সোমবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গণসমাবেশে জামায়াত-শিবিরকে ব্যানার নিয়ে দৃশ্যমানভাবে উপস্থিত থাকতে না দেওয়ায় এটা পরিষ্কার যে বিএনপি এখন ‘ব্যাকফুটে’ খেলতে চাচ্ছে।
তা-ই যদি না চাইত, তাহলে জামায়াতকে ঠেকিয়ে রাখবে কার সাধ্য। যদিও বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে বলছে না যে তাদের কোনো নিষেধ ছিল। ওদের ব্যাখ্যা হলো, সেদিন নাকি ১৮ দলের সমাবেশ ছিল না, ছিল বিএনপির সমাবেশ। কিন্তু এসব কথা বলে জামায়াতের অনুপস্থিতির সাফাই গাওয়া যাবে না। এই মুহূর্তে জামায়াতকে একটু দূরে দূরে রাখার কৌশলের পেছনে দুটি কারণ রয়েছে। একটি হলো বিদেশি বন্ধুদের পরামর্শ। অন্যটি জামায়াতকে সঙ্গে রাখার বিপদ।
বিদেশি বন্ধুরা জামায়াত-হেফাজতের সঙ্গে সুস্পষ্ট দূরত্ব রাখা, সোজা কথায় তাদের সঙ্গ ছাড়ার জন্য পরামর্শ দেওয়ার পর বিএনপির পক্ষে আগের মতো করে চলা কঠিন। তাই অনেকটা ‘ব্যাকফুটে’ খেলার কৌশল নিতে হয়েছে। পাকা খেলোয়াড়েরা সব সময় পিটিয়ে খেলেন না। বিশেষত শতরান পূর্ণ করার বাস্তব সম্ভাবনা সৃষ্টি হলে কিছুটা ধীরে, দেখেশুনে খেলার কৌশল নিলে দলের হতাশ হওয়ার কিছু থাকে না। বরং সবাই উত্সাহিত হয়। বিএনপি ২৯ জানুয়ারি হরতাল না ডেকে কালো পতাকা মিছিলের কর্মসূচি নিয়ে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছে। আরও ভালো করেছে, অন্তত ছয় মাস শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির বাইরে কিছু না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে।
যদি শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করতে হয়, তাহলে জামায়াতকে সামনে রাখা বিপজ্জনক। যেমন সেদিন যদি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জামায়াতের দলীয়ভাবে যোগদানের সুযোগ থাকত, তাহলে মাঠের চিত্রটা একটু চিন্তা করুন। জামায়াতের টার্গেট হলো মঞ্চের সামনের পুরো জায়গাটা ব্যানার-মিছিল নিয়ে আগে থেকেই দখল করে রাখা। এটা সব সময় দেখা গেছে। বিএনপির সমাবেশে গেলে তো তাদের মহা সওয়াবের কাজ হয়। কারণ, কিছু একটা ছলছুতায় ককটেল ফুটিয়ে দোষটা সরকারের এজেন্সির ওপর চাপিয়ে দেওয়া যায়। এই মুহূর্তে, যখন বিদেশি বন্ধুরা জামায়াতের ব্যাপারে সন্দিহান, তখন তাদের ঢাকঢোল পিটিয়ে সমাবেশে আনা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। বিএনপি সেই বাস্তব বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছে।
বিএনপি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের কথা বলেছে বটে, কিন্তু সেটাই কি যথেষ্ট? বিএনপি কি তাদের আগের অনুসৃত রাজনৈতিক অবস্থানের পর্যালোচনা করবে না? যদি না করে, তাহলে আর লাভ কী হলো। চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে, তাদের দলের প্রতি মানুষের এত বড় সমর্থন থাকা সত্ত্বেও কেন এখন কপাল চাপড়াতে হচ্ছে? নির্বাচনের ১০-১২ দিন আগেও তাদের দলের মধ্যে এমন একটা ধারণা দেওয়া হয়েছিল যে দিন সাতেকের মধ্যে সরকার পড়ে যাবে, নির্বাচন ভেসে যাবে। কে ভাসিয়ে দেবে নির্বাচন? সাধারণ মানুষ, নাকি কর্মীরা? নাকি জামায়াত-শিবিরই তাদের একমাত্র ভরসা ছিল? যেটাই হোক না কেন, তাদের হিসাব যে মেলেনি, বিরাট গরমিল ছিল, সেটা না বুঝতে চাইলে দলের আরও বড় ক্ষতি হতে পারে।
আওয়ামী লীগ নির্বাচন করে ফেলেছে ঠিকই, কিন্তু তাকে আদৌ নির্বাচন বলা যায় কি না সেটা বোধ হয় আওয়ামী লীগও বোঝে। একতরফা নির্বাচন এবং নির্বাচনের আগেই ১৫৩ জনের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে পড়ায় আওয়ামী লীগের অনেক নেতার লজ্জায় মাথা কাটা গেছে, এটাও ঠিক। মধ্যবর্তী নির্বাচনের সম্ভাবনা আওয়ামী লীগ উড়িয়ে দেয়নি। যদিও শর্ত দিয়েছে, বিএনপিকে জামায়াত ছাড়তে হবে, তারপর আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচনের বিষয়ে সমঝোতা! তার মানে এই নির্বাচন নির্বাচন না, আরও নির্বাচন আছে।
এখন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে স্বাভাবিক আন্তরাষ্ট্র সম্পর্ক অব্যাহত রাখা এবং আগের মতোই ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যাওয়ার কথা বলার পর বিএনপির পক্ষে সরকারের বৈধতার প্রশ্ন তুলে কঠোর লাইনে চলাও কঠিন। তাদের বিবেচনায় এটা আছে নিশ্চয়, না হলে কেন তারা বলবে যে জামায়াতের সঙ্গে তাদের ঐক্য স্থায়ী কিছু নয়, কৌশলগত। আবার আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংলাপের কথাও তো তারা বলেছে।
এ অবস্থায় জোট-ছুট যেন না হতে হয়, সে জন্য জামায়াত বিএনপির ওপর চাপ সৃষ্টি করবে। ওরা না থাকলে যে বিএনপির আগামী দিনের আন্দোলনে বর্শাফলক হিসেবে কাজ করার কেউ থাকবে না, এ রকম একটা কিছু তারা দেখাতে চাইবে। এখন বিএনপিকে ঠিক করতে হবে, পেট্রলবোমা ও ককটেল মারার লোকের জন্য তারা জামায়াত-শিবিরের কাছে ধরনা দেবে কি না। পুলিশ ও সাধারণ নাগরিক হত্যার জন্য মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত দলের লোকজনকে তারা রাজনৈতিক ছাড়পত্র দেবে কি না। এসব সিদ্ধান্তের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে।
জামায়াত-শিবিরকে দূরে ঠেলে দেওয়ার সুস্পষ্ট অবস্থান না নিয়ে বিএনপি যে সেই আগের সুরে আলোচনার মাধ্যমে ‘নির্দলীয় সরকারের অধীনে’ দ্রুত আরেকটি নির্বাচনের ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়ে চলেছে, তা তো কোনো ফল দেবে না। ‘ব্যাকফুটে’ খেলতে হলে কিছু কৌশল তো বদলাতে হবে। না হলে আবার হরতাল-অবরোধের পথে কি তারা যেতে চায়?
দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্তত তিনটি দেশে এখন নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সংকট চলছে। শ্রীলঙ্কায় ক্ষমতাসীন দল নির্বাচন এমন নগ্নভাবে প্রভাবিত করে যে কল্পনাও করা যায় না। সেদিন বাংলাদেশের একজন প্রথিতযশা বিশেষজ্ঞ উত্তর প্রাদেশিক কাউন্সিল নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে এসে বললেন, ওরে সর্বনাশ, বল প্রয়োগ কাকে বলে, ভোট জালিয়াতি নিয়ে কারও টুঁ শব্দটি করার উপায় নেই! এ অবস্থার মধ্যে নির্বাচন হয়ে যাচ্ছে, বিদেশি পর্যবেক্ষকেরাও যাচ্ছেন।
থাইল্যান্ডে বিরোধী দলের আন্দোলনের মুখে সরকার ২ ফেব্রুয়ারি যে মধ্যবর্তী নির্বাচন দিয়েছে, বিরোধী দল তা বর্জন করে একটি অনির্বাচিত ‘পিপলস কাউন্সিল’-এর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার দাবি করছে। প্রধানমন্ত্রী ইংলাক সিনাওয়াত্রা হাসিমুখে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে চলেছেন। বিরোধী পক্ষের আন্দোলন-অবরোধ সত্ত্বেও তিনি অবিচল। বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয় বিরোধীরা দখল করে নিলে সরকার তাদের মন্ত্রণালয় অন্য ভবনে স্থানান্তর করে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। বিরোধীদের বিক্ষোভ দমনে কোনো রকম বল প্রয়োগ না করার জন্য প্রধানমন্ত্রী পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন। আন্দোলন-বর্জন নিয়ে তাঁর মাথাব্যথা নেই। গত রোববার থাই প্রধানমন্ত্রী ইংলাক বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ায় অভিনন্দনবার্তা পাঠিয়েছেন।
কম্বোডিয়ার অবস্থা আরও খারাপ। সেখানে ১৯৭৯ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রী হুনসেন ক্ষমতায় রয়েছেন। গত বছর জুলাই মাসের নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ রয়েছে হুনসেনের বিরুদ্ধে। কিন্তু হুনসেন নির্বিকার। নির্বাচন হয়, কিন্তু বিরোধী দল সুবিধা করতে পারে না। কারণ, হুনসেনের সরকার ক্ষমতায় এসেছিল পূর্ববর্তী পলপটের খুনি সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ সালের মধ্যে পলপট সরকার অন্তত ২০ লাখ কম্বোডীয় নাগরিককে নির্মমভাবে হত্যা করে। ‘সমাজতন্ত্রের’ নামে তারা ভিয়েতনামি, মুসলিম ও বিশেষভাবে ‘বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীদের’ নির্মূল করার অভিযান চালায়। যার চোখে চশমা, তাকেই বুদ্ধিজীবী বলে চিহ্নিত করে হত্যা করা হয়। একপর্যায়ে ভিয়েতনামের বাহিনী অভিযান চালিয়ে পলপট চক্রকে উত্খাত করে। হুনসেন সরকার ক্ষমতায় আসে। সেই থেকে ওই সরকার চলছে।
গত মাসে কম্বোডিয়ার বিরোধী দল আন্দোলন শুরু করলে বল প্রয়োগে দমন করা হয়। পোশাককর্মীদের বেতন বৃদ্ধির আন্দোলনকে সামনে রেখে বিরোধী দল আন্দোলন করছিল। পোশাককর্মীরা মজুরি দ্বিগুণ করে ১৬০ ডলার দাবি করছিল। এরপর আন্দোলন দমন করা হয়। তখন বিরোধীদলীয় শ্রমিক ইউনিয়নগুলো গার্মেন্টস শ্রমিকদের ধর্মঘট ও মিছিল বন্ধ করে কাজে যোগদানের আহ্বান জানায়। অবস্থা এখন ঠান্ডা।
আপাতত সেখানে বিরোধী দল ‘ব্যাকফুটে’ খেলছে। কারণ, বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে হাজারো অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও, তাদের একটা প্লাস পয়েন্ট। তারা পলপট আমলের বিভীষিকাময় অধ্যায়ের অবসানে সামনের সারিতে ছিল।
বাংলাদেশে বিরোধী দল বিএনপি এখন ‘ব্যাকফুটে’ খেলে কতটা সাফল্য ছিনিয়ে আনতে পারবে, তা নির্ভর করবে তাদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞার ওপর। জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে সংস্রব ত্যাগ এবং হরতাল-অবরোধ-সহিংসতা বন্ধ রেখে শান্তিপূর্ণ যৌক্তিক আন্দোলনই হবে তাদের উত্কৃষ্ট দাওয়াই। এর মধ্য দিয়ে আলোচনা ও আগামী নির্বাচনের পথ প্রশস্ত হতে পারে।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
0 comments:
Post a Comment