Home » , , » কিডনি প্রতিস্থাপনে অপরাধের সুযোগ by তৌফিক মারুফ

কিডনি প্রতিস্থাপনে অপরাধের সুযোগ by তৌফিক মারুফ

Written By Unknown on Friday, September 9, 2011 | 1:34 PM

বাংলাদেশে কিডনি রোগের প্রকোপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কিডনি ও লিভার প্রতিস্থাপনের ব্যবসার নামে অপরাধে নেমেছে বিভিন্ন চক্র। বিশেষজ্ঞরা বলছেন সরকারের উপযুক্ত ব্যবস্থাপনার অভাব ও আইনের যথাযথ প্রয়োগে দুর্বলতার ফাঁক গলেই সহজ হয়ে উঠেছে এ অপরাধ। এই অশুভ প্রবণতা বন্ধে দেশে এখন মৃত্যুপথযাত্রীদের স্বেচ্ছায় কিডনি ও লিভার দান কার্যক্রম চালু করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ নেওয়ার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

কিডনি ফাউন্ডেশন সূত্র জানায়, বাংলাদেশে কিডনিজনিত রোগীর সংখ্যা এক কোটি ৮০ লাখ। প্রতিবছর প্রায় ২০ হাজার লোকের কিডনি অকেজো হয়ে যাচ্ছে। ১০ বছর আগে এর হার ছিল অর্ধেক। দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ তাদের প্রস্রাবে অ্যালবুমিন বা তার উচ্চ রক্তচাপ আছে কি না তা জানে না বলেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয় না। লক্ষণ দেখা দিলেই ছোটে চিকিৎসার জন্য। কিন্তু এরই মধ্যে আক্রান্তদের প্রায় ৭০ ভাগের কিডনি নষ্ট হয়ে যায়। তখন তাদের বেঁচে থাকার জন্য ডায়ালিসিস বা কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন করতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এ দুটোর ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, তাদের পরিসংখ্যান মতে বাংলাদেশের কিডনি রোগীদের ৪ শতাংশের ডায়ালিসিস করার সামর্থ্য আছে। দেশে বর্তমানে ৪২টি ডায়ালিসিস সেন্টার আছে। আর কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন বা কিডনি প্রতিস্থাপন সেন্টার আছে মাত্র আটটি। এসব সেন্টারজুড়ে একটি দালালচক্র অনেক আগে থেকেই তৎপর। নিরুপায় রোগীর স্বজনরা এসব দালালচক্রের খপ্পরে পড়ে একদিকে যেমন কিডনি হারায়, অন্যদিকে আর্থিকভাবে প্রতারিত হয়। এদিক বিবেচনায় ১৯৯৯ সালে দেশে কিডনি প্রতিস্থাপন আইন হয়। এ আইনে নিকটাত্মীয় ছাড়া কারো পক্ষে কাউকে কিডনি দান সম্ভব নয়। এ ছাড়া কিডনি বা মানুষের কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিক্রি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আর চাইলেই কিডনি বা লিভার দেওয়া যায় না। প্রতিস্থাপনের জন্য প্রয়োজন অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা। ফলে কিডনি প্রতিস্থাপন এ দেশে জটিল ও কঠিন। এসব প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দেশে ১৯৮৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৬৫০ মানুষের দেহে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এর বাইরে বিদেশে আরো ৩৫০ বাংলাদেশি রোগীর দেহে দেশীয় দাতাদের কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ও ইউরোলজি হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. জামানুল ইসলাম ভুঁইয়া গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, বিশ্বে এখন পর্যন্ত দুই প্রক্রিয়ায় কিডনি প্রতিস্থাপন হয়ে থাকে। একটি হচ্ছে ব্রেন ডেথ বা নিশ্চিত মৃত্যুর আগমুহূর্তে উপনীত কোনো ব্যক্তির এবং আরেকটি হচ্ছে জীবিত কোনো নিকটত্মীয়ের স্বেচ্ছায় দান করা কিডনি। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত কেবল জীবিত কোনো নিকটাত্মীয়ের কিডনি দানের আইনগত পদ্ধতিটিই চালু। তবে কোনো রোগীর দুটি কিডনি অকেজো হয়ে গেলে কিডনি প্রতিস্থাপনের আগে তাকে বিকল্প পন্থায় বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন হয় ডায়ালিসিসের। রোগীর উপসর্গের ইতিহাস, রক্তের ক্রিয়েটিনিন, ইউরিয়া, ইলেকট্রোলাইট পরীক্ষা ও সনোগ্রাম করে কিডনির অবস্থান ও আকার দেখা, জিএফআর অথবা সিআর ইত্যাদি পরীক্ষা করে কিডনি অকেজো কি না নির্ণয় করা হয়। কিডনি অকেজো জানার পরই ডায়ালিসিসের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আর একজন রোগীর সব দিক বিবেচনা করেই কিডনি প্রতিস্থাপনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়। যিঁনি কিডনি দেবেন তাঁর সঙ্গে রোগীর সম্পর্ক কী তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য আইনানুসারে হলফনামা ও স্থানীয় নির্ধারিত জনপ্রতিনিধির সনদ দেখা হয়। এ ছাড়া দাতার শরীরের অনেক কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করা হয়।
ডা. জামানুল ইসলাম ভুঁইয়া আরো জানান, আইন অনুসারে কিডনিদাতার বয়স অবশ্যই ১৮ বছরের ওপরে এবং ৬০ বছরের নিচে হতে হবে। আর ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, লিভার বা কিডনি রোগ থাকা চলবে না এবং দুটি কিডনিই সম্পূর্ণভাবে ভালো থাকতে হবে। কিডনিদাতাকে স্বেচ্ছায় কিডনিদান করতে হবে, জোর করা চলবে না।
ডা. জামানুল ইসলাম ভুঁইয়া জানান, রোগীর স্বজনরা নিকট কোনো আত্মীয়কে কিডনি দানের জন্য না পেলে কিংবা টিস্যু বা অন্য উপাদানগুলোর মিল না হলে রোগীকে বাঁচানোর জন্য চিকিৎসকের অগোচরেই অবৈধ পথে পা বাড়ান। এতে করেই তাঁরা দালালচক্রের খপ্পরে পড়েন। দালালদের সঙ্গে হয়তো কোনো হাসপাতাল বা ক্লিনিকের অসৎ চিকিৎসক বা অন্য কারো যোগসাজশ থাকলেও থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে ওই চক্র আত্মীয় নয় এমন কাউকে আত্মীয় পরিচয় দিয়ে নিয়ে আসে, এসব ক্ষেত্রে সনদ প্রদানকারী জনপ্রতিনিধিরাও দায়ী থাকেন।
ডা. জামানুল ইসলাম ভুঁইয়া বলেন, যেমন করে নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে একজন রোগীর প্রয়োজনীয় উপাদানে অমিল থাকে, তেমনি অনেক অনাত্মীয়ের সঙ্গেও যে কারো শরীরের প্রয়োজনীয় উপাদানগুলোর মিল থাকতে পারে। দালালচক্র রোগীর স্বজনদের সঙ্গে মিলে এমন ব্যক্তিকেই দাতা হিসেবে খুঁজে বের করে।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ও ইউরোলজি হাসপাতালের পরিচালক বলেন, বাংলাদেশে যদি ব্রেন ডেথ বা নিশ্চিত মৃত্যুর আগমুহূর্তে উপনীত কোনো ব্যক্তির কিডনি দানের প্রচলন চালু হয়, তখন এসব অপরাধ থেমে যাবে। এজন্য সামাজিক ও মানবিক সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে, যেমনটা হয়েছে রক্তদান বা চক্ষুদান কার্যক্রমের ক্ষেত্রে।
হাসপাতাল সূত্র মতে, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি কিডনি প্রতিস্থাপন হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে। এ হাসপাতালে ১৯৮৮ সাল থেকে জীবিত নিকটাত্মীয়ের কিডনি প্রতিস্থাপন কার্যক্রম চলে আসছে। ফলে কিডনি বিক্রির সঙ্গে জড়িত চক্রটি এ হাসপাতালেই বেশি সক্রিয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও এ দেশের সর্বোচ্চ এ হাসপাতালে এ চক্রের সদস্যদের খুঁজে বের করার জন্য মাঠে নেমেছে।
তবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল মজিদ ভুঁইয়া এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, এই হাসপাতালে এ পর্যন্ত এমন কোনো ঘটনা ঘটেছে বলে তাঁর জানা নেই। এখানে যতটা সম্ভব পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর তদন্ত করেই কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়।
কিডনি নিয়ে এ দেশে অবৈধ ব্যবসার কারণ সম্পর্কে কিডনি বিশেষজ্ঞরা বলেন, নিজেরা কিডনি দিলেও কিডনি প্রতিস্থাপনে সিঙ্গাপুরে ১২ থেকে ১৫ লাখ, থাইল্যান্ডে আট থেকে ১০ লাখ এবং ভারতে পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকা লাগে। ফলে দেশে সরকারিভাবে কিডনি প্রতিস্থাপন সহজলোভ্য হলে এই অপরাধ প্রবণতা কমে যাবে।
বাংলাদেশ কিডনি ফাউন্ডেশনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. হারুন অর রশিদ বলেন, বাংলাদেশে বড় সমস্যা হলো, যার টাকা আছে, তার ডোনার নেই। আবার যার ডোনার আছে, তার টাকা নেই। ডোনার যাও পাওয়া যায় তারা হচ্ছে, লিভিং ডোনার। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ব্রেন ডেথ ডোনার আছে। এতে ধর্মীয় কোনো বাধা নেই। বাংলাদেশে ব্রেন ডেথ কোনো ডোনার গড়ে তোলা গেলে অপরাধ কমে যাবে।
সভাপতি অধ্যাপক ডা. হারুন অর রশিদ বলেন, ১৯৯৯ সালে এ দেশে কিডনিসহ মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আইন চালু হয়। আইনটি অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং যথেষ্ট যৌক্তিক। অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে ব্যবসা বন্ধ করার জন্য এ আইনটি করা হয়েছিল। এ জন্য মানুষের সচেতনতা বাড়াতে হবে। এ ছাড়া ব্রেন ডেথের কাছ থেকে কিডনি নেওয়ার এখানে সমস্যা হলো, একেবারে ভৌত অবকাঠামো তৈরি হয়নি। এ জন্য দেশব্যাপী একটা নেটওয়ার্ক গড় তুলতে হবে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যার কিডনি লাগবে এবং যে কিডনি দিতে চায়, তাদের ডাটা এন্ট্রি করা থাকে। পরে মিলে গেলে তাদের খোঁজ দেওয়া হয়। এখানে এমন প্রক্রিয়া নেই। বাংলাদেশে যদি পর্যাপ্ত পরিবেশ এবং কিডনি দেওয়া যায়, তাহলে আমরা এ প্রক্রিয়া এখনই চালু করতে পারি। এ ছাড়া লিভার ও হার্ট ট্রান্সপ্লান্টও এ দেশে সহজ হয়ে উঠছে।
স্বাস্থ্যসচিব হুমায়ুন কবীর গতকাল কালের কণ্ঠকে জানান, সাম্প্রতিক সময়ে এই কিডনি বেচাকেনার খবরগুলো তাঁদের নজরে এসেছে। আগে এর ব্যাপকতা তাঁদের জানা ছিল না। ফলে সরকার এই প্রবণতা বন্ধ বা অপরাধী চক্রকে আইনের আওতায় আনতে খুব দ্রুত কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে বলে তিনি জানান।

0 comments:

Post a Comment

 
Support : Dhumketo ধূমকেতু | NewsCtg.Com | KUTUBDIA @ কুতুবদিয়া | eBlog
Copyright © 2013. Edu2News - All Rights Reserved
Template Created by Nejam Kutubi Published by Darianagar Publications
Proudly powered by Dhumketo ধূমকেতু