগুন লাগার ঘটনায় আরো কমপক্ষে ১০০ জন শ্রমিক আহত হয়েছেন। এ গ্রুপের হাজার হাজার শ্রমিক গ্যাপ, জেসিপেনি ও ফিলিপ্স-ভ্যান হাউসেনের মতো প্রতিষ্ঠানের জন্য পোশাক তৈরি করে থাকে।

বেঁচে যাওয়া শ্রমিকরা অভিযোগ করেছেন, চুরি ঠেকানোর জন্য নিচে নামার দরজায় তালা দেওয়া থাকার কারণে আতঙ্কিত শ্রমিকরা ছাদ থেকে দড়ি বেয়ে নামার চেষ্টা করতে গিয়ে প্রাণে বাঁচতে ব্যর্থ হন। এ মর্মান্তিক ঘটনার আগে গত ফেব্রুয়ারি মাসে সুইডেনের হেনেস অ্যান্ড মরিৎস কম্পানির জন্য সোয়েটার উৎপাদনকারী একটি কারখানা ধসে ২১ শ্রমিক নিহত হয়েছিলেন। এক দশককাল ধরে ব্র্র্যান্ড কম্পানিগুলো উৎপাদনস্থলের পরিবেশ নিয়ে তদারকির যে চেষ্টা করে আসছে, এ আগুনের ঘটনা সে চেষ্টার সীমাবদ্ধতার কথাই প্রমাণ করল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গ্যাপ বছরের প্রথম দিকে হা-মীম গ্রুপের কারখানা পরিদর্শন করেছে। তারা পরিষ্কারভাবেই অগি্নকাণ্ডে বহির্গমনের পথ সুগম করার কথা উল্লেখ করেছিল। সর্বশেষ অগি্নকাণ্ডের ঘটনার মাত্র এক সপ্তাহ আগে পশ্চিমা ব্র্যান্ড কম্পানিগুলোর প্রতিনিধি,কারখানার মালিক, সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা এবং শ্রমিক নেতারা পোশাক শিল্পে আগুন লাগার সমস্যা নিরসনে ঢাকায় এক জরুরি আলোচনায় মিলিত হয়েছিলেন। উল্লেখ্য, পোশাক শিল্প বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ
রপ্তানি করে থাকে।
এ দুর্ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের জন্য স্পর্শকাতর একটি সময়ে। সম্প্রতি সরকারের মজুরি বৃদ্ধির ঘোষণা নিয়ে শ্রমিক ও কারখানা মালিকদের মধ্যে একটি চরম উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। গত নভেম্বর থেকে নতুন ঘোষিত মজুরি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, কিন্তু শ্রমিক নেতারা অভিযোগ করছেন, কিছু ফ্যাক্টরি কৌশলে মজুরি বৃদ্ধির সিদ্ধান্তকে এড়িয়ে যাচ্ছে। তারা নিম্ন মজুরির শ্রমিকদের শ্রেণীভুক্ত করে বেতন ও বিভিন্ন ভাতা থেকে বঞ্চিত করার উদ্যোগ নিয়েছে।
চট্টগ্রামে ৭০টি কারখানা বিদেশি ব্র্যান্ড কম্পানির জন্য পোশাক উৎপাদন করে থাকে। গত সপ্তাহে সেখানে পুলিশের সঙ্গে সহিংসতায় তিনজন শ্রমিক নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় ২৫০ জনের বেশি আহত হয়েছেন।
চীনের কাছ থেকে স্বল্পমূল্যের পোশাক-বাজার বাংলাদেশে চলে আসার পর থেকেই এই শ্রমিক অসন্তোষ লক্ষ করা যাচ্ছে। গত জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চার মাসে বাংলাদেশ থেকে ৬ দশমিক ৮ ইউএস ডলার মূল্যের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। হা-মীমে এই অগি্নকাণ্ডের পর কারখানার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যুক্তরাষ্ট্রের ব্র্যান্ড কম্পানিগুলো এ দুর্ঘটনার একটি স্বাধীন তদন্ত এবং দুর্ঘটনার শিকার শ্রমিক ও শ্রমিক-পরিবারকে সহায়তা দেওয়ার জন্য চাপ দিয়েছে। বাংলাদেশ থেকে পোশাক রপ্তানিকারক সব ব্র্যান্ড কম্পানি আগামী সপ্তাহে দেশটির উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, সরকার ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনার উদ্দেশ্যে উচ্চপর্যায়ের বৈঠকের তাগিদ দিয়েছে। পোশাক কম্পানিগুলো অন্যান্য কারখানায় যেন এমন দুর্ঘটনা না ঘটে, তা ঠেকাতে এবং কারখানা নিরাপদ করতে কী করণীয়, তা খতিয়ে দেখার ব্যাপারে অংশগ্রহণের আগ্রহ ব্যক্ত করেছে।
বাংলাদেশের অসংখ্য পোশাক কারখানা এমন সব বহুতল ভবন ব্যবহার করছে, যেগুলো শিল্পের জন্য উপযোগী করে নির্মাণ করা হয়নি। শিল্প উৎপাদনের জন্য যে ধরনের ভবন প্রয়োজন, তার সঙ্গে এগুলো সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। হাজার হাজার মেশিন চলার জন্য যে ভারী বিদ্যুতের সরবরাহ প্রয়োজন, তার সঙ্গে বৈদ্যুতিক সিস্টেম মানানসই নয়; যে কারণে এ বিদ্যুতের অগি্নকাণ্ডের আশঙ্কা দেখা দেয়। শ্রমিকদেরও জরুরি অবস্থায় কী করণীয়, সে বিষয়ে বিশেষ কোনো প্রশিক্ষণ নেই।
ক্লিন ক্লোথ কম্পানি হিসাব করে দেখেছে, গত পাঁচ বছরে ২০০ পোশাক শ্রমিক অগি্নকাণ্ডে নিহত হয়েছেন। ২০০৫ সালে ৬৪ জন শ্রমিক স্পেকট্রাম কম্পানি ধসে পড়ায় প্রাণ দিয়েছেন।
ব্রিটেনভিত্তিক এথিক্যাল ট্রেডিং ইনেশিয়েটিভের পরিচালক পিটার ম্যাকঅলিস্টার বাংলাদেশের সাম্প্রতিক এ ঘটনাকে বিপজ্জনক ত্রুটি বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, 'এ রকম প্রতিটি নতুন ঘটনাই বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের সংকট আরো ঘনীভূত করছে।'

জোনাথন বির্চাল ও অ্যামি কাজমিন
ফিন্যানশিয়াল টাইমস থেকে ভাষান্তর : মহসীন হাবিব

জিম্মি নাবিকদের মুক্ত করুন

ত ৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশের পতাকাবাহী এমভি জাহান মনি সিঙ্গাপুর থেকে সুয়েজ খাল হয়ে ইউরোপের উদ্দেশে যাওয়ার পথে আরব সাগরে প্রবেশ করলে লাক্ষা দ্বীপপুঞ্জের কাছে সোমালি জলদস্যুরা একে ধাওয়া করে। জাহাজটি দখল করে তারা সোমালি উপকূলে নিয়ে যায় এবং ৬২ কোটি টাকা মুক্তিপণ দাবি করে।

পণ্যবোঝাই জাহাজটিতে ২৫ জন নাবিক এবং জাহাজের প্রধান প্রকৌশলীর স্ত্রীও রয়েছেন। কিন্তু বেশ কয়েক দিন পার হয়ে গেলেও এখনো সরকার বা জাহাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কেউ এ সমস্যার কোনো সমাধানে পেঁৗছতে পারেনি। পরিস্থিতি খুব আশাপ্রদ নয় দেখে নাবিকদের নিকটাত্মীয়রা রবিবার সংবাদ সম্মেলন করে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেন। তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানিয়েছেন যেকোনো মূল্যে নাবিকদের জীবিত ফিরিয়ে আনার। এখন শুধু নাবিকদের আত্মীয়স্বজনই নয়, গোটা দেশ তাকিয়ে আছে প্রধানমন্ত্রী কী ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। এ কথা ঠিক, এমন তীব্র ও বিব্রতকর অবস্থায় বাংলাদেশকে কখনো পড়তে হয়নি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এ ধরনের সংকটে কী করণীয়, তাও বোধ করি বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ভালো করে জানা ছিল না। ব্রিটেন, ভারত, রাশিয়া, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিশালী দেশগুলোকে প্রতিনিয়তই সোমালি জলদস্যুদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে। বিগত দিনে সোমালি জলদস্যুদের দমন করতে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও রাশিয়া যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছে। ব্রিটিশ নৌবাহিনী সোমালি উপকূলে অবস্থান নিয়েছে। কিন্তু কিছুতেই জলদস্যুদের দমন করা যাচ্ছে না। বরং জার্মানির মতো বিশ্বের অনেক শক্তিশালী দেশ মুক্তিপণ দিয়ে জানমাল রক্ষা করতে বাধ্য হয়েছে। তাই বলে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে কেন? বাংলাদেশকে তার নিজের মতো করেই জলদস্যুদের হাত থেকে জানমাল রক্ষার চেষ্টা চালাতে হবে। প্রথমেই সরকারকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে, মুক্তিপণ দিয়ে নাবিকদের রক্ষা করা হবে কি না। যদি সরকার মুক্তিপণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে দ্রুত সেটা সোমালি জলদস্যুদের অবহিত করতে হবে। আর যদি মুক্তিপণ না দিয়ে সোমালিয়া সরকার ও বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে চায়, তাহলে দেশগুলোর সঙ্গে দ্রুত আলোচনা করতে হবে। সর্বোপরি কী ধরনের সিদ্ধান্ত সরকার গ্রহণ করছে, তা সাধারণ মানুষকে তাৎক্ষণিক জানাতে হবে। সরকারের মনে রাখা দরকার, বিষয়টি শুধু নাবিকদের আত্মীয়স্বজন নয়, সারা দেশের মানুষের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। সোমালি জলদস্যুদের হাত থেকে দেশের ২৬ জন নাগরিককে উদ্ধারের চেষ্টার ওপর সরকারের পররাষ্ট্রবিষয়ক ভাবমূর্তি অনেকটা নির্ভর করছে। এমভি জাহান মনিতে জিম্মি নাগরিকরা কোনো দুর্ঘটনার শিকার হলে সরকারকে দেশের মানুষের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। মোট কথা, যে করেই হোক, দেশবাসী দেখতে চায়, তাদের নাগরিকরা অক্ষত অবস্থায় ফিরে এসেছে। মানবিক বিবেচনাকেই জিম্মি সমস্যার সমাধানে সর্বোচ্চ স্থান দিতে হবে। উল্লেখ্য, নেদারল্যান্ডস, ব্রিটেন, জার্মানির মতো দেশগুলো বিগত দিনে মুক্তিপণ দিয়ে তাদের নাগরিকদের ছাড়িয়ে নিয়েছে। সুতরাং এ সম্ভাবনার কথাও সরকারকে মাথায় রাখতে হবে।

বিবেকের কড়া নেড়ে গেল কিশোরী হেনা

Wednesday, February 2, 2011

মা আকলিমা বেগম বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। হেঁটে মেয়ের লাশের পাশেও যেতে পারছেন না। বাবা দরবেশ খাঁ মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছেন। বিড়বিড় করে বলছেন, ‘আমার মেয়েটি এভাবে মেরে ফেললো, কেউ প্রতিবাদ করলো না। আল্লাহ, তুমি পাষণ্ডদের শাস্তি দিয়ো।’ সমাজপতিদের দোররার আঘাতে তাঁদের কিশোরী মেয়ে হেনা আক্তার মারা গেছে সোমবার রাতে। গতকাল বুধবার বিকেল চারটায় মেয়ের লাশ বাড়ি এসেছে।
কান্নায় ভেঙে পড়েছে পরিবার-প্রতিবেশীরা। দরিদ্র দরবেশ খাঁর বাড়িতে কাল যেন মানুষের ঠাঁই ধরে না। শত শত মানুষ ছুটে এসেছে। হেনার পরিবারের সদস্যদের কান্নার ঢেউ গিয়ে লেগেছে তাদের অনেকের মনে। চোখ ভিজে গেছে তাদের। হেনার করুণ মৃত্যু ক্ষুব্ধ করেছে অনেককে, নাড়া দিয়েছে বিবেকে। দোষীদের শাস্তি চেয়েছে তারা।
শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার চামটা গ্রামে ফতোয়াবাজেরা ধর্ষণের শিকার ১৪ বছরের কিশোরী হেনাকে ৭০-৮০টি দোররা মারলে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সে। হাসপাতালে নেওয়ার পর সে মারা যায়। গ্রামের অনেকের সামনেই ঘটেছে এই দোররা মারার ঘটনা, কিন্তু কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পায়নি। ধর্ষক মাহাবুবের স্ত্রীর বড় বোন জাহানারা হেনাকে দোররা মেরেছেন।
হেনাদের প্রতিবেশী হোসনে আরা বলেন, ‘সালিসে আমরা উপস্থিত ছিলাম। সেখানে মাওলানারা প্রথম হেনাকে মাটিতে গেড়ে পাথর মারার নির্দেশ দিয়েছিলেন। অন্য সালিসদারদের অনুরোধে পাথর মারার পরিবর্তে তাকে দোররা মারার রায় দেওয়া হয়। আমরা উপস্থিত থেকে শুধু চোখের পানি ফেলেছি। কোনো প্রতিবাদ করার সাহস পাইনি।’
আরেক প্রতিবেশী নুরুল ইসলাম বলেন, ‘সালিসে কথা বলার কোনো সুযোগ পাইনি। দাঁড়িয়ে থেকে আক্ষেপ করেছি। গরিব লোক বলে তাদের সঙ্গে এটা করা সম্ভব হয়েছে।’
বিক্ষোভ, সমাবেশ, মানববন্ধন: তবে হেনার মৃত্যু আবার বিবেকবোধে তাড়িত করেছে অনেককে। তারা ধর্ষক মাহাবুব ও ফতোয়াবাজদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে শরীয়তপুরে বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ ও মানববন্ধন করেছে। বেলা ১১টায় পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোট, আমরাই পারি নারীর বিরুদ্ধে সব নির্যাতন বন্ধ করতে, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) ও স্থানীয় বেসরকারি সংগঠন এসডিএস জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন করে। মানববন্ধন শেষে শহরে বিক্ষোভ মিছিল করা হয়। বিক্ষোভ শেষে সমাবেশে বক্তব্য দেন রওশন আরা, অমল দাস, আসমত আলী খান, আহসান উল্লাহ ইসমাইলী প্রমুখ।
দুপুর ১২টায় প্রথম আলো বন্ধুসভা শরীয়তপুর সরকারি কলেজ সড়কে মানববন্ধন করে।
লাশ দাফন: শরীয়তপুর সদর হাসপাতাল মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে পুলিশ গতকাল দুপুর ১২টায় হেনার মৃতদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে। বিকেল পাঁচটায় চামটা গ্রামে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক মো. সানোয়ার হোসেন, পুলিশ সুপার এ কে এম শহিদুর রহমান জানাজায় অংশ নেন।
চারজন রিমান্ডে, অন্যরা অধরা: মঙ্গলবার রাত ১০টায় নিহত হেনার বাবা বাদী হয়ে নড়িয়া থানায় ১৮ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেছেন। পুলিশ গ্রেপ্তার হওয়া চারজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে সাত দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করলে বিচারিক হাকিম আবদুল মান্নান আসামি শিল্পী বেগমের তিন দিন, মসজিদের ইমাম মফিজ উদ্দিনের দুই দিন, জয়নাল মীরমালত ও আলাবক্স করাতীর এক দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। প্রধান আসামি ধর্ষক মাহাবুব ও অন্য ফতোয়াবাজদের পুলিশ এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
শরীয়তপুরের পুলিশ সুপার এ কে এম শহিদুর রহমান বলেন, এই নৃশংস ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত, তারা কেউ রেহাই পাবে না। বাকি আসামিদের গ্রেপ্তারের জন্য বিভিন্ন জায়গায় সোর্স লাগানো হয়েছে।
জেলা প্রশাসক মো. সানোয়ার হোসেন বলেন, ‘এই ন্যক্কারজনক ঘটনাটি আমাদের হতভম্ব করেছে। অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশের সঙ্গে আমরা সার্বক্ষণিক সমন্বয় করছি।’
প্রলোভন: নিহত হেনার পরিবারের অভিযোগ, ঘটনা ধামাচাপা দিতে হেনার পরিবারকে সাত লাখ টাকা দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন হেনা হত্যা মামলার আসামি চামটা ইউনিয়ন পরিষদের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ইদ্রিস ফকির। হেনার ভাই ইকবাল হোসেন বলেন, ‘আমরা হতদরিদ্র মানুষ। এর সুযোগ নিয়ে টাকা দিয়ে মাহাবুব ও ফতোয়াবাজদের নেতা ইদ্রিস মেম্বার মীমাংসা করতে চায়। মামলা না চালানোর শর্তে তারা আমাদের সাত লাখ টাকা দিতে চায়।’ তিনি জানান, মঙ্গলবার রাতে ইদ্রিস মেম্বারের এক আত্মীয়ের বাড়িতে সভা করে টাকা দিয়ে মীমাংসা করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয় বলে তাঁরা জানতে পেরেছেন। তিনি বলেন, ‘আমার বোন চলে গেছে, টাকা দিয়ে কী হবে? আমরা হত্যাকারীদের বিচার চাই।’
হেনার বাবা দরবেশ খাঁ বলেন, ‘আমার মেয়েকে ধর্ষণ করার পর কোনো বিচার পেলাম না। উল্টো মেয়েকে বিচারের মুখোমুখি হয়ে জীবন দিতে হলো। এমন সমাজে বসবাস করতেও কষ্ট লাগছে। আমি কোনো টাকাপয়সা চাই না, মেয়ে হত্যার বিচার চাই।’
চামটা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন রাঢ়ী বলেন, নৃশংস এই ঘটনায় এলাকার মানুষ হতবাক হয়ে গেছে। সবাই অভিযুুক্তদের শাস্তি দাবি করছে। তিনি বলেন, ‘একটি চক্র হেনার পরিবারকে টাকা দিয়ে ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে বলে শুনেছি।’
পূর্বাপর হেনা: হেনা পঞ্চপল্লী গুরুরাম উচ্চবিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছে। অর্থকষ্টের কারণে ২০০৮ সালে পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়। রোববার রাত আটটার দিকে প্রাকৃতিক কাজে ঘরের বাইরে গেলে হেনাকে প্রতিবেশী মাহাবুব (৪০) ধর্ষণ করেন। হেনার চিৎকারে দুই পরিবারের লোকজন বেরিয়ে আসে। এর মধ্যে মাহাবুবের স্ত্রী শিল্পী বেগম ও দেবর নিপু ঘটনার জন্য হেনাকে দোষারোপ করে মারধর করেন। সোমবার বিকেলে সালিস বৈঠকে মাহাবুবের পাশাপাশি হেনাকেও ১০০ দোররা মারার রায় দেন সমাজপতিরা। ৭০-৮০টি দোররা মারার পর হেনা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। হাসপাতালে নিলে সে মারা যায়।
গ্রামের আবুল হাশেম মীর বলেন, হেনার বাবা সহজ-সরল গরিব কৃষক। অন্যের জমিতে শ্রম বিক্রি করে সংসার চালান। স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে সংসার। ছোট মেয়ে হেনা শান্ত স্বভাবের ছিল। এমন একটি অসহায় পরিবারের সঙ্গে এই নির্মমতা এলাকার মানুষের মনে নাড়া দিয়েছে।’
হেনাদের বাড়িতে দুটি ছোট টিনের ঘর। একটিতে হেনার চাচা থাকেন। আরেকটি ঘরে থাকে হেনারা। গতকাল টিনের সে ঘরটি ঘিরে ছিল এলাকার কয়েক শ মানুষ। স্বজনেরা ঘর আর আঙিনায় বসে বিলাপ করছে।
মুন্সিগঞ্জেও মানববন্ধন: মুন্সিগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, মুন্সিগঞ্জে প্রথম আলো বন্ধুসভার উদ্যোগে মানববন্ধন হয়েছে। দুপুর দুইটার দিকে জেলা শিল্পকলা একাডেমীর সামনে অনুষ্ঠিত মানববন্ধনে বন্ধুসভার কেন্দ্রীয় পরিচালনা পর্ষদের সাধারণ সম্পাদক সাইদুজ্জামান রওশন, বন্ধুসভার সভাপতি খালেদা খানম, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি মতিউল ইসলাম, বন্ধুসভার উপদেষ্টা তানভীর হাসানসহ বন্ধুসভার সদস্যরা অংশ নেন।

মেয়েটির জন্য কারও মায়া হলো না!

৪ বছরের কিশোরী হেনা ৭০-৮০টি দোররার আঘাতের পর মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। তার আগে ছোট্ট এই মেয়েটি সয়েছে ধর্ষণের ভয়ংকর শারীরিক-মানসিক যন্ত্রণা। মৃত্যু তাকে হয়তো সব যন্ত্রণা আর এই কুৎসিত সমাজ থেকে মুক্তি দিয়েছে।

হেনার ফুফাতো বোনসহ আত্মীয়রা জানান, শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার চামটা গ্রামের দরিদ্র কৃষক দরবেশ খাঁর মেয়ে হেনা। গত রোববার দিবাগত রাতে মেয়েটি প্রাকৃতিক কাজে ঘরের বাইরে যায়। এ সময় তার দূর সম্পর্কের চাচাতো ভাই মাহাবুব (৪০) তার মুখে কাপড় গুঁজে দিয়ে পাশে তার পরিত্যক্ত একটি ঘরে নিয়ে ধর্ষণ করেন। মেয়েটির চিৎকারে প্রথমে মাহাবুবের স্ত্রী ও ভাই বেরিয়ে আসেন। কিন্তু তাঁরা মেয়েটিকে উল্টো মারধর করেন। একপর্যায়ে হেনার বাবা-মা, ভাই-বোনসহ বাড়ির লোকজন বের হয় এবং মেয়েটিকে উদ্ধার করে। হেনাদের ঘর থেকে মাহাবুবের ঘরের দূরত্ব ২০-২৫ গজ হবে বলে জানিয়েছে স্বজনেরা।
নড়িয়া থানা ও এলাকার সূত্র জানায়, ঘটনা জানাজানি হলে পরের দিন সোমবার চামটা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ইদ্রিস ফকিরের নেতৃত্বে সালিস বৈঠকের আয়োজন করা হয়। সালিসে উপস্থিত হন চামটা আবুল বাশার মাদ্রাসার শিক্ষক সাইফুল ও গ্রামের মসজিদের ইমাম মফিজ উদ্দিন। ইদ্রিস ফকির, লতিফ মীরমালত, আক্কাস, ইয়াসিন ও জয়নাল মীরমালতের সমন্বয়ে পাঁচ সদস্যের বিচারক বোর্ড গঠন করা হয়। তাঁরা ইমাম ও মাদ্রাসার শিক্ষকের সঙ্গে পরামর্শ করে ধর্ষণকারী ও ধর্ষণের শিকার কিশোরী উভয়কেই দোররা মারার রায় দেন। মাহাবুবকে ২০০ দোররা ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা আর কিশোরী হেনাকে ১০০ দোররা মারার ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু ধর্ষকের শাস্তি অর্ধেক কমিয়ে তাৎক্ষণিক সালিসকারীরা তাঁকে ১০০ দোররা মারেন। হেনাকে ৭০-৮০টি দোররা মারার পর সে অচেতন হয়ে মাটিতে পড়ে যায়। স্বজনেরা তাকে উদ্ধার করে নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেন। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোমবার রাতে হেনা মারা যায়।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা গোলাম ফারুক প্রথম আলোকে জানান, সোমবার রাতে জরুরি বিভাগে ভর্তি করার কিছুক্ষণ পরই হেনা মারা যায়।
সালিসকারীরা হেনার মৃতদেহ গ্রামে নিয়ে তড়িঘড়ি দাফনের উদ্যোগ নেন। খবর পেয়ে পুলিশ গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে মরদেহ উদ্ধার করে। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে ইউপি সদস্য ইদ্রিস ফকির, ধর্ষক মাহাবুব ও সালিসকারীরা পালিয়ে যান। পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ধর্ষক মাহাবুবের স্ত্রী, জয়নাল মীরমালত, আলাবক্স করাতি ও ইমাম মফিজ উদ্দিনকে আটক করে। শরীয়তপুরের পুলিশ সুপার শহিদুর রহমান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
হেনার বাবা দরবেশ খাঁ কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমি গরিব হওয়ায় প্রভাবশালীরা আমার মেয়ের সঙ্গে এমন আচরণ করেছেন। এভাবে দোররা মেরে মেয়েটিকে মেরে ফেলা হবে, কখনো ভাবিনি। আমি মেয়ে হত্যার বিচার চাই।’
মাহাবুবের স্ত্রী দাবি করেন, তাঁর স্বামীর সঙ্গে অসামাজিক কাজ করায় গ্রামের মানুষ হেনাকে আটক করে মারধর করে। তিনি সেখানে উপস্থিত হয়ে তাকে মারধর করেছেন।
চামটা ইউপির চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন রাঢ়ী বলেন, ‘ঘটনাটি অত্যন্ত বেদনাদায়ক। ভাবতেই লজ্জা লাগছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত।’
পুলিশের হাতে আটক সালিস বৈঠকে উপস্থিত থাকা আলাবক্স করাতি বলেন, ‘দোররা মারার ফতোয়া আমরা দিইনি। প্রভাবশালী সালিসকারীদের চাপের মুখে এর প্রতিবাদ করতে পারিনি। মেয়েটির এমন পরিণতি হবে বুঝতে পারলে প্রতিবাদ করতাম।’
আটক হওয়া ইমাম মফিজ উদ্দিন বলেন, ‘দোররা মারার রায় ঘোষণা করেছেন বিচারকেরা। উপস্থিত অন্যরা তা বাস্তবায়ন করেছেন। তবে সালিসকারীরা আমাদের সঙ্গে পরামর্শ করেছিলেন। আমরা বলেছি, ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকলে ছেলে ও মেয়ে উভয়কেই শাস্তি পেতে হবে।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন গতকাল রাতে জানান, ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের ধরতে পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
নড়িয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল খায়ের ফকির গতকাল রাত নয়টার দিকে জানান, হেনার মৃতদেহ উদ্ধার করে সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। এরপর ময়নাতদন্তের জন্য লাশ শরীয়তপুর সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। মেয়েটির বাবা বাদী হয়ে গ্রেপ্তার হওয়া চারজনসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন।
পুলিশ সুপার এ কে এম শহিদুর রহমান প্রথম আলোকে জানান, অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালানো হবে।

ফাঁসির আসামিকে মুক্তি বিচারক ও জেল সুপারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থার

Wednesday, January 26, 2011

পিল অনুমতির আবেদন (লিভ টু আপিল) চলাকালে ফাঁসির দুই আসামিকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়ায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট বিচারক ও কারা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন জানানো হচ্ছে। গতকাল মঙ্গলবার আপিল বিভাগে এ আবেদনের অনুমতিও নেওয়া হয়েছে।

সাতক্ষীরার চাঞ্চল্যকর শিশু অর্ণব দাস হত্যা মামলার বাদী নিশান চন্দ্র দাস গতকাল হলফনামা সম্পাদন করে সাতক্ষীরার জেলা ও দায়রা জজ মো. আবুল হোসেন খান এবং সাতক্ষীরার জেল সুপার নুরুন্নবী ভুইয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন জানাতে অনুমতি নেন। ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মো. একরামুল হক টুটুল ও খোন্দকার দিলারুজ্জমান বাদীর পক্ষে আপিল বিভাগের চেম্বার জজ বিচারপতি এস কে সিনহার কাছে অনুমতি চান। আদালত অনুমতি দেন।
মামলা আপিল বিভাগে থাকা অবস্থায় অর্ণব হত্যা মামলার ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত দুই আসামিকে ছেড়ে দেওয়ায় বাদী এ আবেদন করতে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে। আসামিরা হচ্ছে খলিলুর রহমান ও ফারুক হোসেন। গত ৯ জানুয়ারি সাতক্ষীরার দায়রা জজ মো. আবুল হোসেন খান আসামিদের মুক্তির আদেশ দেন। আর কারা কর্তৃপক্ষ গত ১১ জানুয়ারি দুজনকে কারাগার থেকে মুক্তি দেয়।
জানা গেছে, গত বছর ২৪ আগস্ট হাইকোর্ট আসামিদের আপিল শুনানি শেষে এ মামলার পাঁচ আসামিকে বেকসুর খালাস দেন। এরপর হাইকোর্টের রায় স্থগিত করতে রাষ্ট্রপক্ষ আবেদন জানালে আপিল বিভাগ গত বছর ৩১ আগস্ট হাইকোর্টের রায় স্থগিত করেন। পরে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল অনুমতির আবেদন (লিভ টু আপিল) করা হয়।
হাইকোর্টের রায় স্থগিত করার বিষয়টি সাতক্ষীরার দায়রা জজ আদালত ও সাতক্ষীরার জেলা কারাগারকে জানানোর পরও কারাগারে থাকা ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মুক্তি দেওয়া হয়। ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু কালের কণ্ঠকে বলেন, হাইকোর্টের রায় আপিল বিভাগ স্থগিত করার পর ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মুক্তি দেওয়া যায় না। আর রায় স্থগিতের বিষয়টি জেনেও আসামিদের মুক্তির নির্দেশ আদালত অবমাননার শামিল।
উল্লেখ্য, ২০০০ সালের ১৮ জুন সকালে সাতক্ষীরা জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার সাঁইহাটি গ্রামের বিমল দাসের ছেলে সাঁইহাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র অর্ণব দাসকে বিদ্যালয় থেকে পাখি দেওয়ার নাম করে ডেকে নেয় খলিষানি গ্রামের আবু দাউদের ছেলে মুকুল গাজী। ২১ জুন সকালে সাঁইহাটি গ্রামের আবদুর রউফ মোড়লের (মেম্বার) বাড়ির পাশে বাঁশবাগানের নালার মধ্যে অর্ণবের লাশ পাওয়া যায়। এক হাত কাটা, দু চোখ উপড়ানো ছিল অর্ণবের।

ভালোবাসা, জীবন—সব হেরেছে যৌতুকের কাছে!

Tuesday, January 25, 2011

ভালোবেসে সুমন সরদারকে বিয়ে করেছিলেন আইরিন আক্তার। যৌতুকের এক লাখ টাকা দিতে না পারায় সেই মনের মানুষের হাতেই খুন হতে হলো তাঁকে।

আইরিনকে খুন করেই ক্ষান্ত হননি সুমন সরদার, তাঁর লাশটিও গুম করার চেষ্টা চালিয়েছেন। পুলিশের কাছে এসব কথা স্বীকারও করেছেন তিনি। শরীয়তপুরের ডামুড্যা উপজেলার চরমালগাঁও গ্রামে ১৪ ডিসেম্বর এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।
এ ঘটনায় নিহত আইরিনের মা লিপি বেগম গত শুক্রবার ডামুড্যা থানায় সুমন সরদারসহ সাতজনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেছেন। ডামুড্যা থানার পুলিশ গত বৃহস্পতিবার রাতে একটি বিল থেকে আইরিনের লাশ উদ্ধার করেছে। একই দিন তারা সুমন সরদারকে গ্রেপ্তার করেছে।
ডামুড্যা থানা ও মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, চরমালগাঁও গ্রামের মজিবর সরদারের ছেলে সুমন সদর উপজেলার রুদ্রকর গ্রামের আব্বাস সরদারের মেয়ে আইরিন আক্তারকে (১৮) ছয় মাস আগে বিয়ে করেন। বিয়ের আগে তাঁদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। বিয়ের পর সুমন বদলে যান। তিনি আইরিনকে তাঁর মা-বাবার কাছ থেকে এক লাখ টাকা এনে দেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকেন। টাকা না দেওয়ায় আইরিনকে তাঁর স্বামীর বাড়ি নেওয়া হয়নি। ১৩ ডিসেম্বর সুমন তাঁর শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে আসেন। এ সময় তিনি শাশুড়ি ও স্ত্রীকে টাকার জন্য চাপ সৃষ্টি করেন। এ নিয়ে তাঁদের মধ্যে ঝগড়া হয়। পরের দিন স্ত্রীকে নিয়ে কেনাকাটা করার কথা বলে সুমন শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে যান।
মামলার এজাহার সূত্রে আরও জানা গেছে, ১৪ ডিসেম্বর রাতে কয়েকজন সহযোগীর সহায়তায় সুমন তাঁর স্ত্রী আইরিনকে শ্বাসরোধে হত্যা করেন। পরে তাঁরা আইরিনের লাশ বালিয়াকান্দি বিলের কচুরিপানার নিচে লুকিয়ে রাখেন। ১৬ ডিসেম্বর সুমনের মা স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানের কাছে গিয়ে জানান, তাঁর ছেলে আইরিনকে হত্যা করেছে। ইউপি চেয়ারম্যান আ. রাজ্জাক বিষয়টি ডামুড্যা থানার পুলিশকে জানান। পুলিশ সুমনকে আটক করে তাঁর স্বীকারোক্তি অনুযায়ী বৃহস্পতিবার গভীর রাতে বালিয়াকান্দি বিল থেকে আইরিনের লাশ উদ্ধার করে।
ডামুড্যা থানা হাজতে থাকা সুমন সরদার বলেন, ‘আমার শাশুড়ি আমার সঙ্গে সব সময় দুর্ব্যবহার করতেন। তিনি আমাদের বিয়ে মেনে নিতে পারেননি। তাই মানুষের পরামর্শে ও সহযোগিতায় আইরিনকে হত্যা করেছি।’
ডামুড্যা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুল কাদির ভূঁইয়া জানান, সুমন স্ত্রী আইরিনকে হত্যার কথা স্বীকার করেছেন। তাঁর স্বীকারোক্তি অনুযায়ী আইরিনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।

অবৈধভাবে ইয়েমেনে যাওয়ার পথে সমুদ্রে নিখোঁজ ৮০ জন

Monday, January 24, 2011

সুখের খোঁজে নৌকায় সাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে ইয়েমেনে যাওয়ার পথে অন্তত ৮০ জন আফ্রিকান নাগরিক নিখোঁজ হয়েছেন।

দুটি নৌকার একটি সমুদ্র পাড়ি দিতে গিয়ে তলিয়ে যায়। অপরটির খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। নিখোঁজ নৌকাটিতে ৪০ জন ইথিওপিয়ান নাগরিক ছিলেন যারা উন্নত জীবনের খোঁজে অবৈধভাবে ইয়েমেনে যাচ্ছিলেন। ইয়েমেনের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে সোমবার জানানো হয়েছে, ৪৬ জন যাত্রী নিয়ে সাগরে ডুবে যাওয়া নৌকা থেকে সোমালিয়ার তিন নাগরিককে উদ্ধার করা হয়েছে এবং ৪০ জনকে নিয়ে অন্য একটি নৌকা সাগরে নিখোঁজ হয়েছে। ডুবে যাওয়া নৌকার বেশিরভাগ যাত্রীই ইথিওপিয়ার নাগরিক।

নারী ও শিশুসহ ৩৫ থেকে ৪০ জন যাত্রী নিয়ে নিখোঁজ হওয়া নৌকাটি সম্পর্কে ইয়েমেনের উপকূলরক্ষীদের উদ্ধৃতি দিয়ে ওয়েবসাইটটি জানিয়েছে, "বাতাসে নৌকাটি কোন্ দিকে যাবে এবং যাত্রীদের ভাগ্যে কি আছে তা আমাদের জানা নেই।" জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) জানিয়েছে, ৪৬ জন যাত্রী নিয়ে ডুবে যাওয়া নৌকাটির যাত্রীদের মধ্যে সোমালিয়ার ৫ জন নাগরিককে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। তাদের কাছে জানা যায়, জিবুতি থেকে ছেড়ে আসার তিন ঘণ্টা পর নৌকাটির ইঞ্জিন জেলেদের একটি জালের সঙ্গে আটকে গেলে যাত্রীদের হুড়োহুড়িতে এ দুর্ঘটনা ঘটে। ইয়েমেন হয়ে পশ্চিমের ও মধ্যপ্রাচ্যের সমৃদ্ধ দেশগুলোতে উন্নত জীবন-জীবিকার খোঁজে প্রায়ই সাগর পাড়ি দেয়ার চেষ্টা চালায় আফ্রিকার দরিদ্র মানুষ। কিন্তু অনুপোযোগী নৌকায় যাত্রা করায় প্রায়ই অনেক আফ্রিকান সাগরে ডুবে প্রাণ হারায়।

বখাটের মোটরসাইকেল চাপা দিল ছাত্রীকে: বাঁ পায়ের দুই হাড় ভেঙে গেছে

Thursday, January 20, 2011

ঝোরে কাঁদছে আমেনা। এ কান্না পা ভাঙার অসহ্য ব্যথার জন্য নয়। হতদরিদ্র পরিবারের সংগ্রামী এ মেয়েটির এমন কান্না তার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায়। আমেনার মর্মন্তুদ এ কান্নায় চোখ ভিজছে সহপাঠীসহ হাসপাতালে কর্তব্যরতদেরও।

কখনো নানিকে আবার কখনো প্রিয় বান্ধবীদের জড়িয়ে ধরে কাঁদছে আমেনা আর বারবার চিৎকার করে বলে উঠছে-‘আমার পা ব্যান্ডেজ করে দেন, আমার সামনে ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা। আমি ঢাকায় যাব না...।’
কিন্তু আশঙ্কাজনক শারীরিক অবস্থার কারণে চিকিৎসকদের কাছে হার মানল মেয়েটির নিদারুণ এ আকুতি। তাকে পাঠানো হলো ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে। পড়ালেখা করে শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন ছিল আমেনার। কিন্তু বখাটের মোটরসাইকেলে আমেনার সঙ্গে চাপা পড়ল তার সেই স্বপ্নও।
দারিদ্র্যের কারণে ঘর ছেড়ে নানা-নানির কাছে আশ্রয় নিয়ে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছিল আমেনা আক্তার। কিন্তু তার এ সংগ্রামে বাধা হয়ে দাঁড়াল বখাটের উৎপাত। গতকাল বুধবার বখাটের মোটরসাইকেলের ধাক্কায় আমেনার বাম পায়ের দুটি হাড় ভেঙে ও লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেছে। বড় ধরনের ও ব্যয়বহুল একটি অস্ত্রোপচারের জন্য আমেনাকে গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু হতদরিদ্র আমেনার চিকিৎসার খরচ কিভাবে জোগাড় হবে, এ নিয়েও দেখা দিয়েছে সংশয়। পরিবার সূত্রে জানা যায়, লেখাপড়ার প্রতি ঝোঁক থাকায় আমেনা ছোটবেলা থেকেই নানা-নানির কাছে থাকে। দরিদ্র নানা-নানির সংসারে থেকেই গত বছর আমেনা এসএসসিতে ৪.৭০ পেয়েছে।
অভিযোগে জানা যায়, গতকাল বুধবার দুপুরে উপজেলার নুরুল আমিন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের একাদশ শ্রেণীর মেধাবী ছাত্রী আমেনা আক্তার (১৭) সহপাঠীদের সঙ্গে পাশের ভদ্রাসন জিসি একাডেমির সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যাচ্ছিল। তারা গুহবাড়ি এলাকায় পৌঁছলে মিজান আকনসহ তিন বখাটে ইচ্ছাকৃতভাবে আমেনাদের ওপর তাদের মোটরসাইকেল তুলে দেয়। এতে আমেনাসহ তিন ছাত্রী সড়কের পাশে পড়ে যায়। তাদের মধ্যে গুরুতর আহত আমেনাকে উদ্ধার করে স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে কলেজের ছাত্ররা তাৎক্ষণিক মিজানকে আটক করে। খবর পেয়ে বখাটেদের পরিচিত লোকজন এসে ছাত্রদের ওপর হামলা চালিয়ে মিজানকে মোটরসাইকেলসহ জোর করে নিয়ে যায়। এ সময় বখাটেদের আক্রমণে আমেনার সহপাঠী হাবিবুর, শাওন, নাসির, জসিমসহ ১০ ছাত্র আহত হয়।
এ ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা নুরুল আমিন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সামনে গাছ ফেলে শিবচর-শরীয়তপুর সড়ক অবরোধ করে। পরে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. তরিকুল ইসলাম ও শিবচর থানা পুলিশ এসে এক ঘণ্টা পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বখাটে মিজান পাশের জাজিরা উপজেলার সেনেরচরের ডেঙ্গর আকনের ছেলে। আমেনার বাবা হারুন মোল্লা ঢাকায় বাসের হেলপার ও মা পারভীন গার্মেন্টকর্মী।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আমেনা বলে, ‘বন্ধু-বান্ধব মিলে পাশের একটি স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যাওয়ার পথে ওর (মিজান) গাড়ি চালানো দেখে আমরা সড়কটির এক পাশে চলে যাই। এরপরও ও হেলেদুলে চালাতে চালাতে হাসতে হাসতে আমাদের ওপর মোটরসাইকেল তুলে দেয়। সামনে আমার ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা। আমি মনে হয় আর পড়তে পারব না। শিক্ষক হতে চেয়েছিলাম, কিন্তু স্বপ্নের শিক্ষক হওয়া আর হলো না আমার।’ আমেনার নানি জয়গুন্নেছা বলেন, ‘আমেনার ছোড সময় থিকাই পড়াশোনার ওপর ঝোঁক। তাই অনেক কষ্টের মধ্যেও আমার কাছেই রাইখা পড়াশোনা করাইতাছি। কী দিয়া ওর চিকিৎসা করামু?’
প্রত্যক্ষদর্শী আমেনার সহপাঠী রোকসানা, সাথী, রোকন, জাহিদ বলেন, ‘কলেজে যাওয়া-আসার সময় সব সময়ই বাইরের ছেলেরা মোটরসাইকেল নিয়ে ছাত্রীদের বিরক্ত করে। আজ মিজানসহ তিন বখাটে খালি সড়কে সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃতভাবে ছাত্রীদের ওপর মোটরসাইকেল উঠিয়ে দিয়েছে। এরপর মিজানকে মোটরসাইকেলসহ আটক করলে প্রায় ২০-২৫ বখাটে আমাদের ওপর হামলা চালিয়ে ওকে ছিনিয়ে নেয়। হামলায় আমাদের ১০ ছাত্র আহত হয়েছে। অবরোধকারী ছাত্ররা অভিযোগ করে, একদিকে ইভ টিজিং করল, এরপর প্রতিবাদ করায় আমাদের ওপর হামলা করল। আমেনা সম্পূর্ণ সুস্থ ও উপযুক্ত বিচার না হলে আমরা সামনে কঠোর আন্দোলনে নামব।’
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. অশোক কুমার ভৌমিক বলেন, ‘মেয়েটির বাম পায়ের দুটি লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেছে ও হাড় ভেঙে গেছে। দ্রুত উন্নত চিকিৎসা করাতে না পারলে মেয়েটি পঙ্গু হয়ে যেতে পারে।’ নুরুল আমিন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অধ্যক্ষ মো. লুৎফর রহমান বলেন, ‘এত বড় একটি ঘটনা ঘটার পর আবার ছাত্রদের ওপর হামলা করেছে ওরা। শিক্ষার্থীদের আপাতত আশ্বাস দিয়ে অবরোধ তুলেছি। কিন্তু এর দৃষ্টান্তমূলক বিচার ও আমেনার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা না হলে পরিস্থিতি অস্বাভাবিক হতে পারে।’ তদন্তকারী কর্মকর্তা শিবচর থানার এসআই মো. সালাহউদ্দিন বলেন, ‘ঘটনাটি ইভ টিজিংয়ের চেয়েও ভয়াবহ। মিজানসহ বখাটেরা সম্পূর্ণ ইচ্ছা করেই ঘটনাটি ঘটিয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছি।’

২০০৯ সালে ভারতে ১৭ হাজার কৃষকের আত্মহত্যা

Monday, January 17, 2011

ভারতে ১৭ হাজারেরও বেশি কৃষক ২০০৯ সালে আত্মহত্যা করেছে। আগের বছরের তুলনায় এ সংখ্যা সাত শতাংশ বেশি। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি) গতকাল সোমবার তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে এ কথা জানায়।

'ভারতে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু ও আত্মহত্যা' শীর্ষক প্রতিবেদনে এনসিআরবি জানায়, ২০০৯ সালে ১৭ হাজার ৩৬৮ কৃষক আত্মহত্যা করেন। আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি ছিল মহারাষ্ট্র, কর্নাটক ও অন্ধ্রপ্রদেশে। কিন্তু কী কারণে কৃষক আত্মহননের পথ বেছে নেয়, সে ব্যাপারে কিছু জানায়নি ব্যুরো।
টাটা ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সেস (টিআইএসএস) জানায়, ৩৭ বছরের মধ্যে ২০০৯ সালের বর্ষাকাল ছিল সবচেয়ে বৃষ্টিহীন। এতে দেশব্যাপী বিশেষ করে, দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোয় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ঠিকমতো ফলন ঘরে তুলতে পারেনি কৃষক। তাদের মাথায় ঋণের বোঝা বেড়ে যায়।
এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে অনেকে আত্মহননের পথ বেছে নেয় বলে মনে করে টিআইএসএস। সংস্থাটির দাবি, ভারতে শহরাঞ্চলে আর্থিক উন্নয়ন হলেও এখনো তিনজনের দুইজন গ্রামে বাস করে। ২০০৯ সাল পর্যন্ত গত ১০ বছরে ভারতে দেড় লাখ কৃষক আত্মহত্যা করেছে। সূত্র : এএফপি।

অমানুষিক পন্থায় ভিক্ষাবৃত্তি

ভিক্ষার পাত্র হাতে অন্ধ-বধির কিংবা বিকলাঙ্গ অনেক শিশুকে দেখিতে পাওয়া যায় শহরাঞ্চলে, জনাকীর্ণ স্থানে। এইসব হতভাগ্য শিশুর কেহ কেহ জন্মগতভাবেই প্রতিবন্ধী। কাহারো কাহারো অঙ্গহানি হয়তো ঘটিয়াছে জন্মের পরে নানান রোগে ভুগিয়া।

কিন্তু ইহার বাহিরেও ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত শিশুদের একটি শ্রেণী রহিয়াছে, যাহারা পথে বসিয়াছে অভাবনীয় নিষ্ঠুরতার শিকার হইয়া। পথে তাহারা ইচ্ছাকৃতভাবে বসিয়াছে, তাহাও বলা যাইবে না। প্রকৃতপক্ষে তাহাদের অপহরণ করিয়া হাত-পা ভাঙ্গিয়া দিয়া কিংবা অঙ্গচ্ছেদন করিয়া বিকলাঙ্গ বানান হইয়াছে। তাহাদের চলৎশক্তিহীন করিয়া হাতে ধরাইয়া দেওয়া হইয়াছে ভিক্ষাপাত্র এবং বসাইয়া দেওয়া হইয়াছে পথে, রেল স্টেশনে, স্টিমারঘাটে অথবা অন্য কোনো জনাকীর্ণ স্থানে। উদয়াস্ত ভিক্ষা করিয়া এই নিষ্পাপ শিশুরা যাহা পায় তাহা চলিয়া যায় নির্দয় দুষ্টচক্রের হাতে। র্যাব সদর দফতরে আহূত এক সংবাদ সম্মেলনে সম্প্রতি রক্ত হিম হইয়া আসা এহেন অমানুষিকতার তথ্য প্রকাশ করা হয়। দুইটি মানবাধিকার সংস্থার সহযোগিতায় র্যাব কামরাঙ্গিরচর হইতে এই বর্বরতার হোতাদের একজনকে গ্রেফতার করে। অভিযুক্ত পালের গোদাটিকে র্যাব সদর দফতরে সাংবাদিকদের সামনে হাজিরও করা হইয়াছিল। সেখানে সেই-ই তাহাদের এইরূপ অপকর্মের বিবরণ দিয়াছে। দুষ্কৃতকারী এই চক্রটি যে শুধু শিশুদের অপহরণ করিয়া ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত করে তাহা নয়, ইহারা মেয়েদেরও তুলিয়া নিয়া গিয়া অনৈতিক কাজে নিয়োজিত করিয়া অর্থ উপার্জন করিয়া থাকে।

এই ধরনের নিষ্ঠুরতার সংবাদে সামান্য মানবিক বোধসম্পন্ন ব্যক্তিমাত্রই বিমর্ষ-বিচলিতবোধ করিবেন, ইহাই স্বাভাবিক। তবে ইহাও সত্য যে, বিষয়টি বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের এক রূঢ় বাস্তবতা। আর, এই অনভিপ্রেত বাস্তবতার মূলে যে কারণটি ক্রিয়াশীল তাহা আর কিছু নয়, দারিদ্র্যের তীব্র কশাঘাত। বাস্তবিপক্ষেই দারিদ্র্য এক ভয়ংকর অভিশাপ। সত্য বটে, কঠিন দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করিয়াও সমাজের এক বৃহৎ অংশ সাধু জীবন-যাপনের চেষ্টা করিয়া থাকেন। কিন্তু দারিদ্র্যের আরেক ধরনের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়া থাকে অপরাধপ্রবণতা এবং ভিক্ষুক মানসিকতার মধ্য দিয়া। এইজন্যই বলা হইয়া থাকে, দারিদ্র্য মানবজীবনে অনেক ক্ষেত্রে পাপের পথ খুলিয়া দেয়। তৃতীয় বিশ্বের গরীবীলাঞ্ছিত দেশসমূহে ভিক্ষাবৃত্তি করিয়া জীবনধারণ করিয়া থাকে, এমন লোকের সংখ্যা অনুলেস্নখ্য নয়। কালক্রমে তাহারা ভাবিতে ও বিশ্বাস করিতে শুরু করে যে, ভিক্ষাও একটি পেশা। এই কাজ করিয়াও আয়-রোজগার করা যায়। এইরূপ মানসিকতাই দুষ্টচক্রকে নিষ্ঠুর পন্থায় অন্যকে, সমাজের অসহায়দের ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত করিয়া আয় করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়া থাকে। যাহারা এহেন নির্দয় পন্থা অবলম্বন করে, তাহারাও যে অর্থনৈতিকভাবে খুব সচ্ছল-সম্পন্ন, তাহা নয়। উহারাও আদতে দরিদ্র, কিন্তু চতুর এবং নিষ্ঠুর।

কাজেই সমস্যাটি মূলত:দারিদ্র্যের। যাহারা অপরাধ করে, যাহারা শিশু ও নারী অপহরণ করে, যাহারা শিশুদের বিকলাঙ্গ করিয়া ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত করে, তাহাদের পাকড়াও করিয়া দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি; সে-তো দিতেই হইবে। কিন্তু মূল যে সমস্যা দারিদ্র্য; সেই বৃত্ত হইতেও বাহির হইয়া আসিতে হইবে। উৎপাদন বৃদ্ধি এবং ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করিতে না পারিলে এই সমস্যার টেকসই সমাধান অসম্ভব।

সবরিমালায় নিহতের সংখ্যা শতাধিক

Sunday, January 16, 2011

ভারতের দক্ষিণে কেরালা রাজ্যের একটি মন্দির থেকে তীর্থযাত্রীদের ফেরার পথে পদদলনের ঘটনায় নিহতের সংখ্যা একশ ছাড়িয়েছে। তাদের মধ্যে পাঁচটি শিশু রয়েছে। আহতের সংখ্যাও শতাধিক। গত শুক্রবার রাতে কেরালার ইদ্দুকি জেলার বেঁদিপেরিয়া শহরের কাছে পুল্লুমেদুতে মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনা ঘটে।

ইদ্দুকির দুর্গম পার্বত্য এলাকায় সবরিমালা মন্দিরে প্রতিবছরের মতো গত দুই মাস ধরে ধর্মীয় অনুষ্ঠান চলছিল। এতে জড়ো হয়েছিল হাজার হাজার মানুষ। প্রতিবছর প্রায় ৪০ লাখ মানুষ পরপর কয়েকটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দেয়।
শুক্রবার ছিল মকর জ্যোতি উৎসবের শেষ দিন। পূজা শেষে তীর্থযাত্রীরা ফেরার সময় পদদলনের ঘটনা ঘটে। পুলিশ জানায়, শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টায় তীর্থযাত্রীবাহী একটি বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ভিড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ে। এতে আতঙ্কিত হয়ে ছোটাছুটি শুরু করলে লোকজন পায়ের নিচে চাপা পড়তে থাকে।
বিশেষ পুলিশ কমিশনার রাজেন্দ্র নায়ার বলেন, 'দুর্ঘটনার কারণে তীর্থযাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এতে পদদলনের ঘটনা ঘটে।' মন্দিরটি দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় হওয়ায় উদ্ধারকাজ চালাতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে বলে জানায় পুলিশ।
রাজ্য স্বরাষ্ট্রসচিব জয় কুমার বার্তা সংস্থা এএফপিকে ১০৪ জন মারা যাওয়ার বিষয় নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, আহতদের মধ্যে অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। নিহতদের মধ্যে এখন পর্যন্ত ৫৪ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। স্থানীয় পুলিশ সঞ্জয় কুমার বলেন, 'আমরা এ পর্যন্ত ১০২টি মৃতদেহ উদ্ধার করেছি। উদ্ধারকাজ প্রায় শেষ।' কেরালার গভর্নর আর এস গাভাই এ ঘটনায় গভীর দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
রাজ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কড়িয়ারি বালাকৃষ্ণ জানিয়েছেন, রাজ্য সরকার এ দুর্ঘটনার তদন্ত করবে। কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এ কে অ্যান্টনি বলেন, মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনা মানুষের কল্পনাতীত। সামরিক বাহিনীর স্থানীয় ইউনিটকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। প্রয়োজনে তাদেরও কাজে লাগানো হবে।
দুর্ঘটনার পরপর কেরালার মুখ্যমন্ত্রী ভি এস অচ্যুতানন্দন জরুরি বৈঠক করেন রাজ্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে। তিনি বলেন, 'এটা দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। আহতদের চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমার সরকার ক্ষতিগ্রস্তদের পরিবারকে যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেবে।'
প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এ ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন। পিটিআই জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে এক লাখ রুপি ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
১৯৯৯ সালে একই ধরনের ঘটনায় সবরিমালা মন্দিরের পাশে পাহাড়ি ভূমিধসে আতঙ্কিত হয়ে সৃষ্ট হুড়োহুড়িতে ৫০ জন নিহত হয়। সূত্র : বিবিসি, এএফপি, রয়টার্স ও দ্য হিন্দু।

নয় পুলিশের রক্তে পিচঢালা পথ লাল

রসিংদীতে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় দুই ওসিসহ পুলিশের ৯ সদস্য নিহত হয়েছেন। আহত আরেক পুলিশ সদস্য আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। গতকাল শনিবার সকালে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের শিবপুর উপজেলার ঘাসিরদিয়া এলাকায় একটি মালবোঝাই ট্রাকের সঙ্গে পুলিশের পিকআপ ভ্যানের মুখোমুখি সংঘর্ষে মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনা ঘটে।

নিহতদের সবাই নরসিংদীর বেলাব থানায় কর্মরত ছিলেন। স্থানীয় পৌরসভা নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়ে একটি সভায় যোগ দিতে ওই পুলিশ সদস্যরা নরসিংদী পুলিশ লাইনে যাচ্ছিলেন। দুর্ঘটনায় নিহত পুলিশ সদস্যরা হলেন বেলাব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফারুক আহমেদ খান (৪৫), ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত) জিয়াউল খান (৪০), উপপরিদর্শক (এসআই) কংকন কুমার মণ্ডল (৪২), কনস্টেবল কৃষ্ণ কুমার বর্মণ (৫০), রিয়াজ উদ্দিন (৪০), নারায়ণচন্দ্র কৃষ্ণ (৪৫), বজলুর রহমান (৫০), মাসুদ পারভেজ (৪২) ও গাড়িচালক রেজাউল হক (৪০)। আহত কনস্টেবলের নাম প্রিয়তোষ (৫০)।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, ১৭ জানুয়ারি নরসিংদী ও মনোহরদী পৌরসভার নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়ে নরসিংদী পুলিশ লাইনে একটি সভা ডাকা হয়েছিল। সভায় যোগ দিতে সকালে বেলাব থানার ওসি ফারুক আহমেদসহ ১০ জনের একটি দল পুলিশ ভ্যানে করে সেখানে যাচ্ছিল। সকাল সোয়া ১১টার দিকে তাদের গাড়িটি শিবপুরের ঘাসিরদিয়া এলাকা অতিক্রম করছিল। ওই সময় বিপরীত দিক থেকে আসা একটি মাছবোঝাই ট্রাক (যশোর মেট্রো-ট-১১-২৩৫২) পুলিশ ভ্যানের ওপর উঠে পড়ে। এতে পুলিশ ভ্যানের সামনের অংশ দুমড়ে-মুচড়ে ট্রাকের ভেতর ঢুকে যায়। ঘটনাস্থলেই জিয়াউল খানসহ পুলিশের আট সদস্য নিহত হন। ওসি ফারুক আহমেদ ও কনস্টেবল প্রিয়তোষকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় নরসিংদী জেলা হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে কয়েক মিনিটের মধ্যে ফারুক মারা যান।
নরসিংদীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বিজয় বসাক জানান, মারাত্মক আহত প্রিয়তোষকে প্রথমে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখান থেকে তাঁকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নেওয়া হয়। তাঁর অবস্থা আশঙ্কাজনক। রাত সোয়া ১২টার দিকে যোগাযোগ করা হলে নরসিংদীর পুলিশ সুপার ড. আক্কাসউদ্দিন ভুঁইয়া কালের কণ্ঠকে জানান, প্রিয়তোষের অবস্থার কোনো উন্নতি ঘটেনি।
নরসিংদী জেলা হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল কর্মকর্তা মিজানুর রহমান কালের কণ্ঠকে জানান, দুর্ঘটনার পর ১০ জনকেই জেলা হাসপাতালে আনা হয়। তাঁদের মধ্যে আগেই আটজনের মৃত্যু হয়েছিল। হাসপাতালে আনার ১০ মিনিট পর ফারুক আহমেদের মৃত্যু হয়।
তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, দুর্ঘটনাকবলিত পুলিশের ভ্যান ও ট্রাকটি মহাসড়কে পড়ে রয়েছে। সংঘর্ষের ফলে পুলিশ ভ্যানের সামনের অংশ ট্রাকের ভেতরে চলে যায়। এতে পুলিশের ভ্যানের সামনে থাকা ফারুক, জিয়াউল ও গাড়িচালক রেজাউল ট্রাকের সঙ্গে আটকে পড়েন। খবর পেয়ে শিবপুর থানা পুলিশ, নরসিংদী পুলিশ লাইনের রিজার্ভ পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা ঘটনাস্থলে ছুটে যান। তাঁরা ক্রেন দিয়ে দুদিক থেকে টেনে গাড়ি দুটি আলাদা করেন। সামনে থাকা ফারুককে আশঙ্কাজনক অবস্থায় জেলা হাসপাতালে পাঠানো গেলেও বাকি দুজন আগেই মারা যান। নিহতদের রক্তে লাল হয়ে যায় পিচঢালা পথ। দুর্ঘটনার পর ট্রাকটি আটক করা হলেও এর চালক ও তার সহকারী পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় শিবপুর থানায় একটি মামলা করা হয়েছে।
দুর্ঘটনার পর মহাসড়কের উভয় পাশে দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়। পরে দুর্ঘটনাকবলিত গাড়ি দুটি মহাসড়ক থেকে সরিয়ে নিলে দুপুর ১২টার দিকে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।
নরসিংদীর পুলিশ সুপার জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) হাসান মাহমুদ খন্দকারকে ফোন করে এ দুর্ঘটনায় শোক প্রকাশ করেন। তিনি নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে সহযোগিতার আশ্বাস দেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. এ টি এম শামসুল হুদা এ ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন। আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার নিহতদের পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে বলে জানান।
দুর্ঘটনার পর উদ্ধারকাজে অংশ নেওয়া স্থানীয় ঘাসিরদিয়া গ্রামের জসিমউদ্দিন বলেন, ‘ট্রাকের ভেতর পুলিশের গাড়ি ঢুকে যাওয়ায় আহতদের উদ্ধার করা যাচ্ছিল না।’
নরসিংদী জেলা হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, মেঝেতে সারি সারি লাশ। একসঙ্গে এত সহকর্মীর চলে যাওয়ার ঘটনা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলেন না অন্যরা। শোকে অনেক পুলিশ সদস্য নির্বাক হয়ে পড়েন। কেউ কেউ হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন।
বেলাব থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আরবীকুল কাঁদতে কাঁদতে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সকালে থানায় আমার ডিউটি থাকায় স্যারদের গাড়িতে পুলিশ লাইনে আসা হয়নি। আমি গাড়ির পেছনেই মোটরসাইকেল নিয়ে আসছিলাম। হঠাৎ করে ঘাসিরদিয়ায় আসার পর দেখি আমাদের গাড়িটি ট্রাকের ভেতরে চলে গেছে। আমাদের স্যাররা মারা গেছেন।’ কথাগুলো বলতে বলতে আবারও তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। কান্না থামিয়ে তিনি আবার বলেন, ‘আমাদের গাড়িটি অনেক পুরনো। থানায় কোনো নতুন গাড়ি না থাকায় ব্যবহার অনুপযোগী হওয়া সত্ত্বেও এটি ব্যবহার করা হচ্ছিল। ভালো গাড়ি থাকলে একসঙ্গে এত মানুষকে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হতো না।’
নিহত ফারুকের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার চান্দুরা গ্রামে। তাঁর বাবার নাম আলী আহাম্মদ খান। জিয়াউল খানের বাড়ি জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার বাগডোবা গ্রামে। তাঁর বাবার নাম ডালিম খান। কংকন কুমার মণ্ডলের বাড়ি খুলনা সদর উপজেলার পাইকগাছা গ্রামে। তাঁর বাবার নাম নিত্যানন্দ। এ ছাড়া কনস্টেবল কৃষ্ণ কুমার বর্মণ গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার উত্তর লস্করচালা গ্রামের শ্রীকান্ত বর্মণের ছেলে, রিয়াজ উদ্দিন কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার ঘাগড়া গ্রামের ইউনুস আলীর ছেলে, নারায়ণচন্দ্র কৃষ্ণ ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার ভেহিবখলা গ্রামের সাধন কুমারের ছেলে, বজলুর রহমান মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার আশাপুর গ্রামের ফয়জুদ্দিনের ছেলে, মাসুদ পারভেজ জামালপুর সদর উপজেলার দমদমা গ্রামের ছোহরাব আলীর ছেলে ও গাড়িচালক রেজাউল হক জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার গোবিন্দনগর গ্রামের আবুল কাশেমের ছেলে। আহত প্রিয়তোষ নেত্রকোনা সদর উপজেলার সাতপাই গ্রামের নিরঞ্জন চন্দ্র পালের ছেলে।
দুর্ঘটনার খবর পেয়ে জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী রাজি উদ্দিন আহমেদ রাজু, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সংসদ সদস্য নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন, নজরুল ইসলাম হীরু, জহিরুল হক মোহন, স্বরাষ্ট্রসচিব আবদুস সোবহান শিকদার, আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার, র‌্যাবের মহাপরিচালক মোখলেছুর রহমান, উপমহাপরিদর্শক (ঢাকা রেঞ্জ) মো. আসাদুজ্জামান, নরসিংদীর জেলা প্রশাসক অমৃত বাড়ৈ, পুলিশ সুপার ড. আক্কাছ উদ্দিন ভূঞা, নরসিংদীর পৌর মেয়র লোকমান হোসেন, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান, জেলা বিএনপির সভাপতি খায়রুল কবির খোকন দুর্ঘটনাস্থল ও হাসপাতাল পরিদর্শন করেন।
ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজি উদ্দিন আহমেদ রাজু বলেন, সাধারণ মানুষ দুর্ঘটনায় পড়লে পুলিশের সদস্যরা তাদের বাঁচাতে ছুটে যেতেন। তাঁরা উদ্ধার করতেন। কিন্তু আজ তাঁদেরই দুর্ঘটনার কবলে পড়তে হলো। ঘটনাটি খুবই মর্মান্তিক।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন বলেন, ‘বেলাব থানা থেকে আমার কাছে ফোন যেত একটি গাড়ির জন্য। কিন্তু আমি তাঁদের নতুন গাড়ি দিতে পারিনি। আজ পুরনো গাড়িতে চড়ে দায়িত্ব পালনকালে তাঁদের এমন দুঃখজনক মৃত্যু হলো। এটা মেনে নেওয়া যায় না।’
আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার নরসিংদী জেলা হাসপাতালে নিহত পুলিশ সদস্যদের লাশ দেখে নির্বাক হয়ে যান। কনস্টেবল নারায়ণচন্দ্র কৃষ্ণ ও পুলিশের গাড়িচালক রেজাউল হকের পরিবারকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে তাঁর চোখও ছলছল করে ওঠে। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘পুলিশ বাহিনীকে অনেক প্রতিবন্ধকতার মধ্যে দায়িত্ব পালন করতে হয়। পুলিশের আধুনিক যানবাহনের অভাব রয়েছে। পুরনো লক্কড়ঝক্কড় গাড়ি দিয়ে পুলিশ সদস্যরা দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এভাবেই আত্মত্যাগ করে যাচ্ছেন। এমন আরো অনেক আত্মত্যাগের মধ্য দিয়েই আমরা দায়িত্ব পালন করছি।’
এক প্রশ্নের জবাবে আইজি হাসান মাহমুদ বলেন, পৌরসভা নির্বাচনের আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক সভায় কনস্টেবলদের উপস্থিতি দরকার ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখা হবে।
পুলিশ সুপার ড. আক্কাছ উদ্দিন ভূঞা কালের কণ্ঠকে বলেন, সন্ধ্যার পর নিহতদের মরদেহের ময়নাতদন্ত শেষে নরসিংদী পুলিশ লাইনে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

লাশের পকেটে বেজে উঠল ফোন

রসিংদী জেলা হাসপাতালের লাশঘরে গতকাল সারি সারি রাখা নিহত পুলিশ সদস্যদের লাশ। হঠাৎ বেজে ওঠে মোবাইল ফোন। শব্দ আসছিল নিহত কনস্টেবল রেজাউল করিমের পোশাকের ভেতর থেকে। একজন কনস্টেবল মোবাইল ফোনটি বের করে কল ধরেন।

ও প্রান্তের কথা শুনে বলেন, ‘আমি রেজাউল না। আপনারা দ্রুত জেলা হাসপাতালে আসেন।’ ফোনের লাইন কাটার পর কারো সঙ্গে কথা না বলেই নীরবে কাঁদতে থাকেন ওই কনস্টেবল। হাসপাতালে একইভাবে আরো দুজন নিহত কনস্টেবলের পকেটে মোবাইলের রিং বেজে ওঠে। কনস্টেবল মঞ্জুরুল হক সাংবাদিকদের বলেন, “নিহতের স্বজনরা ফোন করে দুর্ঘটনার খবর জানতে চেয়েছেন। কেউ বলেন, ‘আমার ছেলে এখন কেমন আছে?’ কেউ বলেন, ‘অজয়ের বাবার কী অবস্থা?’ কিন্তু আমি কিভাবে বলব, দুর্ঘটনায় সব শেষ হয়ে গেছে! ”
সকালেও কথা হয়েছিল : ‘পৌরসভা নির্বাচনের কারণে খুব ব্যস্ত থাকতে হবে।
মেয়েদের বলবা, ঠিক সময়ে খাওয়া-দাওয়া করতে।’ স্ত্রী জয়নবুন্নেসা স্মৃতিকে সকালে মোবাইল ফোনে বলেছিলেন নরসিংদীর বেলাব থানার ওসি ফারুক আহমেদ খান। এর দুই ঘণ্টা পর স্ত্রী খবর পান, তাঁর স্বামী সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজার থেকে তিন মেয়ে অনিকা (৯), অর্ণা (৭) ও প্রিয়ন্তিকে (৪) নিয়ে নরসিংদী ছুটে যান স্মৃতি। গিয়ে পান স্বামীর নিথর দেহ।
‘ও দাদা, আমার বাবা কথা বলে না কেন, কী হয়েছে আমার বাবার? গায়ে এত রক্ত কেন?’ দাদা আলী আহাম্মদ খানকে প্রশ্ন করে অনিকা। কী জবাব দেবেন অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক আলী আহাম্মদ খান? বুকচাপড়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘ওরা আমার সোনারে কাইড়া নিছে!’ ওদিকে স্বামীর লাশ দেখে স্মৃতি বিলাপ করছিলেন, ‘তোমাকে ছাড়া ওরা কিভাবে বাঁচবে? কাকে বাবা বলে ডাকবে?’ মায়ের কান্না দেখে প্রিয়ন্তিও কাঁদতে থাকে। বাবাকে হারিয়ে কাঁদছিল অর্ণাও।
রিক্তর কী থাকল? : কনস্টেবল নারায়ণচন্দ্র দাস স্ত্রী ও দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে বেলাব থানার পাশেই ভাড়া বাসায় থাকতেন। ছেলে অজয় প্রসাদ রিক্ত (৭) স্থানীয় একটি কিন্ডারগার্টেনে প্রথম শ্রেণীতে পড়ে। ছোট মেয়ে সমিতা রানী চন্দ্রের বয়স চার বছর। সংবাদ পেয়ে বেলাব থেকে দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে নরসিংদী জেলা হাসপাতালে ছুটে এসেছেন নারায়ণচন্দ্র দাসের স্ত্রী সুবর্ণা রানী চন্দ্র।
সহ্য করতে পারবেন না ভয়ে সুবর্ণাকে স্বামীর লাশের সামনে যেতে দিচ্ছিলেন না নারায়ণের সহকর্মীরা। সুবর্ণা হাসপাতালের বারান্দায় ছেলে-মেয়েকে নিয়ে বসে বিলাপ করতে থাকেন। মায়ের কান্না দেখে দুই পাশে অবুঝ দুই সন্তান নির্বাক হয়ে যায়। রিক্ত সাংবাদিকদের জানায়, ‘সকাল সাড়ে ৮টার দিকে বাবা বাড়ি থেকে বের হন। যাওয়ার সময় বলেন দুষ্টুমি না করতে। আমি কথা দিয়েছি, দুষ্টুমি করব না। কিন্তু এখন আংকেলরা বলছেন, বাবা নাকি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তাহলে কি বাবা আর ফিরে আসবেন না!’
কাঁদতে কাঁদতে সুবর্ণা রানী চন্দ্র বলেন, ‘রাতে নারায়ণের ডিউটি ছিল। ভোর ৫টার দিকে বাড়ি ফেরেন তিনি। আবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে পুলিশ লাইনের উদ্দেশে বাসা থেকে বের হন।’ সকাল ১১টায় আসে দুর্ঘটনার সংবাদ। কাঁদতে কাঁদতে একসময় মূর্ছা যান সুবর্ণা। জ্ঞান ফেরার পর বিলাপ করতে করতে বলেন, ‘দুটি ছোট ছেলে-মেয়েকে এখন কিভাবে আমি মানুষ করব?’
সহকর্মীদের কান্না : সহকর্মীদের লাশ নিজ হাতে ধরে গাড়ি থেকে নামিয়ে লাশঘরে নিয়ে যাচ্ছেন অন্য কনস্টেবলরা। আবার সেই লাশ তাঁরাই নিয়ে যাচ্ছেন পুলিশ লাইনে। লাশ বহনের সময় প্রতিটি সহকর্মীর চোখের পানি গাল বেয়ে পড়ছিল। কনস্টেবল মোস্তফা বলেন, ‘মাসুদ পারভেজ ভাই আমাকে খুব স্নেহ করতেন। দেখা হলেই বাড়ির খোঁজ নিতেন। গতকালও আমাদের কথা হয়। আজ তাঁর লাশ বহন করতে হচ্ছে।’ তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক এখন মৃত্যুফাঁদ। প্রতিদিনই ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটছে।’
সহকর্মীদের মরদেহ গাড়িতে তোলার সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বিজয় বসাকও। এ সময় উপস্থিত অন্যরাও অশ্র“ সংবরণ করতে পারছিলেন না। বিজয় বসাক সাংবাদিকদের বলেন, ‘সকালেও তাঁরা সবাই ছিলেন সহকর্মী। আর এখন তাঁরা আমাদের মধ্যে নেই, আছে তাঁদের নিথর দেহ। এটা কোনো পুলিশের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।’ নরসিংদীর পুলিশ সুপার ড. আক্কাস উদ্দিন দুর্ঘটনার পর থেকে ছোটাছুটি করছেন। তিনি বলেন, ‘নরসিংদী পৌরসভার আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক সভায় আসতে গিয়ে এভাবে প্রাণ হারাতে হবে আমার লোকজনকে, ভাবতেই পারছি না।’
নিহত পুলিশ সদস্যদের মরদেহ দেখে নির্বাক হয়ে পড়েন পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার। নিহতদের পরিবারের স্বজনদের সান্ত্বনা দিতে গিয়ে নিজের চোখই ছলছল করে ওঠে। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘পুলিশে এমন দুর্ঘটনা কখনো দেখিনি।’ তিনি নিহতের পরিবারকে সরকার থেকে বিশেষভাবে সহায়তা করা হবে বলে আশ্বাস দেন। তিনি সনাতন ট্রাফিক আইন পরিবর্তন করে তা যুগোপযোগী করার ব্যাপারেও মত দেন।
আনোয়ার হোসেন নামের একজন সহকর্মী বলেন, ‘বিশ্বাসই করতে পারছি না। গাড়িতে ওঠার আগেও একসঙ্গে চা খেলাম, গল্প করেছি, সেই মানুষগুলো এখন লাশ!’
 
Support : Dhumketo ধূমকেতু | NewsCtg.Com | KUTUBDIA @ কুতুবদিয়া | eBlog
Copyright © 2013. Edu2News - All Rights Reserved
Template Created by Nejam Kutubi Published by Darianagar Publications
Proudly powered by Dhumketo ধূমকেতু