কবে হবে চার লেন by হকিকত জাহান হকি ও তৌফিকুল ইসলাম বাবর

Saturday, September 24, 2011

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ কাজ কবে শেষ হবে? বিদ্যমান দুই লেনের সড়কটি চার লেনে উন্নীত করতে ১৯৬৭ সালে জমি অধিগ্রহণ করা হলেও এর মাটি ভরাটের কাজ শুরু হয়েছে ২০১০ সালে। গত ৪৪ বছরেও নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি 'ইকোনমিক লাইফ লাইন' হিসেবে ব্যবহৃত এ সড়কটি। চট্টগ্রামসহ সারাদেশের শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য ও সার্বিক অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করে এ সড়কটি। সব ধরনের আমদানি-রফতানি পণ্য আনা-নেওয়া হয় এ সড়ক দিয়েই। এ সড়কটি চার লেনে উন্নীত করার পর শুরু হবে 'ঢাকা-চট্টগ্রাম অ্যাক্সেস কন্ট্রোল হাইওয়ে'। এ সড়কটি হবে বিশেষায়িত।

২০১৩ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা; কিন্তু গত দেড় বছরে কাজ হয়েছে মাত্র ২৫ শতাংশ। হাতে সময় রয়েছে মাত্র ৯ মাস। এ সময়ে প্রকল্পের বাকি ৭৫ শতাংশ কাজ শেষ করা প্রায় অসম্ভব। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত দেড় বছরে প্রকল্পের ৫০ শতাংশ কাজ হলেই কেবল নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করা যেত। কিন্তু তা হয়নি। বর্তমানে প্রকল্পের কাজ যেভাবে এগোচ্ছে তাতে বাকি কাজ শেষ হতে বাড়তি আরও এক বছর সময় লেগে যেতে পারে। অর্থাৎ ২০১৪ সালের জুনের আগে চার লেনের কাজ শেষ হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।
বর্ষার কারণে সাড়ে তিন থেকে চার মাস ধরে প্রকল্পের কাজ বন্ধ
থাকার পর ক'দিন আগে থেকে শুরু হয়েছে। এর আগে ঠিকাদারদের ওয়ার্ক অর্ডার দেওয়া হলেও ভারতীয় প্রতিষ্ঠান দেব কনসালট্যান্ট লিমিটেডকে কনসালট্যান্ট হিসেবে নিয়োগ দেওয়া নিয়ে সৃষ্ট জটিলতায় ৭-৮ মাস সময়ক্ষেপণ, নতুন লেন নির্মাণে মাটি সংকট, মন্ত্রণালয় থেকে যথাসময়ে অর্থ ছাড় না করা, সর্বোপরি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজে ধীরগতির কারণে নির্ধারিত সময়ে শেষ করা যাচ্ছে না প্রকল্পের কাজ। তবে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করা না গেলেও যত
দ্রুত সম্ভব শেষ করতে সরকারের পক্ষ থেকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। প্রকল্পের বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন, প্রকল্প পরিচালনার সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা ও প্রকল্পের দেশি-বিদেশি তিন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই, পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএসহ বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ী সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে চার লেনের সড়ক নির্মাণের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছিল। রাজধানী ঢাকার সঙ্গে বন্দরনগরী ও প্রধান বাণিজ্যিক শহর চট্টগ্রামের উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য চার লেনের সড়কের দাবি আজ সব শ্রেণী-পেশার মানুষের। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ৩৮২ কোটি টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে পুরোপুরিভাবে সরকারি অর্থায়নে।
সরকারের এক হিসাব থেকে জানা গেছে, জিডিপিতে এ মহাসড়কের অবদান ৩০ শতাংশ। প্রতিদিন গড়ে ১৬ হাজার হালকা ও ভারী যানবাহন চলাচল করে এ সড়ক দিয়ে। এর মধ্যে পণ্যবাহী ৬০ ভাগ যানবাহন চলাচল করে এ সড়ক দিয়েই।
যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন সমকালকে বলেন, নির্মাণ ব্যয় মেটানোর জন্য যথাসময়ে পর্যাপ্ত টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দেশের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ চার লেনের সড়কটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, সর্বশেষ ৭০০ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে ১১৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বাকি টাকা চলতি ও আগামী অর্থবছরের মধ্যে বরাদ্দ দেওয়া হলে নির্মাণকাজ অনেকটা এগিয়ে যাবে। মাটি ভরাটসহ অন্যান্য কাজ পুরোদমে চলছে বলে মন্ত্রী জানান।
যোগাযোগমন্ত্রী আরও বলেন, টেন্ডার প্রক্রিয়ার জন্য নির্মাণকাজ শুরু করতে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। তবে আগামী ২ বছরের মধ্যে প্রাক্কলিত ব্যায়ের পুরো টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলে যথাসময়েই এ সড়কের নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, সড়কের বেশিরভাগ ব্রিজ, কালভার্ট নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। বাকি ব্রিজ, কালভার্ট নির্মাণে বেশি সময় লাগবে না। এরপর পুরোদমে শুরু হবে মাটি ভরাটের কাজ।
সড়ক ও জনপথ বিভাগের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পের পরিচালক শফিকুল ইসলাম সমকালকে বলেন, নির্মাণকাজ অব্যাহত আছে। সামনে কাজের চাপ আরও বাড়বে। সে সময় প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে। অর্থের সরবরাহ থাকলে যথাসময়ে নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, পুরো কাজ সম্পন্ন করতে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে ৬-৭ মাস সময় বেশি লাগতে পারে।
অর্থ বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষেত্রে কার্পণ্য করা হলে চার লেনে উন্নীত করার কাজ যথাসময়ে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্ট অনেকে। দাউদকান্দি থেকে চট্টগ্রাম সিটি গেট পর্যন্ত ১০ মিটার প্রস্তের ১৯২ কিলোমিটার নতুন সড়ক নির্মাণে চলতি অর্থবছরে ৭০০ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হলে দেওয়া হয় ১১৩ কোটি টাকা। মাটি ভরাট, ব্রিজ, কালভার্ট নির্মাণকাজে আগামী নভেম্বর-ডিসেম্বরের মধ্যে এ টাকা শেষ হয়ে যাবে। এরপর হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হবে ঠিকাদারদের। তখন অর্থ বরাদ্দের জন্য আবারও ছোটাছুটি শুরু করতে হবে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়কে। চার লেনের এ নতুন সড়ক নির্মাণে এ পর্যন্ত গড়ে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ মাটি ভরাটের কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
বিদ্যমান সড়ক দিয়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতে ডান পাশ দিয়ে নির্মিত হচ্ছে ১০ মিটার প্রস্থের নতুন সড়কটি। ১০ মিটার প্রস্থের বিদ্যমান সড়কটি দুই লেনবিশিষ্ট। প্রস্থের দিক থেকে একই মাপের দুই লেনের নতুন সড়কটিসহ প্রায় তিনশ' কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়টি হবে চার লেনের। চার লেনের সড়কের মাঝখানে থাকবে ৬ মিটারের ডিভাইডার। এর মধ্যে ঢাকা থেকে দাউদকান্দি পর্যন্ত ৩৯ কিলোমিটার সড়ক চার লেন করা হয়েছে বেশ আগে।
পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নাসির উদ্দিন চৌধুরী সমকালকে বলেন, দেশের বৃহত্তর স্বার্থে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কটি যেভাবে উন্নীত করার কথা ছিল গত ৪০ বছরেও তা হয়নি। এতে রফতানি খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তিনি বলেন, এখন পণ্যবাহী একটি গাড়ি ঢাকা থেকে ছাড়লে তা কখন চট্টগ্রামে পেঁৗছবে নিশ্চিত করে বলা যায় না। চার লেনে উন্নীত হলে এ সংকট থাকবে না। কোনো কারণে নির্মাণকাজ যেন পিছিয়ে না যায় সে জন্য সরকারের সব ধরনের সহায়তা অব্যাহত রাখার দাবি জানান তিনি।
মহাসড়কের বর্তমান অবস্থা : ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক এখন রীতিমতো মহাদুর্ভোগের মহাসড়কে পরিণত হয়েছে। এমনিতেই সড়কটির নাজুক অবস্থা। তার ওপর ভারী বৃষ্টিতে অবস্থার আরও অবনতি ঘটেছে। সড়কটির স্থানে স্থানে শুধু দেবেই যায়নি অনেক স্থানে সৃষ্টি হয়েছে বড় খানাখন্দ। সড়কের বিভিন্ন জায়গা উঁচু-নিচু হয়ে যাওয়ায় ব্যাপক ঝুঁকি দেখা দিয়েছে। গাড়িতে স্বাভাবিক গতি তোলা যাচ্ছে না। প্রতিনিয়ত সৃষ্টি হচ্ছে দীর্ঘ যানজট। সর্বোচ্চ ছয় ঘণ্টায় ঢাকা-চট্টগ্রামে চলাচলের কথা থাকলেও এখন সময় লেগে যাচ্ছে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা। সম্প্রতি সড়কটি যানবাহন চলাচলের প্রায় অযোগ্য হয়ে পড়লে সরকার চুক্তি অনুযায়ী চার লেন প্রকল্পের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সড়কের কিছুটা সংস্কার-মেরামত করলেও পরিস্থিতির খুব বেশি উন্নতি হয়নি; কিন্তু দায়সারা গোছের কাজের কারণে তা খুব বেশি টেকসই হয়নি।
মহাসড়কে চলাচলকারী গাড়িচালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মহাসড়কের কমপক্ষে ৩০টি পয়েন্ট এখনও ছোট-বড় খানাখন্দে ভরা। এর মধ্যে সড়কের মিরসরাইয়ের ১০টি, সীতাকুণ্ডের ৫টি, কুমিল্লার ১০টি এবং ফেনীর ৪টি পয়েন্টের অবস্থা খুবই নাজুক। সড়কের মিরসরাইয়ের বড় দারোগাহাট, নিজামপুর কলেজ, হাদিফকির হাট, বড়তাকিয়া, মিরসরাই সদর, মিঠাছড়া, জোড়ারগঞ্জ, বারৈয়ারহাট পৌর সদর, ইসমাইল কার্পেট মিল এলাকা, ছোটকমলদহ বাইপাস মোড় ও মিরসরাই সদর, সীতাকুণ্ডের উপজেলা পরিষদ সংলগ্ন বাইপাস সড়ক, মছইদ্দা স্কুলের সামনের মোড়, ফৌজদারহাট পোর্ট কানেকটিং সড়কের সংযোগস্থল, এসকেএন জুট মিল এলাকা, ফকিরহাট ফায়ার সার্ভিস মোড়ে সড়ক সংস্কার হয়েছে জোড়াতালি দিয়ে। এ ছাড়া কুমিল্লার রায়পুর, চৌদ্দগ্রামের বাতিসাবৈদ্যের বাজার এলাকা, দক্ষিণ উপজেলার ধনাইতরী, দাউদকান্দির মেঘনা-গোমতী টোল প্লাজা মোড়, হাসনপুর, বিতপুর, ইলিয়টগঞ্জের আমিরাবাদ রাস্তার মাথা, চৌদ্দগ্রামের চিওড়া এলাকা, বুড়িচংয়ের নিমসার এবং ফেনী জেলার মুহুরীগঞ্জ, লেমুয়াব্রিজ, মহীপাল ও মোহাম্মদ আলী বাজার এলাকায় এখনও আছে ছোট-বড় গর্ত। এসব স্থানে গাড়ি চলাচল করতে হচ্ছে ঝুঁকি নিয়ে।
ঠিকাদারদের স্বেচ্ছাচারিতা : চুক্তি অনুযায়ী চার লেন প্রকল্প কাজের পাশাপাশি বিদ্যমান সড়কের রক্ষণাবেক্ষণ কাজ তিনটি ঠিকাদার কোম্পানির করার কথা থাকলেও তারা এ কাজ সঠিকভাবে করছে না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। খোদ যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তার কাছ থেকে এ বিষয়ে আপত্তির কথা জানা গেছে। তারা বলেছেন, অনেকটা তাদের অবহেলার কারণেই বিদ্যমান সড়কটির ছোট ছোট গর্ত আজ খানাখন্দে রূপ নিয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী প্রকল্পের কাজ চলাকালে বিদ্যমান সড়কটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারের। নতুন সড়ক নির্মাণের জন্য নির্মাণ সামগ্রীসহ অন্যান্য পণ্য আনা-নেওয়া করতে হয় বিদ্যমান সড়ক দিয়ে। এ ছাড়া জনগণের চলাচল ও পণ্য পরিবহন স্বাভাবিক রাখার দায়িত্বও ঠিকাদারদের ওপর ন্যস্ত হয়। এ ক্ষেত্রে চীনা কোম্পানি সাইনোহাইড্রো করপোরেশন লিমিটেড বেশি অবহেলা করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া রেজা কনস্ট্রাকশন লিমিটেড ও তাহের ব্রাদার্স লিমিটেড নামমাত্র রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করছে বলে জানা গেছে।
ঠিকাদারের বক্তব্য : রেজা কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের পরিচালক স ম মমতাজউদ্দিন বলেন, নতুন সড়কের কাজ চলাকালে বিদ্যমান সড়কটির রক্ষণাবেক্ষণের স্বাভাবিক কাজের দায়িত্ব ঠিকাদারদের ওপর ন্যস্ত থাকে। বিশেষ কারণে ব্যাপক সংস্কারের কাজ করে ঠিকাদাররা পোষাতে পারবেন না। ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কের বেহাল দশা সম্পর্কে তিনি বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে সংস্কার কাজ না হওয়ায় এখন সড়কটির অবস্থা বেশ নাজুক। সড়কটি সংস্কারের জন্য আলাদাভাবে টেন্ডার ডাকা হবে। নতুন সড়ক নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত ঠিকাদাররাই এ টেন্ডারে অংশ নিয়ে সংস্কারকাজ করবেন।
মহাজোট সরকারের আমলে নির্মাণ কাজ শেষ হবে কি : বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, এ সরকারের আমলে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে হলে বাস্তবায়ন কাজে তদারক বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে যথাসময়ে যথাযথ অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে। এ বছর বরাদ্দ দেওয়া ১১৩ কোটি টাকার কাজ আগামী নভেম্বর-ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হবে। শিগগির যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দেওয়া না হলে নভেম্বরে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারদের কাজ বন্ধ হয়ে যাবে। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ এ সড়ক বাস্তবায়নে অর্থ বরাদ্দে গড়িমসি করা হলে যথাসময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে না। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন সড়ক নির্মাণের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়েছিল।
জানা গেছে, ক্ষমতায় আসার পর এ সরকার ১৫২টি সড়ক প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে। এর মধ্যে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোর প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে বিভিন্ন এলাকার মন্ত্রী, এমপিদের চাপে তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ সড়ক নির্মাণে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে বেশি। এ কারণে দেশের মূল সড়ক নির্মাণকাজ পিছিয়ে যাচ্ছে। পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো, কার্যক্রম ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ যাচাই করে সড়ক প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থ বরাদ্দ দিয়ে থাকে।
ব্রিজ, কালভার্ট, ওভার পাস, বাস বে : নতুন ১৯২ কিলোমিটার সড়কে ২৮টি ব্রিজ নির্মিত হবে। এর মধ্যে রয়েছে পাঁচটি বড় ব্রিজ। কালভার্ট নির্মাণ করা হবে ১৯৫টি। দুর্ঘটনা রোধে তিনটি রেলওয়ে ওভারপাস, দুটি আন্ডারপাস, ৩৩টি ফুটওভার ব্রিজ ও যাত্রীসেবা নিশ্চিত করতে দীর্ঘ সড়কের পাশে ৬১ স্থানে বাস বে নির্মাণ করা হবে।
প্রাক্কলিত ব্যয় ও বরাদ্দ : প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ৩৮২ কোটি টাকা। গত তিন অর্থবছরে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৪৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০১০-১১ অর্থবছরে বরাদ্দ দেওয়া হয় ১১৮ কোটি টাকা। চলতি ২০১১-১২ অর্থবছরে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে ৭০০ কোটি টাকা চাওয়া হলে বরাদ্দ দেওয়া হয় ১১৩ কোটি টাকা।
রোড ফান্ড : সূত্র জানায়, সারাদেশের সড়ক উন্নয়নে সরকারের আলাদা কোনো তহবিল নেই। এ খাতের জন্য আলাদা তহবিলের ব্যবস্থা থাকলে জনগুরুত্বসম্পন্ন সড়ক নির্মাণে অর্থ সংকটের কথা ভাবতে হতো না সরকারকে। সরকারের মধ্যে এ তহবিল গঠনের কোনো উদ্যোগও নেই। অথচ প্রতিবেশী দেশ ভারতে সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়নে 'রোড ফান্ড' নামে একটি বিশেষ তহবিল রয়েছে। দেশটির ফুয়েল স্টেশন থেকে প্রতি লিটার তেল বিক্রি করে ক্রেতার কাছ থেকে ২ রুপি করে নেওয়া হয় ওই তহবিলের জন্য। এ ছাড়া সড়কের বিশেষ স্থান থেকে টোল আদায়ের টাকা জমা করা হয় ওই তহবিলে। এ তহবিলের অর্থে ভারত সরকার সর্বশেষ জয়পুর থেকে আজমীর পর্যন্ত ১৩০ কিলোমিটার সড়ক ৬ লেনে উন্নীত করছে। এর সঙ্গে রাখা হচ্ছে সার্ভিস লেন। জম্মু থেকে অমৃতসর প্রায় ৩০০ কিলোমিটার সড়কও উন্নয়ন করা হচ্ছে একই তহবিলের অর্থ খরচ করে।
ঠিকাদারদের সঙ্গে চুক্তি : মহাসড়কটি ১০ ভাগ করে ঠিকাদারদের সঙ্গে চুক্তি করা হয়। এর মধ্যে চীনা কোম্পানি সাইনোহাইড্রো করপোরেশন ৭টি প্যাকেজ, রেজা কনস্ট্রাকশন লিমিটেড দুটি প্যাকেজ এবং তাহের ব্রাদার্স ও আল আমীন কনস্ট্রাকশন যৌথভাবে একটি প্যাকেজে কাজ পেয়েছে।
রেজা কনস্ট্রাকশন : এ কোম্পানি দুটি প্যাকেজে ৩৭ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করছে। এর মধ্যে ১নং প্যাকেজে দাউদকান্দি টোল প্লাজা থেকে কুটুম্বপুর পর্যন্ত ২২ কিলোমিটার ও ৭নং প্যাকেজে ধুমঘাট ব্রিজ থেকে মিরসরাই বাজার পর্যন্ত সাড়ে ১৫ কিলোমিটার সড়ক রয়েছে। দুটি প্যাকেজে ৩৩৪ কোটি টাকার কাজ পেয়েছে এ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। বর্ষার কারণে মাটি ভরাটের কাজ তেমন এগোচ্ছে না। আগামী নভেম্বর থেকে শুকনো মৌসুম শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নির্মাণকাজ পুরোদমে শুরু হবে।
১নং প্যাকেজ : এ প্যাকেজে ২২ কিলোমিটারে ২৫ থেকে ২৮ শতাংশ মাটি ভরাট হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী এতটুকু সড়কে একটি ছোট আকারের ব্রিজ ও সাতটি কালভার্ট নির্মাণ করতে হবে। এর মধ্যে তিনটি কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। চুক্তির বাইরে আরও ছয়টি কালভার্ট নির্মাণ করতে হবে বলে জানিয়েছে নির্মাণ প্রতিষ্ঠান। ব্রিজ নির্মাণ কাজ শুরু হবে আগামী ডিসেম্বর থেকে।
৭নং প্যাকেজ : এ প্যাকেজে ১৫ কিলোমিটারে মাটি ভরাট হয়েছে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ। আগামী মার্চের মধ্যে মাটি ভরাটের কাজ পুরোপুরি শেষ হবে। ৩০টি কালভার্টের মধ্যে সাতটি নির্মিত হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এ ১৫ কিলোমিটার নতুন সড়ক নির্মাণ করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন ঠিকাদার।
ঠিকাদারের বক্তব্য : রেজা কনস্ট্রাকশনের পরিচালক স ম মমতাজউদ্দিন সমকালকে বলেন, এ সড়কটি দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সড়ক। যথাসময়ে সড়কটির নির্মাণকাজ শেষ করতে হলে সরকারের পক্ষ থেকে টাকার সরবরাহ বজায় রাখতে হবে। তিনি বলেন, সর্বশেষ বরাদ্দ দেওয়া ১১৩ কোটি টাকার কাজ আগামী নভেম্বর-ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হবে। এরপর হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হবে। সামনের শীত মৌসুমে কাজের চাপ বেড়ে যাবে। তখন সে অনুপাতে টাকা সরবরাহ করতে হবে। টাকার অভাবে কাজ বন্ধ থাকলে ২০১৩ সালের মধ্যে পুরো সড়কটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হবে না।
তাহের-আল আমীন : কুমিরা বাইপাস থেকে চট্টগ্রাম সিটি গেট পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করছে তাহের ব্রাদার্স লিমিটেড ও আল আমীন কনস্ট্রাকশন লিমিটেড। ১০নং প্যাকেজের আওতায় এ দুটি কোম্পানি পেয়েছে ১৭২ কোটি টাকার কাজ। তাহের ব্রাদার্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল বাশার সমকালকে বলেন, তারা এরই মধ্যে ৪০ শতাংশ মাটি ভরাটের কাজ সম্পন্ন করেছেন। ১৬ কিলোমিটার রাস্তায় মাঝারি আকারের ছয়টি ব্রিজ ও নয়টি কালভার্ট নির্মাণ করতে হবে। এরই মধ্যে সাতটি কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। ব্রিজের পাইলিংয়ের কাজ চলছে। তিনি বলেন, কোনো ধরনের সংকট সৃষ্টি না হলে ২০১৩ সালের মধ্যে ১৬ কিলোমিটার সড়কের নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হবে।
সাইনোহাইড্রো করপোরেশন : কুটুম্বপুর থেকে ধুমঘাট ব্রিজ পর্যন্ত পাঁচটি প্যাকেজ ও মিরসরাই বাজার থেকে কুমিরা বাইপাস পর্যন্ত দুটি প্যাকেজসহ মোট সাতটি প্যাকেজে ১৩৯ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করছে চীনা কোম্পানি সাইনোহাইড্রো করপোরেশন লিমিটেড। মাটি ভরাট, কালভার্ট ও ব্রিজ নির্মাণের কাজ চলছে। জানা গেছে, দরকষাকষিতে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে সাতটি প্যাকেজের আওতায় কাজ পেয়েছে এ কোম্পানি।

উইকিলিকস ঝড় by রাশেদ মেহেদী

Tuesday, September 13, 2011

মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিস্ময় উইকিলিকস। মহাক্ষমতাধর যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন থেকে শুরু করে বিশ্বের ছোট-বড় সব রাষ্ট্রের 'ব্ল্যাকবক্স' ভেঙে তছনছ করে দিচ্ছে উইকিলিকসের ক্ষিপ্রতা। যে অন্ধকারে আগে কখনও কেউ চোখ রাখতে পারেনি, সেখানে চোখ রাখছে উইকিলিকস। অবস্থা এমন যে, সকালে ঘুম থেকে উঠে রাষ্ট্রযন্ত্রের মহানায়করা তটস্থ মনে চোখ রাখেন উইকিলিকসের পাতায়, সাধারণ মানুষ গভীর আগ্রহে জেনে নেন অজানাকে। উইকিলিকসের এ ঝড় বয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের ওপর দিয়েও।
বাংলাদেশের রাজনীতি, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও আলোচিত ওয়ান-ইলেভেনের খুঁটিনাটি অনেক বিষয় বেরিয়ে আসছে প্রতিদিন। দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী বিএনপি, উভয়ের নেতারাই মনে করেন, এটি দেশ, রাজনীতি ও রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে নতুন ষড়যন্ত্র। উদ্দেশ্যমূলক কোনো কারণে একটি বিশেষ মহল এসব করছে বলে তারা বিশ্বাস করেন। দেশের সুশীল সমাজ অবশ্য মনে করেন, উইকিলিকসে ফাঁস হওয়া মার্কিন গোপন তারবার্তার মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতিকদের দৈন্য প্রকাশ পেয়েছে।
তারা বলেন, রাজনীতিবিদরা দেশের মানুষের কাছে না গিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে ধরনা দেন। তাদের কাছে তদবিরে ব্যস্ত থাকেন ছোট-বড় সব দলের নেতারা। কেউ কেউ অবশ্য বলছেন, এভাবে গোপন দলিল প্রকাশ অনৈতিক ও অপরাধ। এদিকে উইকিলিকসের দাবি অনুযায়ী তাদের হাতে আছে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রায় ৩০ লাখ গোপন নথি। যার মধ্যে এখন পর্যন্ত প্রায় ১২ লাখ প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। এর মধ্যে ইরাক যুদ্ধের গোপন নথিই রয়েছে প্রায় সাড়ে চার লাখ। বাংলাদেশ সম্পর্কে ২ হাজার ১৮২টি গোপন নথি আছে উইকিলিকসের হাতে। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত প্রায় ৭০০টি প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিদিন ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হওয়া এসব প্রতিবেদন এখন সংবাদপত্রে পাঠকদের মূল খোরাক। সবকিছু ছাপিয়ে এখন উইকিলিকসের ফাঁস করা প্রতিবেদনের ওপরই হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন পাঠক।
২০১০ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে উইকিলিকস ঝড়ের সূচনা হয়েছিল ইরাক আর আফগান যুদ্ধ নিয়ে মার্কিন গোপন নথি প্রকাশের মধ্য দিয়ে। ইরাক যুদ্ধ নিয়ে সাড়ে ৪ লাখ গোপন নথি আর আফগান যুদ্ধ নিয়ে ৯২ হাজার নথির সঙ্গে দুর্লভ ভিডিওচিত্র। গোটা দুনিয়া অবাক বিস্ময়ে দেখল জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের উইকিলিকস যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের গোপন নথির গোপনীয়তার গর্ব ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। মার্কিন প্রশাসন এ ধাক্কা সামলাতে যখন উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে কাবু করার উপায় খুঁজছিল ঠিক তখন চীন, রাশিয়াসহ একাধিক ক্ষমতাধর দেশের গোপন নথি ফাঁস করে নতুন আলোচনার ঝড় তুলল উইকিলিকস। এরপর একের পর এক নতুন চমক, নতুন আঘাত। উইকিলিকসের দুনিয়া কাঁপানো সেই ঝড় আফ্রিকা, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, ভারত ঘুরে এখন জোর দাপটে বাংলাদেশের সীমানাতেও বয়ে যাচ্ছে। বিশিষ্টজনদের মুখে এমনও শোনা যাচ্ছে, সিডর কিংবা আইলার মতো শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের সাধারণ মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়ে; কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির তালিকায় থাকা কিছু ভাগ্যবান, সিডর কিংবা আইলা যাদের নিরাপদ সুরম্য প্রাসাদ কখনোই স্পর্শ করতে পারেনি, তারা এখন বিধ্বস্ত উইকিলিকস ঝড়ে। এ ঝড় সাধারণ মানুষের জন্য কোনো বিড়ম্বনা বয়ে আনেনি, বরং চোখ খুলে দিচ্ছে প্রতিদিন। ওয়ান-ইলেভেনের সময় কোন নেত্রীর মনে কী ছিল, যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন কোন চোখে কাকে দেখেছে, তারেক রহমানকে নিয়ে বিএনপির পরিকল্পনা কী ছিল, বর্তমান সরকারের কোন মন্ত্রী পর্দার আড়ালে অদক্ষতা এবং সততার অভাবের সার্টিফিকেট পাচ্ছেন, জামায়াতের গোপন মিশনের লক্ষ্য কী_ কোনো কিছুই এখন আর অজানা নয় দেশের সাধারণ মানুষের। অনেকে বলছেন, আর কিছু না হোক দেশের রাজনীতিকদের বিষয়ে উইকিলিকস অন্তত বিচার-বিশ্লেষণের সুযোগ করে দিয়েছে।
অনেকে মন্তব্য করেছেন, উইকিলিকসে প্রকাশিত নথির তীর যখন সরকারি দলের দিকে থাকে তখন বিরোধী দল উইকিলিকসের ভক্ত হয়ে যায়, আর তীর যখন বিরোধী দলের দিকে তখন সরকারি দল মুচকি হাসে। এক কথায় তারা বলছেন, ক্ষমতার ছায়ায় থাকা এসব ব্যক্তির সবাই উইকিলিকসের ভক্ত, আবার বিরোধী_ দুটিই।
যুক্তরাষ্ট্রের নথি প্রকাশ করার মুহূর্ত থেকেই বৈরী পরিবেশের মুখে পড়ে উইকিলিকস। যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বন্ধ, এমনকি আন্তর্জাতিক মাস্টার কার্ড ব্যবহারে বিনা নোটিশে নিষেধাজ্ঞা, প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা, উইকিলিকসের ডোমেইনে এক ডজন হ্যাকারের ধারাবাহিক হামলা। অবশ্য কোনোকিছুই দমিয়ে রাখতে পারেনি উইকিলিকসকে। বরং আরও বেশি উদ্যম, আরও বেশি বেপরোয়া উইকিলিকস। জামিনে বের হয়ে যুক্তরাজ্যে গোয়েন্দাদের ২৪ ঘণ্টা নজরদারির মধ্যে কাটাচ্ছেন জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ, আর উইকিলিকসের পাতায় সেই গোয়েন্দাদের পাঠানো গোপন তারবার্তা দিব্যি ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। ব্রিটিশ-মার্কিন সম্মিলিত গোয়েন্দা শক্তি যেন হার মেনেছে উইকিলিকসের সাইবার বোমার কাছে। সবার মাঝে এখন একটিই প্রশ্ন, উইকিলিকসের এই যাত্রার শেষ কোথায়? আরও কী চমক দেখাবে উইকিলিকস?
বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম উইকিলিকসের দখলে
উইকিলিকসের পাতায় বাংলাদেশের স্থান হয়েছিল ২০১০ সালের ডিসেম্বরে। ২২ ডিসেম্বর প্রকাশিত গোপন নথির বিষয়বস্তু ছিল বাংলাদেশের মাদ্রাসা শিক্ষায় পরিবর্তন আনতে যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনার কথা। এর কিছুদিন পরই হরকাতুল জিহাদ বা হুজিকে একটি গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশের রাজনীতিতে আনতে চেয়েছিল বলে তথ্য প্রকাশ করে হৈচৈ ফেলে দেয় উইকিলিকস। ওয়ান-ইলেভেনের সময় বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টির পাঠানো তারবার্তা নিয়ে প্রথমদিকে উইকিলিকসের পাঠানো তথ্যগুলো ছিল ইসলামী দল এবং তাদের নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা ঘিরেই। ক্ষমতার বৃত্তের কাছাকাছি থাকা দলগুলোর মধ্যে বিএনপির চারদলীয় জোটের প্রধান মিত্র জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশকে ইসলামী রাষ্ট্র বানাতে চায় এবং এ উদ্দেশ্যে নেওয়া তাদের গোপন মিশন নিয়ে তথ্য প্রকাশ করে উইকিলিকস। তখনও ক্ষমতার পালাবদলের প্রধান দুই রাজনৈতিক শক্তির গায়ে উইকিলিকসের আঁচড় লাগেনি।
গত আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে সারাদেশে বেহাল সড়ক ব্যবস্থা নিয়ে দলের ভেতরে-বাইরে কঠোর সমালোচনার মুখোমুখি হন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন। ঠিক সে মুহূর্তে উইকিলিকসের তীরও বিদ্ধ করল তাকে। উইকিলিকসের প্রকাশিত তথ্যে দেখা গেল, ঢাকার যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস আরও কয়েক মাস আগেই যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তার সততা বিশ্বাসযোগ্য নয়_ এমন মত দিয়ে তারবার্তা পাঠিয়েছে ওয়াশিংটনে। পরদিনই সাংবাদিকদের যোগাযোগমন্ত্রী বলেন, তিনি প্রমাণিত সৎ ব্যক্তি, উইকিলিকসের তথ্য গ্রহণযোগ্য নয়। উইকিলিকস নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনিও বললেন, এসব তথ্যের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তখন থেকেই বাংলাদেশের সব সংবাদপত্রের প্রথম পাতার গুরুত্বপূর্ণ শিরোনামে চলে এলো উইকিলিকস। বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল, সংবাদ সংস্থায় বিশেষ জায়গা করে নিল উইকিলিকসের ফাঁস করা প্রতিবেদন।
এরপর একের পর এক বাংলাদেশ বিষয়ক তথ্য ফাঁস হতে থাকলে সংবাদপত্রের প্রথম ও শেষ পাতায় উইকিলিকস কর্নার চালু হলো। টেলিভিশন চ্যানেলগুলো পৃথক শিরোনাম দিয়ে উইকিলিকসের খবর প্রচার শুরু করল। এখানেও শেষ হলো না। এখন কোনো কোনো সংবাদপত্রে উইকিলিকস নিয়ে পৃথক পাতা আর টেলিভিশনে চার-পাঁচটি প্যাকেজ নিয়ে 'উইকিলিকস বিশেষ' প্রচারিত হচ্ছে। এর কারণ হিসেবে সংবাদমাধ্যমগুলোর দায়িত্বশীলদের বক্তব্য হচ্ছে, পাঠক কিংবা দর্শক চায় বলেই এত গুরুত্ব দিয়ে উইকিলিকসে বাংলাদেশ বিষয়ে প্রকাশিত তথ্যকে এত গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সংবাদপত্রগুলোর অনলাইন সংখ্যায় উইকিলিকসের তথ্য নিয়ে তৈরি করা প্রতিবেদনে সবচেয়ে বেশি মতামত আসছে, রেটিং আসছে। সবকিছু মিলিয়ে এ মুহূর্তে বাংলাদেশের পাঠকদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে উইকিলিকস।
উইকিলিকসের পাতায় ওয়ান-ইলেভেনের অজানা অধ্যায়
ওয়ান-ইলেভেনের আগে-পরে রাজনীতিবিদ এবং রাজনৈতিক দলের ভূমিকা নিয়ে অনেক অজানা তথ্য প্রতিদিন প্রকাশ করছে উইকিলিকস। প্রতিটি তথ্যের উৎস যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের গোপন তারবার্তা। এ তথ্যগুলোই বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের প্রধান আকর্ষণ। মাঠের ভাষণে রাজনীতিবিদরা কী বলেন আর পর্দার আড়ালে কী করেন, উইকিলিকসের তথ্য থেকে সে সম্পর্কে আলোচনার সুযোগ হয়েছে। 'ওয়ান-ইলেভেনের পর আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বিগ্ন, বিএনপি চেয়ারপারসন বর্তমান বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া শান্ত ছিলেন', 'তৎকালীন সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদকে রাজনীতিতে চায়নি যুক্তরাষ্ট্র', 'খালেদা জিয়া নিজে রাষ্ট্রপতি আর তার ছেলে বিএনপির বর্তমান সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে প্রধানমন্ত্রী করতে চেয়েছিলেন', 'খালেদা জিয়ার বড় ব্যর্থতা তারেকের দুর্নীতি প্রশ্রয় দেওয়া', 'যেভাবে ভেস্তে গেল মাইনাস টু ফর্মুলা', 'গ্রামীণ ব্যাংকের তৎকালীন এমডি ড. মুহাম্মদ ইউনূস চেয়েছিলেন দুই নেত্রী সরে যান', 'জাতীয় সরকার গঠনের চেষ্টা করেছিল ফখরুদ্দীন সরকার', 'বিডিআর বিদ্রোহের সময় পরিস্থিতি সামলাতে ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী (বর্তমানে অর্থমন্ত্রী) প্রণব মুখার্জির পরামর্শ চেয়েছিল বাংলাদেশ সরকার' প্রভৃতি সংবাদ শিরোনাম বাংলাদেশে এখন তুমুল আলোচিত। যোগাযোগমন্ত্রীর সততা এবং দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার ব্যাপারে উইকিলিকসে তথ্য প্রকাশের পর বিএনপি নেতারা বেশ খুশি হয়েছিলেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, দেশের মন্ত্রীদের সততা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে প্রশ্ন উঠলে তা খুবই দুঃখজনক। তারেক রহমান আর খালেদা জিয়াকে ঘিরে একের পর এক তথ্য ফাঁস হলে সেই মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরই বললেন, উইকিলিকসের তথ্যের বাস্তব ভিত্তি নেই। রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং বিশিষ্টজনরা মনে করছেন, রাজনৈতিক দলগুলো যার যার স্বার্থে উইকিলিকসের তথ্য ব্যবহার করতে চেয়েছে। এখন উইকিলিকসের আঘাত বড় দু'দলের জন্যই বিব্রতকর হয়ে উঠছে। তাদের মতে, উইকিলিকস চোখ খুলে দিচ্ছে।
ক্ষমতাধর দেশের নতুন মাথাব্যথা উইকিলিকস
যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়ার মতো ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর মহাক্ষমতাধর ব্যক্তিদের নতুন মাথাব্যথা এখন উইকিলিকস। যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে এভাবে গোপন দলিল প্রকাশকে অনৈতিক ও অপরাধ বলে মন্তব্য করেছে। হোয়াইট হাউসের প্রেস সচিব রবার্ট গিবস তার এক বিবৃতিতে বলেন, এভাবে গোপন নথি প্রকাশ বড় অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্র সেভাবেই বিষয়টিকে দেখছে। আইনগত ব্যবস্থা কী নেওয়া যায় তাও ভাবা হচ্ছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন সংবাদমাধ্যমকে বলেন, উইকিলিকসের এসব তথ্য যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে কোনো প্রভাব ফেলবে না, কোনো দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কও ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অবশ্য প্রভাব পড়বে বলে তিনি মন্তব্য করেন। প্রকাশিত গোপন নথির সত্যতা সম্পর্কে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
এদিকে সুইডেনের এক নারীকে ধর্ষণের দায়ে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার পর অনেকের মত ছিল, এটি যুক্তরাষ্ট্রের পাতানো মামলা। পরে সে মামলায় অ্যাসাঞ্জ গ্রেফতারও হলেন। শেষ পর্যন্ত জামিনও পেলেন। এরপর যুক্তরাষ্ট্রে জব্দ হলো উইকিলিকসের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট। আন্তর্জাতিক মাস্টার কার্ড পরিচালনায় যুক্ত সংস্থাগুলোও উইকিলিকসকে দেওয়া কার্ড ফেরত চাইল। এর বিরুদ্ধে মামলাও ঠুকে দিল উইকিলিকস। এর পরের অধ্যায়ে হ্যাকারদের হামলা শুরু হলো উইকিলিকসের প্রতি। এক সপ্তাহের ব্যবধানে এক ডজন হামলা হলো। হ্যাকারদের তীব্র উৎপাতের পর উইকিলিকস কর্তৃপক্ষ শেষ পর্যন্ত বিকল্প ডোমেইনের মাধ্যমে নতুন করে তাদের ওয়েবসাইট চালু করল গত ফেব্রুয়ারিতে।

উদ্দেশ্যমূলক

বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী বিকল্প ধারার গণমাধ্যম উইকিলিকসে ফাঁস হওয়া বাংলাদেশ সম্পর্কিত তথ্যগুলোকে উদ্দেশ্যমূলক বলে উল্লেখ করেছেন দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি নেতারা। তারা মনে করছেন এসব তথ্য যে সময়ে প্রকাশ হয়েছে তা রীতিমতো উদ্দেশ্যমূলক। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে 'পানি ঘোলা' করার উদ্দেশ্যেই কোনো একটি মহল এমনটি করছে। বাংলাদেশ সম্পর্কিত তথ্যগুলোকে খুব বেশি গুরুত্ব না দিলেও এর সত্যতা ও উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে আওয়ামী লীগ।
ক্ষমতাসীন দলটির নেতারা বলেছেন, উইকিলিকসে প্রকাশিত সব তথ্যই যে সঠিক ও বাস্তবসম্মত এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই। মার্কিন তারবার্তার তথ্যের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিএনপি নেতারাও। তারা বলেছেন, এর ফলে দেশের রাজনীতি এবং রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হবে। দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতাও বাড়বে। ক্ষমতাসীন ও বিরোধী উভয় দলের নেতারাই মনে করেন, এটি নতুন ষড়যন্ত্র। বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রের বিদ্যমান নিবিড় সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত করার বিশেষ উদ্দেশ্যে এসব প্রচার করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগ এবং বর্তমান সরকার নিয়ে বিভিন্ন তথ্য প্রচার হওয়ার পর বিএনপি সাধুবাদ জানিয়ে বলেছিল, উইকিলিকসের তথ্যেই সরকারের দুর্নীতির প্রমাণ মেলে। বিএনপি সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ পাওয়ার পর মির্জা ফখরুল ইসলাম বললেন, 'এর বাস্তব ভিত্তি নেই'। গতকাল মঙ্গলবার সমকালকে দেওয়া পৃথক প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ নেতারা বলেছেন, অতীতে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনার আলোকে মার্কিন দূতাবাসের গোপন তারবার্তার বরাত দিয়ে যেসব তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে তা সংশ্লিষ্ট দূতাবাসের চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন। এ নিয়ে খুব বেশি 'উল্লসিত' কিংবা 'বিমর্ষ' সর্বোপরি 'মাতামাতি'রও কিছু নেই।
আওয়ামী লীগ নেতাদের বক্তব্য : দলের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য আমির হোসেন আমু এমপি উইকিলিকসে প্রকাশিত তথ্যের সত্যতা বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। তিনি বলেছেন, সেখানে অন্য নেতানেত্রীদের কার সম্পর্কে কী বলা হয়েছে সেগুলো নিয়ে তিনি কিছু বলতে পারবেন না। তবে তার (আমু) সম্পর্কে যে ঘটনা ও তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। কেননা যে তারিখ উল্লেখ করে ঘটনার কথা বলা হচ্ছে; সেই তারিখে তিনি দেশেই ছিলেন না। স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে অবস্থান করছিলেন।
দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, যে বা যারা বাংলাদেশ সম্পর্কিত ঘটনা কিংবা তথ্য প্রকাশ করছেন, সেসবের সত্যতা প্রমাণের দায়িত্ব সংশ্লিষ্টদেরই।
আমাদের দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এসব তথ্য প্রকাশ ও প্রচারের পেছনে এক ধরনের 'অসৎ উদ্দেশ্য' অবশ্যই আছে। মহৎ উদ্দেশ্যে নয়, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে করা তথা 'পানি ঘোলা' করে নিজেদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার লক্ষ্য নিয়েই কেউ কেউ এসব করছেন।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, উইকিলিকসে আমাদের দেশ কিংবা নেতানেত্রী সম্পর্কে যেসব তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে, তা মার্কিন দূতাবাস থেকে সেই দেশের সরকারের কাছে পাঠানো প্রতিবেদন থেকে আসছে। এগুলো এখানকার সংশ্লিষ্ট ওই দূতাবাসটির নিজস্ব চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন। এর মধ্যে কিছু তথ্য আছে, যেগুলো নিঃসন্দেহে বাস্তবতার সঙ্গে সম্পৃক্ত। এসব ঘটনা আমাদের অনেকেরই আগে থেকে জানাও ছিল। সব প্রতিবেদন কিংবা এতে প্রকাশিত সব তথ্যই যে বাস্তবসম্মত কিংবা সত্য হবে_ এটা অবশ্য মনে করার কোনো কারণ নেই।
এদিকে দলটির অনেক নেতা উইকিলিকসে প্রকাশিত তথ্যগুলোকে 'স্পর্শকাতর' বলে উল্লেখ করেছেন। তারা এ নিয়ে মন্তব্য করতেও অনীহা প্রকাশ করেন। দলের উপদেষ্টা পরিষদের এক সদস্য বলেন, 'কোথাকার কোন রাষ্ট্রদূত তার দেশের সরকারের কাছে কী পাঠিয়েছেন, তাই নিয়ে মাতামাতির কিছু দেখছি না। এ নিয়ে মন্তব্য করারও কিছু নেই।'
বিএনপি নেতাদের বক্তব্য : দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, জেমস এফ মরিয়ার্টি বাংলাদেশে আসেন ২০০৮ সালের শেষদিকে। অথচ ২০০৫-০৬ সালের ঘটনা তার বরাত দিয়ে প্রকাশ করা হচ্ছে। ওই সময় যিনি মার্কিন রাষ্ট্রদূত ছিলেন, তার দায়িত্ব ছিল স্টেট ডিপার্টমেন্টে মতামত পাঠানো। ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে সময়ের মিল না থাকায় উইকিলিকসের তথ্য নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন, বিভিন্ন রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের রাজনীতি এবং নেতাদের নিয়ে যেসব মতামত পাঠিয়েছেন, তা তার ব্যক্তিগত মতামত। কারণ তিনি যে সূত্র থেকে তথ্য জানাচ্ছেন, সে সূত্র সত্য নাও বলতে পারে। মোশাররফ আরও বলেন, ঢালাওভাবে বিএনপিকে নিয়ে তারবার্তার তথ্য দিয়ে সংবাদ প্রকাশ উদ্দেশ্যমূলক। এসব শুরু হয়েছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের সফরের আগে। বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রের নিবিড় সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত করার বিশেষ উদ্দেশ্যে এসব প্রচার করা হচ্ছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, এসব তথ্য সম্পূর্ণ সঠিক নয়। কিছুর সত্যতা রয়েছে। সত্য ও মিথ্যার সংমিশ্রণে ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে সময়ের মিল পাওয়া যাচ্ছে না। মাহবুব বলেন, তার সঙ্গে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হ্যারি কে টমাসের কথোপকথন দিয়ে যে তথ্য প্রকাশ হয়েছে, তা সঠিক নয়।
দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার বলেন, স্টেট ডিপার্টমেন্টে পাঠানো মার্কিন রাষ্ট্রদূতদের মতামতে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। এটি শুধু ঘটনাপ্রবাহের ওপর ভিত্তিতে পর্যালোচনা।
এদিকে সোমবার বিএনপিকে নিয়ে উইকিলিকসের তথ্য সম্পর্কে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরে বিএনপি। দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উইকিলিকসের তথ্য নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে বলা হয়, এসব তথ্যের 'বাস্তব ভিত্তি' নেই। দলটির দাবি, এটি যুক্তরাষ্ট্র ও তার প্রশাসনের সঙ্গে বিএনপির নিবিড় সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করার একটি অপকৌশল মাত্র। একই সঙ্গে দেশকে রাজনীতিশূন্য এবং বিএনপিকে হেয় প্রতিপন্ন করার ষড়যন্ত্রেরও অংশ।
ফখরুল বলেন, তারেক রহমানের যুক্তরাষ্ট্র সফর সম্পর্কে গীতা পাসির বরাত দিয়ে উইকিলিকসের ফাঁস করা তথ্যটি বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কয়েকটি বার্তায় যে সময়ের কথা এসেছে, তা মরিয়ার্টির কার্যভার নেওয়ার অনেক আগে।

কিডনি ব্যবসায় ঢাকার নামি হাসপাতাল

Friday, September 9, 2011

খোদ রাজধানীর নামিদামি হাসপাতালগুলো জড়িয়ে পড়েছে অবৈধ কিডনি ব্যবসায়। দালালরা প্রথমে কিডনিদাতাদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করে। এরপর কিডনি গ্রহীতার তথ্য দালাল চক্রের হাতে তুলে দেন চিকিৎসকরা। বিনিময়ে কিডনিদাতাকে দেওয়া হয় ১ লাখ ৭০ হাজার থেকে ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত। শুধু তাই নয়, কিডনিসহ দেহের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গোপনে চুরি করে মোটা টাকার বিনিময়ে বিক্রি করছে এ চক্র।

অর্থের লোভ দেখিয়ে গ্রামের অভাবী মানুষকে কিডনি বিক্রিতে উদ্বুদ্ধ করছে দালালরা। জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার দুটি গ্রামের বেশ কিছু লোক কিডনি বেচাকেনার সঙ্গে যুক্ত। কিডনি কেনাবেচা চক্রের প্রধান তারেক আজিম ওরফে বাবুল চৌধুরী দেশের কিডনি ব্যবসার এমন ভয়ঙ্কর তথ্য জানিয়েছেন। গতকাল দুপুরে তাকে রাজধানীর মিন্টো রোডের মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সামনে হাজির করা হলে তিনি এসব তথ্য জানান। গোয়েন্দা পুলিশ জানায়, বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর ফকিরাপুল থেকে তারেককে গ্রেফতার করে পুলিশ। অবৈধভাবে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়, রাজধানীর এমন পাঁচ-ছয়টি হাসপাতালের নামও জানান তারেক। তবে এসব হাসপাতালের জড়িত চিকিৎসকদের নাম বলতে রাজি হননি তিনি। তারেক আজিজের এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালগুলো। রাতেই পুলিশ কয়েকটি ক্লিনিকে অভিযান চালায়। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, গ্রেফতারের পরপরই পুলিশের কাছে তারেক পান্থপথের 'কলম্বো এশিয়া হেলথ কেয়ার' ও বনানীর 'ট্রেট ওয়ার্থ' নামে দুই ক্লিনিকের
নাম প্রকাশ করেন, যারা এ অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। রাতেই ডিবি তারেককে সঙ্গে নিয়ে ওই দুই ক্লিনিকে অভিযান চালায়। তবে কাউকে আটক করতে পারেনি। তারেক বলেন, এদেশের অনেক প্রভাবশালী মানুষের কাছে আমি কিডনি বিক্রি করেছি। ঢাকার নামকরা হাসপাতালের চিকিৎসকরা এ কিডনি বেচাকেনার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তবে কিডনি বেচাকেনা যে অপরাধ তা এতদিন জানতাম না।
যেভাবে কিডনি বেচাকেনা হয় : তারেক এ অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অকপটে স্বীকার করে বলেন, তিনি ২০০৬ সাল থেকে কিডনি বেচাকেনা করে আসছেন। এ পর্যন্ত অন্তত ৩০ থেকে ৪০টি কিডনি বিক্রি করেছেন। প্রতিটি কিডনি বিক্রিতে তিনি ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা পান। আর কিডনিদাতা পান দেড় লাখ থেকে ৪ লাখ টাকা। তারেক জানান, তিনি রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালের চিকিৎসকদের মাধ্যমে কিডনি প্রয়োজন_ এমন লোকের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করেন। মূলত চিকিৎসকদের মাধ্যমে কিডনি গ্রহীতার নাম ও ঠিকানা পাওয়া যায় বলে কিডনি কেনাবেচার টাকার ভাগ দিতে হয় তাদেরও। নাম-ঠিকানা পাওয়ার পর তাদের সঙ্গে চুক্তি করে জয়পুরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরা অঞ্চলে স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে কিডনিদাতাদের নাম সংগ্রহ করা হয়। পরে তাদের কিডনি বিক্রিতে নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করে ঢাকায় নেওয়া হয়। তারেক সাংবাদিকদের জানান, এভাবে তিনি এ পর্যন্ত সাবেক ডিআইজি আফসার চৌধুরীর স্ত্রী, সাবেক ডিআইজি নুরুল আলম ও গাজীপুরের সাবেক এক সাংসদের স্ত্রীসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে কিডনি সরবরাহ করেছেন। এটা তার কাছে মানবিক কাজ হিসেবেই মনে হয়েছে বলে জানান তারেক। এ ছাড়া রাজধানীর 'মুমূর্ষু রোগীর জন্য কিডনি চাই' বলে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে কিডনি সংগ্রহ করতেন তিনি। রাজধানীর বারডেম ও বিএসএমএমইউর দেয়ালে তারেকের মোবাইল নম্বর দেওয়া আছে। কিডনি সংক্রান্ত কোনো সমস্যা হলে তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়।
যেসব হাসপাতালে কিডনির অবৈধ প্রতিস্থাপন : তারেকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী রাজধানীর বারডেম হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল, কিডনি ফাউন্ডেশন, ল্যাবএইড, ইউনাইটেড হাসপাতাল, কলম্বো এশিয়া হেলথ কেয়ার ও ট্রেট ওয়ার্থ ক্লিনিকসহ বেশ ক'টি বেসরকারি ক্লিনিকে তিনি কিডনি সরবরাহ করেছেন। এসব প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসকরা কিডনি প্রতিস্থাপনের কাজ করে থাকেন। তারেক বলেন, তিনি কিডনিদাতা সংগ্রহ করে শুধু ঢাকায় নয়, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও ভারতের বিভিন্ন হাসপাতালেও পাঠিয়েছেন। এ জন্য রাজধানীর পান্থপথের এক ব্যবসায়ী ও বেশ ক'জন চিকিৎসক তাকে সহযোগিতা করেন।
তারেককে জিজ্ঞাসাবাদ : ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে তারেক জানান, ঝামেলা এড়াতে কিডনিদাতাকে তারা স্বজন পরিচয় দিতেন। পরে মিথ্যা হলফনামা করে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়। এক্ষেত্রে কিডনিদাতা বা গ্রহীতা কিছুই জানতে পারেন না। সবকিছুই দালাল ও চিকিৎসকদের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। ডিবির সহকারী কমিশনার তৌহিদুল ইসলাম সমকালকে বলেন, তারেক কিডনি বেচাকেনায় রাজধানীর কয়েকটি বড় হাসপাতালের নাম বলেছেন। তবে এর সঙ্গে জড়িতদের নাম বলেননি। তার দেওয়া প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তিতে গত বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর দুটি ক্লিনিকে অভিযান চালানো হয়। কিডনি বেচাকেনার সঙ্গে জড়িত রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালের চিকিৎসক ও দালালদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করে অভিযান চালানো হবে।
ডিবির সংবাদ সম্মেলন :সংবাদ সম্মেলনে গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মনিরুজ্জামান জানান, রাজধানীতে কিডনি বেচাকেনার সঙ্গে জড়িত তিনটি গ্রুপের সন্ধান পেয়েছেন তারা। প্রতিটি গ্রুপে সাত-আটজন করে সদস্য রয়েছে। তিনি বলেন, দরিদ্র লোকজনকে নানাভাবে প্রতারণার মাধ্যমে কিডনি বিক্রিতে উদ্বুদ্ধ করে এ চক্রটি। তবে এসব দালাল কিডনিদাতাকে কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে বেশির ভাগ টাকাই মেরে দেয়। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন জয়পুরহাটের কালাই থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) ফজলুল করিম। তিনি সাংবাদিকদের জানান, বেশ কিছুদিন আগে স্থানীয় একটি পত্রিকার খবরে বলা হয়, ৫০-৬০ জন লোক কিডনি দিয়ে মৃত্যুপথযাত্রী হয়েছেন। খবরটি তিনি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে খোঁজখবর নিতে থাকেন। এরই ধারাবাহিকতায় কালাই উপজেলার দুটি ইউনিয়নে ৩৮ কিডনি বিক্রেতার নাম-পরিচয় সংগ্রহ করেন। যারা ঠিকমতো হাঁটাচলা করতে পারছেন না। প্রস্রাব-পায়খানা বন্ধসহ তাদের শরীরে নানা উপসর্গ দেখা দিয়েছে।
যেভাবে গোয়েন্দা জালে তারেক : ডিবি পুলিশ মূলহোতা তারেকের সহযোগী সাইফুল ইসলাম দাউদকে বাগেরহাটের মোল্লাহাট থেকে গ্রেফতার করে। সাইফুল বুধবার জয়পুরহাট আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে কিডনি বেচাকেনার কথা স্বীকার করে মূলহোতা হিসেবে তারেকের নাম জানায়। এর আগে ২৮ আগস্ট কালাই উপজেলার বহুতি গ্রামের আবদুস ছাত্তার, গোলাম মোস্তফা, আবদুল করিম ওরফে ফোরকানকে এবং ৩ সেপ্টেম্বর মোশাররফ হোসেন নামে এক দালালকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ঢাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় তারেককে।
পুলিশ জানায়, তারেকের আসল নাম বাবুল চৌধুরী। তার বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার রাজগঞ্জ ইউনিয়নের ছোট হোসেনপুর গ্রামে। তারেক নিজেকে কখনও তারেক হোসেন আবার কখনও তারেক আজিম বা বাবুল চৌধুরী পরিচয় দিতেন। ঢাকার কয়েকটি ব্যাংকে নামে-বেনামে তার বিপুল অঙ্কের টাকা এবং শ্যামলী ও মিরপুরে একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে বলে পুলিশ জানতে পারে।
আইনে যা রয়েছে : মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন, ১৯৯৯-এর ৯ ধারায় বলা হয়েছে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেনাবেচা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সুস্থ স্বাভাবিক জ্ঞানসম্পন্ন কোনো ব্যক্তি অন্যের দেহে সংযোজনযোগ্য কিডনি, হৃদপিণ্ড, যকৃৎ, অগ্ন্যাশয়, অস্থি, চর্ম, টিস্যুসহ ক্রয়-বিক্রয়, বিনিময়ে কোনো সুবিধা লাভ, সেই উদ্দেশ্যে কোনো বিজ্ঞাপন প্রদান বা প্রচার চালাকে পারবে না। একই আইনের ১০ ধারা অনুযায়ী এ আইন লঙ্ঘন করলে সর্বনিম্ন তিন থেকে সর্বোচ্চ সাত বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড, তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হবে। আইনে বলা হয়েছে, আত্মীয়র মিথ্যা পরিচয়ে কেউ কিডনি বিক্রি করলে দাতা ছাড়াও ক্রেতা, সহায়তাকারী দালাল ও কিডনি সংযোজনে জড়িত চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে একই শাস্তি প্রযোজ্য হবে।
দালাল চক্র : কিডনি ব্যবসার মূলহোতা তারেক হোসেন। তার সহযোগী ও দালাল চক্রের সদস্যরা হলো_ সাইফুল ইসলাম, গোলাম মোস্তফা, আখতার আলম, জাহান আলম, আবদুল ওহাব, ফারুক হোসেন, রেজাউল ইসলাম, জাহিদুল ইসলাম, সৈয়দ আলী, মোকাররম হোসেন, রুহুল আমিন, আবদুল মান্নান ও মোজাম।
আমাদের জয়পুরহাট প্রতিনিধি জানান, বাবুল চৌধুরীকে ঢাকায় গ্রেফতারের পর গতকাল তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য জয়পুরহাটে নেওয়া হয়েছে। জেলার কালাই থানায় দায়েরকৃত মামলার এজাহারভুক্ত আসামি তারেক আজিম।
এদিকে এ মামলায় গ্রেফতার হওয়া কিডনি পাচার চক্রের দালাল সাইফুল ইসলাম দাউদ বৃহস্পতিবার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জাহাঙ্গীর আলমের আদালতে কিডনি পাচারের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ার পর গতকাল গ্রেফতার হওয়া অন্য আসামি আবদুস সাত্তার কিডনি কেনাবেচার সঙ্গে নিজে জড়িত থাকার বিষয় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে উভয়েই বাংলাদেশ, ভারত, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরে ৩০ থেকে ৪০টি কিডনি পাচারে সহযোগিতা করার কথা স্বীকার করে।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যা বলছে
এদিকে কিডনি পাচারকারী দালাল চক্রের প্রধান রাজধানীর নামিদামি হাসপাতালের দিকে অভিযোগের আঙুল তোলার পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছে। মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন ১৯৯৯ অনুযায়ী, নিকটাত্মীয়ের বাইরে অন্য কারও মধ্যে কিডনি আদান-প্রদান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের কর্মকর্তারা বলছেন, কিডনিদাতা ও গ্রহীতার মধ্যে আত্মীয়তার সপক্ষে গ্রহণযোগ্য তথ্য-প্রমাণ হাতে পাওয়ার পরই অস্ত্রোপচার করা হয়।
ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক মেজর (অব.) ডা. মাহবুবুর রহমান সমকালকে বলেন, দাতা ও গ্রহীতার মধ্যে আত্মীয়তার সপক্ষে কাগজপত্র ঠিকঠাক আছে কি-না তা যাচাইয়ের পরই অপারেশন শুরু হয়। কাগজপত্র যাচাইয়ে চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত বোর্ড রয়েছে। তিনি বলেন, দালালের খপ্পরসহ অন্যান্য অপকর্ম বন্ধ হোক_ সেটি আমরা চাই। কিন্তু এ ধরনের ঘটনার মারপ্যাঁচে প্রতিস্থাপন চিকিৎসা বাধাগ্রস্ত হলে কিডনি বিকল রোগীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
বারডেম হাসপাতাল থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ২০০৫ সাল থেকে কিডনি প্রতিস্থাপন শুরুর পর ৮৯টি সফল প্রতিস্থাপন হয়েছে। ১৯৯৯ সালে প্রণীত আইন মেনে প্রতিস্থাপন হয় এবং দাতা-গ্রহীতা উভয়ের পারস্পরিক সম্পর্কের দলিলপত্র যথাযথভাবে পরীক্ষা এবং হাসপাতালে সংরক্ষণ করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় দালাল বা তৃতীয় কোনো পক্ষের সম্পৃক্ত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বিজ্ঞপ্তিতে এ অপকর্মের তীব্র নিন্দা জানিয়ে দোষীদের আইনানুগ শাস্তির দাবি জানানো হয়।
কিডনি ফাউন্ডেশনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. হারুনুর রশিদ সমকালকে বলেন, বাবা-মা, ভাই-বোনের বাইরে কেউ দাতা হলে সেগুলো যাচাই করার চেষ্টা চালানো হয়। এক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্র অথবা বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে আনা অঙ্গীকারনামা দেখে অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নিই আমরা। কিন্তু এর মধ্যে যে এত ভুতুড়ে ব্যাপার লুকিয়ে রয়েছে, তা গণমাধ্যমে প্রকাশের আগে জানা ছিল না। দালাল চক্রের মূলহোতা ফাউন্ডেশনের সংশ্লিষ্টতার যে অভিযোগ করেছেন তা সম্পূর্ণ মিথ্যা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. প্রাণগোপাল দত্ত হাসপাতালের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ সরাসরি নাকচ করে দেন। সমকালকে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে এ পর্যন্ত প্রায় ৫০০ কিডনি প্রতিস্থাপন হয়েছে। দালাল চক্রের অপকর্মের সঙ্গে চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্ট অন্যরা মোটেই জড়িত নন। নিয়ম মেনেই কিডনি প্রতিস্থাপন হচ্ছে। অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে অপকর্মকারীদের কঠোর শাস্তি হওয়া উচিত।

দুর্ভোগের শেষ কবে by রাশেদ মেহেদী ও আলতাব হোসেন

Tuesday, August 16, 2011

সারাদেশের রাস্তাঘাটের বেহাল দশা। আসছে ঈদ। অথচ একের পর এক মহাসড়কে যাত্রীবাহী বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সংস্কার ও মেরামতের অভাবে দেশের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। জনদুর্ভোগও বেড়েছে। সড়ক-মহাসড়কে গুরুতর দুর্ঘটনা নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে উঠেছে। এ নিয়ে সারাদেশে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। হাইকোর্টও মহাসড়ক মেরামতের বিষয়ে রুল জারি করেছেন। তারপরও সংশ্লিষ্টরা নির্বিকার। একে অন্যের ওপর দোষ চাপাচ্ছেন। সময়মতো অর্থ ছাড় না হওয়ায় রাস্তা সংস্কার সম্ভব হচ্ছে না বলে দায় এড়িয়ে যাচ্ছেন খোদ যোগাযোগমন্ত্রী। এ রকম পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের প্রশ্ন, আর কত দুর্ভোগ পোহাতে হবে তাদের?


এদিকে গতকাল সোমবার টানা ষষ্ঠ দিনের মতো ঢাকার মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে বৃহত্তর ময়মনসিংহ এবং উত্তরবঙ্গগামী বাস ছাড়েনি। ফলে সাধারণ যাত্রীদের উঠেছে নাভিশ্বাস। অন্যদিকে শঙ্কা বাড়ছে ঈদে বাড়ি ফেরা নিয়ে। ঈদের আগে দেশে মহাসড়কের এ ধরনের বেহাল অবস্থা নজিরবিহীন। বন্ধ হয়ে যাওয়া সড়কে বাস চলাচলে সরকার ও পরিবহন নেতাদের চোখে পড়ার মতো সমঝোতার উদ্যোগ নেই। কোনো রকম আলোচনা ছাড়াই চলছে পরিবহন ধর্মঘট। ঈদের আগে ও পরে তিন-চার দিন ঘরে ফেরা এবং ঘর থেকে ফিরে
আসা নিয়ে বড় সংকটের
আশঙ্কা করছেন খোদ পরিবহন মালিকরাই।
দেশের সর্বত্রই ভেঙে পড়েছে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। দিন যত যাচ্ছে সড়ক যোগাযোগ পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। তারপরও বড় বড় গর্তসহ খানাখন্দে ভরা বেশিরভাগ মহাসড়কে ঝুঁকি নিয়ে চলছে যানবাহন। এক গর্ত থেকে উঠে আরেক গর্তে পড়ার সময় টাল সামলাতে পারছেন না চালকরা। এদিকে যোগাযোগ সেক্টরের সার্বিক অবস্থা জানতে প্রধানমন্ত্রী নিজে উদ্যোগী হয়ে আজ সকালে তার দফতরে বৈঠক ডেকেছেন।
মহাখালী টার্মিনাল থেকে ১২টি জেলায় বাস চলাচল বন্ধ থাকার কারণে ওইসব জেলার সাধারণ মানুষকে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। গতকাল সমকালের ময়মনসিংহ, শেরপুর, নেত্রকোনা, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল জেলা প্রতিনিধিরা জানান, এসব জেলার সঙ্গে ঢাকার বাস ও ট্রাক চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, শেরপুর এবং জামালপুর জেলার সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় এসব এলাকার বাজারে তেল, চিনি, ময়দা লবণ প্রভৃতি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেড়ে গেছে। ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটে কিছু বিআরটিসি বাস চলাচল করলেও দুর্ভোগ কমেনি। এসব বাসও নির্ধারিত সময়ের চেয়ে কমপক্ষে দুই ঘণ্টা সময় বেশি নিচ্ছে গন্তব্যে পেঁৗছতে। কিশোরগঞ্জ থেকে ভৈরব হয়ে সায়েদাবাদ টার্মিনালে বাস চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। টাঙ্গাইল থেকে কিছু বাস চলছে গাজীপুর পর্যন্ত। বগুড়া, জয়পুরহাট, রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম থেকে মহাখালী টার্মিনালে চলাচলকারী কোনো বাস গতকালও ছাড়েনি। তবে গাবতলী টার্মিনাল থেকে যাতায়াতকারী বাস চলাচল করছে। বগুড়া ও রংপুর জেলা পরিবহন মালিক সমিতির নেতারা জানান, ঢাকা-বগুড়া এবং বগুড়া-রংপুর মহাসড়কের অবস্থাও দিন দিন খারাপ হচ্ছে। তাই আগে যেখানে ঢাকা থেকে বগুড়া যেতে চার-সাড়ে চার ঘণ্টা লাগত, এখন সেখানে ছয়-সাড়ে ছয় ঘণ্টা লাগছে।
'দেশে কি দেখার কেউ নেই' : সোমবার দুপুর ২টায় মহাখালী টার্মিনালের সামনে ঘোরাঘুরি করছিলেন অনেক যাত্রী। অনেকে ব্যাগ নিয়ে বসেছিলেন। টার্মিনাল থেকে কয়েক গজ দূরে চলনবিল ট্রান্সপোর্টের একটি বাস এলে হেলপার হাঁক দিচ্ছিলেন_ 'গাজীপুর, মাওনা'। মাঝবয়সী এক যাত্রী আট-দশ বছরের একটি বাচ্চা নিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন। 'ভাই ময়মনসিংহ যাওয়া যাবে না?' হেলপার উত্তর দিলেন, 'এই গাড়ি ময়মনসিংহ যায় না। মাওনা থেকে লোকাল গাড়ি পাবেন।' লোকটি ফিরে এলেন। কথা হলো তার সঙ্গে। নাম বশীরউদ্দিন। ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন এক সপ্তাহ আগে। দু'দিন থেকেই ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। এরই মধ্যে বুধবার থেকে ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে বাস চলাচল বন্ধ। আজ চালু হবে কাল চালু হবে করে পাঁচ দিনেও চালু হয় না। তিনি বলেন, 'ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের দীঘিরচালা থেকে গাজীপুরের মালেকের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা খুবই খারাপ। এ খারাপ অবস্থা বছরজুড়েই। এখন গাড়ি চলে গর্তের মধ্য দিয়ে, ডানে-বাঁয়ে কাত হয়ে যায়। বুঝলাম না, দেশে কি পাবলিকের সমস্যা দেখার কেউ নেই? সরকারের কারও কি এই রাস্তাটার ওপর চোখ পড়ে না? ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়ক ছয় দিন ধরে বন্ধ, এটা কি সহজ কথা?' টার্মিনালে বাস কর্মচারীরা জানান, দু'চারটি গাড়ি লোকাল হিসেবে গাজীপুর পর্যন্ত চলছে। ড্রাইভার, হেলপারের দিনের খোরাকির জন্য ফাও ট্রিপ। সমিতির সিদ্ধান্ত ছাড়া পুরোদমে গাড়ি চালু হবে না।
মহাখালী টার্মিনাল থেকে ময়মনসিংহ এবং উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন রুটে বাস চালুর ব্যাপারে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েতুল্লাহ বলেন, 'যোগাযোগমন্ত্রী আমাদের নেতাদের নিয়ে মঙ্গলবার ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের অবস্থা দেখতে যাবেন। আমরা খবর নিয়েছি, রাস্তা মেরামতের কাজ দ্রুতগতিতে চলছে। মঙ্গলবার পরিদর্শনে যদি অবস্থা কিছুটা ভালো দেখা যায় আমরা বাস চালু করব।' ঈদের আগে পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন, 'প্রতি বছর ঈদের তিন-চার দিন আগে থেকেই যাত্রীর চাপ অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। এ কারণে মালিকরা ট্রিপের সংখ্যাও বেশি দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু রাস্তাঘাট ভাঙাচোরা হওয়ার কারণে এখন স্বাভাবিক ট্রিপ চালু রাখাই মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। ফলে ঈদের আগে সমস্যার আশঙ্কা থাকছেই।'
আদালতের রুল : ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক মেরামতের বিষয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যে যোগাযোগ ও অর্থ সচিব, সড়ক ও জনপথের (সওজ) প্রধান প্রকৌশলীসহ পাঁচজনকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে আদালত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) বিশেষজ্ঞ সমন্বয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করে মহাসড়কের বেহালদশার জন্য ঠিকাদার বা সংশ্লিষ্টদের কারও কোনো অবহেলা রয়েছে কি-না তা খুঁজে বের করে আগামী ছয় সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দিয়েছেন।
বাস চলাচল বন্ধের নেপথ্যে চাঁদাবাজি : একটি পরিবহন সূত্র জানায়, রাস্তা ভাঙাচোরা ছাড়াও ময়মনসিংহ পরিবহন মালিক সমিতির নামে চাঁদাবাজি নিয়ে ঢাকার মালিক সমিতির বিরোধ বাস চলাচল বন্ধের আরও একটি বড় কারণ। গত ছয় মাস ধরে ময়মনসিংহ মালিক সমিতির নামে ময়মনসিংহ অঞ্চলের বিভিন্ন জেলার মধ্যে চলাচলকারী বাস থেকে ৩০০ টাকা হারে এবং ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটের গাড়ি থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা হারে চাঁদা নেওয়া হচ্ছে। ক'দিন আগে ময়মনসিংহ প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে ময়মনসিংহ পরিবহন মালিক সমিতির নামে প্রকাশ্যেই চাঁদাবাজির অভিযোগ করেন পরিবহন মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক নেতান সৈয়দ শফিকুল ইসলাম মিন্টু। সূত্র জানায়, ২০০৭ সালের পর ময়মনসিংহ জেলা পরিবহন মালিক সমিতির আর কোনো নির্বাচন হয়নি। এ কারণে সমিতির দু'গ্রুপের মধ্যে বিরোধও তীব্র হয়েছে। এক গ্রুপ অন্য গ্রুপের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ আনছে। এ চাঁদাবাজি নিয়ে ঢাকার মালিক সমিতির সঙ্গেও ময়মনসিংহ মালিক সমিতির বর্তমান কমিটির টানাপড়েন চলে আসছিল। ভাঙাচোরা রাস্তা মেরামতের দাবি বর্তমানে বাস্তব সমস্যা থেকে এলেও চাঁদাবাজি নিয়ে বিরোধও একটি বড় কারণ।
এ ছাড়া অভিযোগ রয়েছে, যোগাযোগমন্ত্রীকে চাপে ফেলে লাইসেন্স আদায় করতে সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ উত্তরাঞ্চলে বাস ধর্মঘটের ডাক দিয়েছেন। শ্রমিক ফেডারেশন ২৭ হাজার ৩৮০ নেতাকর্মীর নামে পরীক্ষা ছাড়াই ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যুর তালিকা পাঠিয়েছে বিআরটিএতে। এটি এখন যোগাযোগমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়।
৭০ শতাংশ সড়কই ভাঙাচোরা : সারাদেশে সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের (সওজ) অধীন জাতীয় ও আঞ্চলিক সড়ক ১৮ হাজার কিলোমিটার। এর মধ্যে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ সড়কই ভাঙাচোরা আর খানাখন্দে ভরা। সওজ ও সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের হিসাবে, সারাদেশে অন্তত ১০০ কিলোমিটার মহাসড়ক খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এ ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে অন্তত ২১৬টি স্থান আছে যেখানে বছরে অন্তত তিনটি করে দুর্ঘটনা ঘটে। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশে নয়টি জাতীয় মহাসড়ক আছে। দূরত্ব সাড়ে ৩ হাজার কিলোমিটার। এ মহাসড়কের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ জায়গাগুলো হলো_ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাঁচপুর সেতুর পূর্ব প্রান্ত, গজারিয়া, দাউদকান্দি, সোনারগাঁ ও মধ্যবাউশিয়া। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের টেপারা বাসস্ট্যান্ড, জয়পাড়া বাসস্ট্যান্ড, পুখুরিয়া বাসস্ট্যান্ড, সাভার বাজার ও বাথুলী উল্লেখযোগ্য।
দরকার ৩ হাজার কোটি টাকা :যোগাযোগমন্ত্রী বলেন, যথাসময়ে মেরামত না করায় রাস্তার যে অবস্থা হয়েছে, তাতে মেরামত-রক্ষণাবেক্ষণ করে আর সামাল দেওয়া যাবে না। অনেক রাস্তা নতুন করে নির্মাণ করতে হবে। সে জন্য আরও দেড় হাজার কোটি টাকা দরকার। সব মিলিয়ে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার একটি প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে। সড়ক ও জনপথ বিভাগ আওতাধীন ক্ষতিগ্রস্ত সড়কগুলোর দ্রুত সংস্কার করতে একনেকে একটি প্রকল্প পাস হয়। সরকারদলীয় সাংসদ তোফায়েল আহমেদ সারাদেশের সড়ক ব্যবস্থার বেহাল দশা নিয়ে জাতীয় সংসদে কথা বলার পর ১ হাজার ৪১০ কোটি টাকার প্রকল্পটি একনেক বৈঠকে অনুমোদন দেওয়া হয়। দুই বছর মেয়াদি (২০১০-১১ এবং ২০১১-১২) প্রকল্পটি আগামী জুন মাসে শেষ হবে। দেড় বছরে প্রকল্পের বিপরীতে অর্থ মন্ত্রণালয় দুই দফায় মাত্র ১০৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। প্রথম বছরে ৫০ কোটি টাকা এবং প্রকল্পের শেষ বছরে দিয়েছে ৫৭ কোটি টাকা। প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার প্রকল্প এ সামান্য অর্থ দিয়ে কিছুই করা সম্ভব নয়। প্রকল্প অনুমোদন হওয়ার পর সারাদেশে দরপত্র আহ্বান করা হয়। অনেক জায়গায় কার্যাদেশ দেওয়া হয়। টাকা ছাড় না হওয়ায় বহু ঠিকাদার কাজ শুরু করেননি। তিনি বলেন, গত তিন বছরে যোগাযোগ খাতে বরাদ্দ ছিল অপ্রতুল। যেসব উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে তার বেশির ভাগই বৈদেশিক প্রকল্প সাহায্যের মাধ্যমে। এসব প্রকল্পে স্থানীয় বরাদ্দ না পাওয়ায় প্রকল্পের শতভাগ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় প্রকল্পের বকেয়া ১ হাজার ৩০৩ কোটি টাকাসহ নতুন করে আরও ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রয়োজন। ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা দ্রুত মেরামতের জন্য জরুরিভাবে টাকার প্রয়োজন।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক আজ : যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন সমকালকে বলেন, ঈদের আগে গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার ভাঙা অংশগুলোতে ইট ফেলে মেরামত করে দেব। ইতিমধ্যে কাজ শুরু হয়েছে। এ ছাড়াও সারাদেশের রাস্তা সংস্কারের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে জরুরিভাবে তিন হাজার কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আজ সকালে এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। যোগাযোগমন্ত্রী বলেন, যথাসময়ে টাকা ছাড় না করায় রাস্তার ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে গেছে। তাই ১৪শ' কোটি টাকার কাজ সম্পন্ন করতে এখন ব্যয় করতে হবে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। তিনি আরও বলেন, দুই বছরের জন্য মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের কার্যক্রমের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছিল এক হাজার ৪১০ কোটি টাকা। ব্যয় অনুমোদনও করা হয়েছিল। প্রথম বছর ৫০ কোটি এবং পরের বছর ৫৭ কোটি টাকা ছাড় করা হয়। জরাজীর্ণ ও ক্ষতিগ্রস্ত গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো দ্রুত সংস্কার করতে তার মন্ত্রণালয়ের প্রচেষ্টা ও আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নেই বলে তিনি জানান। তবে সব রাস্তা ঈদের আগে কার্পেটিং করা সম্ভব হবে না। ঈদের পরে সে কাজ এবং নতুন করে রাস্তা তৈরির কাজ শুরু হবে। পুরো রাস্তা সংস্কার হতে কমপক্ষে তিন মাস থেকে সর্বোচ্চ ছয় মাস লাগতে পারে।
নির্মাণের ছয় মাসেই বেহাল হচ্ছে রাস্তা : অনেকে অভিযোগ করেন, কোরীয় ও চীনা ঠিকাদাররা যেসব সড়ক বা অবকাঠামো নির্মাণ করেন সেগুলো দীর্ঘদিন টিকে থাকে। অথচ দু'এক বছর পর পর স্থানীয় ঠিকাদার দিয়ে রাস্তা তৈরি বা মেরামত করা হলেও তা কাজ শেষের ছয় মাস যাওয়ার আগেই চলার অযোগ্য হয়ে পড়ছে। এ বিষয়ে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. এম রহমত উল্লাহ বলেন, একটি রাস্তায় কী পরিমাণ ও ওজনের কতো গাড়ি চলবে তার ওপর গবেষণা করে রাস্তা নির্মাণ না হওয়ার কারণেই এমনটি ঘটছে। অনেকে বলছেন, বিদেশিরা ২০ ভাগ লাভ নিয়ে বাকি টাকার কাজ করে। স্থানীয় ঠিকাদাররা ঘাটে ঘাটে ঘুষ দিয়ে মাত্র ২০ ভাগ অর্থের কাজ করে। বুয়েটের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেপরোয়া ট্রাক চলাচল, অভারলোডেড, রাস্তা নির্মাণে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের কারণেও রাস্তা দ্রুত নষ্ট হচ্ছে। রাস্তাঘাটের বেহাল দশা সম্পর্কে ঢাকা যানবাহন সমন্বয় বোর্ডের অতিরিক্ত নির্বাহী পরিচালক ড. সালাহউদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেন, 'গত সাত থেকে আট বছর এসব রাস্তা ড্রেসআপ (নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ) করা হয়নি। আমি যতদূর জানি বর্তমান সরকার দায়িত্ব নিয়ে সড়ক সংস্কারের একাধিক প্রকল্প নিয়েছে। এই প্রকল্পে যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে, তার খুবই কম অংশ ছাড় করা হচ্ছে। এ কারণে প্রকল্প থাকলেও পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হয়নি। ফলে সমস্যাটা ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটসহ কয়েকটি রুটে প্রকট হয়েছে।'
সমঝোতার উদ্যোগ কম : মহাখালী বাস টার্মিনাল পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম বলেন, 'যাত্রীদের দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে আগামীকাল বুধবার থেকে বাস চলাচলের সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা ভাবছি। সরকারেরর তরফ থেকে বড় বড় গর্তে ইট সুরকি আর বালি দিয়ে ভরাট করলে বাস চলাচল বন্ধ রাখতে হতো না।' সরকারের পক্ষ থেকে পরিবহন ধর্মঘট প্রত্যাহারের বিষয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনা জোরালো হয়নি বলেও তিনি অভিযোগ করেন। বিআরটিসির চেয়ারম্যান এম এম ইকবাল সমকালকে বলেন, বাস মালিকদের হাতে যাত্রীরা জিম্মি হয়ে পড়েছেন। তিনি অভিযোগ করে বলেন, তাদের বাস চলাচল করতে না পারলেও ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে বিআরটিসির ২০টি এবং ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কে ১০টি চলাচল করছে। মালিকরা যাতে ভবিষ্যতে যাত্রীদের জিম্মি না করতে পারে সেজন্য বিআরটিসির বাসের সংখ্যা বাড়ানো হবে বলেও জানান তিনি।
পরিবহন নেতাদের সঙ্গে নৌপরিবহনমন্ত্রীর বৈঠক : সড়ক দুর্ঘটনা রোধে করণীয় ঠিক করতে গতকাল সোমবার সংসদ ভবনে পরিবহন নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। তিনি জানান, বাসচালকদের দুর্ঘটনার ব্যাপারে সচেতন করতে প্রতিটি জেলার টার্মিনালে পৃথক সমাবেশ করা হবে। ২১ আগস্ট গাবতলী টার্মিনালে প্রথম সমাবেশের মধ্য দিয়ে এ কার্যক্রম শুরু হবে। বৈঠক সূত্র জানায়, নৌপরিবহনমন্ত্রী মালিকদের বলেন সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী সিরিয়াসলি নিয়েছেন। তিনি বেপরোয়া বাস চালানোর বিষয়ে খুবই ক্ষুব্ধ। বৈঠকে মহাখালী টার্মিনাল নিয়ন্ত্রণকারী পরিবহন নেতারা গাবতলী টার্মিনালের নেতাদের তাদের বাস ধর্মঘটের প্রতি সমর্থন দেওয়ার প্রস্তাব দেন। গাবতলী টার্মিনাল নিয়ন্ত্রণকারী বাস ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা তাতে রাজি হননি।
খারাপ রাস্তা কত? :সারাদেশে পাকা সড়ক আছে ৯০ হাজার ২১০ কিলোমিটার। এর মধ্যে সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের অধীনে আছে ২১ হাজার ২১০ কিলোমিটার। এর মধ্যে জাতীয় মহাসড়কের আওতায় ৬ হাজার ৪৪৫ কিলোমিটার, অঞ্চলিক মহাসড়কের আওতায় ৪ হাজার ১০৫ কিলোমিটার ও জেলা সড়কের আওতায় ১০ হাজার ৬৬০ কিলোমিটার। প্রতি বছর কী পরিমাণ সড়ক খারাপ হচ্ছে, তা মেরামত করতে কত টাকা লাগবে_ এসব চাহিদা প্রতিবেদন প্রণয়ন করে সওজের মহাসড়ক উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা বিভাগ। চলতি বছর বর্ষা শুরু হওয়ার আগেই ১২ হাজার ৪২৮ কিলোমিটার রাস্তা খারাপ বলে তারা প্রতিবেদন দিয়েছিলেন। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ৮৫০ কিলোমিটার রাস্তা একেবারেই খারাপ, যা যানবাহন চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। আরও দেড় হাজার কিলোমিটার রাস্তা খারাপ হলেও মোটামুটিভাবে যানবাহন চলাচল করতে পারে। বর্ষা শুরু হওয়ার পর বর্তমানে কী পরিমাণ রাস্তা খারাপ হয়েছে সে হিসাব তারা এখনও করেননি। রাজধানীর অবস্থাও খারাপ। এক হাজার ৮৩৫ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে মাত্র ২০-২৫ কিলোমিটার রাস্তার অবস্থা মোটামুটি ভালো। বিশ্বকাপ ক্রিকেট উপলক্ষে ওই রাস্তাগুলোর সংস্কার কাজ করা হয়েছিল। ভাঙাচোরা, কাটাকাটি ও গর্তের কারণে বাকি রাস্তা ক্রমেই চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে।

পুলিশ বেপরোয়া রুখবে কে by শরীফুল ইসলাম ও সাহাদাত হোসেন

Wednesday, August 10, 2011

বেপরোয়া হয়ে উঠছে পুলিশ। একের পর এক লোমহর্ষক ও বিতর্কিত ঘটনার জন্ম দিয়ে চলেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত এ সংস্থাটি। জানমাল রক্ষার পরিবর্তে পুলিশ এখন ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে বলে ধারণা অনেকের মধ্যে বদ্ধমূল হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও পুলিশকে যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। গণমাধ্যমে এ নিয়ে বেশ সমালোচনাও হচ্ছে। সরকারের ভাবমূর্তিও নষ্ট হচ্ছে ব্যাপকভাবে। জনমনে প্রশ্ন, বেপরোয়া এ পুলিশকে রুখবে কে? বিশিষ্টজনরা এ ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে সমকালকে বলেছেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় পুলিশে লোক নেওয়া বন্ধ করতে হবে। পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের প্রথাও বন্ধ করার কথা বলেছেন তারা। এসব ঘটনায় সারাদেশ তোলপাড়। নিরুদ্বিগ্ন শুধু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
গত ২৭ জুলাই সকালে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে পুলিশ এক ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটায়। ১৬ বছরের এক কিশোরকে পুলিশের গাড়ি থেকে নামিয়ে জনতার হাতে তুলে দেওয়া হয়। তারপর গণপিটুনিতে সে মারা
যায়। এ নির্মম হত্যাকা পুলিশের সামনেই ঘটে। মোবাইল ফোনে ধারণ করা এ ঘটনার ভিডিও টেপ প্রচার করা হয়েছে গণমাধ্যমে। ঘটনাটি বিবেকমান মানুষকে হতবাক, অশ্রুসিক্ত করেছে। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবদুল কাদেরকে নিয়ে পুলিশের 'প্যাকেজ' নাটক আরেকটি অবিশ্বাস্য ঘটনা। এর আগে সাভারের আমিনবাজারের বড়দেশী গ্রামে ছয় ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। পুলিশ ওই ছাত্রদের ডাকাত বানানোর অপচেষ্টা চালায়। এর আগে ঝালকাঠিতে লিমনকে গুলিতে আহত করে র‌্যাব। তাকেও সন্ত্রাসী বানানোর নানা অপচেষ্টা চালানো হয়।
কখনও কখনও স্বতঃপ্রণোদিত উচ্চ আদালত নির্যাতিতদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। পুলিশকে ভর্ৎসনাও করেছেন। এতেও তেমন সুফল আসছে না।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুর্বলতা, পুলিশ প্রশাসনে দলীয়করণের মাত্রা বেড়ে যাওয়া, পুলিশের অভ্যন্তরীণ গ্রুপিং এবং চেইন অব কমান্ড দুর্বল হয়ে যাওয়ার কারণে পুলিশে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে। এসব অপরাধ কমাতে হলে পুলিশকে দলীয়করণমুক্ত করতে হবে। অপরাধী পুলিশের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এটি না করলে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে বলে তারা আশঙ্কা করছেন।
তবে পুলিশের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ মানতে নারাজ স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু। এগুলোকে তিনি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে দাবি করেছেন। তিনি সমকালকে বলেন, পুলিশ প্রশাসন বিগত সময়ের চেয়ে অনেক ভালোভাবেই চলছে। পুলিশ প্রশাসনের ভালো কাজের কারণেই আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে। নির্বিঘ্নে সাধারণ মানুষ চলাচল করছে। কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার তদন্ত হচ্ছে। এতে কারও জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এসব প্রথাসিদ্ধ বক্তব্য।
প্রতিমন্ত্রীর এ বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক এসএম শাহজাহান সমকালকে বলেন, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি তেমন ভালো নয়। দলীয়করণ বেড়ে যাওয়ার কারণে বেশ কিছু ঘটনা ঘটছে, যা পুলিশের কাছ থেকে কেউ আশা করে না। এতে সরকার ও পুলিশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। পুলিশকে বিরোধী দল দমনের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
ঘটনা এক : ২৭ জুলাই সকালে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে ঘটে এক অকল্পনীয় ঘটনা। মিলন নামে ১৬ বছরের এক কিশোরকে পুলিশের গাড়ি থেকে নামিয়ে জনতার হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। তারপর গণপিটুনিতে সে মারা যায়। অবিশ্বাস্য এ হত্যাকা ঘটে পুলিশের উপস্থিতিতে। কোম্পানীগঞ্জে ওইদিন ডাকাত সন্দেহে পৃথক স্থানে ছয়জনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয় বলে পুলিশ দাবি করেছিল। এর মধ্যে টেকেরবাজার মোড়ে মারা হয় তিনজনকে। তাদেরই একজন কিশোর শামছুদ্দিন মিলন। মিলনকে মারা হয় সকাল সাড়ে ১০টায়। আর বাকি দু'জনকে মারা হয় ভোরবেলায়। মিলনকে হত্যার অভিযোগ এনে তার মা বাদী হয়ে আদালতে মামলা করেন। এ ঘটনায় 'দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে' শনিবার রাতে কোম্পানীগঞ্জ থানার তিন পুলিশ সদস্যকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। পুলিশ এখানেই তার দায়িত্ব শেষ করেছে। এ ঘটনায় দেশব্যাপী আলোচনার ঝড় উঠেছে।
ঘটনা দুই : সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কাদেরকে ডাকাত প্রমাণ করতে মরিয়া হয়ে ওঠে পুলিশ। তাকে তিনটি মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর চেষ্টা করে। পুলিশের দাবি, ১৫ জুলাই রাতে ঢাবি ছাত্র আবদুল কাদের ও মামুন হোসেন নামে অপর একজনকে গ্রেফতার করা হয়। গাড়িযোগে ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের প্রস্তুতিকালে খিলগাঁও বিশ্বরোড এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তাদের সঙ্গে থাকা চারজন পালিয়ে যায়। পুলিশের দাবি, স্থানীয় জনতা কাদের ও মামুনকে গণপিটুনি দেয়। তবে গণপিটুনির কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কাদেরকে গ্রেফতার করে খিলগাঁও থানা পুলিশ নির্মম নির্যাতন চালায়। খিলগাঁও থানার অফিসার ইনচার্জ কাদেরকে কুপিয়ে জখম করেন। সংবাদপত্রে এমন মর্মন্তুদ খবর প্রকাশিত হলে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। শেষ পর্যন্ত দায়ী পুলিশ কর্মকর্তাদের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়। জামিনে মুক্তি পান কাদের। অনেকের অভিযোগ, কাদেরের মতো অনেককেই পুলিশ ফাঁসিয়ে দিচ্ছে। কাদেরের বিষয়টি আলোর মুখ দেখলেও অনেক ঘটনাই থাকে আড়ালে।
ঘটনা তিন : চলতি বছরের ১৮ জুলাই আমিনবাজারে ডাকাত সন্দেহে ছয় ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা করে গ্রামবাসী। চাঞ্চল্যকর ওই ঘটনার পরও পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। আমিনবাজারের ঘটনায় বেঁচে যাওয়া কিশোর আল আমিন জানায়, স্থানীয় জনগণ যখন তাদের বেধড়ক পেটাতে থাকে তখন সেখানে পুলিশ উপস্থিত ছিল। পুলিশের এক সদস্যকে পা জড়িয়ে ধরে তারা বলতে থাকে, 'ভাই আমরা ডাকাত নই। আমরা ঘুরতে এসেছি।' এরপর এক পুলিশ সদস্য তাকে বলে, 'যদি বাঁচতে চাস, তাহলে ডাকাতির পক্ষে সাক্ষী দিতে হবে। না হলে তোকে গ্রামবাসীর হাতে ছেড়ে দেওয়া হবে।' আমিনবাজারের ঘটনার পর পুলিশের ভূমিকাকে কেন অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা করা হবে না তা সরকারের কাছে জানতে চান হাইকোর্ট।
ঘটনা চার : ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়া গ্রামের বাসিন্দা লিমনকে ২৩ মার্চ বিকেলে র‌্যাব-৮-এর একটি দল আটক করে। এ সময় লিমন নিজেকে কাঁঠালিয়া পিজিএস কারিগরি কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী বলে পরিচয় দেন; কিন্তু র‌্যাবের এক সদস্য লিমনের কথা না শুনেই তার বাঁ পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করেন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় লিমনের একটি পা কেটে ফেলতে হয়। লিমনের এ ঘটনা জানাজানি হলে দেশব্যাপী ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। সোচ্চার হয়ে ওঠে দেশি-বিদেশি একাধিক মানবাধিকার সংগঠন। আদালত লিমনের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে সরকারকে নির্দেশ দেন। এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তে সরকারের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত টিমও গঠন করা হয়। এরই মধ্যে তদন্ত দল তাদের রিপোর্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে; কিন্তু রিপোর্টটি ফ্রিজে চলে গেছে। আজ পর্যন্ত রিপোর্টটি প্রকাশ করেনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উল্টো লিমনকে দোষী বানাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একাধিক বক্তব্য দেন।
সমন্বয়হীনতা : আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে সাম্প্রতিককালে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যাওয়ার পেছনের কারণ অনুসন্ধান করেছে সমকাল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ে আলাপ করা হয়। তাদের মতে, পুলিশে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। চেইন অব কমান্ডও পুরোপুরি মানা হচ্ছে না। ফলে এসব ঘটনা ঘটছে।
অভিযোগ রয়েছে, খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন পুলিশকে কোনো নির্দেশ দিলেও তারা শুনছে না। তারা দোহাই দিচ্ছে কোনো উপদেষ্টা বা দলীয় কোনো উচ্চ পর্যায়ের নেতার। গত জুনে পুলিশের এক কর্মকর্তার ব্যর্থতার কারণে তার কর্মস্থল থেকে অন্য কর্মস্থলে বদলি করতে পুলিশ হেডকোয়ার্টারকে নির্র্দেশ দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। হেডকোয়ার্টার থেকে বলা হয়, সরকারের একজন উপদেষ্টার নির্দেশ রয়েছে তাকে ওই কর্মস্থলে বহাল রাখার। এ ব্যাপারে তারা লিখিত একটি চিঠিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে পাঠান। পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ প্রসঙ্গটি চেপে যান। এভাবে পুলিশের কিছু কিছু অপরাধের দায়ভার নিতে হচ্ছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সভায় পুলিশের যে পদমর্যাদার কর্মকর্তার উপস্থিত থাকার কথা তারা উপস্থিত না থেকে প্রতিনিধি হিসেবে জুনিয়র কর্মকর্তাদের পাঠাচ্ছেন। এতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব হচ্ছে। বারবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বৈঠকের জন্য নির্ধারিত কর্মকর্তাকে উপস্থিত থাকার নির্দেশ দেওয়া হলেও তারা তা মানছেন না। বিশেষ করে পুলিশের পদোন্নতির জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ডিপিসির বৈঠকে আইজিপির উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও তিনি উপস্থিত থাকছেন না। আইজিপির প্রতিনিধি দিয়ে মিটিং চালাতে হচ্ছে। ফলে সঠিক মূল্যায়ন করে অনেক ক্ষেত্রে নীতিমালা অনুযায়ী পদোন্নতি দেওয়া যাচ্ছে না। পুলিশের পক্ষ থেকে যে তালিকা পাঠানো হচ্ছে তাদেরই যাচাই-বাছাই না করে পদোন্নতি দিচ্ছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পদায়নের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটছে। এর প্রভাব পুলিশ প্রশাসনের উচ্চ থেকে তৃণমূল পর্যায়ে পড়ছে।
মাঠ পর্যায়ে পুলিশ : তৃণমূলে ওসি শুনছেন না এসপির কথা, আবার এসপি শুনছেন না ডিআইজির কথা। তারা কথায় কথায় এমপি-মন্ত্রীদের দোহাই দিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছেন। এতে বেড়ে যাচ্ছে পুলিশের অপরাধপ্রবণতা। অপরাধ করলেও শাস্তি দেওয়ার মতো কেউ থাকছেন না। এসব অপরাধ তদন্তে পুলিশের কর্মকর্তা দিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও তা কোনো কাজে আসছে না। নানা ফাঁক-ফোকর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে পুলিশের এসব অপরাধী। এমনকি অপরাধে জড়িয়ে পড়া এসব পুলিশ কর্মকর্তাকে শাস্তি না দিয়ে প্রাইজ পোস্টিংও দেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি এমন কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় জড়িত পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তাৎক্ষণিক এসব কর্মকর্তাকে লঘু শাস্তি দেওয়া হলেও পরে এ শাস্তি প্রত্যাহার করা হচ্ছে। আর অপরাধে জড়িয়ে পড়া পুলিশকে গুরুদণ্ড না দেওয়ায় তারা বেপরোয়া হয়ে উঠছেন। এ বিষয়টি এখন ওপেন সিক্রেট হওয়ায় ওসিসহ কর্মকর্তা নিয়োগ হচ্ছে স্থানীয় এমপিদের ইচ্ছায়। বিনা বাক্যব্যয়ে এমপির হুকুম তালিম করা না হলে তাকে শাস্তিমূলকভাবে বদলি করা হয়। এ ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অসহায়।
পুলিশ মহাপরিদর্শকের বক্তব্য : পুলিশ মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার সমকালকে বলেন, পুলিশ সদস্যরা সততা, নিষ্ঠা ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছে। তবে মুষ্টিমেয় কিছু সদস্য ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম ও অপরাধে জড়াচ্ছে_ এটা অস্বীকার করছি না। যাদের বিরুদ্ধে অপরাধে জড়িয়ে পড়ার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। পুলিশ কোনো ধরনের অপরাধের সঙ্গে আপস করে না, যার প্রমাণ পুলিশের বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থার নজির। বাংলাদেশ পুলিশের যে সংখ্যক সদস্যের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয় তা জনপ্রশাসনে নজিরবিহীন।
এক প্রশ্নের জবাবে পুলিশ মহাপরিদর্শক বলেন, সাভারের বড়দেশী গ্রামে ছয় ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কাদেরের ঘটনায় পুলিশের বিভাগীয় পর্যায়ে তদন্ত চলছে। কাদেরের ঘটনায় অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাকে তার দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এসব ঘটনায় তদন্ত কমিটির রিপোর্ট পাওয়ার পরই প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসবে।
পুলিশ প্রায়ই নানা বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছে_ এটা এড়ানো সম্ভব কি-না, এমন প্রশ্নের জবাবে হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেন, পুলিশের প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়ার মধ্যেই রয়েছে তারা কী ভাবে জনগণের বন্ধু হিসেবে কাজ করবে। পুলিশের প্রশিক্ষণ একটি চলমান প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ার মধ্যে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন বিষয় অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। পুলিশ বাহিনীতে মানবাধিকার, নারীর অধিকার, সমঅধিকার, লিঙ্গ ইত্যাদি অনেক বিষয়েই আগের চেয়ে বেশি গুরুত্বসহকারে ধারণা দেওয়া হচ্ছে। কাদের ও সাভারের বড়দেশী গ্রামের ঘটনায় তদন্ত কমিটির সুপারিশেই থাকবে কী ভাবে পরে এ ধরনের পরিস্থিতি এড়ানো যায়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পুলিশের দূরত্ব রয়েছে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে পুলিশ মহাপরিদর্শক বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমাদের ভালো সমঝোতা রয়েছে। আমরা বোঝাপড়ার ভিত্তিতেই কাজ করছি।
এমন অভিযোগ পাওয়া যায় ওসিদের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের 'মধুর' সম্পর্কের কারণে পুলিশের কাজে ব্যাঘাত ঘটছে_ এ প্রশ্নের উত্তরে হাসান মাহমুদ খন্দকার সমকালকে বলেন, আমাদের কাছে এ ধরনের কোনো অভিযোগ নেই। পুলিশের প্রত্যেক সদস্য তার কাজের বিষয়ে অবগত। রাজনৈতিক প্রভাব ব্যক্তিগত বিষয়।
সাবেক দুই মহাপরিদর্শকের বক্তব্য : সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক এম আজিজুল হক সমকালকে বলেন, সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় আমাদের গোটা ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেমের ওপর একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। মানুষ পুলিশের ওপর আস্থা হারিয়ে নিজের হাতে আইন তুলে নিচ্ছে। নোয়াখালীতে পুলিশের সামনে গণপিটুনিতে এক কিশোরের মৃত্যুর ঘটনাটি দুঃখজনক ও নিষ্ঠুর ।
এক প্রশ্নের জবাবে আজিজুল হক আরও বলেন, বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক দলগুলো পুলিশকে তাদের লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করেছে। এতে পুলিশের চেইন অব কমান্ড কিছুটা হলেও বিঘ্ন হয়। সব কিছুর পরও বিপদে পড়লে মানুষ শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে পুলিশের কাছেই যায়। সেখানে ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা জরুরি। এটা ঠিক, যে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কাদেরের ঘটনায় ওসির শাস্তি হয়েছে। নোয়াখালীর ঘটনায়ও সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সাভারের আমিনবাজারের ঘটনায় তদন্ত হচ্ছে।
সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক নুরুল হুদা সমকালকে বলেন, পুলিশের বর্তমান কিছু কর্মকাণ্ড দেখে মনে হচ্ছে, তাদের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণে কোথাও যেন একটা গলদ রয়েছে। নোয়াখালী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কাদেরের ঘটনায় মনে হয় পুলিশ বাহিনীর কিছু সদস্যের আইন-কানুন সম্পর্কে জানা নেই। সব পুলিশ সদস্যকেই তাদের দায়িত্ব ও আইন-কানুন সম্পর্কে বিস্তারিত শিক্ষা দেওয়া হয়।

সামাজিক অবক্ষয়, নাকি প্রশাসনিক দুর্বলতা by পবিত্র হালদার

Sunday, July 31, 2011

মাজের মানুষ কি এতই অন্ধ বা বিবেক-বর্জিত যে, 'ডাকাত ডাকাত' শুনেই না বুঝে পেটাতে পেটাতে ছয়জনকে মেরে ফেলল? এ সামাজিক অবক্ষয় কিংবা আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া_ এ পদ্ধতি গণতন্ত্রের জন্য এক অশনিসংকেত; যা যে কোনো সময় বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে বাংলাদেশের বর্তমান সামাজিক অবক্ষয় ও প্রশাসনিক দুর্বলতা দুটিই শূন্যের কোঠায় চলে এসেছে। বর্তমানে মানুষ মানুষকে কুকুরের মতো পিটিয়ে মেরে ফেলছে, একটুও বিবেকে বাধছে না কিংবা মানুষের আকুতি এখন আর অন্য মানুষের হৃদয়ে পৌঁছে না। বাঁচার জন্য মরণ চিৎকার আর অন্যের কানে পৌঁছে না, তাহলে কি সামাজিক অবক্ষয় মানুষকে দিন দিন অমানুষ বানিয়ে দিচ্ছে? আবার আমরা যে গণতন্ত্র নিয়ে গর্ব করি, যে দেশকে আমাদের পূর্বপুরুষরা স্বাধীন করেছেন, সে দেশের নির্বাচিত সরকারের প্রশাসনিক বিভাগ মানুষকে নিরাপত্তা দিতে পারে না, তাহলে সে দেশে প্রশাসনিক দুর্বলতার দায়ভার কে নেবে?

গত ১৭ জুলাই সাভারের আমিনবাজারে যে ঘটনা ঘটেছে তার দায়ভার কে নেবে? সরকার, নাকি পরিবার? এখানে দু'পক্ষকেই দায়ভার নিতে হবে। কারণ তারা ছয়জনই ছাত্র। আর ছাত্রই যদি হয় তাহলে ওখানে অত রাতে তারা যাবে কেন? কী কাজ ছিল তাদের? যে চরে দিনের বেলায়ই মানুষ যেতে চায় না কিংবা যেখানে কয়েকদিন আগে পুলিশের অস্ত্র ছিনতাই হয়েছিল, সেখানে গভীর রাতে ছাত্ররা গিয়েছিল কেন? আমরা ছাত্রদের কিংবা সন্তানদের সেভাবে মানুষ করতে পারিনি, যাতে তারা ভালো সঙ্গ বিচার করতে পারে কিংবা কোথায়-কখন যেতে হবে বা যাওয়া যাবে না, সে শিক্ষা দিতে পারিনি_ এ ব্যর্থতা আমাদের শিক্ষক জাতির আর পরিবারের। তাই আংশিকভাবে হলেও আমরা এ দুঃখজনক ঘটনার জন্য দায়ী। আবার যদি অন্যদিক দিয়ে দেখি তাহলে ছাত্ররা না হয় না বুঝে কিংবা কৌতূহলবশে সেখানে গিয়েছিল; কিন্তু তারা যে ডাকাতি করতেই গিয়েছিল তার কোনো প্রমাণ এখনও মেলেনি। ডাকাতি করতে নূ্যনতম যে হাতিয়ার প্রয়োজন সেটিও তাদের ছিল না, তাহলে জনগণ কীভাবে ধরে নিয়েছিল যে তারা ডাকাত? আর সমাজের মানুষ কি এতই অন্ধ বা বিবেক-বর্জিত যে, 'ডাকাত ডাকাত' শুনেই না বুঝে পেটাতে পেটাতে ছয়জনকে মেরে ফেলল? এ সামাজিক অবক্ষয় কিংবা আইন নিজেদের হাতে তুলে নেওয়া_ এ পদ্ধতি গণতন্ত্রের জন্য এক অশনিসংকেত; যা যে কোনো সময় বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
সরকারের প্রশাসনের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি প্রশ্নবিদ্ধ। যেখানে প্রায়ই ডাকাতির ঘটনা ঘটে, যেখানে মাইকে ডাকাত বলে প্রচার করা হয়েছে সেখানে জনগণকে সাহায্য করতে পুলিশের পেঁৗছা উচিত সবার আগে। আর এ ঘটনার ক্ষেত্রে দেখা যায়, ছয়জনকে মেরে ফেলার পর পুলিশ সেখানে পেঁৗছে। তাহলে আমাদের জীবনের নিরাপত্তার দায়িত্ব যাদের হাতে তুলে দিয়ে আমরা দিনে নির্বিঘ্নে চলাফেরা করি কিংবা রাতে ঘুমাই তারা কি-না আমাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ। আর যখনই তারা ব্যর্থ তখনই জনগণ নিজের হাতে আইন তুলে নিচ্ছে। শিগগির এর অবসান হওয়া দরকার। সব বিবেকবান মানুষের আজ জেগে ওঠা উচিত। এত ছাত্র কেন নিহত হলো? তারা যে অন্যায় করেছে তার একমাত্র শাস্তি কি শুধু মৃত্যুই ছিল? না, বাঁচিয়ে রেখেও অন্য শাস্তি দেওয়া যেত। তা আমাদের জানতে হবে। এর সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার চাই।

চাই দ্রুততম ও নিরাপদ ব্যবস্থা

বাই একবাক্যে স্বীকার করেন, একটি দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির প্রধান মানদণ্ডগুলোর একটি এর যোগাযোগ ব্যবস্থা। শুধু সড়ক পথই নয়, রেল, নৌ ও আকাশ পথে কত দ্রুত এক স্থান থেকে অন্য স্থানে মানুষ ও মালপত্র পরিবহন করা যায় তা একটি গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন সূচক। বাংলাদেশের বাস্তবতায় রেলপথে যাতায়াতের সুযোগ সীমিত।

নৌপথ একদা এ দেশে মূল যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হলেও নাব্যতা হারিয়ে অনেক নৌপথই পরিত্যক্ত হতে বসেছে। আকাশ পথে যোগাযোগের সুযোগ এখানে আর্থসামাজিক কারণেই অনেক সীমিত। সবেধন নীলমণি সড়ক ব্যবস্থাই আমাদের যোগাযোগের মেরুদণ্ড। সাম্প্রতিককালে কানেকটিভিটি বলে যে ধারণার কথা বলা হচ্ছে তা বাস্তবায়নে মূল ভূমিকা আমাদের প্রেক্ষাপটে সড়ক অবকাঠামোরই। এখন বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার যোগাযোগ ব্যবস্থার অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত হওয়ার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। আশা করা হচ্ছে খুব শীঘ্র আমাদের রাস্তাঘাট, বন্দর আন্তর্জাতিক ব্যবহারকারীদের জন্যও উন্মুক্ত হবে। এ পরিস্থিতিতে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার হাল-হকিকত বিচার করা খুবই প্রয়োজন। অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য, অবাধ পণ্য পরিবহন, দ্রুততম ও নিরাপদ যোগাযোগ ও স্থানান্তরের স্বার্থেও সড়ক ব্যবস্থার তত্ত্বতালাশ প্রয়োজন। ফলে খুবই সঙ্গত প্রশ্ন হলো, আমাদের সড়ক ব্যবস্থার বর্তমান পরিস্থিতি কী? শনিবারের সমকালে দেশের মহাসড়ক নিয়ে যে প্রতিবেদন ও বিশেষ আয়োজন প্রকাশিত হয়েছে তা পড়ে যে কেউ বলবেন, সড়ক অবকাঠামোর এখন বেহাল দশা। প্রায় সব বিভাগীয় ও জেলা শহরের সঙ্গে ঢাকার সংযোগ সড়কগুলোর অবস্থা শোচনীয়। এমনকি বন্দর ও বাণিজ্যিক শহর চট্টগ্রামের সঙ্গে ঢাকার সংযোগ সড়কটির অবস্থাও ভীষণ হতাশাজনক। অধিকাংশ সড়ক খানাখন্দে পরিপূর্ণ। ভাঙাচোরা কিছু সড়ক দ্রুত যান চলাচলের অনুপযুক্ত শুধু নয়, এগুলো ব্যবহার করাও কষ্টকর। সড়কের অনেক স্থানে নির্মাণ ত্রুটি আছে, আছে অপরিকল্পিত স্থাপনাও। মহাসড়ক দখল করে অবৈধভাবে বাজার বসানোর উদাহরণও এন্তার। যানজট না থাকলেও এসব সড়ক পেরোতে গড়ে দুই থেকে চার ঘণ্টা সময় বেশি লাগে। আর কয়েক কিলোমিটারব্যাপী যানজট থাকলে তো কথাই নেই। দ্রুত পেঁৗছানোর স্বপ্ন সুদূরপরাহত, গন্তব্যে পেঁৗছাতে অনেক শ্রমঘণ্টা অপচয় হবে এটাই এখন নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘার মতো লেগে আছে দুর্ঘটনার উপদ্রব। যে দিন দেশে কোনো দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনা ঘটে না সেদিনটিকে সৌভাগ্যজনক ও ব্যতিক্রম বলেই অভিহিত করা হয়। চালকদের অসতর্কতা, লাইসেন্সবিহীন চালক, ওভারটেকিং, বেপরোয়া গাড়ি চালনার পাশাপাশি এর জন্য দায়ী বেহাল সড়কও। দেশে রাস্তার দৈর্ঘ্য বড়, কিন্তু রাস্তায় সুষ্ঠু তদারকির জন্য পর্যাপ্ত হাইওয়ে পুলিশিংয়ের ব্যবস্থা নেই। যেটুকু ব্যবস্থা আছে তাও কতটা ক্রিয়াশীল সে প্রশ্ন বারবার ওঠে। ফলে দুর্ঘটনা এখন নিত্যসঙ্গী। একটি মালবাহী ট্রাক বা যাত্রীবাহী বাস রাজধানীর উপকণ্ঠে পেঁৗছানোর পর বা রাজধানী থেকে বেরুবার পথে প্রায় প্রতিটি রাস্তায় দীর্ঘ সময়ের যানজটে পড়তে বাধ্য। আর রাজধানীর ভেতরের যানজটের কথা তো বলাই বাহুল্য। পরিস্থিতি থেকে স্পষ্ট যে, আমাদের সড়ক ব্যবস্থা একবিংশ শতাব্দীর উন্নয়নকামী একটি দেশের সড়ক ব্যবস্থা নয়। এমন যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ে পশ্চাৎগতি ছাড়া অগ্রগতি সম্ভব নয়। তাই সড়ক সংস্কারে দ্রুত মনোযোগ দরকার। দ্রুত বড় আকারের পরিকল্পনা হাতে নিয়ে দেশের সড়কপথের সংস্কার ও নির্মাণ কাজ শেষ করা দরকার। দেশের উন্নয়নের জন্য নতুন পথ ও নতুন সেতু আমাদের আরও দরকার। কিন্তু বিদ্যমান পথগুলো ব্যবহারের অনুপযুক্ত হলে তার চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে? ফলে আমরা মনে করি, সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো দ্রুত নিরাপদ, সাবলীল ও দ্রুততম সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য তৎপর হবে।

নিম্নমানের নির্মাণ কাজের দায় কার?

রিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার নুরুল্লাগঞ্জ ইউনিয়নের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা খোলা আকাশের নিচে পাঠগ্রহণ করছে, এমন সচিত্র খবর প্রকাশিত হয়েছে শনিবার সমকালে 'খোলা আকাশের নিচে ক্লাস' শিরোনামে। রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে খোলা আকাশের নিচে পাঠদান করা হয় এবং এ শিক্ষা পদ্ধতি বিশ্বে আদর্শ হিসেবে স্থান করে নিয়েছে।

আমাদের দেশের অনেক শিক্ষার্থীও এ আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেছেন এবং তারাও একে অনুকরণীয় বলে অভিহিত করে থাকেন। তবে শান্তিনিকেতনে পাঠদানের সময় শিক্ষার্থীরা ঠিক খোলা আকাশের নিচে নয়, বসে পড়ে গাছতলায়। ভাঙ্গার ধর্মদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে শান্তিনিকেতনের মিল ঠিক এখানেই। এখানেও শিক্ষার্থীদের মাথার ওপর গাছের পাতার ছায়া রয়েছে। তবে এ মিলের কারণ প্রকৃতির সানি্নধ্যে থেকে পড়াশোনা কিংবা রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা পদ্ধতি অনুসরণে আগ্রহ নয়। ১৯৯৪ সালে এলজিইডির তত্ত্বাবধানে বিদ্যালয়ের জন্য একটি একতলা ভবন নির্মাণ করা হয়েছিল। দেড় দশক অতিক্রম করতে করতেই ভবনটি প্রায় অকেজো হতে বসেছে। বছর তিনেক আগে দেয়াল ও ছাদে নানা ধরনের নির্মাণ ত্রুটি ধরা পড়ে এবং অবস্থা এমনই যে, এটি আর ব্যবহার করা যাবে বলে মনে হয় না। সময়মতো মেরামত কাজ সম্পন্ন হলে হয়তো কিছুদিন ব্যবহার করা যেত। কিন্তু এখন যা অবস্থা তাতে ভবন-ধসের আশঙ্কা করা হচ্ছে। আর এ কারণেই শিক্ষার্থীরা গাছের নিচে ক্লাস নিতে বাধ্য হচ্ছে। তারা কখনও কখনও রোদে ঘর্মাক্ত হয়, বৃষ্টিতে ভিজে যায়। এতে তাদের পাঠগ্রহণের প্রতি অসীম আগ্রহ প্রমাণিত হয়। শিক্ষকদের ধৈর্যও প্রশংসা পেতে পারে। কিন্তু তাতে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের অপরাধ স্খলন হয় না। সরকারের সংশ্লিষ্ট যে বিভাগটি কাজ শেষে যাবতীয় পাওনা পরিশোধ করে ভবনটি বুঝে নিয়েছে তাদের দায়ও কম নয়। প্রকৃতপক্ষে দেশের নানা স্থানে এ ধরনের নিম্নমানের কাজের অভিযোগ রয়েছে। সব এলাকার খবর সংবাদপত্রে আসে না। যখন কোথাও দুর্ঘটনা ঘটে তখনই কেবল বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। এ অনিয়ম বন্ধ করার কোনো উপায়ই কি সরকারের জানা নেই?

ব্রিটেনের 'ভিসা কলেজ' by আসিফ আহমদ

ব্রিটেনে উচ্চশিক্ষার জন্য গিয়ে হাজার হাজার বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রী এখন বিপদে। তারা একেক জন কেবল কলেজে ভর্তির সময় জমা দিয়েছেন ৫ হাজার পাউন্ড। বাংলাদেশের মুদ্রায় যা ৬ লাখ টাকারও বেশি। এর সঙ্গে রয়েছে যাওয়ার খরচসহ আরও বিপুল অর্থ ব্যয়। এখন তাদের মাথায় হাত। এসব ছাত্রছাত্রী যদি দুই মাসের মধ্যে নতুন কোনো কলেজে ভর্তি হতে না পারেন, তাহলে সে দেশ ছাড়তে হবে। কেউ কেউ কি লুকিয়ে সেখানে থেকে যাবেন? এর অর্থ হচ্ছে চিরজীবনের জন্য অবৈধ হয়ে পড়ার শঙ্কা।

বিভিন্ন হিসাবে বলা হচ্ছে, উচ্চশিক্ষার জন্য প্রায় ২৫ হাজার বাংলাদেশি ব্রিটেনে পড়তে গেছেন। তাদের প্রত্যেকে যদি ৬ লাখ টাকা করে কলেজে ফিস হিসেবে জমা দিয়ে থাকেন তাহলে ২৫ হাজারের জন্য জমা পড়েছে অন্তত ১৫০ কোটি টাকা। প্রায় সমপরিমাণ অর্থ তাদের ব্যয় করতে হয়েছে ভিসা ফি, টিকিট ও দালালদের পেছনে।
ব্রিটিশ সরকার তাদের যাওয়ার জন্য ভিসা দিয়েছে এবং এ কারণে তারা সেখানে বৈধভাবেই গেছেন। এখন নিয়মে যথেষ্ট কড়াকড়ি আনা হয়েছে এবং এ কারণেই যত বিপত্তি। ব্রিটেনে পড়াশোনার জন্য যাওয়া বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য খণ্ডকালীন চাকরির সুযোগ ছিল। এ কারণে অনেক ছাত্রছাত্রী সেখানে চলে যাওয়ায় আগ্রহবোধ করত। তারা আয় করে নিজের পড়াশোনা চালাতেন এবং একই সঙ্গে পরিবারেও কিছু অর্থ পাঠাতে পারতেন। কিন্তু এখন ব্রিটিশ সরকার নতুন নিয়ম করেছে_ বেসরকারি কলেজগুলোতে ছাত্র ভিসায় যারা আসবেন, তারা কাজ করতে পারবেন না। এর পাশাপাশি আর্থিক সচ্ছলতা প্রদর্শনের নিয়মকানুনও কঠোর করা হয়েছে। আরও একটি পরীক্ষায় তাদের পড়তে হচ্ছে_ ইংরেজি ভাষার ওপর দক্ষতা। অনেকেই হয়তো এতে উৎরে যেতে পারবেন, কিন্তু আটকা পড়ে যেতে পারেন অন্যান্য পরীক্ষায়।
বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রীরা সেখানে পড়তে পেরেছেন ব্রিটিশ সরকারের নিয়মের কারণেই। এ সুযোগে বেশকিছু কলেজও গড়ে উঠেছিল। এর কয়েকটিতে রীতিমতো বাংলাদেশের কলেজের মতোই পরিবেশ। ধরে নেওয়া যায়, বাংলাদেশ ও ব্রিটেনের একটি চক্র এ ধরনের ভর্তির সুযোগ কাজে লাগিয়ে সেখানে প্রচুর ছাত্রছাত্রীকে নিয়েছে। এমন অনেক কলেজের কথাও শোনা যায়, যেখানে শিক্ষার অবকাঠামো দুর্বল। লাইব্রেরি, ক্লাসরুম সুবিধার বালাই নেই। এমনকি প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষকও নেই। বাংলাদেশে আমরা এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের বাড়বাড়ন্ত দেখি। তাই বলে ব্রিটেনেও? যেসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মান নিয়ে মাথা ঘামানোর কেউ নেই, সেগুলো কী ভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারল? এখন দুর্দিনে তাদের পাশে কে দাঁড়াবে?
কেউ কেউ এসব কলেজের নাম দিয়েছে 'ভিসা কলেজ'। এর সঙ্গে জড়িত চক্র পড়াশোনার নামে কিছু লোককে ব্রিটেনে নিয়ে আসার ব্যবসায়ে জড়িত হয়ে পড়েছে। আগে ছাত্ররা এক কলেজ ছেড়ে অন্য কলেজে ভর্তি হতে পারত। এখন নিয়ম করা হয়েছে, নতুন কলেজে ভর্তি হওয়ার আগে ব্রিটিশ ইমিগ্রেশন দফতরের অনুমতি নিতে হবে। আর এ কাজ খুব কঠিন হবে বলে মনে করা হচ্ছে। এভাবে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীর শুধু শিক্ষা জীবন নয়, ভবিষ্যৎও অন্ধকারময়। তারা নতুন কলেজে ভর্তি হওয়ার অনুমতি পেলেও নতুন করে অর্থ জমা দিতে হবে। কারণ যেসব কলেজ বন্ধ হয়ে গেছে তারা ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে নেওয়া অর্থ ফেরত দিচ্ছে না। এর দায় কে নেবে?
বাংলাদেশের অনেক তরুণ উন্নত দেশগুলোতে কাজের স্বপ্নে বিভোর থাকে। এজন্য বিপুল অর্থ খরচেও দ্বিধা করে না। তারা মনে করে, আয় করতে পারলে সব খরচ উসুল করা যাবে। কিন্তু ব্রিটেনে এখন যে অবস্থা তাতে এটি সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।
বাংলাদেশ সরকার কি এ সমস্যা অবগত ছিল না? এখন কি তাদের কিছুই করার নেই?

জাতীয় ঐকমত্য জরুরি by তারেক শামসুর রেহমান

Monday, June 13, 2011

সংবিধান সংশোধন নিয়ে যেমন সুপারিশ করা হয়েছে, তার সঙ্গে সঙ্গেই সংবিধানে সংযোজন হবে না। বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে (মন্ত্রণালয়, ভেটিং, মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত, বিল আকারে সংসদে উত্থাপন, সংসদে বিতর্ক) এটি সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী হিসেবে গৃহীত হবে। সুতরাং আলাপ-আলোচনার যথেষ্ট সুযোগ আছে গত ৮ জুন জাতীয় সংসদে সংবিধান সংশোধনের জন্য ৫১ দফা সুপারিশ উপস্থাপন করা হয়েছে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর জন্য গঠিত বিশেষ কমিটি এ সুপারিশমালা প্রণয়ন করেছে।

ওই সুপারিশমালায় কী আছে, তা পাঠক ইতিমধ্যে জেনেও গেছেন। বিশেষ কমিটি গত ১০ মাসে ২৭টি বৈঠক করেছে। তথাকথিত সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের বক্তব্যও নিয়েছে। সাবেক প্রধান বিচারপতিদের কেউ কেউ বিশেষ কমিটির আমন্ত্রণে বক্তব্যও রেখেছেন; কিন্তু যেটা অবাক করার বিষয় তা হচ্ছে_ বিশেষ কমিটি কারও সুপারিশই আমলে নেয়নি। সুপারিশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপ, ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যাওয়া, বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকা ইত্যাদি যে বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, তাতে বিতর্কের মাত্রা আরও বাড়বে বলেই মনে হচ্ছে। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানে অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। মহাজোটের অন্যতম শরিক জাতীয় পার্টির নেতা এরশাদের শাসনামলে এটি পাস হয়েছিল। এরশাদ এখনও চাচ্ছেন রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের বিষয়টি সংবিধানে থাকুক। রাষ্ট্রধর্মের প্রশ্নে মহাজোটের শরিক বাম দলগুলোর প্রবল আপত্তি রয়েছে। এমনকি সেক্টর কমান্ডার্স ফেরামের সুপারিশও গ্রহণ করা হয়নি। ইতিমধ্যে অষ্টম সংশোধনীকে (১৯৮৭) চ্যালেঞ্জ করা একটি রিট পিটিশন (২৩ বছর আগে করা) পুনরুজ্জীবিত করে হাইকোর্ট সরকারের ওপর একটি কারণ দর্শাও নোটিশ জারি করেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীর একটি বক্তব্যের প্রতিবাদে বিএনপি তথা চারদলীয় জোট গত ৫ জুন সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতালও পালন করেছে।
উত্থাপিত সুপারিশমালা, বিরোধী দলের তাতে অংশগ্রহণ না থাকা, সর্বোপরি ২৩ বছর আগে করা একটি মামলা পুনরুজ্জীবিত করে হাইকোর্টের কারণ দর্শাও নোটিশ প্রদান_ সব মিলিয়ে একটি জটিল পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে দেশটি। দুঃখজনক হলেও সত্য, সংবিধান সংশোধনের মতো একটি জাতীয় ইস্যুতে কোনো ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হলো না। এখন সরকার যদি এককভাবে সুপারিশগুলো পাস করিয়ে নেয় তাহলে এর পরিণতির জন্য সরকারই এক সময় অভিযুক্ত হবে। বিশেষ কমিটি অনেক বিষয়ে সুপারিশ করেছে, তার ধরন রাজনৈতিক। রাজনৈতিকভাবে এর সমাধান হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল; কিন্তু যে বিভক্তি বাংলাদেশের রাজনীতিকে কুরে কুরে খাচ্ছে, তারই প্রতিফলন ঘটল সংবিধান সংশোধনীতে। সংবিধান সংশোধনীকে কেন্দ্র করে বেশকিছু প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে, যার জবাব খোঁজা অত্যন্ত জরুরি। এক. তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের প্রস্তাব করা হয়েছে। যুক্তি হচ্ছে, উচ্চ আদালতের একটি রায়। কিন্তু রায়ে একথাটিও বলা হয়েছিল যে, আরও দুটি টার্ম তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। সুপারিশে এটি নেই। তাই সঙ্গত কারণেই সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। সরকার ক্ষমতা ধরে রাখতে চায়_ এ অভিযেগে কাটিয়ে ওঠা এখন কঠিন হবে। সংবিধানে মাত্র দুই টার্মের জন্য এ ব্যবস্থা থাকবে, এ ধরনের বিধান রাখা যায় না। এমনকি মূল সংবিধানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা যেভাবে আছে, সেটাও রাখা যাবে না। কেননা তাতে করে সংবিধানে ৫৮গ(৩) ধারা মতে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হওয়ার কথা, যাতে বিএনপির রয়েছে প্রবল আপত্তি। তাই সংবিধানে নয়, বরং সংসদ একটি সিদ্ধান্ত নিতে পারে, দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন একটি দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হবে। এই 'দলনিরপেক্ষ'-এর ব্যাখ্যাও সংসদকে দিতে হবে। সংসদ একটি 'এলডার্স কাউন্সিলের' প্রস্তাব করতে পারে, যেখানে চারজনের একটি টিম (দু'জন আওয়ামী লীগের, দু'জন বিএনপির মনোনীত নিরপেক্ষ ব্যক্তি) নির্বাচন পরিচালনা করবেন। এখানে কেউ এককভাবে 'প্রধান উপদেষ্টার' দায়িত্ব পালন করবেন না। বিকল্প হিসেবে তিনজন 'সিনিয়র সিটিজেন (একজন প্রবীণ প্রধান বিচারপতি, একজন শিক্ষাবিদ, একজন সুশীল অথবা ব্যবসায়িক সমাজের প্রতিনিধি) নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বটি পালন করতে পারেন। সংসদ যদি এ ধরনের একটি ফর্মুলা উপস্থাপন করে তাহলে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষমতা ধরে রাখার যে অভিযোগ, সেই অভিযোগে থেকে সরকার নিষ্কৃতি পাবে। তখন সরকারের বিরুদ্ধে বলার কিছু থাকবে না। দুই. প্রধানমন্ত্রী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিকল্প হিসেবে নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী করার কথা বলেছেন। এটাও গ্রহণযোগ্য হবে না। কেননা আগামী মাসেই সিইসি ও নির্বাচন কমিশনারদের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। সরকারকে এ পদে নতুনদের নিয়োগ দিতে হবে। এখন সরকার যাদেরই নিয়োগ দিক, তাদের নিয়ে বিতর্ক উঠবে। তাদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা খুঁজে বের করা হবে। আর এটা তো ঠিক সামরিক-বেসামরিক আমলারা তাদের অবসরের আগেই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে একটা সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং তার দল ক্ষমতায় গেলেই তারা সরকারের একটা 'পদ' বাগিয়ে নেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এমন পর্যায়ে গিয়ে উন্নীত হয়েছে যে, এখানে 'নিরপেক্ষ' ব্যক্তি এখন খুঁজে পাওয়া ভার। 'প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী' হিসেবে যে তত্ত্বই হাজির করা হোক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে সচিবালয়ের আমলারা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে গেছেন। কেউ এখন বিএনপির আমলা, কেউ আওয়ামী লীগের। সুতরাং সরকার এখন যাদেরই এ পদে নিয়োগ দেবে, তাদের নিয়ে বিতর্ক হবে। নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের সময় একটি বড় ভূমিকা পালন করে। তাদের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা জরুরি। সুতরাং এ ধরনের সাংবিধানিক পদে নিযুক্তি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মতো একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করা যায়। প্রয়োজনে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কর্মপরিধির মধ্যেও এ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা যায়। তিন. বিশেষ কমিটি যখন রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রাখার পক্ষে অভিমত দিয়েছে ঠিক তখনই অষ্টম সংশোধনী, অর্থাৎ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম কেন সংবিধান পরিচালিত নয়, সে ব্যাপারে হাইকোর্ট একটি কারণ দর্শাও নোটিশ জারি করেছেন। এখন হাইকোর্ট যদি একটি রায় দেন তাহলে তা সংসদ সদস্যদের একটি বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে ঠেলে দিতে পারে। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সংসদ সদস্যরা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। তাতে করে হাইকোর্ট অবমাননার প্রশ্ন উঠতে পারে। উপরন্তু সুপারিশমালায় রয়েছে ১৯৭২ সালের সংবিধানের চার মূলনীতিতে ফিরে যাওয়া, যেখানে বলা হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা। এ ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম পরস্পরবিরোধী। এমনকি সংবিধানের ২৫(২) ধারায় যেখানে বলা হয়েছে, 'রাষ্ট্র ইসলামী সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক সংহত, সংরক্ষণ এবং জোরদার করিতে সচেষ্ট হইবেন'_ সংবিধানের এ অংশটুকু নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। পঞ্চম সংশোধনীতে সংবিধানে এটি সংযোজন করা হয়েছিল। ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে এ অংশটুকু ছিল না। বিশেষ কমিটি অবিশ্যিই এ ব্যাপারে কোনো সুপারিশ করেনি। পঞ্চম সংশোধনী এখন উচ্চ আদালত কর্তৃক বাতিল হয়ে যাওয়ায় যে কেউ এখন সংবিধানের ২৫(২) ধারা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন। চার. সুপারিশে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে 'বাঙালি' এবং নাগরিক হিসেবে 'বাংলাদেশী' হিসেবে পরিচিত হবেন। এটা কি নতুন করে আবারও বিতর্ক সৃষ্টি করবে না? তবে একটি ভালো দিক হচ্ছে, প্রস্তাবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে নৃ-গোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, কোনো আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। বাংলাদেশে কোনো আদিবাস নেই। পাঁচ. খসড়ায় অসাংবিধানিক পন্থায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের মতো কাজকে রাষ্ট্রদ্রোহ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এটি নিয়ে কারোরই আপত্তি থাকার কথা নয়। তবে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, কেন অসাংবিধানিক শক্তি ক্ষমতা দখলে উৎসাহিত হয়, সে ব্যাপারে নজর দেওয়া প্রয়োজন। রাজনৈতিক দলগুলো এ ব্যাপারে তাদের দায় এড়াতে পারে না। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব, অসহযোগিতা, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অকার্যকর করা, সংসদ একদলীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়া ইত্যাদি কারণেই অসাংবিধানিক শক্তিগুলো শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ছয়. নির্বাচন কমিশনে চারজন কমিশনার (দু'জনের পরিবর্তে) নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ প্রস্তাবের কোনো গুরুত্ব নেই। মূল প্রশ্ন হচ্ছে, নিরপেক্ষ ও যোগ্য লোকদের নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনতে হবে। সরকার তার 'পছন্দের' লোকদের নিয়োগ দেয়। ফলে বিতর্ক বাড়ে। সুপ্রিম জডিশিয়াল কাউন্সিলের কথা বলা হয়েছে, যেখানে বিচারপতিদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো নিষ্পত্তি হবে। এটি একটি ভালো প্রস্তাব। সাত. সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন ৪৫ থেকে বাড়িয়ে ৫০ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন হবে না। বরং নারীদের মূল ধারায় নিয়ে আসতে হবে এবং সরাসরি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ দিতে হবে। সংরক্ষিত আসন তুলে দিয়ে এক-পঞ্চমাংশ কিংবা এক-ষষ্ঠাংশ আসনে মহিলাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়টি বাধ্যতামূলক করতে হবে।
সংবিধান সংশোধন নিয়ে যেমন সুপারিশ করা হয়েছে, তার সঙ্গে সঙ্গেই সংবিধানে সংযোজন হবে না। বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে (মন্ত্রণালয়, ভেটিং, মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত, বিল আকারে সংসদে উত্থাপন, সংসদে বিতর্ক) এটি সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী হিসেবে গৃহীত হবে। সুতরাং আলাপ-আলোচনার যথেষ্ট সুযোগ আছে। বিএনপির মতামত থাকা প্রয়োজন। কেননা বিএনপি তথা চার দল প্রায় ৩৭ ভাগ ভোটারের প্রতিনিধিত্ব করে। স্পিকার নিজে উদ্যোগী হয়ে বিএনপির মতামত নিতে পারেন এবং তা সুপারিশে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন। সংবিধান সংশোধন নিয়ে একটি জাতীয় ঐকমত্য থাকা প্রয়োজন।

সংস্কৃতির জয়যাত্রা ও কিছু প্রস্তাবনা by মিলন কান্তি দে

যাত্রা শিল্পে পৃষ্ঠপোষকতা সরকারের আরেকটি সময়োচিত উদ্যোগ। এর ফলে অবহেলিত এই শিল্পটি ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি পেয়েছে। আমাদের নাগরিক সমাজ অন্তত কিছুদিন হলেও নিয়মিত যাত্রা দেখতে পেরেছে। সরকারি অর্থায়নে দুটি বিভাগীয় শহরে দুটি যাত্রা উৎসব করা সম্ভব হয়েছে রাজনীতির কোলাহল যতই থাক, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, সংবিধান সংশোধন এবং আদালতের রায় নিয়ে যতই বিতর্ক চলুক, অন্যদিকে দেশে এখন সুবাতাস বইছে। সেটি হচ্ছে আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গন। নাটক, সঙ্গীত, নৃত্য, আবৃত্তি, জাদু, সার্কাস ও যাত্রাপালার ঐকতান বাদনে সরব মাঠ ঘাট প্রান্তর। বলতে গেলে রাজধানী ঢাকাসহ দেশজুড়ে চলছে সংস্কৃতির মহোৎসব।

এই যে শুদ্ধ সংস্কৃতি চর্চার একটি আবহ বিরাজ করছে এবং এর পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে সরকার, এ সম্পর্কে পত্র-পত্রিকায় তেমন ব্যাপক প্রচারণা নেই। ফলে বৃহৎ জনগোষ্ঠী বিশদভাবে জানতে পারছে না সংস্কৃতি ক্ষেত্রে বর্তমান মহাজোট সরকারের মহতী উদ্যোগের কথা।
২০১০-১১ অর্থবছরে সরকারের অনুন্নয়ন বাজেটের আওতায় সংস্কৃতির বিভিন্ন মাধ্যমের পৃষ্ঠপোষকতা ও মানোন্নয়নে একটি প্রকল্প চালু করে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। এই প্রকল্প থেকে অনুষ্ঠানের ধরন ও গুরুত্ব অনুযায়ী অর্থ বরাদ্দ পেয়েছে নাটক, সঙ্গীত, আবৃত্তি, নৃত্য, জাদু ও যাত্রা শিল্পের সংগঠনগুলো। গত মার্চ মাস থেকে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। শেষ হওয়ার মেয়াদ ১৫ জুনের মধ্যে। আমাদের কয়েকজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এবং শিল্পকলা একাডেমীর সুপারিশক্রমেই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় প্রকল্পটি অনুমোদন করে।
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং দারিদ্র্য বিমোচনে সমাজ-সংস্কৃতির উন্নয়ন অপরিহার্য। অতীতের সংস্কৃতিবিমুখ সরকারগুলো বিষয়টি গভীরভাবে উপলব্ধি করেনি। পাকিস্তান আমলে যে স্বৈরাচার শাসকরা রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করেছিল, তাদেরই প্রেতাত্মা ঢুকে পড়ে বাংলাদেশে কোনো কোনো সরকারের মগজে। বাঙালি সংস্কৃতিকে চিরতরে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র করেছিল তারা। এই প্রেক্ষাপটে জাতীয় বিভিন্ন সমস্যা মোকাবেলার মধ্যেও শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশ ও উন্নয়নে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া বর্তমান সরকারের একটি দৃষ্টান্তমূলক কাজ হয়ে রইল।
মূলত দেশ ও জাতির যথার্থ পরিচিতি, তার ইতিহাস, সংগ্রাম, ঐতিহ্য সবকিছুই প্রতিভাত হয়ে ওঠে সে দেশের সাংস্কৃতিক দর্পণে। শিল্পোন্নত দেশগুলোয় দেখা যায়, আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি তথা নাটক, সঙ্গীত, নৃত্যকলা চর্চায়ও সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে উজ্জ্বল উদাহরণ জাপানের 'কাবুকি' ও 'নো' থিয়েটার। শিল্প কারখানা, স্থাপত্যে অধিকতর সমৃদ্ধ এই দেশটি তার ঐতিহ্যকে ভুলে যায়নি। কাবুকি ও নো হচ্ছে সে দেশের এক ট্রাডিশনাল থিটোর আর্ট ফর্ম, যে থিয়েটারকে টিকিয়ে রাখতে জাপান সরকারকে পুঁজি খাটাতে হয় প্রতিবছর। শ্রদ্ধেয় নাট্য ব্যক্তিত্ব, এ দেশে অ্যাবসার্ড নাটকের পথিকৃৎ প্রয়াত সাঈদ আহমেদ একবার বলেছিলেন, এই দুই থিয়েটারের নান্দনিকতা এতটাই হৃদয়স্পর্শী যে, বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধান এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা জাপান সফরে এলে নো ও কাবুকি দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন।
এত কিছু বলার অর্থ এটাই যে, সংস্কৃতির বহু উপাদান ছড়িয়ে আছে আমাদের এই স্বদেশভূমিতে। উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে লোকসংস্কৃতির এক-একটি ধারা। কবিগান, হাফ-আখড়া, মনসামঙ্গল, রয়ানি, গম্ভীরা, পুতুলনাচ_ এসব কালেভদ্রে খুঁজে খুঁজে কোনো বার্ষিক অনুষ্ঠানের জন্য নাগরিক সমাজে নিয়ে আসা হয়। কাবুকি ও নো থিয়েটারের মতো বাঙালির পরিচয়বাহী এসব সাংস্কৃতিক শেকড়গুলোকে আমরা কি সমকালীন জীবনধারায় উপস্থাপন করতে পারি না? বর্তমান সংস্কৃতিবান্ধব সরকারই এটা পারে। সংস্কৃতির মানোন্নয়নে যে প্রকল্পটি চালু হয়েছে তার প্রথম মেয়াদ শেষ হচ্ছে এ মাসেই। আগামী অর্থবছরে শুরু হবে দ্বিতীয় মেয়াদের কর্মসূচি। ওই কর্মসূচিতে লোকসংস্কৃতির উলি্লখিত বিষয়গুলোর জন্য একটা নির্দিষ্ট অর্থ বরাদ্দের প্রস্তাব রাখছি।
শিল্পকলা একাডেমীতে আইটিআই বাংলাদেশ কেন্দ্রের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসবের পর এখন চলছে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের জাতীয় নাট্যোৎসব। ক'দিন আগে শেষ হলো পথনাট্যোৎসব। এসব উৎসবের উদ্দেশ্য শুধু নাটক মঞ্চায়নই নয়, অভিনয় ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে জনগণকে জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে তাই তো আমরা দেখি নাটকে এসেছে নতুন প্রাণ, নতুন দায়বোধ।
সংস্কৃতিক্ষেত্রে অর্থ বরাদ্দ সংস্কৃতিকর্মীদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার এক রকম স্বীকৃতি বলেই আমরা মনে করি। তবে এই প্রকল্পের আওতায় সংস্কৃতির প্রাতিষ্ঠানিক উন্নত রূপ দাঁড় করানো যায় এভাবে_ একটি নাট্য গবেষণাগার ও থিয়েটার ইনস্টিটিউট স্থাপন, প্রতিটি উপজেলায় সঙ্গীত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা, একটি জাতীয় আবৃত্তি একাডেমী প্রতিষ্ঠা।
যাত্রা শিল্পে পৃষ্ঠপোষকতা সরকারের আরেকটি সময়োচিত উদ্যোগ। এর ফলে অবহেলিত এই শিল্পটি ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি পেয়েছে। আমাদের নাগরিক সমাজ অন্তত কিছুদিন হলেও নিয়মিত যাত্রা দেখতে পেরেছে। সরকারি অর্থায়নে দুটি বিভাগীয় শহরে দুটি যাত্রা উৎসব করা সম্ভব হয়েছে বলেই একশ্রেণীর মানুষের মধ্যে যাত্রা সম্পর্কে যে গোঁড়ামি, যে উন্নাসিকতা ছিল, তা কিছুটা দূর হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, এই আয়োজনে দর্শক সুস্থ যাত্রামুখী হতে পেরেছে।
সবশেষে একটা কথা বলা প্রয়োজন, সৃষ্টিশীল ও উন্নয়নমূলক যে কোনো কাজ শুরু করাটাই যথেষ্ট নয়, সার্বিক সাফল্য ও গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য এর ধারাবাহিকতা থাকতে হবে। আগামী অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা হয়েছে। এর পরেই শুরু হবে শিল্পকলা একাডেমীর তত্ত্বাবধানে সংস্কৃতিবিষয়ক প্রকল্পের দ্বিতীয় মেয়াদের বরাদ্দ বণ্টন। আশা করি আমাদের উলি্লখিত প্রস্তাবগুলো বিবেচনায় আসবে।

দৃষ্টিনন্দন ফুরানোর ফুলরাজি by এমএ ফারুখ

জাপানের সর্ব উত্তরের দ্বীপ হোক্কাইডোর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত একটি চমৎকার শহরের নাম 'ফুরানো'। শহরের প্রায় ৭০ শতাংশ জুড়ে রয়েছে পাহাড়-পর্বত এবং বনাঞ্চল। তবে এই পাহাড়-পর্বতের গায়ে চাষ করেই ফুরানো কৃষিপ্রধান এলাকা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। সমগ্র জাপানে গাজরের চাহিদার সিংহভাগ উৎপাদিত হয় ফুরানো থেকে। চমৎকার আবহাওয়া, নৈসর্গিক শোভা, অপেক্ষাকৃত বড় দিনদৈর্ঘ্য এবং ঈষৎ ঠাণ্ডা রাত ফুরানোতে কৃষিকাজের জন্য যথোপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করেছে।

জাপানে বেড়াতে আসা পর্যটকদের কাছে ফুরানো একটি বিখ্যাত পর্যটনস্থল মূলত দুটি কারণে। এর একটি হলো ফুরানোর অতি সুপরিচিত ও সুপ্রসিদ্ধ 'ল্যাভেন্ডার ফিল্ড' এবং দ্বিতীয়টি হলো 'স্কি রিসোর্ট', যা প্রধাণত ইউরোপ, আমেরিকার পর্যটকদের কাছে সমধিক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ফুরানোর সবচেয়ে বড় ল্যাভেন্ডার ফিল্ডটি 'তমিতা ফার্ম' এর অংশ। তমিতা ফার্মটি হোক্কাইডোর সর্বাপেক্ষা প্রাচীন ফুলের ফার্ম। এটি মূলত একটি ল্যাভেন্ডার ফার্ম হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও এখন এখানে বৃহদাকারে চেরি, টিউলিপ, লুপিনসহ বহুবিধ ফুলের চাষ হয়। শত শত হেক্টর জায়গা নিয়ে গঠিত এই ফার্মের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থানটির নাম 'রেইনবো ফিল্ড', যেখানে বিভিন্ন বর্ণের ফুলের সারি খুব সন্তর্পণে পাহাড়ের গা বেয়ে এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত চলে গেছে। তমিতা ফার্মে একটি 'গ্রিনহাউস' রয়েছে, যেখানে সারাবছরই কিছু ফুলের চাষ করা হয় পর্যটকদের জন্য। ফার্মে ঢুকতে কোনো প্রবেশ ফি দিতে হয় না এবং যতক্ষণ ইচ্ছা সময় কাটানো যায়।
তমিতা ফার্মের কর্ণধার হলেন তাদাও তমিতা, যিনি ১৯৩২ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং প্রায় তিন পুরুষ ধরে হোক্কাইডোতে বসবাস করছেন। তাদাও তমিতা ২৫ বছর বয়স থেকে ফুরানোতে ল্যাভেন্ডারের চাষ শুরু করেন। সে সময় তমিতা ফার্মের এই প্রধান কর্তাব্যক্তিটির মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল ফুরানোর ঠাণ্ডা ও শুকনো আবহাওয়া কাজে লাগিয়ে ল্যাভেন্ডার থেকে সুগন্ধী দ্রব্য তৈরি করা। ষাটের দশকে জাপানের অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক উন্নতির প্রাক্কালে তাদাও তমিতার ল্যাভেন্ডার ফার্মের কলেবর বৃদ্ধি পেয়ে ৪০০ হেক্টরে উন্নীত হয়। কিন্তু এই দশকের শেষের দিকে জাপানের ক্রমবর্ধমান অতি আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় ভাটা পড়ে তমিতার ল্যাভেন্ডার ফার্মের অগ্রগতিতে। মানুষ ঝুঁকে পড়ে কৃত্রিম প্রসাধনীর দিকে। ফুরানো এলাকায় তমিতার কাজে ও সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে যারা ল্যাভেন্ডার চাষে আগ্রহী হয়েছিলেন, তারা প্রায় সবাই ল্যাভেন্ডার ফার্মের কাজ গুটিয়ে অন্য কাজে আত্মনিয়োগ করেন। কিন্তু হাল ছাড়েননি তাদাও তমিতা। তিনি মনেপ্রাণে জানতেন সুসময় একদিন আসবে, মানুষের কৃত্রিমতার ঝোঁক সাময়িক মাত্র। এর পরের কাহিনী বেশ চমকপ্রদ। তমিতার অর্থনৈতিক ও মানসিক খরার কোনো এক সকালে একজন সাংবাদিক অভ্যাসবশত ল্যাভেন্ডার ফার্মের কিছু ছবি তুলে নিয়ে যান। এই ছবিগুলোর একটি পরবর্তী বছরে জাপান রেলওয়ে জাতীয় ক্যালেন্ডারের জুন পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়। এরপর তমিতাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। এখন প্রতিবছর মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত অসংখ্য পর্যটকদের ভিড়ে মুখরিত থাকে তমিতার ল্যাভেন্ডার ফার্ম।
মে মাসের হালকা ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় যখন চারদিকে ঘেরা পাহাড় থেকে ঝিরিঝিরি বাতাস বইতে থাকে, যখন ছোট ছোট মেঘরাশি সেই পাহাড়ে আছড়ে পড়ে রৌদ্রস্নাত ধোঁয়ার আস্তরণ তৈরি করে, ঠিক সে সময়ে চারদিকের অবারিত, সি্নগ্ধ, অপার অসীম সুন্দর ফুলরাজির মাঝে নিজের দৃষ্টিকে তৃপ্ত করার মতো ভালো স্থান আর হতে পারে না। চেরি, টিউলিপ, লুপিন, পপি এবং জার্মানিকা'র দৃষ্টিনন্দন রঙ এবং চাপা মিষ্টি গন্ধ মনটাকে সি্নগ্ধ করে তোলে, মনে হয় এটি পৃথিবীর মাঝে একটি ছোট্ট স্বর্গ। এই ফার্মে ফুল চাষের ক্রমবিন্যাস ঠিক করা হয় ফোটা ফুলের রঙের কথাটি বিবেচনায় রেখে। সে জন্যই ফুল ফোটার পর তার রঙ বৈচিত্র্য ও বিন্যাস মানুষকে বিমোহিত করে। পর্যটকদের কাছে এখানে আসার সবচেয়ে আকর্ষণীয় সময়টি হলো জুলাই মাস। কারণ জুলাই মাসে মাঠে প্রায় ৯ ধরনের ফুল ফোটে; লাল টকটকে পপি, হলুদাভ ও হালকা লাল গোলাপ, হলুদ সরিষা, গাঢ় সবুজ ঝোপালো গাছে সাদা আলুর ফুল, পিংক রঙের জাপানিজ গোলাপ, পারপল ল্যাভেন্ডার, হলুদ ও কমলা গাঁদা, গাঢ় হলুদ সুর্যমূখী এবং লাল ও হলুদাভ রঙের মিশ্রণে স্কারলেট সেজ। মাঠের পর মাঠজুড়ে ছড়িয়ে থাকা এই ফুলগুলোর সারি তাদের রূপমাধুর্য দিয়ে দর্শকদের দৃষ্টি ও চিত্ত নন্দিত করে। ফুরানোর ফুলরাজির র্নিমাণশৈলী ও তার উপস্থাপন কৌশল যেন মানুষকে মুগ্ধ, বিমোহিত করে তার স্মৃতিপটে বহু দিনের জন্য জায়গা করে নেয়। নিষ্কলুষ ফুল মানুষকে শিক্ষা দেয় সি্নগ্ধ, নমনীয়, পবিত্র এবং উদার হতে।
সাপ্পোরো, হোক্কাইডো, জাপান

নৈরাজ্যের অচলায়তন by রাশেদ মেহেদী

রাজধানীতে বাস সংকটে পরিবহন মালিকদের, নেতাদের লাভ-ক্ষতি নেই। ক্ষতি হবে সরকারের এবং রাজধানীর এমপিদের। সামনের নির্বাচনে এই বাস সংকটের জন্যই হয়তো তাদের অনেক বড় মূল্য দিতে হবে। গণপরিবহন নিয়ে দুর্ভোগ সরকারের নীরব রক্তক্ষরণ। জরুরি ভিত্তিতে এই রক্তক্ষরণ বন্ধ হতে পারে মধ্যবর্তী দূরত্বের শত শত যাত্রীর জন্য বিআরটিসির সার্কুলার বাস চালু হলে।

রাজধানীর গণপরিবহনে বর্তমানে চলা চরম নৈরাজ্য বন্ধে এই মুহূর্তে এর বিকল্প আছে বলে মনে হয় না ভালো বাস আমদানির কথা উঠলেই এখনকার প্রভাবশালী পরিবহন নেতারা হায় হায় করে ওঠেন। কী বলেন! উন্নত, ভালো বাস নিয়ে আসতে গেলে বাসপ্রতি দেড়-দুই কোটি টাকা দাম পড়বে। সেক্ষেত্রে মতিঝিল-উত্তরার ভাড়া নিতে হবে দেড়শ' টাকা। এটা কি সম্ভব? পরিবহন নেতাদের এই যুক্তি আরও একটি বড় প্রতারণা। কারণ বড় বড় পরিবহন নেতারা ঢাকার রাস্তায় উন্নত বাস সার্ভিস চান না। এ কারণে কম দামের উন্নত বাস সার্ভিস হাতের কাছে থাকলেও তাদের চোখে পড়ে না। গণপরিবহনের জন্য এশিয়ার অধিকাংশ দেশসহ নিউজিল্যান্ড, ইউরোপের ফ্রান্স, চেক, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও আমদানি করা হয় জাপানের উন্নতমানের রিকন্ডিশন্ড গাড়ি। এই গাড়িগুলো জাপানের রাস্তায় দশ বছর চলার পরও কমপক্ষে ত্রিশ বছর চলার নিশ্চয়তা থাকে। আরামদায়ক, উন্নতমানের এই গাড়িগুলো এখনও সর্বোচ্চ দাম গড়ে ২৫-৩০ লাখ টাকায় পাওয়া সম্ভব। যদি ২৫ লাখ টাকা দিয়ে নিম্নমানের নতুন বাস কিনে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২৫ টাকা ভাড়া হয়, তাহলে জাপানের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত উন্নতমানের বাস ২৫ লাখ টাকায় আমদানি করলে সেই ২৫ টাকা ভাড়াতেই পোষাবে। চীনের নিম্নমানের নতুন বাসের যেখানে একশ' বছর সুস্থভাবে চলার নিশ্চয়তা নেই, সেখানে জাপানি রিকন্ডিশন্ড শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস ৩০ বছর পর্যন্ত চলার নিশ্চয়তা আছে। তাহলে এসব বাস গণপরিবহনের জন্য আমদানি করতে বাধা কোথায়? এক সময় কিন্তু ঢাকার রাস্তায় রিকন্ডিশন্ড উন্নতমানের গাড়ি চলত। নিরাপদ এবং রোড স্টার সার্ভিসের কথা অনেকেরই মনে আছে। ১৯৯৮ সালে ঢাকায় নেমেছিল প্রিমিয়াম বাস, ২০০০ সালে নিরাপদ এবং ২০০২ সালে রোড স্টার। এর পাশাপাশি বিআরটিসির ভলভো দোতলা বাস। মানুষ এসব বাসে অনেক নিরাপদে এবং স্বাচ্ছন্দ্যে চলতে পারত। এসব উন্নত বাস চলার সময় মূল সমস্যা দেখা দেয় তথাকথিত প্রভাবশালী শ্রমিক নেতাদের। নামে শ্রমিক নেতা হলেও তারা রীতিমতো বড় বড় মালিক। পুরনো গাড়ি দফায় দফায় ৮-১০ লাখ টাকার মধ্যে হাত বদল করে ভালোই চালাচ্ছেন তারা। এই নেতাদের মূল ব্যবসা অবশ্য চাঁদাবাজি। উন্নত বাসের মালিকরা চাঁদা দিতে চান না, আবার উন্নত বাস চলার কারণে লোকাল বাস, সিটিং বাস এবং অন্যান্য কাউন্টার সার্ভিসের বাসে যাত্রী পাওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা করতে হয়। ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়ানো সহজ হয় না। এই নেতাদের ইশারাতেই বিআরটিএ নিরাপদ পরিবহন ও প্রিমিয়াম সার্ভিসের রুট পারমিট নবায়ন করেনি।
রাজধানীতে ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য শুরু হয় কিন্তু এ বছরের জানুয়ারি মাসে। এ সময় গুলিস্তান-গাজীপুর রুটের মুড়ির টিন বলাকাসহ উত্তরা, মোহাম্মদপুর, মিরপুর রুটের সব ঝরঝরা লোকাল বাস সিটিং সার্ভিস হয়ে যায়। দশ টাকার নিচে ভাড়া নেওয়া হয় না তখন থেকেই। মুড়ির টিনের মতো এসব বাসে ত্রিশ আসনের জায়গায় বিয়ালি্লশ আসন বসিয়ে গরু-ছাগলের মতো যাত্রীদের বসানো হয়। তখন থেকেই রাস্তায় বাস সংকটেরও সৃষ্টি হয়। পত্রপত্রিকায় ছোটখাটো সংবাদ হয়েছে। বিষয়টি খুব বেশি গুরুত্ব দিয়ে কেউ দেখেনি। সমস্যাটা কোথায় হচ্ছে কর্তা-ব্যক্তিরা সেটা কোনোমতেই বুঝতে চাচ্ছেন না। গণহারে ডাইরেক্ট আর সিটিং হওয়ার কারণে বিপাকে পড়ছেন রাজধানীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে বাস করা মানুষ। যে যাত্রী ফার্মগেট থেকে শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া কিংবা মোহাম্মদপুর যাবেন কিংবা মহাখালী থেকে এমইএস, বিশ্বরোড, খিলক্ষেত কিংবা উত্তরা যাবেন, তারাই বিপদে পড়ছেন। তাদের জন্য এখন কোনো বাস নেই। মগবাজার থেকে মহাখালী যাওয়ার বাস কিংবা অন্য কোনো যানবাহন নেই। এসব জায়গার যাত্রীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকেন। তারপর অসংখ্য গাড়িতে উঠতে গিয়ে তথাকথিত সিটিং সার্ভিসের কন্ডাক্টর-হেলপারের গলাধাক্কা খান। সরকারের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে মন্ত্রীদের গালাগাল করেন। শেষ পর্যন্ত ৭ টাকার ভাড়া ১৫-২০ টাকা দিয়ে যেতে বাধ্য হন। কখনও কখনও মহাখালী থেকে বিশ্বরোড যেতে হচ্ছে ৩০ টাকাতেও। অথচ বাস সেই মুড়ির টিন। এই মধ্যবর্তী যাত্রীদের জন্য বিআরটিসি কি পারে না সার্কুলার বাস চালু করতে? কিছু বাস তো শাহবাগ থেকে ফার্মগেট হয়ে মিরপুর-১০ পর্যন্ত চলতেই পারে। কিংবা কিছু বাস তো মগবাজার থেকে মহাখালী হয়ে উত্তরা পর্যন্ত চলতেই পারে। এসব বাসে ৫ টাকা এবং ১০ টাকার দু'ধরনের টিকিট থাকবে। যেমন শাহবাগ থেকে ফার্মগেট ৫ টাকা, শাহবাগ থেকে মিরপুর-১০ পর্যন্ত ১০ টাকা। মগবাজার থেকে বনানী ৫ টাকা, উত্তরা পর্যন্ত ১০ টাকা_ এই ভাড়াতেই কিন্তু দিব্যি সার্কুলার বাস চলতে পারে অফিস সময় এবং বিকেলে অফিস ছুটির পর। না পোষালে আরও ৫ টাকা ভাড়া বেশি নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু মানুষকে অফিসে যাওয়ার সময় এবং ঘরে ফেরার সময় বাস পাওয়ার নিশ্চয়তা দিতে হবে। অথচ বিআরটিসির বাসও বেসরকারি পরিবহন মালিকদের মতো করেই চালানো হচ্ছে। যাত্রীদের দুর্ভোগ কমাতে যদি বিআরটিসির ভূমিকা না থাকে তাহলে সরকারি মালিকানাধীন এই পরিবহন সার্ভিসের গুরুত্ব কোথায়? ২০০৪ সালে কিন্তু ঢাকার বিআরটিসির বেশ কিছু এ ধরনের সার্কুলার বাস চালু হয়েছিল। দুই-তিন মাস চলার পর সেই বেসরকারি পরিবহন মালিকদের চাপেই এসব বাস বন্ধ করা হয়। কারণ তাদের কম দূরত্বে বেশি ভাড়া নেওয়ার কৌশল মার খায়। রাজধানীতে বাস সংকটে পরিবহন মালিকদের, নেতাদের লাভ-ক্ষতি নেই। ক্ষতি হবে সরকারের এবং রাজধানীর এমপিদের। সামনের নির্বাচনে এই বাস সংকটের জন্যই হয়তো তাদের অনেক বড় মূল্য দিতে হবে। গণপরিবহন নিয়ে দুর্ভোগ সরকারের নীরব রক্তক্ষরণ। জরুরি ভিত্তিতে এই রক্তক্ষরণ বন্ধ হতে পারে মধ্যবর্তী দূরত্বের শত শত যাত্রীর জন্য বিআরটিসির সার্কুলার বাস চালু হলে। রাজধানীর গণপরিবহনে বর্তমানে চলা চরম নৈরাজ্য বন্ধে এই মুহূর্তে এর বিকল্প আছে বলে মনে হয় না।
ঢাকার বাস সার্ভিসকে উন্নত করার জন্য বিআরটিসিকে কাজে লাগাতে পারে সরকার। ঢাকার প্রধান দশ-বারোটি রুটের পুরো দায়িত্ব বিআরটিসিকে দিলে কেমন হয়? এক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের পাশাপাশি পরিবহন নেতাদেরও বিআরটিসির পরিচালনা পর্ষদে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। বিআরটিসি দশ-বারোটি রুটে তিন ধরনের বাস সার্ভিস রাখবে। একটি হবে ডবল ডেকার লোকাল সার্ভিস স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য, একটি হবে মধ্যআয়ের মানুষের জন্য নন-এসি কাউন্টার সার্ভিস এবং আর একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সার্ভিস। নির্দিষ্ট মডেলের বাস নির্দিষ্ট রুটে চলবে। বেসরকারি মালিকরা বিআরটিসি অনুমোদিত মডেলের বাস কিনে বিআরটিসির মাধ্যমে চালাতে পারবেন। বিআরটিসি তাদের লাভ বুঝে দেবে। বেসরকারি কোনো কর্তৃপক্ষের পরিচালনায় কোনো বাস সার্ভিস প্রধান দশ-বারোটি রুটে চলবে না। বিআরটিসির চুরি বন্ধে একটি শক্তিশালী মনিটরিং টিম থাকবে, প্রয়োজনে গোপন টিম রাখা হোক। এর ফলে সরকার অনেক ঝামেলা থেকে বেঁচে যাবে। একই মডেলের বাস একটি কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে চলার কারণে যানজট কমবে। পরিবহনে শ্রমিক সংগঠন, মালিক সংগঠন এবং পুলিশ, বিআরটিএর চাঁদাবাজি বন্ধ হবে। যখন-তখন পরিবহন মালিকরা ভাড়া নৈরাজ্য সৃষ্টি করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে পারবে না। একই কর্তৃপক্ষের বাস হওয়ার কারণে বেপরোয়া বাস চালানো, রাস্তার মাঝখানে যাত্রী ওঠানামা বন্ধ হবে, ফলে দূর্ঘটনাও কমবে। সবচেয়ে বড় কথা, রাজধানীর সাধারণ মানুষ কম খরচে উন্নত বাসসেবা পাবে। সিএনজির দাম বাড়ানোর পর বাস ভাড়া নিয়ে বেসরকারি মালিকরা যে নৈরাজ্য এবং ভাড়ার নামে গণডাকাতির নজির স্থাপন করেছেন, তাতে আজ না হলেও অদূর ভবিষ্যতে প্রধান দশ-বারোটি রুটে সরকারের একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার বিকল্প থাকবে না।
 
Support : Dhumketo ধূমকেতু | NewsCtg.Com | KUTUBDIA @ কুতুবদিয়া | eBlog
Copyright © 2013. Edu2News - All Rights Reserved
Template Created by Nejam Kutubi Published by Darianagar Publications
Proudly powered by Dhumketo ধূমকেতু