১৯ জানুয়ারি ডেইলি স্টার-এ অধ্যাপক রেহমান সোবহানের নিবন্ধে বাংলাদেশের চলমান সংকট ও তা থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে একটি গভীর বিশ্লেষণধর্মী নিবন্ধ ছাপা হয়েছে।
তবে তিনি সম্ভবত ধরে নিয়েছেন, ত্রয়োদশ সংশোধনী আর ফিরে আসা সম্ভব নয়। এ ধারণা সত্যি হলে আগামী নির্বাচন যখনই হোক একই প্রশ্ন টিকে রইল, দলীয় প্রধানমন্ত্রীকে রেখে প্রকৃত বিরোধী দল নির্বাচনে যাবে কি যাবে না।
তাঁর সঙ্গে দ্বিমত করার অবকাশ সামান্যই। তবে তিনি যেভাবে ‘আওয়ামী লীগের ৬৫ বছরের জীবনকে গণতন্ত্রের লড়াইয়ের ভ্যানগার্ড’ বলেছেন, তা পুরোপুরি মানা কঠিন। দলের ৬৫ বছরকে অন্তত তিনটি ভাগে ভাগ করতে হবে। পাকিস্তান আমল, বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার আমল। তিনি যাদের ‘সেনানিবাসে জন্ম’ বলে খোঁটা দিয়েছেন তার একটি জাতীয় পার্টি, এখন ভ্যানগার্ডের ঘনিষ্ঠ সহযোগী।
বিগত নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেওয়ার কারণে যদি তাঁর দাবি অনুযায়ী দেশের গণতন্ত্র হ্রাস পায়, তাহলে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারসহ সব বিকল্প খতিয়ে দেখতে হবে। তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে প্রতিটি বুথে নির্বাচনী এজেন্ট নিশ্চিত করা, ভোটারের হাতে মুঠোফোন থাকা, দুই থেকে তিন লাখ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকের উপস্থিতি এবং প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে সমান্তরাল ভোট গণনাপদ্ধতি বজায় থাকাটাকে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীর অধীনে নির্বাচনের রক্ষাকবচ মনে করেন বলে প্রতীয়মান হয়। অথচ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঝাঁঝরা থাকা অবস্থায় এগুলো চূড়ান্ত অর্থে রক্ষাকবচ নয়। খালেদা জিয়াকে প্রধানমন্ত্রী রেখে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে যাবে না।
অধ্যাপক রেহমান আগামী ও মধ্যবর্তী নির্বাচন ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীর অধীনেই কল্পনা করেছেন বা অন্যতম বিকল্প ভাবছেন কি না, তা খুবই স্পষ্ট নয়। তবে তিনি গণমাধ্যমের প্রতি ভরসা করে বলেছেন, ‘একটি অপেক্ষাকৃত স্বাধীন ও প্রতিযোগিতামূলক ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া দেশে আছে। এমনকি তারা ৫ জানুয়ারিতেও সারা দেশে (বস্তুত, ১৪৭টি সংসদীয় আসনে) উপস্থিত থেকেছে। এবং তাৎক্ষণিক কিংবা পরদিন সকালে তারা কেবল ভোটারদের নিম্ন উপস্থিতি তুলে ধরেনি, ভোটকেন্দ্র দখল এবং অবৈধভাবে ব্যালট বাক্স ভর্তি করার বিষয়টিও উন্মোচিত করেছে।’ প্রশ্ন হলো, তাতে কি ফল হয়েছে? আমি মনে করি না যে অপেক্ষাকৃত স্বাধীন গণমাধ্যম সুপ্রিম কোর্টের মতো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের অপারগতাকে অতিক্রম করতে পারে।
পূর্বশর্তহীন সংলাপ এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটি সম্পূর্ণ অংশগ্রহণমূলক একাদশ সংসদ নির্বাচনই তাঁর আকাঙ্ক্ষা। তিনি বলেছেন, ‘বিএনপি সহিংসতায় থাকলে ভবিষ্যতের যেকোনো নির্বাচনে সেটাই তার প্রধান দায় হয়ে থাকবে। খালেদা জিয়া ইতিমধ্যে সেটা বুঝেই কর্মসূচি বদলেছেন।’ কিন্তু প্রশ্ন হলো, এর আয়ুষ্কাল কতটুকু?
অধ্যাপক রেহমান বলেছেন গ্রেপ্তারকৃত বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের (প্রকৃত অভিযুক্ত ছাড়া) সদিচ্ছার নিদর্শন হিসেবে ছেড়ে দিতে। কে কাকে অনুকম্পা করছে? দমনের উদ্দেশ্যে নিরীহ নেতা-কর্মীদের ধরলে তো সরকারি দলের দুঃখ প্রকাশ করার কথা। অধ্যাপক রেহমান যখন ‘শর্তহীন সংলাপের’ কথা বলছেন, তখন তিনি আবার ‘বিদ্যমান সংবিধানের চৌহদ্দির’ মধ্যে থাকাটাকেও ‘অগ্রাধিকার’ দিয়েছেন। সামরিক সরকারের ফরমানের শর্তে সংবিধান এ দেশে কার্যকর থেকেছে। এখন বেসামরিক সরকারের ফরমানের শর্তাধীনে একটি সংবিধান বলবৎ রয়েছে। তা ছাড়া সংবিধানের মধ্যে থেকেও নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ নির্বাচনী সরকার গঠন করা যায়। খালেদা জিয়া সম্প্রতি ক্ষমতায় গিয়ে স্থায়ী সরকারের রূপরেখা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন। রেহমান সোবহানও স্থায়ী নির্বাচনকালীন সরকারের নির্দিষ্ট প্রস্তাবসমূহ দলীয় নির্বাচনী ইশতেহারভুক্ত করা এবং একাদশ সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে সেই প্রস্তাবিত সংশোধনীর বিষয়ে নির্বাচনী ম্যান্ডেট গ্রহণ করার পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁর এই সুপারিশ পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। কারণ, কোনো দল দুই-তৃতীয়াংশ আসন না পেলে সংবিধান সংশোধন করা অসম্ভব হবে। সুতরাং সিপিডির মতো প্রতিষ্ঠানগুলো নির্বাচনকালীন সরকারের একাধিক পূর্ণাঙ্গ বিকল্প রূপরেখা সর্বসাধারণের জানা-বোঝার জন্য প্রকাশ করতে পারে।
তা ছাড়া আপিল বিভাগের রায় বাসি হয়নি। একাদশ সংসদ নির্বাচনও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার নির্দেশনা টিকে আছে। সরকারি দলের প্রচারণার কৌশল হচ্ছে যখন তাকে নির্বাচনী বৈধতার প্রশ্নে কেউ চেপে ধরবে, তখন তারা বলবে, আমরা তো বলেছি এটা নিয়মরক্ষার নির্বাচন। আর ভেতরে ভেতরে পুরো পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকা এবং তার পরও ক্ষমতাসীন দলের প্রধানমন্ত্রীকে রেখেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের চাপ অব্যাহত রাখা।
অধ্যাপক রেহমান লিখেছেন, ‘এখন ক্ষমতাসীন জোট “সর্বদা” যুক্তি দিচ্ছে যে দশম সংসদ একটি সাংবিধানিক প্রয়োজনীয়তা। এবং একাদশ সংসদ নিয়ে আলোচনা হতে পারে।’ স্মরণ করতে পারি, ত্রয়োদশ সংশোধনী আদালতের কাঁধে বন্দুক রেখে শিকার করার পর তারা সংবিধান ছাপিয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার সিদ্ধান্ত সংসদীয় কমিটিতে দুই মাসের কম সময়ের ব্যবধানে একটি নীরব অভ্যুত্থানে নাকচ হয়েছিল। ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করেই তারা বলেছিল, বিরোধী দলের সঙ্গে তারা আলোচনায় প্রস্তুত। সেই আলোচনাটা কী এবং তাতে যে বিএনপিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দেওয়ার বাসনা লুকানো ছিল, সেটা নির্দিষ্টভাবে জানার আগে তত দিনে কয়েক শ ব্যক্তির প্রাণহানি ঘটেছিল। এবারও ওই একই খেলার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে।
তিনি যথার্থই লিখেছেন, ‘একটি সংলাপের জন্য বিপজ্জনক হুমকি হচ্ছে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দল পরস্পরের দুর্বলতা সম্পর্কে সচেতন। ক্ষমতাসীন জোট এ সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে যে রাজপথে পর্যাপ্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার আগ পর্যন্ত তারা ক্ষমতায় টিকে থাকবে। বিরোধী দল রাজপথে সহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে তার জবাব দেবে, যেটা করতে এখন তারা জামায়াতের ওপর নির্ভরশীল। আর জামায়াত সহিংসতার মাত্রা তীব্র করতে পারে।’
এই ভাষ্য নিশ্চিত করছে যে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া এখন স্তব্ধ। তাই গতকাল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে উচ্চারিত ‘দ্রুত সংলাপ,
দ্রুত নির্বাচন’ দিল্লি হনুজ দূর অস্ত কথাটিই স্মরণ করিয়ে দেয়।
বিএনপির উদ্দেশে অধ্যাপক রেহমান বলেছেন, তারা যদি মনে করে যে তারা আবার ক্ষমতায় আসার জনসমর্থন জোগাড় করতে সক্ষম, তাহলে তাদের এ বাস্তবতা মানতে হবে যে তারা কেবল সেটা অর্জন করতে পারে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। এবং সেটা সহিংস মিত্রদের দ্বারা পরিচালিত বিদ্রোহ কিংবা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আশীর্বাদনির্ভর হতে পারে না। বিএনপিকে তার রাজনৈতিক এজেন্ডা নিশ্চিত করতে হলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে। ভোটাররা যাতে জানতে পারেন, এই গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুতে তাঁদের অবস্থান কী?
এর সঙ্গে আমরা পুরোপুরি একমত। বঙ্গবন্ধু, জয় বাংলা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ—এসবের সঙ্গে আসলেই জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সংঘাত নেই, বরং পরিপূরক—সেটা খালেদা জিয়াকে পরিষ্কার করতে হবে। আওয়ামী লীগও জামায়াতের ‘দোসর’ ছিল—এ কথা বলে নতুন প্রজন্মকে জয় করা যাবে না। নির্বাচন-পরবর্তী প্রথম জনসভাটি খালেদা অবশ্য গতকাল জামায়াতকে ছাড়াই করলেন। কিন্তু এসবে চিড়া ভিজবে না।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে সমঝোতার ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। শুধু অনির্বাচিত ব্যক্তির প্রতি অরুচির কারণেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হয়েছে? সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছেন বলেই কি? কিংবা তথাকথিত নৈতিক ও আদর্শগত লড়াইটাই এখানে নিয়ামক? অন্য সব মেকি? অধ্যাপক সোবহানের লেখাকে কেন্দ্র করে এসব প্রশ্নের সুস্পষ্ট উত্তর পেতে নাগরিক সংলাপ শুরু হওয়া দরকার।
অধ্যাপক রেহমান লিখেছেন, ‘যেকোনো সরকার যারা দুর্বল নির্বাচনী ম্যান্ডেট নিয়ে সরকার গঠন করে, অব্যাহতভাবে তাদের কর্তৃত্ব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয় এবং ক্রমবর্ধমান হারে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নিপীড়নমূলক সামর্থ্যের ওপর নির্ভরশীল হতে পারে। এবং একই সঙ্গে তারা ক্ষমতায় থাকতে নিজস্ব পেশিশক্তির ওপর নির্ভর হতে পারে। এর ফলে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক চরিত্র খর্ব হয়।’ আওয়ামী লীগ গত পাঁচ বছরে যুক্তির চেয়ে রাষ্ট্রীয় ও দলীয় পেশিশক্তির ওপরই প্রধানত নির্ভরশীল ছিল। এখন তিনি সম্ভবত এক্ষেত্রে আরো
এ সরকার বেআইনি কিংবা বৈধ সেই বিতর্কে না গিয়ে তিনি অসাধারণ মন্তব্য করেছেন, ‘এ পরিস্থিতির জন্য কে দায়ী—তা নিয়ে আমরা বিতর্ক করতে পারি। কিন্তু বস্তুনিষ্ঠ তথ্যের তাতে হেরফের ঘটে না।’ ২০০৮ সালের নির্বাচনে শতকরা ৮৭ ভাগ ভোটারের ম্যান্ডেটের বিপরীতে ৫ জানুয়ারিতে বিনা ভোটে ১৫৩ আসন ও বাকি ১৪৭ আসনে ১৮ ভাগ ভোটের ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত হয়েছে তারা। এ তথ্য দিয়ে তিনি বলেন, ‘এ ধরনের প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগের জন্য এটাই বাধ্যকর যে জরুরি ভিত্তিতে তার গণতান্ত্রিক গ্রহণযোগ্যতা পুনঃ প্রতিষ্ঠা করা।’ আমরা বলি, রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক চরিত্র হরণের স্বীকৃতি ও অনুশোচনা আগে করা দরকার।
সত্যিকারের গণতন্ত্রের জন্য আপাতত ৫ জানুয়ারির আগের ধারায় ফিরতে হবে। সে জন্য নির্বাচনকালীন সরকারের স্থায়ী অবয়বটা কী হবে, তা নিয়ে সর্বাগ্রে সংলাপ শুরু করা দরকার। হাউস অব কমন্স ও ইইউ পার্লামেন্টের নির্বাচিত রাজনীতিকদের কেউ তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে গণতন্ত্রবিরোধী বলেননি। তবে বিরোধী দলের নেতা গতকালও নিরপেক্ষ সরকারের নির্দিষ্ট রূপরেখা প্রকাশে অক্ষম থাকলেন। এর আগে তিনি মৃত ব্যক্তিদেরও যুক্ত করেছিলেন!
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
0 comments:
Post a Comment